শিকার
‘কী কাকে চাই? এই সাতসকালে একজনের বাসায় এসে এত জোরে জোরে বেল বাজাচ্ছো কেন?’
রীতিমত বাঁজখাই গলার স্বর ভদ্রমহিলার। কবির পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল। কী যেন বলবে বলে শিখে পড়ে এসেছিল, কিছুই আর ঠিকঠাক মতো মনে পড়লো না। আমতা আমতা করে কোনমতে বললো,
‘ইয়ে এখানে বাসা ভাড়া পাওয়া যাবে কি?’
‘বাইরে টু-লেট লাগানো আছে, সেটা দেখনি?’
কবিরের এতক্ষণে মনে হলো, ভদ্রমহিলা শুরু থেকেই তাকে তুমি তুমি করে বলছেন।
আরে আজব তো! সে একজন সাতাশ বছরের যুবক। চেহারাতেও কোন খোকা খোকা ভাব নেই। এই ভদ্রমহিলা তাকে তুমি করে বলছেন কোন বিবেচনায়?
অবশ্য খটকা কিংবা খারাপ লাগলেও প্রতিবাদ করার উপায় নেই। কারণ এই মুহুর্তে কবিরের বাঁচা মরা না হলেও এই শহরে একটু ভদ্রভাবে টিকে থাকা অনেকখানিই নির্ভর করছে এই ভদ্রমহিলার সুমতির ওপর।
ভদ্রস্থ চাকরি করে বারোয়ারী মেসে বাস করা যায় না। হরেকরকম রুচির ছেলেপুলে থাকে সেখানে।
কেউ লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তো কেউ হাফপ্যাণ্ট। পরনের জামা কাপড় মাসে দু’মাসে একবার সাবান দিয়ে কাচে কী না সন্দেহ! গা দিয়ে ভুর ভুর করে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় একেকজন। সেই তারাই আবার বিকেলে বান্ধবীর সাথে দেখা করতে যাওয়ার আগে সেণ্টের পুরো বোতলটাই পারলে শরীরে ঢেলে দেয়।
খাওয়ার টেবিলে বসেও শান্তি নেই। কেউ খেতে বসে হাপুসহুপুস শব্দ করে অথবা চুকচুক শব্দ করে পিরিচে ঢেলে চা খায়। এমন জায়গায় বাইরে থেকে বন্ধু-বান্ধব অথবা আত্মীয় পরিজন কেউ দেখা করতে এলে লজ্জায় একদম মাথা কাটা যায়।
এই তো সেদিন, কবিরের এক মামা চিটাগাং থেকে কী কাজে যেন ঢাকায় এসেছেন। ফেরার আগে তিনি কবিরের সাথে দেখা করতে সোজা একেবারে ওর মেসে গিয়ে হাজির হলেন। ওকে না জানিয়েই।
ছুটির দিন। কবির বেলা করে ঘুম থেকে উঠে ক্যাণ্টিনে গেছে নাস্তা করতে। কবিরের রুমমেট নাফিজ তখন আশেপাশের রুমের কয়েকজনকে জড়ো করে তিনপাত্তি খেলতে শুরু করেছে। মোবাইলে বাজছে চড়া হিন্দি গান।
কবিরের মামাকে ঢুকতে দেখেও তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। নিজেদের খেলায় বেমালুম মজে আছে।
শেষমেষ কবিরের সাথে দেখা হওয়ার পরে মামা প্রথম যে কথাটি ওকে বললেন তা হলো,
‘ভালো চাকরি পেয়েছিস শুনলাম। তাই দেখা করতে এসেছিলাম। কিন্তু যে জায়গায় আছিস! এখানে থাকলে তো স্ট্যাটাসই ভুলে যাবি!’
কথাটা ভুল নয়। কবির নিজেও যে এই বিষয়টা নিয়ে কখনো ভাবেনি তা নয়। ঢাকা ভার্সিটির আইবিএ থেকে বিবিএ এমবিএ করেছে সে। বেশ কেতাদুরস্ত একখানা চাকরিও বাগিয়েছে। অফিসে ঢংঢাং য়ের শেষ নেই। ওকে আবার বেশির ভাগ সময় বিদেশী ডেলিগেটদের সাথে কাজ করতে হয়। কবিরের ইংরেজি বেশ ভালো। তাই তাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
মেসে ফিরে এই পরিবেশের ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণের মধ্যেই কবির আবার অন্যজগতে চলে যায়। পরেরদিন অফিসে গিয়ে সেই জগত থেকে আবার ফিরে আসতে বেশ খানিকটা সময় দিতে হয়। ফিরে এলে আবার যে কে সেই... এই টানাহ্যাঁচড়াই চলছে কয়েকমাস ধরে।
ওর আরেক বন্ধু আবিদেরও একই দশা। কবিরের সাথে একই মেসে থাকে। ওর ছোটবেলার বন্ধু।
সেও কবিরের মতো জাতে উঠতে চায়। কবিরের মতো এত হাইফাই না হলেও আবিদও মোটামুটি একটা চাকরি জোটাতে পেরেছে। তাই দুই বন্ধু মিলে শলা পরামর্শ করে ভালো একটা বাসা খোঁজার কাজে মন দিয়েছে।
কিন্তু হায়! ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া পাওয়া আর বাঘের দুধের সন্ধান পাওয়া একইরকম অসম্ভব ব্যাপার।
নানা জায়গা থেকে খবরাখবর জোগাড় করে গত প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে বাসা খুঁজছে ওরা দু’বন্ধু। প্রায় আটটা নয়টার মতো বাসা ইতিমধ্যে দেখাও হয়ে গিয়েছে। ভাড়া পাওয়ার এখনো কোন নামগন্ধ নেই। ব্যাচেলর শুনলেই সবাই এমনভাবে তাকায় যেন ওরা কোন ক্রিমিনাল। মস্ত কোন ক্রাইম করে এখন আশ্রয় খুঁজতে এসেছে।
দেখেশুনে দু’বন্ধু যখন ভালো একটা বাসার আশা প্রায় একরকম ছেড়েই দিয়েছে, তখনই ওরা এক এজেন্টের সন্ধান পায়।
ভারী অদ্ভূত এজেণ্ট। ব্যাচেলরদের শতকরা শত ভাগ গ্যারান্টিতে বাসা ভাড়া পাইয়ে দেয়। সেজন্য অগ্রীম কিছু টাকা অবশ্য দিতে হয়। বিফলে পুরো মূল্য ফেরত।
সন্ধান পাওয়া মাত্রই কবির আর আবিদ গিয়ে হানা দেয় সেখানে।
প্রায় ওদেরই বয়সী এক ছোকরা। দেখেই বোঝা যায়, মহা চালু। যাকে বলে একেবারে ঝুনা নারিকেল। কোনোরকম ভূমিকা টূমিকা’র ধার না ধেড়ে সোজা ভাষায় বললো,
‘শিকার বোঝেন? শিকার? বাসা ভাড়া পাইতে হইলে শিকারী হইতে হইবো।’
‘শিকার!’ কী অদ্ভূত শর্ত রে বাবা! দু’বন্ধু মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে।
ছেলেটা একপাশে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
‘বুঝলেন না তো! না বোঝারই কথা। এই যেমন ধরেন, আপনারা এতদিন ধইরা ভাড়া পাওয়ার আশায় বাসা খুঁজতাছেন। অথচ কোনো বাসা পাইতাছেন না। কেউ আপনাদের বিশ্বাসই করে না! কেমন না কেমন ছেলে আপনারা, কে জানে! এই বিশ্বাসটাই আসলে অর্জন করতে হইবো, বুঝছেন?’
কবির একটু স্মার্ট হবার চেষ্টা করে। সামনে ঝুঁকে সোজা ছেলেটির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘প্লিজ থামবেন না। খোলাসা করুন আগে। কীসের বিশ্বাস, কার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে?’
‘বাড়িওয়ালার! আবার কার!
আরে, এইটারে বেইজ কইরাই তো এজেন্টগিরি করতাছি। দলে বলে ব্যাচেলর ছেলেপেলে আসে, কেউ বাসা ভাড়া পায় না। আমরা এই এলাকার সব বাড়িওয়ালার দূর্বল দিক গুলান নিয়া... যারে বলে একেবারে রিসার্চ কইরা ফালাইছি। কার কী দরকার, কার বাসায় কাজের লোক নাই, কার ছেলেরে স্কুলে নিয়া যাইতে হইবো, কার মাইয়ারে পড়াইতে হইবো, কারে একটু বাজার টাজার কইরা দিলে খুশী হইবো...এইসব আর কী!’
