www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

১২৫ দিন আর কয়েকটা ঘণ্টা

জানালা খুলে চোখ বন্ধ করে বসে আছি গত দুই ঘণ্টা যাবত ।
মা এই নিয়ে দুইবার এলেন , জিজ্ঞেস করলেন তুই চোখ বন্ধ করে বসে আছিস কেন? জবাব না দেওয়ায় দুইবার ঐ এক প্রশ্ন করলেন , দ্বিতীয়বারও কোন উত্তর পেলেন না । আমি চুপ দেখে মাও আমাকে আর না ঘাটিয়ে চলে গেলেন ।
সকাল মনে হয় প্রায় দশটা বাজে,
দুপুর হবে একটু পরই আমি বেশ টের পাচ্ছি হালকা হালকা রোদ এসে গালে পরছে ।
আমার সবসময়ই নিচ তলার বাসা ভালো লাগতো না তবু জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটিয়েছি নীচতলা বাসায় এখানে অবশ্য একটু অন্য রকম , পাঁচ তলার উপর বসে আছি আকাশ আমার খুব প্রিয় বসন্তের রোদও আমার খুব প্রিয় , আমার মনে হয় যত উপরের দিকে ওঠা যায় আকাশের ততটা কাছে যাওয়া যায় ...
এই পাঁচ তলা থেকে আকাশটাকে যতটা কাছে ভেবেছিলাম ততটা কাছে মনে হয় না, তবু জানালার ফাঁকে আসা এই রোদটা আমার খুব প্রিয় ।
আমি চোখ বন্ধ করে কবরের অন্ধকারের পরিমাণটা বোঝার ট্রাই করছিলাম কিন্তু পারছিলাম না ... পারার কথাও ছিল না বটে , থাকবেই বা কেন ? কবরে তো আর পৃথিবীর রোদ গিয়ে পৌঁছাবে না । কোন স্বাভাবিক মানুষ কবর নিয়ে এমন চিন্তা করে কিনা জানিনা কিন্তু আমি করছি , মৃত্যু খুব কাছে হয়তো তাই কবরের চিন্তা আমার মাথায় মৌমাছির মত ভন ভন করতে থাকে প্রায় সময় ।
কবর থেকে কোন যোগাযোগের মাধ্যম থাকলে ভালো হত , কবর থেকে কিছু তথ্য দিতাম যারা আমার মত মৃত্যুর দ্বার প্রান্তে দাড়িয়ে ।
গত ১২৫ দিন যাবত টাটা মেমোরিয়াল সেন্টার নামক এই হাসপাতালের পাঁচ তলায় আমার বসবাস ।
সারাদিন বিভিন্ন ধরনের ঔষধের গন্ধ , প্রথম প্রথম বমি আসতো কিন্তু এখন আর আসে না , নাকের ভেতর ঢোকানো এক লম্বা নল হাতে গাঁথা ব্যাটার ফ্লাই , দিনে তিনবার করে খাওয়া ঔষধ , আর নিয়ম মাফিক চলা ফেরা এখন এ নিয়েই আমার জীবন ।
আমি অবশ্য রুম টাকে নিজের মত করে নিয়েছি ,আমার ব্যাডটা ছিল এই ছোট্ট রুমটার মাঝ বরাবর আমার করা রিকুয়েস্টের কারনে জানালার পাশে এনে ফিক্সড করা হয়েছে , এখন আমি রোদ দেখতে পারি মন ভরে , ফাল্গুনের হালকা বাতাস আমাকে প্রতিদিন এই হাসপাতালের ব্যাডে এসে স্পর্শ করে যায় , কিন্তু এখন পর্যন্ত কোকিলের ডাক শুনিনি ,কলকাতায় কি একটাও ককিল নেই ?
দেশ ছেড়ে আমি এখন দূরে তবু অনেক দিন থাকার কারনে কলকাতার এই ক্লিনিকটাকে আপনই মনে হয় । কলকাতায় এসে সুনীলের দুইটা বড় বড় বই কিনেছিলাম অনেক মন দিয়ে পড়াও শুরু করে দিয়েছিলাম কিন্তু সেকেন্ড বার কেমো দেওয়ার পর থেকে আর পড়তে পারি না পুরো শরীরের ব্যথা আমাকে আমার বইয়ের জগত থেকে দিন দিন সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ,আমার শুধু ভয় মৃত্যুর আগে যেন অন্তত চোখের দৃষ্টিটা অক্ষত থাকে , অন্ধের মত অন্তত মরতে চাই না ।
বাইরে তেমন একটা যাই না তবু প্রতি রাতে কেউ না কেউ মারা যায় আত্মীয় স্বজনের হাহাকার চিৎকার আমার কানে আসে , প্রথম প্রথম কেমন যেন ভয়ে শিউরে উঠতাম কিন্তু এখন আর ভয় লাগে না ... নিজেকে প্রস্তুত করতেই আমি এখন উঠে পরে লেগেছি ,
বোন_মেরু ক্যান্সার আমার শরীরে বাসা বেঁধেছে , মেডিকেল সাইন্সে যার নাম Osteosarcoma ।
লাস্ট স্টেজে আছি আমি , বাঁচার সম্ভাবনা ক্ষীণ , তবু বাঁচার আশা রাখি , মৃত্যুর আগে মরতে চাই না তাই যতটা দিন আছি প্রত্যেকটা মুহূর্ত ডাবল করে বাঁচতে চাই ।
তবে খারাপ লাগে এই ভেবে যে বাবা মা আর বড় আপু খুব কান্না কাটি করে , তবে কেউ আমার সামনে কান্নাকাটি করে না ।
