আলোকিত সুখ
১।
মুখ বেজার করে দোকানের ক্যাশে বসে আছে সোহেল। ওর মেজাজ খারাপ হয়ে আছে সকাল থেকেই - বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বউএর সাথে বিশ্রী ঝগড়া। স্ত্রীর সাথে কথায় পারে এমন কোন স্বামীটি আছে পৃথিবীতে? বউএর সাথে কথায় না পেরে সে রাগ করে উঠোনে রাখা বালতিতে সজোরে লাথি দেয়, কিন্তু কে জানতো বালতিটা বালিতে ভর্তি!
পায়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে দোকানে চলে আসে সে। অন্যান্য দিনের মতোই বিকিকিনি চলছিল। এক কাস্টমার এসে বলল, তাকে চার কিলো চালে দুশ গ্রাম চাল কম দেয়া হয়েছে, সে অন্য দোকান থেকে মাপিয়ে এনেছে। সোহেল মেশিনে মেপে দেখে আসলেই দুশো গ্রাম কম।
কাস্টমার তাকে উপদেশের সুরে বললেন, "এভাবেই ব্যবসা করেন, না? সুরা আর রহমান এর ৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘"তোমরা সঠিক ওজন কায়েম করো এবং ওজনে কম দিও না।’"
এসব নানা কারণে ওর মেজাজ যখন তিড়িক্ষি ঠিক তখনই শওকত সাহেব এলেন তার কাছ থেকে ডিম কিনতে।
শওকত সাহেব ডিম কেনার সময় নিজ হাতে নাড়াচাড়া করে দেখে কিনেন। সোহেল ওনাকে পছন্দ করেন। সে জানে ওনিও পছন্দ করেন সোহেলকে। ভালোবাসা টের পাওয়া যায়। কিন্তু আজকে ওনার এ নেড়েচেড়ে দেখাটা বিরক্ত লাগতেছে। চেষ্টা করছিল বিরক্তিটা যাতে প্রকাশ পেয়ে না যায়। কিন্তু শওকত সাহেব যখন বললেন, "আজকে তোমার ডিমগুলো এত ছোট কেন?"
সঙ্গে সঙ্গে সারাদিনের সমস্ত রাগ বিষ্ফোরিত হল সোহেলের। সে বলল, "আমার ডিম মানে? ডিম কি আমি পাড়ছি? আর ডিম ছোট মানে? জানেন এই ডিম পাড়তে মুরগীর ***র উপর দিয়ে কি গেছে? মুরগীর কষ্ট বুঝেন? বুঝবেন ক্যামনে? নিজে তো কখনো পাড়েন নাই! ***ফেটে রক্ত বের হয়ে যায় এক একটা ডিম পাড়তে। ডিমের গায়ে রক্ত লেগে থাকে, দেখেছেন কখনো? আর আপনি বলেন ডিম ছোট। আবার কলেজেও পড়ান!"
কথাগুলো বলার পর সোহেলের রাগ কিছুটা পড়ে গেল এবং এটুকু হুঁশও সে ফিরে পেয়েছে যে, তার পক্ষ থেকে বড় অন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে ততক্ষনে।
শওকত সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন সোহেলের ব্যবহারে। অধিক শোকে পাথর হয়ে যাওয়ার অবস্থা ওনার! এগুলো কি ধরনের কথাবার্তা?
ততক্ষণে দোকানটা ঘিরে মানুষের জটলা তৈরি হয়ে গেছে। এবং ক্রমশ তা বাড়ছে। ঝগড়া দেখার মতো বিনোদন আর নেই, হাতাহাতি হলে মজাটা আরও বেশি জমে। তবে হাতাহাতি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ মধ্যবয়সী কাস্টমারটা হচ্ছেন শওকত সাহেব, তিমি খুবই নম্র ভদ্র মানুষ। কথা কাটাকাটিকে মারামারি পর্যন্ত গড়াতে দেবেন বলে মনে হয়না।
পাথর ভাবটা কাটিয়ে উঠে শওকত সাহেব বললেন, "তুমি এসব কি বলছো সোহেল? এগুলো কি ধরনের অসভ্যতা?"
মানুষের জটলা দেখে সোহেল একটু ভয় পেয়ে গেছে। কেননা ঘটনা যদি প্রকাশ পায়, সবাই নিশ্চিত শওকত সাহেবেরই পক্ষ নেবে। কারণ একে তো কলেজে পড়ান শওকত সাহেব, তার উপর সবার সাথে অত্যন্ত নম্র ব্যবহার করেন ওনি। পাবলিক সিমপ্যাথি এমনিতে ওনার পক্ষে যাবে। পরে দেখা যাবে ওকে সবার সামনে ক্ষমা চাইতে হবে। মান সম্মানের ব্যাপার। তাই নিজেকে বাঁচানোর জন্য সে চালাকি করে বলল, "বাকি দিচ্ছিনা বলে এখন অসভ্য হয়ে গেলাম?এতদিন তো বেশ হেসে হেসেই কথা বলতেন। আজ একেবারে চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলছেন!"
শওকত সাহেব আহত গলায় বললেন, "বাকির টাকা কিন্তু বিষয় না সোহেল! তুমি আমার সাথে খারাপ ব্যাবহার করলে কেন সেটা আমি জানতে চাই? আমি কিন্তু তোমার বাপের বয়সী, আমার সাথে এরকম ব্যবহার তুমি করতে পারোনা! আমি তোমার ইয়ার-দোস্ত না যে এরকম কতগুলো কথা তুমি আমাকে বলতে পার?"
জটলা থেকে একজন বলল, "ঘটনা কি ভাই? কি হইছে? কি বলছে?"
শওকত সাহেব বললেন, "দোকানদারকে জিজ্ঞেস করেন কি হইছে?"
সোহেল বলল, "ক্যান? আপনে বলতে পারেননা? আপনার মুখ নাই?"
সোহেল জানে ঘটনাটা শওকত সাহেবের পক্ষে বলা সম্ভব না। শিক্ষিত মানুষ। এমন কথা বলতে ওনার সুক্ষ্ম রুচিতে বাধবে। আর এ সুযোগটাই ও কাজে লাগাতে চাচ্ছে নিজেকে বাঁচানোর জন্য।
জটলার মানুষজন শওকত সাহেবের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে, যাতে তিনি কিছু বলেন। কিন্তু ভীষণ সঙ্কোচ হল ওনার। কৌতুহলী জনতাকে কিছুই বলতে পারেন নি ওনি। জটলার মাঝখান দিয়ে, ভগ্নহৃদয় নিয়ে ওনি চুপচাপ চলে আসলেন দোকান থেকে।
২।
বাজার থলে হাতে বাসার দিকে হাঁটছেন শওকত সাহেব। মনট খুবই খারাপ। ছেলেটা ওর সাথে এত খারাপ ব্যবহার করল কেন? সোহেলকে তো ওনি পছন্দই করেন। ভালবাসার বিনিময় মানুষ এভাবেই দেয়?
বাইরে চমৎকার বিকেল, মন ভাল করে দেয়া একটা হাওয়া বয়ে গেছে শরীর ছুঁয়ে অথচ শওকত সাহেবের মনে হচ্ছে সমস্ত চরাচর বিষণ্ণ হয়ে আছে। আসলে মনের উপর পরিবেশের প্রভাব খুব জোরালো নয়, মনের সুখটাই আসল ব্যাপার। মনে ফুর্তি থাকলে মেঘলা দিনও ঝাল চানাচুর আর মুড়িতে উপভোগ্য হয়ে উঠে। আর মন খারাপ থাকলে উজ্জ্বল রোদের রুপোলী বিকেলও পরীক্ষায় ফেল করার মতো বিস্বাদ লাগে।
"স্যার, ও স্যার!"
তাকে কি কেউ ডাকছে? ভাবছেন শওকত সাহেব। বয়স বাড়ার সাথে শ্রবণ শক্তি কমতে শুরু করেছে, এরকমই হয়। একটা সময় আসবে হয়ত শুনতেই পাবেন না আর! এভাবে একদিন সমস্ত ইন্দ্রিয় অকেজো হয়ে গিয়ে ধুকপুক করা হৃৎপিন্ডটা বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর কি যে হবে সেটা ভেবে আর কূল পাননা শওকত সাহেব।
"ও স্যার! একটু দাঁড়ান না!"
এবার পেছন ফিরে তাকালেন শওকত সাহেব। দেখলেন, সোহেল ছেলেটা এক প্রকার দৌড়ে এগিয়ে আসছে ওনার দিকে। সোহেলের হাতে কাগজের একটা ঠোঙ্গা, দুহাতে সাবধানে ধরে আছে ওটা। ব্যাপার কী? ওনার কাছে আসছে কেন সোহেল? ভাবছেন শওকত সাহেব।
সোহেল কাছে এসে বলল, "আমাকে মাফ করে দেন স্যার। সকাল থেকেই মেজাজটা খারাপ ছিল, তাই আপনাকে কি বলতে কি বলে ফেলছি তার হুঁশ ছিলনা।"
শওকত সাহেব চুপ করে আছেন। কি বলবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না।
"স্যার মাফ করবেন না?" বলল সোহেল, "এই আপনার পায়ে ধরতেছি স্যার...
বলতে বলতেই সোহেল শওকত সাহেবের পা ধরতে গেল।
"আরে করো কি, করো কি" বাঁধা দিলেন শওকত সাহেব। "মাফ করে দিছি তোমাকে, মানুষের ভুল হয়!"
"তাহলে স্যার আপনাকে এ জিনিসটা নিতে হবে" হাতে ধরে রাখা ঠোঙ্গাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল সোহেল।
"কী এটা?" শওকত সাহেবের চোখে কৌতুহল।
"ডিম স্যার!"
"এত ডিম দিয়ে কি করব? ডিম আমি কিনেছি তো।"
"না না স্যার আপনাকে রাখতেই হবে, যদি না রাখেন, অথবা দাম দেয়ার কথা বলেন, তাহলে বুঝব আপনি আমাকে মাফ করেন নাই"
"ভারী মুশকিলে পড়া গেল তো... তোমার ব্যবহারে আমি খুশি হয়েছি, মাফও করে দিসি, কিন্তু ডিম দেয়া লাগবেনা। তুমি ডিম নিয়ে যাও।"
সোহেল ডিমের ঠোঙ্গাটা ওনার বাজার-ব্যাগের ভিতর জোর করে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,"স্যার আমি পাপী মানুষ, আপনার বদদোয়া নিয়ে পাপের ভার আর বাড়াতে চাইনা।" কথাটা বলেই হনহন করে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই দ্রুত চলতে শুরু করল ও, যেন ডিম ফেরত দেয়ার কোন সুযোগ শওকত সাহেব না পান।
শওকত সাহেব ওর চলে যাওয়ার তাকিয়ে রইল। মানুষ বড় অদ্ভুত। ঘটনা ঘটার সময় সোহেল ওর অপরাধ একটুকুও মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলনা। অথচ পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে চলে এসেছে এখন। কথায় বলে "মানুষের মন কুমোরের চাক, পলকে দেয় আঠারো পাক।" মনের অলিগলিতে কখন যে কি ঘটে যায় তার ঠিক নেই!
শওকত সাহেব বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। ওনার মনটা হঠাৎ করেই ভাল হয়ে গেছে, কিছুক্ষণ আগের মন খারাপ ভাবটা আর নেই। বিকেলের রুপোলী রোদকে আরো বেশি রুপোলী লাগছে। আনন্দে কানায় কানায় ভরে উঠেছে মনটা। মনে মনে ভাবছেন "মানুষ আসলে ভাল, পরম করুণাময় তার মধ্যে ভাল হতে চাওয়ার প্রবণতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। ভাল থাকার সুযোগ পেলে সে ভাল হয়ে উঠতে চায়। ভাল থাকার মধ্যে একধরণের সুখ আছে - আলোকিত সুখ! পৃথিবীতে সবাই এমনভাবে সুখ খুঁজে বেড়াচ্ছে যেন তা দুর্লভ কোন গুপ্তধন, অথচ সুখ খুঁজে পাওয়া কী সহজ! অন্যের জন্য কিছু একটা করাই হচ্ছে সুখ।মানুষ কেন যে এটা বুঝেনা কে জানে!"
মুখ বেজার করে দোকানের ক্যাশে বসে আছে সোহেল। ওর মেজাজ খারাপ হয়ে আছে সকাল থেকেই - বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বউএর সাথে বিশ্রী ঝগড়া। স্ত্রীর সাথে কথায় পারে এমন কোন স্বামীটি আছে পৃথিবীতে? বউএর সাথে কথায় না পেরে সে রাগ করে উঠোনে রাখা বালতিতে সজোরে লাথি দেয়, কিন্তু কে জানতো বালতিটা বালিতে ভর্তি!
পায়ে প্রচণ্ড যন্ত্রণা নিয়ে দোকানে চলে আসে সে। অন্যান্য দিনের মতোই বিকিকিনি চলছিল। এক কাস্টমার এসে বলল, তাকে চার কিলো চালে দুশ গ্রাম চাল কম দেয়া হয়েছে, সে অন্য দোকান থেকে মাপিয়ে এনেছে। সোহেল মেশিনে মেপে দেখে আসলেই দুশো গ্রাম কম।
কাস্টমার তাকে উপদেশের সুরে বললেন, "এভাবেই ব্যবসা করেন, না? সুরা আর রহমান এর ৯ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক বলেছেন, ‘"তোমরা সঠিক ওজন কায়েম করো এবং ওজনে কম দিও না।’"
এসব নানা কারণে ওর মেজাজ যখন তিড়িক্ষি ঠিক তখনই শওকত সাহেব এলেন তার কাছ থেকে ডিম কিনতে।
শওকত সাহেব ডিম কেনার সময় নিজ হাতে নাড়াচাড়া করে দেখে কিনেন। সোহেল ওনাকে পছন্দ করেন। সে জানে ওনিও পছন্দ করেন সোহেলকে। ভালোবাসা টের পাওয়া যায়। কিন্তু আজকে ওনার এ নেড়েচেড়ে দেখাটা বিরক্ত লাগতেছে। চেষ্টা করছিল বিরক্তিটা যাতে প্রকাশ পেয়ে না যায়। কিন্তু শওকত সাহেব যখন বললেন, "আজকে তোমার ডিমগুলো এত ছোট কেন?"
সঙ্গে সঙ্গে সারাদিনের সমস্ত রাগ বিষ্ফোরিত হল সোহেলের। সে বলল, "আমার ডিম মানে? ডিম কি আমি পাড়ছি? আর ডিম ছোট মানে? জানেন এই ডিম পাড়তে মুরগীর ***র উপর দিয়ে কি গেছে? মুরগীর কষ্ট বুঝেন? বুঝবেন ক্যামনে? নিজে তো কখনো পাড়েন নাই! ***ফেটে রক্ত বের হয়ে যায় এক একটা ডিম পাড়তে। ডিমের গায়ে রক্ত লেগে থাকে, দেখেছেন কখনো? আর আপনি বলেন ডিম ছোট। আবার কলেজেও পড়ান!"
কথাগুলো বলার পর সোহেলের রাগ কিছুটা পড়ে গেল এবং এটুকু হুঁশও সে ফিরে পেয়েছে যে, তার পক্ষ থেকে বড় অন্যায় হয়ে গেছে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে ততক্ষনে।
শওকত সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন সোহেলের ব্যবহারে। অধিক শোকে পাথর হয়ে যাওয়ার অবস্থা ওনার! এগুলো কি ধরনের কথাবার্তা?
ততক্ষণে দোকানটা ঘিরে মানুষের জটলা তৈরি হয়ে গেছে। এবং ক্রমশ তা বাড়ছে। ঝগড়া দেখার মতো বিনোদন আর নেই, হাতাহাতি হলে মজাটা আরও বেশি জমে। তবে হাতাহাতি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ মধ্যবয়সী কাস্টমারটা হচ্ছেন শওকত সাহেব, তিমি খুবই নম্র ভদ্র মানুষ। কথা কাটাকাটিকে মারামারি পর্যন্ত গড়াতে দেবেন বলে মনে হয়না।
পাথর ভাবটা কাটিয়ে উঠে শওকত সাহেব বললেন, "তুমি এসব কি বলছো সোহেল? এগুলো কি ধরনের অসভ্যতা?"
মানুষের জটলা দেখে সোহেল একটু ভয় পেয়ে গেছে। কেননা ঘটনা যদি প্রকাশ পায়, সবাই নিশ্চিত শওকত সাহেবেরই পক্ষ নেবে। কারণ একে তো কলেজে পড়ান শওকত সাহেব, তার উপর সবার সাথে অত্যন্ত নম্র ব্যবহার করেন ওনি। পাবলিক সিমপ্যাথি এমনিতে ওনার পক্ষে যাবে। পরে দেখা যাবে ওকে সবার সামনে ক্ষমা চাইতে হবে। মান সম্মানের ব্যাপার। তাই নিজেকে বাঁচানোর জন্য সে চালাকি করে বলল, "বাকি দিচ্ছিনা বলে এখন অসভ্য হয়ে গেলাম?এতদিন তো বেশ হেসে হেসেই কথা বলতেন। আজ একেবারে চৌদ্দ গুষ্টি উদ্ধার করে ফেলছেন!"
শওকত সাহেব আহত গলায় বললেন, "বাকির টাকা কিন্তু বিষয় না সোহেল! তুমি আমার সাথে খারাপ ব্যাবহার করলে কেন সেটা আমি জানতে চাই? আমি কিন্তু তোমার বাপের বয়সী, আমার সাথে এরকম ব্যবহার তুমি করতে পারোনা! আমি তোমার ইয়ার-দোস্ত না যে এরকম কতগুলো কথা তুমি আমাকে বলতে পার?"
জটলা থেকে একজন বলল, "ঘটনা কি ভাই? কি হইছে? কি বলছে?"
শওকত সাহেব বললেন, "দোকানদারকে জিজ্ঞেস করেন কি হইছে?"
সোহেল বলল, "ক্যান? আপনে বলতে পারেননা? আপনার মুখ নাই?"
সোহেল জানে ঘটনাটা শওকত সাহেবের পক্ষে বলা সম্ভব না। শিক্ষিত মানুষ। এমন কথা বলতে ওনার সুক্ষ্ম রুচিতে বাধবে। আর এ সুযোগটাই ও কাজে লাগাতে চাচ্ছে নিজেকে বাঁচানোর জন্য।
জটলার মানুষজন শওকত সাহেবের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকাচ্ছে, যাতে তিনি কিছু বলেন। কিন্তু ভীষণ সঙ্কোচ হল ওনার। কৌতুহলী জনতাকে কিছুই বলতে পারেন নি ওনি। জটলার মাঝখান দিয়ে, ভগ্নহৃদয় নিয়ে ওনি চুপচাপ চলে আসলেন দোকান থেকে।
২।
বাজার থলে হাতে বাসার দিকে হাঁটছেন শওকত সাহেব। মনট খুবই খারাপ। ছেলেটা ওর সাথে এত খারাপ ব্যবহার করল কেন? সোহেলকে তো ওনি পছন্দই করেন। ভালবাসার বিনিময় মানুষ এভাবেই দেয়?
বাইরে চমৎকার বিকেল, মন ভাল করে দেয়া একটা হাওয়া বয়ে গেছে শরীর ছুঁয়ে অথচ শওকত সাহেবের মনে হচ্ছে সমস্ত চরাচর বিষণ্ণ হয়ে আছে। আসলে মনের উপর পরিবেশের প্রভাব খুব জোরালো নয়, মনের সুখটাই আসল ব্যাপার। মনে ফুর্তি থাকলে মেঘলা দিনও ঝাল চানাচুর আর মুড়িতে উপভোগ্য হয়ে উঠে। আর মন খারাপ থাকলে উজ্জ্বল রোদের রুপোলী বিকেলও পরীক্ষায় ফেল করার মতো বিস্বাদ লাগে।
"স্যার, ও স্যার!"
তাকে কি কেউ ডাকছে? ভাবছেন শওকত সাহেব। বয়স বাড়ার সাথে শ্রবণ শক্তি কমতে শুরু করেছে, এরকমই হয়। একটা সময় আসবে হয়ত শুনতেই পাবেন না আর! এভাবে একদিন সমস্ত ইন্দ্রিয় অকেজো হয়ে গিয়ে ধুকপুক করা হৃৎপিন্ডটা বন্ধ হয়ে যাবে। তারপর কি যে হবে সেটা ভেবে আর কূল পাননা শওকত সাহেব।
"ও স্যার! একটু দাঁড়ান না!"
এবার পেছন ফিরে তাকালেন শওকত সাহেব। দেখলেন, সোহেল ছেলেটা এক প্রকার দৌড়ে এগিয়ে আসছে ওনার দিকে। সোহেলের হাতে কাগজের একটা ঠোঙ্গা, দুহাতে সাবধানে ধরে আছে ওটা। ব্যাপার কী? ওনার কাছে আসছে কেন সোহেল? ভাবছেন শওকত সাহেব।
সোহেল কাছে এসে বলল, "আমাকে মাফ করে দেন স্যার। সকাল থেকেই মেজাজটা খারাপ ছিল, তাই আপনাকে কি বলতে কি বলে ফেলছি তার হুঁশ ছিলনা।"
শওকত সাহেব চুপ করে আছেন। কি বলবেন কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না।
"স্যার মাফ করবেন না?" বলল সোহেল, "এই আপনার পায়ে ধরতেছি স্যার...
বলতে বলতেই সোহেল শওকত সাহেবের পা ধরতে গেল।
"আরে করো কি, করো কি" বাঁধা দিলেন শওকত সাহেব। "মাফ করে দিছি তোমাকে, মানুষের ভুল হয়!"
"তাহলে স্যার আপনাকে এ জিনিসটা নিতে হবে" হাতে ধরে রাখা ঠোঙ্গাটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল সোহেল।
"কী এটা?" শওকত সাহেবের চোখে কৌতুহল।
"ডিম স্যার!"
"এত ডিম দিয়ে কি করব? ডিম আমি কিনেছি তো।"
"না না স্যার আপনাকে রাখতেই হবে, যদি না রাখেন, অথবা দাম দেয়ার কথা বলেন, তাহলে বুঝব আপনি আমাকে মাফ করেন নাই"
"ভারী মুশকিলে পড়া গেল তো... তোমার ব্যবহারে আমি খুশি হয়েছি, মাফও করে দিসি, কিন্তু ডিম দেয়া লাগবেনা। তুমি ডিম নিয়ে যাও।"
সোহেল ডিমের ঠোঙ্গাটা ওনার বাজার-ব্যাগের ভিতর জোর করে ঢুকিয়ে দিয়ে বলল,"স্যার আমি পাপী মানুষ, আপনার বদদোয়া নিয়ে পাপের ভার আর বাড়াতে চাইনা।" কথাটা বলেই হনহন করে যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকেই দ্রুত চলতে শুরু করল ও, যেন ডিম ফেরত দেয়ার কোন সুযোগ শওকত সাহেব না পান।
শওকত সাহেব ওর চলে যাওয়ার তাকিয়ে রইল। মানুষ বড় অদ্ভুত। ঘটনা ঘটার সময় সোহেল ওর অপরাধ একটুকুও মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলনা। অথচ পায়ে ধরে ক্ষমা চাইতে চলে এসেছে এখন। কথায় বলে "মানুষের মন কুমোরের চাক, পলকে দেয় আঠারো পাক।" মনের অলিগলিতে কখন যে কি ঘটে যায় তার ঠিক নেই!
শওকত সাহেব বাসার দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। ওনার মনটা হঠাৎ করেই ভাল হয়ে গেছে, কিছুক্ষণ আগের মন খারাপ ভাবটা আর নেই। বিকেলের রুপোলী রোদকে আরো বেশি রুপোলী লাগছে। আনন্দে কানায় কানায় ভরে উঠেছে মনটা। মনে মনে ভাবছেন "মানুষ আসলে ভাল, পরম করুণাময় তার মধ্যে ভাল হতে চাওয়ার প্রবণতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। ভাল থাকার সুযোগ পেলে সে ভাল হয়ে উঠতে চায়। ভাল থাকার মধ্যে একধরণের সুখ আছে - আলোকিত সুখ! পৃথিবীতে সবাই এমনভাবে সুখ খুঁজে বেড়াচ্ছে যেন তা দুর্লভ কোন গুপ্তধন, অথচ সুখ খুঁজে পাওয়া কী সহজ! অন্যের জন্য কিছু একটা করাই হচ্ছে সুখ।মানুষ কেন যে এটা বুঝেনা কে জানে!"
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
sudipta chowdhury ২৮/১২/২০১৯Loving person is like "candle" in life
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ১৪/১০/২০১৮বেশ লাগল।