www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

যখন অবেচতন

বর্না রুদ্রকে অবহেলা করেও

খুঁজে ফিরে পথ থেকে পথে, অতপর

অবচেতন মনে চলে অনেক কথপোকথন| শহর

থেকে কিছুটা দূরে বর্নার ২ রুম আর ছোট্ট

বেলকনির ঘর| কাঠের

দোতলা বাড়িটা বাবা শখ

করে বানিয়েছিলেন বর্নার জন্য| এখন

বর্নার বয়স ২৯, একজন অবিবাহিত

আইবুড়ো মানবী| লোকের

কথা থেকে বর্না অনেকটা মুক্ত| কারন

বর্নাকে বৃষ্টি অনেক ভালবাসে| বর্নার

যখনই ইচ্ছে হয়, বৃষ্টির

কাছে প্রার্থনা করে, আর

তখনি রিমঝিমিয়ে ঝড়ে পড়ে বর্নাসক্ত

বৃষ্টিরা| প্রতিদিন সন্ধায় বর্না অনেক

কাঁদে, কারন সকাল

থেকে ফুটে থাকা ফুলেরা চোখের

সামনে মরে যায়|

সেই ভোর থেকে শুরু হয় নীল অর্কিডদের

সাথে বন্ধুত্ব, অথচ শেষ বিকেলে মৃত্যুর

বিলাপ করে অসহায় অর্কিডেরা|

বর্না তাদের বলে "দেখো,

তোমরা বেঁচে থাকবে আজ রাতটা,

তোমাদের আজ চাঁদ দেখাবো কেমন?

তোমরাতো ফুল, তাই চাঁদ দেখোনি"।

ফুলেরা মরে যাবে জেনেও তাদের

সান্তনা দেয়, কারন ওরা তাকে অনেক

ভালবাসে| বর্নার ঘরের সামনের ছোট্ট

উঠানে অনেক সমাধি, ফুলেদের সমাধি,

যেখানে মৃত অর্কিডেরা পরম

শান্তিতে ঘুমায়| এদেরকে সে নিজ

হাতে কবর দিয়ে আসে প্রতিদিন সন্ধ্যায়|

এসে চা নিয়ে বারান্দায় কাঁদতে বসে|

লেঁবুপাতাও তাকে দেখে কষ্ট পায়।

লেঁবুপাতা মাঝে মাঝে বর্নাকে গন্ধ

দিয়ে যায়, আর বর্না প্রাণ ভরে শ্বাস

নিয়ে সব ভুলে যায়| অনেক সুখ আর অনেক

দুঃখ, সবই ওকে ভালবাসে| কিন্তু

বর্না খুঁজে বেড়ায়

অচেনা অজানা কাউকে, যে দূর

থেকে দূরে দাঁড়িয়ে আছে, অদৃশ্য

স্বত্বা নিয়ে|

প্রতি বিকেলে খরগোশেরা কবিতা শিখতে আসে বর্নার

কাছে| সাদা খরগোশের ছানাগুলো বলে,

"তুমি এত সুন্দর কেন?" বর্না হাসে আর

ওদের কোলে তুলে নেয়| ছোট ছোট ঘাসের

ডগা দিয়ে বানানো কার্পেট

নিয়ে আসে খরগোশের দল,

বর্না তাতে বসে কবিতা শেখায়|

এভাবে চলে যেতে থাকে অনেক অনেক

ধূসর দিন| আর অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘ

হতে থাকে তার আপন তালে|

বর্না একা থেকে যায়,

একা ছবি একে যায়, একা একা অনেক

কথা লিখে যায় তার বেলপাতার

ডায়েরিতে| কত যে পথ

চেয়ে থাকা কবিতা একলা ঘুণে খেয়ে পড়ে থাকে,

তার খবর কেউ রাখে না| তারপরও

বর্না নিরবে নিভৃতে ভাল থেকে যায়|

আর অন্যদিকে...

রুদ্র তার নিরুদ্দেশ যাত্রায়

ডুবে হারানো তীর খোঁজে| কখন যে বর্নার

একাকিত্বের কথা ভুলে গেছে, বলতেই

পারে না| কিন্তু বর্না তাকে ভুলে যায়নি,

তাই এখনো বর্না একা রয়ে গেছে| একাই

থেকে যাবে ততদিন, যতদিন রুদ্র

না ফিরবে|

কেটে যায় দিন, কাটে প্রতীক্ষার রাত|

কোথায় রুদ্র আর কোথায় বর্না?! তা শুধু

প্রকৃতির পাতারা অনেক উঁচু থেকে দেখে|

থেকে যায় অজানা গল্পের মত তাদের

ভালবাসার অধ্যায়| বিপ্লবের নেশায় রুদ্র

আজ এতটা দূরে,

বর্না তাকে একবারো থামতে বলেনি| আজ

হঠাৎ করে পেছন

ফিরে তাকিয়ে দেখে রুদ্র| পাঁচটা বছর

চলে গেছে, কখন গেল কিভাবে গেল কিছুই

বোঝে না রুদ্র| এক নব হাহাকার যেন

পাঁজরটাকে ভেঙ্গে দিচ্ছে|

"এতটা বছর? কোথায় সে? কেমন আছে?

কি করে এতটা দিন আমি ভুলে ছিলাম!?"....

এমন অনেক কথা বিড়বিড় করে রুদ্র| ভাবে,

"আমাকে ফিরতে হবে"|

রুদ্রর সামনে অনেক পথ... অনেক গলি|

পেছনে ফেলে আসা সেই পথটা এদের

ভিড়ে হারিয়ে গেছে| কিন্তু

খুঁজে যে তাকে পেতেই হবে,

ফিরে তাকে যেতেই হবে| অনেক

হয়েছে এসব নিষ্ফল বিপ্লব| এবার

চিরচেনা প্রিয়মুখ খুঁজে পাওয়ার

বিপ্লবে যেতে হবে| যেখানে রুদ্র

একলা সৈনিক|

কোমড়ে লুকানো নাইম এম.এম

টা ছুড়ে ফেলে দেয় রুদ্র, এবার হাঁটা শুরু|

গন্তব্য কোথায় জানা নেই, চোখের অদৃশ্য

স্ক্রিনে বর্নার মুখ| পথের শেষ রুদ্র

সৃষ্টি করবে, বর্নার স্পর্শের পরে|

শুরু হল হাঁটা দূর থেকে দূরে... মরীচিকার

দিকে তাকিয়ে...

রুদ্র হাটছে|

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

বর্না তার আশপাশ, প্রকৃতি, ফুল, পাতা,

খরগোশ, বৃষ্টিকে নিয়ে ভালই ছিল| হঠাৎ

একটা অচেনা ঝড়, যে ঝড়

বর্নাকে চিনতে পারেনি| তাই আঘাত

হানে বর্নার ব্যাতিক্রম কাল্পনিক

জীবনটাতে| বর্নাকে সিল মেরে দেয়

মানসিক রোগী বলে| বর্নার মৃত ফুলেদের

কবর, বৃষ্টির সাথে কথা বলা, খরগোশদের

কবিতা শেখানো সব, সবকিছু

নাকি পাগলামি! বাস্তবে এসব কিছুই নেই,

বর্না একটা হসপিটালের

কেবিনে শুয়ে আছে গভীর ঘুমে,

ভেজা চোখ নিয়ে| পৃথিবী তাকে পাগল

বলেছে, আটকে রেখেছে বদ্ধ ঘরে|

বর্না বাকশক্তি হারিয়েছে অনেক আগেই

এখন শুধু চেয়ে থাকা...

বর্নার ডায়েরিটা তার বেডের পাশের

ড্রয়ারেই আছে| সেখানে আছে তার

একলা জীবনের অনেক গল্প,

যেখানে পাতারা কথা বলে,

ফুলেরা কথা বলে, বৃষ্টিরা কথা বলে| আর?

আর আছে তার এনাগ্রামের মত

বোবা কান্নার লেখনী|

দিন দিন বর্না অবনতির দিকে যাচ্ছে, মৃত্যু

শকুনের মত চেয়ে আছে তার দিকে|

বাকশক্তি হারাবার পর এখন উঠতে-বসতেও

পারেনা বর্না| শুধু জীবিত লাশের মত ধূসর

চোখে চেয়ে পড়ে থাকে একলা কেবিনে|

ওদিকে, উদভ্রান্ত রুদ্র হাঁটছে আর

হাঁটছে . . .

রুদ্র হাঁটে আর ভাবে সেই মধ্য দুপুরের কথা|

যেদিন বর্না ব্যাগ থেকে রুটি বের

করে বলেছিল "এই রুটিটা স্টুডেন্টের

মা দিয়েছে আমাকে,, ভেতরে চকোলেট

মিক্সড আছে,, অনেক মজা খেতে,, তাই

তোমার জন্য নিয়ে এসেছি,,

খেয়ে দেখো না একটু"|

রুদ্র ভাবে সেই বিকেলের কথা, যেদিন

গলা থেকে সোনার

চেইনটা খুলতে খুলতে বর্না বলেছিল-

"এটা দিয়ে কি হবে, বেলকাঠের

মালা কিনে পড়ে নিবো,

এটা বিক্রি করে তোমার অস্ত্রটা কিনো,

বিপ্লবীদেরকে সিকিউরড থাকতে হয়,

নাও ধরো তো চেইনটা"|

রুদ্র হেঁটেই চলে, হঠাৎ মনে হচ্ছে চোখের

কোনে এক ফোঁটা জমা পানি এসেছে...

সব পথ শেষ করে সব ঠিকানার ভুল নির্ণয়

করে অবশেষে বর্নার খোঁজ পায় রুদ্র| রুদ্র

ঠায় দাড়িয়ে আছে,

সামনে মহাপ্রাচিরের মত উঁচু ভবন, এটাই

সেই হসপিটাল, যেখানে আছে বর্না|

রুদ্র নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকে ভবনটার

দিকে|

একদিন পুলিশের গুলিতে আহত

রুদ্রকে এখানে এনেছিল বর্না, আজ

সে ওখানেই আছে| সময়ের কাঁটা এ কেমন

দিকে ঘুরলো, বুঝতে পারে না সে|

পা বাড়ায় হাসপাতালের দরজার দিকে|

সিঁড়ি বেয়ে ওঠছে আর হার্টবিট

বাড়ছে বেপরোয়া গতিতে| এতটা বছর পর,

এতটা নির্মম ভাবে দেখা?

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

~~~~~~~

২০১ নাম্বার কেবিন| দরজায়

দাড়িয়ে আছে রুদ্র| ভেতরের অপার

নিস্তব্ধতার শব্দ বাহির থেকে স্পষ্ট

শোনা যাচ্ছে|

দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে রুদ্র...

বুক পর্যন্ত চাদরে ঢাকা, চোখের

নিচে অনেক ডার্ক সার্কেল, ক্লান্ত মুখ,

শুষ্ক ঠোঁট আর বন্ধ চোখ| বুকের

ভেতরটা যেন বন্ধ করে দিল রুদ্রর|

"এ কি হাল তোমার! এতটা দুর্বল

কি করে হলে! সেদিনের সেই

সুন্দরী অনন্যা, আজ সন্ধ্যার ঝরা গোলাপ!"

এমনি ভাবে রুদ্র|

এক পা এক পা করে কাছে যায়,

পাশে বসে বর্নার| আলতো করে মাথায়

হাত বুলায়. .

বর্না চোখ খোলে একরাশ ক্লান্তি নিয়ে|

রুদ্রর দিকে একবার তাকিয়ে আবার চোখ

বন্ধ করে ফেলে| বন্ধ চোখের ভেতর

থেকে বেরিয়ে আসে জলধারা| অনেক

কান্না অনেক... রুদ্র বোকার মত

কান্না দেখে আর ভাবে "এত অভিমান

এতদিন কোথায় রেখেছিলে ?"

বর্নাকে উঠিয়ে বসায় রুদ্র, তারপর

জড়িয়ে ধরে বসে থাকে অনেকক্ষণ|

"কেমন আছো তুমি?"

বর্না চুপ করে থাকে| রুদ্র অনেক কথা বলে,

অনেক কিছু জিজ্ঞেস করে, কিন্তু শুধু

চেয়ে থাকে বর্ণা|

রুদ্র বুঝতে পারে, বর্না নির্বাক

হয়ে গেছে, তার ছটফটে বর্না চুপ

হয়ে গেছে অনেক আগে|

নিশ্চুপ বর্নার দিকে অবাক

চোখে তাকিয়ে থাকে রুদ্র| হঠাৎ খেয়াল

করে বর্না বারবার চোখ দিয়ে পাশের

ড্রয়ারটা দেখাচ্ছে| শুধু বাম

পাশে চেয়ে আছে| রুদ্র

উঠে গিয়ে ড্রয়ারটা খুলে একটা নীল

ডায়েরি দেখতে পায়| অনেক দিনের

চেনা পরিচিত ডায়েরি এটা| চোখের

সামনে ভেসে ওঠে সেদিনের কথা, যেদিন

রুদ্র এই ডায়েরিটা বর্নাকে দিয়েছিল|

এতটা বছর ধরে ডায়েরিটা এত নতুন

থেকে গেলো?

রুদ্র ডায়েরিটা হাতে নিয়ে বর্নার

দিকে তাকায়, বর্নার ভেজা চোখ

চেয়ে থাকে ডায়েরিটার দিকে|

ডায়েরিটা উল্টে পাল্টে দেখতে থাকে রুদ্র

| অনেক কবিতা, ছোট ছোট কথামালা...

আরো কত কি যে লিখেছে তার হিসেব

নেই| হঠাৎ একটা লেখা চোখে পড়ে ওর-

"আমি দাড়িয়ে আছি ঠিক রাতের

রাজপথে

নিভে যাওয়া ল্যাম্পোষ্ট হয়ে,

আমি পড়ে আছি রাস্তার

পাশে পড়ে থাকা

আধখাওয়া সিগারেট হয়ে,

আমি দাঁড়িয়ে আছি মানুষের সমুদ্রে

জাহাজী কাল্পনিকের মত,

আমি ভেসে আছি ঘোলাটে চোখের মাঝে

জমে থাকা ময়লা পানি হয়ে,

আমি ডুবে গেছি একবুক হতাশায়;

আমি বেঁচে আছি অনেক কিছুর মত|

জানো রুদ্র? আমি কত কিছুর মত?"

লেখাটা পড়ে রুদ্র বর্নার দিকে তাকায়,

বর্না শুন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে......

আবার পড়তে থাকে ডায়েরিটা,

যেখানে লেখা-

"আমি বেঁচে আছি কল্পনা আর বাস্তবতার

যুদ্ধে

আহত সৈনিকের মত,

আমি বেঁচে আছি জলের

মাঝে আঁটকে থাকা

মরা মাকড়সার মত,

আমি বেঁচে আছি জ্বলন্ত সিগারেট থেকে

খসে পড়া ছাইয়ের মত,

আমি বেঁচে আছি নিভে যাওয়ার পর

জমাট বাঁধা মোমের মত,

আমি বেঁচে আছি অন্ধকার ঘরের ছোট্ট

ছিদ্র দিয়ে আসা

বিন্দু আলোর মত,

আমি বেঁচে আছি ফেলে দেয়া ডায়েরির

ভিজে যাওয়া পাতার মত,

বর্ষার ছোঁয়াহীন পড়ে থাকা ছাতার মত,

আমি বেঁচে আছি অনাদরে, পরগাছা হয়ে

টিকে থাকা লতার মত|"

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~

~~~~~~~~~~~~~

রুদ্র পড়া শেষ করে চোখ বন্ধ

করে রাখে কিছুক্ষন, ভাবে,

“আমি এতটা ভাগ্যবান প্রেমিক

হয়ে জন্মেছি কেন? তবু আজ এত

ব্যাথা কেন?”

চোখ খুলে ডায়েরির শেষ

পাতাটা দেখে রুদ্র|

সেখানে বড় করে লেখা-

"এতদিন কোথায় ছিলে?"

এবার বর্নার দিকে তাকায় রুদ্র, একি!

বর্না এভাবে চোখ বন্ধ

করে রেখেছে কেন!

রুদ্র কাছে গিয়ে আলতো করে গালে হাত

রাখে বর্নার| একদম বরফের মত শীতল গাল

বুঝিয়ে দেয়, ভাগ্যবান প্রেমিক হয়েও

ভাগ্যের পরিহাসের নির্মম শিকার রুদ্র

আজ| শুধু বলল, "বর্না, এতদিন অবচেতন

ছিলাম, আজ জেগেছি তবে তুমি কেন

অবচেতন হয়ে গেলে??”

চারদিক নিস্তব্ধ আর

অন্ধকারে প্রতিধ্বনি,

“এতদিন কোথায় ছিলে?”
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৩৬৫ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৩/০৫/২০২০

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast