সুগন্ধি রুমাল
১।
ফয়সাল রিক্সা করে অফিস যাচ্ছে। যেতে যেতে তার মনে হল, এটা ঠিক তার অফিস যাওয়ার রাস্তা নয়। অথচ সব ঠিকঠাক আছে। বাঁয়ে বইয়ের দোকান, ডানে নিউ মার্কেট। রাস্তাঘাটেও কোন পরিবর্তন নেই। যথারীতি লোকে লোকারণ্য! কিন্তু তবু ফয়সালের মন খচখচ করছে - কিছু একটা ঝামেলা আছে!
.
ব্যাপার কি বুঝার জন্য ফয়সাল যেই চারপাশে মনযোগ দিল, আতংকের সাথে সে লক্ষ্য করল - তার চারপাশের মানুষগুলোর চেহারা একই রকম। একই চেহারার পুরুষ, একই চেহারার নারী!
.
ফয়সালের ইচ্ছে করল এক লাফ দিয়ে রিক্সা থেকে নেমে একটা দৌড় দেয়, কিন্তু কিছুই করতে পারছেনা সে। হাত পা অবশ হয়ে গেছে। চারপাশে যা ঘটছে তাতে তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সে শুধু অবাক হয়ে খেয়াল করছে তার চারপাশের সবকিছু খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
.
ফয়সাল সেই অদ্ভুত জায়গাটাতে গিয়ে পৌছে গেল, যেখানে নুসরাত নামের একটা মেয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে!
.
২।
ক্যান্টিনে বসে কফি খাচ্ছে নুসরাত। একা। হয়তো ভুল বলা হল। কারণ সে একা নয়। তারা চারপাশে অনেকেই রয়েছে। কিন্তু দেখতে মানুষের মত হলেও তারা ঠিক মানুষ নয়। ওদের সবার চেহারাই একই রকম। একই রকম চেহারার পুরুষ, একই রকম চেহারার নারী।
.
এই অদ্ভুত জায়গায় ও প্রথম এসেছে, মানে আসতে বাধ্য হয়েছে তিনমাস আগে এক বৃষ্টি-মুখর সকালে। নুসরাতের ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় আটটা বাজে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই তার চারপাশটা বদলে গেল। ড্রেসিং টেবিলটা হাওয়া হয়ে গিয়ে সে নিজেকে আবিষ্কার করল আসবাবপত্রহীন বিশাল একটা কামরায়। তার চারপাশে অসংখ্য একই চেহারার মানুষ - একই চেহারার পুরুষ, একই চেহারার নারী।
.
প্রথম তিরিশ মিনিট সে থম মেরে দাঁড়িয়ে ছিল। কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। তারপর সে পালাতে চেষ্টা করে কিন্তু পালাবে কোথায়? এই জায়গাটা একটা বিশাল বাড়ীর মত। এখানে সব আছে। ড্রয়িংরুম, বেডরুম, ড্রেসিংরুম, কিচেন, ক্যান্টিন, ফুড কর্নার ইত্যাদি। কিন্তু এই বাড়ীটার কোথাও শুরু নেই, কোথাও শেষও নেই। কিংবা যেখানেই শুরু, সেখানেই শেষ।
.
সে শুধু প্রথম দিনই পালাবের চেষ্টা করেছে, একবার নয়, সতেরোবার! এবং যতবার পালাতে চেষ্টা করেছে ততবারই সে শত শত রুমের দরজা খুলেছে, কিন্তু শেষপর্যন্ত এসে পৌঁছেছে প্রথম রুমটায় যেখান থেকে সে শুরু করেছিল। তারপর একসময় তার মাথার ভিতর কে যেন কথা বলে উঠলো, "অযথা ক্লান্ত হয়োনা। আমরা যখন চাইবো কেবল তখনই তুমি এখান থেকে বেরুতে পারবে। তার আগে নয়।"
.
নুসরাত বুঝতে পারল এ অদ্ভুত জায়গাটা এ অদ্ভুত মানুষগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তাটা শুধু ওরাই জানে। নুসরাত ছুটে ওদের একজনের কাছে গেল। চেষ্টা করল কথা বলতে। নুসরাত একের পর এক প্রশ্ন করে গেল, কিন্তু ওরা নিরুত্তর। ওরা কেবল এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। ওদের ইচ্ছে হলে নুসরাতের মাথার ভেতর কোন উপায়ে কথা বলে। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য ওরা তাও করছেনা।
.
সেদিন নুসরাতের হাতঘড়িতে যখন ঠিক পাঁচটা বাজে নুসরাত দেখল সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। সে তার ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! সে এক দৌড়ে তার মায়ের কাছে চলে গেল। মা তখন কিচেনে নাস্তা বানাচ্ছিলেন। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল ও। মা তো অবাক।
.
"কি ব্যাপার কাঁদছিস কেন?" মা বলল।
.
কোন কথা বলতে পারছিলনা নুসরাত। সে শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। মা অবাক গলায় বলল, "কিছুক্ষণ আগেও তো তুই আমার সাথে ভাল মানুষের মত কথা বলছিলি। এখন আবার তোর কী হল?"
.
মুহুর্তেই কান্না থেমে গেল নুসরাতের। তার চেহেরায় এখন স্থান পেয়েছে ভয় ও বিস্ময়! কেউ একজন নুসরাত সেজে তার মায়ের সাথে ছিল! কি হচ্ছে এসব তার সাথে? কেন হচ্ছে?
.
পরদিন আবার সকাল আটাটায় ও ঐ অদ্ভুত জায়গাটায় পৌছে যায়, এবং আবার পাঁচটায় নিজের বাসায় চলে আসে। এভাবে সে প্রায় তিন মাস ওই অদ্ভুত জায়গায় আসা যাওয়া করেছে। কিভাবে যায় আর কিভাবে আসে এসবের কিছুই সে বুঝতে পারেনা। একবার সে সকাল আটটা বাজার আগে আগে নিজেকে বিছানার সাথে বেঁধে ফেলে, কিন্তু তবুও ঠিক ৮টা বাজে সে সেখানে পৌছে যায়।
.
ধীরেধীরে সে তার অবস্থা মেনে নিয়েছিল কিন্তু গত পাঁচদিন ধরে সে আর বাসায় আসতে পারছেনা। এই অদ্ভুত জায়গায় আটকে আছে। সে ওই মানুষগুলোকে প্রশ্ন করেছিল তাকে কি আর যেতে দেওয়া হবেনা? তারা তাকে কোন উত্তর দেয়নি।
.
এখন কফি খেতে খেতে তার ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়ে ভাবছিল নুসরাত। তার মাথার ভিতর কেউ একজন কথা বলে উঠল, "চিন্তা করোনা। তোমার জন্য একজন সঙ্গীর ব্যবস্থা করা হচ্ছে!"
.
সঙ্গী? মানে আরও একজন মানুষকে ওরা ধরে নিয়ে আসবে? আহারে না জানি কোন হতভাগার কপাল পুড়ল!
.
৩।
আব্দুল্লাহ হুজুর পুকুর ঘাটে অজু করছেন, পাশে গামছা হাতে মাসুম দাঁড়িয়ে আছে। আব্দুল্লাহ হুজুর বেশিরভাগ সময়ই চুপচাপ থাকেন। যখন বলেন তখনও খুব অল্পই বলেন। অথচ মাসুমকে ওনি অনেকবার বলেছেন তার জন্য তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে হবেনা, কিন্তু কে শুনে কার কথা!
.
আব্দুল্লাহ হুজুর জানেন মাসুম যা করে আন্তরিকভাবেই করে। ওর মধ্যে কোন লোক-দেখানো ব্যাপার নেই। মাঝেমধ্যে মাসুমকে কিছু "রহস্যময় গোপন কথা" বলতে ওনার ইচ্ছে হয়। কিন্তু বলেন না। সে সময়টা এখনো আসেনি। কলবের উপযুক্ততা কারো ইচ্ছা বা চেষ্টায় অর্জিত হয়না। যার হয় আল্লাহতালার দয়াতেই হয়।
.
গামছা দিয়ে হাত-মুখ মুছতে মুছতে মাসুমকে বললেন, "ফয়সাল নামের কোন ছেলে যদি আমার কাছে কোনদিন আসে, যতরাতই হোক আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিবি। আমার ঘুম নষ্ট হবে এটা ভেবে বিদায় করে দিবিনা!"
.
মাসুম কোন প্রশ্ন করলনা। এই স্বল্পভাষী মানুষটাকে তার একই সাথে ভাল লাগে, ভয়ও লাগে!
.
৪।
প্রায় একমাস হয়ে গেল ফয়সাল ওই অদ্ভুত জায়গাটাতে নিয়মিত আসা যাওয়া করতে বাধ্য হচ্ছে। নুসরাতকে ছাড়া ওই জায়গার কোনকিছুই তার ভাল লাগেনা। এই একমাসে ওদের মধ্যে বেশ ভাল বন্ধুত্ব হয়েছে।
.
ঠিক ৮ টা বাজে ফয়সাল ওখানে পৌছে আর পাঁচটা বাজে চলে আসে নিজস্ব পৃথিবীতে। ৫ টা বাজে নুসরাতের মন খারাপ হয়ে যায়। কারণ সে আর তার নিজস্ব পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারেনা। ওকে ওরা বন্দী করে ফেলেছে। ফয়সাল একদিন ৫টা বাজার আগে আগে ওর হাত ধরে বসেছিল যাতে দুজনই একসাথে ফিরে আসতে পারে কিন্তু লাভ হয়নি। ৫টা বাজতেই ফয়সালের চারপাশটা বদলে গেল, আর নুসরাতের চারপাশে রয়ে গেল অদ্ভুত বাড়ীটার রহস্যময় কঠিন দেয়াল।
.
এই একমাসে ওরা কিছু জিনিশ আবিষ্কার করেছে যেমন --
.
->ওই মানুষগুলো মাইন্ড-রীডার। ফয়সাল বা নুসরাতের ভাবনা ওরা টের পেয়ে যায়। উদাহরণঃ ওদের কফি খেতে ইচ্ছে করল, ক্যান্টিন গিয়ে ওরা দেখবে ধোঁয়া উঠা কফির মগ কাউন্টারে রাখা।
.
->সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পৃথিবীতে অন্য নুসরাত ও অন্য ফয়সাল ওদের হয়ে প্রক্সি দেয়। তাই তাদের আশেপাশের মানুষগুলো কখনোই তাদের অনুপস্থিতি জানতে পারেনা। আর তাই পৃথিবীতে ওদের দুজনের কেউই তাদের সমস্যার কথাটা কাওকে বুঝাতে পারেনি। অবশ্য নুসরাতের হয়ে এখনো কেউ প্রক্সি দিয়ে যাচ্ছে কিনা তা তাদের জানা নেই!
.
-> নুসরাত আর ফয়সাল সব কথা একজন আর একজনকে শেয়ার করতে পারছেনা। যেমন অনেক চেষ্টা করেও নুসরাত তার বাড়ীর ঠিকানা ফয়সালকে বলতে পারছেনা। এরা হয়ত কিছু স্মৃতি মুছে দিয়েছে কিংবা ওদের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করছে।
.
-> নুসরাতের মনে হচ্ছে সে ফয়সালকে ভালবেসে ফেলেছে তবে নুসরাত নিশ্চিত নয় তার এ ভালবাসার অনুভুতিও ওদের নিয়ন্ত্রণ কিনা? কিংবা এটা হয়ত ভালবাসা নয়, সে একা বলে এটা ফয়সালের প্রতি একধরনের নির্ভরতা, এক ধরনের নিরাপত্তবোধ।
.
-> ফয়সালের মনে হচ্ছে নুসরাত চাচ্ছেনা, ফয়সাল এখানে না আসার একটা উপায় বের করে ফেলুক। কিন্তু ফয়সাল তার নিজস্ব পৃথিবীতে থাকতে চায়, সে নুসরাতের মতো এ অদ্ভুত বাড়ীতে বন্দী হয়ে থাকতে চায়না। নুসরাতের মত কারো সঙ্গ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার কিন্তু সে অসহায়, তাকে এখানে আর না আসার একটা উপায় যেভাবেই হোক বের করতেই হবে।
.
৫।
রাত ২টা।
.
ফয়সাল আব্দুল্লাহ হুজুরের বাড়ীর উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ীর বাইরে দাওয়ায় একটা যুবক ছেলে শুয়ে আছে। ফয়সাল ভাবল ছেলেটা আব্দুল্লাহ হুজুরের খাদেম। হ্যা এক হিসেবে মাসুমকে আব্দুল্লাহ হুজুরের খাদেম বলা যায়। ছেলেটা সবসময় আব্দুল্লাহ হুজুরের আন্তরিক খেদমতের চেষ্টা করে।
.
ফয়সাল মাসুমের গায়ে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে ডাকতে শুরু করল, "ভাই ও ভাই!"
মাসুম চোখ মেলে তাকাল। ঘুম ভাঙল বলে সে একটুও বিরক্ত হলনা। যেন এরকম ঘটনা তার সাথে হর-হামেশাই ঘটে।
.
মাসুম বলল, "কী চান"
"আব্দুল্লাহ হুজুরের সাথে দেখা করতে চাই"
"ওনি এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। সকালে আসেন।"
"সকালে সম্ভব না। বিষয়টা খুব জরুরী"
মাসুম ফয়সালের দিকে তাকাল। ১মাস আগে বলা হুজুরের একটা কথা ওর মনে পড়ে গেছে। ও বল্ল, "আপনার নাম কী?"
"ফয়সাল!"
.
ফয়সাল এখন আব্দুল্লাহ হুজুরের সামনে বসে আছে। সে হুজুরকে সব কথা খুলে বলেছে। কোন কিছুই বাদ রাখেনি। হুজুর সব কথা মনযোগ সহকারে শুনলেন। চুপচাপ ছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, "আপনার কাছে রুমাল আছে? থাকলে দেন।"
ফয়সাল তার প্যান্টের পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে দিল। রুমালটার এক কোনায় সেলাই করে লেখা আছে -"ফয়সাল"
.
হুজুর মাসুমকে বলে এক গ্লাস পানি আনালেন। তারপর মিনিট তিনেক বিড়বিড় করে কি যেন পড়লেন। পড়া শেষ হলে গ্লাসের পানিতে গভীর একটা ফুক দিলেন - "হু..."
.
তারপর রুমালটাকে ওই ফুক দেয়া পানিতে ডুবিয়ে রাখলেন। কিছুক্ষণ পর রুমাল হাতে নিয়ে বাতাসে নাড়লেন, সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের বাতাস ফুলের সৌরভে ভরে উঠলো, যেন একসাথে অজস্র হাস্নাহেনা ফোটে আছে এখানে।
.
রুমালটা ফয়সালের হাতে দিলেন আব্দুল্লাহ হুজুর। ফয়সাল অবাক হয়ে দেখল রুমালটা ভেজা নয়, রোদে শুকালে যেরকম উষ্ণ হয় অনেকটা সেরকম উষ্ণ। পানির কোন চিহ্নই নেই।
.
আব্দুল্লাহ হুজুর বললেন, "রুমালটা ৪০ দিন আপনার সাথে সাথে রাখবেন। রুমালটার আশেপাশের ৪০ হাতের মধ্যে আপনি নিরাপদ। এর চেয়ে দূরে গেলে আপনি আবার ওদের কবলে পড়ে যাবেন। তবে ৪০ দিন পর থেকে রুমালটা আর সঙ্গে রাখতে হবেনা"
.
তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, "নুসরাত ওখানেই আটকে থাকবে। ওর জন্য কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই রুমাল শুধু আপনার উপকারে আসবে।"
.
আবার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন "সামনে অনেকগুলো রাস্তা, কিন্তু গন্তব্য নির্ধারিত। আমরা কেবল রাস্তাটাই বেছে নিতে পারি। গন্তব্য বেছে নিতে পারিনা।"
.
আবারও কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর বললেন "এবার আপনি আসতে পারেন"
.
ফয়সাল ভাবল, বাংলা ভাষা কী অদ্ভুত - এ ভাষায় আসতে বলে বিদায় জানানো যায়!
.
ফয়সাল ৫০০ টাকার একটা নোট বের করল হুজুরকে দেয়ার জন্য। হুজুর মাসুমকে ইশারা করলে, মাসুম টাকাটা নিল।
.
৬।
ফয়সাল একটা ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে আছে। নিচে দিয়ে বিশাল নদী বয়ে চলছে। তার বুক পকেটে সুগন্ধি রুমাল। সে ঐ অদ্ভুত জায়গায় না যাওয়ার উপায় পেয়ে গেছে, কিন্তু তার মন ভাল নেই, তার মন বিষণ্ণ।
.
গত তিনদিন ধরে ফয়সালকে অদ্ভুত বাড়ীটিতে যেতে হয়নি। সন্দেহ নেই সুগন্ধি রুমাল কাজ করছে। ব্যাপারটা অলৌকিকই বটে। প্রথম দিন খুবই আনন্দিত ছিল ফয়সাল, কিন্তু রাত্রে ঘুমুতে যাওয়ার সময় নুসরাতকে তার ভীষণভাবে মনে পড়লো। কী করছে এখন মেয়েটা? সে কি কোনদিনই পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবেনা? চিরকালের জন্য আটকে পড়েছে সে! নুসরাত কি কাঁদছে? অন্যভুবনে একা একটা মেয়ে কাঁদছে এটা ভাবতেই ফয়সালের খুব কষ্ট হচ্ছে।
.
সেই রাতের পর থেকে তার আর এই পৃথিবী ভাল লাগছেনা। নুসরাতের জন্য মায়া হচ্ছে। সে পথে পথে হেঁটেছে। নিজেকে নানারকম বুঝিয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। তার মন নুসরাতের কাছে পড়ে আছে।
.
একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সে এই ব্রীজের উপর এসে দাঁড়িয়েছে। নদীর বুক বেয়ে আসা প্রবল বাতাস তার চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। নুসরাতের জন্য তার চোখে ভালবাসার অশ্রুজল। বুকপকেট থেকে রুমালটা বের করল সে। একটা পাথর রুমালের ভিতর রেখে রুমালটা ভারী করে নিল ও। তারপর তার ডানহাতের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে নদীর বুকে ছুড়ে দিল রুমালটা!
.
৭।
তাহাজ্জুদ এর নামাজ পড়ে নিয়ে আব্দুল্লাহ হুজুর তার টেবিলে গিয়ে বসলেন। ফজরের আযান হতে আর ১০/১৫ মিনিট বাকি। টেবিলের একপাশে একটা রুমাল রাখা আছে। রুমালটার এক কোনায় সেলাই করে লেখা "ফয়সাল"। রুমালটার দিকে তাকিয়ে তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর রুমালটা ভাঁজ করে সেই ড়্রয়ারটাতে রাখলেন যে ড্রয়ারটাতে রাখা আছে আরো চার পাঁচটা ভাঁজ করা রুমাল - সুগন্ধি রুমাল!
ফয়সাল রিক্সা করে অফিস যাচ্ছে। যেতে যেতে তার মনে হল, এটা ঠিক তার অফিস যাওয়ার রাস্তা নয়। অথচ সব ঠিকঠাক আছে। বাঁয়ে বইয়ের দোকান, ডানে নিউ মার্কেট। রাস্তাঘাটেও কোন পরিবর্তন নেই। যথারীতি লোকে লোকারণ্য! কিন্তু তবু ফয়সালের মন খচখচ করছে - কিছু একটা ঝামেলা আছে!
.
ব্যাপার কি বুঝার জন্য ফয়সাল যেই চারপাশে মনযোগ দিল, আতংকের সাথে সে লক্ষ্য করল - তার চারপাশের মানুষগুলোর চেহারা একই রকম। একই চেহারার পুরুষ, একই চেহারার নারী!
.
ফয়সালের ইচ্ছে করল এক লাফ দিয়ে রিক্সা থেকে নেমে একটা দৌড় দেয়, কিন্তু কিছুই করতে পারছেনা সে। হাত পা অবশ হয়ে গেছে। চারপাশে যা ঘটছে তাতে তার কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। সে শুধু অবাক হয়ে খেয়াল করছে তার চারপাশের সবকিছু খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে।
.
ফয়সাল সেই অদ্ভুত জায়গাটাতে গিয়ে পৌছে গেল, যেখানে নুসরাত নামের একটা মেয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছে!
.
২।
ক্যান্টিনে বসে কফি খাচ্ছে নুসরাত। একা। হয়তো ভুল বলা হল। কারণ সে একা নয়। তারা চারপাশে অনেকেই রয়েছে। কিন্তু দেখতে মানুষের মত হলেও তারা ঠিক মানুষ নয়। ওদের সবার চেহারাই একই রকম। একই রকম চেহারার পুরুষ, একই রকম চেহারার নারী।
.
এই অদ্ভুত জায়গায় ও প্রথম এসেছে, মানে আসতে বাধ্য হয়েছে তিনমাস আগে এক বৃষ্টি-মুখর সকালে। নুসরাতের ঘড়িতে তখন কাঁটায় কাঁটায় আটটা বাজে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই তার চারপাশটা বদলে গেল। ড্রেসিং টেবিলটা হাওয়া হয়ে গিয়ে সে নিজেকে আবিষ্কার করল আসবাবপত্রহীন বিশাল একটা কামরায়। তার চারপাশে অসংখ্য একই চেহারার মানুষ - একই চেহারার পুরুষ, একই চেহারার নারী।
.
প্রথম তিরিশ মিনিট সে থম মেরে দাঁড়িয়ে ছিল। কি করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। তারপর সে পালাতে চেষ্টা করে কিন্তু পালাবে কোথায়? এই জায়গাটা একটা বিশাল বাড়ীর মত। এখানে সব আছে। ড্রয়িংরুম, বেডরুম, ড্রেসিংরুম, কিচেন, ক্যান্টিন, ফুড কর্নার ইত্যাদি। কিন্তু এই বাড়ীটার কোথাও শুরু নেই, কোথাও শেষও নেই। কিংবা যেখানেই শুরু, সেখানেই শেষ।
.
সে শুধু প্রথম দিনই পালাবের চেষ্টা করেছে, একবার নয়, সতেরোবার! এবং যতবার পালাতে চেষ্টা করেছে ততবারই সে শত শত রুমের দরজা খুলেছে, কিন্তু শেষপর্যন্ত এসে পৌঁছেছে প্রথম রুমটায় যেখান থেকে সে শুরু করেছিল। তারপর একসময় তার মাথার ভিতর কে যেন কথা বলে উঠলো, "অযথা ক্লান্ত হয়োনা। আমরা যখন চাইবো কেবল তখনই তুমি এখান থেকে বেরুতে পারবে। তার আগে নয়।"
.
নুসরাত বুঝতে পারল এ অদ্ভুত জায়গাটা এ অদ্ভুত মানুষগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। এখান থেকে বের হওয়ার রাস্তাটা শুধু ওরাই জানে। নুসরাত ছুটে ওদের একজনের কাছে গেল। চেষ্টা করল কথা বলতে। নুসরাত একের পর এক প্রশ্ন করে গেল, কিন্তু ওরা নিরুত্তর। ওরা কেবল এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। ওদের ইচ্ছে হলে নুসরাতের মাথার ভেতর কোন উপায়ে কথা বলে। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য ওরা তাও করছেনা।
.
সেদিন নুসরাতের হাতঘড়িতে যখন ঠিক পাঁচটা বাজে নুসরাত দেখল সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। সে তার ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে! সে এক দৌড়ে তার মায়ের কাছে চলে গেল। মা তখন কিচেনে নাস্তা বানাচ্ছিলেন। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করল ও। মা তো অবাক।
.
"কি ব্যাপার কাঁদছিস কেন?" মা বলল।
.
কোন কথা বলতে পারছিলনা নুসরাত। সে শুধু কেঁদেই যাচ্ছে। মা অবাক গলায় বলল, "কিছুক্ষণ আগেও তো তুই আমার সাথে ভাল মানুষের মত কথা বলছিলি। এখন আবার তোর কী হল?"
.
মুহুর্তেই কান্না থেমে গেল নুসরাতের। তার চেহেরায় এখন স্থান পেয়েছে ভয় ও বিস্ময়! কেউ একজন নুসরাত সেজে তার মায়ের সাথে ছিল! কি হচ্ছে এসব তার সাথে? কেন হচ্ছে?
.
পরদিন আবার সকাল আটাটায় ও ঐ অদ্ভুত জায়গাটায় পৌছে যায়, এবং আবার পাঁচটায় নিজের বাসায় চলে আসে। এভাবে সে প্রায় তিন মাস ওই অদ্ভুত জায়গায় আসা যাওয়া করেছে। কিভাবে যায় আর কিভাবে আসে এসবের কিছুই সে বুঝতে পারেনা। একবার সে সকাল আটটা বাজার আগে আগে নিজেকে বিছানার সাথে বেঁধে ফেলে, কিন্তু তবুও ঠিক ৮টা বাজে সে সেখানে পৌছে যায়।
.
ধীরেধীরে সে তার অবস্থা মেনে নিয়েছিল কিন্তু গত পাঁচদিন ধরে সে আর বাসায় আসতে পারছেনা। এই অদ্ভুত জায়গায় আটকে আছে। সে ওই মানুষগুলোকে প্রশ্ন করেছিল তাকে কি আর যেতে দেওয়া হবেনা? তারা তাকে কোন উত্তর দেয়নি।
.
এখন কফি খেতে খেতে তার ভবিষ্যৎ কি হবে তা নিয়ে ভাবছিল নুসরাত। তার মাথার ভিতর কেউ একজন কথা বলে উঠল, "চিন্তা করোনা। তোমার জন্য একজন সঙ্গীর ব্যবস্থা করা হচ্ছে!"
.
সঙ্গী? মানে আরও একজন মানুষকে ওরা ধরে নিয়ে আসবে? আহারে না জানি কোন হতভাগার কপাল পুড়ল!
.
৩।
আব্দুল্লাহ হুজুর পুকুর ঘাটে অজু করছেন, পাশে গামছা হাতে মাসুম দাঁড়িয়ে আছে। আব্দুল্লাহ হুজুর বেশিরভাগ সময়ই চুপচাপ থাকেন। যখন বলেন তখনও খুব অল্পই বলেন। অথচ মাসুমকে ওনি অনেকবার বলেছেন তার জন্য তোয়ালে হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে হবেনা, কিন্তু কে শুনে কার কথা!
.
আব্দুল্লাহ হুজুর জানেন মাসুম যা করে আন্তরিকভাবেই করে। ওর মধ্যে কোন লোক-দেখানো ব্যাপার নেই। মাঝেমধ্যে মাসুমকে কিছু "রহস্যময় গোপন কথা" বলতে ওনার ইচ্ছে হয়। কিন্তু বলেন না। সে সময়টা এখনো আসেনি। কলবের উপযুক্ততা কারো ইচ্ছা বা চেষ্টায় অর্জিত হয়না। যার হয় আল্লাহতালার দয়াতেই হয়।
.
গামছা দিয়ে হাত-মুখ মুছতে মুছতে মাসুমকে বললেন, "ফয়সাল নামের কোন ছেলে যদি আমার কাছে কোনদিন আসে, যতরাতই হোক আমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে দিবি। আমার ঘুম নষ্ট হবে এটা ভেবে বিদায় করে দিবিনা!"
.
মাসুম কোন প্রশ্ন করলনা। এই স্বল্পভাষী মানুষটাকে তার একই সাথে ভাল লাগে, ভয়ও লাগে!
.
৪।
প্রায় একমাস হয়ে গেল ফয়সাল ওই অদ্ভুত জায়গাটাতে নিয়মিত আসা যাওয়া করতে বাধ্য হচ্ছে। নুসরাতকে ছাড়া ওই জায়গার কোনকিছুই তার ভাল লাগেনা। এই একমাসে ওদের মধ্যে বেশ ভাল বন্ধুত্ব হয়েছে।
.
ঠিক ৮ টা বাজে ফয়সাল ওখানে পৌছে আর পাঁচটা বাজে চলে আসে নিজস্ব পৃথিবীতে। ৫ টা বাজে নুসরাতের মন খারাপ হয়ে যায়। কারণ সে আর তার নিজস্ব পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারেনা। ওকে ওরা বন্দী করে ফেলেছে। ফয়সাল একদিন ৫টা বাজার আগে আগে ওর হাত ধরে বসেছিল যাতে দুজনই একসাথে ফিরে আসতে পারে কিন্তু লাভ হয়নি। ৫টা বাজতেই ফয়সালের চারপাশটা বদলে গেল, আর নুসরাতের চারপাশে রয়ে গেল অদ্ভুত বাড়ীটার রহস্যময় কঠিন দেয়াল।
.
এই একমাসে ওরা কিছু জিনিশ আবিষ্কার করেছে যেমন --
.
->ওই মানুষগুলো মাইন্ড-রীডার। ফয়সাল বা নুসরাতের ভাবনা ওরা টের পেয়ে যায়। উদাহরণঃ ওদের কফি খেতে ইচ্ছে করল, ক্যান্টিন গিয়ে ওরা দেখবে ধোঁয়া উঠা কফির মগ কাউন্টারে রাখা।
.
->সকাল ৮ টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত পৃথিবীতে অন্য নুসরাত ও অন্য ফয়সাল ওদের হয়ে প্রক্সি দেয়। তাই তাদের আশেপাশের মানুষগুলো কখনোই তাদের অনুপস্থিতি জানতে পারেনা। আর তাই পৃথিবীতে ওদের দুজনের কেউই তাদের সমস্যার কথাটা কাওকে বুঝাতে পারেনি। অবশ্য নুসরাতের হয়ে এখনো কেউ প্রক্সি দিয়ে যাচ্ছে কিনা তা তাদের জানা নেই!
.
-> নুসরাত আর ফয়সাল সব কথা একজন আর একজনকে শেয়ার করতে পারছেনা। যেমন অনেক চেষ্টা করেও নুসরাত তার বাড়ীর ঠিকানা ফয়সালকে বলতে পারছেনা। এরা হয়ত কিছু স্মৃতি মুছে দিয়েছে কিংবা ওদের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ করছে।
.
-> নুসরাতের মনে হচ্ছে সে ফয়সালকে ভালবেসে ফেলেছে তবে নুসরাত নিশ্চিত নয় তার এ ভালবাসার অনুভুতিও ওদের নিয়ন্ত্রণ কিনা? কিংবা এটা হয়ত ভালবাসা নয়, সে একা বলে এটা ফয়সালের প্রতি একধরনের নির্ভরতা, এক ধরনের নিরাপত্তবোধ।
.
-> ফয়সালের মনে হচ্ছে নুসরাত চাচ্ছেনা, ফয়সাল এখানে না আসার একটা উপায় বের করে ফেলুক। কিন্তু ফয়সাল তার নিজস্ব পৃথিবীতে থাকতে চায়, সে নুসরাতের মতো এ অদ্ভুত বাড়ীতে বন্দী হয়ে থাকতে চায়না। নুসরাতের মত কারো সঙ্গ পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার কিন্তু সে অসহায়, তাকে এখানে আর না আসার একটা উপায় যেভাবেই হোক বের করতেই হবে।
.
৫।
রাত ২টা।
.
ফয়সাল আব্দুল্লাহ হুজুরের বাড়ীর উঠানে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ীর বাইরে দাওয়ায় একটা যুবক ছেলে শুয়ে আছে। ফয়সাল ভাবল ছেলেটা আব্দুল্লাহ হুজুরের খাদেম। হ্যা এক হিসেবে মাসুমকে আব্দুল্লাহ হুজুরের খাদেম বলা যায়। ছেলেটা সবসময় আব্দুল্লাহ হুজুরের আন্তরিক খেদমতের চেষ্টা করে।
.
ফয়সাল মাসুমের গায়ে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে ডাকতে শুরু করল, "ভাই ও ভাই!"
মাসুম চোখ মেলে তাকাল। ঘুম ভাঙল বলে সে একটুও বিরক্ত হলনা। যেন এরকম ঘটনা তার সাথে হর-হামেশাই ঘটে।
.
মাসুম বলল, "কী চান"
"আব্দুল্লাহ হুজুরের সাথে দেখা করতে চাই"
"ওনি এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। সকালে আসেন।"
"সকালে সম্ভব না। বিষয়টা খুব জরুরী"
মাসুম ফয়সালের দিকে তাকাল। ১মাস আগে বলা হুজুরের একটা কথা ওর মনে পড়ে গেছে। ও বল্ল, "আপনার নাম কী?"
"ফয়সাল!"
.
ফয়সাল এখন আব্দুল্লাহ হুজুরের সামনে বসে আছে। সে হুজুরকে সব কথা খুলে বলেছে। কোন কিছুই বাদ রাখেনি। হুজুর সব কথা মনযোগ সহকারে শুনলেন। চুপচাপ ছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, "আপনার কাছে রুমাল আছে? থাকলে দেন।"
ফয়সাল তার প্যান্টের পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে দিল। রুমালটার এক কোনায় সেলাই করে লেখা আছে -"ফয়সাল"
.
হুজুর মাসুমকে বলে এক গ্লাস পানি আনালেন। তারপর মিনিট তিনেক বিড়বিড় করে কি যেন পড়লেন। পড়া শেষ হলে গ্লাসের পানিতে গভীর একটা ফুক দিলেন - "হু..."
.
তারপর রুমালটাকে ওই ফুক দেয়া পানিতে ডুবিয়ে রাখলেন। কিছুক্ষণ পর রুমাল হাতে নিয়ে বাতাসে নাড়লেন, সঙ্গে সঙ্গে আশেপাশের বাতাস ফুলের সৌরভে ভরে উঠলো, যেন একসাথে অজস্র হাস্নাহেনা ফোটে আছে এখানে।
.
রুমালটা ফয়সালের হাতে দিলেন আব্দুল্লাহ হুজুর। ফয়সাল অবাক হয়ে দেখল রুমালটা ভেজা নয়, রোদে শুকালে যেরকম উষ্ণ হয় অনেকটা সেরকম উষ্ণ। পানির কোন চিহ্নই নেই।
.
আব্দুল্লাহ হুজুর বললেন, "রুমালটা ৪০ দিন আপনার সাথে সাথে রাখবেন। রুমালটার আশেপাশের ৪০ হাতের মধ্যে আপনি নিরাপদ। এর চেয়ে দূরে গেলে আপনি আবার ওদের কবলে পড়ে যাবেন। তবে ৪০ দিন পর থেকে রুমালটা আর সঙ্গে রাখতে হবেনা"
.
তারপর বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বললেন, "নুসরাত ওখানেই আটকে থাকবে। ওর জন্য কিছু করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। এই রুমাল শুধু আপনার উপকারে আসবে।"
.
আবার কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন "সামনে অনেকগুলো রাস্তা, কিন্তু গন্তব্য নির্ধারিত। আমরা কেবল রাস্তাটাই বেছে নিতে পারি। গন্তব্য বেছে নিতে পারিনা।"
.
আবারও কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপর বললেন "এবার আপনি আসতে পারেন"
.
ফয়সাল ভাবল, বাংলা ভাষা কী অদ্ভুত - এ ভাষায় আসতে বলে বিদায় জানানো যায়!
.
ফয়সাল ৫০০ টাকার একটা নোট বের করল হুজুরকে দেয়ার জন্য। হুজুর মাসুমকে ইশারা করলে, মাসুম টাকাটা নিল।
.
৬।
ফয়সাল একটা ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে আছে। নিচে দিয়ে বিশাল নদী বয়ে চলছে। তার বুক পকেটে সুগন্ধি রুমাল। সে ঐ অদ্ভুত জায়গায় না যাওয়ার উপায় পেয়ে গেছে, কিন্তু তার মন ভাল নেই, তার মন বিষণ্ণ।
.
গত তিনদিন ধরে ফয়সালকে অদ্ভুত বাড়ীটিতে যেতে হয়নি। সন্দেহ নেই সুগন্ধি রুমাল কাজ করছে। ব্যাপারটা অলৌকিকই বটে। প্রথম দিন খুবই আনন্দিত ছিল ফয়সাল, কিন্তু রাত্রে ঘুমুতে যাওয়ার সময় নুসরাতকে তার ভীষণভাবে মনে পড়লো। কী করছে এখন মেয়েটা? সে কি কোনদিনই পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারবেনা? চিরকালের জন্য আটকে পড়েছে সে! নুসরাত কি কাঁদছে? অন্যভুবনে একা একটা মেয়ে কাঁদছে এটা ভাবতেই ফয়সালের খুব কষ্ট হচ্ছে।
.
সেই রাতের পর থেকে তার আর এই পৃথিবী ভাল লাগছেনা। নুসরাতের জন্য মায়া হচ্ছে। সে পথে পথে হেঁটেছে। নিজেকে নানারকম বুঝিয়েছে। কিন্তু কাজ হয়নি। তার মন নুসরাতের কাছে পড়ে আছে।
.
একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সে এই ব্রীজের উপর এসে দাঁড়িয়েছে। নদীর বুক বেয়ে আসা প্রবল বাতাস তার চুল এলোমেলো করে দিচ্ছে। নুসরাতের জন্য তার চোখে ভালবাসার অশ্রুজল। বুকপকেট থেকে রুমালটা বের করল সে। একটা পাথর রুমালের ভিতর রেখে রুমালটা ভারী করে নিল ও। তারপর তার ডানহাতের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে নদীর বুকে ছুড়ে দিল রুমালটা!
.
৭।
তাহাজ্জুদ এর নামাজ পড়ে নিয়ে আব্দুল্লাহ হুজুর তার টেবিলে গিয়ে বসলেন। ফজরের আযান হতে আর ১০/১৫ মিনিট বাকি। টেবিলের একপাশে একটা রুমাল রাখা আছে। রুমালটার এক কোনায় সেলাই করে লেখা "ফয়সাল"। রুমালটার দিকে তাকিয়ে তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর রুমালটা ভাঁজ করে সেই ড়্রয়ারটাতে রাখলেন যে ড্রয়ারটাতে রাখা আছে আরো চার পাঁচটা ভাঁজ করা রুমাল - সুগন্ধি রুমাল!
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আখলাক হুসাইন ১০/১০/২০১৮সুন্দর
-
ন্যান্সি দেওয়ান ১০/১০/২০১৮khub misti..
-
আনন্দ চ্যাটার্জী ০৯/১০/২০১৮দারুন লেখা
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ০৮/১০/২০১৮বেশ
-
শুভদীপ চক্রবর্তী ০৮/১০/২০১৮বেশ সুন্দর।