বসন্তের বাতাস
এক
বাঁক খাওয়া পথের একেবারে শেষ মাথায় এসে থামল বাসটা।
চিকন, একদম সরু রাস্তা। একটুখানি টালমাটাল হলেই কাত হয়ে একদিকে পড়ে যেতে পারে, এমন অবস্থা। বাসে বসে বারবার মনে হচ্ছিল, এই বুঝি বাসটা কাত হয়ে গেল! কিংবা সামনে থেকে একটা কিছু ধেয়ে আসল! সেক্ষেত্রেও অবস্থা কী হবে কে জানে! রক্ষে বলতে এটুকুই যে, খুব বেশি এবড়োথেবড়ো না রাস্তাটা। মোটামুটি টাল সামলিয়েই সোজা হেঁকে চলল। সামনে থেকেও কোন যানবাহনের দেখা মিলল না। একবার কেবল একটি নিরীহ গোছের ভ্যান সামনে এসে আবার অনেকটা নির্বিঘ্নেই পাশ কেটে চলেও গেল। পুরো পথে দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে আসলাম। বাসের অন্যান্য যাত্রীদের মুখেচোখে উদ্বিগ্নতার লেশমাত্র নাই। এই পথের সাথে নিত্য সখ্য এদের, বোঝা যায়।
নিজের ছোঁচামিতে নিজের উপরই রাগ লাগতে লাগল। বন্ধু বেড়াতে আসতে বললেই ছোঁচার মত রাজি হয়ে যেতে হবে? আমি যে সত্যি সত্যিই চলে আসবো এটা কি আমার বন্ধুটিই ভেবেছে নাকি! তাও আবার জিগ্রি দোস্ত টোস্ত কিছু না। পরিণত বয়সের খানিকটা অনভ্যস্ত বন্ধুত্ব। চাকরি করতে এসে পরিচয় হয়েছে। এখনো তুমি থেকে তুইতে নামতে পারিনি। শাকিব ভাই বয়সে আমার থেকে খানিকটা সিনিয়রও। সেটা অবশ্য তেমন বড় ব্যাপার না। চাকরি জীবনে দু’চার বছর এদিক সেদিক ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। আমি উনাকে শাকিব ভাই বলেই ডাকতাম। একদিন ডেকে নিয়ে দিলেন বকা।
‘আরে রাখো তোমার ভাই। শাকিব বলে ডাকবা। সিগারেট টিগারেট চলে নাকি? অফিসে তো খাইতে পারি না। চল লাঞ্চব্রেকে কোথাও থেকে ঘুরে আসি।’
সেই শুরু। লাঞ্চব্রেকে কোথাও থেকে ঘুরে আসা এরপর থেকে আমাদের রুটিনে পরিণত হল। ম্যাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করি। নো স্মোকিং অফিস। সারাদিন বহুত ফোটফাট বজায় রেখে চলতে হয়। শার্টের ভাঁজ কুচকানো যাবে না, টাই টলানো যাবে না, স্মার্টনেসে যেন কোন কমতি না থাকে। ভেতরে ভেতরে ফাঁপরে পড়ে যেতাম। শাকিবের সাথে ব্রেকের সময়টা ভালোই এনজয় করতাম। দু’জনে মিলে চলে যেতাম অফিসের পাশের ছোট পার্কটাতে। আস্তে আস্তে আরো দু’চারজন আমাদের এই ‘লাঞ্চব্রেকে’র খবর পেয়ে গেল। জটলা বড় হতে লাগল দিনে দিনে। আমাদের বসের কানে খবরটা যেতেও দেরী হল না। তিনি সবকিছু জেনেও না জানার ভান করে রইলেন। ইয়াং ছেলেপুলে। এইটুকু স্বাধীনতা না দিলে কি চলে?
হঠাৎ করেই শাকিবের বদলি হয়ে গেল। সেই সুদূর খাগড়াছড়ি। আমাদের জোনাল সেকশনে। হেড অফিস থেকে সোজা একেবারে প্রত্যন্ত জোনাল অফিস। আমরা একেবারে হতচকিত হয়ে গেলাম। শাকিব কাজেকর্মে বেশ পটু, চালু ছেলে। অফিসের ঝামেলাজনিত ব্যাপারগুলোতে সবসময়ই তার একটা চাহিদা থাকে। বড় ডেলিগেটদের সে বড়ই ডেলিকেটলি হ্যান্ডেল করে। এত বাকপটু চৌকষ ছেলে আমি জীবনে দেখিনি। কথার মারপ্যাঁচে বড় বড় রুই-কাতলা কে টোপে ফেলে দেয়। সেই টোপ না গিলে আর বুদ্ধি থাকে না। এহেন করিৎকর্মা ছেলেকে হেড অফিস থেকে সরিয়ে দিয়ে বসের কী লাভ হবে আমরা কেউ বুঝে উঠতে পারলাম না। তাও আবার খাগড়াছড়ি; তাও আবার ‘বর্তমান কর্মস্থল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে অব্যাহতি প্রাপ্ত’। আমাদের সাথে বিদায়ের আগমুহুর্তে দেখাটুকু করবার ফুরসত তাকে দেওয়া হলো না।
শাকিব অফিসের জনপ্রিয় ছেলে। কাজেই আমরা গুরুতর মর্মাহত হলাম। কেন অফিস কতৃপক্ষ হুট করে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলো, সেটা এক বড় বিস্ময়সূচক চিহ্ন হয়ে রইলো আমাদের কাছে। সম্ভাব্য সব জায়গাকেই আমরা কারণ হিসেবে টার্গেট করলাম। কিন্তু নাঃ। কোন সিদ্ধান্তে আসা গেল না। এ নির্ঘাত কোন বড় ঘাঁপলা। শাকিবকে কিছুদিন ফোনেও পাওয়া গেল না। রিং করতেই আওয়াজ আসে,’ আপনার কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটিতে সংযোগ প্রদান করা সম্বব হচ্ছে না...।’ অর্থাৎ ফোন বন্ধ। এ তো মহা কেলো!
প্রায় বিশ দিন পরে শাকিবের ফোন পাওয়া গেল। গলার আওয়াজে অবশ্য ঝামেলার কোন গন্ধ পাওয়া গেল না। একই রকম ফুরফুরে মেজাজে আছে মনে হলো; যেন এইমাত্র কোন মজার অভিজ্ঞতা ঘটেছে। জোশে থাকলে যেরকম খানিকটা আঞ্চলিক টানে কথা বলে সেরকম সুরেই কথা বলছে।
‘কী হে! লাঞ্চব্রেক পার্টনার! খবরাখবর কী তোমাদের? আছো তো মহাসুখে। আমারে তো দিলা সবাই ষড়যন্ত্র কইরা সরাইয়া। মনের দুঃখে পাহাড়বাসী হইয়্যা গেলাম।’
আমি তড়বড়িয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করলাম। শাকিব কোন কথারই ঠিকঠাক জবাব দিল না। যা জিজ্ঞেস করি হেসেই উড়িয়ে দেয়। বিরক্ত হয়ে গেলাম শেষমেষ। আমার বিরক্তি বুঝতে পেরেই বোধহয় প্রস্তাবটা দিল।
‘সব কথা কি ফোনে বলতে হয়? সাক্ষাতে কথা হোক। চলে আসো খাগড়াছড়ি। বড় বাংলোতে থাকি। আরে মিয়া, ঈর্ষাতে তো কাহিল হইয়্যা যাইবা।’
এই বলে মনের দুঃখে পাহাড়বাসী হলাম, আবার এই বলে ঈর্ষাতে কাহিল হয়ে যাবো। মাথাটাই মনে হয় গেছে। কিন্তু প্রস্তাবটা মন্দ নয়। সামনের মাসে একটা দুই দিনের ছুটি আছে। এর সাথে যদি আর এক আধদিন ছুটি ম্যানেজ করা যায় তাহলেই ঘুরে আসা যায়। অফিসের দু’একজনকে সাধলাম। কেউই আগ্রহ দেখালো না। দেখাবেই বা কেন? বেশিরভাগই ফ্যামিলি ম্যান। বউ-বাচ্চা নিয়ে এখানে ওখানে বেড়াতে যাবে। ফেসবুকে হাসিখুশি পরিবারের ছবি আপলোড করবে। আমার মত ব্যাচেলরদের আর কী করা! বন্ধুর বাংলোবাড়ি দেখার প্রস্তাব লুফে নেওয়া ছাড়া?
