www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মায়ের প্রপার্টি

১।
সজোরে ব্রেক কষে শওকতের গাড়িটা থামল সুমনের বাড়ীর গেটের সামনে। ড্যাশবোর্ডে লুকিয়ে রাখা পিস্তলটা বের করে নিয়ে কোমরে গুঁজে নিল শওকত। সদর দরজায় এসে কলিং বেল টিপল পাগলের মতো।
.
সুমনই খুলল দরজাটা।
চোখমুখ লাল করে সুমনকে একরকম ধাক্কা দিয়েই ভিতরে ঢুকে পড়ল ও। শওকত বলল,"মা আর শুভকে ডাক। এক্ষুনি। কোথায় ওরা।"
.
"ভাইয়া তুমি জোর করে ওদেরকে এভাবে নিয়ে যেতে পারোনা।"
.
"তুইও ওদেরকে জোর করে এভাবে আটকে রাখতে পারিসনা। মাকে আর শুভকে আমার নামে এভাবে ভুল বুঝাতে পারিসনা।"
.
"বাচ্চার দোহাই দিওনা ভাইয়া। পরিষ্কার করে বলই না - মাকে তুমি এখান থেকে কেন নিয়ে যেতে চাইছো?- তার কারণ হল মায়ের সব প্রপার্টি তুমিই একলা পেতে চাইছো।"
.
"আরে আমি তোর মতো নই। তোর ধান্ধাই হচ্ছে মায়ের সব প্রপার্টি নিজের নামে করে ফেলা।"
.
"সে তুমি তোমার যা ইচ্ছা ভাবো। মা এখান থেকে যাচ্ছেনা, ব্যস। শুভ তার দাদীকে ছাড়া থাকতে পারেনা। সেও তার দাদীর সাথে থাকতে চায়। সে যদি তোমার সাথে যেতে চাই বাঁধা দেবনা আমি, কিন্তু জোর করে তুমি কাওকেই নিয়ে যেতে পারবেনা ভাইয়া।"
.
"তাই না?" বলতে বলতে পিস্তলটা বের করল শওকত! "ডাক মাকে। ডাক শুভকে!"
.
"এসব তুমি কি করছো ভাইয়া? পাগল হয়ে গেছো তুমি?"
.
ওদের চেঁচামেচিতে ততক্ষণে মা আর শুভ ছুটে চলে এসেছে ঘটনাস্থলে। আতংকে বিস্ফোরিত সবার চোখ।
.
শওকত মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, "চল মা, আমার বাড়ীতে চল।"
.
শওকতের অমনোযোগিতার সুযোগে ক্ষিপ্র গতিতে শওকতের পিস্তল ধরে ফেলল সুমন! চেষ্টা করল কেড়ে নিতে, কিন্তু পারলোনা। পিস্তলটা নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া শুরু হল দুজনের মধ্যে।
.
যাতে কোনভাবেই কোন দুর্ঘটনা না ঘটে পিস্তলটা ওদের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে এগিয়ে গেল মা আর শুভ। শওকত, মা আর শুভ। পিস্তলটাকে কেন্দ্র করে একটা আতঙ্কিত হৈচৈ শুরু করেছে ওরা তিনজন।
.
ঠুস!
.
শেষপর্যন্ত একটা বুলেট বেরিয়ে গেল পিস্তল থেকে। মেঝেতে লুটিয়ে পড়লেন মা! বুক থেকে গলগল করে রক্ত বেরুচ্ছে। সমস্ত ঘরটাতে এখন পিনপতন নীরবতা।

