আলোর যাত্রী
একদম কাড়াকাড়ি করবি না। চুপচাপ খাবি আর উঠে পড়বি।
গদাইয়ের এই কথায় অজিত মুখ টিপে হাসে। তাই দেখে দীপন মুখে হাত রেখে না হাসার ইশারা করে। সেটাই বুঝতে পেরে সবচেয়ে বড় তারা লঙ্কা পিঁয়াজ মাখা বাটিটা এগিয়ে দেয়।
মলিনা, মায়ের মন। সবই জানে। পান্তা ভাত। বেশি করে জল দেওয়া। তার উপরে শুধু লঙ্কা পিঁয়াজ। কে আর টানাটানি করবে?
গদাই এটুকুই জোগাড় করতে গতকাল দুপুর থেকে কত কষ্ট করেছে। তাই দিয়ে গত রাতের আর আজ সকালের টিফিনটা তো হল। বাবা হিসেবে সেটাই জানান দিয়ে সটান খেয়ে উঠে পড়ল গদাই।
পেট ভরে নি। মলিনা জানে। আরো জানে সামনের কল থেকে ঢকঢক করে জল খেয়ে নেবে।
গদাই ডান হাতে কলের মুখ চেপে ধরে বাম হাতে চাপা কল পাম্প করতে থাকে। তারপর ডান হাতে মুখ লাগিয়ে জল খেয়ে নেয়। পেট ভরে গেছে। এরপর পাশে গাছের তলায় দাঁড়ায়। সবে রোদ উঠেছে। তবু ভালই তেজ আছে।
তাহলে কি এই সংসারে তাদের এভাবেই বাঁচতে হবে।
সকালের খাবারটুকু খেতে না খেতে দুপুরের চিন্তা। একটু বেশি আয় করে যে জমা করবে তাও হয়ে উঠছে না। কোথা থেকে যেন ভুঁইফোড় অনুপম পাশে এসে দাঁড়ায়। বলে - কি রে গদাই, তোকে তখন থেকে খুঁজছি। রিক্সাটা নে আর চল।
অনুপমদের মাল বয়ে নিয়ে যাওয়া ট্রাক্টর আছে। আজ নিশ্চয় বিগড়েছে। তাই গদাইয়ের ডাক পড়েছে। না হলে তো ডাকে না। তাই নিয়ে বার দশেক খড় ভুষি আর কিছু উল্টোপাল্টা জিনিষের ভরা বস্তা বইতে বইতে তা প্রায় বিকেল হতে চলল। মাঝে অবশ্য কিছু জলপানি পেয়েছে। মুড়ি কলা চানাচুর। ভেবেছিল ছোটছেলে দীপনর জন্য কলাটা নিয়ে যাবে। কিন্তু অনুপমের মা বসেছিল একেবারে সামনে। গদাইকে ভাল চোখে দেখে।
আর দেখবেই না কেন? যেখানে যা রাখতে বলে সব কিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে দেয় গদাই। ধানের গোলার পাশে যে সব ইঁদুরের গর্ত ছিল তাও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। বাঁশের তৈরি ধামার কাঠি উঠেছিল। তাও গদাই ঠিক করে দিয়েছে। ঝাঁটাটা ভাল করে বেঁধে দিয়েছে। একেবারে পাকা কাজের লোক।
কাজ শেষ করে মজুরি নিয়ে ফিরছে এমন সময় দৌড়তে দৌড়তে পাড়ার বিলু এসে খবর দিল অজিত কোন গাছে চড়তে গিয়ে পড়ে গেছে।
গদাই বিরক্ত হয়। তাদের তো কোন গাছ নেই। অন্যের আমগাছে জামগাছে চড়ে আমা জাম পাড়ার একটা বদ অভ্যাস আছে অজিতের। আসলে নিজেদের কোন জমি নেই। চাষ আবাদ নেই। ফল মূলের গাছ নেই। পুকুরের মাছ নেই। শুধু একটু থাকার জায়গা আছে।
কোন কালে কবে হয়তো অনেক জায়গা জমি ছিল। সেসব নাকি দেনার দায়ে অসুখ বিসুখে সব বিক্রিবাটায় চলে গেছে। গদাইয়ের কিছু কিছু মনে পড়ে। কিছু মনে পড়ে না।
বাড়িতে গিয়ে দেখে সব হা হা হি হি করে হাসছে। অজিত হাত পায়ের ছড়ে যাওয়া জায়গায় লাল ওষুধ লাগিয়ে চুপ করে বসে আছে। অর্ণব গ্রামের বড় ডাক্তার। পাশেই থাকে। ডাক পড়লেই চলে আসে। কেউ বলে পকেট কাটা ডাক্তার। কেউ বলে ধন্বন্তরি। গদাই বড় সমীহ করে। অর্ণব বলল - গদাইকাকা, দাও দু'শটা টাকা দাও।
দিচ্ছি বলে গদাই অর্ণবকে ডেকে বাইরে নিয়ে এল। অর্ণবকে বাড়ির দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল - আজ নেই গো ভাইপো। তবে দিয়ে দেব।
অর্ণব হা হা করে হাসে। বলে - তোমার অজিত ছেলেটা পাকা মাথা। দীপনও কম যায় না। ওদের পড়াটা ছাড়িও না। ওরা যেন কোন ক্লাস হল?
