www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

রাতের অপূর্ণ গল্প

আজকাল বেশ গরম পড়েছে ।

গোস্বা সূর্যকে ঠেলে আকাশে যদি মেঘের আনাগোনা দেখা যেতো! শীতল বাতাসে যদি নিথর গাছের পাতায় ঝড় উঠতো!
বেশ ভালোই হতো ।
রুমাল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বেশ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে রাতুল ।
তবু সাইকেলে প্যাডেল মেরেই চলেছে ।
কপাল বেয়ে দরদর ঘাম ঝড়ছে । রং চটকানো শার্টের পেছনটা ভিজে গেছে । ভেতরে স্যান্ডো গেঞ্জি পরা হয়নি ।
পুরনো জিন্সপ্যান্টটার ভাঁজে ভাঁজে বেশ ময়লাটে দেখাচ্ছে ।

পাকারাস্তায় সাইকেল চালাচ্ছে । তবু যেনো চাকা ঘুরেনা । মনে হয় উল্টা ঘুরছে । যতোই প্যাডেল দিচ্ছে, ততোই যেনো থেমে যেতে চাইছে সাইকেলের চাকা ।
আচ্ছা এমন হচ্ছে কেনো?
এমন দিনে আসলে এমনই হয় ।
সময় হঠাৎ করে দীর্ঘ হয়ে যায় । রবিবার যেনো ফিরে যায় অতীতের শনিবারে । বিকেল ফিরে যায় সকালে । কিন্তু এইচ,এস, সি পরীক্ষার আগে সময়ের তো এমন উদারতা দেখিনি! আর কয়েকটা মাস হাতে পেলেই পরীক্ষাটা ভালো দেয়া যেতো ।
ভালো পরীক্ষা দিয়েই বা কী হবে!
আমার মতো বর্গাচাষীর ছেলের কি আর ওদের মতো মেডিকেল-ইঞ্জিনিয়ারিং-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সামর্থ্য আছে?

কিছুদিন আগেই, সব তত্ত্বীয় পরীক্ষার শেষে ব্যবহারিক পরীক্ষা চলার সময় বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেছিলো, "বাজান, এইবার তো তুই ইন্টার পাস করবি । অহন পড়ালেখা ছাইরা চাকরি টাকরি কর ।"

বাবার মুখে কথাটা শুনে রাতুলের খুব খারাপ লেগেছিলো । কোথায় তার সহপাঠিরা ভার্সিটি-মেডিকেল কোচিং করতে ভর্তি হচ্ছে, আর তার বাবা কিনা বলছে পড়ালেখা ছেড়ে দিতে !

সারাটা দিন সে বাইরে বাইরে ঘুরে কাটিয়ে দিয়েছে । মনের ভিতর একটাই প্রশ্ন, আমরা কেনো এতো গরীব?
সন্ধ্যেবেলায় ঘরে ফিরে চারটে ভাত খেয়ে ঘুমাতে গেলো । ঘুম আসছেনা । জানালার খুপড়ি দিয়ে চাঁদটাকে দেখছে আর ভাবছে । ভাবনাগুলো চোখের মণি থেকে নির্গমিত হয়ে তিলে পড়া বালিশ ভিজাচ্ছে ।
চোখের জল যখন শুকিয়ে গেলো, বুকের ভেতরটায় বিশাল জায়গা খুঁজে পেলো । এ জায়গা ত্যাগের, সহমর্মিতার !
আমার বাবাতো কম কষ্ট করেনি আমার জন্য । যখন যা চেয়েছি, সাধ্যে না থাকলেও ঋণ করে হলেও দিয়েছে । বাবাও আর ভাঙ্গা শরীর নিয়ে কাজ করতে পারছেনা । আমরা গরীব । গরীবদের অত বড় বড় স্বপ্ন দেখাও পাপ । এ যে অন্যায়, এ যে বাবার প্রতি জুলুম ।

পরদিন সকালে উঠে বাবাকে বলল যে, সে গাজীপুরে যাবে । গার্মেন্টসের চাকরি করবে । খুশির খবর হলেও বাবার মুখটা কেমন জানি কাঁদো কাঁদো ভাব! তার সাথে তীব্রহতাশা ফুটে উঠেছে । আক্ষেপের জলছাপটাও এড়ায়নি রাতুলের চোখকে । এতটুকুন বয়সে কটা দিনে অনেক কিছুই বুঝে নিয়েছে সে । তবে তার চোখে খুব একটা জল আসলোনা । কারণ, রাতে তো কম কাঁদেনি ।

শেষমেশ সিদ্ধান্ত হলো আর দুটো মাস থেকে তারপর যাবে রাতুল ।

এরমাঝখানের দিনগুলোত ছন্নছাড়া ভাবে কেটে গেলো ।

বাজার থেকে নতুন শার্ট, প্যান্ট আর একজোড়া জুতা কিনে দিয়েছে তার বাবা ।
ট্রাংকে তুলে রেখেছে । যাবার দিন পড়ে যাবে ।

