www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

অদ্ভুত আঁধার এক

একটা ছেঁড়া কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে শুভেন্দু।তার পায়ের ঠিক কাছেই তার বারো বছরের মেয়ে অন্তরা বসে বসে গান গাইছে।তার অসম্ভব খিদে লেগেছে।খিদে লাগলেই সে গান গেয়ে খিদে ভোলার চেষ্টা করে।রাত প্রায় বারোটা।একটা নির্মাণাধীন দশ তল ভবনের নিচে ওরা অস্থায়ী আসন নিয়েছে।ওরা যাযাবর প্রকৃতির অর্থাৎ যেখানেই রাত সেখানেই কাত।অন্তরা ওর বাবার জন্য দুটো রুটি এনেছিল।দুটো রুটিই ওর বাবা খেয়ে ফেলেছে।তাই ও না খেয়েই আছে।অবশ্য অন্তরা বেশ না খেয়েই থাকতে পারে।না খেয়ে খেয়ে তার চেহারায় একটা জীর্ণভাব এসে গেছে।শুভেন্দু মাঝেমাঝে তার শরীরটা একটু নাড়া দিচ্ছে।অন্তরার গানে তার ঘুমের কিছুটা ব্যাঘাত ঘটছে।শুভেন্দু কিছু বলবে বলে ভাবছে।সে শুধু ভাবছে,আহা কী সুন্দর গলা!
মাগো ঘুমোবিনা?
অন্তরা গান থামিয়ে বলল,না বাবা ঘুমোতে ইচ্ছে করছেনা।তুমি ঘুমোও।
ঘুমোবো কি করে?কানের কাছে যদি ভ্যানভ্যান করিছ,তাহলে.....
কথাটা শেষ করার আগেই অন্তরা বলল,ঠিক আছে।আমি চুপ।ঘুমোও বাবা।
অন্তরা এবার তার পাশের ঝাঁকা থেকে কতগুলো ফুল নিয়ে ফুলের মালা তৈরিতে ব্যস্ত হল।এই জগতসংসারে অন্তরার আপন বলতে ওর বাবা আর বাবারও আপন বলতে এই স্নেহের অভাগী মেয়েটি।অন্তরা ফুল বিক্রি করে কলকাতার রাস্তায়।যা আয় হয় তা দিয়ে দুপুরে বেশ ভালোই খাওয়াদাওয়া হয় দুটো প্রাণির কিন্তু রাতে তেমনটা নয়।অন্তরা প্রায় রাতেই খায়না।সে প্রতিদিন কিছু না কিছু পয়সা জমায়।অন্তরা গান ধরল,
"স্বপ্নে আমি দেখি যাকে
সেকি ডাকে বসে আমাকে?"
অন্তরার গানের গলা বেশ সুরেলা।সুমিষ্ট গলায় বেশ ভালোই গান করে।শুভেন্দুর মেয়ের গান শুনতে বেশ ভালোই লাগছে।সে যদি বলে,মাগো অতি চমৎকার তোমার গানের গলা।তাহলে দেখা যাবে মেয়েটি গান গেয়েই যাবে।রাতে নিজেও ঘুমোবে না আর বাপকেও ঘুমোতে দেবেনা।তাই বাপে একটা খেই দিয়ে উঠল,গান বন্ধ,স্টপ,শুধু ভ্যানভ্যান,প্যানপ্যান....
অন্তরা একগাল হেসে ফেলল,কিন্তু গানের আসর ভাঙল না।গান গেয়েই গেল তবে সেটা নিজের মধ্যে।বাইরের পরিবেশকে বুঝতে দিলনা।অন্তরা মালা গেঁথেই যাচ্ছে।সকালসকাল বেড়িয়ে পড়তে হবে কলকাতার রাজপথে,বড় বড় সাহেবদের গাড়ি জ্যামে থামা মাত্রই সে এগিয়ে যাবে ফুল বিক্রি করতে।শুভেন্দু আর তার মেয়ে অন্তরা দিনেরবেলা বস্তিতেও থাকে তবে এখন আর বস্তিতে খুব একটা থাকা হয়না।কয়েকদিন যাবত এই খানেই ওরা আছে।এই খানেই ওদের আবাস।ভোর হতে হতে ওদের এখানটা ছেড়ে চলে যেতে হবে।নাহলে সকাল বেলা বিল্ডিংয়ের দারোয়ান,মালিকের গালিগালাজ খেতে হবে।নির্মাণাধীন বিল্ডিংটির পাশেই একটা ফুটপাত আছে,অন্তরার বাবা দিনের বেলা ওই ফুটপাতেই শুয়ে বসে দিন কাটিয়ে দেয়।শুভেন্দু খোঁড়া।হেঁটে চলতে পারেনা।তারমতো লোক অনায়াসে ভিক্ষা করে কলকাতা শহরে পেট বাঁচিয়ে যাচ্ছে কিন্তু সে ভিক্ষা করেনা।তার মেয়েটি ফুল বিক্রি করে জীবন চালায় তাতেই হয়ে যায় দুটো পেটের অন্নসংস্থান।বাবার আত্নসম্মানে বাধে ভিক্ষা করাটা।ক্লাশ ফাইভ অবধি পড়ালেখা হয়েছে তার।ক্লাশে একবার ফার্স্ট হয়েছিল সে।শুভেন্দু এই কথাগুলো যখন ভাবে তখন তার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ে।দুঃখ দুর্দশায় জড়তাগ্রস্ত তার পুরোটা জীবন।কী কষ্ট!কী কষ্ট!
বাবা ঘুমিয়ে গেলে নাকি?
শুভেন্দু তার শরীর দিয়ে হালকা ইশারা করে বোঝাল,সে ঘুমোয় নি।রাতে তার ভাল ঘুম হয়না।সারাটা দিনই তো ঘুমোয়।ঘুমোনোর মধ্যে দিয়ে দিন কেটে যায়।এতো নিরিবিলি রাত অথচ ঘুম আসছেনা কিন্তু দিনের বেলা কলকারখানা আর গাড়ির আওয়াজে দিব্যি ঘুম হয় তার।কেন এরকম হয় কে জানে?
বাবা খিদে লেগেছে তোমার?
বাবা জানে মেয়েটি না খাওয়া।এই কথাটা বাবার বলা উচিত ছিল তার মেয়েকে কিন্তু....
কথাগুলো ভাবতে ভাবতে তার চোখের কোণাটা ভিজে গেল।শুভেন্দু না খেয়ে থাকতে পারেনা কিন্তু তার এই মেয়েটি কি করে যে পারে সেই জানে!
মাগো তোর খিদে লেগেছে কি!
অন্তরা ফুল সুতোর মধ্যে দিতে দিতে বলল,না বাবা,খিদে লাগলে চিড়ে খেয়ে নেব।সামান্য চিড়ে আছে ব্যগটায়।
তাহলে খেয়ে নে না।
খিদে নেইতো।
ও আচ্ছা ঘুমিয়ে পড়।রাত তো অনেক হলোরে।সকালেই তো বেড়িয়ে পড়তে হবে।ঘুমো মা।যায়গাটা খুব একটা সুবিধার নারে।কখন যে কী হয়!
কিছুই হবে না।তুমি ঘুমোও।আমাকে নিয়ে চিন্তার কিচ্ছু নেই।
শুভেন্দুর তার মেয়েটিকে নিয়ে বড্ড দুশ্চিন্তা হয়।মেয়েটির বয়স অল্প কিন্তু বয়স তো বেড়েই যাচ্ছে।মেয়েটার একটা বিয়ে দিতে পারলে সে বাঁচত।কেইবা ওকে বিয়ে করবে?সেটাই প্রশ্ন।
রাত ক্রমেই বাড়ছে।লোকজনের আনাগোনা ক্রমেই হালকা হয়ে আসছে।শুভেন্দু খুকখুক করে কাঁশল।অন্তরা এবার ঘুমোনোর জন্য প্রস্তুত হল।তার ঘুম ঘুম আসছে।বাবার পাশেই সে ঘুমিয়ে যাবে।অন্তরার শোয়ার সাথে সাথেই চোখ ভেঙে ঘুম পেয়ে যায়।ওর ঘুমে তেমন একটা সমস্যা নেই।অবশ্য সারাদিন রাস্তায় রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি করলে রাতে ঘুম আসবেই।সেটাই স্বাভাবিক।শুভেন্দু ভাবছে দারোয়ান লোকটা গেল কোথায়?লোকটা প্রায় সারারাত জেগে থাকে,জেগে জেগে বহুতল ভবনটি পাহাড়া দেয়।দারোয়ান অবশ্য শুভেন্দুকে দেখতে পারেনা।প্রতিমুহূর্তে কথা বলার সময় ভ্রু কুঁচকে থাকে আর বলে,কি জ্বালা তুমি এখানেই আছো,যাও ঐদিকে যাও।আপদ জুটেছে এখানে!
দারোয়ানের কথা বাপ বেটির গায়ে লাগেনা।শুভেন্দু দারোয়ানকে বেশ ভয়ও পায়।তাই দারোয়ানের কথা মুখ বুজে শুনে যায়।
শুভেন্দু প্রায় ঘুমিয়েই পড়েছিল হঠাৎ তার ঘুম ভাঙল একটা মোটরবাইকের খটখট শব্দে।বড্ড জ্বালাধরা শব্দ।শুভেন্দুর মাথার শিরা দপদপ করে উঠল।হঠাৎ কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যাওয়ার দরুন এমন লাগছে তার।শুভেন্দু তাকিয়ে আছে মোটরবাইকের দিকে।দুজন অল্প বয়স্ক ছেলে মোটরবাইক থেকে নামল।ছেলে দুটো থেকে ওদের দূরত্ব খুব বেশী না।অন্তরা ফুলগুলো পাশে রেখেই শুয়ে পড়েছে।ছেলেদুটো হাঁটতে হাঁটতে ওদের কাছেই আসল।একজনের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট।ভুসভুস করে সিগারেট টানছে আর প্রতিমুহুর্তে একদলা করে থুথু ফেলছে।অন্তরার ঘুম ভেঙে গেছে।ও শোয়া থেকে উঠে বসল।
এই তুই কি ফুল বিক্রি করিস?
অন্তরা উৎকণ্ঠিত চোখে তাকিয়ে আছে।কিছুই বললনা ও।
আবার একি প্রশ্ন একজনের কাছ থেকে,কি হল বল,ফুল বিক্রি করিস নাকি?
অন্তরা হ্যাঁ-সুচক মাথা নাড়ল।
যে ছেলেটি প্রতিমুহূর্তে থুথু ফেলে যাচ্ছে সে বলে উঠল,দেখি ফুল দেখি।তোর ফুল দেখা।
অন্তরা বলল,তোমরা ফুল কিনবে?
হ্যাঁ।কিনতে এসছি।
অন্তরা ঘুম ঘুম চোখে বলল,অন্যসময় এসো।

এখন বড্ড ঘুম পাচ্ছে গো।
হঠাৎ ছেলে দুটো অন্তরার হাত চেপে ধরে বলল,দাঁড়া তোর ঘুম ছুটাই।আমাদের সাথে চল।তোকে টাকা পয়সা দেবো।
অন্তরা হাত দুটো ছাড়াবার চেষ্টা করে বলল,ছাড়!শুয়োর কোথাকার!আমার কাছে এসেছিস ক্যানো।অন্য কোথাও যা।
শুভেন্দু কাঁথাটা সরিয়ে অনেক কষ্টে দাঁড়িয়ে বলল,তোমরা কে?আমার মেয়েকে ছেড়ে দাও বাবারা....
হু দেবো।আগে ওকে নিয়ে একটু....!(মুদ্রণের অযোগ্য)
শুভেন্দু ছেলেদুটোর খুব কাছে গিয়ে বলল,আমার মেয়েকে ছেড়ে দে।নাহলে পুলিসে দেবো।পুলিস ডাকবো।
ছেলেদুটো শুভেন্দুর কথার কর্ণপাত না করে ওকে সিঁড়ি দিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেলো ওপরের তলায়।শুভেন্দুর পা কাঁপছে।সে কি করবে বুঝে উঠতে পারছেনা।সে চিৎকার করতেও পারছেনা মনে হচ্ছে তার গলা কে যেন চেপে ধরে রেখেছে।হঠাৎ তার সামনে দারোয়ান এসে হাজির।শুভেন্দু কেমন যেন একটা শক্তি খুঁজে পেল।সে চিৎকার দিয়ে উঠল,দারোয়ান দা আমার মেয়েটাকে বাঁচান।
বাঁচাবো মানে!ও কোথায়?
দুটো ছেলে ওকে ওপরে তুলে নিয়ে গেছে।তারাতারি যান না হলে মেরে ফেলবে ওকে।
ওপরে অন্তরার গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।দারোয়ান কান খাড়া করল।দারোয়ান বেশ তড়িৎ গতিতেই সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল।তার ব্যাপারটা বুঝতে বাকী থাকল না।সে তার টর্চলাইটের আলো ফেলে লম্বা লম্বা পা ফেলে ওপরে উঠতে লাগল।
শুভেন্দু বেশ ছটফট করছে।তার সারা শরীর কাঁপছে আর ঘামে জবজবে অবস্থা।তারও ইচ্ছে করছে সিঁড়ি ভেঙে ওপরে যেতে কিন্তু পা এগুচ্ছেনা।পা দুটো এমনিতেই অবশ তারপর আজ যেন আরও বেশি অবশ লাগছে।
মেয়েটির আর কোনো চিৎকারের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছেনা।শুভেন্দু হঠাৎ কাঁদতে শুরু করল।দারোয়ান নিচে নেমে আসছে।তার চোখ চকচক করছে।
দারোয়ান দা আমার মেয়ে কোথায়?
দারোয়ান রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বলল,কি যন্ত্রণা!ঘুমিয়ে থাকোতো।ডিস্টার্ব কোরোনা।তোমার মেয়ের কিছুই হয়নি।ও গল্প করছে।
কিন্তু আমার মেয়ে কোথায়?ওকে নিয়ে আসেন।
ও আসবে।ঘুমোও তো।ভারী যন্ত্রণা!
এটা কেমন কথা বললেন।
তুমি পারলে তুমি যাও।আমি পারবনা।বললাম তো কোনো সমস্যা নেই।
কথাগুলো বলেই দারোয়ান বেশ দ্রুত গতিতে কোথায় যেন হেঁটে গেল।শুভেন্দুর মাথা কেমন যেন ভনভন করে উঠল।সে অন্ধকারের ভেতরেই খোঁড়া পা নিয়ে দেয়াল ধরে ধরে সিঁড়ির দিকে এগুতে লাগল।মেয়েটার কোনো কণ্ঠস্বর পাওয়া যাচ্ছেনা।অন্তরা কি মারা গেল তাহলে?মাথাটা বেশ ঘুরছে।তার মনে হল সে অজ্ঞান হয়ে যাবে কিন্তু তাকে অজ্ঞান হলে চলবে না।পশুদের হাত থেকে মেয়েটাকে উদ্ধার করতে হবে।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৭৩৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১২/০৬/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • রহিমুল্লাহ শরিফ ১৯/০৬/২০১৬
    সুন্দর
  • অঙ্কুর মজুমদার ১৫/০৬/২০১৬
    Nice Story
  • বিশ্বামিত্র ১৫/০৬/২০১৬
    খুব ভাল হয়েছে।
  • পরশ ১৫/০৬/২০১৬
    ভাল
  • চমৎকার সূচনা::::--------------
  • ওয়াও :::
    চমৎকার :::!:::::
 
Quantcast