www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

প্রবাসীর গল্প

প্রবাসীর গল্প ।

প্রতিদিন শাটল ট্রেনে ভার্সিটি যাওয়া আর ক্লাস শেষে বাসায় ফেরা যেনো রুটিন হয়ে গেছে ।জীবনটাই একটি নিয়মের ছকে বাঁধা ।তারপর ও বাঁধার গন্ডি পেরিয়ে আবেগী মন হারিয়ে যেতে চায় কোনো এক দূর অজানায় ।২২ উর্দ্ধ তরুণ রায়হান ও মাঝে মাঝে শাটল ট্রেনের এ ঝনঝনানি আর ব্যাচেলর ম্যাচের ঝঞ্জাট থেকে মুক্ত হতে চায় ।কিন্তু ছাত্রজীবনের শেষ নাহলে কি আর মুক্তি মিলে ,কর্মীজীবনে আর এক ধরাবাঁধার ছকে শিকল পরতে হয় ।

প্রতিনিয়ত রায়হানের কল্পনার জগতে আজকাল এ সবই উদিত হয় ।আজ শাটল ট্রেনের সে ঝনঝনানি কেন যেনো অপ্রত্যাশিত সুর হয়ে হৃদয়ঙ্গম করতে লাগল ।হঠাৎ করে দুটি চোখ কেনো জানি চির পরিচিত আর অতি আপন মনে হল ।হরিণীর চোখের অধিকারিণী মেয়েটি রুপা চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বি বি এ ম্যানেজমেন্ট পড়ুয়া ছাত্রী ।একই ডিফার্টমেন্টের ছাত্র রায়হান ও শুধু পার্থক্যটা হল রায়হান তার ছেয়ে ২ব্যাচ সিনিয়ার ।

দিন শেষে ক্লান্ত রায়হান শরীলের ক্লান্তি উপলদ্ধি করতে পারলে ও মনের ক্লান্তি যেনো উপলদ্ধিত হলোনা ।সে অচেনা চোখ গুলো মনের আকাশে উদিত হতে লাগল ।এত সুন্দর চোখ হয় মানুষের ।এভাবে যেতে যেতে রায়হান বুঝতে পারল কেউ একজন তার মনে বাসা বেঁধেছে ।রায়হান ট্রেন স্টেশনে আজকাল নিজের অজান্তে কারো জন্যে আগে এসে বসে থাকে ক্লাস শেষে ফেরার পথে ও কারো অপেক্ষায় থাকে ।ধীরে ধীরে রুপা ও বুঝতে পারলো রায়হান তাকে কিছু বলতে চায় ।অবশেষে রুপা আর রায়হানের পরিচয় প্রেমে পরিণত হল ।

এভাবে দিন গড়িয়ে মাস ,মাস গড়িয়ে বছর গেলো রায়হান ও ছাত্রত্ব শেষ করে চাকরি নামক সোনার হরিণের পিছনে ছুটতে লাগল ।চাকরি সে কি আমাদের দেশে এত সহজে ধরা দেয় ।তবু ও রায়হান থেমে থাকেনা ,একদিকে রায়হানের মাথায় পরিবারের বোঝা অন্যদিকে রুপার ফ্যামিলি থেকে রুপার উপর বিয়ের চাপ বেড়েই চলেছে ।অবশেষে উপায়ান্তর না পেয়ে রায়হান স্টুডেন্ট ভিসায় বাহিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয় ।বাহির থেকে একটি এম বি করা হল ,সাথে বিদেশে সেটল হবে সংসারের ও হালধরা হবে দেশে বিয়ের বাজারে যেহেতু ইউরোপ ফেরত ছেলের কদর আছে সেহেতু রুপার পরিবারের নিকট ও তার কদর বাড়বে ।

রায়হান তার গন্তব্যে পৌছানোর জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ,মাঝখানে বাঁধ সাধল রুপা ,রুপার শেষ কথা ছিল ছোট্ট চাকরি হলে ও দুজন দেশে এক ছাদের নিচে থাকতে চায় ।কীন্তু রায়হানের মাথার উপর যে খোলা আকাশ ছাড়া কোনো ছাদ নেই ।স্কুল শিক্ষক বাবার উপর আর কতকাল নির্ভরশীল হয়ে থাকবে ? টি উ শ নি করে যে টাকা পায় তা দিয়ে নিজের খরছ চলে কিন্তু সংসারের চাকা ঘুরে না ।তার উপর রায়হানের বড় ভাই বিয়ে করে বউ নিয়ে শহরে থাকলে ও গ্রামের মা বাবা পুরো পরিবারের সাথে সম্পর্কহীন ।

সব কিছু মিলিয়ে পুরো পরিবারের বোঝা নিজ কাঁধেই রায়হান কে বহন করতে হবে ।একদিকে বৃদ্ধ বাবা মা পরিবার অন্যদিকে রুপার দু চোখের অশ্রু ,রুপার কথা ছিল হয়ত আমার দু হাত তোমাকে ধরে রাখতে পারবে না কিন্তু তোমাকে আমি ছেড়ে দেবোনা ।আমার দু হাত তোমাকে আটকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাবে ।

না রুপার ভালবাসা অবশেষে রায়হানের পরিবারের প্রতি দায়বদ্ধতা নিকট হারমানে ।কিন্তু শপথ হলো রায়হান ফিরে আসা পর্যন্ত রুপা তার অপেক্ষার প্রহর গুণবে ।বাবার জমি বিক্রির টাকায় পরিবারের চাকা ঘুরাতে রায়হান পাড়ি দেয় বিলেতে (লন্ডন )।

নতুন দেশ নতুন ভার্সিটি নতুন স্বপ্ন ।কিছুদিন যেতে না যেতে রায়হান বুঝতে পারল কল্পনায় ইউরোপ যতটা আরামদায়ক বাস্তবতায় ততটা কষ্টকর ।স্বপ্ন এবং বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন ।সপ্তাহে তিনদিন ক্লাস তারপর জব সব কিছু মিলিয়ে রায়হানের স্বপ্নের লন্ডন আর বাস্তবতার সাথে সে মিল খুঁজে পেলোনা এভাবে বছর খানেক অতিবাহিত হওয়ার পর আসলো কলেজ টিউশন ন ফ্রি ,এদিকে অসুস্থ বাবা দেশে প্রায় শয্যাশায়ী ।এত সব কিছুর মাঝে ও পরিবারের সবার মুখের হাসি আর রুপার সাথে আলাপন টুকুই ছিল রায়হানের স্বস্তির একমাত্র অবলম্বন ।কলেজ ক্লাস পড়া লেখা আর সম্ভবনা পরিবারের জন্য এ আত্মত্যাগ না করলে যে হয়ত বাবাকে হারাতে হবে ।টিউশন ফ্রি না দিয়ে রায়হান বাবার চিকিৎসার্থে সে টাকা দেশেই পাঠান ।স্কুল শিক্ষক বাবার কত স্বপ্ন ছিল সন্তানদের নিয়ে ,রায়হানের বড় ভাই থেকে ও না থাকার মত তাই রায়হানকে সব দায়িত্বের বার বহন করে যেতে হচ্ছে ।

দিশেহারা রায়হান এক সময় দ্বিগবিদ্বিগ হারিয়ে লন্ডন ছেড়ে অবৈধ উপায়ে পাড়ি দেয় জার্মানি ।ছাত্র থেকে সে হয়ে যায় রিফিউজি ,অবৈধভাবে কাজ করে সংসারের গানিটানা আর রুপার সাথে ঘরবাঁধার স্বপ্নে বিভোর রায়হান বৈধ হওয়ার জন্য জার্মানিতে আর এক জীবন যুদ্ধে লিপ্ত হয় ।দিন গিয়ে রাতে লুকায় ,আর রাতের আঁধার কেটে আবার ভোর হয় কিন্তু রায়হানের ভাগ্যাকাশে সূর্য উদিত হয়না ।মনে হয় রায়হানের ভাগ্যটা পাথরে ঢাকা তারপর ও রায়হানের চেষ্টা থেমে নেই ।ইতিমধ্যে রায়হান লন্ডন ছেড়ে জার্মানিতে প্রায় দু বছর কাটিয়ে ফেলেছে ।বাবার চিকিৎসার ব্যয়বার বহন করার জন্য রায়হান লন্ডন ছেড়ে জার্মানি এলে ও বাবা তাকে ছেড়ে পরকালে পাড়ি দেয় ।ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বাবার কবরে দু মুঠো মাটি দেওয়ার সৌভাগ্য রায়হানের হলনা ।