গদাই হাত কাঁচুমাচু করে। বলে - এই তো দশ ক্লাস পেরোল।
অর্ণব গদাইয়ের কাঁধে হাত রাখে। বলে - গদাইকাকা, তোমাকে স্যালুট করি। খুব কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করছো। এর ভাল ফল পাবেই পাবে।
ভিজিট না পেয়েও কেউ প্রশংসা করে এই প্রথম দেখল গদাই। এটাই সবচেয়ে বড় ভাল ফলাফল।
তবু ঘরে সব সময় ক্ষুধা লেগে আছে। খাবার সংগ্রহ করতে করতে মনে হয় যেন এ পৃথিবীটা ক্ষুধার রাজ্য। এই ক্ষুধা নিবারণ হল তো পরের মুহূর্ত আবার ক্ষুধা নিবারণের চিন্তা। তবু তার মাঝে এরকম চাঁদ ওঠে। অর্ণব।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে গদাই ভাবে অজিতের জন্য তার খুব মান। খেতে পায় না, পরতে পায় না, অনেকের কাছে ধার দেনা তবু সবাই মাপ করে দেয়। কিছু জিজ্ঞেস করার আগে মলিনা বলে - বিকেল তো গড়িয়ে গেল এখন কিছু খাবে নাকি?
- কি আছে শুনি?
- কেন? তুমি কি ভেবেছ আমরা না খেয়ে থাকব?
সে কথা কখনই ভাবে না গদাই। প্রত্যেক শীতের শুরুতে যখন সামনের মাঠ থেকে রবি শস্য ওঠে। যদিও নিজের একটুও নেই। রায়বাবুদের বাড়িতে সোনার ফসল তুলতে গদাই চলে যায় মাস দুই তিন। কি সুন্দর সবুজ দুধ দুধ ধানের শিস ধীরে ধীরে পাকা সোনার রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। কত ভালোবেসে জল দিতে হয়, সার দিতে হয়, আস্তে আস্তে গোড়াতে নিড়ান দিতে হয়। এসবই নিজের চোখের সামনে দিনের পর দিন গদাই দেখেছে। কিন্তু গোলা ভর্তি করে অন্যের ঘরে তুলে দিতে হয়। অবশ্য দু এক বস্তা পায়। চৈত্রের শেষে যখন আবার বাড়ি ফেরে তখন নিয়ে আসে।
আর ততদিন মলিনা ঠিক সংসার চালিয়ে নেয়। নিজে পড়াশুনা ভাল জানে না। তাও অজিত দীপন এবং তারা কারো পড়াশুনা বন্ধ করে না। কেন না এর মাঝে স্কুলের পরীক্ষার রেজাল্ট আসে। এ সমস্ত কিছু ঠিক সামলে নেয় মলিনা।
চিমনি জ্বেলে পড়তে বসে ওরা। কেউ গুনগুন কেউ চিৎকার আর কেউ খাতায় কিসব লেখে। অথচ যে যার মত মশা তাড়িয়ে গরমে হাত পাখা নেড়ে ঠিক পড়া করে যায়। বড় কঠিন মনোযোগ। খড় আর টিনের ছাউনি ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে গদাই দেখে এসব। পাশে এসে দাঁড়ায় মলিনা। আকাশে প্রায় একটা গোল চাঁদ উঁকি মারে। মেঘ এসে জুটেছে। তাই চাঁদ একেবারে স্বচ্ছ নয়। গদাই বলে - আজ পূর্ণিমা কি না জানি না। তবে চাঁদটা তোমার হাতে বানানো রুটির মত।
মলিনা গলা নামিয়ে হাসে। ঘরের মধ্যে যেখানে ছেলেমেয়েরা পড়ছে সেদিকে আঙুল তুলে মলিনা বলে - আকাশে কি দেখছো নিচে মাটির দিকে তাকিয়ে দেখো ওই তোমার তিনটে চাঁদ।
গদাই হতাশা লুকায় না। বলে - আর চাঁদ। আর পারি না। কবে আমাদের খাওয়া পরার চিন্তা থাকবে না। কবে আমাদের দালান বাড়ি হবে।
মলিনা একটু রাগ দেখায়। বলে - আমাদেরকে তুমি ভালোবাসো না, তাই তো?
রাগ হয় গদাইয়ের। বলে - কেন? কেন তোমার এমন মনে হল?
- কেন? এই আমাদের রাজ প্রাসাদ। ওই দেখো তোমার রাজকুমার রাজকুমারী। এই আমি রাণী আর এই তুমি রাজা। এসব ভুলে গেলে?
মলিনা আর গদাই দুজনে এত জোরে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে যে অজিত দীপন এবং তারা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। হাঁ করে বাবা মাকে দেখে।
আশেপাশে অনেকেই বেরিয়ে আসে। অবাক হয়। ভাবে। বলাবলি করে - কি ফ্যামিলি রে বাবা? খেতে পায় না। ফুটো ঘরে বৃষ্টির জল পড়ে। এর ওর কাছে চেয়ে চিন্তে সংসার চলে। তাও প্রায়ই খিলখিলানো হাসি ওঠে। হা হা হি হি লেগেই থাকে। আর ছেলেমেয়েগুলোকে দেখো যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা কেউ। একটা হ্যারিকেন পর্যন্ত কিনতে পারে নি। বড় চিমনি জ্বেলে তার চারপাশে গোল হয়ে বসে গঁ গঁ করে পড়ে যায়। আর পারেও বটে। ভাল রেজাল্ট লেগেই আছে।
তাই পাড়া প্রতিবেশী মনে মনে বিরূপ হলেও ভাল ব্যবহার করে। ভালো করে কথা বলে। একটা সমীহ ভাব চোখে পড়ে।
চোখের কথা ভেবেই গদাই ছেলেমেয়েদের রাত জেগে পড়তে না বলে। কেন না দিনের আলোর সঙ্গে যতটা পারা যায় একত্রিত হতে হয়। সূর্যই তো সকল শক্তির উৎস। এসব জেনেছে দীপনর কাছ থেকে। একেবারে বাপ নেওটা ছেলে। তাই সূর্যের স্পর্শে থাকতে হয়। যেমন তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হয়। দিনেরবেলায় সময় সুযোগ থাকলেও না ঘুমিয়ে কাজ করে নিতে হয়। যাতে ক্লান্ত দেহ যেন রাতে পূর্ণ বিশ্রাম পায়। অজিত একটু রাত জেগে পড়তে চায়। কিন্তু বিলাস মাস্টারের কাছে শেখা এসব কথা বার বার বোঝায় গদাই। সেও ছাড়বার পাত্র নয়। বিজ্ঞান দিয়ে মানুষের মন দিয়ে নিজেকে শিক্ষিত হওয়ার চেষ্টায় বোঝায়।
কিন্তু গদাইও কম যায় না। বলে - রেশনে যা কেরোসিন পাই তাতে সপ্তাহ চলে না। খোলা মার্কেটে কেনার সামর্থ্য নেই। তার উপর সনাতনমুদি একটু বাড়তি তেল না দিলে তাও চলত না। তাই রাত জাগা চলবে না। দিনে বেশি বেশি করে পড়। দিনের আলো কাজে লাগাও। তাহলে তুইও দিনের মত হবি।
তারা বলে - তাহলে বাবা রাতের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না। সেও তো কম যায় না।
গদাই অতশত বোঝাতে পারে না। বলে - সে তো সূর্য আছে বলে। চাঁদও সুন্দর।
চোখ জুড়িয়ে আসে গদাইয়ের। আর ঘুমে কাদা হয়ে যায়।
