জুলিয়া
১।
জানুয়ারি ২৫, ২১২১।
এক্সপ্রেসো কফির মন সতেজ করা ঘ্রাণে আধটুকু যা ঘুম রাফির শরীরে লেগে ছিল তাও খসে গেল। কুকিং রোবট জুলিয়া এসে খাবারের ট্রে ছোট্ট ডাইনিং টেবিলে রাখলো। এর মানে ঘড়িতে এখন সাড়ে সাতটা। মানুষের সময় জ্ঞান না থাকতে পারে, কিন্তু রোবটের সময় জ্ঞান টনটনে। জুলিয়ার যন্ত্র-জীবন ঘড়ির নিয়মে বাঁধা।
রাফি "নিম" ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির একজন এসিস্ট্যান্ট কেমিস্ট। তার অফিসটা কাছেই। ওয়াকিং ডিস্টেন্স। বাসা থেকে, ন'টা বাজার ৫/১০ মিনিট আগে বেরুলেই হয়।
সে বিছানা ছেড়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই সে খেতে বসলো। ডাইনিং টেবিলেটা ও শোবার ঘরেই রেখেছে।
শক্ত গ্লাসের গোল ডাইনিং টেবিলে পিরিচে ঢাকা কফি, অমলেট আর দুটো টোস্ট। এ আজ তার সকালের নাস্তা।
ওর এই ছোট্ট ডাইনিং টেবিল আসলে এক আশ্চর্য জিনিস। এটা কম্পিউটারাইজড। গোল শক্ত গ্লাসটা হচ্ছে ডিসপ্লে কাম রিমোট কন্ট্রোল। যা জুলিয়াকে কন্ট্রোল করে।
ঝটপট তৈরি করা যায় এরকম কুড়িটা আইটেম জুলিয়া রান্না করতে পারে। ওর পেট আসলে একটা স্লাইডিং ওভেন। সেখানে নানা আকৃতির পাঁচটি সেল। ভাজা, সিদ্ধ আর পোড়া এই তিন রকমের খাবার তৈরির জন্যে তিন রকম সেল। এছাড়া আছে আরও বিশেষ দুটো সেল।
যখন যা লাগে কিচেন থেকে নিয়ে ওভেনে ঢুকিয়ে রান্না করে। ডিসপ্লেতে সেট করা টাইম আর কমান্ড অনুযায়ী জুলিয়া একটিভেট হয়ে খাবার তৈরি করে ফেলে অটোমেটিক। একা ব্যাচেলর জীবনে, রাফির মতো মানুষের জন্যে জুলিয়া একটা আশির্বাদ।
অমলেট মুখে দিতেই বুঝলো লবণ বেশি হয়েছে, মুখে দেয়া যায় না। তবুও দুটো ডিম দিয়ে তৈরি এ খাদ্যবস্তু নষ্ট করতে তার মায়া লাগল। চোখ মুখ কুঁচকে খেয়ে নিল। কফিতে চুমুক দিতেই খিঁচড়ে গেল মেজাজটা। পাউডারের পরিমাণ ভয়াবহ। তিতকুটে ভাবটা জিভ আর মগজে ধাক্কার মতো লাগছে। রাফির ইচ্ছে করলো চেচিয়ে বলে - কফি কি সস্তা হয়ে গেছে? নাকি তোর বাপের টাকায় কেনা?
কিন্তু কাকে সে মেজাজ দেখাবে?
আধুনিক বিজ্ঞান, মন ভরে গালি-গালাজ করার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। মানুষের সাথে রাগ করার যে স্যাটিসফেকশন, যন্ত্র আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেললেও সে শান্তি পাওয়া যায় না। পাওয়া যেতো, যদি মানুষের উপর রাগ করে তা ভাঙ্গা হতো। মানুষ মানুষকে ছাড়া বাঁচতে পারে না, এর চেয়ে বড় সত্য হয়তো খুব একটা নেই। সবচেয়ে বড় অহংকারী ব্যক্তিও বড়াই করে বলতে পারবেনা, "মানুষের আমার দরকার নাই, আমি একা থাকতে পারবো।" কারণ এমন কিছু লোক তার দরকার যাদের কাছে সে তার অহংকার জাহির করবে।
রাফি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জুলিয়ার যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা যাচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে সে রুচি মত খাবার সার্ভ করতে পারছেনা। সেট করে দেয়া রেসিপি সে চেক করে দেখেছে। কোন ভুল নেই, ঠিকঠাক আছে। হয়তো কোন টেকনিক্যাল ফল্ট, একজন রোবট-মেকানিকের কাছে যাওয়া দরকার।
২।
দুপুরে লাঞ্চ খেতে বাসায় ফিরল রাফি। অফিস ক্যান্টিনের খাবার তার পছন্দ। কিন্তু এমন গলাকাটা দাম, খেতে আর ইচ্ছে করেনা। তাছাড়া অভিজ্ঞতা বলছে সব পছন্দ অপছন্দকে গুরুত্ব দিলে জীবনে নানা ধরনের জটিলতা দেখা যায়। রাফি নির্ঝঞ্ঝাট জীবনে অভ্যস্ত। বিয়ে-থা করেনি। বিয়ের অনুমতি পাওয়ার জন্যে ১০ টা ডায়মন্ড কার্ড ট্যাক্স দিতে হবে। সে মধ্যবিত্ত - সিলভার কার্ডের মানুষ। খুব হিসাব নিকাশ করে চললে, বছরে একটা, বড় জোর দুটো গোল্ডেন কার্ড জমে। কাজেই অকারণ খরচ তার অপছন্দ।
রাফি দেখলো কম্পিউটারাইজড ডাইনিং টেবিলে সাজানো আছে - ভাত, ডাল, আলুভাজি আর ভূনা মাছ। খাবার দেখে তো লোভনীয়ই মনে হচ্ছে। কেমন বানিয়েছে আল্লাহই জানে। মেকানিকের সাথে দেখা করার কথা ভুলেই গেছে সে। অবশ্য বিকেলেও দেখা করা যাবে। তাড়াহুড়ো করার তো কিছু নেই।
রাফি খুব তৃপ্তি সহকারে খেল। জুলিয়াকে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার। সে কিচেনে গিয়ে মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা জুলিয়াকে দেখল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের উপর ও খুব বিরক্ত হলো। জুলিয়া, মানুষকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলার একটা অস্ত্র! সে বুঝুক না বুঝুক তাকে ধন্যবাদ জানানোর কিছু নেই।
৩।
ফেব্রুয়ারি ১৪, ২১২১।
রাফি বিছানায় শুয়ে আছে। জুলিয়া ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেছে। নতুন কোন ভুল করেনি জুলিয়া। রাফিও রোবট-মেকানিকের কাছে আর যায়নি। কি দরকার! কম করে হলেও ৫টা সিলভার কার্ড চেয়ে বসবে সার্ভিস চার্জ হিসেবে। তাছাড়া হয়তো টেম্পোরারি এরর। নিজে নিজেই ঠিক হয়ে গেছে যখন, শুধু শুধু কার্ড খরচের কোন মানে নেই।
রাফির ইচ্ছে ছিল আরও কিছুক্ষণ বিছানায় অলসভাবে শুয়ে থাকার। কিন্তু খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে বলে তাকে উঠতে হলো। আজ অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ছুটির দিন।
গত আট বছর ধরে সারা বিশ্বের সব দেশেই ভ্যালেন্টাইন্স ডে বিশেষ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। সব দেশেই এটা ছুটির দিন। বাইরে বেরুলেই দেখা যায় সজ্জিত মানুষের ভীড়। ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড এর মতো বিষয় গুলোর জন্যেও এখন ভালবাসার মতো সুন্দর আর পবিত্র শব্দ ব্যবহার হচ্ছে।
রাফি ঘরকুনো মানুষ। পারতপক্ষে সে বাসার বাইরে যায়না। বাসা থেকে অফিস, অফিস থেকে বাসা, এই হচ্ছে তার পৃথিবী। তার মতো মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যন্ত্রের পৃথিবীতে তার মতো সিলভার কার্ডের মানুষের জগতটা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে।
পুরো ব্রেকফাস্ট দূরে থাক, অর্ধেক খাবার খেতে না খেতেই, তীব্র জ্বলুনি শুরু হলো রাফির বুকে। মনে হচ্ছে আগুন থেকে বের করে আনা গনগনে লাল কয়লা তার বুকে ঠেসে ধরেছে কেউ। কণ্ঠনালি জ্বলে যাচ্ছে সাথে পেটেও ভয়ানক যন্ত্রণা - যেন নাড়িভুড়ি সব পুড়ে যাচ্ছে।
বিছানায় চিত হয়ে ধপাস করে পড়ে যাওয়ার আগে এক মুহূর্তের জন্য একটা সন্দেহ মাথায় খেলে গেল - কারখানা থেকে নিয়ে আসা ক্যামিকেলের কোন একটা জার কি সে ভুল করে কিচেনে রেখে এসেছে? এবং যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে জুলিয়া হয়তো খাবারে মিশিয়ে দিয়েছে সেই ক্যামিকেল!
৪।
লাঞ্চের সময় হওয়ায় জুলিয়া এইমাত্র এক্টিভেট হলো। ঝটপট লাঞ্চ তৈরি করল। একটা ট্রে হাতে সে রাফির শোবার ঘরে ঢুকে কম্পিউটারাইজড ডাইনিং টেবিলে খাবার রাখল। পাশেই বিছানায় চিত হয়ে পড়ে আছে রাফির নিথর শরীর। সাদা ফেনায় ঠোঁট জোড়া আর মুখের কিছু অংশ ঢাকা পড়ে গেছে। চোখ দুটো বিস্ফোরিত, যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সেই চোখে যন্ত্র নির্ভর এ পৃথিবীর প্রতি তীব্র ঘৃণা।
জুলিয়া রাফির খাবার সাজিয়ে দিয়ে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে কিচেনের দিকে চলে গেল। কিচেনে মিটসেফের পাশে এসে দাঁড়ানো মাত্রই অটোমেটিক ডি-এক্টিভেট হয়ে গেল সে। সে এখন একটা ধাতব জঞ্জাল ছাড়া আর কিছুই নয়। অফ হোয়াইট রঙ করা দেয়ালের দিকে সে অপলক তাকিয়ে আছে। ওর চোখদুটো আসলে হাই-রেজুলেশন ক্যামেরা, ৫৭৬ মেগাপিক্সেল...
মানুষের চোখের মতো করে তৈরি করা হলেও, বস্তুত কাঁচের ওই দুটো চোখে কোন দুঃখ নেই, নেই কোন অনুশোচনা কিংবা ভয়!
জানুয়ারি ২৫, ২১২১।
এক্সপ্রেসো কফির মন সতেজ করা ঘ্রাণে আধটুকু যা ঘুম রাফির শরীরে লেগে ছিল তাও খসে গেল। কুকিং রোবট জুলিয়া এসে খাবারের ট্রে ছোট্ট ডাইনিং টেবিলে রাখলো। এর মানে ঘড়িতে এখন সাড়ে সাতটা। মানুষের সময় জ্ঞান না থাকতে পারে, কিন্তু রোবটের সময় জ্ঞান টনটনে। জুলিয়ার যন্ত্র-জীবন ঘড়ির নিয়মে বাঁধা।
রাফি "নিম" ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির একজন এসিস্ট্যান্ট কেমিস্ট। তার অফিসটা কাছেই। ওয়াকিং ডিস্টেন্স। বাসা থেকে, ন'টা বাজার ৫/১০ মিনিট আগে বেরুলেই হয়।
সে বিছানা ছেড়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েই সে খেতে বসলো। ডাইনিং টেবিলেটা ও শোবার ঘরেই রেখেছে।
শক্ত গ্লাসের গোল ডাইনিং টেবিলে পিরিচে ঢাকা কফি, অমলেট আর দুটো টোস্ট। এ আজ তার সকালের নাস্তা।
ওর এই ছোট্ট ডাইনিং টেবিল আসলে এক আশ্চর্য জিনিস। এটা কম্পিউটারাইজড। গোল শক্ত গ্লাসটা হচ্ছে ডিসপ্লে কাম রিমোট কন্ট্রোল। যা জুলিয়াকে কন্ট্রোল করে।
ঝটপট তৈরি করা যায় এরকম কুড়িটা আইটেম জুলিয়া রান্না করতে পারে। ওর পেট আসলে একটা স্লাইডিং ওভেন। সেখানে নানা আকৃতির পাঁচটি সেল। ভাজা, সিদ্ধ আর পোড়া এই তিন রকমের খাবার তৈরির জন্যে তিন রকম সেল। এছাড়া আছে আরও বিশেষ দুটো সেল।
যখন যা লাগে কিচেন থেকে নিয়ে ওভেনে ঢুকিয়ে রান্না করে। ডিসপ্লেতে সেট করা টাইম আর কমান্ড অনুযায়ী জুলিয়া একটিভেট হয়ে খাবার তৈরি করে ফেলে অটোমেটিক। একা ব্যাচেলর জীবনে, রাফির মতো মানুষের জন্যে জুলিয়া একটা আশির্বাদ।
অমলেট মুখে দিতেই বুঝলো লবণ বেশি হয়েছে, মুখে দেয়া যায় না। তবুও দুটো ডিম দিয়ে তৈরি এ খাদ্যবস্তু নষ্ট করতে তার মায়া লাগল। চোখ মুখ কুঁচকে খেয়ে নিল। কফিতে চুমুক দিতেই খিঁচড়ে গেল মেজাজটা। পাউডারের পরিমাণ ভয়াবহ। তিতকুটে ভাবটা জিভ আর মগজে ধাক্কার মতো লাগছে। রাফির ইচ্ছে করলো চেচিয়ে বলে - কফি কি সস্তা হয়ে গেছে? নাকি তোর বাপের টাকায় কেনা?
