যাত্রা নাস্তি (প্রথম পর্ব)
আঁকাবাঁকা গতিতে একটা সাপ এগিয়ে যাচ্ছিলো। মাটি রঙের ডোরা সাপ। এদের নাকি বিষ থাকে না। তাই অনেকে এদের দেখে ভয় পায় না। হঠাৎ সজোরে নেমে আসা তরবারির আঘাতে সেটার মাথা দেহ থেকে আলাদা হয়ে গেলো। খানিকক্ষণ ছটফট করে সেটা মৃত্যুর হাতে নিজেকে সোপর্দ করলো।
সেদিকে বেশ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে বিশাল দেহধারী এক জোয়ান লোক। শুধু সে না। তার সাথে আরো অনেকে আছে।
বিশ থেকে ত্রিশজনের একটা দল রেলপথের দুদিকে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকে তাদের বন্দুক পরীক্ষা করে দেখছে।
সবার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে তাদের সর্দার।
সে বারবার মানচিত্র দেখে মিলিয়ে নিচ্ছে। আর মনে মনে আন্দাজ করে নিচ্ছে ট্রেনের অবস্থান।
কলকাতাগামী ট্রেন এদিক দিয়েই যাওয়ার কথা। প্রতি মাসে একবার করে দেশ ঘুরে তারা ট্রেন ডাকাতি করে বেড়ায়।
ডাকাতি তাদের রক্তে মিশে আছে। প্রায় তিন পুরুষের পেশা বলে কথা।
সূর্যের খাড়া রশ্মির কারণে মাটির উপর বেশ ঘন পরিষ্কার ছায়া পড়েছে। সেদিকে তাকিয়ে সময়ের হিসাব করলো সর্দার।
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ট্রেন চলে আসবে। তার ইশারা অনুযায়ী একদল চলে গেলো সোপানগঞ্জ স্টেশনের দিকে।
এখন রওয়ানা দিলে সময়মতো সেখানে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। তাদের চলে যাওয়ার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলো সে। একদম দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকলো
*******************
প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন আকাশবাবু। অনেকক্ষণ ধরে ট্রেনের মৃদু ঝাকুনিতে শান্তিময় ঝিমুনি দিচ্ছিলেন। তার মাথাটা টপ্পাগানের ঢোলের ন্যায় তাল মিলিয়ে দুলছিলো সেই কখন থেকে। সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল পাশের সিটে মায়ের কোলে বসে থাকা ৫ বছর বয়সী খুকি। খুকির চোখের সেই কৌতূহলী চাহনি দেখে মনে হচ্ছিলো, আকাশবাবু নয়, স্বয়ং নন্দিপাড়ার মোষ এসে ঝিমুচ্ছে!
আকাশবাবুর ঘুম ভাঙ্গার কারণ আমার জানা নেই। আকাশবাবু নিজেও তেমন বুঝতে পারলেন না। তবে এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে নিলেন।
ছোট একখানা কামরা।
মুখোমুখি দুই পর্যায়ের চারটি বেঞ্চ পাতা। সেগুলোতে তিনজন করে বসতে পারে।
দুটো বেঞ্চ হাউসফুল হলেও আকাশবাবু আর তার সামনের বেঞ্চে সম্মিলিত জনসংখ্যা মাত্র একজন।
ময়লা মেঝের উপর একগাদা বাদামের খোসা ফেলে কে যেন চম্পট দিয়েছে আগের স্টেশনে।
আর জানালার ভাঙা কাচ দিয়ে দেখা যায় দূরের শুকনো মাঠ। মাঠ দেখে বুঝা যায় এখন কোন মাস চলছে।
ট্রেন থেমে আছে এক অঘোষিত বিলম্বের অজুহাতে।
এই কামরার সবচেয়ে দক্ষিণের কোণার সিটে জানালার পাশে বসে আছেন আকাশবাবু। তার পরনে খাদি পাঞ্জাবি। স্বদেশি আন্দোলনের জের ধরে বেশ সস্তায় পেয়েছিলেন মেদিনীপুরে। তাই এক হিসেবে চারখানা কিনে ফেলা।
পাঞ্জাবির বুকের দিকে কোনো কাজ করা নেই। সেখানে সকাল থেকে অনবরত গরম থাকার প্রভাব পড়েছে। হালকা গাঢ় হয়ে যাওয়া স্থানের কাপড়খানা টান দিয়ে ধরে ভেতরে জোরে ফুঁ দিলেন তিনি।
হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গার কারণে শরীর জ্বর উঠার মতো গরম হয়ে আছে। তিনি থলের ভেতর থেকে চামড়ার মশক বের করে গলায় পানি ঢেলে নিলেন। যেন অসীম নরকের মাঝে একখণ্ড বরফ গলে পড়ে গেল, আর সকল দুঃখ দূর হতে থাকলো।
“দুঃখিত জনাব। আপনাকে জাগিয়ে দিলাম।”
আকাশবাবু চমকে উঠলো। কে? কে কথা বলে? তিনি মাথা ঘুরে এদিক ওদিক তাকালেন। কই! কেউ নাই তো। তিনি এবার মাথা বের করে দিলেন জানালা দিয়ে। যেদিকে চোখ যায় শুধু ক্ষেত আর ক্ষেত। মানুষ কেউ নাই।
আবার কে যেন বলে উঠলো, “এই যে জনাব। কাউকে খুঁজছেন?”
আকাশবাবু এবার আবিষ্কার করলো সামনের সিটে বসা এক ভদ্রলোককে। বেশ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বয়স ৭০ এর কাছাকাছি হবে হয়তো। চামড়া দেখে মানুষের বয়স আন্দাজ করে যা বলা গেলো আর কি।
“না মানে কে যেন কথা বলছিলো। ঘুম থেকে উঠলাম বলে বুঝতে পারলাম না কে বললো”,এই বলে আকাশবাবু আরো এক ঢোক পানি খেলেন। আজ বড্ড পিপাসা পেয়েছে তার।
লোকটা খনখনে গলায় হেসে উঠলো।
কী অদ্ভুত! এখানে হাসির কি আছে? এর আগে কাউকে পানি খেতে দেখেনি নাকি? আকাশবাবু পানির মশক ব্যাগে ঢুকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেন।
বুড়ো মানুষ হাসির চোটে কিছুক্ষণ কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো। তারপর বললো, “কে আবার কথা বলবে? আমিই বলেছি। খোলা মাঠে ট্রেন থামা দেখে উঠে পড়লাম কিছুক্ষণ আগে। আমি আবার সামনের স্টেশনেই যাচ্ছি।”
আকাশাবাবু কথা শুনলো মন দিয়ে। তারপর সামান্য মাথা ঝুকে প্রণাম করে নিলো। লোকটি এর প্রত্যুত্তরে হাত জোড় করে নমষ্কার জানালো। আকাশবাবুর কপালে বিরক্তির ভাব চলে আসলো। এই লোকই তার ঘুম ভাঙ্গার কারণ, সেটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো।
এরপর অনেক্ষণ কোনো কথা হলো না। প্রায় আধা ঘণ্টা বাদে ট্রেন চলা শুরু করলো। আকাশবাবু খুশি হলেন মনে মনে। একে তিনি ট্রেনের দুলোনিতে ঘুমাতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, জানালা দিয়ে ট্রেন কাটা বাতাস ছুটে আসছে।
সে ফের জানালা গলে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলো।
একের পর এক ক্ষেত পেছনে ফেলে ছুটে চলা চলন্ত ট্রেন।
দূরে দিগন্ত মিলে যাওয়া এক নাম না জানা নদী। চোখের দৃষ্টি ভালো থাকলে সেখানে পাল তুলে চলা দুটো নৌকার আভাস ধরা পড়বে।
ওদিকে ট্রেনের ভেতর পাশের বগি থেকে ভেসে আসছে পোলাওয়ের মিষ্টি ঘ্রাণ। সকালের নাস্তায় ৬টা লুচি খাওয়ার সুবাদে আকাশবাবুর ক্ষুধা উদ্রেক হচ্ছে না। নয়তো একেবারে ফেঁসে যেতো। লুচির কথা মনে হতেই তার ঢেঁকুর উঠলো।
হালকা চোখ মেলে দেখলো সামনে বসে থাকা লোকটা তার দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। কিন্তু চোখ দেখে বুঝা গেলো তার মন এখানে নেই। আপনমনে কিছু একটা ভাবছে সে।
ঠিক তখন ট্রেনের বিপরীত বেঞ্চের ওদিক থেকে অ্যাঁ বাদাম বাঁদাম স্বরের হাক ডাক শোনা গেল। আকাশবাবু মাথা ঘুরিয়ে তাকালো।
পুরো ট্রেনের কু ঝিক ঝিক বিলাপের মধ্যে এই বাদামওয়ালা যেন বেমানান ঢোল। তাই সবাই মাথা ঘুরিয়ে তাকে এক পলক দেখে নিলো। বাদামওয়ালার পিছু পিছু কাগজওয়ালাও আছে। একদিকে বেচারা বাদামওয়ালার হাঁককে কেউ আমলেই নিচ্ছে না। কেউ বাদাম কিনছেও না। কিন্তু কাগজওয়ালা কোনো হাঁক দেয়ার পূর্বেই দু’একজন ইনকিলাব, সন্দেশ, পূর্ব বাণী ইত্যাদি হাঁক দিয়ে কাগজ কিনে নিচ্ছে।
আকাশাবাবু মুচকি হেসে উঠলো। বাদামওয়ালা কাগজওয়ালা যেন তার জীবনের প্রতিচ্ছবি! যা চায়, তা পায় না। যা চায় না, তা উড়ে চলে আসে।
“এই বাদাম, এদিকে এক পোয়া দিয়ে যাও।” আকাশবাবু পকেট থেকে আধুলি বের করলো। বাদামওয়ালা একগাল হেসে এক ঠোঙ্গা এগিয়ে দিলো। তারপর পয়সা গুনে যেই না চলে যাচ্ছিলো, তখন ফের হাঁক পড়লো।
