যাত্রা নাস্তি (তৃতীয় পর্ব)
পাঞ্জাবিখানা শক্ত হাতে ঘুড়িয়ে চিপে দেওয়ায় টপ টপ করে কয়েক ফোঁটা পানি মাটিতে পড়ে গেলো। প্রায় আধা ঘন্টা ধরে পাঞ্জাবি শুকানোর চেষ্টা করছে আকাশবাবু। কিন্তু কাপড় যতই চিপা হচ্ছে, ততই পানি বেরিয়ে আসছে।
সে সজোড়ে ডানে বামে ঝাড়া দিয়ে সেটা ছড়িয়ে দিলো খড়ের গাদার উপর। সারা দুপুর বৃষ্টি হবার পর পড়ন্ত বিকালের মিহি রোদে কোনো কাপড় শুকানোর কথা না। কিন্তু এই অঞ্চলে সন্ধ্যা নামলেই ভূতের মতো ঠান্ডা চেপে বসে। তাই গায়ে কিছু না দেয়া থাকলে টিকে থাকা কষ্টকর হবে।
বৃষ্টির পানিতে সস্তা দড়িখানা নিজে থেকেই নরম হয়ে যাওয়ায় সেটা খুলতে কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয়নি। তবে হাতের কব্জিতে টকটকে লাল দাগ দেখে কেমন যেন মাথা ঝিম দিয়ে উঠে।
আকাশবাবুর সেখানে ভ্রূক্ষেপ করার সময় নেই। সে হাত দিয়ে পাঞ্জাবির কাপড় পরীক্ষা করলো। এখনও ভেজা ভেজা ভাব চলে যায়নি। নিচের ছেঁড়া অংশ কাপড় চিপার ফলে আরো কিছুটা ছিঁড়ে গেছে।
গুরগাও স্টেশন থেকে দুই ক্রোশ পথ দূরত্বে এক বিশাল ক্ষেতের ধারে আশ্রয় নিয়েছে সে।
দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ধ্বনি।
ক্ষেতের কাকতাড়ুয়ার ভয়ংকর মূর্তি আর কয়েকটি মাছরাঙ্গা পাখির এদিক ওদিক সাই করে উড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই।
বছরের এই সময় ক্ষেতে কৃষকদের আনাগোনাও কম থাকে। চোখে দেখা দূরত্বে কোনো বাড়িঘর নজরে আসছে না। তবে নজরে ছিল।
যখন সে ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হিতাহিতজ্ঞানকে তোয়াক্কা না করে সোজা যেদিকে দৃষ্টি যায় ছুটে যাচ্ছিলো, তখন বেশ কয়েকটি ঘর নজরে পড়েছিলো।
গৃহস্থালি ঘর।
গোয়াল ঘর।
উঠানে কাদায় খেলা করা শিশু।
রোদে দেয়া কাপড় ঘরে নেয়ার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত গৃহিণী এবং আরো অনেক কিছু।
ঝুম বৃষ্টিতে আইল ধরে গ্রামে ঢুকে যাওয়া হাত বাঁধা এক হতভাগাকে অনেকেই লক্ষ করেনি বৃষ্টির সংগ্রামে। তবে যারা লক্ষ করেছে, তাদের সবাই শিশু নয়তো নারী। এক জোড়া কৌতূহলী দৃষ্টি ব্যতীত কিছুই দেয়ার ছিল না তাদের। গ্রাম শেষে এই জনমানবহীন ক্ষেতের নির্জন বৃক্ষ ছায়াতলে বসে সে খানিকটা জিরিয়ে নিলো। ততক্ষণে বৃষ্টিও শেষ। হাতের বাঁধনটাও হালকা হয়ে গেছে। গায়ে খানিকটা শক্তি ফিরে পেতে সে ঠান্ডা মাথায় সবকিছু ভাবা শুরু করলো।
পুরো ঘটনা এখনো তার হজম হয়ে উঠেনি। কিছুক্ষণ আগেও সে নিশ্চিন্তে ট্রেনে বসে ঘুমোচ্ছিলো। আর এখন সে এক অজপাড়া গাঁয় বসে পাঞ্জাবি শুকাচ্ছে।
ট্রেনের সবাইকে সে মনে মনে শাপ দিলো। সবচেয়ে বেশি শাপ দিলো ট্রেনের ঘোমটা পড়া মহিলাকে। সে ইচ্ছে করলেই তাকে এত বড় বিপদ থেকে বাঁচাতে পারতো। সামান্য একটা থলে তার নজর এড়িয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। অকথ্য ভাষায় কয়েকটা গালি দিলো সে।
গুরগাও যেতে হলে তাকে রেলপথ ধরে এগুতে হবে। আর বাড়ি ফিরতে হলে তার প্রচুর অর্থ দরকার। সেটা এখন জোগাড় করা অসম্ভব। এর চেয়ে দুক্রোশ পথ হেঁটে পিসির বাড়ি চলে যাওয়া মঙ্গলকর।
তবে বিপত্তি আসলো অন্যদিকে। ঠিক কোনদিক ধরে এগুলে সে রেলপথ ধরতে পারবে সেটা সে ভুলে গেছে। বিপদের মুখে সে পাগলের মতো এদিক সেদিক আঁকাবাঁকা পথে এগিয়েছে। তাই সঠিক রাস্তা ঠিক মনে নেই তার।
আধা ভেজা পাঞ্জাবিখানা গায়ে চড়িয়ে সে মোটামুটি আন্দাজ করে একদিকে এগুতে থাকলো। খাদি পাঞ্জাবির সবুজ রঙ এখন কাদার সাথে মিশে এক কিম্ভূতকিমাকার ভূষণ হয়ে গেছে।
বৃষ্টির পানিতে আইল পিচ্ছিল হয়ে যাওয়ায় বেশ সাবধানে এগুতে হচ্ছে। বেশ বড় একটা ক্ষেত পাড়ি দিয়ে সে শক্ত মেঠো পথে উঠে আসলো। পথের দুধারে ডোবা পচা পুকুরে হাঁস সাঁতার কাটছে।