কবির একেবারে যেন আকাশ থেকে পড়ে। পাশে তাকিয়ে দেখে আবিদেরও একই হাল। হাঁ করা মুখ বন্ধ করে শেষমেষ প্রশ্ন করে,
‘আপনি বলতে চাইছেন, আমরা এইসব ফাইফরমাশের কাজ করে দিয়ে বাসা ভাড়া নিব? টাকা দিয়ে থাকবো আবার এসবও করে দিতে হবে?’
‘জি, ভাইজান। এই তো বুইঝা ফালাইছেন।’ পান খাওয়া লাল-কালো দাঁতের সারি বের করে উত্তর দিলো ছেলেটি।
‘মাথা ঠিক আছে আপনার? আমরা কি ফেলনা লোকজন নাকি? কোনো আত্মসম্মান নেই আমাদের?’
‘জি, ভাইজান আছে! কিন্তু হেই আত্মসম্মান ধুইয়া তো বাসা খুঁইজা পাইবেন না। এই অঞ্চলে খুব ভালো একটা তিন রুমের বাসা খালি আছে। এক্কেবারে আপনাগো লাইগা পারফেক্ট। খুব সোজা একটা কাম করতে হইবো। বাড়িওয়ালার মাইয়া অংকে খারাপ। আপনাগো কাউরে একটু পড়াইতে হইবো। ব্যস, তাইলেই কাম হইয়া যাইবো। দশ হাজার টাকা আগাম দিবেন আমারে। কাম না হইলে টাকা ফেরত।’
কবির অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে। ওর মুখে আর কথা যোগায় না। বাকী কথা আবিদই শেষ করে,
‘কাজ না হলে মানে? আমাদের কি আগে টিউশনী করে উনার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে? তারপরে বাসা ভাড়া দিবেন?’
‘তার চাইতে আরেকটু ভালো ব্যবস্থা। বাসায় উঠবার পারবেন, পড়ানোর কথা আগে বইলা নিবেন। দুইমাসের শর্তে বাসা পাইবেন। আপনাদের পড়ানো পছন্দ হইলে যদ্দিন খুশি থাকতে পারবেন। আর তা না হইলে দুইমাস পরে নতুন বাসা খুঁজতে হইবো।’
‘কী বলেন এইসব? এগুলো কি মগের মুল্লুক নাকি?’
‘আরে ভাই, সব কিছুর মইধ্যেই চাইলে ফাঁকি মারা যায় বুঝেন না!
দুইমাস পরে চাইলে আর পড়াইবেন না। কারণ দুইমাস টিকতে পারলেই আপনারা পার্মানেণ্ট হয়্যা যাবেন। তখন আপনাদের সরাইতে হইলে অন্ততঃ ছয়মাস আগে নোটিস দিতে হইবো। তারমানে অন্তত আটমাসের বন্দোবস্ত পাক্কা। সব খবর নিয়াই বুদ্ধি দিতাছি চিন্তা ভাবনা কইরা দেখেন!’
কবির আর আবিদ একেবারে থ বনে গেল। এ কী আজব নিয়মকানুনের মধ্যে এসে পড়লো তারা? এমন কথা কে কোথায় শুনেছে?
কবির মাথা নেড়ে অসম্মতির সুরে বললো,
‘দূর! এসব কোনো কথা হলো? এই বয়সে টিউশনী করতে হবে? আর তাও বাসা ভাড়া নেওয়ার জন্য!’
‘রাজি না হইলে নাই! বাসা খুঁইজা বেড়ান ফ্যাঁ ফ্যাঁ কইরা! কে মানা করছে? না পোষাইলে কাইটা পড়েন ভাইসাব। আমার অন্য কাস্টমার আইবো।’
ওরা কাটলো না। কাটার কোনো উপায় নাই। এই দুই সপ্তাহেই ওরা বুঝে গেছে ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া পাওয়া কী দুঃসাধ্য ব্যাপার!
আবিদ কম্প্রোমাইজিং সুরে বললো,
‘ভাই, বাড়িওয়ালাকে খুশি করার জন্য টিউশনীই কি করতে হবে? ইয়ে...মানে আর কিছু করা যাবে না?’
এজেণ্ট ছেলেটা বললো,
‘আরে ভাই, বুঝেন না কেন? আপনারা শিক্ষিত ছেলেপেলে। টিউশনী তো সম্মানের কাজ। কোনো বাড়ির বাজার কইরা দিতে বললে ভালো হইতো? আর তাছাড়া একেক বাড়িওয়ালার একেক রিকুরমেণ্ট। আপনাদের যে বাসার সন্ধান দিতাছি তাদের রিকুরমেণ্ট এইটাই। মাইয়ারে পড়াইবেন। তারা খুশি...আপনারাও খুশি! এখন বলেন, রাজি আছেন কী না!’
আর গাঁইগুঁই করার সুযোগ নেই। কবির তবুও ঘাড় গোঁজ করে আছে দেখে আবিদই লীড নিয়ে বললো,
‘জি ভাই, আমরা রাজি। আপনি সেই বাসার ঠিকানা দেন।’
‘জি, দিতাছি। কী কী বলতে হইবো সবকিছু শিখাইয়া পড়াইয়া দিতে হইবো। শুনেন, বাড়িওয়ালার চাইতে বাড়িওয়ালীরেই বেশি পামপট্টি দিবেন, বুঝলেন? আর...’
একগাদা উপদেশ মাথায় নিয়ে কবির আজ বাসা দেখতে এসেছে। এসেই বাড়িওয়ালীর খসখসে আওয়াজ শুনে অর্ধেক কথা তার পেটের মধ্যেই রয়ে গেল।
‘কী ব্যাপার! কথা বলো না কেন? বাসা ভাড়া নিবা? পরিবার কোথায়? ছেলেমেয়ে আছে নাকি নতুন বিয়ে?’
‘জি, ইয়ে মানে...ব্যাচেলর। আমি আর আমার আরেক বন্ধু থাকবো...না না...প্লিজ দরজা বন্ধ করবেন না! আমার কথা শোনেন। আমি জানতে পেরেছি আপনি আপনার মেয়ের জন্য প্রাইভেট টিউটর খুঁজছেন। আমি তাকে পড়াতে রাজি আছি।’
ব্যাচেলর শুনেই বাড়িওয়ালী কোনো কথাতেই আর যেতে চাচ্ছিলেন না। একেবারে মুখের ওপরেই দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন। কবিরের পরের কথাগুলো শুনে আপাদমস্তক জরিপ করে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কীসে পড়াশুনা করেছো? এখন কী কর? ইন্টারমিডিয়েট এর অংক করতে পারবে?’
কবির বিনয়ে মাখনের মতো গলে গিয়ে বললো,
‘জি, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এমবিএ করেছি। আইবিএ থেকে। পড়াশুনায় ভালোই ছিলাম। পারবো ইনশাল্লাহ। আপনি কয়েকদিন দেখেন। তাহলেই বুঝতে পারবেন।’
‘হুম, সে তো বুঝতে পারবোই। তা কয়জন থাকবা? দুইজন? হুম...আচ্ছা বাসা দেখে যাও। আমার বাসার শর্ত জানো তো? দুইমাস আমি টেম্পোরারি বেসিজে রাখি। পছন্দ না হলে দুইমাস পরে অন্য বাসা খুঁজে নিতে হবে। রাজি তো?’
কবির গলায় আরো মধু ঢেলে বলে,
‘জি জি অবশ্যই রাজি। রাজি না হওয়ার তো কোনোই কারণ নেই। এটা তো সুন্দর ব্যবস্থা। ভাড়াটিয়া ভালো না হলে কি রাখা যায়?...’
কবির এতক্ষণে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। শিখিয়ে দেওয়া সব বাক্যই বেশ গড়্গড়িয়ে আওড়ে গেল সে। সাথে নিজের কিছু আপ্ত বাক্যও যোগ করে দিলো। বাড়িওয়ালী আর বেশি কথা বাড়ালেন না। শুধু ছোট করে বললেন,
‘বাসা দেখে যাও। পছন্দ হলে কাল পরশু চলে এসো। আর শোনো, আমি কিন্তু রাত বিরেতে হৈ চৈ পছন্দ করি না। আমার বাসার কিছু নিয়ম কানুন আছে...
মেসে ফিরে কবির সটান বিছানায় পড়ে রইলো কিছুক্ষণ। আবিদ বাইরে থেকে ফিরতেই খুব একচোট ঝাল ঝাড়লো তার ওপরে।
‘আমাকে একা পাঠায়ে দিয়ে বসে বসে মজা নিলি তাই না? টিউশনীও আমাকেই করতে হবে, আবার বাড়িওয়ালীর সাথে কথাও আমাকেই বলতে হবে? বাপ রে, বাপ! কী ভয়াবহ জিনিস রে বাবা! একদিনেই আমার দফারফা হয়ে গেছে!’