২।

তিন মাস আগের ঘটনা।
.
শওকতদের ড্রয়িংরুমে তুমুল কথা কাটাকাটি করছে দুই ভাই। বড় ভাই শওকত আর ছোট ভাই সুমন। ওদের একমাত্র বোন নীলুফার দর্শক হয়ে বসে আছে ওদের সাথে।
.
"দ্যাখ সুমন" শওকত বলছে, "মা সেখানেই থাকবে, যেখানে মা ভাল থাকে। আর মা আমার এখানেই ভাল আছে।"
.
সুমন বলল, "ঠিক আছে ভাইয়া, মাকে জিজ্ঞাস করে দেখ, মা কোথায় ভাল থাকবে, আর কোথায় ভাল থাকবেনা। মা যেখানে থাকতে চাইবে, সেখানেই থাকবে। আমার কোন আপত্তি নেই। ডাকো মাকে।"
.
শওকত বলল,"ডাকাডাকির কিছু নেই। মা কোত্থাও যাবেনা, মা এখানেই থাকবে। তুই তো একা থাকিস। মায়ের দেখভাল করবি কী করে?"
.
সুমন বলল, "দেখাশোনা আমি করতে পারবো ভাইয়া, ও নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবেনা। তুমি কেমন দেখাশুনা করছো, জানা আছে আমার...
.
এবার নীলুফার কথা বলে উঠলো, "তোমরা এভাবে ঝগড়া করোনা। একবার মাকেই জিজ্ঞেস করিনা মা কোথায় থাকতে চায়?"
.
সুমন বলল, "এতক্ষণ ধরে আমি এটাই তো বলতে চাচ্ছি নীলুফার।"
.
শওকত নীলুফারের দিকে তাকিয়ে বলল, "শোন ওকে বেশি প্রশ্রয় দিসনা। তোর কি মনে হয় ও মার জন্য এখানে এসেছে? না, তা নয়। ওর শুধু একটাই ধান্ধা - মা যাতে তার সমস্ত প্রপার্টি ওর নামে করে দেয়।"
.
সুমন বলল, "তাহলে কি মাকে তুমি এটার জন্যই বাড়িতে রাখতে চাও?
.
"দ্যাখ, ফালতু কথা বলবিনা। আমি বড় ছেলে। মা আমার সঙ্গে থাকবে।"
.
"এবার তোরা চুপ কর" ড্রয়িংরুমে ঢুকতে ঢুকতে মা বললেন, "বন্ধ কর তোরা আমাকে নিয়ে এ লড়াই।"

শওকত সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো, বলল, "ঝগড়াটা তো ও শুরু করেছে মা। ও বলছে, তুমি এখানে ভাল নেই। তুমিই বল মা, তুমি এখানে ভাল নেই?"

উঠে দাঁড়ালো সুমনও, বলল, "হ্যা মা তুমিই ঠিক করো, তুমি কোথায় বেশি ভাল থাকবে? এখানে থাকবে না আমার কাছে?

মা বেশ ভালই ঝামেলায় পড়লেন। দুই ছেলের মন যাতে রাখতে পারেন এমন কোন উত্তর দেওয়ার উপায় নেই এ পরিস্থিতিতে। একটা সাইড বেছে নিতেই হবে ওনাকে। দুই ছেলের দিকে নার্ভাস ভঙ্গীতে তাকালেন ওনি।
.
সুমন এগিয়ে এসে মায়ের হাত ধরল। বলল, "মা ভেবোনা। আমি আছি তোমার সাথে। তুমি শুধু এটুকু বলে দাও যে তুমি এখানে থাকতে চাওনা। প্রাণের বিনিময়ে হলেও তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব আমি।"
.
মা শওকতের দিকে তাকিয়ে বললেন, "বাবা শওকত, তোর এখানে নীলুফার আছে। সুমন একা থাকে। ওর সঙ্গে থাকাটা তো আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে, তাই না? তাছাড়া আমি তো আসব মাঝেমধ্যে। তোর এখানে আসা-যাওয়া থাকবে। তুই মন খারাপ করিস না বাপ।"


সেদিন রাতে শওকত মন খারাপ করে বসেছিল নিজের বিছানায়। তার একমাত্র ছেলে শুভ এসে বলল, "বাবা, দাদিমা যদি সুমন চাচ্চুর ওখানে যায়। আমিও সুমন চাচ্চুর ওখানে যাবো। দাদিমার সাথে থাকবো!

শওকত বলল, "কোথাও যাচ্ছেনা তোর দাদী।নাটক হচ্ছে সব। সুমন আমার মাথাটাই খারাপ করে দিয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে আবার ফিরে আসবে তোর দাদীএখানে।"
.
"ঠিক আছে তো বাবা আমিও ফিরে আসব কয়েকদিনের মধ্যে। দাদিমার সাথে থাকবো। প্লিজ বাবা, প্লিজ।!

৩।

ইন্সপেক্টর সাজ্জাদের মুখোমুখি চেয়ারে বসে আছে শওকত।
শওকতকে চুপচাপ দেখে ইন্সপেক্টর বললেন, "নিজের মায়ের খুন! কেন খুন করলেন মি.শওকত?"
.
"দেখুন ইন্সপেক্টর" শওকত বলল, "আপনারা পুলিশের লোক। প্লিজ লোকের কথায় কান দেবেন না। যা শুনছেন, যা দেখছেন তা আদৌ সত্য নয়।"
.
"তাহলে সত্যিটা কী মি. শওকত? আপনি আপনার মায়ের খুনের কেসে অভিযুক্ত আছেন। তাহলে আপনার বিরুদ্ধে আনিত আভিযোগ কিভাবে মিথ্যা হতে পারে?"
.
"যেটা ঘটেছিল সেটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র, স্রেফ এক্সিডেন্ট। আর আমাকে অত্যন্ত চালাকির সাথে ফাঁসিয়ে দেয়া হয়েছে।"
.
"আপনি পিস্তল কিনেছিলেন?"
.
"হ্যা, কিন্তু সেটা কাওকে খুন করার জন্য নয়। ভয় দেখানোর জন্য কিনেছিলাম।"
.
"কাকে ভয় দেখাতে?"
.
বিশেষ কাওকে নয়। ধরুন কেউ এটাক করল আমাদের, হামলা করল দোকানে - আপনি তো জানেন আমাদের ডায়মন্ডের দোকান - বলতে পারেন একধরনের আত্মরক্ষার জন্যই কিনেছিলাম পিস্তলটা।"
.
কিন্তু যে পিস্তলটা কাওকে ভয় দেখানোর জন্য কিনেছিলেন, সে পিস্তল দিয়েই আপনি আপনার মাকেই খুন করে ফেললেন, এমনটা কেন মি. শওকত?
.
দেখুন, আমি আপনাকে আগেই বলেছি ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল। আমি আমার মাকে খুন করিনি, আমি আমার মাকে খুব ভালবাসতাম। আমি...
.
কথাটা শেষ করতে না দিয়ে ইনস্পেক্টর বলে উঠলেন, "কিন্তু হয়তো আপনার ছেলে আপনাকে ভালবাসেনা মি. শওকত।" কথাটা বলেই শওকতের চোখে চোখ রাখলেন ইন্সপেক্টর। শওকত কি এখন একটু নার্ভাস? কিংবা তার চোখ কি একটু ছলছল করছে? ইন্সপেক্টর সাজ্জাদ জানে মানুষের চোখ অনেক কিছু বলে দেয়, কিন্তু এ মানুষটার চোখ কেমন গোলমেলে, বিভ্রান্তিকর। ইন্সপেক্টর বলছেন, "আপনার ছেলে আপনার সাথে থাকেনা কেন? কেন সে তার চাচার সাথে থাকে?"
.
"এর জন্য সুমন দায়ী। ওর জন্যই আমি সব হারিয়েছি! সুমনের প্ল্যান ছিল, মাকে তার সঙ্গে রেখে, ভুলিয়েভালিয়ে মায়ের সব প্রপার্টি হাতিয়ে নেয়া। যাতে আমি কিচ্ছু না পাই।"
.
"কিন্তু আপনার ছেলে শুভ কেন আপনার সাথে থাকেনা। বাবার কাছে না থেকে চাচার কাছে থাকতে পছন্দ করছে, এমনটি কেন?"
.
"দেখুন, শুভ তার চাচার সাথে নয় তার দাদীর সাথে থাকতো। ও বাড়ীর একমাত্র নাতী। আমার স্ত্রী মারা যাবার পর দাদীর আদর স্নেহ পেয়ে পেয়ে বড় হয়েছে। ও ওর দাদী ছাড়া একেবারেই থাকতে পারতোনা। তাই ও মায়ের সাথে সুমনের ওখানে চলে গেছে।"
.
"ঠিক আছে মানলাম আপনার কথা। কিন্ত পিস্তল থেকে গুলিটা তো বেরুল! আর আপনি বলছেন আপনি আপনার মাকে খুন করেন নি।"
.
"আমার মাথা ভীষণ গরম ছিল। কারণ ও প্রত্যেকদিন আমার ব্যাপারে মা আর আমার ছেলের মন বিষিয়ে তুলছিল। সেজন্য আমি ভেবেছিলাম একটা পিস্তল কিনে ওকে ভয় দেখানো দরকার।"
.
"কিন্তু ১০ মিনিটও আগেও আপনি বলেছিলেন, "ডায়মন্ডের দোকান" "এটাক" "আত্মরক্ষা। ইত্যাদি, ইত্যাদি।"

বোবা হয়ে গেল শওকত। পুলিশের জেরায় কখন যে ও সত্য বলতে শুরু করেছে তার খেয়ালই নেই।
.
"মি. শওকত আপনি এটাও বলবেন ওটাও বলবেন। তাহলে কেউ কিচ্ছু বিশ্বাস করবেনা।"
.
"বিশ্বাস করার দরকার নাই। আমি একটা কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। কিন্তু সত্য এটাই যে, আমি সত্যি সত্যিই সুমনকে ভয় দেখানোর জন্য পিস্তল নিয়ে ওর বাড়ী গিয়েছিলাম। কাওকে খুন করার জন্য যায়নি।" কাঁদতে শুরু করল শওকত। "আমি আমার মাকে মারতে চায়নি, কেউ কি তার মাকে মারতে পারে?"
.
"পারে মি. শওকত পারে। এই যেমন আপনি পেরেছেন। পৃথিবীতে অনেক কিছুই ঘটে শওকত সাহেব... আপনি নিশ্চয় জানেন আপনার একমাত্র ছেলে শুভ, আপনার বিরুদ্ধেই স্টেটমেন্ট দিয়েছে!"

৪।
সুমনের ড্রয়িংরুমে বসে আছে ওরা তিনজন। সুমন, নীলুফার আর শুভ। ছোটবেলায় শুভ মাকে হারিয়েছে, আর এখন বাবা থেকেও নেই - শওকতের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে!
.
শুভ বলল, "বাবা কি করে পারলো দাদিমাকে গুলি করতে!"
.
শুভ কাঁদছে। সে পৃথিবীর সবার থেকে, সবকিছু থেকে তার দাদিমাকে বেশি ভালবাসতো।
.
নীলুফার চুপ করে আছে। শুভর এ প্রশ্নের কী উত্তর দিবে সে! সুমন শুভকে বুকে টেনে নিল। মাথায় হাত বুলাতে লাগল ওর। সুমনের মনে পড়ে যাচ্ছে সেদিনের ঘটনা - পিস্তল নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করতে করতে হঠাৎ তার চোখে পড়ল, পিস্তলের নলটা তার মায়ের হৃৎপিন্ড বরাবর তাক করা। হঠাৎ করেই তার মাথাটা পরিষ্কার হয়ে গেল। দ্রুত চিন্তা শুরু করল ওর মস্তিষ্ক -- রাগে ভাইয়ার হুঁশ নেই, ট্রিগারে ভাইয়ার আঙ্গুল, নলটা মায়ের দিকে তাক করা -- মায়ের সব প্রপার্টি একসাথে পেয়ে যাওয়ার এর চেয়ে বড় সুযোগ আর সে পাবেনা। আলগোছে ভাইয়ার আঙ্গুলের উপর আঙ্গুল রেখে ট্রিগারটা টিপে দিলো ও! ভাইয়ার অবস্থা তখন এমন যে সে নিজেও মনে করছে ভুল করে ট্রিগার সেই টেনে দিয়েছে!
.
সুমনের বুকে মাথা রেখে কেঁদেই চলছে শুভ। নীলুফার অন্যমনষ্ক হয়ে মাথা নিচু করে আছে। নইলে সে দেখতে পেত, শুভর মাথায় হাত বুলাতে থাকা সুমনের ঠোঁটে ক্রুর হাসি ফুটে আছে ...
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৫৪৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৩/০৯/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast