বেলকনি
ঘুম ভাঙতেই বালিশের তলা থেকে এন্ড্রয়েড মোবাইলটা বের করে নিল ইরফান। ডিসপ্লেতে দেখল ভোর চারটা বাজে। যখনই ঘুম ভাঙুক সে সময় দেখে। এর পেছনের মনস্তাত্ত্বিক কারণ কি, কে জানে? ওর ধারণা বেশিরভাগ মানুষ তাই করে। এমন তো না যে সে খুব পাংকচুয়াল। বরং উল্টো। তার সবকিছুতেই লেইট হয়ে যায়। তবে একটা ঘটনার সময় সে সঠিক সময় উপস্থিত ছিল - মর্মান্তিক সঠিক সময়!
.
আলো এখনো ভালো করে ফোটে নি, এখনো অন্ধকার গাঢ় হয়ে আছে। এরকম আলো-আঁধারি ভোরে, ইরফান জানেনা কেন তার মনটা অন্যরকম হয়ে যায়। মনে হয় এরকম সময়ে পৃথিবীর কারো মনেই কোন অপবিত্র চিন্তা স্থান পেতে পারেনা। নিজেক কেমন নিষ্কলুষ, পবিত্র আর ফুরফুরে লাগে।
.
বিছানায় উঠে বসল ও। ওর পাশের বেডে ফয়সাল ঘুমিয়ে আছে। বেলকনি দিয়ে আসা আবছা আলোয় সে দেখল, ফয়সালের লুঙি কোমরে উঠে গেছে। আচ্ছা, ভাবছে ইরফান, ঘুমের মধ্যে লুঙি কোমরে উঠে যাওয়াটা কি শুধু ব্যাচেলরদের সমস্যা? এর মধ্যে কি কোন ফ্রয়েডিয় ব্যাপার স্যাপার আছে? - বিপুলা এ ধরণীর কতটুকু জানি?
.
ফয়সালের বালিশের তলায় রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিল ও। স্মোকার বলতে যা বুঝায় ও ঠিক তা নয়, তবে মাঝেমধ্যে খেতে তার ভালই লাগে। তাছাড়া ফ্রীতে যখন খাচ্ছে তখন ভাল কি আর মন্দ কি। ফয়সাল বলে ফ্রীতে পেলে নাকি বিষও মন্দ নয়।
.
কিচেনে গিয়ে চুলায় চায়ের ছোট "ডেকচি" বসিয়ে দিল ও। সে এত নিঃশব্দে কাজ করছিল যাতে মেসের কারোই ঘুম না ভাঙে। কিন্তু কখন যে ওর পেছনে মেস পরিচালক কবির ভাই এসে দাঁড়িয়েছেন তা খেয়ালই করেনি।
.
তিনি বললেন, "চা হচ্ছে নাকি?"
"হ্যাঁ।"
"আজ এত সকাল সকাল উঠে গেছেন? ঘটনা কী? শরীর খারাপ নাকি?"
"জি না। চা খাবেন কবির ভাই?
"দেন এক কাপ।"
"ইরফান ভাই!"
"জি বলুন।"
"এরকম লাগছে কেন আপনাকে? কিছু হয়েছে নাকি?"
"না, কী হবে?"
"সিগারেটও খাচ্ছেন?"
"না, এমনি, মাঝেমধ্যে খাই তো!"
"সেই মাঝেমধ্যেটা কখন সেটা তো আমি জানি ইরফান ভাই!"
ও চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। ইরফান নরম স্বরে ডাকল, "কবির ভাই।"
"হুম, বলেন"
"আজ আমার কেন জানি বড় ভালো লাগছে।"
"ভালো লাগার কী হল আবার?"
.
এ কথাটা বলেই কবির ভাই কিচেন থেকে বের হয়ে চলে আসলেন। ইরফান ছেলেটার জন্য খুব মায়া হয় ওনার। ইরফানের আজ কেন ভাল লাগছে তা কবির ভাই জানে। আজ তেরোই জুন। এ দিনই ইরার সাথে ইরফান প্রথম ফোনে কথা বলেছিল।
.
ইরা মেয়েটা ওদের মুখোমুখি বিল্ডিংএ থাকতো। খুবই সাধারণ মেয়ে। গড়পড়তা চেহেরা। কিন্তু ইরফান সমস্ত দিন-রাত এমনভাবে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতো যেন আর কিছুক্ষণ ওয়েট করলেই মেরিলিন মনেরোকে দেখা যাবে।
.
ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক, কিংবা প্রচণ্ড টর্নেডো হোক। কিছুই আসে যায় না। ইরাকে এক পলক দেখার জন্য সে তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতো।
.
একদিন ইরার বাবা কি কারণে জানি ওনাদের বেলকনিতে বসে ছিলেন। ইরফানকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপালের চামড়ায় ভঁজ ফেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।
.
মিনিট দশেক পর ইরার বাবা মেসে এসে হাজির। কারো সাথে কোন কথা নয়, বিশালদেহী ভদ্রলোক সোজা এসে ইরফানের গাল প্রচন্ড জোরে থাপ্পড় লাগালেন! সবাই হতভম্ব দৃশ্যটা দেখল শুধু!
.
কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, থাপ্পড়ের চোটে কয়েকটা দাঁত খুলে যাওয়ার বদলে ইরফানের ভাগ্য খুলে গেল। সেদিন বিকেলে, ইরা মেয়েটি ওদের বেলকনি থেকে, একটা বড় কাগজে ওর মোবাইল নাম্বার লিখে দিয়ে, ওর সাথে ফোনে কথা বলার জন্য ইশারা করেছিল ইরফানকে!
.
ব্যস শুরু হয়ে গেল নতুন অধ্যায়। বিকেলবেলা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা, আর রাতের বেলা ঘন্টার ঘন্টা কথা বলা নিয়মিত রুটিন হয়ে পড়ল ওদের।
.
একদিন ওরা সিদ্ধান্ত নিল এবার বাইরে কোথাও দেখা করবে ওরা, কিন্তু ওদের এই প্রথম দেখাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ওরা ঠিক করল ১৪ই ফেব্রুয়ারিই দেখা করবে- তার আগে না।
.
শুরু হল অপেক্ষা! কিন্তু বেলকনির সরাসরি সম্প্রচার এবং মোবাইলে অডিও সম্প্রচার বন্ধ হলনা, চলতেই থাকল।
.
অবশেষে এল সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। দেখা করল দুজন, সারাদিন ঘুরে বেড়াল ওরা। আনন্দে ঝলমল করে উঠলো ওদের সমস্ত আকাশ ও পৃথিবী!
.
কিন্তু ভাগ্যবিধাতা অন্যরকম পরিকল্পনা করে রেখেছিল ওদের জন্য!
.
সন্ধ্যায় ফিরে আসছিল ওরা দুজন। শাহবাগ মোড়ের একটা পিকআপ ভ্যান ইরফানের চোখের সামনেই কেড়ে নিল ইরার জীবন। ইরফান শুধু রক্ত দেখেছিল, আর কিছু নয়। ইরাকে ইরফান ছঁয়েও দেখতে পারেনি, কিছু বুঝে উঠার আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল ও।
.
ইরফানের জ্ঞান ফিরে প্রায় তিরিশ ঘন্টা পর। কিন্তু ইরার করুণ মৃত্যুতে সে অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। ওকে ওর বাবা-মা অনেকবারই ওদের নিজেদের বাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রতিবারই সে এই মেসে ফিরে আসে। প্রায় সমস্ত দিন, সমস্ত রাত বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে ও। এর ওর কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে খায় মাঝেমাঝে। ওর মধ্যে চোখে পড়ার মত তেমন বড় কোন অস্বাভাবিকতা নেই। সবার সঙ্গে নম্র ব্যবহার।
.
এভাবেই কেটে গেছে চারটি বছর!
.
কবির ভাই বেলকনিতে এসে দেখল আলো ফুটে বাইরে ফর্সা হতে শুরু করেছে। আকাশ হালকা নীল। পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। ইরফান যথারীতি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। ইরাদের বেলকনিতে একটা চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছে ইরার বাবা। মাঝেমাঝে ইরফানের দিকে তাকাচ্ছেন ওনি। তার চোখে নেই রাগ, কিংবা অভিমান। ইরাকে নিয়েও কোনরকম কষ্ট পাননা এখন ওনি। ইরফানের মতো ছেলের ভালবাসা যারা পায়, তারা মহা-ভাগ্যবতী; তাদের নিয়ে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই!
.
আলো এখনো ভালো করে ফোটে নি, এখনো অন্ধকার গাঢ় হয়ে আছে। এরকম আলো-আঁধারি ভোরে, ইরফান জানেনা কেন তার মনটা অন্যরকম হয়ে যায়। মনে হয় এরকম সময়ে পৃথিবীর কারো মনেই কোন অপবিত্র চিন্তা স্থান পেতে পারেনা। নিজেক কেমন নিষ্কলুষ, পবিত্র আর ফুরফুরে লাগে।
.
বিছানায় উঠে বসল ও। ওর পাশের বেডে ফয়সাল ঘুমিয়ে আছে। বেলকনি দিয়ে আসা আবছা আলোয় সে দেখল, ফয়সালের লুঙি কোমরে উঠে গেছে। আচ্ছা, ভাবছে ইরফান, ঘুমের মধ্যে লুঙি কোমরে উঠে যাওয়াটা কি শুধু ব্যাচেলরদের সমস্যা? এর মধ্যে কি কোন ফ্রয়েডিয় ব্যাপার স্যাপার আছে? - বিপুলা এ ধরণীর কতটুকু জানি?
.
ফয়সালের বালিশের তলায় রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিল ও। স্মোকার বলতে যা বুঝায় ও ঠিক তা নয়, তবে মাঝেমধ্যে খেতে তার ভালই লাগে। তাছাড়া ফ্রীতে যখন খাচ্ছে তখন ভাল কি আর মন্দ কি। ফয়সাল বলে ফ্রীতে পেলে নাকি বিষও মন্দ নয়।
.
কিচেনে গিয়ে চুলায় চায়ের ছোট "ডেকচি" বসিয়ে দিল ও। সে এত নিঃশব্দে কাজ করছিল যাতে মেসের কারোই ঘুম না ভাঙে। কিন্তু কখন যে ওর পেছনে মেস পরিচালক কবির ভাই এসে দাঁড়িয়েছেন তা খেয়ালই করেনি।
.
তিনি বললেন, "চা হচ্ছে নাকি?"
"হ্যাঁ।"
"আজ এত সকাল সকাল উঠে গেছেন? ঘটনা কী? শরীর খারাপ নাকি?"
"জি না। চা খাবেন কবির ভাই?
"দেন এক কাপ।"
"ইরফান ভাই!"
"জি বলুন।"
"এরকম লাগছে কেন আপনাকে? কিছু হয়েছে নাকি?"
"না, কী হবে?"
"সিগারেটও খাচ্ছেন?"
"না, এমনি, মাঝেমধ্যে খাই তো!"
"সেই মাঝেমধ্যেটা কখন সেটা তো আমি জানি ইরফান ভাই!"
ও চুপ করে রইল। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। ইরফান নরম স্বরে ডাকল, "কবির ভাই।"
"হুম, বলেন"
"আজ আমার কেন জানি বড় ভালো লাগছে।"
"ভালো লাগার কী হল আবার?"
.
এ কথাটা বলেই কবির ভাই কিচেন থেকে বের হয়ে চলে আসলেন। ইরফান ছেলেটার জন্য খুব মায়া হয় ওনার। ইরফানের আজ কেন ভাল লাগছে তা কবির ভাই জানে। আজ তেরোই জুন। এ দিনই ইরার সাথে ইরফান প্রথম ফোনে কথা বলেছিল।
.
ইরা মেয়েটা ওদের মুখোমুখি বিল্ডিংএ থাকতো। খুবই সাধারণ মেয়ে। গড়পড়তা চেহেরা। কিন্তু ইরফান সমস্ত দিন-রাত এমনভাবে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকতো যেন আর কিছুক্ষণ ওয়েট করলেই মেরিলিন মনেরোকে দেখা যাবে।
.
ঝড় হোক, বৃষ্টি হোক, কিংবা প্রচণ্ড টর্নেডো হোক। কিছুই আসে যায় না। ইরাকে এক পলক দেখার জন্য সে তীর্থের কাকের মতো দাঁড়িয়ে থাকতো।
.
একদিন ইরার বাবা কি কারণে জানি ওনাদের বেলকনিতে বসে ছিলেন। ইরফানকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কপালের চামড়ায় ভঁজ ফেলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন।
.
মিনিট দশেক পর ইরার বাবা মেসে এসে হাজির। কারো সাথে কোন কথা নয়, বিশালদেহী ভদ্রলোক সোজা এসে ইরফানের গাল প্রচন্ড জোরে থাপ্পড় লাগালেন! সবাই হতভম্ব দৃশ্যটা দেখল শুধু!
.
কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, থাপ্পড়ের চোটে কয়েকটা দাঁত খুলে যাওয়ার বদলে ইরফানের ভাগ্য খুলে গেল। সেদিন বিকেলে, ইরা মেয়েটি ওদের বেলকনি থেকে, একটা বড় কাগজে ওর মোবাইল নাম্বার লিখে দিয়ে, ওর সাথে ফোনে কথা বলার জন্য ইশারা করেছিল ইরফানকে!
.
ব্যস শুরু হয়ে গেল নতুন অধ্যায়। বিকেলবেলা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকা, আর রাতের বেলা ঘন্টার ঘন্টা কথা বলা নিয়মিত রুটিন হয়ে পড়ল ওদের।
.
একদিন ওরা সিদ্ধান্ত নিল এবার বাইরে কোথাও দেখা করবে ওরা, কিন্তু ওদের এই প্রথম দেখাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ওরা ঠিক করল ১৪ই ফেব্রুয়ারিই দেখা করবে- তার আগে না।
.
শুরু হল অপেক্ষা! কিন্তু বেলকনির সরাসরি সম্প্রচার এবং মোবাইলে অডিও সম্প্রচার বন্ধ হলনা, চলতেই থাকল।
.
অবশেষে এল সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। দেখা করল দুজন, সারাদিন ঘুরে বেড়াল ওরা। আনন্দে ঝলমল করে উঠলো ওদের সমস্ত আকাশ ও পৃথিবী!
.
কিন্তু ভাগ্যবিধাতা অন্যরকম পরিকল্পনা করে রেখেছিল ওদের জন্য!
.
সন্ধ্যায় ফিরে আসছিল ওরা দুজন। শাহবাগ মোড়ের একটা পিকআপ ভ্যান ইরফানের চোখের সামনেই কেড়ে নিল ইরার জীবন। ইরফান শুধু রক্ত দেখেছিল, আর কিছু নয়। ইরাকে ইরফান ছঁয়েও দেখতে পারেনি, কিছু বুঝে উঠার আগেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল ও।
.
ইরফানের জ্ঞান ফিরে প্রায় তিরিশ ঘন্টা পর। কিন্তু ইরার করুণ মৃত্যুতে সে অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে। ওকে ওর বাবা-মা অনেকবারই ওদের নিজেদের বাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু প্রতিবারই সে এই মেসে ফিরে আসে। প্রায় সমস্ত দিন, সমস্ত রাত বেলকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে ও। এর ওর কাছ থেকে সিগারেট নিয়ে খায় মাঝেমাঝে। ওর মধ্যে চোখে পড়ার মত তেমন বড় কোন অস্বাভাবিকতা নেই। সবার সঙ্গে নম্র ব্যবহার।
.
এভাবেই কেটে গেছে চারটি বছর!
.
কবির ভাই বেলকনিতে এসে দেখল আলো ফুটে বাইরে ফর্সা হতে শুরু করেছে। আকাশ হালকা নীল। পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে। ইরফান যথারীতি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। ইরাদের বেলকনিতে একটা চেয়ারে বসে পত্রিকা পড়ছে ইরার বাবা। মাঝেমাঝে ইরফানের দিকে তাকাচ্ছেন ওনি। তার চোখে নেই রাগ, কিংবা অভিমান। ইরাকে নিয়েও কোনরকম কষ্ট পাননা এখন ওনি। ইরফানের মতো ছেলের ভালবাসা যারা পায়, তারা মহা-ভাগ্যবতী; তাদের নিয়ে কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই!
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ২০/০৯/২০১৮পড়ছি।
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ২০/০৯/২০১৮পড়তে ভালো লাগলো।