www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

প্রতিফল

১।
সকাল এগারোটা।
শওকত সাহেব অফিস থেকে বাসায় ফিরছেন। আজ অফিসে পৌছা মাত্রই তার শরীরটা খারাপ হয়ে গেল। ওয়াশরুমে গিয়ে তিনবার বমি করলেন। অফিস-স্টাফরা সবাই তাকে বাসায় চলে যেতে বল্লেন।

তিনিও বুঝতে পারলেন, অবস্থা বেশ সুবিধার না, তাই ছুটি নিয়ে নিলেন। আসার সময় বাস না ধরে সিএনজিতে চড়লেন। ১৫ মিনিটের মধ্যেই বাসায় পৌছে গেলেন তিনি। কিন্তু বাসায় আসামাত্র তিনি অবাক, সদর-দরজাটা ভাল করে লাগানো নেই। বিরক্ত হলেন ওনি। এসবের মানে কী! নাসরিন এত কেয়ারলেস হল কি করে? যে যুগ পড়েছে চোর/ডাকাতের কোন আলাদা জাত আছে? সুযোগ পেলে এখন সবাই চোর, সবাই ডাকাত।

হনহন করে বাসায় ঢুকে একটু চিল্লাফাল্লা করবেন ভাবছেন কিন্তু হঠাৎ করেই মনের ভিতর কু ডেকে উঠল। জানেনা কেন ওনার মনে হল, নাসরিন ছাড়াও বাসায় আরও কেউ একজন আছে। অথচ নাসরিন ছাড়া আর কেউ থাকার কথা নয়।

তিনি যথাসম্ভব শব্দহীন পা টিপে টিপে এগুতে লাগলেন। বেডরুমের কাছাকাছি আসতেই ফিসফিস কথা আর হাসির শব্দ শুনা যেতে লাগল। নর-নারীর চিরকালীন শারীরিক সম্পর্কের গন্ধ লেগে আছে ওই হাসি আর ফিসফিসানিতে। নাসরিন! এ বয়সে! ছি!

বেডরুমের অল্প ফাঁক হওয়া দরজা দিয়ে যা দেখবেন বলে ভয় পাচ্ছিলেন, তাই দেখলেন। মনটা ভেংগেচুরে চৌচির হয়ে গেল কিন্তু তার সাথে এত বড় বেঈমানিটা তার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু জামান কি করে করতে পারল?

২।

রাত ১ টা।
জামান সাহেবের ফোনটা বেজেই যাচ্ছে। বালিশের তলায় হাত ঢুকিয়ে, জোর করে চোখ মেলে মোবাইল স্ক্রিনে তাকালেন ওনি। নাম্বারটা দেখেই চট করে তার পাশে শুয়ে থাকা স্ত্রীর দিকে তাকালেন। এত রাতে নাসরিনের ফোন?
কলটা ততক্ষণে কেটে গেছে।

মোবাইলটা নিয়ে সন্তর্পণে ওয়াশরুমে চলে আসলেন জামান সাহেব। দরজার হুক লাগাচ্ছেন, মোবাইলটা আবার বেজে উঠল, দ্রুত রিসিভ করলেন, কন্ঠে রাগ আর বিরক্তি ফুটিয়ে তুলে ফিসফিস করে বললেন, "এত রাতে ফোন করতেছ? সাহেদা জেগে গেলে? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার?
ওপাশ থেকে রহস্যময় কন্ঠে নাসরিন বলল, "এখন তোমাকে যে খবরটা দেব, খুশিতে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে!"
"মানে?" জামানের কন্ঠে একই সাথে বিরক্তি আর কৌতুহল।
"শওকত আর নেই। ও মারা গেছে!"

৩।
নাসরিন দীর্ঘ সময় ধরে শাওয়ার নিচ্ছেন। শওকতের লাশটার সাথে এতক্ষণ শুয়ে ছিল বলে গা ঘিনঘিন করছে। বহুদিন ধরে এই যন্ত্রণা তার মাথায় চেপে ছিল, মৃত্যু আসি আসি করেও আসছিলনা শওকত সাহেবের। এবার আপদ বিদায় হল।

শওকত আজ বাসায় আসেন রাত ৮ টায়। এত দেরী করে বাসায় যদিও তিনি আসেননা। নাসরিন কোনরকম কৌতুহল দেখালেন না, ওনার প্রতি কোন রকম আগ্রহই নাসরিনের নেই। কিন্তু নাসরিনকে যে ব্যাপারটা অবাক করল, সেটা হচ্ছে মানুষটা চুপচাপ হয়ে আছে। কোন কথা বলছেনা। অন্য সময় বকবক করে নাসরিনকে জ্বালিয়ে মারত লোকটা।
শওকত সাহেব যখন না খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লেন, নাসরিন জিজ্ঞেস করল "কি ব্যাপার খাবেনা? শরীর খারাপ?"
কোন উত্তর না দিয়ে করুণ চোখে তাকিয়েছিল নাসরিনের দিকে। চোখ ছলছল করছিল, যেন এখনই কেঁদে ফেলবেন। নাসরিন মনে মনে ভাবলেন, এ আবার কিরকম ঢং!

নাসরিন খেয়েদেয়ে, কিচেন গুছিয়ে বিছানায় এসে শুলেন। তিরিশ মিনিট পর অদ্ভুত অনুভুতি হল নাসরিনের। শওকত সাহেব একেবারে মুর্তির মত শুয়ে আছেন। নিঃশাসের শব্দ নেই, পেটের ওঠানামা নেই। মরে টরে গেল না তো? শওকত সাহেব হার্টের রুগী, গতবছরের শুরুতে তার গুরুতর হার্ট এটাক হয়। এরপর দীর্ঘ এক বছর তাকে দুঃচিন্তা ঘিরে থাকতো। ঘুম ভেঙে গেলে কোন কারণ ছাড়াই তিনি ভয় পেতেন।
কৌতুহলী হয়ে কব্জির নাড়ী টিপে চেক করলেন নাসরিন। কোন স্পন্দন নেই! মারা গেছেন শওকত সাহেব! ঝট করে বিছানা নেমে গেলেন ওনি, প্রথমে কি করবেন বুঝে উঠতে পারলেন না,তারপর জামনকে ফোন করে খবরটা জানিয়ে এখন শাওয়ার নিচ্ছেন ওনি। জামান ওকে জিজ্ঞেস করেছিল তুমি শিউর হলে কি করে?
নাসরিন বলেছিলেন "ভুলে যেওনা, মডার্ন ক্লিনিকে আমি ৫ বছর নার্সের চাকরি করেছিলাম।"

টাওয়েল দিয়ে গা মুছতে মুছতে ভাবছেন মৃত্যুর খবরটা তাদের একমাত্র ছেলে ফয়সালকে কিভাবে দেবেন? খবরটা দেওয়ার সময় এমন ভঙ্গী করতে হবে যেন বুকটা ভেংগে চৌচির হয়ে গেছে তার। কারণ তিনি কাউকে বুঝতে দিতে চান না যে স্বামী মারা যাওয়াতে তিনি এতটুকুও কষ্ট পাননি।

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বেডরুমে এসে নাসরিন দেখলেন, বিছানায় শওকত সাহেবের লাশটা নেই!
এদিক ওদিক তাকিয়ে আতংকিত হয়ে খেয়াল করে শওকত সাহেব কাঠের পুতুলের মত ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে আছে, তাকিয়ে আছে আয়নার দিকে।

নাসরিনের ইচ্ছে হচ্ছিল প্রচন্ড জোরে একটা চিৎকার দেয় কিন্তু পারছেনা। গলা শুকিয়ে গেছে তার। তার এখন উচিৎ এক দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে যাওয়া, কিন্তু তাও সে পারছেনা। হাত পা একদম অবশ হয়ে গেছে তার।

শওকত সাহেব পুতুলের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে নাসরিনের দিকে তাকালেন, তার চোখ বিষণ্ণ, কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি দাত কেলিয়ে হাসছেন।
শওকত আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন, যেন তিনি যন্ত্রচালিত, এমনভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন নাসরিনের দিকে। ইস্পাত-কঠিন শক্ত দুটো হাত নাসরিনের গলা টিপে ধরল। নাসরিনকে মেঝেতে শুইয়ে দিয়ে শওকত সাহেব শ্লেষ্মা জড়ানো কন্ঠে বললেন "ঘুমাও সোনা"।

৪।
শওকত সাহেবের বাসায় মানুষের ভীড় বাড়ছে। দুটো লাশ পাশাপাশি শোয়ানো। ফয়সাল তার বাবা মায়ের জন্য আকুল হয়ে কাঁদছে। নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ওদের দুজনকে। ডাক্তার পরীক্ষা করে জানিয়েছিলেন যে, তাদের ধারণা আগে শওকত সাহেব মারা যান পরে নাসরিন। কিন্ত ফয়সাল বলল, "তা কি করে সম্ভব? বাবাই তো আমাকে মায়ের মৃত্যুসংবাদ জানান। বাবা আগে মারা গেলে আমাকে ফোন দিলেন কি করে?"

কথাটা শুনে শিউরে উঠল জামান সাহেব, অজান্তে চোখ গেল শওকত সাহেবের লাশের দিকে, তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন যে লাশটা করুণ চোখে তার দিকে তাকিয়ে হাসছে! শওকত সাহেব কি কোনভাবে তার আর নাসরিনের ব্যাপারটা জানতে পেরেছিলেন? কিংবা মৃত্যুর পর জেনেছেন?

বাসার একপাশে দাঁড়িয়ে আছেন জামান সাহেব। অজানা আতংকে তার মনটা ভরে আছে। ভয়ে লাশের দিকে তাকাতে পারছেন না। কি দেখে না কি দেখে! তিনি ক্রমশ অস্থির হয়ে উঠছেন। তার পক্ষে আর একটা মুহুর্তও এখানে দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব নয়। তিনি দ্রুত ফয়সালের দিকে এগিয়ে গেলেন। বললেন, "বাবা আমাকে এখনই একটু বাসায় যেতে হচ্ছে। নিজেকে শক্ত রাখো। আমি যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি চলে আসব।"

শওকত সাহেবের বাসা দ্রত ত্যাগ করছেন জামান সাহেব। কিন্তু দশ কদমও পেরুতে পারেন নি, তিনি পেছন থেকে স্পষ্ট শুনতে পেলেন কেউ যেন শ্লেষ্মা জড়ানো কন্ঠে তার কানে কানে বলে উঠল, "এবার তোমার পালা!"
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৪৩৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৩/০৯/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast