www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

পথের সাথী-১

দৈনন্দিন ব্যস্ত দিনকাটানোর পর বাসে চড়ে বসেছিলাম বাসায় ফিরব বলে। বসেছিলাম বিআরটিসি ডাবল ডেকারবাসের দ্বিতীয় তলার প্রথম সারিতে যেখান থেকে সম্মুখ রাস্তা পরিষ্কার দেখা যায়।বাসে তখন যাত্রী আমাকে নিয়ে মোট তিন জন। আমার পাশে চলাচলের পথ তারপরের সিটে দশএগারো বছরের এক ছেলে বসা ছিল। যা দৃষ্টি উদাসীন, চেহারা মলিন, চোখের নিচে কালো দাগ, ছটপট ছটপট ভাব, হাত ও পায়ে কাটা ছেড়ার চিহ্ন, ডান হাতে আটকানো রয়েছে রং বেরং এর পাঁচটি বেসলেট, নগ্ন পায়ে ধুলো জমে রয়েছে যেন সে অনেকদূর ধুলোমাখা পথ হেটে এসেছে। গায়েরছিন্ন পোষাকে কাঁদা মাটির ছোপ ছোপ আলপনা।



কিছুক্ষণ পর দুজন লোকএসে ছেলেটিকে তার সিট থেকে তুলে তারাও ওর সীটটি দখল করে বসে। আমি ভাবতে থাকি সবলেরকাছে দুর্বলের অসহায় আত্মসমর্পণ। ছেলেটি তখন আমার পাশের সীটে এসে আসন গেড়ে বসে।আমি ছেলেটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি, তাকে জিজ্ঞেস করি"নাম কি তোমার?

"আলামিন"ছেলেটির নির্লিপ্ত-ভাবে উত্তর দেয়। আমি আবারো প্রশ্ন করলাম "তুমি কি কর?"

"ডিউটি করি"ছেলেটি উত্তর দেয়।

"কিসের ডিউটি?"

"বাসে ডিউটি করি, ৪ নম্বর বাস আসেনা সাভার যায় ঐ বাসে থাকি।"

"তোমার বাবা মা নাই?"

"বাপ নাই মারা গেছে, মা আছে।"

"তোমার মা কি করে?"

"গার্মেন্টসও কামকরে?"

"লেখাপড়া কতদূর পড়েছ?" আমি জানতে চাইলাম

"লেখাপড়া করি নাই, ক্লাস ওয়ান পর্যন্ত পড়ছি।"

"লেখাপড়া করতে ইচ্ছাকরেনা?"

"মায়ে কইছিল লেখাপড়াকরতে, আমি না কইরা দিছি। লেখাপড়া কইরা কি অইব?"

"তাই! লেখাপড়া কইরাকিচ্ছু অইবনা?"

"লেখাপড়া কইরা কি আরঅইব।"

"লেখাপড়া করলে ভালাচাকরি করতে পারবা, টেকা কামাইতে পারবা।" আমি তাকে লেখাপড়ার উপকারিতাবুঝাতে যাই।

"টেকাতো অহনওকামাই।" ছেলেটির গর্বিত উত্তর।

"বাসে তোমারে কয়ট্যাহা দেয়?"

"দেয় পাঁচ সাতশ।"

"মাসে পাঁচ সাত শ?"

"আরে না, দিনে।" আমি অবাক হই, এই ছেলে দিনে পাঁচ থেকে সাতশ টাকা কামাই করে! তাকে বলি

"তাইলেতো মাসেতোমার ম্যালা ইনকাম।"

"হয়, টাকা খাওয়ার মানুষ নাই।"

"তুমি তো লেখাপড়াজানোনা তো ট্যাকা গুন কেমনে?"

"ট্যাকা গুনতেলেখাপড়া জানুন লাগে না, এমনিতেই গুনন যায়।"

"তাই নাকি? তাহলে কও দেখি তিনশ আর পাঁচশ কত হয়?" আমি তাকে পরীক্ষায় ফেলেদিই কিন্তু সে সহজেই উত্তর দিয়ে দেয়।

"আটশ ট্যাকা।"

আমি বললাম"বাহ্!"



তার হাত ও পায়ের কাটাছেঁড়ার চিহ্নগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম

"আচ্ছা তোমার হাতপায়ে এসব কাটা দাগ কেন?"

"এক্সিডেন্টকরছিলাম।" সে সহজভাবে উত্তর দেয়।

"এক্সিডেন্টকরছিলা!"

"হয়, বাস একবার সামনের একটা বাসের লগে লাগাইয়া দিছিল, আমি গেইটে দাড়ায়া ছিলাম, নিজেরে ঠিকমত সামলাইতে পারিনাই রাস্তায় পইরা গেছিলাম হাত পা ভাইঙ্গা গেছিল, একটুর লাইগা চাক্কার নিচে যাইনাই।"

"ঠিক অইতে কয়দিনলাগছিলো?"

"মাস তিনেকলাগছিলো।"

"চিকিৎসার ট্যাকা কেদিছিল?"

"মালিক কিছু ট্যাকাদিছিল।'

"বাসে তোমার ডিউটিকতক্ষণ?"

"শুক্কুরবার ছাড়াপ্রত্যেকদিন।'

"প্রত্যেকদিন কিদিনে না রাইতেও থাকতে হয়?"

"দিন রাইতসবসময়।"

'ঘুমাও না?"

"ফজরের আজানের পরকয়েক মিনিট ঘুমাই, আর শুক্কুরবার হারাদিন ঘুমাই।"

"কি কও! কয়েক মিনিটঘুমাইয়াই দিন কাটাইয়া দেও?"আমি অবিশ্বাসের স্বরে বলে উঠি। আমি ভাবি দৈনিকসাতঘন্টা ঘুমিয়েও আমার ঘুমের তৃষ্ণা মেটেনা আর এই ছেলে মাত্র কয়েক মিনিট ঘুমায়।

"হ, আগে খারাপ লাগত অহন অভ্যাস হয়া গেছে।" ছেলেটি তার অভিব্যক্তি জানায়। আমিতাকে বলি

"দেখছ, লেখাপড়া করলেই কি তোমার এত কষ্ট করুন লাগত? আরামে চাকরি করতা।এক্সিডেন্টে হাত পাও ভাঙত না, রাইতে শান্তিমত ঘুমাইতে পারতা।"

"কষ্ট না করলে কি আরআরাম অইব? লেখাপড়া জানলেই কি ট্যাকা কামাই করা যায়? কত শিক্ষিত মানুষ দেখলাম দু এক ট্যাকা কম দেওনের লাইগা খেঁচ করে। আর আমি যেট্যাহা কামাই করি এই ট্যাহাইতো কুত্তা খাইব।"



ওর হাতের বেসলেটগুলোরদিকে তাকিয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম "এগুলো কি?"

"এ গুলাবেসলেট" সে উত্তর দেয়।

"এগুলো লাগাইছ কেন?"

"অনেকে লাগায় তাইআমিও লাগাইছি'

"আইজ তোমার ডিউটিনাই?"

"না, আজ ছুটি নিছি বইনের বাড়িত গেছিলাম।"

"বইনের বাড়ি কৈ?"

"টঙ্গি।"

"বইন কি করে?"

"আগে গার্মেন্টস একাম করত বিয়া হওনের পর আর করেনা।"

"দুলাভাই কি করে?"

"কম্পিউটারে কাম করে?"

"কোন কম্পিউটার?"

"এতকিছু জানিনা।"

"তুমি বিরক্ত হচ্ছনাকি?"

"আরে না, আমার কামই অইল সারাদিন কথা কওয়া।"

"তুমি বইনের বাড়িগেলা অথচ ভালা জামা কাপড় পইড়া গেলা না? জামায় কাঁদা মাটি একাকার, পায়েও দেখি জুতা নাই।"

"জামা ভালাই ছিল, আওনের সময় এক গাড়ি কাঁদা ছিটাইয়া দিছে। জুতা ভুলে বইনের বাড়িত রাইখাআইছি।"



আমাদের কথোপকথনের মাঝেশুনলাম সে গুনগুন করে গান গাইছে। তাকে বললাম

"ভালো করে গানগাও।"

"আমি গাইতেপারিনা।" সে গান গাইতে অস্বীকৃতি জানায়।

"এইযে গুন গুনকরতাছো এইডাই গাও।'

"আমি কইলামতোপারিনা।"

"তোমরা কই ভাইবোন?"

"আমার আরেক ভাইআছে।"

"ভাই কি করে?"

"গাড়ি চালায়।"

"দিনে কয় ট্যাহাপায়।"

"হাজারের উপরে পায়।লং রুঢেতো মেলা যাত্রী।"

"তোমার বাড়ি কই যেনকইছিলা?"

"বরিশাল।"

"বাড়ি যাও না?"

"ঈদের পরেযামু।"

"বড় অইয়া কি হইতেচাও?"

"ড্রাইভার হমু, গাড়িত কাম করতাছি ড্রাইভার না হইতে পারলে ইজ্জত থাকব?" যাক তারও একটি স্বপ্ন আছে জেনে আমার ভালো লাগল।



ঐদিন তার সাথে এর বেশী আরকথা হয়নি, আমার গন্তব্যে আমাদের বাসটি চলে আসায় আমি বাস থেকে নেমেযাই। আমি আশায় থাকি আবার হয়ত আলামিনের সাথে আমার দেখা হবে যেদিন সে থাকবে বাসেরচালক আর আমি তখনো থাকব বাস যাত্রী হিসেবে।
বিষয়শ্রেণী: অন্যান্য
ব্লগটি ১১৪৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২২/০৯/২০১৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • Înšigniã Āvî ২২/০৯/২০১৩
    মন কেড়ে নেওয়া এক ঘটনা
  • মাহমুদ নাহিদ ২২/০৯/২০১৩
    ভালো লাগলো ।
 
Quantcast