বাবার প্রেমের চিঠি
১।
রিমা তার বাবার ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়ে দেখে টেবিলের তলায় চিঠি লেখার প্যাডের একটা ভাঁজ করা রঙিন পৃষ্ঠা পড়ে আছে। বাবা যথেষ্ট গোছানো মানুষ, এই বয়সেও তিনি যথেষ্ট সচেতন চলাফেরা করেন। বাবার ঘরে কখনো কিছু পড়ে থাকেনা। তবু প্রতিদিন ঘর ঝাড়ু দেয়া রিমার অভ্যাস।
কাগজটা দেখে রিমা একটু অবাকই হল! চিঠি লেখার প্যাড দিয়ে বাবা কি করবে? ঝাড়ু দিয়ে সে কাগজটা টেনে আনছে কিন্তু কি মনে করে সে কাগজটা হাতে তুলে নিল।
ভাঁজ করা কাগজটা খুলে পড়তে শুরু করল। লেখাটা পুরো শেষ করতে পারেনি, মাথাটা চক্কোর দিয়ে উঠল ওর। কাগজটা একটা চিঠি। বাবার হাতে লেখা একটা প্রেমের চিঠি!
২।
রিমার বড় ভাই রাহাতের রুমে একটা বৈঠক বসেছে। রিমারা ২ ভাই ১ বোন। অন্যজনের নাম রাসেল। রিমা সবার ছোট। সবাই অবিবাহিত। তবে রিমার বিয়ের জন্য এখন ভাবনা চিন্তা চলছে।
তিন ভাই-বোনের বৈঠকের বিষয় হচ্ছে, বাবার রুম থেকে পাওয়া প্রেমের চিঠি। এ বয়সে বাবা এসব কেন করছে? ওদের মা মারা গেছে মাত্র ৪ বছর। এমন তো না যে অল্প বয়সে স্ত্রী মারা গেছেন বলে তার সঙ্গীর প্রয়োজন। ২৮ বছর সংসার করেছেন। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে, সবচেয়ে ছোট যে রিমা সেই অনার্স ফাইনাল ইয়ার পড়ছে। কোথায় বাবা মেয়ের বিয়ে নিয়ে টেনশন করবেন তা না, এ বয়সে তার প্রেমের অসুখ হয়েছে। ছিঃ।
তিন ভাই বোন বাবার উপর খুবই বিরক্ত হয়েছে। বাবার প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ এতকাল ওরা লালন করে এসেছিল তাতে চিড় ধরেছে। চিঠিটা ইতোমধ্যে পড়ে ফেলেছে ওরা। চিঠিটা বকুল নামের কোন এক মহিলা বা মেয়েকে লেখা।
রাসেল বলল, "বাবার সাথে এ বিষয়ে সরাসরি কথা বললে ভাল হয়। বুঝিয়ে সুঝিয়ে যেভাবে হোক বাবাকে এ বিশ্রী বিষয়টা থেকে দূরে রাখতে হবে। নইলে বাবা উল্টোপাল্টা কিছু যদি করে ফেলেন, আমাদের কি মান সম্মান বলে কিছু আর থাকবে? রিমার একটা ভাল বিয়ে দিতে পারব?"
রাহাত বলল, "বাবার সাথে সরাসরি আলাপ করাটা ঠিক লাগছেনা। তিন/চারটা দিন বাবাকে অবজারভ করি, জানতে চেষ্টা করি বকুল নামের মানুষটা কে? কোথায় থাকে? আমরা যাই করিনা কেন, সিচুয়েশন ট্যাকটিক্যালি হ্যান্ডল করব। বিষয়টা যে আমরা জেনে গেছি, সেটা বাবাকে বুঝতে দেয়া যাবেনা। তাহলে আড়ালটা নষ্ট হয়ে গিয়ে বাবা আরো বেপরোয়া হয়ে পড়তে পারে। প্রেম তা যে বয়সেই হোক না কেন মানুষকে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলে।"
রাসেল বলল, "বাবা প্রায় ১টার দিকে লাইট জ্বালিয়ে রাখে। মনে হয় ও সময়ই বাবা ঐ মহিলার সাথে যোগাযোগ করে।"
"বাবা যে এমন করতে পারবে..." কথাটা শেষ করতে পারেনি রিমা, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। এমনিতেই কারো মন ভাল নেই। রিমার কান্না পরিবেশটাকে আরো ভারী করে তোলল।
"আহ! কাঁদিস না তো" বিরক্ত হল রাহাত, তারপর রাসেলের দিকে তাকিয়ে বলল, "তুই একটা কাজ কর, কাল বিকেলে যখন বাবা বাইরে যাবে, বাবার ঘরের দরজায় ছোট একটা ফুটো করে রাখবি। রাত একটার দিকে বাবা কি করে সেটা আমাদের দেখতে হবে!"
