www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ফেরদৌস রায়হান

জলবায়ু পরিবতর্ন , মানব সৃষ্ট সংঙ্কট
ফেরদৌস রায়হান
চৈত্র মাসের শুরুতে হাওর অঞ্চলে বন্যায় ভেসে গেছে বোরো ফসল। এখন কর্তিক মাসে অকাল বন্যায় রাস্তা, মাঠ-ঘাট,হাওর-বাওড়,পানিতে ভরে গেছে । স্মরণ কালের এ দীর্ঘ বন্যা বোরো,সাইল,আমন তিনটি ফসল নষ্ট হয়ে গেছে ।

বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব দৃশ্যমান হচেছ । দেশের সর্বত্র কোথাও হচ্ছে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় কোথাও বা পড়ছে বরফ। বাংলাদেশে চলতি বছরে চৈত্র মাসের বৃষ্টিতে হাওরের ফসল তলিয়ে গেছে, আর কার্তিক মাসেও হচ্ছে বর্ষাকালের মত টানা বর্ষণ। কিন্তু মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে না পারলে এর পরিণতি হবে ভয়াভহ । ইতি মধ্যে বাংলাদেশের মানুষ তাহা টের পেয়ে গেছে ।

১৮৮০ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে মেরু অঞ্চলের বরফ গলা শুরু করেছে এবং সমুদ্রের পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। যদি গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ না করা হয়, তাহলে বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট বৃদ্ধি পাবে যাতে পৃথিবীর বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জীবনধারণ অসম্ভব হয়ে পড়বে।

গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়ায় বায়ুমণ্ডলে থাকা কিছু গ্যাস তাপ বায়ুমণ্ডলে আটকে রাখছে যা সাধারণত মহাশুণ্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার কথা। কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাস এর মধ্যে অন্যতম। বায়ুতে কার্বন ডাই অক্সাইড না থাকলে পৃথিবী তুষারাবৃত বিরানভূমি হত। ১৮৯৬ সালে বিজ্ঞানীরা অনুসিদ্ধান্তে পৌঁছেন যে মানুষ যত বেশি গ্রিনহাউজ গ্যাস ত্যাগ করবে পৃথিবীর তাপমাত্রা তত বৃদ্ধি পাবে।শিল্পযুগের তুলনায় বর্তমানে বায়ুতে কার্বন ডাই অক্সাইডের পরিমাণ ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, এবং বিজ্ঞানীরা তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়ে যে অনুমান করেছিলেন ঠিক ততটাই বেড়েছে।

কার্বন ডাই অক্সাইড বৃদ্ধির জন্য মানুষই দায়ী। তেজস্ক্রিয় পদ্ধতিতে প্রাকৃতিক ও শিল্পযুগের কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের পার্থক্য নিরূপণের পরে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে বাড়তি গ্যাস মানুষের কর্মকাণ্ডের কারণেই সৃষ্টি হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই অক্সাইড ।

পৃথিবী ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন। আগামী ২৫-৩০ বছরের মধ্যে জলবায়ু ক্রমাগত উষ্ণ হতে থাকবে। কোরাল রিফ এবং অন্যান্য সংবেদনশীল জীবজগতে ইতিমধ্যে মড়ক লেগে গেছে। যদি দীর্ঘমেয়াদী কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণ না করা হয় তাহলে এর প্রতিক্রিয়ায় পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে এবং পৃথিবীতে বৃহত্তম প্রাণী ও বৃক্ষের বিলুপ্তির সূচনা শুরু হবে। মেরু অঞ্চলের বরফ গলে বিশ্বের বেশিরভাগ উপকূলীয় শহর ডুবে যাবে। বাংলাদেশের ১৭ শতাংশ ভূমি সমুদ্র গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষ জলবায়ু পরিবতর এর কারনে ঘৃহহীন হয়ে পড়বে ।

প্রকৃতির এই বিরূপ রূপ ধারণ করার কারনে,বিজ্ঞানীরা বিস্ময় প্রকাশ করেছেন যে তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে লু হাওয়া, প্রচণ্ড বজ্র ঝড়বৃষ্টি, উপকূলীয় বন্যা সৃষ্টি হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে খরার তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে ।এই সমস্যার বাস্তবিক সমাধান কল্পে,কার্বন নিঃসরণ নীতিমালা বিশেষজ্ঞরা দ্রুত কার্যকরের আহ্বান জানাচ্ছেন।

জলবায়ু বান্ধব জ্বালানি নীতি । বায়ু,সোলার,পানিবিদ্যুৎ ও পারমাণবিক জ্বালানি বায়ুমণ্ডলে সবচেয়ে কম কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে। প্রাকৃতিক গ্যাসের মাধ্যমে পরিচালিত পাওয়ার প্ল্যান্টও অনেক কম কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে। কিন্তু জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলা ও বায়ুদূষণ কমানোর মাধ্যমে স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাসে,জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধে ব্যক্তি পর্যায়ে নাগরিক হিসেবে আমরা পরিবর্তনের ডাক তুলতে পারি ।

এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) এবং পোস্টড্যাম ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট ইমপ্যাক্ট রিসার্চ (পিআইকে) যৌথ উদ্যোগে এ প্রতিবেদন তৈরি করে।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনে এই অঞ্চলের দেশগুলোতে ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি হ্রাস, বর্তমান উন্নয়ন ধারা বাধাগ্রস্ত এবং মানুষের জীবনযাত্রার মান হ্রাস পাবে। বেড়ে যাবে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। এতে বলা হয়, এশীয় অঞ্চলে বায়ু দূষণের ক্ষতিকর প্রভাবে প্রতি বছরে ৩৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এ ধরনের মৃত্যুর তালিকায় চীন, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ২০৫০ সালের মধ্যে তাপ প্রবাহে বৃদ্ধ মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা ৫২ হাজার উন্নীত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।এছাড়া ম্যালেরিয়া ও ডেঙ্গুর মতো রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে। বসতি সমস্যা, ব্যাপক অভিবাসন, বিশেষ করে নগর এলাকায় বৃদ্ধি পাবে। ফলে নগরীতে জনসংখ্যার চাপ বাড়বে এবং সেবামূলক খাতগুলোতে চাপ বাড়বে।

একই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ও টাইফুনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এটা বৃদ্ধির পরিমাণ ৫০ শতাংশের বেশি হতে পারে। সেইসঙ্গে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে বৃষ্টিপাত ২০ থেকে ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে পারে। অঞ্চলের উপকূল ও নিচু এলাকায় বন্যার ঝুঁকি বৃদ্ধি পাবে। 

এ অঞ্চলের ২৫টি নগরীর মধ্যে ১৯টিতে সমুদ্রের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পাবে। এর মধ্যে ফিলিপাইনেই সাতটি উপকূলীয় বন্যা ও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হবে ইন্দোনেশিয়া। ২১০০ সাল পর্যন্ত এখানে প্রতিবছরে ৫৯ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়, বছরে নদী প্লাবিত এবং ড্রেনেজ ব্যবস্থার কারণে দেশের ২০ থেকে ২৫ ভাগ এলাকা প্লাবিত হতে পারে। বিগত ২০ বছরের মধ্যে তিন বছর যথাক্রমে ১৯৮৭, ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালে বড় বন্যা হয়। এ সময় দেশের ৬০ ভাগের অধিক এলাকা প্লাবিত হয়।

এদিগে বাংলাদেশ সরকারের হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন অধিদফতর অন্তর্ভুক্ত নয় এশিয়ার বৃহত্তম হাওর হাকালুকির ।হাকালুকি হাওরের আয়তন ১৮১.১৫বর্গ কিলোমিটার। হাওরটি ৫টি উপজেলা ও ১১টি ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত। হাওরের ৪০% বড়লেখা, ৩০% কুলাউড়া, ১৫% ফেঞ্চুগঞ্জ, ১০% গোলাপগঞ্জ এবং ৫% বিয়ানীবাজার উপজেলার অন্তর্গত।

হাকালুকি হাওরের বিশাল জলরাশির মূল প্রবাহ হলো জুরী এবং পানাই নদী। এ জলরাশি হাওরের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত কুশিয়ারা নদী দিয়ে প্রবাহিত হয়। বর্ষাকালে হাওর সংলগ্ন এলাকা প্লাবিত হয়ে বিশাল রূপ ধারণ করে।

হাকালুকি হাওরে প্রায় ২৩৮টি বিল রয়েছে। প্রায় সারা বছরই বিলগুলোতে পানি থাকে। বিলগুলো হচ্ছে- চাতলা বিল, চৌকিয়া বিল, ডুল­া বিল, পিংলার কোণা বিল, ফুটি বিল, তুরাল বিল, তেকুনি বিল, পাওল বিল, জুয়ালা বিল, কাইয়ারকোণা বিল, বালিজুড়ি বিল, কুকুরডুবি বিল, কাটুয়া বিল, বিরাই বিল, রাহিয়া বিল, চিনাউরা বিল, দুধাল বিল, মায়াজুরি বিল, বারজালা বিল, পারজালা বিল, মুছনা বিল, লাম্বা বিল, দিয়া বিল ইত্যাদি।

অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ নির্মাণ, নদী ড্রেজিং আর সীমাহীন দূর্নীতির কারনে পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় এমনিতে একটু বৃষ্টি হলে সারা বছর পানি লেগে থাকে ।

অপর দিগে জুরী নদী, সুরমা নদীর মূল উত্স উজানে ভারতের বরাক নদী । এই বরাক নদীর মিলন স্তল চীনের তুইভাই তুইমুই নদী । আমেরিকার এক দল বিজ্ঞানী বলেছেন । টিপাইমুখে যে রাবারড্রাম বাঁধ বসানোর ফলে ২০৫০ সালের মধ্যে হাকালুকি সাহারা মরুভূমিতে পরিণত হবে । ধংশ হবে মৌলভীবাজার জেলার ১৩৪ টি চা বাগান ।

হাকালুকি হাওরে গরু,মহিষ, মাছ ও হাঁস মৃত্যুর পেছনে ভারতের ইউরেনিয়াম প্রধান কারণ এমন খবরে হাওরাঞ্চল জুড়ে দেখা দিয়েছে তীব্র আতঙ্ক। কিন্তূ হাকালুকিতে ইউরেনিয়ামের অবস্থান রয়েছে সে বিষয় মানতে নারাজ জেলার প্রাণিসম্পদ এবং মৎস্য কর্মকর্তারা

ইউরেনিয়ামের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পানিতে ইউরেনিয়াম মিশ্রণের ফলে ইউরেনিয়াম ট্রাই হাইড্রাইড উৎপন্ন হয়। সেখান থেকে ইউরেনিয়াম অক্সাইড উৎপাদন হয়, যা যেকোনো অক্সাইড প্রাণি জগতের জন্য ক্ষতিকারক।

সিলেট এমসি কলেজের রসায়ন বিভাগের প্রধান শেখ আবুল কাওসার ইউরেনিয়ামের বিষয়ে বলেন, ইউরেনিয়াম পানিতে মিশ্রণের ফলে মারাত্মাক তেজষ্ক্রিয়তা সৃষ্টি হয়, যা যেকোনো প্রাণির জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অন্য প্রসঙ্গে আবুল কাওসার বলেন, শুধু মাছ কিংবা হাঁস নয়, মানুষ, হাওরঞ্চলে ছোট ছোট পাখি, জলজ প্রাণিও তেজষ্ক্রিয়তা থেকে রক্ষা পাবে না

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হাওরাঞ্চলের পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ অস্বাভাবিকহারে কমে যাওয়ায় মাছের মড়ক দেখা দিতে পারে। মাছের স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য প্রতি এক লাখ লিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ থাকতে হবে ৫ থেকে ৮ মিলিলিটার। অক্সিজেনের পরিমাণ ৪ ভাগের নিচে কমে এলে জলজ প্রাণির মৃত্যুর কারণ ঘটতে পারে।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সীমান্ত থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে রয়েছে ওপেনপিট ইউরেনিয়াম খনি। বন্যার পানিতে বাংলাদেশে ইউরেনিয়াম প্রবেশের কারণে হাওরাঞ্চলে মাছ ও হাঁসের মৃত্যু হচ্ছে এমন সংবাদ মৌলভীবাজার জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

মানব সৃষ্ট এ সকল সংকট মোকাবেলায় ব্যক্তি,গুষ্টি,সংগঠন,রাষ্টকে যৌথভাবে উদ্বোগ নিতে হবে ।
বিষয়শ্রেণী: সমসাময়িক
ব্লগটি ১১৮৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৮/১০/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast