www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

মাইন্ড রিডার

১।
ইরফান তার রিডিং টেবিলে বসে বিভিন্ন বই ঘেঁটে নোট নিচ্ছে, এমন সময় তার মেসমেট কবির এসে বলল, "দোস্ত একটা ঝামেলা হয়ে গেছে"

"কী ঝামেলা?"

"ব্যাংক থেকে টাকা তোলে মেসে ফিরছি। টাকাটা পকেটমার হয়ে গেছে। শালার পকেটমার মনে হয় আমার উপর নজর রাখছিল। এখনো মেসের টাকাটা দিইনি। তোর কাছে হাজের তিনেক টাকা হবে? নেক্সট মাসে শোধ করে দেব"

ইরফান তার ড্রয়ার থেকে তিনটা ১ হাজার টাকার নোট কবিরকে দিল। যদিও সে জানে কবির মিথ্যা বলছে। টাকাটা আসলে সে ওর গার্লফ্রেন্ডের পেছনে খরচ করেছে। কোন পকেট-মার টার হয়নি। কিন্তু তবুও সে টাকাটা দিল কারণ টাকা ঠিক সময়ে পরিশোধ না করলে মেস পরিচালক মেস-মেম্বারের সাথে জঘন্য ব্যবহার করেন।

কবির টাকাটা হাতে নিয়ে বলল, "থ্যাংকস দোস্ত!"

কথাটা শুনার সঙ্গে সঙ্গে ইরফানের মন খারাপ হয়ে গেল। কারণ সে স্পষ্ট শুনতে পেল কবির মনে মনে বলছে, "শালা বলদ, একটা গল্প বানায়া বলছি,সেটাও বিশ্বাস করছে!"

২।

রুনা ভার্সিটি-লাইব্রেরীর এক কোনায় একটা বই নিয়ে বসেছে, কিন্তু সে পড়ছেনা। সে ওয়েট করছে কখন ইরফান নামের শুকনা, লম্বা ছেলেটা আসবে। ছেলেটা প্রায় প্রতিদিনই লাইব্রেরীতে আসে। পড়ে, নোট নেয়, কথাবার্তা তেমন বলেনা। বন্ধুরা আড্ডা দিলে চুপচাপ শুনে। ছেলেটা ওর ক্লাসমেট, তবে ওর সাথে কখনো কোন কথা হয়নি। ছেলেটাকে প্রচণ্ড ভাল লাগলেও আগ-বাড়িয়ে কথা বলতে তার ইচ্ছে হয়না।

ইরফান যখন লাইব্রেরীতে ঢুকল, সঙ্গে সঙ্গে রুনা বই পড়ার ভান করতে শুরু করল। আড়চোখে তাকাচ্ছে। ছেলেটাকে দেখলেই তার হার্ট-বিট বেড়ে যায়।

কিছুক্ষণ পর ওদের ক্লাসমেট আইরিন এসে ইরফানের মাথার চুল নেড়ে দিয়ে বলল "কি অবস্থা দোস্ত" বলেই ইরফানের পাশে বসল ও। ব্যাগ থেকে একটা সিংগারা-চমুচার প্যাকেট বের করল। "তোর জন্য দোস্ত।"

এ দৃশ্য দেখে গা জ্বলতে শুরু করল রুনার। জেলাসি কি জিনিষ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে ও। চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকতে কিন্তু ইতোমধ্যে ওর নাকটা ফুলে উঠেছে, গাল লাল টকটকে হয়ে গেছে। সে মনে মনে বলে উঠলো, "***টার এত দরদ কেন? ইরফান শুধু আমার, আমার!

তখনি রুনা খেয়াল করল ইরফান ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে!

সেদিনই ভার্সিটি থেকে যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল রুনা। পেছন থেকে ইরফান ওকে ডাকল। রুনা অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকাল। ইরফান কাছে এসে বল্ল, "বাসায় যাচ্ছো?

"হুম"

"তাড়া?"

"না, তেমন তাড়া নেই বলুন।"

"চল,কোথাও গিয়ে বসি, চা/কফি খাই। যাবে?"

রুনা মনে করতে পারছেনা সে আজ কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছে! মনে করতে পারলে অবশ্যই ওর জন্য একটা গিফট কিনবে ও।
ইরফান বল্ল, "কোন সমস্যা?

"না, না, চলুন!"

রুনা মনে মনে ভাবছে "ইশ, আল্লাই জানে আজ আমাকে কেমন দেখাচ্ছে"
ইরফান হেসে উঠে বলল "তোমাকে সুন্দর লাগছে!"

৩।

ইরফানের মনে হচ্ছে সে ভুল করছে। রুনার সঙ্গে আগে যেমন দূরত্ব বজায় রেখেছিল, এখনো তেমনি রাখা উচিৎ ছিল। ও ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে রুনার প্রতি। যা কোনমতেই হতে দেয়া যায়না, কোনমতেই না। ও ভেবেছিল রুনার সঙ্গে একটা সহজ-স্বাভাবিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তোলবে এবং ধীরেধীরে রুনার অবসেসন কেটে যাবে, কিন্তু হয়েছে উল্টো। রুনা আরো বেশি পসেসিভ ও এগ্রেসিভ হয়ে পড়েছে।

কয়েকদিন আগে ইরফান, রুনা আর আইরিন ক্যান্টিনে বসে চা খাচ্ছিল। আইরিন একটা জোকস বলে নিজেই হাসতে হাসতে ইরফানের গায়ে ঢলে পড়লো। ইরফান জানে ওর প্রতি আইরিনের অন্যরকম দুর্বলতা নেই। ও একটা অদ্ভুত ব্যাপার খেয়াল করেছে মেয়েরা যাদের প্রেমে পড়ে তাদের সাথে সহজভাবে মিশতে পারেনা। যাদের প্রতি দুর্বলতা নেই তাদের সঙ্গেই বরং স্বাভাবিক আচরণ করে।

কিন্তু রুনা ব্যাপারটা পছন্দ করলনা। ও আইরিনকে বলে বসল, "তুই ছেলেদের গায়ে পড়ে কথা বলিস কেনরে, খুবই বিশ্রী স্বভাব তোর।"
ইরফান আর আইরিন দুজনই হতভম্ব! নার্ভাসনেস কাটিয়ে আইরিন বলল, "কি বলছিস এসব তুই? আমরা ফ্রেন্ডস!"

"আমরাও ফ্রেন্ডস আইরিন, তাই বলে কোলে উঠে বসতে হবে?"

আইরিনের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। ও এতটাই শকড যে যুৎসই কোন জবাব ওর মুখে আসতেছে না।

ইরফান দেখল যে ব্যাপারটা খুব বাজে হয়ে যাচ্ছে। সে আইরিনকে ডিফেন্ড করে বলল, "এসব তুমি কি বলছ রুনা। আইরিন আমাদের ভাল বন্ধু। ও তো সবসময় এরকম। হাসিখুশি, প্রাণবন্ত, এটাই ওর নেচার। এর মধ্যে অন্য কোন ব্যাপার নেই।"

রুনা চুপ থাকল, মনে মনে বলল, "তা তো তুমি বলবেই। ***টা তোমার গায়ে হাত দিচ্ছে তোমার তো ভাল লাগবেই। সব ছেলেগুলো বদের হাড্ডি। উগ্র পোশাক পরা কোন মেয়ে দেখলে জিভ লকলক করে। ভাল মেয়েদের কোন দাম নেই। ঠিক আছে, ***টার মত কাল থেকে আমিও উগ্র পোশাক পরে আসব। দেখি তোমার কি অবস্থা হয়!"

এসব শুনে ইরফান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রুনা এসব কী ভাবছে! ছিঃ! রুনা দেখতে এত ইনোসেন্ট, কেউ কল্পনাও করতে পারবেনা যে এমন নোংরা কথা ও ভাবতে পারে।

ইরফান সিদ্ধান্ত নিল রুনার সাথে ও আবার দূরত্ব বজায় রাখবে!

৪।

রুনা আর ইরফান চুপচাপ হাঁটছে। রুনা ইরফানকে ফোন করে আসতে বলেছিল।ইরফান জানে রুনা ওর জন্য ৩০ হাজার টাকা দামের একটা হাতঘড়ি কিনেছে যেটা এখন ওর ভ্যানিটিব্যাগের মধ্যে আছে। ওর হাত এ ঘড়ির উপযুক্ত নয়। ৩০ হাজার টাকা দিয়ে ওর অনায়াসে ৬ মাস চলে যাবে। যেভাবেই হোক আজকেই রুনাকে কঠিন কথাগুলো বলে ফেলতে হবে, নইলে মেয়েটা আর কি কি পাগলামি করে তার ঠিক নেই।

আকাশে ঘনকালো মেঘ। যে কোন সময় তুমুল বৃষ্টি হবে। ক্রমশ মানুষজন কমতে শুরু করেছে, দেখতে না দেখতেই রাস্তাটা একপ্রকার ফাঁকা হয়ে গেল।

টপটপ করে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করলে, ওরা দুজন একটু দ্রুত হেঁটে কাছের একটা যাত্রী-ছাওনীর বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। ততক্ষনে শুরু হয়ে গেছে প্রবল বর্ষণ।

"তোমাকে কিছুকথা জানানো দরকার" ইরফান বলল, "ইন ফ্যাক্ট অনেক আগেই জানানো দরকার ছিল। ভেবেছিলাম প্রয়োজন নেই। কিন্তু আর বেশি দেরী করাটা খুব বড় ভুল হয়ে যাবে।"

রুনা অবাক হয়ে ইরফানের দিকে তাকাল। কি এমন কথা ওর বলার থাকতে পারে যে এমন নাটকীয় ভঙ্গীতে কথা শুরু করেছে? রুনা জিজ্ঞেস করল, "কী কথা?"

"মাইন্ড-রিডিং সম্পর্কে কিছু জানো?"

"মনের কথা, ভাবনা জেনে ফেলতে পারা ওইসব?

"হ্যা ওইসব। আমার অই মাইন্ড রিডিং করার ক্ষমতা আছে। না না এখনি কোন প্রমাণ চেয়োনা আগে তুমি আমার কথা মনযোগ দিয়ে শুনো। কারণ আজকের পর আমরা একজন আরেকজনের সাথে আর কখনো কোন কথা বলবনা।"

"এসব তুমি কি বলছ?

"প্লিজ আমাকে শেষ করতে দাও রুনা... যাদের মাইন্ড-রিডিং ক্ষমতা নেই তারা হয়ত ভাবতে পারে, মানুষের মনের কথা,ভাবনা পড়ে ফেলতে পারা খুব মজার একটা ব্যাপার আসলে কিন্তু তা নয়। বরং তার উল্টো। কারো মনের ভাবনা জেনে ফেলার মতো যন্ত্রণা আর নেই।

মাইন্ড-রিডিং ক্ষমতা থাকলে তুমি কাওকে ভালবাসতে পারবেনা। প্রিয় মানুষগুলোকে ঘৃণা করতে ইচ্ছে করবে। ধরো তোমার মাইন্ড-রিডিং ক্ষমতা আছে আর তুমি জেনে ফেললে তোমার বাবা পরকিয়ায় জড়িত, তোমার কেমন লাগবে? মানুষের অন্ধকার দিক জেনে ফেলা খুবই অস্বস্তিকর।

আমাকে তোমার ভালোলাগার বিষয়টা প্রথম দিন থেকেই জানি। তোমাকে প্রশ্রয় দিতে চায়নি বলে তোমার সাথে দূরত্ব রেখেছি যাতে তুমি আমাকে আরো বেশী ভালবেসে না ফেলো। কিন্তু লাইব্রেরীতে তুমি যখন মনে মনে আইরিনকে নোংরা গালি দিচ্ছিলে, আমি ভাবলাম তোমার সাথে সহজ একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে তুলি, যাতে অন্যদের সম্পর্কে তোমার বাজে ধারণা না আসে। পরে দেখা গেল এটা বড় একটা ভুল সিদ্ধান্ত। তুমি ক্রমশ আমার প্রতি অবসেসড হয়ে পড়েছ, আরো বেশি এগ্রেসিভ হয়ে পড়েছ।

তুমি এতটাই অবসেসড যে ক্যান্টিনে আইরিন আর আমাকে জড়িয়ে নোংরা সন্দেহ করেছিলে।

তুমি এতটাই অবসেসড যে আমার জন্য ৩০ হাজার টাকা দামের ঘড়ি কিনতে একটুও দ্বিধা করনি, যার যোগ্য আমি নই।

তুমি এতটাই অবসেসড যে তুমি আইরিনকে আননোন নাম্বার থেকে থ্রেট করেছো!

তুমি আমার সাথে কখনো সুখী হতে পারবেনা, ইন ফ্যাক্ট কোন মেয়েই পারবেনা। তোমার কোন অযোগ্যতা নেই। আমিই তোমার অযোগ্য। আমার ক্ষমতাই আমার সীমাবদ্ধতা, আমার শক্তিই আমার দুর্বলতা। জানিনা কতটুকু সত্যি, আমার এক বন্ধু একবার বলেছিল যে খুব বেশী যারা স্মার্ট তারা নাকি মিলিটারিতে চান্স পায়না। তারা ওভারকোয়ালিফাইড হয়ে ঝরে যায়। ধরে নাও সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমার অবস্থাও তেমন, আমি ওভারকোয়ালিফাইড। আমার আর কিছু বলার নেই। তুমি কিছু বলতে চাইলে বল, আমি এখন বিদায় নিতে চাচ্ছি।

স্তব্ধ হয়ে ইরফানের কথা শুনছিল রুনা। ওকে নিয়ে বলা ইরফানের প্রতিটা কথা সত্য। রুনা করুণ চোখে ইরফানের দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বলল, "আমি কি তোমার হাত ধরতে পারি? কিছুক্ষনের জন্য?"

রুনার কন্ঠে এমন কিছু ছিল যা কাঁপিয়ে দিল ইরফানের ভেতরটা। সে হাত বাড়িয়ে দিল। রুনা কিছুক্ষণ হাত ধরে বসে থাকল। তারপর অচানক ইরফানের হাত ছেড়ে দিয়ে, দুহাতে মুখ ডেকে কাঁদতে শুরু করল।

কি করবে বুঝে উঠতে পারলনা ইরফান, শেষে ধীরেধীরে বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়াল ও। বলল, "আমাকে ক্ষমা করো রুনা।"

ইরফান তুমুল বৃষ্টির মধ্যে রাস্তায় নেমে পড়ল। হাঁটতে শুরু করল আজানা গন্তব্যের দিকে। পেছনে এখনো কেঁদেই চলেছে রুনা। রুনার যদি মাইন্ড-রিডিং ক্ষমতা থাকতো তাহলে সে টের পেত তার প্রতি ইরফানের সত্যিকারের ভালবাসা, জানতে পারতো বৃষ্টির ভিতর দিয়ে হাঁটতে থাকা ইরফানের চোখেও জল!
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৫৩২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১০/০৯/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • নির্ঘুম মিশ্র ১০/০৯/২০১৮
    আপনার লেখার মান অনবদ্য। পড়ে খুবই ভাল লাগল।
  • পড়েছি।
  • আশা মনি ১০/০৯/২০১৮
    অসাধারন
 
Quantcast