তাদের সামনে বা অন্য যে কারো সামনে আমিও অনেক শক্ত মনের একজন মানুষ , কিন্তু যখন রাতের বেলায় আমি ঘুমিয়ে গেলে মা আস্তে করে আমার হাতের উপর হাত রাখে , যখন তার চোখের বিন্দু বিন্দু জল এসে আমার হাতের উপর পরে তখন কাঁদতে ইচ্ছা হয় খুব জোড়ে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছা হয় , কিন্তু আমি কাঁদি না কারন আমার কান্না আমার বাবা মা আর আপুকে অনেক বেশি কষ্ট দেয় ।
চোখ খুললাম , সূর্য তখন মাথার উপর উঠে গেছে , আমার ঔষধ খাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে ,
মা বললেন অনেক ক্ষণ বসে থেকেছিস এবার একটু শুয়ে পর , শুতে আমার ভালো লাগে না কয়েকদিন পরই তো চিরদিনের জন্য শুতে হবে , তবে এখন কেন ?
আমি মাকে বললাম মা আয়নাটা একটু দেবে ? মা একটু থতমত খেয়ে বলে বসলেন অহ আয়না আয়নাটা গত রাতে ভেঙে গিয়েছে , তোর বাবাকে বলেছি পরে কিনে এনে দেবেন ,
আমি জানি আয়না ভাঙেনি ! গত কেমো দেওয়ার পর থেকে মা আমাকে আয়না থেকে দূরে রাখেন আমি জানি হয়ত আমার চেহারা নষ্ট হয়ে গিয়েছে মাথায় হাত দিলে বুঝতে পারি আমার মাথা ভর্তি কোঁকড়া ছোট ছোট করে কাটা চুল এখন প্রায় নেই বললেই চলে ! মা হয়ত তার ছেলেকে এই বীভৎস চেহারাটা দেখতে দিতে চান না , তাই আয়না চাইলেই এই সেই বাহানা বানিয়ে কথা এরিয়ে যান !!
মা আবারো শুয়ে পড়ার কথা বললেন , আমি বাধ্য ছেলের মত শুয়ে পরলা্‌ম
আজকে শরীরটা অন্যদিনের চেয়ে একটু খারাপ , শ্বাস নিতে সামান্য কষ্ট হচ্ছে আর পুরো শরীরে অসহ্য রকম ব্যথা , খাবার কষ্ট করে খেতে হয় না এখন নলের মাধ্যমে অটোমেটিক পেটে চলে যায় ।
হটাৎ শ্বাস কষ্টটা বেড়ে গেলো ,
তারপর...তারপর আর কিছুই বলতে পারি না ।
যখন চোখ খুললাম দেখি আমি আর আগের রুমে নাই , অন্য একটা রুমে আনা হয়েছে , চারিদিকে কেমন যেন একটা নীরবতা , গ্লাসের বাইরে বাবা মা আর আপুকে দেখা যাচ্ছে ।
একটু পর তারা সবাই ভেতরে এলেন সবার চোখ লাল , যে বাবা কখনো কাঁদেন না তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন আর বলতে লাগলেন বাবা তুই ঠিক আছিস তো ? তুই তো আমাদের ভয় পায়িয়ে দিয়েছিলি।
আমি কথা বলতে চাইলাম কিন্তু স্পষ্ট ভাবে কিছুই বলতে পারছিলাম না , অক্সিজেন মাস্কটা নার্স সরিয়ে দিলেন বললাম
বাবা আমি তো এত সহজে তোমাদের ছেড়ে যাবো না । আরো অনেক দিন জ্বালাবো তোমাদের । বাবা কান্না থামিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন শান্ত দৃষ্টিতে ।
নার্স সবাইকে বাইরে পাঁঠিয়ে আমাকে কি যেন একটা ইঞ্জেকশান দিলেন আমার শরীর অবশ হয়ে আসছিল ।
চোখ দুটো ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিল তখন হটাৎ একটা মাঠ দেখতে পেলাম দেখলাম আমি ছোট্ট একটা সেন্ডু গেঞ্জি পরে মাঠে দৌড়ে বেড়াচ্ছি হটাৎ দেখলাম নীরাকে আমার ছোট বেলার খেলার সাথী আমার বড় বোন !!!
আমরা দৌড়ে দৌড়ে মাঠের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে চলে যাচ্ছি আর
আমি বলছি পারবে না আপু তুমি আমাকে কখনই ধরতে পারবে না !!!!
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৩৫২ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৭/০৩/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • ।সুন্দর লেখা।
  • ২৮/০৩/২০১৫
    ভালো লাগল পড়ে ।
  • সবুজ আহমেদ কক্স ১৮/০৩/২০১৫
    চমৎকার গল্প
  • আবিদ আল আহসান ১৭/০৩/২০১৫
    ভাল
  • নহাজা য়াজিনা ১৭/০৩/২০১৫
    অসম্পূর্ণ মনে হলো।
  • হাতে স্বল্প সময় থাকলেও আপনার লেখাটি এড়িয়ে যেতে পারলাম না। খুব ভাল লিখেছেন। গল্পটি বাস্তব হলে আমি মর্মাহত।
    • ফাহমিদা ফাম্মী ১৭/০৩/২০১৫
      গল্পটা কিছুটা বাস্তব , আমার এক ভাই মারা গেছেন গত ১৪ মার্চ , তাকে নিয়েই মূলত লেখাটা
      • অগ্নিপক্ষ ১৮/০৩/২০১৫
        আয়াম সো সরি টু হিয়ার দ্যাট...।
    • ফাহমিদা ফাম্মী ১৭/০৩/২০১৫
      ধন্যবাদ :)
  • কপিল দেব ১৭/০৩/২০১৫
    ভাল লাগা লেগে আছে লেখাটাতে !!
 
Quantcast