পরের দিন খাল পাড়ের ধারে লকলকিয়ে ওঠা কলমিশাক তুলে আনে মলিনা। এ রকম খাস খাল বিল আছে। পুকুর আছে। মালিকানাও আছে। অক্ষয়জ্যেঠু রবিকাকা সত্যবাবু এদের নিজস্ব দালান বাড়ি উঠোন পুকুর আমগাছ জামগাছ সব্জি চাষ সব সব আছে। তবু কেমন যেন দুঃখী দুঃখী। সারাদিন ফিটফাট পোশাক পরে, ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়, একে ওকে হুকুম জারি করে তবু কি যেন একটা নেই নেই ভাব। সব আছে অথচ নেই নেই। আর মলিনার কিছু নেই তাই নেই নেই বলার সুযোগ নেই।
কেন না একটা দুটো জামা কাপড়। ফিটফাট হওয়ার সুযোগ নেই। ভাতের সঙ্গে যা পায় তাই খায়। আলাদা চয়েস করার সুযোগ নেই। তাছাড়া কতদিন রুটি খাওয়া হয় নি। আটার অনেক দাম। গম ভেঙে আটা করতে আবার অনেক ঝামেলা। তার চেয়ে ভাতই ঠিক আছে। চাল কেনো আর ফোটাও।
সেবার বংশীদের পুকুরে মাছ মরল। সেই মরা মাছ এনে দিব্যি রান্না করে খেয়ে নিল। আর এই যে কলমী শাক দীপন খেতে ভালোবাসে। মলিনাও জেনে গেছে কড়াই খুব গরম করে নিলে আর শেষের দিকে ভাজা ভাজা হয়ে গেলে যদি তেল দেওয়া হয় তবে তেলও কম লাগে আর তেলের স্বাদও লাগে।
দুপুরে তাই খেতে বসে গদাই বলে - অনেকদিন পরে দুপুরে একসাথে বসে খাচ্ছি। সনাতনমুদি ভালো লোক। দোকানের মালপত্র বয়ে দেওয়ার কাজ শেষ হতেই ছেড়ে দিল। বলল - যা বাড়ি যা। তোর সোনার টুকরো ছেলেমেয়েদের সাথে একসঙ্গে খাবি যা। খাওয়ার জন্য এক্সট্রা টাকাও দিল।
তারা বলে - বাবা, ভাইকে একটা জামা কিনে দাও। ভালো রেজাল্ট করল তারপর কিছু দাও নি।
খাওয়া না থামিয়ে গদাই একবার তারাকে দেখে আর একবার মলিনাকে। মলিনার চোখের ইশারায় গদাই বুঝে যায়। আসলে তারা তার নিজের ছিঁড়ে যাওয়া জামার কথা বলছে।
কেউ আর কিছু বলে না। শুধু অজিত বলে - মা, আর একটু কলমিশাক হবে।
দীপন কার সাথে খেলবে বলে বেরিয়ে যায়। তারার ঘুম ঘুম ভাব আসে। অজিত প্রথমে পেনসিল দিয়ে তারপর পেন দিয়ে খুব সুন্দর ছবি আঁকে। তারাকে বলে - দেখ দিদি দেখ। কেমন হয়েছে?
তারা যেমনই হোক প্রথমেই বলবে - বাহ। সুন্দর হয়েছে। আজও তাই বলে। তারপর ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে। বোঝার চেষ্টা করে গাছ পাখি পাহাড় নদীর মাঝে মানুষটিকে অজিত যেন আকাশ দেখাতে চাইছে। আলাদা করে কিছু নেই তবু মানুষের এই প্রকৃতির মাঝে যে জীবন আছে তা বুঝতে শিখেছে অজিত। আর তারা সে রকম আঁকতে পারে না তবে আঁকাকে বুঝতে শেখাও চাট্টিখানি কথা নয়।
পেছনে খড়ের গাদা থেকে শুকনো খড় বেছে ঘরে আনতে আনতে মলিনা ভাই বোনের এসব দেখে। এই খড়, কুড়িয়ে পাওয়া পাটকাঠি, শুকনো গাছের ডাল পাতা দিয়ে উনুন জ্বালতে হয়। দুবেলা ভাত ডাল তরকারি। সব দায়িত্ব মলিনার। অন্য কেউ মাথা ঘামায় না। আর ঘামাবেই বা কেন? বাদবাকি সবাই যে যার ভাবনা ভাবছে। ভাবনা পাল্টাপাল্টি করে নিলে মলিনা কি অজিতের মত ছবি আঁকতে পারবে?