কিন্তু কাকে সে মেজাজ দেখাবে?
আধুনিক বিজ্ঞান, মন ভরে গালি-গালাজ করার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। মানুষের সাথে রাগ করার যে স্যাটিসফেকশন, যন্ত্র আছাড় দিয়ে ভেঙে ফেললেও সে শান্তি পাওয়া যায় না। পাওয়া যেতো, যদি মানুষের উপর রাগ করে তা ভাঙ্গা হতো। মানুষ মানুষকে ছাড়া বাঁচতে পারে না, এর চেয়ে বড় সত্য হয়তো খুব একটা নেই। সবচেয়ে বড় অহংকারী ব্যক্তিও বড়াই করে বলতে পারবেনা, "মানুষের আমার দরকার নাই, আমি একা থাকতে পারবো।" কারণ এমন কিছু লোক তার দরকার যাদের কাছে সে তার অহংকার জাহির করবে।
রাফি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। জুলিয়ার যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা যাচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে সে রুচি মত খাবার সার্ভ করতে পারছেনা। সেট করে দেয়া রেসিপি সে চেক করে দেখেছে। কোন ভুল নেই, ঠিকঠাক আছে। হয়তো কোন টেকনিক্যাল ফল্ট, একজন রোবট-মেকানিকের কাছে যাওয়া দরকার।
২।
দুপুরে লাঞ্চ খেতে বাসায় ফিরল রাফি। অফিস ক্যান্টিনের খাবার তার পছন্দ। কিন্তু এমন গলাকাটা দাম, খেতে আর ইচ্ছে করেনা। তাছাড়া অভিজ্ঞতা বলছে সব পছন্দ অপছন্দকে গুরুত্ব দিলে জীবনে নানা ধরনের জটিলতা দেখা যায়। রাফি নির্ঝঞ্ঝাট জীবনে অভ্যস্ত। বিয়ে-থা করেনি। বিয়ের অনুমতি পাওয়ার জন্যে ১০ টা ডায়মন্ড কার্ড ট্যাক্স দিতে হবে। সে মধ্যবিত্ত - সিলভার কার্ডের মানুষ। খুব হিসাব নিকাশ করে চললে, বছরে একটা, বড় জোর দুটো গোল্ডেন কার্ড জমে। কাজেই অকারণ খরচ তার অপছন্দ।
রাফি দেখলো কম্পিউটারাইজড ডাইনিং টেবিলে সাজানো আছে - ভাত, ডাল, আলুভাজি আর ভূনা মাছ। খাবার দেখে তো লোভনীয়ই মনে হচ্ছে। কেমন বানিয়েছে আল্লাহই জানে। মেকানিকের সাথে দেখা করার কথা ভুলেই গেছে সে। অবশ্য বিকেলেও দেখা করা যাবে। তাড়াহুড়ো করার তো কিছু নেই।
রাফি খুব তৃপ্তি সহকারে খেল। জুলিয়াকে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার। সে কিচেনে গিয়ে মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা জুলিয়াকে দেখল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজের উপর ও খুব বিরক্ত হলো। জুলিয়া, মানুষকে অপ্রয়োজনীয় করে তোলার একটা অস্ত্র! সে বুঝুক না বুঝুক তাকে ধন্যবাদ জানানোর কিছু নেই।
৩।
ফেব্রুয়ারি ১৪, ২১২১।
রাফি বিছানায় শুয়ে আছে। জুলিয়া ব্রেকফাস্ট দিয়ে গেছে। নতুন কোন ভুল করেনি জুলিয়া। রাফিও রোবট-মেকানিকের কাছে আর যায়নি। কি দরকার! কম করে হলেও ৫টা সিলভার কার্ড চেয়ে বসবে সার্ভিস চার্জ হিসেবে। তাছাড়া হয়তো টেম্পোরারি এরর। নিজে নিজেই ঠিক হয়ে গেছে যখন, শুধু শুধু কার্ড খরচের কোন মানে নেই।
রাফির ইচ্ছে ছিল আরও কিছুক্ষণ বিছানায় অলসভাবে শুয়ে থাকার। কিন্তু খাবার ঠান্ডা হয়ে যাবে বলে তাকে উঠতে হলো। আজ অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই। ১৪ই ফেব্রুয়ারি ছুটির দিন।
গত আট বছর ধরে সারা বিশ্বের সব দেশেই ভ্যালেন্টাইন্স ডে বিশেষ দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। সব দেশেই এটা ছুটির দিন। বাইরে বেরুলেই দেখা যায় সজ্জিত মানুষের ভীড়। ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড এর মতো বিষয় গুলোর জন্যেও এখন ভালবাসার মতো সুন্দর আর পবিত্র শব্দ ব্যবহার হচ্ছে।
রাফি ঘরকুনো মানুষ। পারতপক্ষে সে বাসার বাইরে যায়না। বাসা থেকে অফিস, অফিস থেকে বাসা, এই হচ্ছে তার পৃথিবী। তার মতো মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। যন্ত্রের পৃথিবীতে তার মতো সিলভার কার্ডের মানুষের জগতটা ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে।
পুরো ব্রেকফাস্ট দূরে থাক, অর্ধেক খাবার খেতে না খেতেই, তীব্র জ্বলুনি শুরু হলো রাফির বুকে। মনে হচ্ছে আগুন থেকে বের করে আনা গনগনে লাল কয়লা তার বুকে ঠেসে ধরেছে কেউ। কণ্ঠনালি জ্বলে যাচ্ছে সাথে পেটেও ভয়ানক যন্ত্রণা - যেন নাড়িভুড়ি সব পুড়ে যাচ্ছে।
বিছানায় চিত হয়ে ধপাস করে পড়ে যাওয়ার আগে এক মুহূর্তের জন্য একটা সন্দেহ মাথায় খেলে গেল - কারখানা থেকে নিয়ে আসা ক্যামিকেলের কোন একটা জার কি সে ভুল করে কিচেনে রেখে এসেছে? এবং যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে জুলিয়া হয়তো খাবারে মিশিয়ে দিয়েছে সেই ক্যামিকেল!
৪।
লাঞ্চের সময় হওয়ায় জুলিয়া এইমাত্র এক্টিভেট হলো। ঝটপট লাঞ্চ তৈরি করল। একটা ট্রে হাতে সে রাফির শোবার ঘরে ঢুকে কম্পিউটারাইজড ডাইনিং টেবিলে খাবার রাখল। পাশেই বিছানায় চিত হয়ে পড়ে আছে রাফির নিথর শরীর। সাদা ফেনায় ঠোঁট জোড়া আর মুখের কিছু অংশ ঢাকা পড়ে গেছে। চোখ দুটো বিস্ফোরিত, যেন কোটর থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। সেই চোখে যন্ত্র নির্ভর এ পৃথিবীর প্রতি তীব্র ঘৃণা।
জুলিয়া রাফির খাবার সাজিয়ে দিয়ে শোবার ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে কিচেনের দিকে চলে গেল। কিচেনে মিটসেফের পাশে এসে দাঁড়ানো মাত্রই অটোমেটিক ডি-এক্টিভেট হয়ে গেল সে। সে এখন একটা ধাতব জঞ্জাল ছাড়া আর কিছুই নয়। অফ হোয়াইট রঙ করা দেয়ালের দিকে সে অপলক তাকিয়ে আছে। ওর চোখদুটো আসলে হাই-রেজুলেশন ক্যামেরা, ৫৭৬ মেগাপিক্সেল...
মানুষের চোখের মতো করে তৈরি করা হলেও, বস্তুত কাঁচের ওই দুটো চোখে কোন দুঃখ নেই, নেই কোন অনুশোচনা কিংবা ভয়!
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
জামাল উদ্দিন জীবন ২৬/০৮/২০২১সুন্দর
-
নহাজা য়াজিনা ১৬/০৮/২০২১বেশ ভালো লেগেছে আপনার লেখা! শুভকামনা জানবেন।