খন খনে গলায় বুড়ো লোকটা বাদামওয়ালাকে ডাকছে। তারও বাদাম দরকার।
এবার আকাশবাবু বুড়োকে ভালো করে লক্ষ করলো।
পরনে সাদা ধুতি। কালো জামা। গালের বামদিকে সামান্য সেলাইয়ের দাগ। সেটার কারণে তাকে আরো নিরীহ ঠাউর হচ্ছে।
সাথে কোনো থলে নেই। শুধু ধুতির কোঁচায় সামান্য কয়েকটি পয়সার ঝনঝনানি তার আবরণ হয়ে আছে।
বাদামের ঠোঙ্গা হাতে নিয়ে সে আবার আনমনে হয়ে যায়। এই সময়ের মাঝে বেশ কয়েকজন হকার চলে গেলো। কেউ কেউ মিষ্টি বিক্রি করছিলো। অনেকেই মুড়ি ভাজি নিয়ে এদিক ওদিক দু চার পয়সা কামিয়ে নিলো। আমি একের পর এক বাদাম খোসা ছাড়াচ্ছি আর জানালার বাইরে দিয়ে প্রকৃতির পরিবর্তন দেখছি। আধা ঘন্টার মধ্যে রৌদ্রোজ্জ্বল ভ্যাপসা গরম আবহাওয়া বদলে যেতে থাকলো। আকাশের কোণায় ধূসর মেঘ জমছে। তবে এখনি বৃষ্টি হবে না।
বৃষ্টি হলে প্রকৃতি আগে থেকেই জানান দেয়। খেয়াল করলে বাতাসে মাটির সোদা গন্ধটুকু শুষে নেয়া যায়। ভেজা বাতাস কেমন ভারি হয়ে উঠে। সেই মেঘলা প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিতে আকাশ থেকে টিপ টিপ করে দু এক ফোঁটা পড়বে। সেদিকে তাকিয়ে ঠাহর করার সাথে সাথে ঝুপ করে বড় বড় ফোঁটার আর্দ্র আক্রমণে গরু ছাগল মানুষ সবাই ছুটোছুটি শুরু করে।
আকাশাবাবু দাঁড়িয়ে গেল। বাদামের ঠোঙ্গাখানা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো। সামনের বুড়ো তখনও বাদাম চিবুচ্ছে। বেশ ধীরগতিতে বাদাম খাওয়া দৃশ্য দেখে কেন জানি মায়া হয়।
কামরার দরজা খুলে ডানদিকে করিডোর ধরে হাঁটা শুরু করলো সে। ট্রেনের বারান্দায় দু একজন দাঁড়িয়ে গল্প করছিলো। তাকে দেখে কেমন নিচুস্বরে তারা বিপরীত দিকে চলে গেল। অন্য সময় হলে সে অবাক হতো, কিন্তু ট্রেনে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু না। হরেক কিসিমের মানুষ থাকে এখানে। সে ওদিকে তোয়াক্কা না করে শেষ মাথার দরজা খুলে টয়লেট আবিষ্কার করলো। ভেতরে ঢুকে খিল লাগাতে গিয়ে আরেক বিপত্তির মুখোমুখি হলো সে। কোন হতচ্ছাড়া দরজার খিল ভেঙে ফেলেছে। সেখানে শোভা পাচ্ছে পুরাতন ছন্নহীন চিকন দড়ি। সেটা দরজার ফুটোতে বিশেষ কায়দায় বাঁধন দিলে দরজা লেগে থাকে। তবুও ভরসা নেই। তাই আকাশবাবু গান গাওয়া শুরু করলো। আর যত সম্ভব শব্দ করে কাজ করতে থাকলো।
কাজ শেষ করে ড্রাম থেকে এক মগ পানি নিয়ে যেই মুখ ধুতে যাবেন, তখন ট্রেন মাটির পথ পেরিয়ে আচমকা এক ধাতব ব্রিজের উপর প্রত্যাবর্তন করলো। তাই অস্বাভাবিক ঝাঁকুনিতে দুলতে থাকলো ট্রেন। আর সেই ঝাঁকুনিতে আকাশবাবুর হাতের মগ কেঁপে উঠলো।
নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বেচারা বুঝি পড়েই যেত। তবে সেটা সামলে নিলো সে বেশ কায়দা করে। তবে ততক্ষণে তার শখের খাদির উপর মগের অর্ধেক জল বিসর্জিত হয়ে গেছে। বুকের শুরু থেকে হাঁটু পর্যন্ত কাপড় পানির ভেজা রঙ্গে রঙিন হয়ে গেলো।
“ধেৎ!” অকথ্য ভাষায় কয়েকটা গালি দিলো সে। মুখ ধোয়ার অভিলাষ ত্যাগ করে সে দ্রুত বের হয়ে আসলো সেই অভিশপ্ত টয়লেট থেকে। করিডরে তখন এক পিরান পরা ভদ্রলোক হেঁটে যাচ্ছিলো। তার এই হাল দেখে চুক চুক শব্দ করে স্বান্তনা দিলো।
মুখ কুঁচকে থাকা আকাশাবাবু হাতের কাছে কোনো কাপড় না পেয়ে দ্রুত ফিরে গেলো নিজের কামরায়।
দরজা খুলতেই বুড়ো ভদ্রলোক মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। তার নির্লিপ্ত চোখ দেখে বোঝার উপায় নেই তার অভিব্যক্তি কী। আকাশবাবু বেশ গোমড়া মুখে এদিক ওদিক তাকালো। কাপড়ের পানি অন্য আরেকটি কাপড় দিয়ে হালকা করে মুছে দিতে পারলো হতো। কিন্তু কোথাও কাপড় নেই। থাকার কথাও না। সে ট্রেনে আছে। কোনো দর্জির দোকানে না।
কামরার অন্যান্যরা যে যার যার কাজে ব্যস্ত। দুজন মহিলা মুখে কাপড় দিয়ে একে অপরের সাথে গল্প করছে। এদের একজনের কোলে একটি শিশু রয়েছে। শিশুটি বার কয়েক মাথা নেড়ে কোনো দুর্বোধ্য সাংকেতিক ভাষায় তাকে কিছু বলার চেষ্টা করলো। আকাশবাবু সামান্য মুচকি হাসি দিলো তার দিকে তাকিয়ে।
তারপর দ্রুত তার আসনে এসে বসে পড়লো।
এবার বুড়ো ভদ্রলোক তার আসনের পেছন থেকে পাতলা চটের থলেখানা বের করলো। তাজ্জব ব্যাপার! এর আগে এই থলেটা তার চোখে পড়েনি। বুড়ো কোন আক্কেলে থলেটার উপর বসে আছেন কে জানে?
বুড়ো লোকটা এবার থলে থেকে একটা গামছা বের করে আকাশবাবুর দিকে এগিয়ে দিলো। আকাশবাবু ডানহাত দিয়ে গামছাখানা নিয়ে সেটি দিয়ে বুকের অংশে লেগে থাকা পানি মুছতে থাকলো। তারপর ইতস্তত স্বরে বলে উঠলো, “ধন্যবাদ চাচা। এই টয়লেটে একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেলো”।
বুড়ো স্মিত হাসি দিয়ে মাথা নাড়লো। “এই ট্রেনে তুমি নতুন নাকি? বাঙ্গুরা ব্রিজের ঝাঁকুনিতে কেউ টয়লেটে বসে থাকে নাকি?”
“না ঠিক তা না। বাঙ্গুরার ঝাঁকিতে একবার হাতের সর্ষে শিশি পড়ে সর্বনাশ হয়ে গিয়েছিলো। আমি এই ঝাঁকির কথা জানি আজ্ঞে। কিন্তু মুখ ধোঁয়ার আগে খেয়াল করিনি কোথায় আছি”। গামছাখানা বুড়োর হাতে ফেরত দিল সে। মুখে কৃতজ্ঞতার ছাপ। একটু আগেও বুড়োর প্রতি রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে থাকা আকাশের চেহারায় কিছুটা শ্রান্ত ভাব চলে এসেছে। আশ্চর্যজনকভাবে সেই বিরক্তিটাও লাগছে না। উল্টো অনুশোচনা হচ্ছে। বেচারা বুড়োকে কি যাচ্ছেতাই বলছিলো সে মনে মনে।
“কোথায় যাওয়া হচ্ছে তোমার বাবা?”
“জ্বী আজ্ঞে! কলকাতা যাব। কিন্তু মাঝে রাস্তায় পিসির বাড়িতে একটা নিমন্ত্রণ পাওয়ায় সরাসরি ট্রেন নিতে পারলাম না। আমি কলকাতাতে ব্যবসা করি চাচা”।
“কলকাতার আমার এককালে ব্যবসা ছিল। কিসের ব্যবসা করো তুমি? আমি আবার পাটের থলে বিক্রি করতাম। বেশ বড় আড়ত ছিল আমার। এখন অবশ্য পুরোটাই রাজশাহীতে নিয়ে এসেছি। ওখানের আবহাওয়া আমার বয়সে মানে না বাবা”।
লোকটার চামড়ার ভাঁজ দেখে তার কথার সত্যতা যাচাই করা যায়। বয়স বেড়ে গেলে সবধরনের তাপমাত্রা এই চামড়া সইতে পারবে না সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়। আকাশবাবু ফের বাইরের দিকে তাকালো। আকাশে মেঘ জমে ঘনীভূত হয়ে আছে। বুড়ো এবার আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করে, “তা বাবা তোমার নামটা কী?”
বুড়োর দিকে একপলক তাকালো সে। এরপর হু হু করে হেসে দিলো। তার হাসির শব্দে পাশের কোলে শুয়ে থাকা শিশুটা বেশ মজা পেলো। সেও ‘আই আই হ উ’ ইত্যাদি ধ্বনিতে অভিবাদন জানালো আকাশবাবুকে।
বুড়ো অবশ্য খানিকটা ভড়কে গেলো। তার চোখে তখন অনিশ্চয়তা। কোনো ভুল করলো কি না সে উত্তর খুঁজছে হাতড়ে।
আকাশবাবু বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। “এতক্ষণ ধরে আমি আমার নাম বলিনি সেটা বলবেন না! আমি আকাশ। পুরো নাম আকাশ ইন্দু।” এই বলে পাশের শিশুটার দিকে স্মিত হাসি দিল সে। শিশুর মা কাপড়ের আড়াল থেকে তাকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে দেখছে। আর যাই হোক, হো হো করে অভদ্রের মতো হেসে উঠা মানুষ সুবিধার না।
“তা তোমার পিসির বাড়ি কোথায় বাবা?”
“জ্বি সেটা গুরগাওতে। আর দুই স্টেশন বাদেই। প্রতি ছয়মাসে কোনো না কোনো কাজে সেখানে একবার আমার যাওয়া লাগেই”।
বুড়ো তার অমায়িক হাসিমাখা মুখে অনবরত তাকিয়ে আছেন। অনেক মানুষ থাকে যাদের মুখ থেকে হাসির ভাবটা কখনোই হারিয়ে যায় না। বোধহয় এদের কাছেই পৃথিবীটা খুব সুন্দর। হয়তো এদের হাসির জন্যই সকালে পূর্ব আকাশ রাঙ্গা করে সূর্য সজাগ হয়।
“তা কাকা আপনি কোথায় যাচ্ছেন? সামনের স্টেশন তো সোপানগঞ্জ। সেখানে আপনার কোন ব্যবসা আছে?”
“না বাবা! সেখানে ব্যবসা কিছু নেই। আমি প্রতি মাসে একবার সেখানে যাই। আমার বাবার কিছু জমি আছে সেখানে। এবারের মৌসুমে সেখানে আলুর বীজ বুনেছি। গত দুই মৌসুম ধরে ধান চাষ করেও তেমন সুবিধা করতে পারি নাই। তাই এবার ভাবলাম আলু চাষ করে দেখি”। বুড়োর বাদাম খাওয়া শেষ। সে হাতের শেষ বাদামটা খোসা ছাড়িয়ে পাশের সিটে বসা এক খোকাকে দিয়ে দিলো। খোকা নিতে চাচ্ছিলো না। হাত দুটো শক্ত করে পেছনে লুকিয়ে রাখা হচ্ছিলো। পরবর্তীতে তার মা-গোছের কারো নির্দেশে সেটা বেরিয়ে আসলো। চিলের মতো ছোঁ দিয়ে বাদাম ছিনিয়ে নিয়ে সেটার দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইলো সে। সেদিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো আকাশবাবু। বুড়ো ধুতির কোণা দিয়ে নাক মুছলো।
ভবানীপুর টু কলকাতা ট্রেন ছুটে চলছে অবিরাম। পেছনে ফেলে সব গ্রাম গ্রামান্তর।
ছুটে চলে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে অনেক খোকা দূর থেকে অভিবাদন করছে হাত নেড়ে।
ঘাস খেতে থাকা গরুগুলো মাথা তুলে তাকালো মাত্র। হয়তো হঠাৎ ট্রেনের বিকট শব্দে তাদের টনক নড়েছে।
ওদিকে আকাশের মেঘ ঘন হয়ে ধীরে ধীরে চারদিক অন্ধকার করে ফেলছে।
ট্রেনের ভেতর প্রতিটা কামরায় মানুষজনের গুঞ্জনে মুখর। আকাশাবাবুর মতো অনেকেই গল্প করছে। অনেকে ঘুমোচ্ছে বেঘোর। করিডোর দিয়ে ট্রেনের টি টি ময়লা ইউনিফর্ম পরে হেঁটে টহল দিচ্ছে এদিক ওদিক। তার হাতে জরিমানার রশিদ বই। সেখান থেকে পাঁচটি পাতা ছেঁড়া।
সন্দেহজনক সেই লোকগুলো এখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করে যাচ্ছে। কেউ টয়লেটের দিকে এগিয়ে গেলে তারা কোনো এক অজানা কারণে অন্যত্র প্রস্থান করছে সাময়িকভাবে।
ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা দ্রুত ছুটে যাচ্ছে সংখ্যার সাড়ি ধরে। তার পিছু ধীর গতিতে এগুচ্ছে মিনিটের কাঁটা।
সবকিছু অবিরাম চললে ব্যাপারটা মন্দ হতো না। কিন্তু তা কখনো হয় না। প্রকৃতির অঘোষিত এই নিয়মকে সমর্থন জানিয়ে অবিরাম ছুটে চলা ট্রেনও ধীরে ধীরে থামতে থাকে। প্রথমে ট্রেনের দুলোনি কিছুটা কমে আসে। তার সাথে সাথে কু ঝিক ঝিক রব কাঁটা পড়ে এক অদ্ভুত গোঙানিতে রূপ নেয়। আকাশবাবু জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। সবুজ ফসলী জমির বদলে এখন সেখানে শোভা পাচ্ছে লাল ইটের বেশ কয়েকটি অফিস দালান। সোপানগঞ্জ স্টেশন এসে পড়েছে ট্রেন। এখানে কম করে হলেও ট্রেন ২০ মিনিটের মতো থেমে থাকবে। কারণ সামনেই জংশন। কলকাতা ফেরত কাগমারী এক্সপ্রেস সেটা ক্রস করা পর্যন্ত এখানেই যাত্রাবিরতি।
বুড়ো এবার তার চিকন থলে সমেত উঠে দাঁড়ালো। পাশের বেঞ্চের অনেকেই উঠে পড়লো। তবে সেই শিশুসমেত মা শুধু বসে থাকলো। তারা বোধহয় কলকাতায় নামবে। আর নাহয় ভবানিপুর স্টেশন। কে জানে কোথায় নামবে!
“তা বাবা উঠি এখন। চলে আসলাম”। বুড়ো সামান্য মাথা নিচু করে নমস্কার জানালো। আকাশবাবুও তার সাথে উঠে পড়লো।
“চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। ট্রেন তো আরো ১০-১৫ মিনিট পরে ছাড়বে”। বুড়ো থলেটা নিজের হাতে নিলো সে। জায়গা বুকিং-এর চিহ্নস্বরূপ আকাশবাবু তার থলেটা আড়াআড়িভাবে আসনে বিছিয়ে রাখলো। তারপর দুজনে নেমে পড়লো ট্রেন থেকে।
“আপনার বাড়ি কোনদিকে চাচা?”
“বাড়ি না তো। জমি। কয়েকটা ক্ষেত আর কি”। আকাশবাবু জিভ কাটলো। এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলো সে। “ওহ চাচা! ভুলে গিয়েছিলাম। তা সেটা কোনদিকে?”
বুড়ো আঙুল দিয়ে দক্ষিণ দিকে ইশারা করলো। সেখানে বেশ লম্বা একটা রাস্তা সোজা গ্রামের ভেতর ঢুকে গেছে। সেদিকে এগুতে থাকলো আকাশবাবু। তখন বুড়ো বাধা দিলো। “এতদূর যেয়ে তোমার কাজ নেই বাবা। এর চেয়ে বরং ওই চায়ের দোকানটায় বসি। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করা যাবে। তোমার পাঞ্জাবিটাও বেশ শুকিয়ে গেছে দেখা যাচ্ছে”।
আকাশবাবু নিজের বুকের দিকে তাকালো। এখনও কিছুটা ভেজা ভেজা ভাব রয়েছে। তবে কিছুক্ষণের মাঝেই শুকিয়ে যাবে। আকাশের মেঘ ভেদ করে এক চিলতে রোদ এসে পড়লো স্টেশনের চালে। নতুন চাল বলে সেটা বেশ ঝলমল করে উঠেছে। তবে পরক্ষণেই পুনরায় সেটা মেঘের মাতব্বরিতে হারিয়ে গেলো।
দুজন গিয়ে বসে পড়লো চায়ের দোকানে। দোকানি বুড়োকে বেশ আগে থেকেই চিনে বোধহয়। তাই বসামাত্রই লম্বা সালাম ঠুকে দিলো। সালাম শুনে আকাশবাবু তাকালো দোকানির দিকে। তার মাথায় তালপাতার তৈরি টুপি পরা। মুসলমান লোক। সোপানগঞ্জের এদিকে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। ভেতরের দিকে গেলে কিছু হিন্দু পরিবার রয়েছে। তবে তারা বেশিরভাগই কলকাতা থাকে বলে এখানে বেশি দেখা যায় না।
বুড়ো সালামের উত্তরে হাত জোড় করে নমস্কার দিয়ে হালকা কুশল বিনিময় করে নিলো। চাওয়ালা ভদ্রতার খাতিরে জানালো তার দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। শরীরও নাকি আর মানায় না। আকাশবাবু আনমনে বসে থাকে। আর কি সব সাতপাঁচ ভাবে। চায়ের দোকানের সামনে বেশ বড় একটি দেয়াল। সেখানে সদ্য চুনকামের ছাপ দেখা যাচ্ছে। দেয়ালের উপর বেশ বড় করে লাল রঙ দিয়ে কর্তৃপক্ষ লিখে দিয়েছে, দেয়ালে পোস্টার লাগানো নিষেধ। সেই নিষেধাজ্ঞা যেন এক ভেলকিবাজি। দেয়ালের এই লাল লেখাটি যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে সবাইকে পোস্টার লাগানোর জন্য। কারণ সেই লেখার নিচেই বেশ ঘটা করে তিনটি পোস্টার লাগানো।
একটিতে সাদাকালো একটি শহুরে ছবি স্কেচ করা। নিচে কালো মোটা অক্ষরে আবাসন প্রকল্পের বিজ্ঞাপন সাঁটা। লাল হরফে ‘সীমিত’ লেখাটি দেখে খুব মজা লাগলো। আর দ্বিতীয় পোস্টারটিতে এক কবিরাজ মশাই তার বিভিন্ন কেরামতি নিয়ে সাফাই গেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। আকাশবাবু রীতিমত মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকলো।
সাপের বিষ নামানো।
ভূত তাড়ানো। অবাধ্য মেয়েকে বশীকরণ।
রাহুর গ্রাস থেকে মুক্তি।
অনিদ্রা অশ্ব গেজ ভগন্দর থেকে পরিত্রাণ মন্ত্র। ভগ্ন শরীরে বলদায়ক টনিক...... ইত্যাদির ফর্দ দিয়ে ভরা পোস্টারখানা।
নিচে বড় করে কবিরাজ নাগ বিধুর নাম লেখা। ঠিকানা দেয়া নিতাইগঞ্জ বটতলা। সোপানগঞ্জ।
আকাশবাবুর চা প্রস্তুত হয়ে গেলো। সে চায়ে চুমুক দিতে দিতে তৃতীয় পোস্টারে চোখ বুলাচ্ছিলো। অন্যান্য পোস্টারের চেয়ে এই পোস্টারটা বেশি নজর কাড়ে। কারণ, এর উপরে শিরোনামে লেখা- ‘একে ধরিয়ে দিন’।
আকাশবাবু সুরুৎ শব্দে চায়ে চুমুক দিলো। বুড়ো তার চায়ের কাপে ফু দিয়ে ঠান্ডা করতে থাকলো। সেও আকাশবাবুর দেখাদেখি পোস্টার দেখতে লাগলো। দোকানি গরম পানি আনার জন্য দোকানের পেছনে লাকড়ির চুলাঘরে চলে গেলো।
পোস্টারে পেন্সিল স্কেচে আঁকা এক তরুণের ছবি। বয়স তার বেশি হলে আকাশবাবুর সমানই বা হবে। চেহারায় নিষ্পাপ ভাব ফুটে উঠেছে। তার অপরাধ নিয়ে কোনো বিবরণ দেয়া নেই। সাধারণত এসব পোস্টারে অপরাধীর সকল কুকীর্তির মোটামুটি সাইজের একটা ফর্দ জুড়ে দেয়া হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে এমন কিছু দেখা গেলো না।
এমনকি নামও দেয়া নেই। এমন তো হবার কথা না।
নিচে ছোট করে যোগাযোগের ঠিকানা দেয়া- ‘সোপানগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ি’। উপযুক্ত ইনামের লোভনীয় ঘোষণাটুকুও দেখা যাচ্ছে না।
নিতান্তই অলসতাবশত পোস্টার আঁকা হয়েছে বলে মনে হলো তার। বিশেষ করা কলকাতার মণ্ডল লেনের প্রতিটি দেয়ালে এরূপ পোস্টারে ছাওয়া। সেখানে পারলে অপরাধীর বাপ দাদার নামসহ লিখে দেয়। উচ্চতা থেকে শুরু করে শনাক্তকরণ চিহ্ন দিয়ে বেশ ভারিক্কি পোস্টার তৈরি করা হয় যে, যে কেউ একপলক পোস্টার দেখলে পুরো জ্বলজ্যান্ত মানুষটাকে নিজের চোখের সামনে নাচতে দেখে।
“তা বাবা তোমার কি নাগ বিধুর দাওয়াই লাগবে নাকি?” বুড়ো বেশ হাসির সাথে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। বুড়োর প্রশ্নে যেন ঘুম থেকে উঠলো আকাশবাবু। বোকার মতো চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে ঠোঁট পুড়ে গেলো তার। দোকানি তখন গরম পানির ডেকচি হাতে ফিরছিলো। সে পুরো কথোপকথন শুনতে পেয়েছিলো। তাই সে হো হো করে হাসতে থাকলো। “এবার সত্যি সত্যিই লাগবে, ভাতিজা চলো নাগের কাছে”। এই বলে আকাশবাবুর পুড়ে যাওয়া ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। সেটায় হালকা করে আঙুল বুলাচ্ছিলো আকাশবাবু।
“না চাচা। ওরকম কিছু না। এমনেই চলে যাবে। ঠাণ্ডা জল দিয়ে দু এক মিনিট ধরে রাখলেই হবে বৈকি। তাছাড়া বাসায় মেন্থল গুড়ো আছে। বেশি কালো হয়ে গেলে সেটা দিতে পারি”।
“বাসায় তো ফিরবে অনেক বাদে। না কি? এর আগে তোমার কি না নেমন্তন্ন আছে বললে”। বুড়োর কথায় যুক্তি আছে। ততদিনে সেটা পেকে যেতে পারে। তবে এর মানে এই না তাকে কোনো তন্ত্রমন্ত্র পড়া ভুয়া কবিরাজের কাছে ধর্ণা দিতে হবে। সেটা আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো আকাশবাবু।
দোকানি শক্ত তক্তার উপর বসে কাপগুলো পানি দিয়ে খলিয়ে নিচ্ছিলো। হঠাৎ তার চোখ পোস্টারের দিকে আটকে গেলো। ব্যাপারটা প্রথমে লক্ষ করলো বুড়ো লোকটা। সে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দেখলো দোকানিকে।
আকাশবাবু তখন দিব্যি চা খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। ট্রেন ছাড়ারও সময় হয়ে এলো বোধহয়। এজন্যে তার তাড়া। তবে চায়ের কাপ ফেরত দেয়ার সময় সেও ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো। “কী ব্যাপার চাচাজী? দেয়ালে তাকিয়ে আছেন যে! ওখানে কী হয়েছে?”
দোকানি আকাশের ডাকে সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। তারপর এক গাল হেসে উত্তর দিলো, “ও কিছু না বাবা। পোস্টার পড়ছিলুম। যদিও নেখাপরা কিস্যু শিখিনি। তবে পোস্টারের ছবি দেখছিলাম”।
বুড়ো লোকটা তখনও তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সে অস্থির হয়ে উঠলো। সে আকাশের পাঞ্জাবির কোণা খামচে ধরে উঠলো। দোকানি লাফিয়ে উঠলো প্রায়। সে ভেবেছিলো বুড়োর খিঁচুনি লেগে গেছে। কিন্তু না। বুড়ো সুস্থই আছে।
আকাশবাবু হা হয়ে গেলো। “এ কি করছেন চাচা। ছাড়ুন। পাঞ্জাবিটা ছিঁড়ে যাচ্ছে তো”। বলতে না বলতেই ‘ফেৎ’ করে পাঞ্জাবির কোণা ছিঁড়ে গেলো। আকাশবাবু হা হা করে উঠলো। এ কী ধরনের কান্ড! বুড়ো এরকম করলো কেনো?
বুড়ো যেন বলার ভাষা হারিয়ে ফেলছে। বহু কষ্টে মুখে বোল এনে সে প্রায় চাপাস্বরে বললো, “আকাশ ফাকাশ এসব মিথ্যাচারী ছাড়ো। কে তুমি বাবা? এক্ষুনি বলো! নয়তো পুলিশে ধরিয়ে দেবো”।
আকাশবাবু ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। সে কিছু বুঝতে পারলো না। বোঝার কথাও না। হঠাৎ পাগলামি করা বুড়োর দিকে সে বোকার মতো তাকিয়ে থাকলো। ডান হাত তার তখনও ঠোঁটের উপর। পুড়ে যাওয়া অংশ সামান্য জ্বালা করছে। দোকানি কাঁধের উপর গামছা দিয়ে তক্তা থেকে নেমে আসলো। সে কাহিনীর হারানো অংশ খুঁজে পেতে উন্মুখ। কী হলো আসলে?
বুড়ো তখন কাঁপা কাঁপা হাতে পোস্টারের দিকে তর্জনী আঙুল তুলে দেয়। তার আঙুল দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো সে কোন পোস্টারের দিকে ইশারা করছে। সেই ধরিয়ে দেন শিরোনামওয়ালা পোস্টার। যার উপর নিচে নাম ঠিকানা কিছুই লেখা নেই। শুধু জ্বলজ্বল করছে একটি জ্বলজ্যান্ত তরুণের পেন্সিল স্ক্যাচ। বড্ড অবোধ্য সেই স্কেচের মতো দেখতে আরো হাজারটা মানুষ থাকতে পারে। ঘুরিয়ে যদি বলি, হাজারখানের মানুষের সাথে সেই স্কেচের মিল খুঁজে পাওয়া যাওয়ার কথা। কিন্তু বুড়ো সে কথা মানতে নারাজ। স্ক্যাচের সেই অপরাধী নাকি চা খেতে চলে আসা গুরগাওগামী আকাশবাবু!
কী সাঙ্ঘাতিক কথা। আকাশবাবুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। “কী যা তা বলছেন চাচা”। দোকানির দিকে তাকিয়ে সে কাষ্ঠ হাসি দিয়ে বললো, “চাচাজি আপনিই বলুন না”।
কিন্তু দোকানি কিছু বলছে না। সে কী আর বলবে। তার কাছেও তো স্কেচের সেই অপরাধীর সাথে আকাশের বড্ড মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। আকাশবাবু বুঝলো অবস্থা সুবিধার না। এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব তার কেটে পড়া উচিত।
“চাচা আমি তাহলে আসি। আমার আবার ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। নমস্কার চাচা। আদাব চাচাজী”। এই বলে সে ট্রেনের দিকে দ্রুত হাঁটতে থাকলো। পেছনে বোকার মতো তাকিয়ে আছে এক বুড়ো, যার মুখে সদা লেগে থাকা হাসির ঝিলিক প্রায় দশ বছরের মাথায় প্রথমবারের মতো উধাও হয়ে গেছে। আর ইতস্তত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক মুসলিম চাওয়ালা।
জীবনে কখনো সে এত সামনে থেকে কোনো অপরাধী দেখেনি বলেই তার উত্তেজনা তাকে কাবু করে ফেলছে।
কলকাতাগামী ট্রেনটা তখন হালকা করে কেঁপে উঠলো। আকাশবাবু প্রায় ছুটে এসে সেটাতে উঠে গেলো।
দূর থেকে হুইসেলের শব্দ কানে ভেসে আসছে। আকাশবাবু তখনও সামলে উঠতে পারেনি। সে বড় বড় দম নিতে থাকলো।
ছেঁড়া পাঞ্জাবি গায়ের মানুষটাকে দেখে করিডোরের দু’একজন মানুষ বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
সেদিকে বেশ মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে আছে বিশাল দেহধারী এক জোয়ান লোক। শুধু সে না। তার সাথে আরো অনেকে আছে।
বিশ থেকে ত্রিশজনের একটা দল রেলপথের দুদিকে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকে তাদের বন্দুক পরীক্ষা করে দেখছে।
সবার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে তাদের সর্দার।
সে বারবার মানচিত্র দেখে মিলিয়ে নিচ্ছে। আর মনে মনে আন্দাজ করে নিচ্ছে ট্রেনের অবস্থান।
কলকাতাগামী ট্রেন এদিক দিয়েই যাওয়ার কথা। প্রতি মাসে একবার করে দেশ ঘুরে তারা ট্রেন ডাকাতি করে বেড়ায়।
ডাকাতি তাদের রক্তে মিশে আছে। প্রায় তিন পুরুষের পেশা বলে কথা।
সূর্যের খাড়া রশ্মির কারণে মাটির উপর বেশ ঘন পরিষ্কার ছায়া পড়েছে। সেদিকে তাকিয়ে সময়ের হিসাব করলো সর্দার।
ঘন্টাখানেকের মধ্যেই ট্রেন চলে আসবে। তার ইশারা অনুযায়ী একদল চলে গেলো সোপানগঞ্জ স্টেশনের দিকে।
এখন রওয়ানা দিলে সময়মতো সেখানে পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। তাদের চলে যাওয়ার দিকে অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে রইলো সে। একদম দিগন্তে মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকলো
*******************
প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন আকাশবাবু। অনেকক্ষণ ধরে ট্রেনের মৃদু ঝাকুনিতে শান্তিময় ঝিমুনি দিচ্ছিলেন। তার মাথাটা টপ্পাগানের ঢোলের ন্যায় তাল মিলিয়ে দুলছিলো সেই কখন থেকে। সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল পাশের সিটে মায়ের কোলে বসে থাকা ৫ বছর বয়সী খুকি। খুকির চোখের সেই কৌতূহলী চাহনি দেখে মনে হচ্ছিলো, আকাশবাবু নয়, স্বয়ং নন্দিপাড়ার মোষ এসে ঝিমুচ্ছে!
আকাশবাবুর ঘুম ভাঙ্গার কারণ আমার জানা নেই। আকাশবাবু নিজেও তেমন বুঝতে পারলেন না। তবে এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে নিলেন।
ছোট একখানা কামরা।
মুখোমুখি দুই পর্যায়ের চারটি বেঞ্চ পাতা। সেগুলোতে তিনজন করে বসতে পারে।
দুটো বেঞ্চ হাউসফুল হলেও আকাশবাবু আর তার সামনের বেঞ্চে সম্মিলিত জনসংখ্যা মাত্র একজন।
ময়লা মেঝের উপর একগাদা বাদামের খোসা ফেলে কে যেন চম্পট দিয়েছে আগের স্টেশনে।
আর জানালার ভাঙা কাচ দিয়ে দেখা যায় দূরের শুকনো মাঠ। মাঠ দেখে বুঝা যায় এখন কোন মাস চলছে।
ট্রেন থেমে আছে এক অঘোষিত বিলম্বের অজুহাতে।
এই কামরার সবচেয়ে দক্ষিণের কোণার সিটে জানালার পাশে বসে আছেন আকাশবাবু। তার পরনে খাদি পাঞ্জাবি। স্বদেশি আন্দোলনের জের ধরে বেশ সস্তায় পেয়েছিলেন মেদিনীপুরে। তাই এক হিসেবে চারখানা কিনে ফেলা।
পাঞ্জাবির বুকের দিকে কোনো কাজ করা নেই। সেখানে সকাল থেকে অনবরত গরম থাকার প্রভাব পড়েছে। হালকা গাঢ় হয়ে যাওয়া স্থানের কাপড়খানা টান দিয়ে ধরে ভেতরে জোরে ফুঁ দিলেন তিনি।
হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গার কারণে শরীর জ্বর উঠার মতো গরম হয়ে আছে। তিনি থলের ভেতর থেকে চামড়ার মশক বের করে গলায় পানি ঢেলে নিলেন। যেন অসীম নরকের মাঝে একখণ্ড বরফ গলে পড়ে গেল, আর সকল দুঃখ দূর হতে থাকলো।
“দুঃখিত জনাব। আপনাকে জাগিয়ে দিলাম।”
আকাশবাবু চমকে উঠলো। কে? কে কথা বলে? তিনি মাথা ঘুরে এদিক ওদিক তাকালেন। কই! কেউ নাই তো। তিনি এবার মাথা বের করে দিলেন জানালা দিয়ে। যেদিকে চোখ যায় শুধু ক্ষেত আর ক্ষেত। মানুষ কেউ নাই।
আবার কে যেন বলে উঠলো, “এই যে জনাব। কাউকে খুঁজছেন?”
আকাশবাবু এবার আবিষ্কার করলো সামনের সিটে বসা এক ভদ্রলোককে। বেশ শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। বয়স ৭০ এর কাছাকাছি হবে হয়তো। চামড়া দেখে মানুষের বয়স আন্দাজ করে যা বলা গেলো আর কি।
“না মানে কে যেন কথা বলছিলো। ঘুম থেকে উঠলাম বলে বুঝতে পারলাম না কে বললো”,এই বলে আকাশবাবু আরো এক ঢোক পানি খেলেন। আজ বড্ড পিপাসা পেয়েছে তার।
লোকটা খনখনে গলায় হেসে উঠলো।
কী অদ্ভুত! এখানে হাসির কি আছে? এর আগে কাউকে পানি খেতে দেখেনি নাকি? আকাশবাবু পানির মশক ব্যাগে ঢুকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকলেন।
বুড়ো মানুষ হাসির চোটে কিছুক্ষণ কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো। তারপর বললো, “কে আবার কথা বলবে? আমিই বলেছি। খোলা মাঠে ট্রেন থামা দেখে উঠে পড়লাম কিছুক্ষণ আগে। আমি আবার সামনের স্টেশনেই যাচ্ছি।”
আকাশাবাবু কথা শুনলো মন দিয়ে। তারপর সামান্য মাথা ঝুকে প্রণাম করে নিলো। লোকটি এর প্রত্যুত্তরে হাত জোড় করে নমষ্কার জানালো। আকাশবাবুর কপালে বিরক্তির ভাব চলে আসলো। এই লোকই তার ঘুম ভাঙ্গার কারণ, সেটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো।
এরপর অনেক্ষণ কোনো কথা হলো না। প্রায় আধা ঘণ্টা বাদে ট্রেন চলা শুরু করলো। আকাশবাবু খুশি হলেন মনে মনে। একে তিনি ট্রেনের দুলোনিতে ঘুমাতে পারবেন। দ্বিতীয়ত, জানালা দিয়ে ট্রেন কাটা বাতাস ছুটে আসছে।
সে ফের জানালা গলে দৃষ্টিনিক্ষেপ করলো।
একের পর এক ক্ষেত পেছনে ফেলে ছুটে চলা চলন্ত ট্রেন।
দূরে দিগন্ত মিলে যাওয়া এক নাম না জানা নদী। চোখের দৃষ্টি ভালো থাকলে সেখানে পাল তুলে চলা দুটো নৌকার আভাস ধরা পড়বে।
ওদিকে ট্রেনের ভেতর পাশের বগি থেকে ভেসে আসছে পোলাওয়ের মিষ্টি ঘ্রাণ। সকালের নাস্তায় ৬টা লুচি খাওয়ার সুবাদে আকাশবাবুর ক্ষুধা উদ্রেক হচ্ছে না। নয়তো একেবারে ফেঁসে যেতো। লুচির কথা মনে হতেই তার ঢেঁকুর উঠলো।
হালকা চোখ মেলে দেখলো সামনে বসে থাকা লোকটা তার দিকে একমনে তাকিয়ে আছে। কিন্তু চোখ দেখে বুঝা গেলো তার মন এখানে নেই। আপনমনে কিছু একটা ভাবছে সে।
ঠিক তখন ট্রেনের বিপরীত বেঞ্চের ওদিক থেকে অ্যাঁ বাদাম বাঁদাম স্বরের হাক ডাক শোনা গেল। আকাশবাবু মাথা ঘুরিয়ে তাকালো।
পুরো ট্রেনের কু ঝিক ঝিক বিলাপের মধ্যে এই বাদামওয়ালা যেন বেমানান ঢোল। তাই সবাই মাথা ঘুরিয়ে তাকে এক পলক দেখে নিলো। বাদামওয়ালার পিছু পিছু কাগজওয়ালাও আছে। একদিকে বেচারা বাদামওয়ালার হাঁককে কেউ আমলেই নিচ্ছে না। কেউ বাদাম কিনছেও না। কিন্তু কাগজওয়ালা কোনো হাঁক দেয়ার পূর্বেই দু’একজন ইনকিলাব, সন্দেশ, পূর্ব বাণী ইত্যাদি হাঁক দিয়ে কাগজ কিনে নিচ্ছে।
আকাশাবাবু মুচকি হেসে উঠলো। বাদামওয়ালা কাগজওয়ালা যেন তার জীবনের প্রতিচ্ছবি! যা চায়, তা পায় না। যা চায় না, তা উড়ে চলে আসে।
“এই বাদাম, এদিকে এক পোয়া দিয়ে যাও।” আকাশবাবু পকেট থেকে আধুলি বের করলো। বাদামওয়ালা একগাল হেসে এক ঠোঙ্গা এগিয়ে দিলো। তারপর পয়সা গুনে যেই না চলে যাচ্ছিলো, তখন ফের হাঁক পড়লো।
খন খনে গলায় বুড়ো লোকটা বাদামওয়ালাকে ডাকছে। তারও বাদাম দরকার।
এবার আকাশবাবু বুড়োকে ভালো করে লক্ষ করলো।
পরনে সাদা ধুতি। কালো জামা। গালের বামদিকে সামান্য সেলাইয়ের দাগ। সেটার কারণে তাকে আরো নিরীহ ঠাউর হচ্ছে।
সাথে কোনো থলে নেই। শুধু ধুতির কোঁচায় সামান্য কয়েকটি পয়সার ঝনঝনানি তার আবরণ হয়ে আছে।
বাদামের ঠোঙ্গা হাতে নিয়ে সে আবার আনমনে হয়ে যায়। এই সময়ের মাঝে বেশ কয়েকজন হকার চলে গেলো। কেউ কেউ মিষ্টি বিক্রি করছিলো। অনেকেই মুড়ি ভাজি নিয়ে এদিক ওদিক দু চার পয়সা কামিয়ে নিলো। আমি একের পর এক বাদাম খোসা ছাড়াচ্ছি আর জানালার বাইরে দিয়ে প্রকৃতির পরিবর্তন দেখছি। আধা ঘন্টার মধ্যে রৌদ্রোজ্জ্বল ভ্যাপসা গরম আবহাওয়া বদলে যেতে থাকলো। আকাশের কোণায় ধূসর মেঘ জমছে। তবে এখনি বৃষ্টি হবে না।
বৃষ্টি হলে প্রকৃতি আগে থেকেই জানান দেয়। খেয়াল করলে বাতাসে মাটির সোদা গন্ধটুকু শুষে নেয়া যায়। ভেজা বাতাস কেমন ভারি হয়ে উঠে। সেই মেঘলা প্রকৃতির সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিতে আকাশ থেকে টিপ টিপ করে দু এক ফোঁটা পড়বে। সেদিকে তাকিয়ে ঠাহর করার সাথে সাথে ঝুপ করে বড় বড় ফোঁটার আর্দ্র আক্রমণে গরু ছাগল মানুষ সবাই ছুটোছুটি শুরু করে।
আকাশাবাবু দাঁড়িয়ে গেল। বাদামের ঠোঙ্গাখানা জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিলো। সামনের বুড়ো তখনও বাদাম চিবুচ্ছে। বেশ ধীরগতিতে বাদাম খাওয়া দৃশ্য দেখে কেন জানি মায়া হয়।
কামরার দরজা খুলে ডানদিকে করিডোর ধরে হাঁটা শুরু করলো সে। ট্রেনের বারান্দায় দু একজন দাঁড়িয়ে গল্প করছিলো। তাকে দেখে কেমন নিচুস্বরে তারা বিপরীত দিকে চলে গেল। অন্য সময় হলে সে অবাক হতো, কিন্তু ট্রেনে ব্যাপারটা অস্বাভাবিক কিছু না। হরেক কিসিমের মানুষ থাকে এখানে। সে ওদিকে তোয়াক্কা না করে শেষ মাথার দরজা খুলে টয়লেট আবিষ্কার করলো। ভেতরে ঢুকে খিল লাগাতে গিয়ে আরেক বিপত্তির মুখোমুখি হলো সে। কোন হতচ্ছাড়া দরজার খিল ভেঙে ফেলেছে। সেখানে শোভা পাচ্ছে পুরাতন ছন্নহীন চিকন দড়ি। সেটা দরজার ফুটোতে বিশেষ কায়দায় বাঁধন দিলে দরজা লেগে থাকে। তবুও ভরসা নেই। তাই আকাশবাবু গান গাওয়া শুরু করলো। আর যত সম্ভব শব্দ করে কাজ করতে থাকলো।
কাজ শেষ করে ড্রাম থেকে এক মগ পানি নিয়ে যেই মুখ ধুতে যাবেন, তখন ট্রেন মাটির পথ পেরিয়ে আচমকা এক ধাতব ব্রিজের উপর প্রত্যাবর্তন করলো। তাই অস্বাভাবিক ঝাঁকুনিতে দুলতে থাকলো ট্রেন। আর সেই ঝাঁকুনিতে আকাশবাবুর হাতের মগ কেঁপে উঠলো।
নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বেচারা বুঝি পড়েই যেত। তবে সেটা সামলে নিলো সে বেশ কায়দা করে। তবে ততক্ষণে তার শখের খাদির উপর মগের অর্ধেক জল বিসর্জিত হয়ে গেছে। বুকের শুরু থেকে হাঁটু পর্যন্ত কাপড় পানির ভেজা রঙ্গে রঙিন হয়ে গেলো।
“ধেৎ!” অকথ্য ভাষায় কয়েকটা গালি দিলো সে। মুখ ধোয়ার অভিলাষ ত্যাগ করে সে দ্রুত বের হয়ে আসলো সেই অভিশপ্ত টয়লেট থেকে। করিডরে তখন এক পিরান পরা ভদ্রলোক হেঁটে যাচ্ছিলো। তার এই হাল দেখে চুক চুক শব্দ করে স্বান্তনা দিলো।
মুখ কুঁচকে থাকা আকাশাবাবু হাতের কাছে কোনো কাপড় না পেয়ে দ্রুত ফিরে গেলো নিজের কামরায়।
দরজা খুলতেই বুড়ো ভদ্রলোক মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। তার নির্লিপ্ত চোখ দেখে বোঝার উপায় নেই তার অভিব্যক্তি কী। আকাশবাবু বেশ গোমড়া মুখে এদিক ওদিক তাকালো। কাপড়ের পানি অন্য আরেকটি কাপড় দিয়ে হালকা করে মুছে দিতে পারলো হতো। কিন্তু কোথাও কাপড় নেই। থাকার কথাও না। সে ট্রেনে আছে। কোনো দর্জির দোকানে না।
কামরার অন্যান্যরা যে যার যার কাজে ব্যস্ত। দুজন মহিলা মুখে কাপড় দিয়ে একে অপরের সাথে গল্প করছে। এদের একজনের কোলে একটি শিশু রয়েছে। শিশুটি বার কয়েক মাথা নেড়ে কোনো দুর্বোধ্য সাংকেতিক ভাষায় তাকে কিছু বলার চেষ্টা করলো। আকাশবাবু সামান্য মুচকি হাসি দিলো তার দিকে তাকিয়ে।
তারপর দ্রুত তার আসনে এসে বসে পড়লো।
এবার বুড়ো ভদ্রলোক তার আসনের পেছন থেকে পাতলা চটের থলেখানা বের করলো। তাজ্জব ব্যাপার! এর আগে এই থলেটা তার চোখে পড়েনি। বুড়ো কোন আক্কেলে থলেটার উপর বসে আছেন কে জানে?
বুড়ো লোকটা এবার থলে থেকে একটা গামছা বের করে আকাশবাবুর দিকে এগিয়ে দিলো। আকাশবাবু ডানহাত দিয়ে গামছাখানা নিয়ে সেটি দিয়ে বুকের অংশে লেগে থাকা পানি মুছতে থাকলো। তারপর ইতস্তত স্বরে বলে উঠলো, “ধন্যবাদ চাচা। এই টয়লেটে একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেলো”।
বুড়ো স্মিত হাসি দিয়ে মাথা নাড়লো। “এই ট্রেনে তুমি নতুন নাকি? বাঙ্গুরা ব্রিজের ঝাঁকুনিতে কেউ টয়লেটে বসে থাকে নাকি?”
“না ঠিক তা না। বাঙ্গুরার ঝাঁকিতে একবার হাতের সর্ষে শিশি পড়ে সর্বনাশ হয়ে গিয়েছিলো। আমি এই ঝাঁকির কথা জানি আজ্ঞে। কিন্তু মুখ ধোঁয়ার আগে খেয়াল করিনি কোথায় আছি”। গামছাখানা বুড়োর হাতে ফেরত দিল সে। মুখে কৃতজ্ঞতার ছাপ। একটু আগেও বুড়োর প্রতি রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে থাকা আকাশের চেহারায় কিছুটা শ্রান্ত ভাব চলে এসেছে। আশ্চর্যজনকভাবে সেই বিরক্তিটাও লাগছে না। উল্টো অনুশোচনা হচ্ছে। বেচারা বুড়োকে কি যাচ্ছেতাই বলছিলো সে মনে মনে।
“কোথায় যাওয়া হচ্ছে তোমার বাবা?”
“জ্বী আজ্ঞে! কলকাতা যাব। কিন্তু মাঝে রাস্তায় পিসির বাড়িতে একটা নিমন্ত্রণ পাওয়ায় সরাসরি ট্রেন নিতে পারলাম না। আমি কলকাতাতে ব্যবসা করি চাচা”।
“কলকাতার আমার এককালে ব্যবসা ছিল। কিসের ব্যবসা করো তুমি? আমি আবার পাটের থলে বিক্রি করতাম। বেশ বড় আড়ত ছিল আমার। এখন অবশ্য পুরোটাই রাজশাহীতে নিয়ে এসেছি। ওখানের আবহাওয়া আমার বয়সে মানে না বাবা”।
লোকটার চামড়ার ভাঁজ দেখে তার কথার সত্যতা যাচাই করা যায়। বয়স বেড়ে গেলে সবধরনের তাপমাত্রা এই চামড়া সইতে পারবে না সেটা নিশ্চিত করে বলা যায়। আকাশবাবু ফের বাইরের দিকে তাকালো। আকাশে মেঘ জমে ঘনীভূত হয়ে আছে। বুড়ো এবার আমতা আমতা করে জিজ্ঞাসা করে, “তা বাবা তোমার নামটা কী?”
বুড়োর দিকে একপলক তাকালো সে। এরপর হু হু করে হেসে দিলো। তার হাসির শব্দে পাশের কোলে শুয়ে থাকা শিশুটা বেশ মজা পেলো। সেও ‘আই আই হ উ’ ইত্যাদি ধ্বনিতে অভিবাদন জানালো আকাশবাবুকে।
বুড়ো অবশ্য খানিকটা ভড়কে গেলো। তার চোখে তখন অনিশ্চয়তা। কোনো ভুল করলো কি না সে উত্তর খুঁজছে হাতড়ে।
আকাশবাবু বুঝতে পারলো ব্যাপারটা। “এতক্ষণ ধরে আমি আমার নাম বলিনি সেটা বলবেন না! আমি আকাশ। পুরো নাম আকাশ ইন্দু।” এই বলে পাশের শিশুটার দিকে স্মিত হাসি দিল সে। শিশুর মা কাপড়ের আড়াল থেকে তাকে সন্দেহজনক দৃষ্টিতে দেখছে। আর যাই হোক, হো হো করে অভদ্রের মতো হেসে উঠা মানুষ সুবিধার না।
“তা তোমার পিসির বাড়ি কোথায় বাবা?”
“জ্বি সেটা গুরগাওতে। আর দুই স্টেশন বাদেই। প্রতি ছয়মাসে কোনো না কোনো কাজে সেখানে একবার আমার যাওয়া লাগেই”।
বুড়ো তার অমায়িক হাসিমাখা মুখে অনবরত তাকিয়ে আছেন। অনেক মানুষ থাকে যাদের মুখ থেকে হাসির ভাবটা কখনোই হারিয়ে যায় না। বোধহয় এদের কাছেই পৃথিবীটা খুব সুন্দর। হয়তো এদের হাসির জন্যই সকালে পূর্ব আকাশ রাঙ্গা করে সূর্য সজাগ হয়।
“তা কাকা আপনি কোথায় যাচ্ছেন? সামনের স্টেশন তো সোপানগঞ্জ। সেখানে আপনার কোন ব্যবসা আছে?”
“না বাবা! সেখানে ব্যবসা কিছু নেই। আমি প্রতি মাসে একবার সেখানে যাই। আমার বাবার কিছু জমি আছে সেখানে। এবারের মৌসুমে সেখানে আলুর বীজ বুনেছি। গত দুই মৌসুম ধরে ধান চাষ করেও তেমন সুবিধা করতে পারি নাই। তাই এবার ভাবলাম আলু চাষ করে দেখি”। বুড়োর বাদাম খাওয়া শেষ। সে হাতের শেষ বাদামটা খোসা ছাড়িয়ে পাশের সিটে বসা এক খোকাকে দিয়ে দিলো। খোকা নিতে চাচ্ছিলো না। হাত দুটো শক্ত করে পেছনে লুকিয়ে রাখা হচ্ছিলো। পরবর্তীতে তার মা-গোছের কারো নির্দেশে সেটা বেরিয়ে আসলো। চিলের মতো ছোঁ দিয়ে বাদাম ছিনিয়ে নিয়ে সেটার দিকে কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে রইলো সে। সেদিকে তাকিয়ে হেসে উঠলো আকাশবাবু। বুড়ো ধুতির কোণা দিয়ে নাক মুছলো।
ভবানীপুর টু কলকাতা ট্রেন ছুটে চলছে অবিরাম। পেছনে ফেলে সব গ্রাম গ্রামান্তর।
ছুটে চলে ট্রেনের দিকে তাকিয়ে অনেক খোকা দূর থেকে অভিবাদন করছে হাত নেড়ে।
ঘাস খেতে থাকা গরুগুলো মাথা তুলে তাকালো মাত্র। হয়তো হঠাৎ ট্রেনের বিকট শব্দে তাদের টনক নড়েছে।
ওদিকে আকাশের মেঘ ঘন হয়ে ধীরে ধীরে চারদিক অন্ধকার করে ফেলছে।
ট্রেনের ভেতর প্রতিটা কামরায় মানুষজনের গুঞ্জনে মুখর। আকাশাবাবুর মতো অনেকেই গল্প করছে। অনেকে ঘুমোচ্ছে বেঘোর। করিডোর দিয়ে ট্রেনের টি টি ময়লা ইউনিফর্ম পরে হেঁটে টহল দিচ্ছে এদিক ওদিক। তার হাতে জরিমানার রশিদ বই। সেখান থেকে পাঁচটি পাতা ছেঁড়া।
সন্দেহজনক সেই লোকগুলো এখনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে গল্প করে যাচ্ছে। কেউ টয়লেটের দিকে এগিয়ে গেলে তারা কোনো এক অজানা কারণে অন্যত্র প্রস্থান করছে সাময়িকভাবে।
ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা দ্রুত ছুটে যাচ্ছে সংখ্যার সাড়ি ধরে। তার পিছু ধীর গতিতে এগুচ্ছে মিনিটের কাঁটা।
সবকিছু অবিরাম চললে ব্যাপারটা মন্দ হতো না। কিন্তু তা কখনো হয় না। প্রকৃতির অঘোষিত এই নিয়মকে সমর্থন জানিয়ে অবিরাম ছুটে চলা ট্রেনও ধীরে ধীরে থামতে থাকে। প্রথমে ট্রেনের দুলোনি কিছুটা কমে আসে। তার সাথে সাথে কু ঝিক ঝিক রব কাঁটা পড়ে এক অদ্ভুত গোঙানিতে রূপ নেয়। আকাশবাবু জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। সবুজ ফসলী জমির বদলে এখন সেখানে শোভা পাচ্ছে লাল ইটের বেশ কয়েকটি অফিস দালান। সোপানগঞ্জ স্টেশন এসে পড়েছে ট্রেন। এখানে কম করে হলেও ট্রেন ২০ মিনিটের মতো থেমে থাকবে। কারণ সামনেই জংশন। কলকাতা ফেরত কাগমারী এক্সপ্রেস সেটা ক্রস করা পর্যন্ত এখানেই যাত্রাবিরতি।
বুড়ো এবার তার চিকন থলে সমেত উঠে দাঁড়ালো। পাশের বেঞ্চের অনেকেই উঠে পড়লো। তবে সেই শিশুসমেত মা শুধু বসে থাকলো। তারা বোধহয় কলকাতায় নামবে। আর নাহয় ভবানিপুর স্টেশন। কে জানে কোথায় নামবে!
“তা বাবা উঠি এখন। চলে আসলাম”। বুড়ো সামান্য মাথা নিচু করে নমস্কার জানালো। আকাশবাবুও তার সাথে উঠে পড়লো।
“চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি। ট্রেন তো আরো ১০-১৫ মিনিট পরে ছাড়বে”। বুড়ো থলেটা নিজের হাতে নিলো সে। জায়গা বুকিং-এর চিহ্নস্বরূপ আকাশবাবু তার থলেটা আড়াআড়িভাবে আসনে বিছিয়ে রাখলো। তারপর দুজনে নেমে পড়লো ট্রেন থেকে।
“আপনার বাড়ি কোনদিকে চাচা?”
“বাড়ি না তো। জমি। কয়েকটা ক্ষেত আর কি”। আকাশবাবু জিভ কাটলো। এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলো সে। “ওহ চাচা! ভুলে গিয়েছিলাম। তা সেটা কোনদিকে?”
বুড়ো আঙুল দিয়ে দক্ষিণ দিকে ইশারা করলো। সেখানে বেশ লম্বা একটা রাস্তা সোজা গ্রামের ভেতর ঢুকে গেছে। সেদিকে এগুতে থাকলো আকাশবাবু। তখন বুড়ো বাধা দিলো। “এতদূর যেয়ে তোমার কাজ নেই বাবা। এর চেয়ে বরং ওই চায়ের দোকানটায় বসি। বেশ কিছুক্ষণ গল্প করা যাবে। তোমার পাঞ্জাবিটাও বেশ শুকিয়ে গেছে দেখা যাচ্ছে”।
আকাশবাবু নিজের বুকের দিকে তাকালো। এখনও কিছুটা ভেজা ভেজা ভাব রয়েছে। তবে কিছুক্ষণের মাঝেই শুকিয়ে যাবে। আকাশের মেঘ ভেদ করে এক চিলতে রোদ এসে পড়লো স্টেশনের চালে। নতুন চাল বলে সেটা বেশ ঝলমল করে উঠেছে। তবে পরক্ষণেই পুনরায় সেটা মেঘের মাতব্বরিতে হারিয়ে গেলো।
দুজন গিয়ে বসে পড়লো চায়ের দোকানে। দোকানি বুড়োকে বেশ আগে থেকেই চিনে বোধহয়। তাই বসামাত্রই লম্বা সালাম ঠুকে দিলো। সালাম শুনে আকাশবাবু তাকালো দোকানির দিকে। তার মাথায় তালপাতার তৈরি টুপি পরা। মুসলমান লোক। সোপানগঞ্জের এদিকে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। ভেতরের দিকে গেলে কিছু হিন্দু পরিবার রয়েছে। তবে তারা বেশিরভাগই কলকাতা থাকে বলে এখানে বেশি দেখা যায় না।
বুড়ো সালামের উত্তরে হাত জোড় করে নমস্কার দিয়ে হালকা কুশল বিনিময় করে নিলো। চাওয়ালা ভদ্রতার খাতিরে জানালো তার দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। শরীরও নাকি আর মানায় না। আকাশবাবু আনমনে বসে থাকে। আর কি সব সাতপাঁচ ভাবে। চায়ের দোকানের সামনে বেশ বড় একটি দেয়াল। সেখানে সদ্য চুনকামের ছাপ দেখা যাচ্ছে। দেয়ালের উপর বেশ বড় করে লাল রঙ দিয়ে কর্তৃপক্ষ লিখে দিয়েছে, দেয়ালে পোস্টার লাগানো নিষেধ। সেই নিষেধাজ্ঞা যেন এক ভেলকিবাজি। দেয়ালের এই লাল লেখাটি যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে সবাইকে পোস্টার লাগানোর জন্য। কারণ সেই লেখার নিচেই বেশ ঘটা করে তিনটি পোস্টার লাগানো।
একটিতে সাদাকালো একটি শহুরে ছবি স্কেচ করা। নিচে কালো মোটা অক্ষরে আবাসন প্রকল্পের বিজ্ঞাপন সাঁটা। লাল হরফে ‘সীমিত’ লেখাটি দেখে খুব মজা লাগলো। আর দ্বিতীয় পোস্টারটিতে এক কবিরাজ মশাই তার বিভিন্ন কেরামতি নিয়ে সাফাই গেয়ে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। আকাশবাবু রীতিমত মনোযোগ দিয়ে পড়তে থাকলো।
সাপের বিষ নামানো।
ভূত তাড়ানো। অবাধ্য মেয়েকে বশীকরণ।
রাহুর গ্রাস থেকে মুক্তি।
অনিদ্রা অশ্ব গেজ ভগন্দর থেকে পরিত্রাণ মন্ত্র। ভগ্ন শরীরে বলদায়ক টনিক...... ইত্যাদির ফর্দ দিয়ে ভরা পোস্টারখানা।
নিচে বড় করে কবিরাজ নাগ বিধুর নাম লেখা। ঠিকানা দেয়া নিতাইগঞ্জ বটতলা। সোপানগঞ্জ।
আকাশবাবুর চা প্রস্তুত হয়ে গেলো। সে চায়ে চুমুক দিতে দিতে তৃতীয় পোস্টারে চোখ বুলাচ্ছিলো। অন্যান্য পোস্টারের চেয়ে এই পোস্টারটা বেশি নজর কাড়ে। কারণ, এর উপরে শিরোনামে লেখা- ‘একে ধরিয়ে দিন’।
আকাশবাবু সুরুৎ শব্দে চায়ে চুমুক দিলো। বুড়ো তার চায়ের কাপে ফু দিয়ে ঠান্ডা করতে থাকলো। সেও আকাশবাবুর দেখাদেখি পোস্টার দেখতে লাগলো। দোকানি গরম পানি আনার জন্য দোকানের পেছনে লাকড়ির চুলাঘরে চলে গেলো।
পোস্টারে পেন্সিল স্কেচে আঁকা এক তরুণের ছবি। বয়স তার বেশি হলে আকাশবাবুর সমানই বা হবে। চেহারায় নিষ্পাপ ভাব ফুটে উঠেছে। তার অপরাধ নিয়ে কোনো বিবরণ দেয়া নেই। সাধারণত এসব পোস্টারে অপরাধীর সকল কুকীর্তির মোটামুটি সাইজের একটা ফর্দ জুড়ে দেয়া হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে এমন কিছু দেখা গেলো না।
এমনকি নামও দেয়া নেই। এমন তো হবার কথা না।
নিচে ছোট করে যোগাযোগের ঠিকানা দেয়া- ‘সোপানগঞ্জ পুলিশ ফাঁড়ি’। উপযুক্ত ইনামের লোভনীয় ঘোষণাটুকুও দেখা যাচ্ছে না।
নিতান্তই অলসতাবশত পোস্টার আঁকা হয়েছে বলে মনে হলো তার। বিশেষ করা কলকাতার মণ্ডল লেনের প্রতিটি দেয়ালে এরূপ পোস্টারে ছাওয়া। সেখানে পারলে অপরাধীর বাপ দাদার নামসহ লিখে দেয়। উচ্চতা থেকে শুরু করে শনাক্তকরণ চিহ্ন দিয়ে বেশ ভারিক্কি পোস্টার তৈরি করা হয় যে, যে কেউ একপলক পোস্টার দেখলে পুরো জ্বলজ্যান্ত মানুষটাকে নিজের চোখের সামনে নাচতে দেখে।
“তা বাবা তোমার কি নাগ বিধুর দাওয়াই লাগবে নাকি?” বুড়ো বেশ হাসির সাথে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। বুড়োর প্রশ্নে যেন ঘুম থেকে উঠলো আকাশবাবু। বোকার মতো চায়ের কাপে চুমুক দিতে গিয়ে ঠোঁট পুড়ে গেলো তার। দোকানি তখন গরম পানির ডেকচি হাতে ফিরছিলো। সে পুরো কথোপকথন শুনতে পেয়েছিলো। তাই সে হো হো করে হাসতে থাকলো। “এবার সত্যি সত্যিই লাগবে, ভাতিজা চলো নাগের কাছে”। এই বলে আকাশবাবুর পুড়ে যাওয়া ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। সেটায় হালকা করে আঙুল বুলাচ্ছিলো আকাশবাবু।
“না চাচা। ওরকম কিছু না। এমনেই চলে যাবে। ঠাণ্ডা জল দিয়ে দু এক মিনিট ধরে রাখলেই হবে বৈকি। তাছাড়া বাসায় মেন্থল গুড়ো আছে। বেশি কালো হয়ে গেলে সেটা দিতে পারি”।
“বাসায় তো ফিরবে অনেক বাদে। না কি? এর আগে তোমার কি না নেমন্তন্ন আছে বললে”। বুড়োর কথায় যুক্তি আছে। ততদিনে সেটা পেকে যেতে পারে। তবে এর মানে এই না তাকে কোনো তন্ত্রমন্ত্র পড়া ভুয়া কবিরাজের কাছে ধর্ণা দিতে হবে। সেটা আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিচ্ছিলো আকাশবাবু।
দোকানি শক্ত তক্তার উপর বসে কাপগুলো পানি দিয়ে খলিয়ে নিচ্ছিলো। হঠাৎ তার চোখ পোস্টারের দিকে আটকে গেলো। ব্যাপারটা প্রথমে লক্ষ করলো বুড়ো লোকটা। সে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে দেখলো দোকানিকে।
আকাশবাবু তখন দিব্যি চা খেয়ে শেষ করে ফেলেছে। ট্রেন ছাড়ারও সময় হয়ে এলো বোধহয়। এজন্যে তার তাড়া। তবে চায়ের কাপ ফেরত দেয়ার সময় সেও ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো। “কী ব্যাপার চাচাজী? দেয়ালে তাকিয়ে আছেন যে! ওখানে কী হয়েছে?”
দোকানি আকাশের ডাকে সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। তারপর এক গাল হেসে উত্তর দিলো, “ও কিছু না বাবা। পোস্টার পড়ছিলুম। যদিও নেখাপরা কিস্যু শিখিনি। তবে পোস্টারের ছবি দেখছিলাম”।
বুড়ো লোকটা তখনও তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সে অস্থির হয়ে উঠলো। সে আকাশের পাঞ্জাবির কোণা খামচে ধরে উঠলো। দোকানি লাফিয়ে উঠলো প্রায়। সে ভেবেছিলো বুড়োর খিঁচুনি লেগে গেছে। কিন্তু না। বুড়ো সুস্থই আছে।
আকাশবাবু হা হয়ে গেলো। “এ কি করছেন চাচা। ছাড়ুন। পাঞ্জাবিটা ছিঁড়ে যাচ্ছে তো”। বলতে না বলতেই ‘ফেৎ’ করে পাঞ্জাবির কোণা ছিঁড়ে গেলো। আকাশবাবু হা হা করে উঠলো। এ কী ধরনের কান্ড! বুড়ো এরকম করলো কেনো?
বুড়ো যেন বলার ভাষা হারিয়ে ফেলছে। বহু কষ্টে মুখে বোল এনে সে প্রায় চাপাস্বরে বললো, “আকাশ ফাকাশ এসব মিথ্যাচারী ছাড়ো। কে তুমি বাবা? এক্ষুনি বলো! নয়তো পুলিশে ধরিয়ে দেবো”।
আকাশবাবু ফ্যাল ফ্যাল করে তার দিকে তাকিয়ে থাকলো। সে কিছু বুঝতে পারলো না। বোঝার কথাও না। হঠাৎ পাগলামি করা বুড়োর দিকে সে বোকার মতো তাকিয়ে থাকলো। ডান হাত তার তখনও ঠোঁটের উপর। পুড়ে যাওয়া অংশ সামান্য জ্বালা করছে। দোকানি কাঁধের উপর গামছা দিয়ে তক্তা থেকে নেমে আসলো। সে কাহিনীর হারানো অংশ খুঁজে পেতে উন্মুখ। কী হলো আসলে?
বুড়ো তখন কাঁপা কাঁপা হাতে পোস্টারের দিকে তর্জনী আঙুল তুলে দেয়। তার আঙুল দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিলো সে কোন পোস্টারের দিকে ইশারা করছে। সেই ধরিয়ে দেন শিরোনামওয়ালা পোস্টার। যার উপর নিচে নাম ঠিকানা কিছুই লেখা নেই। শুধু জ্বলজ্বল করছে একটি জ্বলজ্যান্ত তরুণের পেন্সিল স্ক্যাচ। বড্ড অবোধ্য সেই স্কেচের মতো দেখতে আরো হাজারটা মানুষ থাকতে পারে। ঘুরিয়ে যদি বলি, হাজারখানের মানুষের সাথে সেই স্কেচের মিল খুঁজে পাওয়া যাওয়ার কথা। কিন্তু বুড়ো সে কথা মানতে নারাজ। স্ক্যাচের সেই অপরাধী নাকি চা খেতে চলে আসা গুরগাওগামী আকাশবাবু!
কী সাঙ্ঘাতিক কথা। আকাশবাবুর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। “কী যা তা বলছেন চাচা”। দোকানির দিকে তাকিয়ে সে কাষ্ঠ হাসি দিয়ে বললো, “চাচাজি আপনিই বলুন না”।
কিন্তু দোকানি কিছু বলছে না। সে কী আর বলবে। তার কাছেও তো স্কেচের সেই অপরাধীর সাথে আকাশের বড্ড মিল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। আকাশবাবু বুঝলো অবস্থা সুবিধার না। এখান থেকে যত দ্রুত সম্ভব তার কেটে পড়া উচিত।
“চাচা আমি তাহলে আসি। আমার আবার ট্রেন ছেড়ে দিচ্ছে। নমস্কার চাচা। আদাব চাচাজী”। এই বলে সে ট্রেনের দিকে দ্রুত হাঁটতে থাকলো। পেছনে বোকার মতো তাকিয়ে আছে এক বুড়ো, যার মুখে সদা লেগে থাকা হাসির ঝিলিক প্রায় দশ বছরের মাথায় প্রথমবারের মতো উধাও হয়ে গেছে। আর ইতস্তত মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক মুসলিম চাওয়ালা।
জীবনে কখনো সে এত সামনে থেকে কোনো অপরাধী দেখেনি বলেই তার উত্তেজনা তাকে কাবু করে ফেলছে।
কলকাতাগামী ট্রেনটা তখন হালকা করে কেঁপে উঠলো। আকাশবাবু প্রায় ছুটে এসে সেটাতে উঠে গেলো।
দূর থেকে হুইসেলের শব্দ কানে ভেসে আসছে। আকাশবাবু তখনও সামলে উঠতে পারেনি। সে বড় বড় দম নিতে থাকলো।
ছেঁড়া পাঞ্জাবি গায়ের মানুষটাকে দেখে করিডোরের দু’একজন মানুষ বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ২৬/০৫/২০১৮অপেক্ষায় থাকলাম পরবর্তী পর্বের জন্য।
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ২৬/০৫/২০১৮এখানে গল্প কয়টি?