পশ্চিমের আকাশ গোধূলির সাজে রক্তিম হয়ে পড়ায় সেটা দেখতে চমৎকার লাগার কথা। তবে আকাশবাবুর সারা গা চুলকাচ্ছে। তবে পায়ের দিকে রক্ত বেরুচ্ছে।
জিনিসটা কোনো জোঁকের কারসাজি কিনা বোঝার জন্য সে মাথানিচু করলো। ঠিক তখন কোথা থেকে এক বিশাল কুকুর ছুটে এসে ঘেউ ঘেউ স্বরে তার দিকে চেচাতে থাকলো।
হঠাৎ করে এত বিশাল এক শিকারী কুকুরের চিৎকারে আকাশবাবু মাটিতে বসে পড়লো। কুকুরের আগুনের গোলার মতো চোখ দেখে তার রক্ত হিম হয়ে গেলো। সে উঠে সোজা দৌড়াতে থাকলো আবার।
কুকুরটাও তার পিছু পিছু দৌড়াতে থাকলো। তবে জানের মায়ায় ছুটে চলে আকাশবাবু ততক্ষণে কুকুরের নাগালের বাইরে চলে এসেছে। তবু কোনো রিস্ক নেয়ার প্রয়োজন নেই।
তাই সে আরো পাঁচ মিনিট অবিরাম ছুটে চললো। এবার সে মেঠোপথ পেরিয়ে মানুষের বসতিতে এসে পড়লো। রাস্তার একদিকে ক্ষেত আর অন্যদিকে মানুষের বসতি।
সে খানিকটা পিছন ফিরে তাকালো।
নাহ। কোনো শিকারী কুকুরের অস্তিত্ব নেই। এবার সে দৌড়ানো থামিয়ে হাঁটা ধরলো। এদিক ওদিক মানুষের সন্ধান করতে লাগলো সে।
সন্ধ্যার মিষ্টি বাতাস বইছে। দূরের গাছগুলো সেই তালে মৃদু দুলছে। ঠিক তখন গরু ছাগলকে বাড়ি ফিরিয়ে আনা রাখালরা পথ ধরে এগুচ্ছিলো।
সে ধীর পায়ে একজনের দিকে এগিয়ে গেলো। সামান্য কাশি দিয়ে সে হাক দিলো। “অই!”
রাখালবালক তার গরুবাহিনী নিয়ে থেমে গেলো। একহাতে শক্ত করে দড়ি ধরে সে চোখ দিয়ে আপাদমস্তক দেখে নিলো তাকে। “কি অইছে? কি চান?” ভীরু গলায় প্রশ্ন রাখালের।
সে গাল চুলকাতে চুলকাতে উত্তর দিলো, “রেলপথ কোনদিকে যায়?”
রাখাল বালক মাথা নেড়ে বললো সে জানে না। আকাশবাবু বেশ অবাক হলো। রাখালদের নখদর্পণে থাকার কথা সবকিছু। তাই সে নিশ্চিত মিথ্যা বলছে। সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলো। “রেলপথটা কোনদিকে বলো। আমি খুব বিপদে পড়েছি। আমার বাড়ি যেতে হবে খুব শীঘ্রই।”
রাখাল বালক এবারো মাথা নাড়লো। তারপর সে গরুদের ‘হু হট’ বলে পুনরায় বাড়ির দিকে চড়াতে থাকলো। আকাশবাবু তার দিকে তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে।
রাখলও ফিরে যাওয়ার সময় বার বার তাকে দেখে নিচ্ছিলো। তার চোখে অনিশ্চয়তার ছাপ। তার এই কাদামাখা বেশে যে কেউ তাকে সন্দেহ করবে। এই সহজ সত্যটুকু আকাশবাবু মেনে নিতে পারছে না।
ঠিক তখন পেছন থেকে উজ্জ্বল আলো এসে সন্ধ্যার আবছা আধারকে দূর করে দিলো। আকাশবাবু সেদিকে তাকানো মাত্র তার চোখে এসে আলো পড়লো। হঠাৎ উজ্জ্বল আলো পড়ায় তার চোখ জ্বালা করতে থাকলো। সে হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে নিলো।
কিছুক্ষণ পর আলো সয়ে যাওয়ায় সে হাত সরিয়ে নিলো।
সাফারি প্যান্ট পড়া এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে। তার এক হাতে দুনলা বন্দুক। আরেক হাতে হাই পাওয়ার টর্চ লাইট। তার পেছনে দাঁড়ানো সেই শিকারি কুকুর। তাকে দেখে হালকা ঘেউ করে উঠলো একবার।
তবে এবার আকাশবাবু ভয় পেলো না। কারণ, ভদ্রলোককে দেখে তার মনে হচ্ছে এবার কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে।
ভদ্রলোক এখানকার রেঞ্জার অফিসার। এদিকের বন জঙ্গল তার আওতাধীন। প্রতিদিন বিকেলে বন্দুক হাতে তিনি নিজেই বের হন। সাথে থাকে সেই শিকারী কুকুর।
আকাশবাবুকে দেখে সে চোর ভেবে পিছু নিয়েছে। আকাশবাবু তাকে তার দুঃখের কথা জানালো।
কীভাবে ট্রেনে ডাকাত পড়ায় সে পালিয়ে এসেছে প্রাণ বাঁচাতে।
এর চেয়ে বেশি কিছু জানানোর প্রয়োজন সে মনে করলো না। রেঞ্জার মানুষ। এক কথায় টার্জানের পুলিশ ভার্সন। দরকার কী বেশি কথা বলার?
ভদ্রলোক তাকে গুরগাও যেতে সাহায্য করবেন বললো। আকাশবাবু হাত মুখ ধুয়ে উঠানে বসলো। তাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই বিধায় রেঞ্জার আমন্ত্রণ জানায় নি।
তাছাড়া সে খুব দ্রুত চলে যেতে চায়।
নিশ্চিত গুরগাওতে পিসি চিন্তা করছে।
যখন জানতে পারবে ট্রেনে ডাকাত পড়েছে, নিশ্চয় বাড়িতে খবর চলে যাবে। তবে সেটা ঢের সময়ের ব্যাপার। এখান থেকে বাড়িতে চিঠি যেতে কমপক্ষে চারদিন লাগবে। এর আগেই সে গুরগাও চলে যাবে। তারপর পরশুর ট্রেনে সোজা কলকাতা।
রেঞ্জার তাকে গরম স্যুপ খেতে দিলো। তারপর সে কোনো এক অফিসের কাজের বায়না দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য ভেতরে চলে গেলো। সে কথা দিলো ঘন্টাখানেকের মধ্যে সব কাজ সেরে তার নিজের গাড়িতে করে গুরগাও স্টেশনে পৌঁছে দেয়া হবে। কৃতজ্ঞতায় আকাশবাবুর চোখে জল এসে গেলো। ভদ্রলোক কুকুরটাকে নিয়ে ভেতরে যাওয়ার পর সে চারদিক তাকিয়ে দেখে নিলো।
ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। বাইরের উঠানে চারটে বাতি জ্বলছে। বিজলি বাতি। এদিকে রেঞ্জারের বাসায় রাত্রে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। রেঞ্জারের সাথে এই কুকুর আর একজন চাকর ছাড়া কেউ থাকে না।
ভদ্রলোকের উঠানেও অফিসের ছাপ। বেশ বড় দুটো বোর্ড টানানো। একটাতে বন জঙ্গলের বিভিন্ন জরিপ এবং বনের মানচিত্র আঁকা। আকাশবাবু উঠে গিয়ে সেটা পরখ করতে লাগলো।
বনের প্রায় উত্তর দিকে রেলপথের চিহ্ন দেয়া। সে সেখান থেকে তার অবস্থান বের করার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে সে রেঞ্জারের বাসভবন বের করেও ফেললো।
এখান থেকে উত্তরে ছোট মেঠোপথ দিয়ে সেখানে যাওয়া যায়। কিন্তু পথটা অসম্পূর্ণ। আর শহর পর্যন্ত যেতে হলে পশ্চিমের পাকা রাস্তায় উঠা লাগবে। সেখান থেকে সোজা ডানদিকে গেলে গুরগাও বাজার। সেখান থেকে সে স্টেশন নিজেই হেঁটে হেঁটে যেতে পারবে।
তবে এই পথটা একটু বেশি দূরত্ব অতিক্রম করা লাগবে। বলতে গেলে রেলপথের দ্বিগুণ। তবে এ নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। রেঞ্জারের জিপে করে প্রয়োজন হলে সারারাত ভ্রমণ করা যাবে।
তার ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছিলো। তবে স্যুপের উষ্ণতা তাকে চাঙ্গা করে দিয়েছে।
পরের নোটিশ বোর্ডে বিভিন্ন দরকারি কাগজ লাগানো। এক দুটা কাগজ সে মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকলো। হাতে কাজ না থাকলে যা হয় আর কি। সেখানে রেঞ্জার অফিসের বিভিন্ন নীতিমালা নিয়ে নির্দেশ প্রদান করা।
ঠিক তখন চারটি বাতির মাঝে দুটো বাতি নিভে গেলো। আকাশবাবু পেছনে তাকালো। ঠিক কি কারণে সেটা নিভে গেলো বোঝা গেলো না।
রেঞ্জারের চাকর বোধহয় এর জন্য প্রস্তুত ছিল। সে তখনই একটা টুলবক্স নিয়ে ছুটে আসলো। রেঞ্জার সাহেব নিজেও বেরিয়ে আসলো তার সেই হাই পাওয়ার টর্চ নিয়ে। এসে সোজা আলো ফেললো তার উপর। সে হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে সামান্য হাসি দিলো। এর মানে সে ঠিক আছে।
রেঞ্জার তার দিকে এগিয়ে আসলো। “তা একা একা কী করছেন ওদিকে?”
“এই নোটিশ পড়ছিলাম। আপনার স্যুপ আমাকে আবার চাঙ্গা করে তুলেছে।” এই বলে একগাল হাসি দিলো আকাশবাবু।
চাকর দুটো লাইট পুনরায় জ্বালিয়ে দিলো। এবার কেন জানি আগের চেয়ে একটু বেশি আলো লাগছিলো।
রেঞ্জার টর্চ হাতে তার পাশে এসে দাঁড়ালো। চাকর টুলবক্স নিয়ে ভেতরে চলে গেলো সামান্য নমস্কার জানিয়ে।
“তা কী নোটিশ পড়ছেন?”
“এদিকে যা পাচ্ছি। আপনাদের রেশনের নোটিশ পড়লাম।” এই বলে আকাশবাবু আঙুল দিয়ে দেখালো সেটা। রেঞ্জার হাসি দিয়ে উঠলো। “আমি নিজেই এগুলো পড়ি না। পাচু এখানে সব নোটিশ টানিয়ে দেয়। আমি শুধু চোর ডাকাতের নাম লিস্টি আসলে সেগুলো পড়ি। আমার কাজ এই জঙ্গলকে চোর ডাকাত মুক্ত কর।”
এই বলে সে আরো ডানদিকের নোটিশ দেখাতে লাগলো। সেখানে বেশ কিছু দুর্ধর্ষ যুবকের ছবি লাগানো।
আকাশবাবু সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। কাউকে চেনা যায় কিনা দেখলো সে।
রেঞ্জার তার কাঁধে হালকা চাপড় দিয়ে পুনরায় ভেতরে চলে গেলো। তার অফিস থেকে টেলিফোনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বোধহয় অফিসিয়াল ফোন। তার হাঁটার গতি দেখে তাই মনে হচ্ছে।
আকাশবাবু পুনরায় নোটিশ পড়ায় মন দিলো। কিন্তু এবার শুধু ছবি দেখাতেই তার নজর সীমাবদ্ধ। এক ডাকাত সর্দারের ছবি এতটাই জীবন্ত যে দেখলে মনে হয় এই বুঝি তেড়ে আসলো রামদা হাতে।
সে হাত দিয়ে ছবিটা ছুয়ে দেখতে গেলো, ঠিক তখন সেটা মাটিতে পড়ে গেলো। বেশ জং ধরা আলপিনের ফলে সেগুলো ধরলেই পড়ে যায়।
আকাশবাবু সেটা মাটি থেকে তুললো। হাত দিয়ে ধুলো ঝেড়ে সেটা পুনরায় লাগানোর চেষ্টা করতে গেলো। ঠিক তখন সে পুনরায় পিলে চমকে উঠলো।
এ কী সর্বনাশ!
ডাকাতের ছবির নিচ থেকে যেন সিন্দাবাদের ভূতের মতো বেরিয়ে এসেছে সেই ভৌতিক নোটিশ। সে মোটা অক্ষরে লেখা ‘একে ধরিয়ে দিন’ আর তার নিচে শোভা পাচ্ছে অবিকল আকাশবাবুর মতো দেখতে একখানা পেন্সিল স্কেচ!
আকাশবাবু যেন মূর্ছা যায়। তার রক্ত গরম হয়ে গেলো উত্তেজনায়। সে আড়চোখে রেঞ্জারের অফিসের দিকে তাকালো। রেঞ্জার তখন টেলিফোনে ব্যস্ত। তার চাকরটাকে দেখা যাচ্ছে না।
রেঞ্জার কী পুরো ব্যাপারটা জানে? এতক্ষণ কী নাটক করছিলো? তার কানে বেজে উঠছে রেঞ্জারের কথাগুলো, ‘আকাশবাবুকে দেখে সে চোর ভেবে পিছু নিয়েছে’!
তাহলে কী এখন সে অফিসে জানাচ্ছে তার ব্যাপারে? ঘন্টাখানেক পরে তাকে শহরে পৌঁছে দেয়াটা তাহলে পুরোটাই বাহানা?
কি জানি বাবা। আকাশবাবু কোনোকিছু ঠিকমতো ভাবতে পারছে না।
এসব কী ভাবছে সে? একথা সত্য নাও হতে পারে। আর পোস্টারটাতো আড়ালে ছিল। পরেই তার মাথায় নতুন ভুত চাপলো, হয়তো পোস্টার আড়াল করে রাখা হয়েছে যেন তার নজরে না পড়ে। এই কথা সত্য হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম হতে পারে। তবে যদি আসলেই সত্য হয়?
আকাশবাবু স্যুপের বাটি রেখে দিল উঠানে। তার পুরো শরীর ঘেমে যাওয়ার পুনরায় চুলকানি উঠে গেলো।
তবে তার এদিকে ভ্রূক্ষেপ করার ফুরসৎ নেই।
তাকে অনেকদূর যেতে হবে। সে একপলক মানচিত্রটার দিকে তাকিয়ে কি যেন আন্দাজ করে নিলো। তারপর দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করলো।
মেঠোপথ ধরে রেলপথ যাওয়াই তার লক্ষ্য। (চলবে)
সে সজোড়ে ডানে বামে ঝাড়া দিয়ে সেটা ছড়িয়ে দিলো খড়ের গাদার উপর। সারা দুপুর বৃষ্টি হবার পর পড়ন্ত বিকালের মিহি রোদে কোনো কাপড় শুকানোর কথা না। কিন্তু এই অঞ্চলে সন্ধ্যা নামলেই ভূতের মতো ঠান্ডা চেপে বসে। তাই গায়ে কিছু না দেয়া থাকলে টিকে থাকা কষ্টকর হবে।
বৃষ্টির পানিতে সস্তা দড়িখানা নিজে থেকেই নরম হয়ে যাওয়ায় সেটা খুলতে কারো সাহায্যের প্রয়োজন হয়নি। তবে হাতের কব্জিতে টকটকে লাল দাগ দেখে কেমন যেন মাথা ঝিম দিয়ে উঠে।
আকাশবাবুর সেখানে ভ্রূক্ষেপ করার সময় নেই। সে হাত দিয়ে পাঞ্জাবির কাপড় পরীক্ষা করলো। এখনও ভেজা ভেজা ভাব চলে যায়নি। নিচের ছেঁড়া অংশ কাপড় চিপার ফলে আরো কিছুটা ছিঁড়ে গেছে।
গুরগাও স্টেশন থেকে দুই ক্রোশ পথ দূরত্বে এক বিশাল ক্ষেতের ধারে আশ্রয় নিয়েছে সে।
দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের ঘেউ ঘেউ ধ্বনি।
ক্ষেতের কাকতাড়ুয়ার ভয়ংকর মূর্তি আর কয়েকটি মাছরাঙ্গা পাখির এদিক ওদিক সাই করে উড়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো প্রাণের অস্তিত্ব নেই।
বছরের এই সময় ক্ষেতে কৃষকদের আনাগোনাও কম থাকে। চোখে দেখা দূরত্বে কোনো বাড়িঘর নজরে আসছে না। তবে নজরে ছিল।
যখন সে ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে হিতাহিতজ্ঞানকে তোয়াক্কা না করে সোজা যেদিকে দৃষ্টি যায় ছুটে যাচ্ছিলো, তখন বেশ কয়েকটি ঘর নজরে পড়েছিলো।
গৃহস্থালি ঘর।
গোয়াল ঘর।
উঠানে কাদায় খেলা করা শিশু।
রোদে দেয়া কাপড় ঘরে নেয়ার প্রচেষ্টায় ব্যস্ত গৃহিণী এবং আরো অনেক কিছু।
ঝুম বৃষ্টিতে আইল ধরে গ্রামে ঢুকে যাওয়া হাত বাঁধা এক হতভাগাকে অনেকেই লক্ষ করেনি বৃষ্টির সংগ্রামে। তবে যারা লক্ষ করেছে, তাদের সবাই শিশু নয়তো নারী। এক জোড়া কৌতূহলী দৃষ্টি ব্যতীত কিছুই দেয়ার ছিল না তাদের। গ্রাম শেষে এই জনমানবহীন ক্ষেতের নির্জন বৃক্ষ ছায়াতলে বসে সে খানিকটা জিরিয়ে নিলো। ততক্ষণে বৃষ্টিও শেষ। হাতের বাঁধনটাও হালকা হয়ে গেছে। গায়ে খানিকটা শক্তি ফিরে পেতে সে ঠান্ডা মাথায় সবকিছু ভাবা শুরু করলো।
পুরো ঘটনা এখনো তার হজম হয়ে উঠেনি। কিছুক্ষণ আগেও সে নিশ্চিন্তে ট্রেনে বসে ঘুমোচ্ছিলো। আর এখন সে এক অজপাড়া গাঁয় বসে পাঞ্জাবি শুকাচ্ছে।
ট্রেনের সবাইকে সে মনে মনে শাপ দিলো। সবচেয়ে বেশি শাপ দিলো ট্রেনের ঘোমটা পড়া মহিলাকে। সে ইচ্ছে করলেই তাকে এত বড় বিপদ থেকে বাঁচাতে পারতো। সামান্য একটা থলে তার নজর এড়িয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। অকথ্য ভাষায় কয়েকটা গালি দিলো সে।
গুরগাও যেতে হলে তাকে রেলপথ ধরে এগুতে হবে। আর বাড়ি ফিরতে হলে তার প্রচুর অর্থ দরকার। সেটা এখন জোগাড় করা অসম্ভব। এর চেয়ে দুক্রোশ পথ হেঁটে পিসির বাড়ি চলে যাওয়া মঙ্গলকর।
তবে বিপত্তি আসলো অন্যদিকে। ঠিক কোনদিক ধরে এগুলে সে রেলপথ ধরতে পারবে সেটা সে ভুলে গেছে। বিপদের মুখে সে পাগলের মতো এদিক সেদিক আঁকাবাঁকা পথে এগিয়েছে। তাই সঠিক রাস্তা ঠিক মনে নেই তার।
আধা ভেজা পাঞ্জাবিখানা গায়ে চড়িয়ে সে মোটামুটি আন্দাজ করে একদিকে এগুতে থাকলো। খাদি পাঞ্জাবির সবুজ রঙ এখন কাদার সাথে মিশে এক কিম্ভূতকিমাকার ভূষণ হয়ে গেছে।
বৃষ্টির পানিতে আইল পিচ্ছিল হয়ে যাওয়ায় বেশ সাবধানে এগুতে হচ্ছে। বেশ বড় একটা ক্ষেত পাড়ি দিয়ে সে শক্ত মেঠো পথে উঠে আসলো। পথের দুধারে ডোবা পচা পুকুরে হাঁস সাঁতার কাটছে।
পশ্চিমের আকাশ গোধূলির সাজে রক্তিম হয়ে পড়ায় সেটা দেখতে চমৎকার লাগার কথা। তবে আকাশবাবুর সারা গা চুলকাচ্ছে। তবে পায়ের দিকে রক্ত বেরুচ্ছে।
জিনিসটা কোনো জোঁকের কারসাজি কিনা বোঝার জন্য সে মাথানিচু করলো। ঠিক তখন কোথা থেকে এক বিশাল কুকুর ছুটে এসে ঘেউ ঘেউ স্বরে তার দিকে চেচাতে থাকলো।
হঠাৎ করে এত বিশাল এক শিকারী কুকুরের চিৎকারে আকাশবাবু মাটিতে বসে পড়লো। কুকুরের আগুনের গোলার মতো চোখ দেখে তার রক্ত হিম হয়ে গেলো। সে উঠে সোজা দৌড়াতে থাকলো আবার।
কুকুরটাও তার পিছু পিছু দৌড়াতে থাকলো। তবে জানের মায়ায় ছুটে চলে আকাশবাবু ততক্ষণে কুকুরের নাগালের বাইরে চলে এসেছে। তবু কোনো রিস্ক নেয়ার প্রয়োজন নেই।
তাই সে আরো পাঁচ মিনিট অবিরাম ছুটে চললো। এবার সে মেঠোপথ পেরিয়ে মানুষের বসতিতে এসে পড়লো। রাস্তার একদিকে ক্ষেত আর অন্যদিকে মানুষের বসতি।
সে খানিকটা পিছন ফিরে তাকালো।
নাহ। কোনো শিকারী কুকুরের অস্তিত্ব নেই। এবার সে দৌড়ানো থামিয়ে হাঁটা ধরলো। এদিক ওদিক মানুষের সন্ধান করতে লাগলো সে।
সন্ধ্যার মিষ্টি বাতাস বইছে। দূরের গাছগুলো সেই তালে মৃদু দুলছে। ঠিক তখন গরু ছাগলকে বাড়ি ফিরিয়ে আনা রাখালরা পথ ধরে এগুচ্ছিলো।
সে ধীর পায়ে একজনের দিকে এগিয়ে গেলো। সামান্য কাশি দিয়ে সে হাক দিলো। “অই!”
রাখালবালক তার গরুবাহিনী নিয়ে থেমে গেলো। একহাতে শক্ত করে দড়ি ধরে সে চোখ দিয়ে আপাদমস্তক দেখে নিলো তাকে। “কি অইছে? কি চান?” ভীরু গলায় প্রশ্ন রাখালের।
সে গাল চুলকাতে চুলকাতে উত্তর দিলো, “রেলপথ কোনদিকে যায়?”
রাখাল বালক মাথা নেড়ে বললো সে জানে না। আকাশবাবু বেশ অবাক হলো। রাখালদের নখদর্পণে থাকার কথা সবকিছু। তাই সে নিশ্চিত মিথ্যা বলছে। সে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলো। “রেলপথটা কোনদিকে বলো। আমি খুব বিপদে পড়েছি। আমার বাড়ি যেতে হবে খুব শীঘ্রই।”
রাখাল বালক এবারো মাথা নাড়লো। তারপর সে গরুদের ‘হু হট’ বলে পুনরায় বাড়ির দিকে চড়াতে থাকলো। আকাশবাবু তার দিকে তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে।
রাখলও ফিরে যাওয়ার সময় বার বার তাকে দেখে নিচ্ছিলো। তার চোখে অনিশ্চয়তার ছাপ। তার এই কাদামাখা বেশে যে কেউ তাকে সন্দেহ করবে। এই সহজ সত্যটুকু আকাশবাবু মেনে নিতে পারছে না।
ঠিক তখন পেছন থেকে উজ্জ্বল আলো এসে সন্ধ্যার আবছা আধারকে দূর করে দিলো। আকাশবাবু সেদিকে তাকানো মাত্র তার চোখে এসে আলো পড়লো। হঠাৎ উজ্জ্বল আলো পড়ায় তার চোখ জ্বালা করতে থাকলো। সে হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে নিলো।
কিছুক্ষণ পর আলো সয়ে যাওয়ায় সে হাত সরিয়ে নিলো।
সাফারি প্যান্ট পড়া এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে। তার এক হাতে দুনলা বন্দুক। আরেক হাতে হাই পাওয়ার টর্চ লাইট। তার পেছনে দাঁড়ানো সেই শিকারি কুকুর। তাকে দেখে হালকা ঘেউ করে উঠলো একবার।
তবে এবার আকাশবাবু ভয় পেলো না। কারণ, ভদ্রলোককে দেখে তার মনে হচ্ছে এবার কোনো সাহায্য পাওয়া যাবে।
ভদ্রলোক এখানকার রেঞ্জার অফিসার। এদিকের বন জঙ্গল তার আওতাধীন। প্রতিদিন বিকেলে বন্দুক হাতে তিনি নিজেই বের হন। সাথে থাকে সেই শিকারী কুকুর।
আকাশবাবুকে দেখে সে চোর ভেবে পিছু নিয়েছে। আকাশবাবু তাকে তার দুঃখের কথা জানালো।
কীভাবে ট্রেনে ডাকাত পড়ায় সে পালিয়ে এসেছে প্রাণ বাঁচাতে।
এর চেয়ে বেশি কিছু জানানোর প্রয়োজন সে মনে করলো না। রেঞ্জার মানুষ। এক কথায় টার্জানের পুলিশ ভার্সন। দরকার কী বেশি কথা বলার?
ভদ্রলোক তাকে গুরগাও যেতে সাহায্য করবেন বললো। আকাশবাবু হাত মুখ ধুয়ে উঠানে বসলো। তাকে ভেতরে নিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা নেই বিধায় রেঞ্জার আমন্ত্রণ জানায় নি।
তাছাড়া সে খুব দ্রুত চলে যেতে চায়।
নিশ্চিত গুরগাওতে পিসি চিন্তা করছে।
যখন জানতে পারবে ট্রেনে ডাকাত পড়েছে, নিশ্চয় বাড়িতে খবর চলে যাবে। তবে সেটা ঢের সময়ের ব্যাপার। এখান থেকে বাড়িতে চিঠি যেতে কমপক্ষে চারদিন লাগবে। এর আগেই সে গুরগাও চলে যাবে। তারপর পরশুর ট্রেনে সোজা কলকাতা।
রেঞ্জার তাকে গরম স্যুপ খেতে দিলো। তারপর সে কোনো এক অফিসের কাজের বায়না দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য ভেতরে চলে গেলো। সে কথা দিলো ঘন্টাখানেকের মধ্যে সব কাজ সেরে তার নিজের গাড়িতে করে গুরগাও স্টেশনে পৌঁছে দেয়া হবে। কৃতজ্ঞতায় আকাশবাবুর চোখে জল এসে গেলো। ভদ্রলোক কুকুরটাকে নিয়ে ভেতরে যাওয়ার পর সে চারদিক তাকিয়ে দেখে নিলো।
ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। বাইরের উঠানে চারটে বাতি জ্বলছে। বিজলি বাতি। এদিকে রেঞ্জারের বাসায় রাত্রে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়। রেঞ্জারের সাথে এই কুকুর আর একজন চাকর ছাড়া কেউ থাকে না।
ভদ্রলোকের উঠানেও অফিসের ছাপ। বেশ বড় দুটো বোর্ড টানানো। একটাতে বন জঙ্গলের বিভিন্ন জরিপ এবং বনের মানচিত্র আঁকা। আকাশবাবু উঠে গিয়ে সেটা পরখ করতে লাগলো।
বনের প্রায় উত্তর দিকে রেলপথের চিহ্ন দেয়া। সে সেখান থেকে তার অবস্থান বের করার চেষ্টা করলো। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে সে রেঞ্জারের বাসভবন বের করেও ফেললো।
এখান থেকে উত্তরে ছোট মেঠোপথ দিয়ে সেখানে যাওয়া যায়। কিন্তু পথটা অসম্পূর্ণ। আর শহর পর্যন্ত যেতে হলে পশ্চিমের পাকা রাস্তায় উঠা লাগবে। সেখান থেকে সোজা ডানদিকে গেলে গুরগাও বাজার। সেখান থেকে সে স্টেশন নিজেই হেঁটে হেঁটে যেতে পারবে।
তবে এই পথটা একটু বেশি দূরত্ব অতিক্রম করা লাগবে। বলতে গেলে রেলপথের দ্বিগুণ। তবে এ নিয়ে তার মাথাব্যথা নেই। রেঞ্জারের জিপে করে প্রয়োজন হলে সারারাত ভ্রমণ করা যাবে।
তার ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসছিলো। তবে স্যুপের উষ্ণতা তাকে চাঙ্গা করে দিয়েছে।
পরের নোটিশ বোর্ডে বিভিন্ন দরকারি কাগজ লাগানো। এক দুটা কাগজ সে মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকলো। হাতে কাজ না থাকলে যা হয় আর কি। সেখানে রেঞ্জার অফিসের বিভিন্ন নীতিমালা নিয়ে নির্দেশ প্রদান করা।
ঠিক তখন চারটি বাতির মাঝে দুটো বাতি নিভে গেলো। আকাশবাবু পেছনে তাকালো। ঠিক কি কারণে সেটা নিভে গেলো বোঝা গেলো না।
রেঞ্জারের চাকর বোধহয় এর জন্য প্রস্তুত ছিল। সে তখনই একটা টুলবক্স নিয়ে ছুটে আসলো। রেঞ্জার সাহেব নিজেও বেরিয়ে আসলো তার সেই হাই পাওয়ার টর্চ নিয়ে। এসে সোজা আলো ফেললো তার উপর। সে হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে সামান্য হাসি দিলো। এর মানে সে ঠিক আছে।
রেঞ্জার তার দিকে এগিয়ে আসলো। “তা একা একা কী করছেন ওদিকে?”
“এই নোটিশ পড়ছিলাম। আপনার স্যুপ আমাকে আবার চাঙ্গা করে তুলেছে।” এই বলে একগাল হাসি দিলো আকাশবাবু।
চাকর দুটো লাইট পুনরায় জ্বালিয়ে দিলো। এবার কেন জানি আগের চেয়ে একটু বেশি আলো লাগছিলো।
রেঞ্জার টর্চ হাতে তার পাশে এসে দাঁড়ালো। চাকর টুলবক্স নিয়ে ভেতরে চলে গেলো সামান্য নমস্কার জানিয়ে।
“তা কী নোটিশ পড়ছেন?”
“এদিকে যা পাচ্ছি। আপনাদের রেশনের নোটিশ পড়লাম।” এই বলে আকাশবাবু আঙুল দিয়ে দেখালো সেটা। রেঞ্জার হাসি দিয়ে উঠলো। “আমি নিজেই এগুলো পড়ি না। পাচু এখানে সব নোটিশ টানিয়ে দেয়। আমি শুধু চোর ডাকাতের নাম লিস্টি আসলে সেগুলো পড়ি। আমার কাজ এই জঙ্গলকে চোর ডাকাত মুক্ত কর।”
এই বলে সে আরো ডানদিকের নোটিশ দেখাতে লাগলো। সেখানে বেশ কিছু দুর্ধর্ষ যুবকের ছবি লাগানো।
আকাশবাবু সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো। কাউকে চেনা যায় কিনা দেখলো সে।
রেঞ্জার তার কাঁধে হালকা চাপড় দিয়ে পুনরায় ভেতরে চলে গেলো। তার অফিস থেকে টেলিফোনের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। বোধহয় অফিসিয়াল ফোন। তার হাঁটার গতি দেখে তাই মনে হচ্ছে।
আকাশবাবু পুনরায় নোটিশ পড়ায় মন দিলো। কিন্তু এবার শুধু ছবি দেখাতেই তার নজর সীমাবদ্ধ। এক ডাকাত সর্দারের ছবি এতটাই জীবন্ত যে দেখলে মনে হয় এই বুঝি তেড়ে আসলো রামদা হাতে।
সে হাত দিয়ে ছবিটা ছুয়ে দেখতে গেলো, ঠিক তখন সেটা মাটিতে পড়ে গেলো। বেশ জং ধরা আলপিনের ফলে সেগুলো ধরলেই পড়ে যায়।
আকাশবাবু সেটা মাটি থেকে তুললো। হাত দিয়ে ধুলো ঝেড়ে সেটা পুনরায় লাগানোর চেষ্টা করতে গেলো। ঠিক তখন সে পুনরায় পিলে চমকে উঠলো।
এ কী সর্বনাশ!
ডাকাতের ছবির নিচ থেকে যেন সিন্দাবাদের ভূতের মতো বেরিয়ে এসেছে সেই ভৌতিক নোটিশ। সে মোটা অক্ষরে লেখা ‘একে ধরিয়ে দিন’ আর তার নিচে শোভা পাচ্ছে অবিকল আকাশবাবুর মতো দেখতে একখানা পেন্সিল স্কেচ!
আকাশবাবু যেন মূর্ছা যায়। তার রক্ত গরম হয়ে গেলো উত্তেজনায়। সে আড়চোখে রেঞ্জারের অফিসের দিকে তাকালো। রেঞ্জার তখন টেলিফোনে ব্যস্ত। তার চাকরটাকে দেখা যাচ্ছে না।
রেঞ্জার কী পুরো ব্যাপারটা জানে? এতক্ষণ কী নাটক করছিলো? তার কানে বেজে উঠছে রেঞ্জারের কথাগুলো, ‘আকাশবাবুকে দেখে সে চোর ভেবে পিছু নিয়েছে’!
তাহলে কী এখন সে অফিসে জানাচ্ছে তার ব্যাপারে? ঘন্টাখানেক পরে তাকে শহরে পৌঁছে দেয়াটা তাহলে পুরোটাই বাহানা?
কি জানি বাবা। আকাশবাবু কোনোকিছু ঠিকমতো ভাবতে পারছে না।
এসব কী ভাবছে সে? একথা সত্য নাও হতে পারে। আর পোস্টারটাতো আড়ালে ছিল। পরেই তার মাথায় নতুন ভুত চাপলো, হয়তো পোস্টার আড়াল করে রাখা হয়েছে যেন তার নজরে না পড়ে। এই কথা সত্য হওয়ার সম্ভাবনা খুব কম হতে পারে। তবে যদি আসলেই সত্য হয়?
আকাশবাবু স্যুপের বাটি রেখে দিল উঠানে। তার পুরো শরীর ঘেমে যাওয়ার পুনরায় চুলকানি উঠে গেলো।
তবে তার এদিকে ভ্রূক্ষেপ করার ফুরসৎ নেই।
তাকে অনেকদূর যেতে হবে। সে একপলক মানচিত্রটার দিকে তাকিয়ে কি যেন আন্দাজ করে নিলো। তারপর দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করলো।
মেঠোপথ ধরে রেলপথ যাওয়াই তার লক্ষ্য। (চলবে)
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আব্দুল হক ২৮/০৫/২০১৮বেশ ভালো লাগল। ধন্যবাদ!