দু’বন্ধুর মধ্যে অনেক হিসেব নিকেশের পরে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, বাড়িওয়ালীর মেয়েকে কবিরই পড়াবে। কবির অনেক চেষ্টা করেছিল আবিদকে ভার দেওয়ার। কিন্তু আবিদের এক কথা,
‘বন্ধু, তুই বিবিএ পড়েছিস। আর আমি পড়েছি জিওলোজী। অংক টংক সব ভুলে গেছি। ওসব দায়িত্ব তোর। আর তুই কী স্মার্ট! আমি পড়াইতে গেলে দুইমাসের আগেই নাকচ হয়ে যাবো। শেষে আমও যাবে, ছালাও যাবে।’
অগত্যা কবিরকেই ভার নিতে হয়েছে। ঝুঁকি নেওয়ার অভ্যাস তার ভালোই আছে। দেখাই যাক না, কী হয়!’
দুদিনের মধ্যেই কবির আর আবিদ নতুন বাসায় উঠে গেল।
এজেন্ট ছেলেটা ভুল বলেনি। বাসাটা ওদের জন্য একেবারে পারফেক্ট। দুটো বেডরুম আর একটা ডাইনিং কাম ড্রইং। ভাড়াও খুব বেশি নয়।
বাড়িওয়ালীর মেয়েকে সপ্তাহে দু’দিন পড়াতে হবে। দুই ছুটির দিনে কোনো এক ফাঁকে এসে পড়িয়ে গেলেই হবে। পড়ানো কতদিন চালাতে হবে, সেটা নিয়ে এখনো চিন্তাভাবনা শুরু করেনি কবির। ছাত্রীর কোয়ালিটি বুঝে চিন্তাভাবনা করতে হবে। বেশি গোমূর্খ না হলে এমন একটা বাসার জন্য করলোই না হয় কিছুদিন টিউশনী!
কিন্তু তার আগে দুইমাসের প্রভিশনাল পিরিয়ডটা তো ঠিকঠাক পার করতে হবে!
যেদিন থেকে পড়ানো শুরু করার কথা, কবির সেদিন সময়ের পনেরো মিনিট আগেই বাড়িওয়ালার বাসায় গিয়ে হাজির হলো। এবারে আর বাড়িওয়ালী নয়, দরজা খুলে দিল কাজের মেয়ে। কবিরকে দেখেই দাঁত বের করে বললো,
‘আপনে আফার নতুন মাস্টার? সুফায় বসেন। আফারে ডাক দেই।’
কবির ড্রইংরুমে বসে বসে ঘামতে লাগলো। ইন্টারমিডিয়েটের পরে ভর্তি পরীক্ষার পালা চুকিয়ে দিয়ে কিছুদিন টিউশনী করেছিল। সে কোন আমলের কথা! আজ এতদিন পরে কী পড়াবে কে জানে! ইন্টারমিডিয়েটের বইও নিশ্চয়ই এতদিনে সব পালটে গেছে। অথচ ঠিকমত পড়ানোর ওপরেই সবকিছু নির্ভর করছে।
দুঃশ্চিন্তা বাদ দিয়ে ঘরের শোভা দেখায় মন দিলো সে।
বাড়িওয়ালীর যে খিটমিটে মেজাজ সেদিন দেখেছে, তার তুলনায় অবশ্য ঘরের মেজাজ বেশ শান্ত ও সুশীল। দেওয়ালে চমৎকার হাতের কাজের ওয়ালমেট। বাহারী শোকেসে রুচিশীল শোপিস। বড় মাটির ফুলদানিতে বাঁশের লম্বা স্টিক বেশ কায়দা করে সাজানো। পায়ের নীচে ঘাসের মতো রঙ আর ঘনত্বের পুরু কার্পেট। জানালাতেও একই রঙের মনোমুগ্ধকর পর্দা। যথেষ্ট রুচিশীল, সুশোভোন সবকিছু।
এমন বাসার কত্রী কাউকে প্রথম দেখাতে তুমি সম্বোধনে কথা বলেন, সেটা মানতে কষ্ট হচ্ছে।
ড্রইংরুমের সাজগোজের দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়াতে কবির একটু আনমোনা হয়ে পড়েছিল। জলজ্যান্ত বাড়িওয়ালীর উপস্থিতিও তাই টের পায়নি। হঠাৎ গলা খাঁকারিতে চমকে সামনে তাকিয়ে দেখে সাক্ষাৎ যমদূত বসে আছেন মুখোমুখি সোফায়।
চোখের দৃষ্টি কবিরের ওপরে সোজাসুজি নিবদ্ধ। কবিরের হঠাৎ কেমন যেন অস্বস্তি শুরু হতে লাগলো। এত জরিপ করার কী আছে রে বাবা!
‘শোন, আমার মেয়েকে কিন্তু একেবারে পুরো দু’ঘণ্টা পড়াতে হবে। একটুও কম হলে চলবে না। আর আমি মাসে তোমাকে পাঁচ হাজার করে দিব, ঠিক আছে? চাইলে ভাড়া পাঁচহাজার কমও দিতে পারো, যেটা তোমাদের খুশি। মনে কর না যে, বাড়িওয়ালী কিপ্টে। মানুষ খারাপ। চারপাশে নানাজাতের লোক দেখি কী না! তাই একটু খ্যাঁচখ্যাঁচ করতে হয় মাঝে মাঝে।’
বাড়িওয়ালীর কথা এবারে বেশ ভালো লাগলো কবিরের। এখন আর ভদ্রমহিলাকে তেমন দজ্জাল প্রকৃতির মনে হচ্ছে না। শুধু তুমি সম্বোধনটা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।
ভদ্রমহিলা যেন কবিরের মনের কথা আঁচ করে নিলেন। প্রায় সাথে সাথেই বললেন,
‘শোন, বয়স হয়েছে তো! হুট করে অল্প বয়সীদের তুমি বলে ফেলি। কিছু মনে করো না যেন।’
‘না না... ঠিক আছে...’ কবির শশব্যস্তে বলে ওঠে। এরপরে আর কথা চলে না।
অল্প সময় পরেই দরজার পর্দা ঠেলে ঘরে একটি মেয়ে প্রবেশ করলো। কবির মুখ তুলে মেয়েটিকে দেখেই চোখ নামিয়ে নিল। তারপরে বিদ্যুতস্পৃষ্টের মতো আবার তাকালো।
কবিরের মনে হলো, মেয়েটার মুখশ্রী ঠিক যেন চাবুকের মতো। ঠিক এই শব্দটাই মাথায় এলো তার। এত সুন্দর!
এক মুহুর্ত মাত্র। তারপরেই সাথে সাথে আবার চোখ নামিয়ে নিল।
সামনে না তাকিয়েও বুঝতে পারলো ভদ্রমহিলা এখন একদৃষ্টিতে কবিরকে দেখছেন। কবিরের শরীর একেবারে ঘেমে গেল। মুখ চোখ দিয়ে যেন হল্কা বেরুচ্ছে। ছিঃ ছিঃ! ভদ্রমহিলা কী ভাবলেন!
মেয়েটি ঘরে ঢুকে নরম ভঙ্গিতে মার পাশে গিয়ে বসলো। হাতে ধরা আছে বই খাতা। তার মধ্যে তেমন কোনো অস্বস্তি নেই। বাড়িওয়ালী স্পষ্ট সুরে বললেন,
‘এ আমার মেয়ে জুঁথি। অংক পড়বে তোমার কাছে। এই ঘরেই পড়াও। আমি উঠি।’
উঠি বলেও অবশ্য উঠলেন না তিনি। বসেই রইলেন। কবির মেয়েটির দিকে অর্ধেক তাকিয়ে অর্ধেক না তাকিয়ে বললো,
‘তোমার বইটা দেখি আগে। আমি তো অনেক আগে পাশ করেছি। বইটা আগে একবার দেখে নিই ...’
আস্তে আস্তে পরিস্থিতি কিছুটা সহজ হলো। পড়ুয়া কবির বইয়ের মধ্যে ঢুকে গিয়ে পরিস্থিতির গভীরতা তথা গাম্ভীর্য আপাতত ভুলে গেল। আর তাছাড়া মেয়েটিও বেশ সহজ। কথা বার্তায় একেবারেই জড়তা নেই। তাই পড়ানোতে মনোনিবেশ করা গেল সহজেই।
ভদ্রমহিলাও কোন ফাঁকে চলে গিয়েছেন, কবির বুঝতে পারেনি।
দিন কেটে যায়। বেশ ভালো বাসা, আশেপাশের পরিবেশটাও ভালো। কাজের একটা বুয়াও পাওয়া গেছে সুবিধামত। রান্না বান্না থেকে শুরু করে সবকিছুই সে করে দিয়ে যায়।
কবিরের পড়ানোও চলছে জোরে সোরে। আবিদ মাঝেমাঝে কানের কাছে এসে ঘ্যান ঘ্যান করে,
‘কী রে, তোর ছাত্রী কেমন? কিছুই তো বলিস না! বিষয় কী?’
বিষয় গুরুতর। আবিদকে কিছুই বলা যাবে না। শেষে আবিদের কাছেও যদি মনে হয়, ইন্টারমিডিয়েটের অংক সে নিজেও করাতে পারবে! তখন? দরকার নাই বাবা! এই ছাত্রীকে কবিরই পড়াবে।
কবির প্রশ্ন শুনে গা ছাড়া ভাবে উত্তর দেয়,
‘ছাত্রী মোটামুটি। মাথায় কিছু নাই। কষ্ট করে ঢোকাতে হয়!’
‘আর চেহারা সুরত?’
কবির সতর্ক হয়। অতি নিস্পৃহভাবে বলে,
‘বলার মতো কিছু না!’
দুটোই ডাঁহা মিথ্যে কথা! এই মেয়েকে অংকে দূর্বল বললে নিজের অংকের মাথা নিয়েই দু’বার ভাবতে হয়। মেয়ের তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার মতো অংকের মাথা! তাহলে সেই এজেন্ট ছেলেটা ‘মেয়ে অংকে দূর্বল’ এই কথা কেন বললো?
বিষয়টা নিয়ে কবির একটু ভাবনা চিন্তা করে দেখলো। রহস্যটা কী? জানতে হবে তো!
একদিন পড়ানোর ফাঁকেই জুঁথিকে জিজ্ঞেস করলো কবির,
‘আচ্ছা, তুমি কি এর আগেও কারো কাছে প্রাইভেট পড়েছো?’
জুঁথি উদাসীনভাবে উত্তর দিলো,
‘পড়েছি তো! যারাই ঐ বাসায় এসেছে সবাই পড়ানোর চেষ্টা চালিয়েছে।’
‘বলো কী! কারো পড়ানোই পছন্দ হয়নি তোমার?’
‘না, কেউ কেউ তো ভালোই পড়াতেন। কিন্তু মা’র কাউকে পছন্দ হতো না। তাই বাদ দিয়ে দিতেন। দু’মাস পড়িয়েই আবার নতুন টিচার। কেউ টিকে না।’
কবির আতঙ্কিত হলো। মুখ ফস্কে বেরিয়েও এলো,
‘এ তো ভারী চিন্তার কথা!’
‘সেটাই! দেখেন আপনি টিকতে পারেন কী না!’
কথাটা বলেই ঠোঁট কামড়ে অদ্ভূত মায়াময় ভঙ্গিতে হাসি লুকোলো জুঁথি। আবিদের বুকের মধ্যে ঝড় উঠলো। যে করেই হোক, এই টিউশনী তার চাইই চাই! এর জন্যে বাসা ছাড়তে হলেও ক্ষতি নেই।
সে দ্বিগুণ নিবিষ্টতায় পড়ানোতে মনোযোগ দিলো।
দেখতে দেখতে দু’মাস অতিক্রান্ত হলো। প্রতিটি দিন বুকের ধুকপুকুনি নিয়ে পড়াতে আসে আবিদ। মনে হতে থাকে, আজই বুঝি তার শেষ দিন। বাড়িওয়ালী তাকে নিরালায় ডেকে নিয়ে বলবেন,
‘দু’মাস তো দেখলাম। তোমরা না হয় অন্য বাসা দেখ।’
ভয় মাখা উদ্বেগে দরজার দিকে ঘনঘন তাকায় কবির। জুঁথিকে আবার একদিন জিজ্ঞেস করে,
‘আচ্ছা, আগের টিচারদের পড়ানো কেন ভালো লাগেনি আন্টির?’
‘একজন সিগারেট খেতেন বেশি। পড়ানোর মাঝখানে একবার ব্রেক নিয়ে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট খেতেন। একজন আমার বইয়ের ফাঁকে চিঠি গুঁজে দিয়েছিলেন। আর একজন...আচ্ছা থাক! আরেকজন আরো বেশি বাড়াবাড়ি করেছিলেন। মা তাকে সেইদিনই পড়ানো থেকে এবং বাসা থেকেও বিদায় করে দিয়েছিলেন।’
‘হুম...গুরুতর ব্যাপার!’
কবির মনে মনে চিন্তা করে দেখে তার ইমেজ ঠিক আছে কী না! অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সে জুঁথির দিকে ঘন ঘন চোখ তুলে তাকায় না। ইচ্ছেটাকে বহু কষ্টে সংবরণ করে। তবু বলা তো যায় না! এর মধ্যেও কিছু ভুলভাল হয়ে গেল কী না!
দু’মাস পার হয়ে তিনমাসে পা রাখলো ওরা। আবিদ উচ্ছ্বাস ভরে বলে,
‘দোস্ত, ফাঁড়া মনে হয় কাইটা গেল রে!’
‘আহ্! সত্যিই যেন তাই হয়!’ মনে মনে ভাবে কবির।
অবশেষে একদিন বাড়িওয়ালী দর্শন দিলেন। বেশ নরম সুরে বললেন,
‘ভালোই তো পড়াচ্ছো দেখি। ঠিক আছে। জুঁথির পরীক্ষা’র আর বেশি দেরিও নাই। তুমি ইচ্ছে করলে পড়াতে পারো। না পড়ালেও ক্ষতি নেই। জুঁথি তো কোচিং এ যায়। ওখানে নিয়মিত পরীক্ষা দেয়। তোমার অসুবিধা হলে আর না আসলেও চলবে।’
কবিরের পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যায়। তবে কী...তবে কী...সেও বাতিল হয়ে গেল!
ভদ্রমহিলা আবার বললেন,
‘তোমার দেশের বাড়িতে কে কে আছেন? বাবা-মা...ভাই-বোন?’
কবির কিছু বুঝতে পারে না। উনি এসব কেন জিজ্ঞেস করছেন? আসল কাজেই অখুশি হয়ে গেলেন!
কবির মুখ কালো করে বলে,
‘জি... আমার বাবা নেই। মা আছেন দেশে। এক বড় বোন আছে। বিয়ে হয়ে গেছে।’
‘তোমার মা’র ফোন নাম্বার টা দিও তো আমাকে! একটু কথা বলবো।’
জুঁথি আর কবির দু’জনেই অবাক হয়ে তাকায় ভদ্রমহিলার দিকে।
বাড়িওয়ালী খুশি খুশি মনে ঘরে ঢোকেন। আজ রাতেই স্বামীকে জানাতে হবে। খোঁজাখুঁজি শেষ হলো অবশেষে।
বেশি সুন্দরী মেয়ের মায়েদের যে এত ফ্যাঁকড়া এটা অন্যেরা কীভাবে জানবে? পাড়ার ছেলে ছোকরাদের জ্বালায় শান্তি হারাম হয়ে গিয়েছিল তার। হাজার ফন্দি এঁটে মেয়েটাকে জ্বালাতো শয়তানগুলো।
মেয়েটা পড়াশুনায় বেশ ভালো। তবু ঠিক করে ফেলেছিলেন বিয়ে দিয়ে দিবেন। জামাই বিয়ের পরে পড়ালে পড়াবে। তিনি এই অশান্তি আর নিতে পারছেন না!
বাসা ভাড়া দেওয়ার এজেন্ট ছেলেটাই বুদ্ধিটা দিয়েছিল তাকে। বড় ভালো ছেলেটা। মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করে তাকে। সে ই বলেছিল,
‘খালাম্মা শিকার বোঝেন, শিকার? শিকারী হইতে হইবো!
বলবেন, দুইমাস মাইয়ারে পড়ানো দেখবেন। আসলে দেখবেন, ছেলে কেমন? আচার আচরণ কেমন? ভালো না হইলে গেট আউট। আর ভালো হইলে... কপ কইরা শিকার কইরা ফালাইবেন।
হি হি হি...’
রীতিমত বাঁজখাই গলার স্বর ভদ্রমহিলার। কবির পুরোপুরি হকচকিয়ে গেল। কী যেন বলবে বলে শিখে পড়ে এসেছিল, কিছুই আর ঠিকঠাক মতো মনে পড়লো না। আমতা আমতা করে কোনমতে বললো,
‘ইয়ে এখানে বাসা ভাড়া পাওয়া যাবে কি?’
‘বাইরে টু-লেট লাগানো আছে, সেটা দেখনি?’
কবিরের এতক্ষণে মনে হলো, ভদ্রমহিলা শুরু থেকেই তাকে তুমি তুমি করে বলছেন।
আরে আজব তো! সে একজন সাতাশ বছরের যুবক। চেহারাতেও কোন খোকা খোকা ভাব নেই। এই ভদ্রমহিলা তাকে তুমি করে বলছেন কোন বিবেচনায়?
অবশ্য খটকা কিংবা খারাপ লাগলেও প্রতিবাদ করার উপায় নেই। কারণ এই মুহুর্তে কবিরের বাঁচা মরা না হলেও এই শহরে একটু ভদ্রভাবে টিকে থাকা অনেকখানিই নির্ভর করছে এই ভদ্রমহিলার সুমতির ওপর।
ভদ্রস্থ চাকরি করে বারোয়ারী মেসে বাস করা যায় না। হরেকরকম রুচির ছেলেপুলে থাকে সেখানে।
কেউ লুঙ্গি পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তো কেউ হাফপ্যাণ্ট। পরনের জামা কাপড় মাসে দু’মাসে একবার সাবান দিয়ে কাচে কী না সন্দেহ! গা দিয়ে ভুর ভুর করে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে ঘুরে বেড়ায় একেকজন। সেই তারাই আবার বিকেলে বান্ধবীর সাথে দেখা করতে যাওয়ার আগে সেণ্টের পুরো বোতলটাই পারলে শরীরে ঢেলে দেয়।
খাওয়ার টেবিলে বসেও শান্তি নেই। কেউ খেতে বসে হাপুসহুপুস শব্দ করে অথবা চুকচুক শব্দ করে পিরিচে ঢেলে চা খায়। এমন জায়গায় বাইরে থেকে বন্ধু-বান্ধব অথবা আত্মীয় পরিজন কেউ দেখা করতে এলে লজ্জায় একদম মাথা কাটা যায়।
এই তো সেদিন, কবিরের এক মামা চিটাগাং থেকে কী কাজে যেন ঢাকায় এসেছেন। ফেরার আগে তিনি কবিরের সাথে দেখা করতে সোজা একেবারে ওর মেসে গিয়ে হাজির হলেন। ওকে না জানিয়েই।
ছুটির দিন। কবির বেলা করে ঘুম থেকে উঠে ক্যাণ্টিনে গেছে নাস্তা করতে। কবিরের রুমমেট নাফিজ তখন আশেপাশের রুমের কয়েকজনকে জড়ো করে তিনপাত্তি খেলতে শুরু করেছে। মোবাইলে বাজছে চড়া হিন্দি গান।
কবিরের মামাকে ঢুকতে দেখেও তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। নিজেদের খেলায় বেমালুম মজে আছে।
শেষমেষ কবিরের সাথে দেখা হওয়ার পরে মামা প্রথম যে কথাটি ওকে বললেন তা হলো,
‘ভালো চাকরি পেয়েছিস শুনলাম। তাই দেখা করতে এসেছিলাম। কিন্তু যে জায়গায় আছিস! এখানে থাকলে তো স্ট্যাটাসই ভুলে যাবি!’
কথাটা ভুল নয়। কবির নিজেও যে এই বিষয়টা নিয়ে কখনো ভাবেনি তা নয়। ঢাকা ভার্সিটির আইবিএ থেকে বিবিএ এমবিএ করেছে সে। বেশ কেতাদুরস্ত একখানা চাকরিও বাগিয়েছে। অফিসে ঢংঢাং য়ের শেষ নেই। ওকে আবার বেশির ভাগ সময় বিদেশী ডেলিগেটদের সাথে কাজ করতে হয়। কবিরের ইংরেজি বেশ ভালো। তাই তাকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।
মেসে ফিরে এই পরিবেশের ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণের মধ্যেই কবির আবার অন্যজগতে চলে যায়। পরেরদিন অফিসে গিয়ে সেই জগত থেকে আবার ফিরে আসতে বেশ খানিকটা সময় দিতে হয়। ফিরে এলে আবার যে কে সেই... এই টানাহ্যাঁচড়াই চলছে কয়েকমাস ধরে।
ওর আরেক বন্ধু আবিদেরও একই দশা। কবিরের সাথে একই মেসে থাকে। ওর ছোটবেলার বন্ধু।
সেও কবিরের মতো জাতে উঠতে চায়। কবিরের মতো এত হাইফাই না হলেও আবিদও মোটামুটি একটা চাকরি জোটাতে পেরেছে। তাই দুই বন্ধু মিলে শলা পরামর্শ করে ভালো একটা বাসা খোঁজার কাজে মন দিয়েছে।
কিন্তু হায়! ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া পাওয়া আর বাঘের দুধের সন্ধান পাওয়া একইরকম অসম্ভব ব্যাপার।
নানা জায়গা থেকে খবরাখবর জোগাড় করে গত প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে বাসা খুঁজছে ওরা দু’বন্ধু। প্রায় আটটা নয়টার মতো বাসা ইতিমধ্যে দেখাও হয়ে গিয়েছে। ভাড়া পাওয়ার এখনো কোন নামগন্ধ নেই। ব্যাচেলর শুনলেই সবাই এমনভাবে তাকায় যেন ওরা কোন ক্রিমিনাল। মস্ত কোন ক্রাইম করে এখন আশ্রয় খুঁজতে এসেছে।
দেখেশুনে দু’বন্ধু যখন ভালো একটা বাসার আশা প্রায় একরকম ছেড়েই দিয়েছে, তখনই ওরা এক এজেন্টের সন্ধান পায়।
ভারী অদ্ভূত এজেণ্ট। ব্যাচেলরদের শতকরা শত ভাগ গ্যারান্টিতে বাসা ভাড়া পাইয়ে দেয়। সেজন্য অগ্রীম কিছু টাকা অবশ্য দিতে হয়। বিফলে পুরো মূল্য ফেরত।
সন্ধান পাওয়া মাত্রই কবির আর আবিদ গিয়ে হানা দেয় সেখানে।
প্রায় ওদেরই বয়সী এক ছোকরা। দেখেই বোঝা যায়, মহা চালু। যাকে বলে একেবারে ঝুনা নারিকেল। কোনোরকম ভূমিকা টূমিকা’র ধার না ধেড়ে সোজা ভাষায় বললো,
‘শিকার বোঝেন? শিকার? বাসা ভাড়া পাইতে হইলে শিকারী হইতে হইবো।’
‘শিকার!’ কী অদ্ভূত শর্ত রে বাবা! দু’বন্ধু মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে।
ছেলেটা একপাশে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
‘বুঝলেন না তো! না বোঝারই কথা। এই যেমন ধরেন, আপনারা এতদিন ধইরা ভাড়া পাওয়ার আশায় বাসা খুঁজতাছেন। অথচ কোনো বাসা পাইতাছেন না। কেউ আপনাদের বিশ্বাসই করে না! কেমন না কেমন ছেলে আপনারা, কে জানে! এই বিশ্বাসটাই আসলে অর্জন করতে হইবো, বুঝছেন?’
কবির একটু স্মার্ট হবার চেষ্টা করে। সামনে ঝুঁকে সোজা ছেলেটির চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘প্লিজ থামবেন না। খোলাসা করুন আগে। কীসের বিশ্বাস, কার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে?’
‘বাড়িওয়ালার! আবার কার!
আরে, এইটারে বেইজ কইরাই তো এজেন্টগিরি করতাছি। দলে বলে ব্যাচেলর ছেলেপেলে আসে, কেউ বাসা ভাড়া পায় না। আমরা এই এলাকার সব বাড়িওয়ালার দূর্বল দিক গুলান নিয়া... যারে বলে একেবারে রিসার্চ কইরা ফালাইছি। কার কী দরকার, কার বাসায় কাজের লোক নাই, কার ছেলেরে স্কুলে নিয়া যাইতে হইবো, কার মাইয়ারে পড়াইতে হইবো, কারে একটু বাজার টাজার কইরা দিলে খুশী হইবো...এইসব আর কী!’
কবির একেবারে যেন আকাশ থেকে পড়ে। পাশে তাকিয়ে দেখে আবিদেরও একই হাল। হাঁ করা মুখ বন্ধ করে শেষমেষ প্রশ্ন করে,
‘আপনি বলতে চাইছেন, আমরা এইসব ফাইফরমাশের কাজ করে দিয়ে বাসা ভাড়া নিব? টাকা দিয়ে থাকবো আবার এসবও করে দিতে হবে?’
‘জি, ভাইজান। এই তো বুইঝা ফালাইছেন।’ পান খাওয়া লাল-কালো দাঁতের সারি বের করে উত্তর দিলো ছেলেটি।
‘মাথা ঠিক আছে আপনার? আমরা কি ফেলনা লোকজন নাকি? কোনো আত্মসম্মান নেই আমাদের?’
‘জি, ভাইজান আছে! কিন্তু হেই আত্মসম্মান ধুইয়া তো বাসা খুঁইজা পাইবেন না। এই অঞ্চলে খুব ভালো একটা তিন রুমের বাসা খালি আছে। এক্কেবারে আপনাগো লাইগা পারফেক্ট। খুব সোজা একটা কাম করতে হইবো। বাড়িওয়ালার মাইয়া অংকে খারাপ। আপনাগো কাউরে একটু পড়াইতে হইবো। ব্যস, তাইলেই কাম হইয়া যাইবো। দশ হাজার টাকা আগাম দিবেন আমারে। কাম না হইলে টাকা ফেরত।’
কবির অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছে। ওর মুখে আর কথা যোগায় না। বাকী কথা আবিদই শেষ করে,
‘কাজ না হলে মানে? আমাদের কি আগে টিউশনী করে উনার বিশ্বাস অর্জন করতে হবে? তারপরে বাসা ভাড়া দিবেন?’
‘তার চাইতে আরেকটু ভালো ব্যবস্থা। বাসায় উঠবার পারবেন, পড়ানোর কথা আগে বইলা নিবেন। দুইমাসের শর্তে বাসা পাইবেন। আপনাদের পড়ানো পছন্দ হইলে যদ্দিন খুশি থাকতে পারবেন। আর তা না হইলে দুইমাস পরে নতুন বাসা খুঁজতে হইবো।’
‘কী বলেন এইসব? এগুলো কি মগের মুল্লুক নাকি?’
‘আরে ভাই, সব কিছুর মইধ্যেই চাইলে ফাঁকি মারা যায় বুঝেন না!
দুইমাস পরে চাইলে আর পড়াইবেন না। কারণ দুইমাস টিকতে পারলেই আপনারা পার্মানেণ্ট হয়্যা যাবেন। তখন আপনাদের সরাইতে হইলে অন্ততঃ ছয়মাস আগে নোটিস দিতে হইবো। তারমানে অন্তত আটমাসের বন্দোবস্ত পাক্কা। সব খবর নিয়াই বুদ্ধি দিতাছি চিন্তা ভাবনা কইরা দেখেন!’
কবির আর আবিদ একেবারে থ বনে গেল। এ কী আজব নিয়মকানুনের মধ্যে এসে পড়লো তারা? এমন কথা কে কোথায় শুনেছে?
কবির মাথা নেড়ে অসম্মতির সুরে বললো,
‘দূর! এসব কোনো কথা হলো? এই বয়সে টিউশনী করতে হবে? আর তাও বাসা ভাড়া নেওয়ার জন্য!’
‘রাজি না হইলে নাই! বাসা খুঁইজা বেড়ান ফ্যাঁ ফ্যাঁ কইরা! কে মানা করছে? না পোষাইলে কাইটা পড়েন ভাইসাব। আমার অন্য কাস্টমার আইবো।’
ওরা কাটলো না। কাটার কোনো উপায় নাই। এই দুই সপ্তাহেই ওরা বুঝে গেছে ব্যাচেলরদের বাসা ভাড়া পাওয়া কী দুঃসাধ্য ব্যাপার!
আবিদ কম্প্রোমাইজিং সুরে বললো,
‘ভাই, বাড়িওয়ালাকে খুশি করার জন্য টিউশনীই কি করতে হবে? ইয়ে...মানে আর কিছু করা যাবে না?’
এজেণ্ট ছেলেটা বললো,
‘আরে ভাই, বুঝেন না কেন? আপনারা শিক্ষিত ছেলেপেলে। টিউশনী তো সম্মানের কাজ। কোনো বাড়ির বাজার কইরা দিতে বললে ভালো হইতো? আর তাছাড়া একেক বাড়িওয়ালার একেক রিকুরমেণ্ট। আপনাদের যে বাসার সন্ধান দিতাছি তাদের রিকুরমেণ্ট এইটাই। মাইয়ারে পড়াইবেন। তারা খুশি...আপনারাও খুশি! এখন বলেন, রাজি আছেন কী না!’
আর গাঁইগুঁই করার সুযোগ নেই। কবির তবুও ঘাড় গোঁজ করে আছে দেখে আবিদই লীড নিয়ে বললো,
‘জি ভাই, আমরা রাজি। আপনি সেই বাসার ঠিকানা দেন।’
‘জি, দিতাছি। কী কী বলতে হইবো সবকিছু শিখাইয়া পড়াইয়া দিতে হইবো। শুনেন, বাড়িওয়ালার চাইতে বাড়িওয়ালীরেই বেশি পামপট্টি দিবেন, বুঝলেন? আর...’
একগাদা উপদেশ মাথায় নিয়ে কবির আজ বাসা দেখতে এসেছে। এসেই বাড়িওয়ালীর খসখসে আওয়াজ শুনে অর্ধেক কথা তার পেটের মধ্যেই রয়ে গেল।
‘কী ব্যাপার! কথা বলো না কেন? বাসা ভাড়া নিবা? পরিবার কোথায়? ছেলেমেয়ে আছে নাকি নতুন বিয়ে?’
‘জি, ইয়ে মানে...ব্যাচেলর। আমি আর আমার আরেক বন্ধু থাকবো...না না...প্লিজ দরজা বন্ধ করবেন না! আমার কথা শোনেন। আমি জানতে পেরেছি আপনি আপনার মেয়ের জন্য প্রাইভেট টিউটর খুঁজছেন। আমি তাকে পড়াতে রাজি আছি।’
ব্যাচেলর শুনেই বাড়িওয়ালী কোনো কথাতেই আর যেতে চাচ্ছিলেন না। একেবারে মুখের ওপরেই দরজা বন্ধ করতে যাচ্ছিলেন। কবিরের পরের কথাগুলো শুনে আপাদমস্তক জরিপ করে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কীসে পড়াশুনা করেছো? এখন কী কর? ইন্টারমিডিয়েট এর অংক করতে পারবে?’
কবির বিনয়ে মাখনের মতো গলে গিয়ে বললো,
‘জি, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে এমবিএ করেছি। আইবিএ থেকে। পড়াশুনায় ভালোই ছিলাম। পারবো ইনশাল্লাহ। আপনি কয়েকদিন দেখেন। তাহলেই বুঝতে পারবেন।’
‘হুম, সে তো বুঝতে পারবোই। তা কয়জন থাকবা? দুইজন? হুম...আচ্ছা বাসা দেখে যাও। আমার বাসার শর্ত জানো তো? দুইমাস আমি টেম্পোরারি বেসিজে রাখি। পছন্দ না হলে দুইমাস পরে অন্য বাসা খুঁজে নিতে হবে। রাজি তো?’
কবির গলায় আরো মধু ঢেলে বলে,
‘জি জি অবশ্যই রাজি। রাজি না হওয়ার তো কোনোই কারণ নেই। এটা তো সুন্দর ব্যবস্থা। ভাড়াটিয়া ভালো না হলে কি রাখা যায়?...’
কবির এতক্ষণে আত্মবিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। শিখিয়ে দেওয়া সব বাক্যই বেশ গড়্গড়িয়ে আওড়ে গেল সে। সাথে নিজের কিছু আপ্ত বাক্যও যোগ করে দিলো। বাড়িওয়ালী আর বেশি কথা বাড়ালেন না। শুধু ছোট করে বললেন,
‘বাসা দেখে যাও। পছন্দ হলে কাল পরশু চলে এসো। আর শোনো, আমি কিন্তু রাত বিরেতে হৈ চৈ পছন্দ করি না। আমার বাসার কিছু নিয়ম কানুন আছে...
মেসে ফিরে কবির সটান বিছানায় পড়ে রইলো কিছুক্ষণ। আবিদ বাইরে থেকে ফিরতেই খুব একচোট ঝাল ঝাড়লো তার ওপরে।
‘আমাকে একা পাঠায়ে দিয়ে বসে বসে মজা নিলি তাই না? টিউশনীও আমাকেই করতে হবে, আবার বাড়িওয়ালীর সাথে কথাও আমাকেই বলতে হবে? বাপ রে, বাপ! কী ভয়াবহ জিনিস রে বাবা! একদিনেই আমার দফারফা হয়ে গেছে!’
দু’বন্ধুর মধ্যে অনেক হিসেব নিকেশের পরে এই সিদ্ধান্ত হয়েছে যে, বাড়িওয়ালীর মেয়েকে কবিরই পড়াবে। কবির অনেক চেষ্টা করেছিল আবিদকে ভার দেওয়ার। কিন্তু আবিদের এক কথা,
‘বন্ধু, তুই বিবিএ পড়েছিস। আর আমি পড়েছি জিওলোজী। অংক টংক সব ভুলে গেছি। ওসব দায়িত্ব তোর। আর তুই কী স্মার্ট! আমি পড়াইতে গেলে দুইমাসের আগেই নাকচ হয়ে যাবো। শেষে আমও যাবে, ছালাও যাবে।’
অগত্যা কবিরকেই ভার নিতে হয়েছে। ঝুঁকি নেওয়ার অভ্যাস তার ভালোই আছে। দেখাই যাক না, কী হয়!’
দুদিনের মধ্যেই কবির আর আবিদ নতুন বাসায় উঠে গেল।
এজেন্ট ছেলেটা ভুল বলেনি। বাসাটা ওদের জন্য একেবারে পারফেক্ট। দুটো বেডরুম আর একটা ডাইনিং কাম ড্রইং। ভাড়াও খুব বেশি নয়।
বাড়িওয়ালীর মেয়েকে সপ্তাহে দু’দিন পড়াতে হবে। দুই ছুটির দিনে কোনো এক ফাঁকে এসে পড়িয়ে গেলেই হবে। পড়ানো কতদিন চালাতে হবে, সেটা নিয়ে এখনো চিন্তাভাবনা শুরু করেনি কবির। ছাত্রীর কোয়ালিটি বুঝে চিন্তাভাবনা করতে হবে। বেশি গোমূর্খ না হলে এমন একটা বাসার জন্য করলোই না হয় কিছুদিন টিউশনী!
কিন্তু তার আগে দুইমাসের প্রভিশনাল পিরিয়ডটা তো ঠিকঠাক পার করতে হবে!
যেদিন থেকে পড়ানো শুরু করার কথা, কবির সেদিন সময়ের পনেরো মিনিট আগেই বাড়িওয়ালার বাসায় গিয়ে হাজির হলো। এবারে আর বাড়িওয়ালী নয়, দরজা খুলে দিল কাজের মেয়ে। কবিরকে দেখেই দাঁত বের করে বললো,
‘আপনে আফার নতুন মাস্টার? সুফায় বসেন। আফারে ডাক দেই।’
কবির ড্রইংরুমে বসে বসে ঘামতে লাগলো। ইন্টারমিডিয়েটের পরে ভর্তি পরীক্ষার পালা চুকিয়ে দিয়ে কিছুদিন টিউশনী করেছিল। সে কোন আমলের কথা! আজ এতদিন পরে কী পড়াবে কে জানে! ইন্টারমিডিয়েটের বইও নিশ্চয়ই এতদিনে সব পালটে গেছে। অথচ ঠিকমত পড়ানোর ওপরেই সবকিছু নির্ভর করছে।
দুঃশ্চিন্তা বাদ দিয়ে ঘরের শোভা দেখায় মন দিলো সে।
বাড়িওয়ালীর যে খিটমিটে মেজাজ সেদিন দেখেছে, তার তুলনায় অবশ্য ঘরের মেজাজ বেশ শান্ত ও সুশীল। দেওয়ালে চমৎকার হাতের কাজের ওয়ালমেট। বাহারী শোকেসে রুচিশীল শোপিস। বড় মাটির ফুলদানিতে বাঁশের লম্বা স্টিক বেশ কায়দা করে সাজানো। পায়ের নীচে ঘাসের মতো রঙ আর ঘনত্বের পুরু কার্পেট। জানালাতেও একই রঙের মনোমুগ্ধকর পর্দা। যথেষ্ট রুচিশীল, সুশোভোন সবকিছু।
এমন বাসার কত্রী কাউকে প্রথম দেখাতে তুমি সম্বোধনে কথা বলেন, সেটা মানতে কষ্ট হচ্ছে।
ড্রইংরুমের সাজগোজের দিকে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়াতে কবির একটু আনমোনা হয়ে পড়েছিল। জলজ্যান্ত বাড়িওয়ালীর উপস্থিতিও তাই টের পায়নি। হঠাৎ গলা খাঁকারিতে চমকে সামনে তাকিয়ে দেখে সাক্ষাৎ যমদূত বসে আছেন মুখোমুখি সোফায়।
চোখের দৃষ্টি কবিরের ওপরে সোজাসুজি নিবদ্ধ। কবিরের হঠাৎ কেমন যেন অস্বস্তি শুরু হতে লাগলো। এত জরিপ করার কী আছে রে বাবা!
‘শোন, আমার মেয়েকে কিন্তু একেবারে পুরো দু’ঘণ্টা পড়াতে হবে। একটুও কম হলে চলবে না। আর আমি মাসে তোমাকে পাঁচ হাজার করে দিব, ঠিক আছে? চাইলে ভাড়া পাঁচহাজার কমও দিতে পারো, যেটা তোমাদের খুশি। মনে কর না যে, বাড়িওয়ালী কিপ্টে। মানুষ খারাপ। চারপাশে নানাজাতের লোক দেখি কী না! তাই একটু খ্যাঁচখ্যাঁচ করতে হয় মাঝে মাঝে।’
বাড়িওয়ালীর কথা এবারে বেশ ভালো লাগলো কবিরের। এখন আর ভদ্রমহিলাকে তেমন দজ্জাল প্রকৃতির মনে হচ্ছে না। শুধু তুমি সম্বোধনটা মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।
ভদ্রমহিলা যেন কবিরের মনের কথা আঁচ করে নিলেন। প্রায় সাথে সাথেই বললেন,
‘শোন, বয়স হয়েছে তো! হুট করে অল্প বয়সীদের তুমি বলে ফেলি। কিছু মনে করো না যেন।’
‘না না... ঠিক আছে...’ কবির শশব্যস্তে বলে ওঠে। এরপরে আর কথা চলে না।
অল্প সময় পরেই দরজার পর্দা ঠেলে ঘরে একটি মেয়ে প্রবেশ করলো। কবির মুখ তুলে মেয়েটিকে দেখেই চোখ নামিয়ে নিল। তারপরে বিদ্যুতস্পৃষ্টের মতো আবার তাকালো।
কবিরের মনে হলো, মেয়েটার মুখশ্রী ঠিক যেন চাবুকের মতো। ঠিক এই শব্দটাই মাথায় এলো তার। এত সুন্দর!
এক মুহুর্ত মাত্র। তারপরেই সাথে সাথে আবার চোখ নামিয়ে নিল।
সামনে না তাকিয়েও বুঝতে পারলো ভদ্রমহিলা এখন একদৃষ্টিতে কবিরকে দেখছেন। কবিরের শরীর একেবারে ঘেমে গেল। মুখ চোখ দিয়ে যেন হল্কা বেরুচ্ছে। ছিঃ ছিঃ! ভদ্রমহিলা কী ভাবলেন!
মেয়েটি ঘরে ঢুকে নরম ভঙ্গিতে মার পাশে গিয়ে বসলো। হাতে ধরা আছে বই খাতা। তার মধ্যে তেমন কোনো অস্বস্তি নেই। বাড়িওয়ালী স্পষ্ট সুরে বললেন,
‘এ আমার মেয়ে জুঁথি। অংক পড়বে তোমার কাছে। এই ঘরেই পড়াও। আমি উঠি।’
উঠি বলেও অবশ্য উঠলেন না তিনি। বসেই রইলেন। কবির মেয়েটির দিকে অর্ধেক তাকিয়ে অর্ধেক না তাকিয়ে বললো,
‘তোমার বইটা দেখি আগে। আমি তো অনেক আগে পাশ করেছি। বইটা আগে একবার দেখে নিই ...’
আস্তে আস্তে পরিস্থিতি কিছুটা সহজ হলো। পড়ুয়া কবির বইয়ের মধ্যে ঢুকে গিয়ে পরিস্থিতির গভীরতা তথা গাম্ভীর্য আপাতত ভুলে গেল। আর তাছাড়া মেয়েটিও বেশ সহজ। কথা বার্তায় একেবারেই জড়তা নেই। তাই পড়ানোতে মনোনিবেশ করা গেল সহজেই।
ভদ্রমহিলাও কোন ফাঁকে চলে গিয়েছেন, কবির বুঝতে পারেনি।
দিন কেটে যায়। বেশ ভালো বাসা, আশেপাশের পরিবেশটাও ভালো। কাজের একটা বুয়াও পাওয়া গেছে সুবিধামত। রান্না বান্না থেকে শুরু করে সবকিছুই সে করে দিয়ে যায়।
কবিরের পড়ানোও চলছে জোরে সোরে। আবিদ মাঝেমাঝে কানের কাছে এসে ঘ্যান ঘ্যান করে,
‘কী রে, তোর ছাত্রী কেমন? কিছুই তো বলিস না! বিষয় কী?’
বিষয় গুরুতর। আবিদকে কিছুই বলা যাবে না। শেষে আবিদের কাছেও যদি মনে হয়, ইন্টারমিডিয়েটের অংক সে নিজেও করাতে পারবে! তখন? দরকার নাই বাবা! এই ছাত্রীকে কবিরই পড়াবে।
কবির প্রশ্ন শুনে গা ছাড়া ভাবে উত্তর দেয়,
‘ছাত্রী মোটামুটি। মাথায় কিছু নাই। কষ্ট করে ঢোকাতে হয়!’
‘আর চেহারা সুরত?’
কবির সতর্ক হয়। অতি নিস্পৃহভাবে বলে,
‘বলার মতো কিছু না!’
দুটোই ডাঁহা মিথ্যে কথা! এই মেয়েকে অংকে দূর্বল বললে নিজের অংকের মাথা নিয়েই দু’বার ভাবতে হয়। মেয়ের তো ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার মতো অংকের মাথা! তাহলে সেই এজেন্ট ছেলেটা ‘মেয়ে অংকে দূর্বল’ এই কথা কেন বললো?
বিষয়টা নিয়ে কবির একটু ভাবনা চিন্তা করে দেখলো। রহস্যটা কী? জানতে হবে তো!
একদিন পড়ানোর ফাঁকেই জুঁথিকে জিজ্ঞেস করলো কবির,
‘আচ্ছা, তুমি কি এর আগেও কারো কাছে প্রাইভেট পড়েছো?’
জুঁথি উদাসীনভাবে উত্তর দিলো,
‘পড়েছি তো! যারাই ঐ বাসায় এসেছে সবাই পড়ানোর চেষ্টা চালিয়েছে।’
‘বলো কী! কারো পড়ানোই পছন্দ হয়নি তোমার?’
‘না, কেউ কেউ তো ভালোই পড়াতেন। কিন্তু মা’র কাউকে পছন্দ হতো না। তাই বাদ দিয়ে দিতেন। দু’মাস পড়িয়েই আবার নতুন টিচার। কেউ টিকে না।’
কবির আতঙ্কিত হলো। মুখ ফস্কে বেরিয়েও এলো,
‘এ তো ভারী চিন্তার কথা!’
‘সেটাই! দেখেন আপনি টিকতে পারেন কী না!’
কথাটা বলেই ঠোঁট কামড়ে অদ্ভূত মায়াময় ভঙ্গিতে হাসি লুকোলো জুঁথি। আবিদের বুকের মধ্যে ঝড় উঠলো। যে করেই হোক, এই টিউশনী তার চাইই চাই! এর জন্যে বাসা ছাড়তে হলেও ক্ষতি নেই।
সে দ্বিগুণ নিবিষ্টতায় পড়ানোতে মনোযোগ দিলো।
দেখতে দেখতে দু’মাস অতিক্রান্ত হলো। প্রতিটি দিন বুকের ধুকপুকুনি নিয়ে পড়াতে আসে আবিদ। মনে হতে থাকে, আজই বুঝি তার শেষ দিন। বাড়িওয়ালী তাকে নিরালায় ডেকে নিয়ে বলবেন,
‘দু’মাস তো দেখলাম। তোমরা না হয় অন্য বাসা দেখ।’
ভয় মাখা উদ্বেগে দরজার দিকে ঘনঘন তাকায় কবির। জুঁথিকে আবার একদিন জিজ্ঞেস করে,
‘আচ্ছা, আগের টিচারদের পড়ানো কেন ভালো লাগেনি আন্টির?’
‘একজন সিগারেট খেতেন বেশি। পড়ানোর মাঝখানে একবার ব্রেক নিয়ে বারান্দায় গিয়ে সিগারেট খেতেন। একজন আমার বইয়ের ফাঁকে চিঠি গুঁজে দিয়েছিলেন। আর একজন...আচ্ছা থাক! আরেকজন আরো বেশি বাড়াবাড়ি করেছিলেন। মা তাকে সেইদিনই পড়ানো থেকে এবং বাসা থেকেও বিদায় করে দিয়েছিলেন।’
‘হুম...গুরুতর ব্যাপার!’
কবির মনে মনে চিন্তা করে দেখে তার ইমেজ ঠিক আছে কী না! অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সে জুঁথির দিকে ঘন ঘন চোখ তুলে তাকায় না। ইচ্ছেটাকে বহু কষ্টে সংবরণ করে। তবু বলা তো যায় না! এর মধ্যেও কিছু ভুলভাল হয়ে গেল কী না!
দু’মাস পার হয়ে তিনমাসে পা রাখলো ওরা। আবিদ উচ্ছ্বাস ভরে বলে,
‘দোস্ত, ফাঁড়া মনে হয় কাইটা গেল রে!’
‘আহ্! সত্যিই যেন তাই হয়!’ মনে মনে ভাবে কবির।
অবশেষে একদিন বাড়িওয়ালী দর্শন দিলেন। বেশ নরম সুরে বললেন,
‘ভালোই তো পড়াচ্ছো দেখি। ঠিক আছে। জুঁথির পরীক্ষা’র আর বেশি দেরিও নাই। তুমি ইচ্ছে করলে পড়াতে পারো। না পড়ালেও ক্ষতি নেই। জুঁথি তো কোচিং এ যায়। ওখানে নিয়মিত পরীক্ষা দেয়। তোমার অসুবিধা হলে আর না আসলেও চলবে।’
কবিরের পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যায়। তবে কী...তবে কী...সেও বাতিল হয়ে গেল!
ভদ্রমহিলা আবার বললেন,
‘তোমার দেশের বাড়িতে কে কে আছেন? বাবা-মা...ভাই-বোন?’
কবির কিছু বুঝতে পারে না। উনি এসব কেন জিজ্ঞেস করছেন? আসল কাজেই অখুশি হয়ে গেলেন!
কবির মুখ কালো করে বলে,
‘জি... আমার বাবা নেই। মা আছেন দেশে। এক বড় বোন আছে। বিয়ে হয়ে গেছে।’
‘তোমার মা’র ফোন নাম্বার টা দিও তো আমাকে! একটু কথা বলবো।’
জুঁথি আর কবির দু’জনেই অবাক হয়ে তাকায় ভদ্রমহিলার দিকে।
বাড়িওয়ালী খুশি খুশি মনে ঘরে ঢোকেন। আজ রাতেই স্বামীকে জানাতে হবে। খোঁজাখুঁজি শেষ হলো অবশেষে।
বেশি সুন্দরী মেয়ের মায়েদের যে এত ফ্যাঁকড়া এটা অন্যেরা কীভাবে জানবে? পাড়ার ছেলে ছোকরাদের জ্বালায় শান্তি হারাম হয়ে গিয়েছিল তার। হাজার ফন্দি এঁটে মেয়েটাকে জ্বালাতো শয়তানগুলো।
মেয়েটা পড়াশুনায় বেশ ভালো। তবু ঠিক করে ফেলেছিলেন বিয়ে দিয়ে দিবেন। জামাই বিয়ের পরে পড়ালে পড়াবে। তিনি এই অশান্তি আর নিতে পারছেন না!
বাসা ভাড়া দেওয়ার এজেন্ট ছেলেটাই বুদ্ধিটা দিয়েছিল তাকে। বড় ভালো ছেলেটা। মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করে তাকে। সে ই বলেছিল,
‘খালাম্মা শিকার বোঝেন, শিকার? শিকারী হইতে হইবো!
বলবেন, দুইমাস মাইয়ারে পড়ানো দেখবেন। আসলে দেখবেন, ছেলে কেমন? আচার আচরণ কেমন? ভালো না হইলে গেট আউট। আর ভালো হইলে... কপ কইরা শিকার কইরা ফালাইবেন।
হি হি হি...’
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আসাদুজ্জামান খান ১৭/০৫/২০১৮
-
তাহমিদ জামান ১৪/০৫/২০১৮আমি কারো শিকার হতে পারলাম না।
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ১৪/০৫/২০১৮শিকার! ভালো লাগল।
অনেক শুভকামনা। -
মোঃ ইমরান হোসেন (ইমু) ১৩/০৫/২০১৮long narrative
really nice
thanking................. -
পবিত্র চক্রবর্তী ১৩/০৫/২০১৮ভালো লাগলো ॥
-
কামরুজ্জামান সাদ ১৩/০৫/২০১৮এজেন্টের বুদ্ধির তারিফ করতে হয়।আসলে সবাইকে শিকারী হতে হবে।কপ করে শিকার ধরতে হবে।ভাল লেগেছে গল্পটা।
গল্প্টা বেশ। আমার ভুল না হয়ে থাকলে আপনি 'গ-ক' এর নিয়মিত লেখিকা।