বর্ষাকালীন রহস্যকল্পনা
চাষাড়া রেলস্টেশনের দক্ষিন দিকের বেঞ্চটা পানিতে ভিজে একেবারে বসার অনুপযুক্ত হয়ে গেছে। সেই সতেরশো সনের শক্ত ব্রিটিশ টিনের মধ্যে একটা বড় ফুটো একযুগ ধরে বর্ষার সময় যত্ন নিয়ে বেঞ্চটাকে ভিজিয়ে দেয়।
সবেমাত্র ঢাকা ফেরত মেইলটা স্টেশনে এসে চাপা দম বের করে একদম নিথর হয়ে গেল।
ট্রেনের সাথে আমার পুরানি দোস্তি।
এইতো বছর বিশেক আগে নইমুদ্দির বৌ যখন ট্রেনের নিচে কাটা পড়লো, তখনো ছিলাম; গতকাল যখন নইমুদ্দির বড় মেয়ে ট্রেনের নিচে গেল- আমি দিব্যি দাঁড়িয়ে ৫ টাকার সস্তা বিঁড়ি ফুঁকছিলাম।
আমি সেদিন ছিলাম, আজো আছি। ট্রেনের সাথে আমার পুরানি দোস্তি!
আগের বার যখন নইমুদ্দিকে প্রশ্ন করলাম, ব্যাপার কী?
নির্বিকার অনুভূতিশুণ্য নইমুদ্দি বলেছিল- সে জানে না।
এবার কেন জানি জিজ্ঞাসা করতে প্রচণ্ড ইচ্ছা হলেও করলাম না।
কারণ, নইমুদ্দি জানবে না। জানার কথাও না।
পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল ধাঁধাঁ! নইমুদ্দির মতো পাড় মাতালের হিমসিম খাওয়ারই কথা।সেই যেদিন খোদা নিজ কুদরতে বাবা আদমের পাঁজরের হাড় দিয়ে বিবি হাওয়াকে গড়লেন, সেদিন থেকে গোলক ধাঁধাঁর শুরু।যতই সমাধান করতে যাই, ততই মাথা ঝিম ধরে। নিজেই গোলকে অন্ধের মত ঘুরতে থাকি।
রহস্যময়ী নারী!
ভেজা বেঞ্চটাকে বাম হাতের তালু দিয়ে মুছে বসে পড়লাম। সব বয়সে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। হাঁপিয়ে উঠতে হয়।
মেইল ট্রেন থামা মানেই একদল ভিক্ষুকের ঢল। ভ্রাম্যমান ফকিরেরা এখানে সেখানে শৈল্পিক কায়দায় হাত পাতে।কঠিন দৃষ্টি মেলে তাকায় কর্তারা। যত্তসব ঝামেলা!
গরিব দেশে নুন আনতে পান্তা উবে হাওয়া, সেথায় আবার আরেকটা পেটে সিকি ঢালা? সেই সিকির ঝনঝনানিও তো কানে শূল হয়ে বিঁধে!
তবে ভিন্ন ব্যাপার ঘটে কর্ত্রীদের বেলায়।কর্তার বাম হাতটা ধরে মৃদু ঝাঁকুনি দেয়।এই দেখেছ দুইদিন কিছু খায়নি। দেখ বাচ্চাটা দেখতে ঠিক আমাদের খোকনের মতো! কিছু একটা দাও ওকে।
তাদের দুচোখ দরদে টলটল করে উঠে।
রহস্যময়ী নারী! রহস্য তার মমতায়, রহস্য তার শাড়ির আঁচলে। যেটা বিকালে শীতলক্ষ্যার বাতাসে পতপত করে উড়ে।
রহস্য তার ঠোঁটের খাঁজে! কিংবা কপালের ভাঁজে!!
বেঞ্চের পাশে একটা ময়লা গামছা পাতা। সবসময়ই থাকে। ঝালমুড়িওয়ালা সাজুর পুরাতন আসন। সাজুর বাপ-দাদারা এইখানেই গামছা পেতে বছরের পর বছর ঝালমুড়ি বেচে আসছে। ঝালমুড়ি তৈয়ারে সাজুর হাতখানা একদম পেকে গেছে। সকালে যখন হালকা করে রোদ পড়ে, তখন থেকে এইখানে অপেক্ষমান যাত্রীরা ভিড় করে। স্বরচিত রাগে ‘ঝালমুড়ি! অয়ে ঝালমুড়ি!’ ডাকে সে সরগরম করে ফেলে এইদিকটা। ওর ঝালমুড়িতে আসলেই জাদু আছে। যে একবার খায়, সে এইখান দিয়ে যাওয়ার সময় কথাচ্ছলে একমুঠি হলেও মুড়ি মুখে পুরে।
আজ বৃষ্টি বলে এখনো ও আসেনি তবে গামছাটা দিনের বাকিটা সময় এভাবেই পড়ে থাকে। স্টেশন মাস্টার থেকে শুরু করে ঢাকার মেইলের ভিখারী, সবাই দেখলেই চিনে সাজুর গামছাটাকে।
সাজুর গামছায় আপাতত আশ্রয় নিয়েছে একদল ক্ষুদে ভিখারী। হয়তো এখনো ট্রেনিং শেষ হয়নি, তাই ওদের মাঠ পর্যায়ে মিশন থেকে অনির্দিষ্টকালীন অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
ওদের মধ্যে বড় বোন গোছের একটা মেয়েও দেখা গেল। কী সাঙ্ঘাতিক মায়াবি মেয়েটা!
ওর চোখ কেমন টলটলে, চুলগুলো ময়লামাখা হলেও যত্ন করে ধুয়ে দিলে রূপালী বাসনের মতো ঝলমল করে উঠবে। কমলার কোয়ার মতো হালকা ঠোঁটজোড়া কেমন অনাহারে শুকনো মরিচের মতো মলীন হয়ে আছে। ওকে দেখলেই তারার কথা মনে পড়ে।
দূর আকাশের তারা?
আরে নাহ! আকাশের ঝিকমিক করা তারা না। তালতলা মক্তবের হুজুরের মেয়ে তারা।
ওর নাম তারা কেন সেটা ছিল বহুকালের কৌতূহল! একদিন যদিও উত্তর মিলেছিল।
ওর গায়ের রঙ ছিল গাঢ় কালো এবং বেঢপ গড়ন। আকাশের তারা মর্ত্যের তারাকে দেখলে নির্ঘাত লজ্জায় মাথা কুটে মরতো। তবু সেই তারা ছিল আমার আকাশের তারা। কখন যে সেই কচি হৃদয়ের সাদা কাগজে জাদুকরি রঙ ছড়িয়ে গেল, বুঝতেই পারি নি।
আশ্চর্য লাগতো। এতো মেয়ে থাকতে এই তারা! রহস্যজনক।
ওর না ছিল রূপ, না ছিল গুণ, আর নাই বা ছিল বাঁকা চাহনি।
ভোরের সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে তারা ঘুম থেকে উঠতো। সকালের মিষ্টি রোদে ওর দেখা পেতাম মোল্লাবাড়ির পুকুরে- কলসিকাঁখে। কবিতার মেয়েদের মতো হেলেদুলে চলা মেয়ে তারা নয়। সাদামাটা ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বাড়ি ফিরত সে। ফেরার পথে ছলাৎ ছলাৎ জল ছিটকে ভিজিয়ে যেত মেঠো পথ। সেদিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম আমি।
মাঝে মাঝে ফেরার পথে আমি দাঁড়াতাম। চপচপে তেলা মাথায়; মাঝখানে যত্ন করে সিঁথি করে।
জানি না সেটা কল্পনা কি না- তারা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে হাসি দিত মাঝে মাঝে। হুজুরের শালিন কন্যার মাঝে এতো রোমান্টিকতা থাকার কথা না- কল্পনাই বৈকি!
তবে কখনো সাহস হতো না ওর সাথে কথা বলার। এই বলি বলি করতে করতে কখন যে বড় হয়ে গেছি সেটাও টের পাইনি।
একদিন ঠিক করলাম বলেই ফেলি। তবে এমন তালিমারা লুঙ্গি আর গামছা গলায় তো বিয়ের কথা বলা যায় না। তাই সকাল হতেই সোনাকান্দার হাটে ছুটে গেলাম। সুন্দর একখানা লুঙ্গি আর খাদি কাপড়ের ফতুয়া নিলাম। সাথে গন্ধ সাবান, তেল, চিরুনি আর রঙিন গামছা।
রহস্যময়ী নারী। তার টানে, তাকে কাছে পেতে কতই না কায়দা কানুন!
মনের আকাশ তখন তারায় তারায় ভরা।
দুপুরের সুরুজটা তখন মাথার উপরে। বাড়ি ফিরে উঠানে বসতে না বসতেই শুনি তারা আর নেই। সেই সকাল থেকে তার কেমন কেমন জানি লাগছিল। তারপর হঠাৎ রক্তবমি করে সটান হয়ে পটল তুলে তারা।আকাশের তারার মতো হারিয়ে যাবে বলেই হয়তো ওর নাম হয়েছিল তারা। ঠিক এমন সময়েই ওকে হারালাম; এটাও রহস্যজনক!
রহস্যময়ী নারী! যার রহস্যে বদলায় জীবন; কখনো থমকেও দাঁড়ায়। তবে আমার জীবন থমকে দাঁড়ায় নি, সামান্য হোঁচট খেল এই যা!
বাইরে বৃষ্টি কমে গেছে। বৃষ্টি সবার কাছে কলের গান হয়ে আসে না। বৃষ্টি আমার অসহ্য লাগে। কেমন বিদঘুটে করে ফেলে আশেপাশের মাটিকে। রাস্তায় চলা দায় হয়ে যায়।
ফতুল্লার মোড় তখন ছোটখাট খাল। রিকশাগুলো যখন হাঁটুপানিতে সংগ্রাম করে, তখন সেগুলোকে দূর থেকে স্থলের স্টিমার মনে হয়। বৃষ্টির সাথে আমার এই কাঠখোট্টা সম্পর্ক পুরানি দোস্তি নয়। সেটা একভাবে বলতে গেলে নতুনই- সময়ের হিসেবে না হলেও! এক তাজা তিক্ততায় নর্দমার কাদার মতো নোংরা করে তুলে অনুভূতি।
আমার বাবা ছিলেন আমার পুরো উল্টো। উনার বিলাসিতার খেলনা ছিল একটা দ্বিতল কুঠুরি। নিচের তলায় কোন কামরা ছিল না। মই দিয়ে দোতলায় উঠতে হতো। বৃষ্টি নামলেই বাবা কাজ ফেলে মই বেয়ে উঠে যেতেন। খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবার কাকভেজা মূর্তি দেখে প্রচণ্ড লোভ হতো বৃষ্টিতে ভেজার। কিন্তু কঠোর মায়ের পিটুনির ভয়ে সাহস হতো না।
সেদিনের বর্ষায় কোন পাগলামি ছিল কিনা সেটা জানি না। কিন্তু হঠাৎ করে দেখি বাবার কুঠুরির বারান্দা থেকে পাগলের মতো অট্টহাসি ভেসে আসছে। বিকট সেই হাসিতে মুহূর্তের মধ্যে বাতাস বাজেভাবে বিষিয়ে গেল। ছড়িয়ে গেল গুপ্ত আতঙ্ক। কৌতূহলী দু’চোখের সাহস ছিল না ওদিকে তাকানোর।
পরে শুনলাম সেটা মা ছিলেন। হঠাৎ বর্ষার বাতাসের উন্মাদনায় রহস্যময়ী হয়ে উঠেন তিনি।
“রইসের বৌ পাগলা নাচন দিছে, শুনছস নি?” বাজারময় ছড়িয়ে পড়ে। কালের নির্মম পরিহাসে নিঃস্ব ঠাকুরমার ঝুলিতে নতুন গল্প এলো বলে! গল্প এক বটবৃক্ষ। দ্রুতই শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে শক্ত আসন গড়ে তোলে। মায়ের পাগলামিও সমানুপাতিক হারে বাড়তে থাকলে বাবা বাধ্য হয়ে মাকে তালাবন্দি করেন।
বৃষ্টি হলেই মা কেমন চিৎকার করে উঠেন। বাবা চলে যান কুঠুরিতে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজেন। দূর থেকে বুঝতাম তার চোখ অনুভূতিশুণ্য। ঠিক যেমন শুণ্য ছিল নইমুদ্দির। রহস্যময়ীর ভেলকিতে অনুভূতিরা একদম কাবু হয়ে গেছে।
রহস্যময়ী নারী। তাদের চোখের কোণায় কানায় কানায় ভর্তি মায়া। তাদের মায়ার ভানুমতিতে কাবু হয়ে পড়ে ধরা; ধুম্রজালে জড়িয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে বাস্তবতা। তেমনি মায়ের মায়াকান্না আর আহত মিনতিতে সব ভুলে তালা খুলে দেই এক বর্ষায়।
সেদিনও বিকট হাসি ভেসে এসেছিল কুঠুরির উপর থেকে। হয়তো ভয়টা তখন সাহসে বদলে গেছে। তাই জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি নারিকেল কাটার দা হাতে মা হাসছেন দোতলায়। আর নিচেই নিথর হয়ে পড়ে আছেন বাবা। বাদামী উঠান তখন বেনারসি বেদনায় রক্তিম হয়ে উঠেছে। আমি হড়বড় করে বমি করে দিলাম।
মাকে যখন বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ, তাকে দেখে কে বলবে কিছুক্ষণ আগেই বিভৎস কায়দায় নষ্ট করেছেন একটা সাংসারিক উপন্যাস। ভ্যান এ মা উঠলেন সুবোধ ভদ্র বৌ এর মত। মাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি। বাপের বাড়ি যাচ্ছে বহুদিন পর। দূরে দাঁড়িয়ে আমার মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে। এলাকাময় তখন চাপা উচ্ছ্বাস। ঠাকুরমার ঝুলি একেবারে ভরে গেছে! হাজার বছর পর এমন নিষ্ঠুর আনন্দে বর্ণীল হয়ে উঠে বিবর্ণ গ্রাম।
সেই দিন থেকেই কেন জানি বর্ষা দেখলেই ভিতরটা অজানা আতঙ্কে ছেয়ে যায়। বৃষ্টির টিপটিপ ফোঁটা আমার চোখে দুঃখ এনে অশ্রু হয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে।
বৃষ্টি! তোকে আমার অসহ্য লাগে।
**************************************************
ঢাকা মেইলের ফেরার সময় হয়ে গেছে। বৃষ্টিটা আবার শুরু হয়েছে। আর দেরি করলে চলবে না। আজকাল বর্ষা হোক বা শীত, মুহূর্তের মধ্যে ফাঁকা ট্রেন লোকে ভরে উঠে। তখন পা রাখার জায়গাটুকুনও পাওয়া যায় না।
যদিও ব্যাপারটা আমার কাছে মন্দ লাগে না।
হাজার লোকের ভিড়ে তাকিয়ে আমি খুঁজি- আমার মা কে, তারা কে, নইমুদ্দির বড় মেয়ে এবং অন্যান্যদের। জানি যে কখনো ফিরবে না, তবুও।
রহস্যময়ী নারী বলে কথা। চোখের পলকে হাজার রহস্য কবিতা বুনে রেখেছে যারা, তারা ফিরে আসতেই পারে।
দূর আকাশে কালো মেঘ জমছে, বৃষ্টির গতিও বাড়ছে।।
সবেমাত্র ঢাকা ফেরত মেইলটা স্টেশনে এসে চাপা দম বের করে একদম নিথর হয়ে গেল।
ট্রেনের সাথে আমার পুরানি দোস্তি।
এইতো বছর বিশেক আগে নইমুদ্দির বৌ যখন ট্রেনের নিচে কাটা পড়লো, তখনো ছিলাম; গতকাল যখন নইমুদ্দির বড় মেয়ে ট্রেনের নিচে গেল- আমি দিব্যি দাঁড়িয়ে ৫ টাকার সস্তা বিঁড়ি ফুঁকছিলাম।
আমি সেদিন ছিলাম, আজো আছি। ট্রেনের সাথে আমার পুরানি দোস্তি!
আগের বার যখন নইমুদ্দিকে প্রশ্ন করলাম, ব্যাপার কী?
নির্বিকার অনুভূতিশুণ্য নইমুদ্দি বলেছিল- সে জানে না।
এবার কেন জানি জিজ্ঞাসা করতে প্রচণ্ড ইচ্ছা হলেও করলাম না।
কারণ, নইমুদ্দি জানবে না। জানার কথাও না।
পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল ধাঁধাঁ! নইমুদ্দির মতো পাড় মাতালের হিমসিম খাওয়ারই কথা।সেই যেদিন খোদা নিজ কুদরতে বাবা আদমের পাঁজরের হাড় দিয়ে বিবি হাওয়াকে গড়লেন, সেদিন থেকে গোলক ধাঁধাঁর শুরু।যতই সমাধান করতে যাই, ততই মাথা ঝিম ধরে। নিজেই গোলকে অন্ধের মত ঘুরতে থাকি।
রহস্যময়ী নারী!
ভেজা বেঞ্চটাকে বাম হাতের তালু দিয়ে মুছে বসে পড়লাম। সব বয়সে দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। হাঁপিয়ে উঠতে হয়।
মেইল ট্রেন থামা মানেই একদল ভিক্ষুকের ঢল। ভ্রাম্যমান ফকিরেরা এখানে সেখানে শৈল্পিক কায়দায় হাত পাতে।কঠিন দৃষ্টি মেলে তাকায় কর্তারা। যত্তসব ঝামেলা!
গরিব দেশে নুন আনতে পান্তা উবে হাওয়া, সেথায় আবার আরেকটা পেটে সিকি ঢালা? সেই সিকির ঝনঝনানিও তো কানে শূল হয়ে বিঁধে!
তবে ভিন্ন ব্যাপার ঘটে কর্ত্রীদের বেলায়।কর্তার বাম হাতটা ধরে মৃদু ঝাঁকুনি দেয়।এই দেখেছ দুইদিন কিছু খায়নি। দেখ বাচ্চাটা দেখতে ঠিক আমাদের খোকনের মতো! কিছু একটা দাও ওকে।
তাদের দুচোখ দরদে টলটল করে উঠে।
রহস্যময়ী নারী! রহস্য তার মমতায়, রহস্য তার শাড়ির আঁচলে। যেটা বিকালে শীতলক্ষ্যার বাতাসে পতপত করে উড়ে।
রহস্য তার ঠোঁটের খাঁজে! কিংবা কপালের ভাঁজে!!
বেঞ্চের পাশে একটা ময়লা গামছা পাতা। সবসময়ই থাকে। ঝালমুড়িওয়ালা সাজুর পুরাতন আসন। সাজুর বাপ-দাদারা এইখানেই গামছা পেতে বছরের পর বছর ঝালমুড়ি বেচে আসছে। ঝালমুড়ি তৈয়ারে সাজুর হাতখানা একদম পেকে গেছে। সকালে যখন হালকা করে রোদ পড়ে, তখন থেকে এইখানে অপেক্ষমান যাত্রীরা ভিড় করে। স্বরচিত রাগে ‘ঝালমুড়ি! অয়ে ঝালমুড়ি!’ ডাকে সে সরগরম করে ফেলে এইদিকটা। ওর ঝালমুড়িতে আসলেই জাদু আছে। যে একবার খায়, সে এইখান দিয়ে যাওয়ার সময় কথাচ্ছলে একমুঠি হলেও মুড়ি মুখে পুরে।
আজ বৃষ্টি বলে এখনো ও আসেনি তবে গামছাটা দিনের বাকিটা সময় এভাবেই পড়ে থাকে। স্টেশন মাস্টার থেকে শুরু করে ঢাকার মেইলের ভিখারী, সবাই দেখলেই চিনে সাজুর গামছাটাকে।
সাজুর গামছায় আপাতত আশ্রয় নিয়েছে একদল ক্ষুদে ভিখারী। হয়তো এখনো ট্রেনিং শেষ হয়নি, তাই ওদের মাঠ পর্যায়ে মিশন থেকে অনির্দিষ্টকালীন অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
ওদের মধ্যে বড় বোন গোছের একটা মেয়েও দেখা গেল। কী সাঙ্ঘাতিক মায়াবি মেয়েটা!
ওর চোখ কেমন টলটলে, চুলগুলো ময়লামাখা হলেও যত্ন করে ধুয়ে দিলে রূপালী বাসনের মতো ঝলমল করে উঠবে। কমলার কোয়ার মতো হালকা ঠোঁটজোড়া কেমন অনাহারে শুকনো মরিচের মতো মলীন হয়ে আছে। ওকে দেখলেই তারার কথা মনে পড়ে।
দূর আকাশের তারা?
আরে নাহ! আকাশের ঝিকমিক করা তারা না। তালতলা মক্তবের হুজুরের মেয়ে তারা।
ওর নাম তারা কেন সেটা ছিল বহুকালের কৌতূহল! একদিন যদিও উত্তর মিলেছিল।
ওর গায়ের রঙ ছিল গাঢ় কালো এবং বেঢপ গড়ন। আকাশের তারা মর্ত্যের তারাকে দেখলে নির্ঘাত লজ্জায় মাথা কুটে মরতো। তবু সেই তারা ছিল আমার আকাশের তারা। কখন যে সেই কচি হৃদয়ের সাদা কাগজে জাদুকরি রঙ ছড়িয়ে গেল, বুঝতেই পারি নি।
আশ্চর্য লাগতো। এতো মেয়ে থাকতে এই তারা! রহস্যজনক।
ওর না ছিল রূপ, না ছিল গুণ, আর নাই বা ছিল বাঁকা চাহনি।
ভোরের সূর্যের সাথে পাল্লা দিয়ে তারা ঘুম থেকে উঠতো। সকালের মিষ্টি রোদে ওর দেখা পেতাম মোল্লাবাড়ির পুকুরে- কলসিকাঁখে। কবিতার মেয়েদের মতো হেলেদুলে চলা মেয়ে তারা নয়। সাদামাটা ভঙ্গিতে সোজা হয়ে বাড়ি ফিরত সে। ফেরার পথে ছলাৎ ছলাৎ জল ছিটকে ভিজিয়ে যেত মেঠো পথ। সেদিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম আমি।
মাঝে মাঝে ফেরার পথে আমি দাঁড়াতাম। চপচপে তেলা মাথায়; মাঝখানে যত্ন করে সিঁথি করে।
জানি না সেটা কল্পনা কি না- তারা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে হাসি দিত মাঝে মাঝে। হুজুরের শালিন কন্যার মাঝে এতো রোমান্টিকতা থাকার কথা না- কল্পনাই বৈকি!
তবে কখনো সাহস হতো না ওর সাথে কথা বলার। এই বলি বলি করতে করতে কখন যে বড় হয়ে গেছি সেটাও টের পাইনি।
একদিন ঠিক করলাম বলেই ফেলি। তবে এমন তালিমারা লুঙ্গি আর গামছা গলায় তো বিয়ের কথা বলা যায় না। তাই সকাল হতেই সোনাকান্দার হাটে ছুটে গেলাম। সুন্দর একখানা লুঙ্গি আর খাদি কাপড়ের ফতুয়া নিলাম। সাথে গন্ধ সাবান, তেল, চিরুনি আর রঙিন গামছা।
রহস্যময়ী নারী। তার টানে, তাকে কাছে পেতে কতই না কায়দা কানুন!
মনের আকাশ তখন তারায় তারায় ভরা।
দুপুরের সুরুজটা তখন মাথার উপরে। বাড়ি ফিরে উঠানে বসতে না বসতেই শুনি তারা আর নেই। সেই সকাল থেকে তার কেমন কেমন জানি লাগছিল। তারপর হঠাৎ রক্তবমি করে সটান হয়ে পটল তুলে তারা।আকাশের তারার মতো হারিয়ে যাবে বলেই হয়তো ওর নাম হয়েছিল তারা। ঠিক এমন সময়েই ওকে হারালাম; এটাও রহস্যজনক!
রহস্যময়ী নারী! যার রহস্যে বদলায় জীবন; কখনো থমকেও দাঁড়ায়। তবে আমার জীবন থমকে দাঁড়ায় নি, সামান্য হোঁচট খেল এই যা!
বাইরে বৃষ্টি কমে গেছে। বৃষ্টি সবার কাছে কলের গান হয়ে আসে না। বৃষ্টি আমার অসহ্য লাগে। কেমন বিদঘুটে করে ফেলে আশেপাশের মাটিকে। রাস্তায় চলা দায় হয়ে যায়।
ফতুল্লার মোড় তখন ছোটখাট খাল। রিকশাগুলো যখন হাঁটুপানিতে সংগ্রাম করে, তখন সেগুলোকে দূর থেকে স্থলের স্টিমার মনে হয়। বৃষ্টির সাথে আমার এই কাঠখোট্টা সম্পর্ক পুরানি দোস্তি নয়। সেটা একভাবে বলতে গেলে নতুনই- সময়ের হিসেবে না হলেও! এক তাজা তিক্ততায় নর্দমার কাদার মতো নোংরা করে তুলে অনুভূতি।
আমার বাবা ছিলেন আমার পুরো উল্টো। উনার বিলাসিতার খেলনা ছিল একটা দ্বিতল কুঠুরি। নিচের তলায় কোন কামরা ছিল না। মই দিয়ে দোতলায় উঠতে হতো। বৃষ্টি নামলেই বাবা কাজ ফেলে মই বেয়ে উঠে যেতেন। খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবার কাকভেজা মূর্তি দেখে প্রচণ্ড লোভ হতো বৃষ্টিতে ভেজার। কিন্তু কঠোর মায়ের পিটুনির ভয়ে সাহস হতো না।
সেদিনের বর্ষায় কোন পাগলামি ছিল কিনা সেটা জানি না। কিন্তু হঠাৎ করে দেখি বাবার কুঠুরির বারান্দা থেকে পাগলের মতো অট্টহাসি ভেসে আসছে। বিকট সেই হাসিতে মুহূর্তের মধ্যে বাতাস বাজেভাবে বিষিয়ে গেল। ছড়িয়ে গেল গুপ্ত আতঙ্ক। কৌতূহলী দু’চোখের সাহস ছিল না ওদিকে তাকানোর।
পরে শুনলাম সেটা মা ছিলেন। হঠাৎ বর্ষার বাতাসের উন্মাদনায় রহস্যময়ী হয়ে উঠেন তিনি।
“রইসের বৌ পাগলা নাচন দিছে, শুনছস নি?” বাজারময় ছড়িয়ে পড়ে। কালের নির্মম পরিহাসে নিঃস্ব ঠাকুরমার ঝুলিতে নতুন গল্প এলো বলে! গল্প এক বটবৃক্ষ। দ্রুতই শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে শক্ত আসন গড়ে তোলে। মায়ের পাগলামিও সমানুপাতিক হারে বাড়তে থাকলে বাবা বাধ্য হয়ে মাকে তালাবন্দি করেন।
বৃষ্টি হলেই মা কেমন চিৎকার করে উঠেন। বাবা চলে যান কুঠুরিতে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজেন। দূর থেকে বুঝতাম তার চোখ অনুভূতিশুণ্য। ঠিক যেমন শুণ্য ছিল নইমুদ্দির। রহস্যময়ীর ভেলকিতে অনুভূতিরা একদম কাবু হয়ে গেছে।
রহস্যময়ী নারী। তাদের চোখের কোণায় কানায় কানায় ভর্তি মায়া। তাদের মায়ার ভানুমতিতে কাবু হয়ে পড়ে ধরা; ধুম্রজালে জড়িয়ে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে বাস্তবতা। তেমনি মায়ের মায়াকান্না আর আহত মিনতিতে সব ভুলে তালা খুলে দেই এক বর্ষায়।
সেদিনও বিকট হাসি ভেসে এসেছিল কুঠুরির উপর থেকে। হয়তো ভয়টা তখন সাহসে বদলে গেছে। তাই জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি নারিকেল কাটার দা হাতে মা হাসছেন দোতলায়। আর নিচেই নিথর হয়ে পড়ে আছেন বাবা। বাদামী উঠান তখন বেনারসি বেদনায় রক্তিম হয়ে উঠেছে। আমি হড়বড় করে বমি করে দিলাম।
মাকে যখন বেঁধে নিয়ে যাচ্ছিল পুলিশ, তাকে দেখে কে বলবে কিছুক্ষণ আগেই বিভৎস কায়দায় নষ্ট করেছেন একটা সাংসারিক উপন্যাস। ভ্যান এ মা উঠলেন সুবোধ ভদ্র বৌ এর মত। মাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছুই হয়নি। বাপের বাড়ি যাচ্ছে বহুদিন পর। দূরে দাঁড়িয়ে আমার মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে। এলাকাময় তখন চাপা উচ্ছ্বাস। ঠাকুরমার ঝুলি একেবারে ভরে গেছে! হাজার বছর পর এমন নিষ্ঠুর আনন্দে বর্ণীল হয়ে উঠে বিবর্ণ গ্রাম।
সেই দিন থেকেই কেন জানি বর্ষা দেখলেই ভিতরটা অজানা আতঙ্কে ছেয়ে যায়। বৃষ্টির টিপটিপ ফোঁটা আমার চোখে দুঃখ এনে অশ্রু হয়ে টপটপ করে গড়িয়ে পড়ে।
বৃষ্টি! তোকে আমার অসহ্য লাগে।
**************************************************
ঢাকা মেইলের ফেরার সময় হয়ে গেছে। বৃষ্টিটা আবার শুরু হয়েছে। আর দেরি করলে চলবে না। আজকাল বর্ষা হোক বা শীত, মুহূর্তের মধ্যে ফাঁকা ট্রেন লোকে ভরে উঠে। তখন পা রাখার জায়গাটুকুনও পাওয়া যায় না।
যদিও ব্যাপারটা আমার কাছে মন্দ লাগে না।
হাজার লোকের ভিড়ে তাকিয়ে আমি খুঁজি- আমার মা কে, তারা কে, নইমুদ্দির বড় মেয়ে এবং অন্যান্যদের। জানি যে কখনো ফিরবে না, তবুও।
রহস্যময়ী নারী বলে কথা। চোখের পলকে হাজার রহস্য কবিতা বুনে রেখেছে যারা, তারা ফিরে আসতেই পারে।
দূর আকাশে কালো মেঘ জমছে, বৃষ্টির গতিও বাড়ছে।।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।