যুগে যুগে রোহিঙ্গা মুসলমানদের নির্যাতনের ইতিকথা
ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, মিয়ানমারে মুসলিমদের প্রতি নির্যাতন নতুন কোন ঘটনা নয়। ১৭০০ শতকে আরাকানের এমরায়ুক ইউ শহরের স্বাধীন সুলতান ছিলেন একজন মুসলমান। সর্বপ্রথম জুলুমের শিকার হয় ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দে বর্মি রাজা বোধাপায়া আরাকান দখল করে নেয়। দখলের পর ঢালাওভাবে মুসলিম নিধন ও বিতাড়ন শুরু করে। ইতিহাস সাক্ষী, ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে ৩০ হাজার বার্মিজ সেনা আরাকান আক্রমণ করে মুসলমানদের মসজিদ ও বিভিন্ন স্থাপনা ধ্বংস করে দেয়। একই সঙ্গে তারা বহু রোহিঙ্গা মুসলমানকে পুড়িয়ে হত্যা করে এবং প্রায় ২ লাখ রোহিঙ্গা মুসলমানকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে। বস্তুত মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম নিধনে বৌদ্ধদের এ ষড়যন্ত্র কয়েক শতাব্দি ধরে চলা যুগপৎ হিংস্রাত্মক কাণ্ড। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানগণ বিশ্বের সবচেয়ে ভাগ্যাহত জনগোষ্ঠী। অথচ এককালে তাদের ছিল স্বাধীন রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি।
এ উপমহাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সর্বপ্রথম যে কয়টি এলাকায় মুসলিম বসতি গড়ে ওঠে, আরাকান তার মধ্যে অন্যতম। রোহিঙ্গারা সেই আরাকানী মুসলমানের বংশধর। এক সময় আরাকানে স্বাধীন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৪৩০ সালে প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শাসন দুইশ’ বছরেরও অধিককাল স্থায়ী হয়। ১৬৩১ সাল থেকে ১৬৩৫ সাল পর্যন্ত আরাকানে ব্যাপক দুর্ভিক্ষ হয়। এরপর মুসলিম শাসনের অবসান ঘটে। ১৬৬০ সালে আরাকান রাজা থান্দথুধম্মা নিজ রাজ্যে আশ্রিত মোঘল সম্রাট শাহজাদা সুজাকে স্বপরিবারে হত্যা করেন। এরপর শুরু হয় মুসলমানের উপর তার নিষ্ঠুর অমানবিক অত্যাচার-নিপীড়ন। ১৭৮০ সালে বর্মী রাজা বোধাপোয়া আরাকান দখল করে নেয়। সেও ছিল ঘোর মুসলিমবিদ্বেষী। বর্মী রাজা ঢালাওভাবে মুসলিম নিধন করতে থাকে। এর মধ্যে ১৮২৮ সালে বার্মা ইংরেজদের শাসনে চলে যায়। তখন মুসলমানরা কিছুটা স্বস্তিতে কাটালেও ১৯৩৭ সালে বার্মার স্বায়ত্তশাসন লাভের পর বৌদ্ধদের পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ব্যাপক রূপ নেয় এবং তারা প্রায় ৩০ লাখ মুসলিমকে হত্যা করে। এ সময় মুসলিমদের উপর অবর্ণনীয় ধ্বংসকাণ্ড চালানো হয়। ১৯৪২ সালে জাপান বার্মা দখল করার পর স্থানীয় মগরা জাপানি সৈন্যদের সহায়তা নিয়ে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। ইতিহাসে এটি ১৯৪২ সালের গণহত্যা নামে খ্যাত। তখন লক্ষাধিক রোহিঙ্গা মুসলমানকে হত্যা করা হয় স্বাধীনতা-উত্তর ১৯৪৭ সালের শাসনতান্ত্রিক নির্বাচনে ইংরেজদের দেওয়া ‘সন্দেহভাজন নাগরিক’ অভিধার কারণে মুসলমানদের নাম ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীনতা লাভ করলেও মুসলিম নির্যাতনের এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি, উন নামক শাসক আরাকান থেকে মুসলমানদের বিতাড়নের উদ্দেশ্যে ১৯৪৮ সালে মগ সেনাদের নিয়ে Burma Territorial Force গঠন করে নিয়মিত উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। পরিকল্পিতভাবে মুসলিম বুদ্ধিজীবী, গ্রামপ্রধান, আলেম-ওলামা, ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয় এবং মুসলমান অধ্যুষিত গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, আর সেখানে মগদের জন্য বসতি নির্মাণ করা হয়। ১৯৬২ সালের ২ রা মার্চ উনকে হটিয়ে ক্ষমতা দখলের পর নে উইন সংখ্যালঘুদের সব সাংবিধানিক অধিকার বাতিল করে দেন। ১৯৬৪ সালে রোহিঙ্গাদের সব সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নিষিদ্ধ করা হয় এবং ১৯৬৫ সালের অক্টোবর থেকে Burma Broadcasting Service থেকে প্রচারিত রোহিঙ্গা ভাষার সব অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই বার্মা সরকার ১৯৭৩ সালে উত্তর আরাকানে Major Aung Than operation ও ১৯৭৪ সালে Sabe operation নামে রোহিঙ্গা উচ্ছেদ অভিযান চালায়। ফলে হাজার হাজার রোহিঙ্গা জীবন রক্ষার্থে যুদ্ধবিধ্বস্ত দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলাদেশে এসে নিরাপদ আশ্রয় গ্রহণ করে। সে সময় তৎকালীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দৃঢ় অবস্থান ও চরমপত্রের কারণে বার্মা সরকার বিতাড়িতদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দেয়া তথ্য অনুসারে, ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে মিয়ানমারের মুসলিম রোহিঙ্গারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার এবং বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে সেনাবাহিনীর ‘নাগামিন’ (কিং ড্রাগন অপারেশন) অভিযানের ফলে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এই সেনা অভিযান বেসামরিক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলছিল এবং ফলে ব্যাপক হত্যা, ধর্ষণ ও মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা ঘটে। ১৯৭৯ সালে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ক্ষমতার সময় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এর মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি হলে সে সময় ৩ লাখ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত যায়। কিন্তু পরবর্তীতে (১৯৯১ সালের নভেম্বর মাসে পুনরায় প্রায় ২ লাখ ৬৫ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।) ১৯৮২ সালে মিয়ানমারের সরকার রোহিঙ্গা মুসলিমদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়। ফলে রোহিঙ্গা মুসলিমগণ তাদের ভোটাধিকার, সাংবিধানিক ও সামাজিক অধিকার হারান; নিজ দেশেই তারা হয়ে যান পরবাসী।
এ বছরের প্রথম দিকে মিয়ানমারে আবারো হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন চালানো হয়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী, নাসাকা, লুন্টিং বাহিনী ও পুলিশ সদস্য সকলেই যৌথভাবেই এই অভিযানে অংশগ্রহণ করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল – “No Muslims allowed to stay overnight. No Muslims allowed to rent houses. No marriage with Muslims” (The Guardian). সর্বোপরি, “আরাকান হচ্ছে রাখাইন রাজ্য – যেখানে রোহিঙ্গা মুসলিমদের কোনো স্থান নেই”- এই হচ্ছে তাদের মূলমন্ত্র। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৪, ১৯৮৫, ১৯৯১, ২০১২ এবং ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা উচ্ছেদে বর্বরতম অভিযান পরিচালনা করে বার্মার সামরিক জান্তা। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের রাষ্ট্রবিহীন ঘোষণা করে তাদের বিরুদ্ধে করা সব ধরনের অপরাধকে বৈধতা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদের কোনো অনুচ্ছেদই সেখানে মানা হচ্ছে না। জাতিসংঘসহ অন্যান্য মানবাধিকার সংস্থা রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে এ কথা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে রোহিঙ্গারা পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী, কিন্তু এ ব্যাপারে তারা যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি।
বার্মার স্বাধীনতার পরে সেখানে রোহিঙ্গা-সহ অন্যান্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে তারা পরিকল্পিত গণহত্যা ও নৃশংসতা চালাতে থাকে। এভাবে মুসলিম রোহিঙ্গাদেরকে সমূলে উৎখাত করার জন্য সেখানে একের পর এক বহু অভিযান পরিচালনা করা হয়, যেমন–
১. ৫ম বর্মী রেজিমেন্ট-এর সামরিক অভিযান – নভেম্বর ১৯৪৮ ইং।
২. বার্মা টেরিটোরিয়াল ফোর্স (BTF)-এর অভিযান – ১৯৪৮ থেকে ১৯৫০ ইং।
৩. দ্বিতীয় জরুরী ছিন রেজিমেন্ট-এর সামরিক অভিযান – নভেম্বর ১৯৪৮ ইং।
৪. মাউ অভিযান – অক্টোবর ১৯৫২ থেকে ১৯৫৩ ইং।
৫. মনে-থোন অভিযান– অক্টোবর ১৯৫৪ ইং।
৬. সমন্বিত অভিবাসন ও সামরিক যৌথ অভিযান – জানুয়ারী ১৯৫৫ ইং।
৭. ইউনিয়ন মিলিটারি পুলিশ (UMP) অভিযান – ১৯৫৫ থেকে ১৯৫৮ ইং।
৮. ক্যাপ্টেন হটিন কিয়াও অভিযান – ১৯৫৯ ইং।
৯. শোয়ে কি অভিযান – অক্টোবর ১৯৬৬ ইং।
১০. কি গান অভিযান – অক্টোবর-ডিসেম্বর ১৯৬৬ ইং।
১১. ঙ্গাজিঙ্কা অভিযান – ১৯৬৭ থেকে ১৯৬৯ ইং।
১২. মিয়াট মোন অভিযান – ফেব্রুয়ারী ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ ইং।
১৩. মেজর অং থান অভিযান – ১৯৭৩ ইং।
১৪. সাবি অভিযান – ফেব্রুয়ারী ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৮ ইং।
১৫. নাগা মিন (ড্রাগন রাজা) অভিযান – ফেব্রুয়ারী ১৯৭৮ থেকে ১৯৭৯ ইং।
(এ অভিযানে প্রায় ৩ লক্ষ রোহিঙ্গা বাস্তুহারা হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় এবং (exodus); ৪০ হাজার রোহিঙ্গা মারা যায়।)
১৬. সোয়ে হিন্থা অভিযান – অগাস্ট ১৯৭৮ থেকে ১৯৮০ ইং।
১৭. গেলোন অভিযান – ১৯৭৯ ইং।
১৮. তাউঙ্গকের গণহত্যা – ১৯৮৪ ইং।
১৯. তাউঙ্গি (পশ্চিম বার্মা)-এর মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা। পিয়াই ও রেঙ্গুন সহ বার্মার অনেক অঞ্চলে এই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে।
২০. পি থিয়া অভিযান – জুলাই ১৯৯১-৯২ (এতে ২ লক্ষ ৬৮ হাজার রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।
২১. নাসাকা অভিযান – ১৯৯২ থেকে অব্যাহত।
২২. মুসলিমবিরোধী সাস্প্রদায়িক দাঙ্গা – মার্চ ১৯৯৭ (মান্দালয়)।
২৩. সিটিওয়ে’তে মুসলিম বিরোধী দাঙ্গা – ফেব্রুয়ারী ২০০১ ইং।
২৪. মধ্য বার্মার মুসলিম বিরোধী সর্বাঙ্গীন দাঙ্গা – মে ২০০১
২৫. মধ্য বার্মার মুসলিমবিরোধী সর্বাঙ্গীন দাঙ্গা (বিশেষত পিয়াই/প্রোম, বাগো/পেগু শহরে) – ৯/১১ -এর পরবর্তী থেকে অক্টোবর ২০০১ ইং।
২৬. সেনা বাহিনী ও বৌদ্ধদের যৌথ মুসলিমনিধন অভিযান – জুন ২০১২ থেকে অব্যাহত।
২৭. সাম্প্রতিক (বিশেষ করে ২০১৬ ইং) সেনা বাহিনী, সরকারী মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ও বৌদ্ধভিক্ষুদের সম্মিলিত মুসলিমনির্মূল অভিযান।
টীকাঃ- কোন এক সময় মিয়ানমানের মোট জনসংখ্যার ৪০% মুসলমান ছিল। (সংখ্যাটা ১৪ মিলিয়ন)
প্রথম পর্বে-রোহিঙ্গা ও মিয়ানমারের ইতিকথা
http://www.tarunyo.com/faizbd1/blog/post20170910080624/
কৃতজ্ঞতা- নিউজ, উইকিপিডিয়া
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মুহাম্মদ মোজাম্মেল হোসেন ১৩/০৯/২০১৭তথ্যবহূল নিবন্ধটি পড়ে ভাল লাগলো । রোহিঙ্গাদের দুর্দশা সহসা দূর হোক এই কামনা করি ।