তাই আজকে সে রং চটকানো শার্টটা পরেই শহরে যাচ্ছে ।
কারণ আজ রেজাল্ট দেয়ার কথা ।

সাইকেলের প্যাডেল চালাতে চালাতে যতই শহরের কাছাকাছি আসছে, বুকটা ততই দুরুদুরু কাঁপছে ।

অবশেষে শহরের একটা কম্পিউটারের দোকানে এসে থামলো । অনেক ভিড় । চেনা কয়েকটা সহপাঠির দেখা মিললো । তারাও রেজাল্ট দেখতে এসেছে ।

সবার দেখা শেষ । এবার তার দেখার পালা । কিন্তু ইন্টারনেটে প্রবলেম । তাই টেলিটক সিমে দেখতে হচ্ছে । শুধু রেজাল্ট আসছে , সব সাবজেক্টের রেজাল্ট আসছেনা । তবু রোল নাম্বার দিলো রাতুল, তবে ভয়ে ভয়ে । রোল নাম্বারটা বলেই বাইরে চলে এলো । বেশ ভয় আর অস্থির লাগছে ।
-রাতুল কে?
-জি ভাই, আমি ।
-আপনি জিপিএ ৫ পেয়েছেন !
রাতুলের কান শো শো করছে ।
চোখ ঝাঁপসা দেখছে । কারণ সে প্রাইভেট পড়তে পারেনি অর্থের অভাবে । তারপরেও. . . .?

নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে, এসএমএস স্বচক্ষে দেখলো সত্যিই সে A+ পেয়েছে । দোকানের ভাইটাকে টাকা দিয়ে সাইকেলে চেপে বসলো । তার সহপাঠীরা সোৎসাহে বলল, দোস্ত, তুইতো A+ পাইছিস! মিষ্টি খাওয়া !

রাতুলের কাছে ততটাকা নেই । তাই বললো, আরেকদিন খাওয়াবো ।

সাইকেল ঘুরিয়ে ফের রওনা হলো গ্রামে ।

বাড়ি ফিরার পথে রাতুলের চিন্তাকথা পাঠকদের সামনে তুলে ধরতে চাই না । কারণ বাড়ি ফিরার পথে সে তার নিজস্ব জগতের অনেক কিছু ভেবেছে । গোপন করে রেখেছে অশ্রুর আড়ালে । তবে একটা কথা বলে রাখি, বাড়ি ফিরে সে তার বাবাকে বলেছিলো-

বাবা, আমি ইন্টার পাস করেছি । জিপিএ- ৩.৫০ পেয়েছি ।

সেদিন রাতেই সে গাজীপুরের টিকেট কাটে । ঠাকুরগাঁও টু গাজীপুর । অনেক দূরের পথ ।
একেএকে সবাইকে বিদায় জানিয়ে কোচে উঠল রাতুল । গাজীপুরে তার দুলাভাইয়ের ওখানে
উঠবে সে ।

দশটার দিকে গাড়ি ছাড়লো । এই প্রথম রাতুল বাবা মা ছেড়ে দূরে যাচ্ছে । চেনাশহরটাও আজ গাড়ির ভিতর অচেনা লাগছে । গাড়ি চলছে ।
। তারপাশে একটা ভদ্রলোক । মনে হয়, ব্যবসার উদ্দেশ্যে ঢাকা যাবেন । রাতুল চুপটি করে বসে জানালা দিয়ে বাইরেটা দেখছে । মুখটা অনেক বিমর্ষ ।

সে তার বাবাকে মিথ্যে বলেছে । কারণ ভালো রেজাল্টের কথা শুনলে হয়তো যেতে দিতোনা ।
কিন্তু তাকে তো যেতেই হবে ।

টুত টুত করে পকেটের মোবাইলটা বেজে উঠলো । এসএমএস এলো ১৬২২২ থেকে ।
আসবেই তো । সেই
দুপুর থেকে কম এসএমএস
পাঠিয়েছে সে । কিন্তু একটা রেজাল্টো আসেনি ।
ইনবক্স খুলে দেখলো তার রেজাল্ট এসেছে । মেসেজের নিচে এসে তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো ।

একি! সে প্রত্যেক বিষয়েই A+ পেয়েছে ! তারমানে গোল্ডেন A+?

দুইমিনিট ধরে এসএমএসটা দেখার পর কী মনে করে যেনো ডিলিট করে দিলো ।

ফের বাইরে চাঁদটার দিকে তাকিয়ে আছে রাতুল ।
কী ভাবছে সে?
অপূর্ণ রাতের গল্প?
হয়তো ।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৯৩৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৭/০৮/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast