www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় – রাজকীয় শিক্ষা ব্যবস্থা

একটা রাজ পরিবারের গল্প বলি। অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক রাজার ছিল একটি মাত্র পুত্র। বৃদ্ধ রাজার মৃত্যুর পর তার উত্তরাধিকারী হিসেবে সিংহাসনে বসলেন তার সেই একমাত্র পুত্র। একে রাজার ছেলে তায় আবার সবেধন নীলমণি তাই সবরকম ভোগবিলাস আর আরাম আয়েশের মধ্যে দিয়ে সময় ঠিকই কেটে গেছে কিন্তু কষ্ট করে লেখাপড়াটা আর শেখা হয়ে উঠেনি। নতুন রাজা হিসেবে সিংহাসনে বসার পর তাই লেখাপড়া না জানার কারনে রাজ্য পরিচালনায় নানামুখী স্যমস্যা দেখা দিল। লোকজন আড়ালে আবডালে তাকে মূর্খ রাজা বলে ডাকতে শুরু করলো। এক কান দুই কান করে এই কথা রাজার কানেও এসে পৌছাল। তাই একদিন রাজা রাজ্যের সমস্ত শিক্ষিত পণ্ডিতদের ডেকে পাঠালেন। যথাসময়ে পণ্ডিতরা এসে পৌঁছালে রাজা তাদের বললেন,”আপনারা যে পদ্ধতিতে লেখাপড়া শিখেছেন তা অনেক সময় সাপেক্ষ ও কষ্টকর। এটা ফকির মিসকিনদের লেখাপড়ার পদ্ধতি। আমি রাজা আমার এত সময় নেই। তাই আপনারা এমন একটা রাজকীয় শিক্ষা ব্যবস্থা বের করুন যাতে খুব দ্রুত ও সহজে সমস্ত কিছু শিখে ফেলা যায়। আপনাদের সাতদিন সময় দেয়া হল।” ।
রাজার এই কথায় সেকেলে পণ্ডিতরা মহা সমস্যায় পড়ে গেলেন । তারা ভেবে ভেবে আকুল হলেন কিন্তু কোন পদ্ধতি বের করতে পারলেন না । সাতদিন পর তারা রাজ দরবারে এসে জানালেন “জাঁহাপনা, সব মানুষের জন্য লেখাপড়ার পদ্ধতি একই। সহজ কোন রাজকীয় পদ্ধতি নেই। লেখাপড়া শিখতে হলে এভাবে কষ্ট করেই শিখতে হবে”।
পণ্ডিতদের এই কথা শুনে মূর্খ রাজা গেলেন বেজায় চটে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন এই ব্যর্থতার শাস্তি হিসেবে তিনি সমস্ত পণ্ডিতদের মৃত্যুদণ্ড দিবেন। এতে আর একটা লাভও হবে দেশে কোন শিক্ষিত লোক না থাকলে লোকজন আর তাকে মূর্খও বলতে পারবে না ।

ঐ যুগের এনালগ পণ্ডিতরা আসলে আজকের ডিজিটাল পণ্ডিতদের মত এতটা স্মার্ট ও জ্ঞানপাপী ছিলেন না তাই তারা মূর্খ রাজার সমস্যার সমাধান দিতে না পেরে বিনা অপরাধে গুরুদণ্ড পেয়েছিলেন। বর্তমানে ছাত্র ছাত্রীদের সংখ্যাধিক্যের কারনে উচ্চ শিক্ষার ক্ষেত্রে সরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমুহে অপর্যাপ্ত আসন সংখ্যা ও শিক্ষার পরিবেশ ও অবকাঠামো সস্তার তিন অবস্থা হওয়ার সুযোগ নিয়ে আজকালকার কিছু ডিজিটাল জ্ঞানপাপী বের করে ফেলেছে সেই রাজকীয় শিক্ষা ব্যবস্থা। আর সেটা হল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। ভর্তি সংক্রান্ত কোন দুশ্চিন্তা নেই। খুব বেশী কষ্ট করার দরকার নাই। যা শুধু পরীক্ষায় আসবে সেরকম গুটিকয়েক নিদিষ্ট প্রশ্ন পড়ানো হয়। প্রায় সব ছাত্র ছাত্রীই নিদিষ্ট সময় শেষে ঐ সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়া তথাকথিত খুব ভাল CGPA নিয়ে পাস করে যাবে। শিক্ষা নামের এই প্রহসনের শর্ত একটাই তা হল তার অবিভাবকের থাকতে হবে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা দেবার ক্ষমতা । ইদানিং নাকি কোন কোন প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি থেকে পরীক্ষা ছাড়াই সার্টিফিকেটও পাওয়া যায় জায়গা ও সময়মত মালপানি দিতে পারলেই। আসলে বেশীরভাগ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যতটা না শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তার চেয়ে অনেক বেশী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এখন প্রশ্ন হল কারা পড়ছে এইসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমুহে। ছাত্র ছাত্রীদের সংখ্যাধিক্যের কারনে সবগুলো সরকারী চিকিৎসা, প্রকৌশল সহ বিশ্ববিদ্যালইয়ে ভর্তি অত্যন্ত প্রতিযোগিতা পূর্ণ। তাই শুধু সত্যিকার মেধাবী ছাত্র ছাত্রীরাই এগুলোতে পড়াশুনা করার সুযোগ পায়। মেধাবী মানেই তো পরিশ্রমী। টমাস আলভা এডিসন বলেছিলেন “মেধা বা প্রতিভার ৯৮ ভাগই হল পরিশ্রম আর বাকি দুই ভাগ হল ভাগ্য”। কিন্তু রাজা রাজরাদের আমল চলে গেলেও সেই আমলের রাজাদের বংশধররা তো রয়ে গেছেন। সেই সব মুকুট ও সিংহাসন বিহীন রাজাদের বংশধররা যারা পরিশ্রম করতে পারবেন না কিন্তু অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট চাই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অভিমুখী এই প্রজন্মকে আবার কয়েকটি উপ শ্রেনীতে ভাগে ভাগ করা যায় ।

১) উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান যাদের টাকা পয়সার আভাব নাই । কষ্ট করে পড়াশোনা করার অভিরুচি এদের নাই।এদের শুধু লোক জনকে বলার জন্য অর্থাৎ Ego Needs Fulfill করার জন্য সার্টিফিকেট চাই । এদের ভেতর যারা একটু বেশী সামর্থ্যবান বা নাক উচু তারা আবার নিজেদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষার জন্য দেশের বাইরেও পাঠিয়ে দিয়ে থাকেন ।

২) উচ্চবিত্ত ঘরের সন্তান যাদের নিজস্ব ব্যাবসা বা শিল্প প্রতিষ্ঠান আছে। এদেরও সময় নষ্ট ও কষ্ট করে পড়াশোনা করার অভিরুচি নাই । অর্থের বিনিময়ে শুধু সার্টিফিকেট চাই। কাজ এরা নিজেদের প্রতিষ্ঠানেই করবেন।

৩) উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান যাদের নিজস্ব ব্যাবসা বা শিল্প প্রতিষ্ঠান না থাকলেও ভাল কানেকশন আছে। সার্টিফিকেট চাই শুধু আনুষ্ঠানিকতা পুরনের জন্য ।

৪) মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান যারা উপরের তিন শ্রেনীর দেখাদেখি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াটাকে আভিজ্যাতের পরিচায়ক মনে করে জমি জমা, গহনা গাটি, ধান চাল, পান সুপারি, আলু পটল বিক্রি করে বা বাবার কষ্টের পেনশন বা পরিবারের সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয় কিন্তু ভুলটা বুঝতে পারে চাকরির বাজারে ঢোকার পর কিন্তু তখন আর কিছু করার থাকে না। এই শ্রেণীর বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অভিভাবকরা ততটা শিক্ষিত বা সচেতন নয় বলে তারা কিসে সন্তানের সত্যিকার ভাল হবে তা ভালভাবে বুঝতে না পেরেই নিজের সর্বস্ব দিয়ে দেয় সন্তানের কল্যাণ চিন্তা করে।

এবার আমার নিজের দেখা একটা ঘটনা বলি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া আমার পাশের ফ্ল্যাটের এক ছাত্রের কাছে তার এলাকার এক ছোট ভাই ফোন করেছে তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি সংক্রান্ত তথ্যের জন্য । সে খুব উচ্চস্বরে কথা বলছে ফলে আমার রুম থেকে পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে । সে জানতে চাচ্ছে “এই তোমার দুইটা সেকেন্ড ডিভিশন আছে তো নাহলে কিন্তু ভর্তি হওয়া কঠিন হয়ে যাবে”। যেখানে তৃতীয় শ্রেণীকে অনেক ক্ষেত্রেই ফেলের সমতুল্য ধরা হয় । ভাল কোন জায়গায় ভর্তি পরিক্ষাই দেয়া যায় না। সেখানে সে বলছে ভর্তি করা যাবে তবে একটু কঠিন হবে। মানে টাকা একটু বেশী লাগবে এই আর কি! চাকরির বাজারে ঢুকে এই শ্রেণীর ছাত্র ছাত্রীদের সার্টিফিকেট অনুসারে জ্ঞানের পরিসর প্রশস্ত না হওয়ায় প্রায়ই যেসব কথা শুনতে হয় একটি প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ কমিটির সদস্য হবার বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তার থেকে কয়েকটা উল্লেখ করছি “কত টাকা দিয়ে সার্টিফিকেট কিনছেন”? বা “এসব ডিগ্রী তো এখন গরু ছাগলেও নেয়” … ইত্যাদি ইত্যাদি । আমার পরিচিত এমনি একজন একবার দুঃখ করে বলছিল আগে তো বুঝিনি এখন বুঝতে পারছি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়ে জীবনটা নষ্ট করে ফেলেছি । তবে এক্ষেত্রে দুই একটা ব্যতিক্রম যে নেই তা নয় কিন্তু ব্যতিক্রম কখনো দৃষ্টান্ত নয়। আর এইসব শ্রেণীর কিছু কিছু মেয়ে সন্তানকেও অনেক সময় দেখা যায় স্টাইল বা বিয়ের বাজারে দাম বাড়ানোর জন্য গায়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সার্টিফিকেট লাগাতে।

এই চারটি শ্রেনীর সাথে বর্তমান প্রেক্ষাপটে যুক্ত হয়েছে আরও একটি শ্রেণী।
৫) এরা হল চাকরীজীবি শ্রেণী। কাজের চাপ, সময় কম তাই বিনা আয়েশে কিছু টাকা খরচ করে বাড়তি একটি সার্টিফিকেট নিয়ে এই তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে ক্যারিয়ারটা যদি আর একটু এগিয়ে নেয়া যায় এই আর কি!

আমার এক বন্ধু যুক্তি দেখিয়ে বলল “স্মার্টনেস, লাইফ স্টাইল, সোশ্যাল স্ট্যাটাস, ষ্ট্যাণ্ডার্ড অফ লিভিং সব কিছুতেই তো সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছাত্রীরা এগিয়ে আছে। আর তাদের অনেকেই তো ভাল ক্যারিয়ারও তৈরি করেছে । “এই বন্ধু আসলে এ যুক্তি দিয়ে এই লেখায় পূর্বে উল্লেখিত ঐ প্রথম তিনটি শ্রেণীকেই বোঝাতে চেয়েছেন যারা জন্মগত ভাবেই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছেন । আমি আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি যারা নিজেরা বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে কোন না কোন ভাবে জড়িত তাদের মধ্যে দুই একজন বুদ্ধিমান মানুষ বাদে প্রায় সবাই যুক্তিহীন ভাবে বা মনগড়া যুক্তি দিয়ে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অন্ধ সমর্থন দিয়ে যায়। এমন অনেকেও আছেন যারা এক সময় বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ঘোর বিরোধী ছিলেন কিন্তু বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হবার তাদের অবস্থান বদলে যেতে দেখেছি । আমার ছাত্র জীবনের দীর্ঘ একটা সময় আমার বিভিন্ন বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছাত্রীদের সাথে মেশার ও তাদের জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। এই অভিমত মুলত আমার সেই অভিজ্ঞতা ও দেশের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে লেখা। তবে আবারো বলছি এক্ষেত্রে দুই একটা ব্যতিক্রম যে নেই তা নয় কিন্তু ব্যতিক্রম কখনো দৃষ্টান্ত নয়। কারো সাথে আমার কোন বিরোধ নেই বা আমার এই লেখার উদ্দেশ্য ব্যাক্তিগত ভাবে কাউকে ছোট করা নয়। শিক্ষার নামে ব্যাঙয়ের ছাতার মত গজিয়ে উঠা বেশীর ভাগ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আজ যে ব্যবসা ও ভণ্ডামি চলছে তার প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরা । ব্যাবসায়িক স্বার্থে বেসরকারী শিক্ষা ব্যবস্থার নামে লেখাপড়ার মান নষ্ট করে দিয়ে যেভাবে সার্টিফিকেট সর্বস্ব আগামী প্রজন্ম গড়ার পাঁয়তারা চলছে তার প্রতিবাদ জানানো ।

প্রেক্ষাপটঃ বাংলাদেশ
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ১৪৭৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৪/০২/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • anish bhattacharjee ২৪/০২/২০১৫
    SOTTI KOTHA
  • ভানু ভাস্কর ১২/০২/২০১৫
    ভালো লাগলো। কিন্তু আমি ভাবছি, আমার এক কাজিন কেমন করে ম্যাথ-এ পাশ করে ফেললো! এটা অসম্ভব ঘটনা - মিরাকল। সে দেশের কথাকথিত সেরা বেসরকারি বিশ্বঃ তে পড়ে, থুক্কু সার্টিফিকেট কেনে।
    • হাসান ইমতি ১৪/০২/২০১৫
      ম্যাথ এ কোথা থেকে কি পাশ করেছে বুঝতে পারলাম না, আর দুই একটি ব্যাতিক্রম যে নেই তা কিন্তু নয়, আমার লেখাটি সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে, ভালোবাসা ।
  • আনন্দ রাজবংশী ১০/০২/২০১৫
    ভালোই লিখেছেন
  • অস্পষ্ট ছবি ০৭/০২/২০১৫
    ডিজিটাল বলে কথা!
  • জাহিদুর রহমান ০৬/০২/২০১৫
    Bisal lakhaaaa
    tobe valo laglo
    • হাসান ইমতি ০৭/০২/২০১৫
      ভালোবাসা ...
      • জাহিদুর রহমান ০৮/০২/২০১৫
        Apnakao
  • সুব্রত দাশ আপন ০৪/০২/২০১৫
    আপনার গল্পে বুড়াবুড়ির কথা ও পন্ডিতের অসাধারণ চালাকী, বোকাবী সহ বর্তমানের শিক্ষা ব্যবস্থার সব কিছুই উঠে উঠেছে।
  • সবুজ আহমেদ কক্স ০৪/০২/২০১৫
    দারুণ ভালো লাগলো ........................।।
 
Quantcast