কদর
সাতসকালে বাজারের দিকে যাওয়ার আগ মুহুর্তেই ঘটে বিপত্তিটা। সুরুজ মিঞা তার ছাতাটা খুঁজে পাচ্ছে না। খিঁচড়ে গেল মেজাজটা। কাজের সময় কোথায় আরো জিনিসপত্র আগায়ে দিবে তা না, গিয়ে বসে পড়েছে চুলার পাশে। সারাদিনে ঐ এক কাজ। মেয়ে দুটিও হয়েছে সেইরকম। সুরুজ মিঞার আশেপাশে ভিড়ে না। সারাদিন মায়ের চারপাশে ঘুরঘুর করছে, বাবা ডাকলে মুখ চুপসে সামনে এসে দাঁড়াবে। দেখে মনে হবে যেন চুরি করে ধরা পড়েছে, সামনে পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে। এত ভয় পায় কেন কে জানে! তাড়াতাড়ী বিয়ে শাদি দিয়ে জায়গামত বিদেয় করতে পারলে নিশ্চিন্তি হওয়া যায়। মেয়ে পালতে গিয়ে অকাজেই অনেক টাকা পয়সা খরচ হয়ে গেছে। এত পরিশ্রমের টাকা! এভাবে অজায়গায় নষ্ট হয়ে গেলে চলবে? কথাগুলো ভাবতে ভাবতে খিঁচড়ানো মেজাজটা আরো তেতে ওঠে।
ভাদ্রের সকাল। একটু পরেই গা ঝলসানো রোদ উঠবে। উঠানের এক পাশের গোয়াল ঘরে আট-নয় টা গরু পরম নিশ্চিন্ত মনে খড় চিবুচ্ছে। ছোট মেয়েটা পাশে বসে একটা বড় মাটির ভাড়ে ভাতের ফেনের সাথে গমের ভুষি মেশাচ্ছে, সর্ব সাকুল্যে প্রায় পনেরো-বিশ টা গরুর মালিক সুরুজ মিঞা। গ্রামের বেশ অবস্থাপন্ন গৃহস্থ সে। সামান্য অবস্থা থেকে আজ তার এই উত্থান। বাপের সম্পত্তি বলতে ছিল এই ভিটা আর এক জোড়া গরু। সেই এক জোড়া গরু থেকেই মাত্র কয়েক বছরেই ফুলে ফেঁপে উঠেছে সুরুজ মিঞা। দুধ বেচে হিসেব করে করে সংসার চালিয়েছে আর জমানো টাকা দিয়ে গরুর সংখ্যা বাড়িয়েছে। নিজের জন্য একটা টাকাও খরচ করেনি। পৈতৃক ভিটাটা মেরামত করিয়েছে। অতীতের কথা মনে করে গর্বে বুক ভরে ওঠে তার। নিজের বউ আর মেয়ে গুলোকে প্রায়ই তার এই উথানের কথা শুনতে হয়। আজও তার ব্যাতিক্রম হল না। জোরে জোরে কিছুক্ষণ মুণ্ডুপাত করলো সবার। "সারাদিন খাইটে মরি। ছাতাটাও দেইখে রাখতে পারো না। ঘরে বইসে করো কী সারাদিন? কথায় কথায় চুলার পাড় দেখাও। মাইয়া দুইখান কোন কাজের হইলো না। আমার কপাল মন্দ। একটা পোলা হইলে আগলাইয়া রাখতো। কুনখান দিয়া সব কিছু হইলো বুঝবার পারতাছো না তো! বুঝবা কেমনে? মুখখু মাইয়া মানুষ।"
চুলার পাশে বসে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাফিজা বেগম। মনে মনে বলে,"হ, হেই তো খালি বুঝবার পারবো!" আজ এত গুলো বছর ধরে সে আর পরে তার এই মেয়ে দুইটা যে হাড় ভাংগা খাটুনি খেটে যাচ্ছে তা এই লোকরে বলে কী হবে! মেয়ে দুইটারে স্কুলে পর্যন্ত দেয় নাই। বলে, 'মাইয়াগো পড়ায়া লাভ নাই। পরের বাড়ী পাঠাইয়া দিতে পারলেই তো চুইক্যা গেল।' সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বেগার খাটুনি খাটে মেয়ে দুইটা। গরুর খাবার দেওয়া, গোসল করানো, মাঠে নিয়ে যাওয়া। তার পরেও আছে বাড়ির কাজ। আহারে, তার মেয়ে দুইটারে নিজে থেকে শখ করে একটা কাপড় ও কিনে দেয় নাই কোনদিন। বিয়ের পরে কই যাবে কে জানে! নিজের বাপে যত্ন করলো না, পরের ছেলে কী করবে কে জানে!
সুরুজ মিঞার ছাতা শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল ঐ চুলার পাড় থেকেই। ভুলটা কার হয়েছিল কে জানে! ভুলে খড়ি রাখার মাচায় চলে গিয়েছিল ছাতাটা।খড়ি মনে করে চুলার মধ্যে ঢুকিয়েও দিয়েছিল হাফিজা খাতুন। সকাল বেলাতেই বকাঝকা খেয়ে মাথাটা আউলা হয়ে গিয়েছিল।বড় মেয়ে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি বের করে আনে। ছাতার এক পাশের কাপড় একটু পুড়ে গিয়েছে। সুরুজ মিঞা ব্যাপার টা ঠিক দেখে ফেলে। শকুনের চোখ তার। তারপর যা হবার তাই হয়।হাড় কিপ্টে লোক সুরুজ মিঞা। ছাতার এই চরম দুর্দশা সে হজম করতে পারে না। বউ আর দুই মেয়ের উপর অজস্র গালমন্দ বর্ষণ করতে করতে বাজার অভিমুখে রওয়ানা হয় সে।
সেই দিন আর পারলো না হাফিজা বেগম। সামান্য একটা ভুলের জন্য এত শাপশাপান্ত! হাড়ি কুড়ি ফেলে সে ঘরে ঢুকে দোর লাগায়। আজ জাহান্নামে যাক সব। সে কোন কাজ করবে না।
বড় মেয়ে মুনিয়া অনেকক্ষণ ধরে মাকে ডেকে ডেকে খ্যান্ত দেয়। মাকে ভাল মতই চেনে সে।বাবার এই নিত্য দিনের হাঙ্গামায় মাকে আশ্র্য় করেই বাঁচে তারা দুই বোন। পাখীর মার মত মা তাদের দু বোনকে ডানা দিয়ে আগলিয়ে রাখে। ছেলে না জন্মানোর বাবার যত রাগ সব এসে জড়ো হয় তাদের দুই বোনের উপর।
অনেকক্ষণ মার দরজার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে চুলার পাড়ে এসে বসে মুনিয়া। অনেক কাজ পরে আছে। ছোটবেলা থেকে কাজ করতে করতে গৃহস্হালির কাজে সে পটু। তবু অসাবধানে কখন যেন গায়ের সাথে পেঁচিয়ে রাখা ওড়নার এক কোণা চুলার মধ্যে পড়ে যায় তা খেয়াল করেনি মুনিয়া। ঠিকমত বুঝে উঠতে উঠতেই জামার অনেকখানি অংশে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ছোট মেয়ের চিৎকারে হাফিজা বেগম দৌড়ে এসে দেখে, মুনিয়া অঞ্জান হয়ে পড়ে আছে উঠানে।
সুরুজ মিঞার কাছে যখন খবর পৌঁছায় বেলা তখন দুপুর গড়িয়েছে।পাশের বাড়ির ছেলেটা এসে জানায়, মুনিয়ার শরীরে আগুন লেগেছে। সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছে তাকে। এক রাশ বিরক্তি নিয়ে হাতের কাজ ফেলে সুরুজ মিঞাকে ছুটতে হয় সদর হাসপাতালে। গিয়ে দেখে হাসপাতালের ওয়ার্ডে শুয়ে আছে মুনিয়া। হাতে পায়ে মোটা ব্যাণ্ডেজ়। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো বাবাকে। পাশে নির্বাক বসে আছে হাফিজা বেগম। ছোট মেয়েটা কাঁদছে পায়ের কাছে বসে।
চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখলো সুরুজ মিঞা। ঘর-বাড়ী খোলা রেখে বাড়ী শুদ্ধু সব চলে এসেছে। গরুগুলো খোলা পড়ে আছে। কেউ যদি এসে নিয়ে যায়?! তিল তিল করে গড়ে তোলা এত কষ্টের ধন তার...
আজ অবধি কেউ কদর করতে শিখলো না...।।
ভাদ্রের সকাল। একটু পরেই গা ঝলসানো রোদ উঠবে। উঠানের এক পাশের গোয়াল ঘরে আট-নয় টা গরু পরম নিশ্চিন্ত মনে খড় চিবুচ্ছে। ছোট মেয়েটা পাশে বসে একটা বড় মাটির ভাড়ে ভাতের ফেনের সাথে গমের ভুষি মেশাচ্ছে, সর্ব সাকুল্যে প্রায় পনেরো-বিশ টা গরুর মালিক সুরুজ মিঞা। গ্রামের বেশ অবস্থাপন্ন গৃহস্থ সে। সামান্য অবস্থা থেকে আজ তার এই উত্থান। বাপের সম্পত্তি বলতে ছিল এই ভিটা আর এক জোড়া গরু। সেই এক জোড়া গরু থেকেই মাত্র কয়েক বছরেই ফুলে ফেঁপে উঠেছে সুরুজ মিঞা। দুধ বেচে হিসেব করে করে সংসার চালিয়েছে আর জমানো টাকা দিয়ে গরুর সংখ্যা বাড়িয়েছে। নিজের জন্য একটা টাকাও খরচ করেনি। পৈতৃক ভিটাটা মেরামত করিয়েছে। অতীতের কথা মনে করে গর্বে বুক ভরে ওঠে তার। নিজের বউ আর মেয়ে গুলোকে প্রায়ই তার এই উথানের কথা শুনতে হয়। আজও তার ব্যাতিক্রম হল না। জোরে জোরে কিছুক্ষণ মুণ্ডুপাত করলো সবার। "সারাদিন খাইটে মরি। ছাতাটাও দেইখে রাখতে পারো না। ঘরে বইসে করো কী সারাদিন? কথায় কথায় চুলার পাড় দেখাও। মাইয়া দুইখান কোন কাজের হইলো না। আমার কপাল মন্দ। একটা পোলা হইলে আগলাইয়া রাখতো। কুনখান দিয়া সব কিছু হইলো বুঝবার পারতাছো না তো! বুঝবা কেমনে? মুখখু মাইয়া মানুষ।"
চুলার পাশে বসে নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাফিজা বেগম। মনে মনে বলে,"হ, হেই তো খালি বুঝবার পারবো!" আজ এত গুলো বছর ধরে সে আর পরে তার এই মেয়ে দুইটা যে হাড় ভাংগা খাটুনি খেটে যাচ্ছে তা এই লোকরে বলে কী হবে! মেয়ে দুইটারে স্কুলে পর্যন্ত দেয় নাই। বলে, 'মাইয়াগো পড়ায়া লাভ নাই। পরের বাড়ী পাঠাইয়া দিতে পারলেই তো চুইক্যা গেল।' সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বেগার খাটুনি খাটে মেয়ে দুইটা। গরুর খাবার দেওয়া, গোসল করানো, মাঠে নিয়ে যাওয়া। তার পরেও আছে বাড়ির কাজ। আহারে, তার মেয়ে দুইটারে নিজে থেকে শখ করে একটা কাপড় ও কিনে দেয় নাই কোনদিন। বিয়ের পরে কই যাবে কে জানে! নিজের বাপে যত্ন করলো না, পরের ছেলে কী করবে কে জানে!
সুরুজ মিঞার ছাতা শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল ঐ চুলার পাড় থেকেই। ভুলটা কার হয়েছিল কে জানে! ভুলে খড়ি রাখার মাচায় চলে গিয়েছিল ছাতাটা।খড়ি মনে করে চুলার মধ্যে ঢুকিয়েও দিয়েছিল হাফিজা খাতুন। সকাল বেলাতেই বকাঝকা খেয়ে মাথাটা আউলা হয়ে গিয়েছিল।বড় মেয়ে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি বের করে আনে। ছাতার এক পাশের কাপড় একটু পুড়ে গিয়েছে। সুরুজ মিঞা ব্যাপার টা ঠিক দেখে ফেলে। শকুনের চোখ তার। তারপর যা হবার তাই হয়।হাড় কিপ্টে লোক সুরুজ মিঞা। ছাতার এই চরম দুর্দশা সে হজম করতে পারে না। বউ আর দুই মেয়ের উপর অজস্র গালমন্দ বর্ষণ করতে করতে বাজার অভিমুখে রওয়ানা হয় সে।
সেই দিন আর পারলো না হাফিজা বেগম। সামান্য একটা ভুলের জন্য এত শাপশাপান্ত! হাড়ি কুড়ি ফেলে সে ঘরে ঢুকে দোর লাগায়। আজ জাহান্নামে যাক সব। সে কোন কাজ করবে না।
বড় মেয়ে মুনিয়া অনেকক্ষণ ধরে মাকে ডেকে ডেকে খ্যান্ত দেয়। মাকে ভাল মতই চেনে সে।বাবার এই নিত্য দিনের হাঙ্গামায় মাকে আশ্র্য় করেই বাঁচে তারা দুই বোন। পাখীর মার মত মা তাদের দু বোনকে ডানা দিয়ে আগলিয়ে রাখে। ছেলে না জন্মানোর বাবার যত রাগ সব এসে জড়ো হয় তাদের দুই বোনের উপর।
অনেকক্ষণ মার দরজার সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে চুলার পাড়ে এসে বসে মুনিয়া। অনেক কাজ পরে আছে। ছোটবেলা থেকে কাজ করতে করতে গৃহস্হালির কাজে সে পটু। তবু অসাবধানে কখন যেন গায়ের সাথে পেঁচিয়ে রাখা ওড়নার এক কোণা চুলার মধ্যে পড়ে যায় তা খেয়াল করেনি মুনিয়া। ঠিকমত বুঝে উঠতে উঠতেই জামার অনেকখানি অংশে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ছোট মেয়ের চিৎকারে হাফিজা বেগম দৌড়ে এসে দেখে, মুনিয়া অঞ্জান হয়ে পড়ে আছে উঠানে।
সুরুজ মিঞার কাছে যখন খবর পৌঁছায় বেলা তখন দুপুর গড়িয়েছে।পাশের বাড়ির ছেলেটা এসে জানায়, মুনিয়ার শরীরে আগুন লেগেছে। সদর হাসপাতালে নিয়ে গেছে তাকে। এক রাশ বিরক্তি নিয়ে হাতের কাজ ফেলে সুরুজ মিঞাকে ছুটতে হয় সদর হাসপাতালে। গিয়ে দেখে হাসপাতালের ওয়ার্ডে শুয়ে আছে মুনিয়া। হাতে পায়ে মোটা ব্যাণ্ডেজ়। শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো বাবাকে। পাশে নির্বাক বসে আছে হাফিজা বেগম। ছোট মেয়েটা কাঁদছে পায়ের কাছে বসে।
চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সব দেখলো সুরুজ মিঞা। ঘর-বাড়ী খোলা রেখে বাড়ী শুদ্ধু সব চলে এসেছে। গরুগুলো খোলা পড়ে আছে। কেউ যদি এসে নিয়ে যায়?! তিল তিল করে গড়ে তোলা এত কষ্টের ধন তার...
আজ অবধি কেউ কদর করতে শিখলো না...।।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
স্বাধীন আমিনুল ইসলাম ০৬/০৫/২০১৫পরিচিত আবহমান বাংলার রুপ।
-
অবুঝ ব্লগার ০১/০৫/২০১৫ভাল লাগলো
-
এম এস সজীব ৩০/০৪/২০১৫বেশ
-
অ ২৯/০৪/২০১৫বেশ ভালো লিখেছেন ...
-
তরীকুল ইসলাম সৈকত ২৮/০৪/২০১৫মুনিয়া। নামটা খুব প্রিয় আমার।