দুই
শাকিবকে দেখে সত্যিই বড় আনন্দিত হলাম। মহা আমুদে ছেলে। অফিসটাকে বেশ মাতিয়ে রাখতো। শাকিব চলে আসার পর অফিসের মজাটাই যেন চলে গেছে। আমাকে দেখে শাকিবও বেশ খুশি হলো মনে হয়। সটান জড়িয়ে ধরলো একেবারে।
‘আরে ভাই, তুমি যে সত্যিই আমার কথায় চলে আসবা এতটাতো আমি আশাই করি নাই।’
শাকিবের দাবী মিথ্যে নয়। বিরাট বড় বাংলো। চারপাশ ঘিরে ফুলের বাগান। বাংলোর ভেতরটাও যথেষ্ট আধুনিক। আমাদের খাগড়াছড়ি জোনাল সেকশনে সাধারণত কেউ আসতে চায় না। অল্প কয়েকজন স্টাফ আছে। হেড অফিসের সাথে এই অফিসের তেমন কোন যোগাযোগ নেই বললেই চলে। খুব একটা কাজকর্মও নেই। অনেকটা পানিশমেন্ট পোস্টিং বলা চলে। জেলের কয়েদিদের আরাম আয়েশ দিয়ে একটু মনোরঞ্জনের চেষ্টা আর কী!
গড়বড়টাতো এখানেই। শাকিবের মত মহা কামিয়াব ছেলেকে কেন পানিশমেন্ট পোস্টিং দেওয়া হবে?! কারণ জানতে আমার আর তর সইছে না। এটা ওটা শেষে আসল কথা পাড়লাম। শাকিব তো পাত্তাই দেয় না। মুচকি হেসে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। বুঝলাম, সে আরাম করে বলতে চায়। বেশ, আমারো হাতে গোটা তিনদিন সময় আছে।
দুপুরে একেবারে মহাভোজ করলাম। আমার আসার খবর জেনে শাকিব আগেভাগেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল। পুকুরের পাকা রুই, কচি পাঁঠার মাংস, খাগড়াছড়ির স্পেশাল শুঁটকি, চিকন চালের ঝরঝরে ভাত। খাওয়া শেষে খাঁটি গাওয়া ঘি দিয়ে বানানো ঘন দুধের সেমাই। শরীরটা আরামের চোটে একেবারে নেতিয়ে পড়লো।
'শাকিব, ভাবছি আমিও খাগড়াছড়ি পোস্টিং এর জন্য বসের কাছে আবেদন করবো। অথবা তুমি কী ক্রাইম করেছো সেটা জানাও। সেটাই করে ফেলি।'
শাকিব কৌতুক করে বললো, 'তোমার জন্য প্রথমটাই নিরাপদ। দ্বিতীয়টা করার সব উপকরণ নাও পাইতে পারো।'
মনে হচ্ছে শাকিব মুখ খুলছে। আমিও চেপে ধরলাম।
'কী হইছে বলো বন্ধু। আর সাসপেন্সে রাইখো না।'
'সাসপেন্সে কি আর সাধে রাখি রে ভাই! কী যে হইলো নিজেও এখনো বুইঝা উঠতে পারতাছি না। তোমারে আর কী বোঝাবো?'
দু'জন গিয়ে বসলাম বেডরুমের সাথে লাগোয়া ব্যালকনিতে। চমৎকার বাতাস বইছে। শীত যাই যাই করছে। বসন্ত আসি আসি করছে। আবহাওয়া অতি মনোহর। বাতাসে শাকিবের চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মাথা ভর্তি সিল্কি চুল শাকিবের। এক জায়গায় স্থির থাকে না। ওর গায়ে একটা মেরুন পাঞ্জাবী। হাতাটা বেশ কায়দা করে কনুই পর্যন্ত গোটানো। তীক্ষ্ণ নাক আর বুদ্ধিদীপ্ত চোখে সারাক্ষণ কেমন একটা আমোদ খেলা করে। আমি মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলাম, সাকিবের মত সুপুরুষ সচরাচর চোখে পড়ে না। শাকিব ঢাকার অফিস থেকে চলে আসার পরে আমাদের তো বন্ধু বিয়োগে কিছুটা মন খারাপ হয়েছেই। কিন্তু কানাঘুষো শুনতে পাই, বেশ কয়েকজন মহিলা সহকর্মী ইদানীং উঠতে বসতে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছেন। কাজে কর্মে ঠিকঠাক মন বসছে না। মানে নিন্দুকেরা বলাবলি করছে আর কী!
শাকিবের এক হাতে সিগারেট। এলোমেলো চুলকে অন্যহাতে শাসন করতে করতে সে গল্প শুরু করে।
তিন
ঘটনার সূত্রপাত ঢাকার অফিসেই।
সেদিন অফিস ছুটির পরেও একটা এসাইনমেন্ট নিয়ে কাজ করছিলাম। একটা ব্যাপার কিছুতেই ঠিকমত মেলাতে পারছিলাম না। গড়বড় লাগছিল। তুমি তো জানোই, বস অফিস শেষেও অনেকক্ষণ রুমে বসে কাজ করেন। তাই ভাবলাম, বসের সাথে আলাপ করে আসি। একটা সমাধান পেয়ে যেতে পারি।
গিয়ে দেখি, স্যারের রুমের দরজা ভেজিয়ে রাখা। কিন্তু ফোনে কার সাথে যেন বেশ উচ্চস্বরে কথা বলছেন। বাইরে থেকে বেশ কিছু কথোপকথন শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে হল, কাউকে ধমকাধমকি করছেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসবো কিনা ভাবছি। তারপর কী মনে করে ঢুকেই পড়লাম। স্যার ইশারায় আমাকে বসতে বললেন। আমার উপস্থিতিতেই আরো কিছুক্ষণ ধমকাধমকি চললো।
‘এভাবে চলতে থাকলে আমি তোমার লেখাপড়াই বন্ধ করে দিব। তারপর তোমার যেটা করতে ভাল লাগে কর গে যাও।’
আমি মুখ চিমসিয়ে বসে থাকলাম। ঢুকে পড়ে দেখি ভালো ঝামেলা হলো!
স্যার অবশ্য আর বেশিক্ষণ কথা বললেন না। কথা শেষ করে আমার দিকে ফিরলেন। চেহারায় মহাবিরক্তি। আমি কী বলতে এসেছিলাম তা প্রায় ভুলেই গেলাম। আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করছি। স্যার মনে হলো না কিছু শুনছেন। ঠিকই তাই। আমার কথার ধারকাছ দিয়ে না গিয়ে বললেন,
‘শাকিব, তুমি তো ঢাকা ভার্সিটিতে পড়তে। বেশিদিন হয় পাস করোনি। তোমার পরিচিত কোন ভালো ছাত্র আছে যে ‘এ’ লেভেলের কাউকে পড়াতে পারবে?’
আমি হুট করে কী বলবো বুঝতে পারলাম না। ভার্সিটি ছেড়েছি তাও প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো। জুনিয়রদের সাথেও তেমন একটা যোগাযোগ নেই। আমি বেশি চিন্তা ভাবনায় না গিয়ে বলে ফেললাম,
‘না স্যার, তেমন কেউ তো পরিচিত নেই। নিউজপেপারে খোঁজ করলে পাওয়া যেতে পারে। এরকম বিজ্ঞাপন তো প্রায়ই থাকে।’
‘আরে না। যাকে তাকে দিয়ে কাজ হবে না। চেনা জানার মধ্যে হলে ভাল হয়। তুমি তো ভাল খোঁজ-খবর রাখো। তোমার পরিচিত কাউকে যদি পাও...’, তারপর কী একটু চিন্তা করে বললেন,
‘শাকিব, তোমার তো অংকের মাথা খুব ভালো। তুমি আমার মেয়েটাকে পড়াও না!’
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। কী মহা গাট্টায় পড়লাম রে বাবা! ভার্সিটি জীবনের শুরুতে একটু আধটু টিউশনী করেছিলাম। এখন এই চাকরিজীবনে এসে আবার টিউশনী? তাও আবার বসের মেয়েকে? নাঃ আজ, বসের রুমে ঢোকাই ঠিক হয়নি আমার।
স্যার মনে হয় আমার মনের অবস্থাটা বুঝে ফেললেন। আশ্বস্ত করার মত করে বললেন,
‘আসলে মা মরা মেয়ে। একটু জেদি। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কখনো বাধা দিইনি। যখন যা চেয়েছে পেয়ে গেছে। কিন্তু এখন তো আর পারা যাচ্ছে না। পড়াশুনার অবস্থা খুব খারাপ। ওর কলেজের প্রিন্সিপাল আ্মার বন্ধু মানুষ। সেজন্যই কিছুটা মান রেখে কথা বলেছে। মেয়ের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে বলেছে। কী বলবো তোমাকে, বন্ধুর সামনে নাকটাই কাটা গেছে আমার।’
আমি চুপচাপ শুনে যাচ্ছি। কীই বা বলবো এখানে। তবু সুযোগ বুঝে বলেই ফেললাম,
‘কিন্তু স্যার, আমি পড়ালে কি বিশেষ কোন উপকার হবে? প্রফেশনাল কাউকে দিয়ে পড়ালে ভালো হত মনে হয়।’
স্যার মুখ বিকৃত করে বললেন,
‘রাখো, তোমার প্রফেশনাল। অনেক দেখলাম। আমি কি আর বসে আছি? কেউই একটু দায়িত্ব নিয়ে পড়ায় না। তোমার উপর আমার অগাধ আস্থা, শাকিব। তুমি ওর অংকের দায়িত্বটা নিলে নিশ্চিন্ত হতাম। পারিশ্রমিক নিয়ে একদম চিন্তা করবে না।’
এরপরে তো আর আমার কিছু বলার থাকে না। ঠিক হলো, সপ্তাহে দু’দিন অফিস শেষে স্যারের বাসায় গিয়ে পড়াবো। খুবই ঝামেলায় পড়লাম। কিন্তু কী করা! চাকরি বাঁচাতে কত কীই করতে হয়। এ তো সামান্য ছাত্রী পড়ানো।
স্যারের মেয়ের বয়স আঠারো-উনিশ। নাম লামিয়া। চাল-চলনে যাকে বলে অতি আধুনিক। ঠিকমত বাংলা বলতে ভীষণ অসুবিধা। সব কিছুতেই একটা নাক উঁচু ভাব। আমাকে দেখে প্রথম প্রথম পাত্তাই দিলো না। আমিও ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে শুরু করলাম। এই জাতীয় অতি আধুনিক মেয়েদের ব্যাপারে আমি বরাবরই কিছুটা এলার্জী বোধ করি। এরা ভাব দেখায় দুনিয়ার সবকিছু বুঝে গেছে। আসলে বোঝে তো মানকচু!
পড়াতে গিয়ে দেখলাম, যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়েও বড় গাধা। এর মাথায় কী করে অংক ঢোকাবো আমি সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলাম।
এদিকে নিজের গোমর ফাঁস হওয়ার পর লামিয়া নিজে থেকেই ঠাণ্ডা মেরে গেল। আমার প্রতি অবজ্ঞা কমে গিয়ে একটু যেন বেশিই সমীহ দেখাতে শুরু করে দিল। ভাব গতিক বিশেষ ভালো ঠেকলো না আমার। অতি ইঁচড়ে পাকা মেয়ে। পড়া সংক্রান্ত প্রশ্নের চেয়ে অন্য কিছু জানার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহ। আমি কোথায় থাকি, ফেসবুকে নিয়মিত বসি কিনা ইত্যাদি। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। এ না হয় কাঁচা বসন্তের দোলায় দুলছে। আমার তো বসন্ত পেকে গেছে। সুতরাং মনকে বোঝালাম, খবরদার...সাধু সাবধান।
ছাত্রীর কোয়ালিটি ছাড়া আর কোন কিছু খারাপ না। দেড়-দু’ঘণ্টা পড়াই। ভেতর থেকে মজার মজার নাস্তা আসে। লামিয়ার তো মা নেই। এত মজার নাস্তা কে বানায় আল্লাহ্ মালুম। একেকদিন একেক রকম সম্ভার। প্রচুর পরিমানে। মেসে গিয়ে আর রাতের খাবার খাওয়ার প্রয়োজন হয় না।
একদিন লামিয়াকে অংক বোঝানোর মাঝখানে চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজে চমকে উঠলাম। লামিয়া তো চুড়ি পড়ে না। কী সব নানান স্টাইলের ব্যান্ড পড়ে। তাকিয়ে দেখি, আমার সামনে এক অপূর্ব রূপসী দাঁড়িয়ে। ছেড়ে দেওয়া লম্বা চুল, কাজল টানা চোখ, দু’হাত ভর্তি চুড়ি, পরনে হালকা বেগুনি রঙের তাঁতের সুতি শাড়ি। বয়স টেনেটুনে চব্বিশ-পঁচিশ হবে। আমার তো হার্ট এটাক হবার দশা! একেবারে যেন শরৎচন্দ্রের নায়িকা আমার সামনে দাঁড়িয়ে। লামিয়ার যে বড় বোন আছে এ খবর তো আমি জানতাম না। আমার ঘোর কাটলো মেয়েটির রিনরিনে আওয়াজে,
‘আপনার সাথে পরিচিত হতে এলাম। লামিয়া কেমন পড়ছে সেটাও তো জানা দরকার। আমি লামিয়ার ...’
‘আঃ পড়ার সময় ডিস্টার্ব করছো কেন? পড়া শেষে আলাপ করলেই তো হয়।’ লামিয়া একেবারে খেকিয়ে উঠলো।
‘ওঃ সরি। জী, পরে আলাপ করবো আপনার সাথে।’ মুখটা কালো করে মেয়েটি তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো।
আমি বিষাক্ত চোখে তাকালাম লামিয়ার দিকে। মহা সেয়ানা মেয়ে। আমার চোখের মুগ্ধতা বুঝতে ভুল হয়নি। কেমন যেন ক্ষীপ্ত মনে হলো।
‘উনি কে? তোমার বড় বোন বুঝি? উনি আলাপ করতে এসেছিলেন। তোমার এরকম ভাবে কথা বলা উচিত হয়নি।’
লামিয়া হুঁ হাঁ একটা কিছু বললো। আমার সেদিন আর পাঠদানে মন বসলো না। মনটা পড়ে রইলো অন্য কোথাও।
এরপর থেকে আমার অবস্থা যা হলো তা আর কী বলবো! কারণে অকারণে এদিক সেদিক চাইতাম। অপ্রয়োজনে পানি খেতে চাইতাম। আশা, যদি পানির গ্লাস হাতে আবার সে আসে!
কিন্তু নাঃ...আর আসলো না কোনদিন। মরিয়া হয়ে একদিন অফিস আওয়ারে লামিয়াদের বাসায় ফোন দিলাম। জানতাম, এ সময় লামিয়া বা স্যার কেউই বাসায় থাকবে না। সেও না থাকতে পারে। একটা সুযোগ নিলাম আর কী!
আমাকে হতাশ না করে সে ফোন ধরলো। ভাব দেখালাম লামিয়াকে ফোন করেছি। জরুরী কিছু বলতে ভুলে গেছি সেটা জানাতে। সে আমার অযুহাত বুঝলো কি না কে জানে! কেবল একটু হাসি দিল। ফোনের তারের মধ্য দিয়ে সে হাসি আমার হৃদয় তারে ঢুকে গেল। একেবারে বেড়াছেড়া অবস্থা!
টুকটাক ভালোই কথাবার্তা হলো। গল্পে গল্পে আমার অনেক কিছুই তাকে বলে ফেললাম। কিন্তু নিজের সম্পর্কে তেমন কিছুই সে জানালো না। আমার প্রতিটা প্রশ্নই সুনিপুণভাবে এড়িয়ে গেল। শুধু নিজের নামটা বললো, নাইমা।
এরপরেও আরো বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছি। আমার তখন বেহাল দশা। কিন্তু নাইমা আর বেশি কথা বলতে চাইতো না। একদিন লামিয়াকে পড়ানো শেষে ব্যাপক দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়ে বললাম,
‘নাইমাকে একটু ডাকো ত!’
লামিয়া হাঁ করে আমার দিকে তাকালো। যেন বুঝতে পারছে না আমি কী বলছি। বুঝতে পেরে কাট কাট করে বললো,
‘বাসায় নেই।’
পরিষ্কার মিথ্যে কথা। মেসে এসে অনেক চিন্তা ভাবনা করলাম। দেখতে দেখতে একত্রিশ বসন্ত পার করতে চলেছি। দেশের বাড়ি থেকে মা প্রায়ই বিয়ের জন্য তাগাদা দেন। বিয়ে তো করা দরকার আমিও বুঝি। কিন্তু কাউকেই তো মনে ধরে না। বসের মেয়েকে পছন্দ করে ফেলেছি, এটাই যা সমস্যার। কিন্তু নিজেই নিজের পক্ষে সাফাই গাইলাম। আমি কি পাত্র হিসেবে ফেলনা নাকি? স্যার চোখ বুজে আমাকে বিশ্বাস করেন। ভালো চাকরি করি, মোটা মাইনে পাই। দেখতে শুনতে খারাপ না। ঠিক করলাম, নিজেই স্যারকে প্রস্তাবটা দিব। আমার তো বাবা নেই। দেশের বাড়িতে এক চাচা আছেন। কী দরকার তাকে শুধু শুধু ঝামেলা দিয়ে!
তোমাদের কাউকে কিছু জানাই নাই। ভেবেছি, ভালোয় ভালোয় সব কিছু হয়ে গেলে পরে জানাবো।
সুযোগমত একদিন অফিস শেষে বসের রূমে ঢুকলাম। তারপর একথা ওকথা শেষে খুব মোলায়েম ভাবে নিজের ইচ্ছের কথাটা জানালাম।
‘স্যার, ইয়ে যদি কিছু না মনে করেন...আমার তো তেমন কোন মুরুব্বী নেই, তাই আমিই...মানে...আমি আপনার বড় মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।’
স্যারের দু’চোখ বিস্ফোরিত।
‘বড় মেয়ে? মানে? আমার তো একটাই মেয়ে!’
‘স্যার, নাইমা’র কথা বলছিলাম।’
‘হোয়াট? হাউ ডেয়ার ইউ? হাউ...আই উইল ফিনিশ ইউ...’
স্যার চিৎকার করতে করতে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাবার দশা। আমি কিছু বুঝতে না পেরেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।
চার
এই পর্যন্ত বলে শাকিব থামলো। আমিও কিছু বুঝতে না পেরে ওর মুখের দিকে চাইলাম। মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। এতে দোষের কী হয়েছে? শাকিব আমার হতবিহবল দশা প্রাণভরে উপভোগ করলো। যেন শেষ চাল দিচ্ছে এমনভাবে বললো,
‘কিছু বুঝলে না তো? আমার অবস্থাও ছিল তথৈবচ। পরেরদিন সকাল বেলা ডিরেক্টর আজিম স্যার আমার মেসে এসে হাজির। তুমি তো জানোই, উনি আমাকে একটু বিশেষ স্নেহ করেন। তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম, কী ভয়ানক প্যাঁচ লাগিয়ে দিয়েছি। আর একটু হলে তো চাকরিটাই গিয়েছিল। আজিম স্যার ম্যানেজিং কমিটির সবাইকে বলে কয়ে চাকরিটা বাঁচাতে পেরেছেন।’
‘কিন্তু বস এত রেগে গেলেন কেন?’
‘আরে রাগবেন না তো কী করবেন? আমি যদি তার বউকে বিয়ে করতে চাই, তো উনি কি আমাকে কোলে নিয়ে আদর করবেন?’
‘কী বললে? বউ? অ্যাঁ...হাহ্ হাহ্ হা...।’
‘আমি কী করে জানবো বলো যে, পঞ্চান্নোর্ধ বসের চব্বিশ বছরের তন্বী দ্বিতীয় পক্ষ থাকবে? মান-ইজ্জত প্রায় ডুবতে বসেছিল। তোমাদের সাথে দেখা করবো কোন মুখ নিয়ে বলো? এই ইয়ে, তুমি আবার অফিসের কাউকে...মানে বুঝতেই তো পারছো...ইট্স কনফিডেন্সিয়াল।’
আমার হাসির দমক থামছেই না। থেকে থেকেই হিঁচকি’র মত উঠছে। শাকিব চোখ পাকিয়ে বললো,
‘হাসি থামাও। চলো, বাইরে থেকে ঘুরে আসি। দেখছো না কী চমৎকার বাতাস বইছে? আহা! বসন্তের বাতাস!’
বাঁক খাওয়া পথের একেবারে শেষ মাথায় এসে থামল বাসটা।
চিকন, একদম সরু রাস্তা। একটুখানি টালমাটাল হলেই কাত হয়ে একদিকে পড়ে যেতে পারে, এমন অবস্থা। বাসে বসে বারবার মনে হচ্ছিল, এই বুঝি বাসটা কাত হয়ে গেল! কিংবা সামনে থেকে একটা কিছু ধেয়ে আসল! সেক্ষেত্রেও অবস্থা কী হবে কে জানে! রক্ষে বলতে এটুকুই যে, খুব বেশি এবড়োথেবড়ো না রাস্তাটা। মোটামুটি টাল সামলিয়েই সোজা হেঁকে চলল। সামনে থেকেও কোন যানবাহনের দেখা মিলল না। একবার কেবল একটি নিরীহ গোছের ভ্যান সামনে এসে আবার অনেকটা নির্বিঘ্নেই পাশ কেটে চলেও গেল। পুরো পথে দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে আসলাম। বাসের অন্যান্য যাত্রীদের মুখেচোখে উদ্বিগ্নতার লেশমাত্র নাই। এই পথের সাথে নিত্য সখ্য এদের, বোঝা যায়।
নিজের ছোঁচামিতে নিজের উপরই রাগ লাগতে লাগল। বন্ধু বেড়াতে আসতে বললেই ছোঁচার মত রাজি হয়ে যেতে হবে? আমি যে সত্যি সত্যিই চলে আসবো এটা কি আমার বন্ধুটিই ভেবেছে নাকি! তাও আবার জিগ্রি দোস্ত টোস্ত কিছু না। পরিণত বয়সের খানিকটা অনভ্যস্ত বন্ধুত্ব। চাকরি করতে এসে পরিচয় হয়েছে। এখনো তুমি থেকে তুইতে নামতে পারিনি। শাকিব ভাই বয়সে আমার থেকে খানিকটা সিনিয়রও। সেটা অবশ্য তেমন বড় ব্যাপার না। চাকরি জীবনে দু’চার বছর এদিক সেদিক ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। আমি উনাকে শাকিব ভাই বলেই ডাকতাম। একদিন ডেকে নিয়ে দিলেন বকা।
‘আরে রাখো তোমার ভাই। শাকিব বলে ডাকবা। সিগারেট টিগারেট চলে নাকি? অফিসে তো খাইতে পারি না। চল লাঞ্চব্রেকে কোথাও থেকে ঘুরে আসি।’
সেই শুরু। লাঞ্চব্রেকে কোথাও থেকে ঘুরে আসা এরপর থেকে আমাদের রুটিনে পরিণত হল। ম্যাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করি। নো স্মোকিং অফিস। সারাদিন বহুত ফোটফাট বজায় রেখে চলতে হয়। শার্টের ভাঁজ কুচকানো যাবে না, টাই টলানো যাবে না, স্মার্টনেসে যেন কোন কমতি না থাকে। ভেতরে ভেতরে ফাঁপরে পড়ে যেতাম। শাকিবের সাথে ব্রেকের সময়টা ভালোই এনজয় করতাম। দু’জনে মিলে চলে যেতাম অফিসের পাশের ছোট পার্কটাতে। আস্তে আস্তে আরো দু’চারজন আমাদের এই ‘লাঞ্চব্রেকে’র খবর পেয়ে গেল। জটলা বড় হতে লাগল দিনে দিনে। আমাদের বসের কানে খবরটা যেতেও দেরী হল না। তিনি সবকিছু জেনেও না জানার ভান করে রইলেন। ইয়াং ছেলেপুলে। এইটুকু স্বাধীনতা না দিলে কি চলে?
হঠাৎ করেই শাকিবের বদলি হয়ে গেল। সেই সুদূর খাগড়াছড়ি। আমাদের জোনাল সেকশনে। হেড অফিস থেকে সোজা একেবারে প্রত্যন্ত জোনাল অফিস। আমরা একেবারে হতচকিত হয়ে গেলাম। শাকিব কাজেকর্মে বেশ পটু, চালু ছেলে। অফিসের ঝামেলাজনিত ব্যাপারগুলোতে সবসময়ই তার একটা চাহিদা থাকে। বড় ডেলিগেটদের সে বড়ই ডেলিকেটলি হ্যান্ডেল করে। এত বাকপটু চৌকষ ছেলে আমি জীবনে দেখিনি। কথার মারপ্যাঁচে বড় বড় রুই-কাতলা কে টোপে ফেলে দেয়। সেই টোপ না গিলে আর বুদ্ধি থাকে না। এহেন করিৎকর্মা ছেলেকে হেড অফিস থেকে সরিয়ে দিয়ে বসের কী লাভ হবে আমরা কেউ বুঝে উঠতে পারলাম না। তাও আবার খাগড়াছড়ি; তাও আবার ‘বর্তমান কর্মস্থল থেকে তাৎক্ষণিকভাবে অব্যাহতি প্রাপ্ত’। আমাদের সাথে বিদায়ের আগমুহুর্তে দেখাটুকু করবার ফুরসত তাকে দেওয়া হলো না।
শাকিব অফিসের জনপ্রিয় ছেলে। কাজেই আমরা গুরুতর মর্মাহত হলাম। কেন অফিস কতৃপক্ষ হুট করে এত বড় একটা সিদ্ধান্ত নিলো, সেটা এক বড় বিস্ময়সূচক চিহ্ন হয়ে রইলো আমাদের কাছে। সম্ভাব্য সব জায়গাকেই আমরা কারণ হিসেবে টার্গেট করলাম। কিন্তু নাঃ। কোন সিদ্ধান্তে আসা গেল না। এ নির্ঘাত কোন বড় ঘাঁপলা। শাকিবকে কিছুদিন ফোনেও পাওয়া গেল না। রিং করতেই আওয়াজ আসে,’ আপনার কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটিতে সংযোগ প্রদান করা সম্বব হচ্ছে না...।’ অর্থাৎ ফোন বন্ধ। এ তো মহা কেলো!
প্রায় বিশ দিন পরে শাকিবের ফোন পাওয়া গেল। গলার আওয়াজে অবশ্য ঝামেলার কোন গন্ধ পাওয়া গেল না। একই রকম ফুরফুরে মেজাজে আছে মনে হলো; যেন এইমাত্র কোন মজার অভিজ্ঞতা ঘটেছে। জোশে থাকলে যেরকম খানিকটা আঞ্চলিক টানে কথা বলে সেরকম সুরেই কথা বলছে।
‘কী হে! লাঞ্চব্রেক পার্টনার! খবরাখবর কী তোমাদের? আছো তো মহাসুখে। আমারে তো দিলা সবাই ষড়যন্ত্র কইরা সরাইয়া। মনের দুঃখে পাহাড়বাসী হইয়্যা গেলাম।’
আমি তড়বড়িয়ে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করলাম। শাকিব কোন কথারই ঠিকঠাক জবাব দিল না। যা জিজ্ঞেস করি হেসেই উড়িয়ে দেয়। বিরক্ত হয়ে গেলাম শেষমেষ। আমার বিরক্তি বুঝতে পেরেই বোধহয় প্রস্তাবটা দিল।
‘সব কথা কি ফোনে বলতে হয়? সাক্ষাতে কথা হোক। চলে আসো খাগড়াছড়ি। বড় বাংলোতে থাকি। আরে মিয়া, ঈর্ষাতে তো কাহিল হইয়্যা যাইবা।’
এই বলে মনের দুঃখে পাহাড়বাসী হলাম, আবার এই বলে ঈর্ষাতে কাহিল হয়ে যাবো। মাথাটাই মনে হয় গেছে। কিন্তু প্রস্তাবটা মন্দ নয়। সামনের মাসে একটা দুই দিনের ছুটি আছে। এর সাথে যদি আর এক আধদিন ছুটি ম্যানেজ করা যায় তাহলেই ঘুরে আসা যায়। অফিসের দু’একজনকে সাধলাম। কেউই আগ্রহ দেখালো না। দেখাবেই বা কেন? বেশিরভাগই ফ্যামিলি ম্যান। বউ-বাচ্চা নিয়ে এখানে ওখানে বেড়াতে যাবে। ফেসবুকে হাসিখুশি পরিবারের ছবি আপলোড করবে। আমার মত ব্যাচেলরদের আর কী করা! বন্ধুর বাংলোবাড়ি দেখার প্রস্তাব লুফে নেওয়া ছাড়া?
দুই
শাকিবকে দেখে সত্যিই বড় আনন্দিত হলাম। মহা আমুদে ছেলে। অফিসটাকে বেশ মাতিয়ে রাখতো। শাকিব চলে আসার পর অফিসের মজাটাই যেন চলে গেছে। আমাকে দেখে শাকিবও বেশ খুশি হলো মনে হয়। সটান জড়িয়ে ধরলো একেবারে।
‘আরে ভাই, তুমি যে সত্যিই আমার কথায় চলে আসবা এতটাতো আমি আশাই করি নাই।’
শাকিবের দাবী মিথ্যে নয়। বিরাট বড় বাংলো। চারপাশ ঘিরে ফুলের বাগান। বাংলোর ভেতরটাও যথেষ্ট আধুনিক। আমাদের খাগড়াছড়ি জোনাল সেকশনে সাধারণত কেউ আসতে চায় না। অল্প কয়েকজন স্টাফ আছে। হেড অফিসের সাথে এই অফিসের তেমন কোন যোগাযোগ নেই বললেই চলে। খুব একটা কাজকর্মও নেই। অনেকটা পানিশমেন্ট পোস্টিং বলা চলে। জেলের কয়েদিদের আরাম আয়েশ দিয়ে একটু মনোরঞ্জনের চেষ্টা আর কী!
গড়বড়টাতো এখানেই। শাকিবের মত মহা কামিয়াব ছেলেকে কেন পানিশমেন্ট পোস্টিং দেওয়া হবে?! কারণ জানতে আমার আর তর সইছে না। এটা ওটা শেষে আসল কথা পাড়লাম। শাকিব তো পাত্তাই দেয় না। মুচকি হেসে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়। বুঝলাম, সে আরাম করে বলতে চায়। বেশ, আমারো হাতে গোটা তিনদিন সময় আছে।
দুপুরে একেবারে মহাভোজ করলাম। আমার আসার খবর জেনে শাকিব আগেভাগেই ব্যবস্থা করে রেখেছিল। পুকুরের পাকা রুই, কচি পাঁঠার মাংস, খাগড়াছড়ির স্পেশাল শুঁটকি, চিকন চালের ঝরঝরে ভাত। খাওয়া শেষে খাঁটি গাওয়া ঘি দিয়ে বানানো ঘন দুধের সেমাই। শরীরটা আরামের চোটে একেবারে নেতিয়ে পড়লো।
'শাকিব, ভাবছি আমিও খাগড়াছড়ি পোস্টিং এর জন্য বসের কাছে আবেদন করবো। অথবা তুমি কী ক্রাইম করেছো সেটা জানাও। সেটাই করে ফেলি।'
শাকিব কৌতুক করে বললো, 'তোমার জন্য প্রথমটাই নিরাপদ। দ্বিতীয়টা করার সব উপকরণ নাও পাইতে পারো।'
মনে হচ্ছে শাকিব মুখ খুলছে। আমিও চেপে ধরলাম।
'কী হইছে বলো বন্ধু। আর সাসপেন্সে রাইখো না।'
'সাসপেন্সে কি আর সাধে রাখি রে ভাই! কী যে হইলো নিজেও এখনো বুইঝা উঠতে পারতাছি না। তোমারে আর কী বোঝাবো?'
দু'জন গিয়ে বসলাম বেডরুমের সাথে লাগোয়া ব্যালকনিতে। চমৎকার বাতাস বইছে। শীত যাই যাই করছে। বসন্ত আসি আসি করছে। আবহাওয়া অতি মনোহর। বাতাসে শাকিবের চুল এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। মাথা ভর্তি সিল্কি চুল শাকিবের। এক জায়গায় স্থির থাকে না। ওর গায়ে একটা মেরুন পাঞ্জাবী। হাতাটা বেশ কায়দা করে কনুই পর্যন্ত গোটানো। তীক্ষ্ণ নাক আর বুদ্ধিদীপ্ত চোখে সারাক্ষণ কেমন একটা আমোদ খেলা করে। আমি মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হলাম, সাকিবের মত সুপুরুষ সচরাচর চোখে পড়ে না। শাকিব ঢাকার অফিস থেকে চলে আসার পরে আমাদের তো বন্ধু বিয়োগে কিছুটা মন খারাপ হয়েছেই। কিন্তু কানাঘুষো শুনতে পাই, বেশ কয়েকজন মহিলা সহকর্মী ইদানীং উঠতে বসতে ঘন ঘন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছেন। কাজে কর্মে ঠিকঠাক মন বসছে না। মানে নিন্দুকেরা বলাবলি করছে আর কী!
শাকিবের এক হাতে সিগারেট। এলোমেলো চুলকে অন্যহাতে শাসন করতে করতে সে গল্প শুরু করে।
তিন
ঘটনার সূত্রপাত ঢাকার অফিসেই।
সেদিন অফিস ছুটির পরেও একটা এসাইনমেন্ট নিয়ে কাজ করছিলাম। একটা ব্যাপার কিছুতেই ঠিকমত মেলাতে পারছিলাম না। গড়বড় লাগছিল। তুমি তো জানোই, বস অফিস শেষেও অনেকক্ষণ রুমে বসে কাজ করেন। তাই ভাবলাম, বসের সাথে আলাপ করে আসি। একটা সমাধান পেয়ে যেতে পারি।
গিয়ে দেখি, স্যারের রুমের দরজা ভেজিয়ে রাখা। কিন্তু ফোনে কার সাথে যেন বেশ উচ্চস্বরে কথা বলছেন। বাইরে থেকে বেশ কিছু কথোপকথন শুনতে পাচ্ছিলাম। মনে হল, কাউকে ধমকাধমকি করছেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে চলে আসবো কিনা ভাবছি। তারপর কী মনে করে ঢুকেই পড়লাম। স্যার ইশারায় আমাকে বসতে বললেন। আমার উপস্থিতিতেই আরো কিছুক্ষণ ধমকাধমকি চললো।
‘এভাবে চলতে থাকলে আমি তোমার লেখাপড়াই বন্ধ করে দিব। তারপর তোমার যেটা করতে ভাল লাগে কর গে যাও।’
আমি মুখ চিমসিয়ে বসে থাকলাম। ঢুকে পড়ে দেখি ভালো ঝামেলা হলো!
স্যার অবশ্য আর বেশিক্ষণ কথা বললেন না। কথা শেষ করে আমার দিকে ফিরলেন। চেহারায় মহাবিরক্তি। আমি কী বলতে এসেছিলাম তা প্রায় ভুলেই গেলাম। আমতা আমতা করে বলার চেষ্টা করছি। স্যার মনে হলো না কিছু শুনছেন। ঠিকই তাই। আমার কথার ধারকাছ দিয়ে না গিয়ে বললেন,
‘শাকিব, তুমি তো ঢাকা ভার্সিটিতে পড়তে। বেশিদিন হয় পাস করোনি। তোমার পরিচিত কোন ভালো ছাত্র আছে যে ‘এ’ লেভেলের কাউকে পড়াতে পারবে?’
আমি হুট করে কী বলবো বুঝতে পারলাম না। ভার্সিটি ছেড়েছি তাও প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো। জুনিয়রদের সাথেও তেমন একটা যোগাযোগ নেই। আমি বেশি চিন্তা ভাবনায় না গিয়ে বলে ফেললাম,
‘না স্যার, তেমন কেউ তো পরিচিত নেই। নিউজপেপারে খোঁজ করলে পাওয়া যেতে পারে। এরকম বিজ্ঞাপন তো প্রায়ই থাকে।’
‘আরে না। যাকে তাকে দিয়ে কাজ হবে না। চেনা জানার মধ্যে হলে ভাল হয়। তুমি তো ভাল খোঁজ-খবর রাখো। তোমার পরিচিত কাউকে যদি পাও...’, তারপর কী একটু চিন্তা করে বললেন,
‘শাকিব, তোমার তো অংকের মাথা খুব ভালো। তুমি আমার মেয়েটাকে পড়াও না!’
আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। কী মহা গাট্টায় পড়লাম রে বাবা! ভার্সিটি জীবনের শুরুতে একটু আধটু টিউশনী করেছিলাম। এখন এই চাকরিজীবনে এসে আবার টিউশনী? তাও আবার বসের মেয়েকে? নাঃ আজ, বসের রুমে ঢোকাই ঠিক হয়নি আমার।
স্যার মনে হয় আমার মনের অবস্থাটা বুঝে ফেললেন। আশ্বস্ত করার মত করে বললেন,
‘আসলে মা মরা মেয়ে। একটু জেদি। ইচ্ছা-অনিচ্ছায় কখনো বাধা দিইনি। যখন যা চেয়েছে পেয়ে গেছে। কিন্তু এখন তো আর পারা যাচ্ছে না। পড়াশুনার অবস্থা খুব খারাপ। ওর কলেজের প্রিন্সিপাল আ্মার বন্ধু মানুষ। সেজন্যই কিছুটা মান রেখে কথা বলেছে। মেয়ের দিকে বিশেষ মনোযোগ দিতে বলেছে। কী বলবো তোমাকে, বন্ধুর সামনে নাকটাই কাটা গেছে আমার।’
আমি চুপচাপ শুনে যাচ্ছি। কীই বা বলবো এখানে। তবু সুযোগ বুঝে বলেই ফেললাম,
‘কিন্তু স্যার, আমি পড়ালে কি বিশেষ কোন উপকার হবে? প্রফেশনাল কাউকে দিয়ে পড়ালে ভালো হত মনে হয়।’
স্যার মুখ বিকৃত করে বললেন,
‘রাখো, তোমার প্রফেশনাল। অনেক দেখলাম। আমি কি আর বসে আছি? কেউই একটু দায়িত্ব নিয়ে পড়ায় না। তোমার উপর আমার অগাধ আস্থা, শাকিব। তুমি ওর অংকের দায়িত্বটা নিলে নিশ্চিন্ত হতাম। পারিশ্রমিক নিয়ে একদম চিন্তা করবে না।’
এরপরে তো আর আমার কিছু বলার থাকে না। ঠিক হলো, সপ্তাহে দু’দিন অফিস শেষে স্যারের বাসায় গিয়ে পড়াবো। খুবই ঝামেলায় পড়লাম। কিন্তু কী করা! চাকরি বাঁচাতে কত কীই করতে হয়। এ তো সামান্য ছাত্রী পড়ানো।
স্যারের মেয়ের বয়স আঠারো-উনিশ। নাম লামিয়া। চাল-চলনে যাকে বলে অতি আধুনিক। ঠিকমত বাংলা বলতে ভীষণ অসুবিধা। সব কিছুতেই একটা নাক উঁচু ভাব। আমাকে দেখে প্রথম প্রথম পাত্তাই দিলো না। আমিও ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে শুরু করলাম। এই জাতীয় অতি আধুনিক মেয়েদের ব্যাপারে আমি বরাবরই কিছুটা এলার্জী বোধ করি। এরা ভাব দেখায় দুনিয়ার সবকিছু বুঝে গেছে। আসলে বোঝে তো মানকচু!
পড়াতে গিয়ে দেখলাম, যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়েও বড় গাধা। এর মাথায় কী করে অংক ঢোকাবো আমি সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলাম।
এদিকে নিজের গোমর ফাঁস হওয়ার পর লামিয়া নিজে থেকেই ঠাণ্ডা মেরে গেল। আমার প্রতি অবজ্ঞা কমে গিয়ে একটু যেন বেশিই সমীহ দেখাতে শুরু করে দিল। ভাব গতিক বিশেষ ভালো ঠেকলো না আমার। অতি ইঁচড়ে পাকা মেয়ে। পড়া সংক্রান্ত প্রশ্নের চেয়ে অন্য কিছু জানার ব্যাপারেই বেশি আগ্রহ। আমি কোথায় থাকি, ফেসবুকে নিয়মিত বসি কিনা ইত্যাদি। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। এ না হয় কাঁচা বসন্তের দোলায় দুলছে। আমার তো বসন্ত পেকে গেছে। সুতরাং মনকে বোঝালাম, খবরদার...সাধু সাবধান।
ছাত্রীর কোয়ালিটি ছাড়া আর কোন কিছু খারাপ না। দেড়-দু’ঘণ্টা পড়াই। ভেতর থেকে মজার মজার নাস্তা আসে। লামিয়ার তো মা নেই। এত মজার নাস্তা কে বানায় আল্লাহ্ মালুম। একেকদিন একেক রকম সম্ভার। প্রচুর পরিমানে। মেসে গিয়ে আর রাতের খাবার খাওয়ার প্রয়োজন হয় না।
একদিন লামিয়াকে অংক বোঝানোর মাঝখানে চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজে চমকে উঠলাম। লামিয়া তো চুড়ি পড়ে না। কী সব নানান স্টাইলের ব্যান্ড পড়ে। তাকিয়ে দেখি, আমার সামনে এক অপূর্ব রূপসী দাঁড়িয়ে। ছেড়ে দেওয়া লম্বা চুল, কাজল টানা চোখ, দু’হাত ভর্তি চুড়ি, পরনে হালকা বেগুনি রঙের তাঁতের সুতি শাড়ি। বয়স টেনেটুনে চব্বিশ-পঁচিশ হবে। আমার তো হার্ট এটাক হবার দশা! একেবারে যেন শরৎচন্দ্রের নায়িকা আমার সামনে দাঁড়িয়ে। লামিয়ার যে বড় বোন আছে এ খবর তো আমি জানতাম না। আমার ঘোর কাটলো মেয়েটির রিনরিনে আওয়াজে,
‘আপনার সাথে পরিচিত হতে এলাম। লামিয়া কেমন পড়ছে সেটাও তো জানা দরকার। আমি লামিয়ার ...’
‘আঃ পড়ার সময় ডিস্টার্ব করছো কেন? পড়া শেষে আলাপ করলেই তো হয়।’ লামিয়া একেবারে খেকিয়ে উঠলো।
‘ওঃ সরি। জী, পরে আলাপ করবো আপনার সাথে।’ মুখটা কালো করে মেয়েটি তাড়াতাড়ি উঠে পড়লো।
আমি বিষাক্ত চোখে তাকালাম লামিয়ার দিকে। মহা সেয়ানা মেয়ে। আমার চোখের মুগ্ধতা বুঝতে ভুল হয়নি। কেমন যেন ক্ষীপ্ত মনে হলো।
‘উনি কে? তোমার বড় বোন বুঝি? উনি আলাপ করতে এসেছিলেন। তোমার এরকম ভাবে কথা বলা উচিত হয়নি।’
লামিয়া হুঁ হাঁ একটা কিছু বললো। আমার সেদিন আর পাঠদানে মন বসলো না। মনটা পড়ে রইলো অন্য কোথাও।
এরপর থেকে আমার অবস্থা যা হলো তা আর কী বলবো! কারণে অকারণে এদিক সেদিক চাইতাম। অপ্রয়োজনে পানি খেতে চাইতাম। আশা, যদি পানির গ্লাস হাতে আবার সে আসে!
কিন্তু নাঃ...আর আসলো না কোনদিন। মরিয়া হয়ে একদিন অফিস আওয়ারে লামিয়াদের বাসায় ফোন দিলাম। জানতাম, এ সময় লামিয়া বা স্যার কেউই বাসায় থাকবে না। সেও না থাকতে পারে। একটা সুযোগ নিলাম আর কী!
আমাকে হতাশ না করে সে ফোন ধরলো। ভাব দেখালাম লামিয়াকে ফোন করেছি। জরুরী কিছু বলতে ভুলে গেছি সেটা জানাতে। সে আমার অযুহাত বুঝলো কি না কে জানে! কেবল একটু হাসি দিল। ফোনের তারের মধ্য দিয়ে সে হাসি আমার হৃদয় তারে ঢুকে গেল। একেবারে বেড়াছেড়া অবস্থা!
টুকটাক ভালোই কথাবার্তা হলো। গল্পে গল্পে আমার অনেক কিছুই তাকে বলে ফেললাম। কিন্তু নিজের সম্পর্কে তেমন কিছুই সে জানালো না। আমার প্রতিটা প্রশ্নই সুনিপুণভাবে এড়িয়ে গেল। শুধু নিজের নামটা বললো, নাইমা।
এরপরেও আরো বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছি। আমার তখন বেহাল দশা। কিন্তু নাইমা আর বেশি কথা বলতে চাইতো না। একদিন লামিয়াকে পড়ানো শেষে ব্যাপক দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিয়ে বললাম,
‘নাইমাকে একটু ডাকো ত!’
লামিয়া হাঁ করে আমার দিকে তাকালো। যেন বুঝতে পারছে না আমি কী বলছি। বুঝতে পেরে কাট কাট করে বললো,
‘বাসায় নেই।’
পরিষ্কার মিথ্যে কথা। মেসে এসে অনেক চিন্তা ভাবনা করলাম। দেখতে দেখতে একত্রিশ বসন্ত পার করতে চলেছি। দেশের বাড়ি থেকে মা প্রায়ই বিয়ের জন্য তাগাদা দেন। বিয়ে তো করা দরকার আমিও বুঝি। কিন্তু কাউকেই তো মনে ধরে না। বসের মেয়েকে পছন্দ করে ফেলেছি, এটাই যা সমস্যার। কিন্তু নিজেই নিজের পক্ষে সাফাই গাইলাম। আমি কি পাত্র হিসেবে ফেলনা নাকি? স্যার চোখ বুজে আমাকে বিশ্বাস করেন। ভালো চাকরি করি, মোটা মাইনে পাই। দেখতে শুনতে খারাপ না। ঠিক করলাম, নিজেই স্যারকে প্রস্তাবটা দিব। আমার তো বাবা নেই। দেশের বাড়িতে এক চাচা আছেন। কী দরকার তাকে শুধু শুধু ঝামেলা দিয়ে!
তোমাদের কাউকে কিছু জানাই নাই। ভেবেছি, ভালোয় ভালোয় সব কিছু হয়ে গেলে পরে জানাবো।
সুযোগমত একদিন অফিস শেষে বসের রূমে ঢুকলাম। তারপর একথা ওকথা শেষে খুব মোলায়েম ভাবে নিজের ইচ্ছের কথাটা জানালাম।
‘স্যার, ইয়ে যদি কিছু না মনে করেন...আমার তো তেমন কোন মুরুব্বী নেই, তাই আমিই...মানে...আমি আপনার বড় মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।’
স্যারের দু’চোখ বিস্ফোরিত।
‘বড় মেয়ে? মানে? আমার তো একটাই মেয়ে!’
‘স্যার, নাইমা’র কথা বলছিলাম।’
‘হোয়াট? হাউ ডেয়ার ইউ? হাউ...আই উইল ফিনিশ ইউ...’
স্যার চিৎকার করতে করতে প্রায় অজ্ঞান হয়ে যাবার দশা। আমি কিছু বুঝতে না পেরেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে আসলাম।
চার
এই পর্যন্ত বলে শাকিব থামলো। আমিও কিছু বুঝতে না পেরে ওর মুখের দিকে চাইলাম। মেয়েকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। এতে দোষের কী হয়েছে? শাকিব আমার হতবিহবল দশা প্রাণভরে উপভোগ করলো। যেন শেষ চাল দিচ্ছে এমনভাবে বললো,
‘কিছু বুঝলে না তো? আমার অবস্থাও ছিল তথৈবচ। পরেরদিন সকাল বেলা ডিরেক্টর আজিম স্যার আমার মেসে এসে হাজির। তুমি তো জানোই, উনি আমাকে একটু বিশেষ স্নেহ করেন। তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম, কী ভয়ানক প্যাঁচ লাগিয়ে দিয়েছি। আর একটু হলে তো চাকরিটাই গিয়েছিল। আজিম স্যার ম্যানেজিং কমিটির সবাইকে বলে কয়ে চাকরিটা বাঁচাতে পেরেছেন।’
‘কিন্তু বস এত রেগে গেলেন কেন?’
‘আরে রাগবেন না তো কী করবেন? আমি যদি তার বউকে বিয়ে করতে চাই, তো উনি কি আমাকে কোলে নিয়ে আদর করবেন?’
‘কী বললে? বউ? অ্যাঁ...হাহ্ হাহ্ হা...।’
‘আমি কী করে জানবো বলো যে, পঞ্চান্নোর্ধ বসের চব্বিশ বছরের তন্বী দ্বিতীয় পক্ষ থাকবে? মান-ইজ্জত প্রায় ডুবতে বসেছিল। তোমাদের সাথে দেখা করবো কোন মুখ নিয়ে বলো? এই ইয়ে, তুমি আবার অফিসের কাউকে...মানে বুঝতেই তো পারছো...ইট্স কনফিডেন্সিয়াল।’
আমার হাসির দমক থামছেই না। থেকে থেকেই হিঁচকি’র মত উঠছে। শাকিব চোখ পাকিয়ে বললো,
‘হাসি থামাও। চলো, বাইরে থেকে ঘুরে আসি। দেখছো না কী চমৎকার বাতাস বইছে? আহা! বসন্তের বাতাস!’
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোহন দাস (বিষাক্ত কবি) ২৯/০১/২০২০সুন্দর
-
রেজাউল রেজা (নীরব কবি) ২০/০৫/২০১৮Nice!
-
মোঃ ইমরান হোসেন (ইমু) ১৯/০৫/২০১৮আশা করছি গল্পগুলো একদিন উপন্যাস হয়ে প্রকাশ হবে!!!!!!!!!!!!!!!!!!