৩।
রাত ১টা।
বাবার ঘরে এখনো বাতি জ্বলে উঠেনি। রিমা বাবার রুমের সামনে অপেক্ষা করছে। সবাই তো একসাথে ফুটোতে চোখ রাখতে পারবেনা তাই রাহাত বলেছিল কাজটা রিমা করবে।
রিমা বলেছিল আমি কেন?
"আড়িপাতা টাইপ কাজে মেয়েরা এক্সপার্ট সেজন্য "
ভাইয়ার উপর রাগ হচ্ছিল, ইচ্ছে করছিল দু কথা শুনিয়ে দেয়। অন্য সময় হলে করতও সেটা। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। ও আর কথা বাড়ায়নি।
বাবার ঘরে আলো জ্বলে উঠল! রিমা সন্তর্পণে দরজার কাছে হেঁটে গিয়ে দরজার ফুটোতে চোখ রাখল। পুরো রুমের প্রায় দেখা যাচ্ছে।
তিরিশ মিনিট পর রিমা রাহাতের রুমে গেল সেখানে দুইভাই ওয়েট করছে। ওরা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রিমা যা বলল তার মূল বক্তব্য হল - বাবা প্রথমে ওয়াশরুমে গেলেন। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে, তার টেবিলে গিয়ে বসলেন। চাবি দিয়ে টেবিলের ফোল্ডিং ডালা খুলে একটা প্যাড বের করলেন। তারপর লিখতে শুরু করলেন। লেখা শেষ হওয়ার পর কাগজটা টেবিলের ভিতরে রেখে দিয়ে তালা মেরে দিলেন।
রাহাত সব শুনে বলল, "টেবিলটাতেই তাহলে সব তথ্য লুকোনো আছে।ওটা খুলতে পারলেই
আমাদের কাছে সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চলে আসবে। কাল বিকেলে চাবিওয়ালা দিয়ে টেবিলটার একটা নকল চাবি বানিয়ে নিতে হবে!"
৪।
বিকেলে বাবা বাইরে চলে গেলে পর ওরা তিন ভাইবোন ওনার রুমে ঢুকল। চাবিওয়ালা দিয়ে বানানো চাবিটা দিয়ে টেবিলের তালাটা খুলে ফেলল। ডালা খুলে দেখে একপাশে কিছু বই আর চিঠি লেখার প্যাড। অন্যপাশে অনেকগুলো চিঠি ভাঁজ করে রাখা আছে। এর মানে কী! বাবা চিঠিগুলো পাঠাতো না? এখানেই রেখে দিত সব? কিন্তু কেন?
রাসেল বলল, "মনে হচ্ছে বাবা দ্বিধায় ভুগছে। অথবা সাহস হচ্ছেনা। কিন্তু ঠিকই কথাবার্তা যোগাযোগ এসব হচ্ছে। হয়তো একতরফা প্রেম। হতে পারেনা?"
রাহাত বলল "আমরা সবাই চিঠিগুলো পড়ব। কোথাও ওই মহিলার ঠিকানা কিংবা অন্য কোন গুত্বপূর্ণ তথ্য পেলে সঙ্গে সঙ্গে পরস্পরকে জানিয়ে দিব। তথ্যগুলো টুকে নেব। পরে কি করতে হবে, ভাবনা-চিন্তা করে বের করা যাবে।"
ওরা চিঠি পড়তে শুরু করল। প্রায় সবগুলো চিঠির মূল বক্তব্য হচ্ছে - "তোমাকে খুব মিস করছি। জানিনা কখন আমাদের মিলন হবে!"
একটা বিষয় ওরা খেয়াল করল, সবগুলো চিঠির নিচে তারিখ লেখা। তারিখ থেকে অনুমান করা যাচ্ছে চিঠিগুলো সাম্প্রতিক, ৩/৪ মাস ধরে বাবা এসব শুরু করেছে। তার মানে ব্যাপারটা হয়তো ততোটা গভীর নয়। এখনি ব্যবস্থা নিতে পারলে, বাবাকে শোধরানো যাবে।
"ভাইয়া!" রিমা ধরা গলায় বলে উঠল, ওরা দুজনই রিমার দিকে তাকাল। রিমা হাতের চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে শান্ত স্বরে বলল "এই চিঠিটা পড়।" রিমার চোখে জল!
রাহাত চিঠিটা হাতে নিল, পড়া শেষ করে রাসেলের হাতে দিল। তারপর রিমার পাশে বাবার বিছানায় গিয়ে বসে পড়ল।
রাসেল চিঠি পড়তে শুরু করল,
প্রিয় বকুল,
কেমন আছো? বেহেশতে ভাল আছো নিশ্চয়?
তুমি তো জানো আজ আমি একদম ভাল নেই। কারণ আজ যে ১০ই জুন!! আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিন! কখনো ভাবিনি আমাকে তুমি এভাবে একা ফেলে চলে যাবে। তুমি নেই আজ চার বছর হতে চলল। এ চার বছরে একটা রাতও ঠিকমতো ঘুমুতে পারিনি। প্রতি রাতে আজো আমি তোমার কথা মনে করে কাঁদি।
জানো রোজ তোমাকে একটা করে চিঠি লিখছি ইদানীং। তোমার ঠিকানা জানা নেই, তবু মনে হয়, পরম করুণাময়ের দয়ায় এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথাও না কোথাও আমার চিঠিগুলো তুমি ঠিকই পড়তে পারছো।
যেখানেই থাকো ভাল থেকো প্রিয়, অপেক্ষা করে থেকো। আমার বয়সও তো আর কম হলনা, আর বেশিদিন নেই আমাদের এক হতে ...
ইতি
তোমার আমি...
১০/৬/২০১৮
চিঠিটা পড়ে তিন ভাই-বোনের মন বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। খারাপ লাগছে বাবার জন্য। নিজেদের অপরাধী মনে হচ্ছে। কারণ ১০ই জুন তাদের মায়ের মৃত্যুর তারিখ!
বাবার চিঠিপত্র টেবিলের ভিতর যেমন রাখা ছিল যথাসাধ্য তেমন গুছিয়ে নিয়ে বিছানায় বসল তিনজন। অপেক্ষা করছে বাবার জন্য, কেননা একটা প্রশ্নের উত্তর ওদের এখনো জানা হয়নি - চিঠিগুলো বকুলকে লেখা কেন? মায়ের নাম তো রাবেয়া!
৫।
বিকেলবেলার হাঁটাহাঁটি সেরে বাবা ঘরে এসে দেখলেন, তার তিন ছেলেমেয়ে তার বিছানায় বসে আছে। ব্যাপার কি? গুরুত্বপূর্ণ কিছু নাকি? তিনি তার ছেলেমেয়েদের দিকে কৌতুহলী হয়ে তাকালেন।
রাহাত ধীরেধীরে বলল, "বাবা, তুমি কি মাকে বকুল বলে ডাকতে?
বাবা খুব অবাক হলেন। বললেন, "হ্যাঁ... কিন্তু তোরা জানলি কি করে?
"আমরা তো কখনো শুনিনি? কেন ডাকতে বাবা?"
প্রশ্নটা শুনে বিব্রত হলেন ওনি। বোকা ছেলেমেয়েগুলো বলে কি? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের অনেক কথাই তো শেয়ার করা যায় না। তিনি রাবেয়াকে বকুল ডাকতেন যখন ওনারা দুজন একলা হতেন। রাবেয়ার দিঘল কালো চুলে ওনি বকুল ফুলের ঘ্রাণ পেতেন, তাই ওনি ভালবাসাময় অন্তরঙ্গ মুহুর্তগুলোতে রাবেয়াকে বকুল বলে ডাকতেন। এসব কথা কি আর ছেলেময়েদের বলা যায়? ওনি সামান্য হেসে ওঠে বললেন, "বলতাম আর কি... কিন্তু কেন? আজ হঠাৎ এসব কথা কেন?
রিমা অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলনা, বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ওর কান্না রাহাত আর রাসেলকেও স্পর্শ করল, ওরাও এগিয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। গত তিন/চারদিন ধরে বাবাকে সন্দেহ করে ওরা যা যা করেছে তা ভেবে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে ওদের। ভীষণ অপরাধবোধ হচ্ছে। রাহাত বলল, "আমাদের মাফ করে দাও বাবা, আমরা অন্যায় করেছি।"
বাবা তার ছেলেমেয়েদের কান্ড দেখে হতভম্ব! মাফ চাচ্ছে কেন ওরা? কি অন্যায় করেছে তার ছেলেমেয়েরা? কিন্তু তিনি কান্নারত ছেলেমেয়েদের কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। এ জীবনে ওরাই তো বকুলের রেখে যাওয়া সবচেয়ে দামি স্মৃতি! পরম মমতায় ওদের মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন তিনি।
রিমা তার বাবার ঘর ঝাড়ু দিতে গিয়ে দেখে টেবিলের তলায় চিঠি লেখার প্যাডের একটা ভাঁজ করা রঙিন পৃষ্ঠা পড়ে আছে। বাবা যথেষ্ট গোছানো মানুষ, এই বয়সেও তিনি যথেষ্ট সচেতন চলাফেরা করেন। বাবার ঘরে কখনো কিছু পড়ে থাকেনা। তবু প্রতিদিন ঘর ঝাড়ু দেয়া রিমার অভ্যাস।
কাগজটা দেখে রিমা একটু অবাকই হল! চিঠি লেখার প্যাড দিয়ে বাবা কি করবে? ঝাড়ু দিয়ে সে কাগজটা টেনে আনছে কিন্তু কি মনে করে সে কাগজটা হাতে তুলে নিল।
ভাঁজ করা কাগজটা খুলে পড়তে শুরু করল। লেখাটা পুরো শেষ করতে পারেনি, মাথাটা চক্কোর দিয়ে উঠল ওর। কাগজটা একটা চিঠি। বাবার হাতে লেখা একটা প্রেমের চিঠি!
২।
রিমার বড় ভাই রাহাতের রুমে একটা বৈঠক বসেছে। রিমারা ২ ভাই ১ বোন। অন্যজনের নাম রাসেল। রিমা সবার ছোট। সবাই অবিবাহিত। তবে রিমার বিয়ের জন্য এখন ভাবনা চিন্তা চলছে।
তিন ভাই-বোনের বৈঠকের বিষয় হচ্ছে, বাবার রুম থেকে পাওয়া প্রেমের চিঠি। এ বয়সে বাবা এসব কেন করছে? ওদের মা মারা গেছে মাত্র ৪ বছর। এমন তো না যে অল্প বয়সে স্ত্রী মারা গেছেন বলে তার সঙ্গীর প্রয়োজন। ২৮ বছর সংসার করেছেন। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে, সবচেয়ে ছোট যে রিমা সেই অনার্স ফাইনাল ইয়ার পড়ছে। কোথায় বাবা মেয়ের বিয়ে নিয়ে টেনশন করবেন তা না, এ বয়সে তার প্রেমের অসুখ হয়েছে। ছিঃ।
তিন ভাই বোন বাবার উপর খুবই বিরক্ত হয়েছে। বাবার প্রতি যে শ্রদ্ধাবোধ এতকাল ওরা লালন করে এসেছিল তাতে চিড় ধরেছে। চিঠিটা ইতোমধ্যে পড়ে ফেলেছে ওরা। চিঠিটা বকুল নামের কোন এক মহিলা বা মেয়েকে লেখা।
রাসেল বলল, "বাবার সাথে এ বিষয়ে সরাসরি কথা বললে ভাল হয়। বুঝিয়ে সুঝিয়ে যেভাবে হোক বাবাকে এ বিশ্রী বিষয়টা থেকে দূরে রাখতে হবে। নইলে বাবা উল্টোপাল্টা কিছু যদি করে ফেলেন, আমাদের কি মান সম্মান বলে কিছু আর থাকবে? রিমার একটা ভাল বিয়ে দিতে পারব?"
রাহাত বলল, "বাবার সাথে সরাসরি আলাপ করাটা ঠিক লাগছেনা। তিন/চারটা দিন বাবাকে অবজারভ করি, জানতে চেষ্টা করি বকুল নামের মানুষটা কে? কোথায় থাকে? আমরা যাই করিনা কেন, সিচুয়েশন ট্যাকটিক্যালি হ্যান্ডল করব। বিষয়টা যে আমরা জেনে গেছি, সেটা বাবাকে বুঝতে দেয়া যাবেনা। তাহলে আড়ালটা নষ্ট হয়ে গিয়ে বাবা আরো বেপরোয়া হয়ে পড়তে পারে। প্রেম তা যে বয়সেই হোক না কেন মানুষকে মোহাচ্ছন্ন করে ফেলে।"
রাসেল বলল, "বাবা প্রায় ১টার দিকে লাইট জ্বালিয়ে রাখে। মনে হয় ও সময়ই বাবা ঐ মহিলার সাথে যোগাযোগ করে।"
"বাবা যে এমন করতে পারবে..." কথাটা শেষ করতে পারেনি রিমা, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। এমনিতেই কারো মন ভাল নেই। রিমার কান্না পরিবেশটাকে আরো ভারী করে তোলল।
"আহ! কাঁদিস না তো" বিরক্ত হল রাহাত, তারপর রাসেলের দিকে তাকিয়ে বলল, "তুই একটা কাজ কর, কাল বিকেলে যখন বাবা বাইরে যাবে, বাবার ঘরের দরজায় ছোট একটা ফুটো করে রাখবি। রাত একটার দিকে বাবা কি করে সেটা আমাদের দেখতে হবে!"
৩।
রাত ১টা।
বাবার ঘরে এখনো বাতি জ্বলে উঠেনি। রিমা বাবার রুমের সামনে অপেক্ষা করছে। সবাই তো একসাথে ফুটোতে চোখ রাখতে পারবেনা তাই রাহাত বলেছিল কাজটা রিমা করবে।
রিমা বলেছিল আমি কেন?
"আড়িপাতা টাইপ কাজে মেয়েরা এক্সপার্ট সেজন্য "
ভাইয়ার উপর রাগ হচ্ছিল, ইচ্ছে করছিল দু কথা শুনিয়ে দেয়। অন্য সময় হলে করতও সেটা। কিন্তু এখন পরিস্থিতি ভিন্ন। ও আর কথা বাড়ায়নি।
বাবার ঘরে আলো জ্বলে উঠল! রিমা সন্তর্পণে দরজার কাছে হেঁটে গিয়ে দরজার ফুটোতে চোখ রাখল। পুরো রুমের প্রায় দেখা যাচ্ছে।
তিরিশ মিনিট পর রিমা রাহাতের রুমে গেল সেখানে দুইভাই ওয়েট করছে। ওরা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই রিমা যা বলল তার মূল বক্তব্য হল - বাবা প্রথমে ওয়াশরুমে গেলেন। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে, তার টেবিলে গিয়ে বসলেন। চাবি দিয়ে টেবিলের ফোল্ডিং ডালা খুলে একটা প্যাড বের করলেন। তারপর লিখতে শুরু করলেন। লেখা শেষ হওয়ার পর কাগজটা টেবিলের ভিতরে রেখে দিয়ে তালা মেরে দিলেন।
রাহাত সব শুনে বলল, "টেবিলটাতেই তাহলে সব তথ্য লুকোনো আছে।ওটা খুলতে পারলেই
আমাদের কাছে সব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চলে আসবে। কাল বিকেলে চাবিওয়ালা দিয়ে টেবিলটার একটা নকল চাবি বানিয়ে নিতে হবে!"
৪।
বিকেলে বাবা বাইরে চলে গেলে পর ওরা তিন ভাইবোন ওনার রুমে ঢুকল। চাবিওয়ালা দিয়ে বানানো চাবিটা দিয়ে টেবিলের তালাটা খুলে ফেলল। ডালা খুলে দেখে একপাশে কিছু বই আর চিঠি লেখার প্যাড। অন্যপাশে অনেকগুলো চিঠি ভাঁজ করে রাখা আছে। এর মানে কী! বাবা চিঠিগুলো পাঠাতো না? এখানেই রেখে দিত সব? কিন্তু কেন?
রাসেল বলল, "মনে হচ্ছে বাবা দ্বিধায় ভুগছে। অথবা সাহস হচ্ছেনা। কিন্তু ঠিকই কথাবার্তা যোগাযোগ এসব হচ্ছে। হয়তো একতরফা প্রেম। হতে পারেনা?"
রাহাত বলল "আমরা সবাই চিঠিগুলো পড়ব। কোথাও ওই মহিলার ঠিকানা কিংবা অন্য কোন গুত্বপূর্ণ তথ্য পেলে সঙ্গে সঙ্গে পরস্পরকে জানিয়ে দিব। তথ্যগুলো টুকে নেব। পরে কি করতে হবে, ভাবনা-চিন্তা করে বের করা যাবে।"
ওরা চিঠি পড়তে শুরু করল। প্রায় সবগুলো চিঠির মূল বক্তব্য হচ্ছে - "তোমাকে খুব মিস করছি। জানিনা কখন আমাদের মিলন হবে!"
একটা বিষয় ওরা খেয়াল করল, সবগুলো চিঠির নিচে তারিখ লেখা। তারিখ থেকে অনুমান করা যাচ্ছে চিঠিগুলো সাম্প্রতিক, ৩/৪ মাস ধরে বাবা এসব শুরু করেছে। তার মানে ব্যাপারটা হয়তো ততোটা গভীর নয়। এখনি ব্যবস্থা নিতে পারলে, বাবাকে শোধরানো যাবে।
"ভাইয়া!" রিমা ধরা গলায় বলে উঠল, ওরা দুজনই রিমার দিকে তাকাল। রিমা হাতের চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে শান্ত স্বরে বলল "এই চিঠিটা পড়।" রিমার চোখে জল!
রাহাত চিঠিটা হাতে নিল, পড়া শেষ করে রাসেলের হাতে দিল। তারপর রিমার পাশে বাবার বিছানায় গিয়ে বসে পড়ল।
রাসেল চিঠি পড়তে শুরু করল,
প্রিয় বকুল,
কেমন আছো? বেহেশতে ভাল আছো নিশ্চয়?
তুমি তো জানো আজ আমি একদম ভাল নেই। কারণ আজ যে ১০ই জুন!! আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃখের দিন! কখনো ভাবিনি আমাকে তুমি এভাবে একা ফেলে চলে যাবে। তুমি নেই আজ চার বছর হতে চলল। এ চার বছরে একটা রাতও ঠিকমতো ঘুমুতে পারিনি। প্রতি রাতে আজো আমি তোমার কথা মনে করে কাঁদি।
জানো রোজ তোমাকে একটা করে চিঠি লিখছি ইদানীং। তোমার ঠিকানা জানা নেই, তবু মনে হয়, পরম করুণাময়ের দয়ায় এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথাও না কোথাও আমার চিঠিগুলো তুমি ঠিকই পড়তে পারছো।
যেখানেই থাকো ভাল থেকো প্রিয়, অপেক্ষা করে থেকো। আমার বয়সও তো আর কম হলনা, আর বেশিদিন নেই আমাদের এক হতে ...
ইতি
তোমার আমি...
১০/৬/২০১৮
চিঠিটা পড়ে তিন ভাই-বোনের মন বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। খারাপ লাগছে বাবার জন্য। নিজেদের অপরাধী মনে হচ্ছে। কারণ ১০ই জুন তাদের মায়ের মৃত্যুর তারিখ!
বাবার চিঠিপত্র টেবিলের ভিতর যেমন রাখা ছিল যথাসাধ্য তেমন গুছিয়ে নিয়ে বিছানায় বসল তিনজন। অপেক্ষা করছে বাবার জন্য, কেননা একটা প্রশ্নের উত্তর ওদের এখনো জানা হয়নি - চিঠিগুলো বকুলকে লেখা কেন? মায়ের নাম তো রাবেয়া!
৫।
বিকেলবেলার হাঁটাহাঁটি সেরে বাবা ঘরে এসে দেখলেন, তার তিন ছেলেমেয়ে তার বিছানায় বসে আছে। ব্যাপার কি? গুরুত্বপূর্ণ কিছু নাকি? তিনি তার ছেলেমেয়েদের দিকে কৌতুহলী হয়ে তাকালেন।
রাহাত ধীরেধীরে বলল, "বাবা, তুমি কি মাকে বকুল বলে ডাকতে?
বাবা খুব অবাক হলেন। বললেন, "হ্যাঁ... কিন্তু তোরা জানলি কি করে?
"আমরা তো কখনো শুনিনি? কেন ডাকতে বাবা?"
প্রশ্নটা শুনে বিব্রত হলেন ওনি। বোকা ছেলেমেয়েগুলো বলে কি? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের অনেক কথাই তো শেয়ার করা যায় না। তিনি রাবেয়াকে বকুল ডাকতেন যখন ওনারা দুজন একলা হতেন। রাবেয়ার দিঘল কালো চুলে ওনি বকুল ফুলের ঘ্রাণ পেতেন, তাই ওনি ভালবাসাময় অন্তরঙ্গ মুহুর্তগুলোতে রাবেয়াকে বকুল বলে ডাকতেন। এসব কথা কি আর ছেলেময়েদের বলা যায়? ওনি সামান্য হেসে ওঠে বললেন, "বলতাম আর কি... কিন্তু কেন? আজ হঠাৎ এসব কথা কেন?
রিমা অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে আর সামলে রাখতে পারলনা, বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। ওর কান্না রাহাত আর রাসেলকেও স্পর্শ করল, ওরাও এগিয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। গত তিন/চারদিন ধরে বাবাকে সন্দেহ করে ওরা যা যা করেছে তা ভেবে লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে ওদের। ভীষণ অপরাধবোধ হচ্ছে। রাহাত বলল, "আমাদের মাফ করে দাও বাবা, আমরা অন্যায় করেছি।"
বাবা তার ছেলেমেয়েদের কান্ড দেখে হতভম্ব! মাফ চাচ্ছে কেন ওরা? কি অন্যায় করেছে তার ছেলেমেয়েরা? কিন্তু তিনি কান্নারত ছেলেমেয়েদের কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। এ জীবনে ওরাই তো বকুলের রেখে যাওয়া সবচেয়ে দামি স্মৃতি! পরম মমতায় ওদের মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন তিনি।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
রুমা চৌধুরী ১০/০৯/২০১৮অসাধারণ লাগল। দারুণ গল্প। শুভেচ্ছা রইল।
-
ন্যান্সি দেওয়ান ০৪/০৯/২০১৮Darun laglo.
-
সাঁঝের তারা ০৩/০৯/২০১৮খুব ভালো ...