বাবাকে হারিয়ে রায়হান পৃথিবীতে আর একটি অবলম্বন হারিয়ে ফেললো ।ইদানিং রুপার সাথে ও রায়হানের তেমন একটা যোগাযোগ হয়না রায়হানের বুজার অবশিষ্ট রইল না যে রুপা অনেক পরিবর্তন হয়ে গেছে ।রুপার পরিবর্তন গুলো রায়হানের চোখ কে ফাঁকি দিতে পারলে ও মনকে ফাঁকি দিতে পারেনি ।তারপর ও রায়হান রুপাকে হারাতে চায় না ।নিজেরমনের সাথে নিজে যুদ্ধ করে যেতে লাগল অন্যদিকে রুপাকে ঠি ক আগের মত একই আশ্বাস দিয়ে যেতে লাগল আর কয়টা দিন ওয়ার্কপারমিট টা নিয়েই চলে আসবো ।

রায়হানের ওয়ার্কপারমিট না মিললেও ইতিমধ্যে রুপার বিয়ের পারমিট মিলে গেছে ।পরিবারের পছন্দে রুপার সাথে চট্ট্রগ্রামের এক ব্যবসায়ী ছেলের সাথে বিয়ে হয় ।বিয়ের কয়েকদিন আগে থেকে রুপা রায়হানের সাথে যোগাযোগ ছিন্ন করে ফেলে ।এদিকে রায়হান রুপাকে ফেইসবুক ইমো রুপার মোবাইল নাম্বার সর্বত্র চেষ্টা করে ওখুঁজে না পেয়ে রুপার চিন্তায় হতাশ হয়ে পড়ল ।প্রবাসে এসে বাবাকে হারালো ভালোবাসার মানুষকে হারালো পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটাই যেনো অনর্থক মনে হল ।

তারপর ও প্রবাসীদেরকে বেঁচে থাকতে হয় পরিবারের জন্য ছোট ভাইবোনের জন্য । তাদের বুকের ক্ষত গুলো শুকিয়ে আবার ক্ষত হয় কিন্তু তা দেখার কেউ থাকে না ।অবশেষে রায়হান ওয়ার্কপারমিট পেলো দেশে আসবে কতদিন মাতৃভূমি ছেড়ে প্রবাসে পড়ে আছে ।রুপার সাথে দেখা করবে এর মাঝে বাঁধ সাধল রায়হানের ছোট বোনের বিয়ে ।মায়ের অনুরোধে আরো কিছুদিন থেকে গেলো ছোট বোনটার বিয়ে দিয়ে তারপরেই দেশে ফিরল ।ইতিমধ্যে প্রবাসে রায়হানের প্রায় ৭ টি বছর কেটে গেলো রায়হান বিমান বন্দরে নেমে দেশের অনেক পরিবর্তন দেখতে পেলো ।তার সে স্কুল পড়ুয়া ছোট ভাইটা এখন ভার্সিটি পড়ে ছোট বোনটা এখন আর এক সংসারের বউ ।সবাইকে বিমান বন্দরে দেখে নিজ চোখে গড়িয়ে পড়ল দু ফোঁটা অশ্রুজল ,চোখের জলের নাকি রং হয়না তাই কোনটি খুশির আর কোনটি কষ্টের তা বুজা যায়না ।এ বিমানবন্দরে আজ থাকার কথা ছিল রায়হানের বাবার আর রুপার ।

কিন্তু না রুপা ও নেই বাবা ও নেই ।কিছু পেতেহলে নাকি কিছু হারাতে হয় এইটা প্রকৃতির নিয়ম ।ভাগ্যান্বেষী রায়হানের ক্ষেত্রে ও তাই হলো ।দেশে এসে রায়হান রুপাকে খুঁজে খুঁজে প্রায় একমাস পার করে দিল ।রুপার সেই স্মৃতি সেই স্থান সবই আছে শুধু রুপা নেই ।কোনো এক অজানা বিকেলে রায়হান জি ইসির সানমার ওশেন সিটির ফাস্টফুড শপে বন্ধুদের সাথে আড্ডারত এমতবস্তায় তার পাশের টেবিলে বসা ভদ্র মহিলা আর এক ভদ্র লোক ।প্রথমে নিজ চোখকেই বিশ্বাস করাতে পারল না যে রুপা কিনা ।রুপাই মেয়েটি তবে সে আর একা নয় সাথে তার স্বামী ।এ ভদ্র লোকটির স্থান আজ রায়হানর ে থাকার কথা ছিল ।কিন্তু পরিবারের হাল ধরতে ধরতে রুপাকে হারিয়েফেললো ।রুপা কথা দিয়েছিলো কিন্তু রুপার. কি দোষ কত দিন অপেক্ষা করা যায় ।রুপা রায়হানকে দেখে চমকে উঠলে ও না দেখার ভান করে স্বামীকে নিয়ে তারাতারি স্থান ত্যাগ করলো ।রায়হানের মনটা রুপার পিছু ছুটলে ও রায়হানের দুটি পা স্থির হয়ে আছে ।সে হটাৎ যেনো সেন্স লেস হয়ে গেলো ।কিছুই বুজে উঠতে পারলনা ।

এদিকে রায়হানের মা রায়হানের না সত্ত্বে ও ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজতে লাগল ।রায়হানের ছোট ভাইকে ও রায়হানের জন্য পাত্রী দেখতে বলা হল ।তখন ছোট ভাইয়ের জবাব ছিল ওর বয়স হয়ে গেছে কে তাকে বিয়ে করবে ।কথা গুলো রায়হান তার রুম থেকে স্পষ্ট শুনতে পেলো ।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রায়হান ভাবল সত্যিই ত বয়স হয়ে গেছে ।মেঘে মেঘে অনেক বেলা কেটে গেছে প্রবাসে ।রায়হান এ যাত্রায় বিয়ে না করেই ফিরল ।আবার কর্মস্থল ,সে ব্যাচেলর জীবন ,প্রবাসটাই যেন. দেশ হয়ে গেছে । জীবন কেটে যাচ্ছে মায়ের সাথে দেশে কথা বলার সময় মা প্রতিনিয়ত রায়হানকে বিয়ের তাগিদ দিয়ে যায় ।কিন্তু কেউত জানেনা এ মনে যে আজ ও রুপা বসবাস করে ।দেশ থেকে রায়হান ঘুরে এসেছে প্রায় এক বছর হয়ে গেলো ।

রুপার সাথে তার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ৩ বছরের মত ।হঠাৎ দেখি রুপার sms রায়হান প্রথমে বিশ্বাস করতে পারলনা ।পরবর্তীতে রুপার লিখা বিশাল sms এর বিস্তারিত পড়ে রুপার জন্য খুব কষ্ট হলো ।রুপার ডিভোর্স হয়ে গেছে. ছয়মাস হতে চললো ।সাংসারিক জীবনে অনেক নির্যাতিত হয়েছিল কিন্তু তারপর ও শেষ রক্ষা হলো না lরুপা আর রায়হান আবার পুনরায় তাদের অতীতে ফিরে গেলো । তাদের এক সময় বিয়ে হল ।কিন্তু রায়হানের মনে ক্ষত গুলো রয়ে গেলো ।বাবা হারানোর ক্ষত রুপাকে হারানোর ক্ষত ।রুপার সাথে বিয়ে হয়েছে বউ পেয়েছে কিন্তু ভালোবাসার রুপাকে হারিয়ে ফেলেছে সে কবে ।প্রবাস জীবনএমনি প্রিয়জন হারিয়ে যায় অতি আপনজন হারিয়ে যায় ।হারানোর ক্ষত নিয়ে বেঁচে থাকতে হয় ।এ ক্ষত কেউ দেখেনা কেউ বুজে না এ ক্ষতের যন্ত্রনা ।

লেখক --জে আলম দোলন
ফ্রান্স প্রবাসী
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮৭০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০১/০৭/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • Altamas Pasha ০৫/১১/২০১৮
    অসাধারণ লেখা
  • অনেক আনন্দ পেলাম।
  • Altamas Pasha ০২/০৭/২০১৮
    চমৎকার একটি গল্প পড়ে আনন্দ পেলাম।
 
Quantcast