পারবে না। কেন না মলিনা অতশত ভাবে না। আবার রাত্রি আসে। প্রতিদিন আসে। প্রতিদিন আজকে খাবার কি পাবে? রান্না কি হবে? ভাবতে ভাবতে ভাবনা হাত লাগায়। যোগালির কাজ, যোগাড়ের কাজ আর কাজের যোগাড় এসব কিছু করতে করতে রান্না হয় খাওয়া হয় আর সবাই ঘুমোতে যায়।
চাঁদ ওঠে। গাছের ফাঁকে তার জ্যোৎস্নায় ঝলমল করে ওঠে মাটির পৃথিবী। সেই পৃথিবীতে অজিত দীপন সকলে স্কুলে যায়। পায়ে হেঁটে। কোন কোন দিন ছুটি পায় গদাই। কেউ জনমজুরের জন্য ডাকে না। গ্রামের মাটি কাটার কাজ বন্ধ। বাঁধ উঁচু এখন আর হচ্ছে না। পাকা বাড়ির যোগালির কাজে যেতে মন চাইছে না। খুব খাটুনি। তাই গদাই ঘরে থেকে অজিত দীপন ও তারার স্কুল যাওয়া দেখে। একটা জুতো এনে দিতে পারে নি। ব্যাগগুলো ছেঁড়া। তার জন্য মানুষের কাছে কাছে হাত পাতে। কিন্তু অসৎ কিছু ভাবনা মনে আসে নি।
তাছাড়া মানুষের কাছে হাত পাতবে না তো কার কাছে হাত পাতবে? নিজের ও পরিবারের খাওয়া পরার মাপ না মেপে সংসার করে ফেলেছে। সেই সংসারকে মাঝ পথে তো ছেড়ে দিতে পারে না। বয়ে নিয়ে যেতেই হবে। এই বয়ে নিয়ে যাওয়ার নাম জীবন। এটুকু না থাকলে আর থাকল কি? এই যে অজিত স্কুলে যাচ্ছে সে কি জানে পড়তে পড়তে একদিন অনেক টাকা আয় করবে নাকি অনেক জ্ঞান অর্জন করবে? জ্ঞানের কি কাজ যদি না প্রয়োগ হয়? টাকারও কি কাজ যদি নিজের আঁটোসাঁটোতেই জীবন বয়ে যায়। আবার পরের জন্য বিলিয়ে দেওয়াও কি বুদ্ধিমানের কাজ?
এসব ভাবতে ভাবতে ঘরের দরজা জুড়ে বসে গদাই। সামনের পুকুর থেকে এক ঝলক বাতাস আসে। মনে খুশির হিল্লোল বয়ে যায়। গদাই ডাকে - মলি, এসো বসি। নরম রোদ। আর দেখো, এখনও উধাও হয়ে যায় নি সবুজ।
মলিনা হাসে। মানুষটা সারা জীবন শুধু খেটে গেল। ভাল ভাল পরা খাওয়া থাকা পায় নি কিন্তু এমন মানুষ কি সবাই পায়? বলে - কি ব্যাপার? হঠাৎ কেমন উদাস হয়ে পড়ছ।
গদাই নিজেকে বাঁশ বাঁধানো দরজার পাল্লায় এলিয়ে দেয়। বলে - উদাস নয়। মানুষ করা ও মানুষ হওয়ার চর্চা ভাবছি। ছেলেমেয়েকে কি মানুষ করতে পারব? খিদের এই রাজত্বে পূর্ণিমার চাঁদ কি তার জ্যোৎস্না দিতে পারবে? নাকি রুটির মত গোল হয়ে আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে আকাশে থেকে যাবে?
মলিনা বলে - তোমার কথা বুঝতে পারি না। এত বড় বড় কথা কোথায় শিখলে? কোন স্কুলে গিয়েছিলে?
- শিখতে হলে স্কুলে যেতে হয় না। মানুষের মাঝেই বিশ্ববিদ্যালয়। আমি তো মানুষের মাঝে রোজ কাজ করি।
সংসারের এটা ওটা করতে করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়। কুপি জ্বেলে গোল হয়ে বসে গদাই ও তার সংসার। সবার মুখে আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট হয়ে ওঠে সারা পৃথিবী জুড়ে। ঘরে ঘরে।
(২)
পৃথিবী জুড়ে এত ঘর। একতলা দোতলা পাঁচতলা দশ বিশ তিরিশ চল্লিশ। তবু কত মানুষ থাকে নীচ থেকে উপরে। সেই তো ঘরের ভেতরে ছোট্ট একটা খোপের মধ্যে। এই সাততলা বিল্ডিং-এ কত কামরা। প্রত্যেকটার নম্বর দেওয়া। নামও দেওয়া। রিসেপশনে খোঁজ করলে সব পাওয়া যাবে।
গদাইয়ের এই কথায় অজিত মুখ টিপে হাসে। তাই দেখে দীপন মুখে হাত রেখে না হাসার ইশারা করে। সেটাই বুঝতে পেরে সবচেয়ে বড় তারা লঙ্কা পিঁয়াজ মাখা বাটিটা এগিয়ে দেয়।
মলিনা, মায়ের মন। সবই জানে। পান্তা ভাত। বেশি করে জল দেওয়া। তার উপরে শুধু লঙ্কা পিঁয়াজ। কে আর টানাটানি করবে?
গদাই এটুকুই জোগাড় করতে গতকাল দুপুর থেকে কত কষ্ট করেছে। তাই দিয়ে গত রাতের আর আজ সকালের টিফিনটা তো হল। বাবা হিসেবে সেটাই জানান দিয়ে সটান খেয়ে উঠে পড়ল গদাই।
পেট ভরে নি। মলিনা জানে। আরো জানে সামনের কল থেকে ঢকঢক করে জল খেয়ে নেবে।
গদাই ডান হাতে কলের মুখ চেপে ধরে বাম হাতে চাপা কল পাম্প করতে থাকে। তারপর ডান হাতে মুখ লাগিয়ে জল খেয়ে নেয়। পেট ভরে গেছে। এরপর পাশে গাছের তলায় দাঁড়ায়। সবে রোদ উঠেছে। তবু ভালই তেজ আছে।
তাহলে কি এই সংসারে তাদের এভাবেই বাঁচতে হবে।
সকালের খাবারটুকু খেতে না খেতে দুপুরের চিন্তা। একটু বেশি আয় করে যে জমা করবে তাও হয়ে উঠছে না। কোথা থেকে যেন ভুঁইফোড় অনুপম পাশে এসে দাঁড়ায়। বলে - কি রে গদাই, তোকে তখন থেকে খুঁজছি। রিক্সাটা নে আর চল।
অনুপমদের মাল বয়ে নিয়ে যাওয়া ট্রাক্টর আছে। আজ নিশ্চয় বিগড়েছে। তাই গদাইয়ের ডাক পড়েছে। না হলে তো ডাকে না। তাই নিয়ে বার দশেক খড় ভুষি আর কিছু উল্টোপাল্টা জিনিষের ভরা বস্তা বইতে বইতে তা প্রায় বিকেল হতে চলল। মাঝে অবশ্য কিছু জলপানি পেয়েছে। মুড়ি কলা চানাচুর। ভেবেছিল ছোটছেলে দীপনর জন্য কলাটা নিয়ে যাবে। কিন্তু অনুপমের মা বসেছিল একেবারে সামনে। গদাইকে ভাল চোখে দেখে।
আর দেখবেই না কেন? যেখানে যা রাখতে বলে সব কিছু সাজিয়ে গুছিয়ে রেখে দেয় গদাই। ধানের গোলার পাশে যে সব ইঁদুরের গর্ত ছিল তাও খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। বাঁশের তৈরি ধামার কাঠি উঠেছিল। তাও গদাই ঠিক করে দিয়েছে। ঝাঁটাটা ভাল করে বেঁধে দিয়েছে। একেবারে পাকা কাজের লোক।
কাজ শেষ করে মজুরি নিয়ে ফিরছে এমন সময় দৌড়তে দৌড়তে পাড়ার বিলু এসে খবর দিল অজিত কোন গাছে চড়তে গিয়ে পড়ে গেছে।
গদাই বিরক্ত হয়। তাদের তো কোন গাছ নেই। অন্যের আমগাছে জামগাছে চড়ে আমা জাম পাড়ার একটা বদ অভ্যাস আছে অজিতের। আসলে নিজেদের কোন জমি নেই। চাষ আবাদ নেই। ফল মূলের গাছ নেই। পুকুরের মাছ নেই। শুধু একটু থাকার জায়গা আছে।
কোন কালে কবে হয়তো অনেক জায়গা জমি ছিল। সেসব নাকি দেনার দায়ে অসুখ বিসুখে সব বিক্রিবাটায় চলে গেছে। গদাইয়ের কিছু কিছু মনে পড়ে। কিছু মনে পড়ে না।
বাড়িতে গিয়ে দেখে সব হা হা হি হি করে হাসছে। অজিত হাত পায়ের ছড়ে যাওয়া জায়গায় লাল ওষুধ লাগিয়ে চুপ করে বসে আছে। অর্ণব গ্রামের বড় ডাক্তার। পাশেই থাকে। ডাক পড়লেই চলে আসে। কেউ বলে পকেট কাটা ডাক্তার। কেউ বলে ধন্বন্তরি। গদাই বড় সমীহ করে। অর্ণব বলল - গদাইকাকা, দাও দু'শটা টাকা দাও।
দিচ্ছি বলে গদাই অর্ণবকে ডেকে বাইরে নিয়ে এল। অর্ণবকে বাড়ির দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল - আজ নেই গো ভাইপো। তবে দিয়ে দেব।
অর্ণব হা হা করে হাসে। বলে - তোমার অজিত ছেলেটা পাকা মাথা। দীপনও কম যায় না। ওদের পড়াটা ছাড়িও না। ওরা যেন কোন ক্লাস হল?
গদাই হাত কাঁচুমাচু করে। বলে - এই তো দশ ক্লাস পেরোল।
অর্ণব গদাইয়ের কাঁধে হাত রাখে। বলে - গদাইকাকা, তোমাকে স্যালুট করি। খুব কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করছো। এর ভাল ফল পাবেই পাবে।
ভিজিট না পেয়েও কেউ প্রশংসা করে এই প্রথম দেখল গদাই। এটাই সবচেয়ে বড় ভাল ফলাফল।
তবু ঘরে সব সময় ক্ষুধা লেগে আছে। খাবার সংগ্রহ করতে করতে মনে হয় যেন এ পৃথিবীটা ক্ষুধার রাজ্য। এই ক্ষুধা নিবারণ হল তো পরের মুহূর্ত আবার ক্ষুধা নিবারণের চিন্তা। তবু তার মাঝে এরকম চাঁদ ওঠে। অর্ণব।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে গদাই ভাবে অজিতের জন্য তার খুব মান। খেতে পায় না, পরতে পায় না, অনেকের কাছে ধার দেনা তবু সবাই মাপ করে দেয়। কিছু জিজ্ঞেস করার আগে মলিনা বলে - বিকেল তো গড়িয়ে গেল এখন কিছু খাবে নাকি?
- কি আছে শুনি?
- কেন? তুমি কি ভেবেছ আমরা না খেয়ে থাকব?
সে কথা কখনই ভাবে না গদাই। প্রত্যেক শীতের শুরুতে যখন সামনের মাঠ থেকে রবি শস্য ওঠে। যদিও নিজের একটুও নেই। রায়বাবুদের বাড়িতে সোনার ফসল তুলতে গদাই চলে যায় মাস দুই তিন। কি সুন্দর সবুজ দুধ দুধ ধানের শিস ধীরে ধীরে পাকা সোনার রঙে রঙিন হয়ে ওঠে। কত ভালোবেসে জল দিতে হয়, সার দিতে হয়, আস্তে আস্তে গোড়াতে নিড়ান দিতে হয়। এসবই নিজের চোখের সামনে দিনের পর দিন গদাই দেখেছে। কিন্তু গোলা ভর্তি করে অন্যের ঘরে তুলে দিতে হয়। অবশ্য দু এক বস্তা পায়। চৈত্রের শেষে যখন আবার বাড়ি ফেরে তখন নিয়ে আসে।
আর ততদিন মলিনা ঠিক সংসার চালিয়ে নেয়। নিজে পড়াশুনা ভাল জানে না। তাও অজিত দীপন এবং তারা কারো পড়াশুনা বন্ধ করে না। কেন না এর মাঝে স্কুলের পরীক্ষার রেজাল্ট আসে। এ সমস্ত কিছু ঠিক সামলে নেয় মলিনা।
চিমনি জ্বেলে পড়তে বসে ওরা। কেউ গুনগুন কেউ চিৎকার আর কেউ খাতায় কিসব লেখে। অথচ যে যার মত মশা তাড়িয়ে গরমে হাত পাখা নেড়ে ঠিক পড়া করে যায়। বড় কঠিন মনোযোগ। খড় আর টিনের ছাউনি ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে গদাই দেখে এসব। পাশে এসে দাঁড়ায় মলিনা। আকাশে প্রায় একটা গোল চাঁদ উঁকি মারে। মেঘ এসে জুটেছে। তাই চাঁদ একেবারে স্বচ্ছ নয়। গদাই বলে - আজ পূর্ণিমা কি না জানি না। তবে চাঁদটা তোমার হাতে বানানো রুটির মত।
মলিনা গলা নামিয়ে হাসে। ঘরের মধ্যে যেখানে ছেলেমেয়েরা পড়ছে সেদিকে আঙুল তুলে মলিনা বলে - আকাশে কি দেখছো নিচে মাটির দিকে তাকিয়ে দেখো ওই তোমার তিনটে চাঁদ।
গদাই হতাশা লুকায় না। বলে - আর চাঁদ। আর পারি না। কবে আমাদের খাওয়া পরার চিন্তা থাকবে না। কবে আমাদের দালান বাড়ি হবে।
মলিনা একটু রাগ দেখায়। বলে - আমাদেরকে তুমি ভালোবাসো না, তাই তো?
রাগ হয় গদাইয়ের। বলে - কেন? কেন তোমার এমন মনে হল?
- কেন? এই আমাদের রাজ প্রাসাদ। ওই দেখো তোমার রাজকুমার রাজকুমারী। এই আমি রাণী আর এই তুমি রাজা। এসব ভুলে গেলে?
মলিনা আর গদাই দুজনে এত জোরে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে যে অজিত দীপন এবং তারা ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। হাঁ করে বাবা মাকে দেখে।
আশেপাশে অনেকেই বেরিয়ে আসে। অবাক হয়। ভাবে। বলাবলি করে - কি ফ্যামিলি রে বাবা? খেতে পায় না। ফুটো ঘরে বৃষ্টির জল পড়ে। এর ওর কাছে চেয়ে চিন্তে সংসার চলে। তাও প্রায়ই খিলখিলানো হাসি ওঠে। হা হা হি হি লেগেই থাকে। আর ছেলেমেয়েগুলোকে দেখো যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা কেউ। একটা হ্যারিকেন পর্যন্ত কিনতে পারে নি। বড় চিমনি জ্বেলে তার চারপাশে গোল হয়ে বসে গঁ গঁ করে পড়ে যায়। আর পারেও বটে। ভাল রেজাল্ট লেগেই আছে।
তাই পাড়া প্রতিবেশী মনে মনে বিরূপ হলেও ভাল ব্যবহার করে। ভালো করে কথা বলে। একটা সমীহ ভাব চোখে পড়ে।
চোখের কথা ভেবেই গদাই ছেলেমেয়েদের রাত জেগে পড়তে না বলে। কেন না দিনের আলোর সঙ্গে যতটা পারা যায় একত্রিত হতে হয়। সূর্যই তো সকল শক্তির উৎস। এসব জেনেছে দীপনর কাছ থেকে। একেবারে বাপ নেওটা ছেলে। তাই সূর্যের স্পর্শে থাকতে হয়। যেমন তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হয়। দিনেরবেলায় সময় সুযোগ থাকলেও না ঘুমিয়ে কাজ করে নিতে হয়। যাতে ক্লান্ত দেহ যেন রাতে পূর্ণ বিশ্রাম পায়। অজিত একটু রাত জেগে পড়তে চায়। কিন্তু বিলাস মাস্টারের কাছে শেখা এসব কথা বার বার বোঝায় গদাই। সেও ছাড়বার পাত্র নয়। বিজ্ঞান দিয়ে মানুষের মন দিয়ে নিজেকে শিক্ষিত হওয়ার চেষ্টায় বোঝায়।
কিন্তু গদাইও কম যায় না। বলে - রেশনে যা কেরোসিন পাই তাতে সপ্তাহ চলে না। খোলা মার্কেটে কেনার সামর্থ্য নেই। তার উপর সনাতনমুদি একটু বাড়তি তেল না দিলে তাও চলত না। তাই রাত জাগা চলবে না। দিনে বেশি বেশি করে পড়। দিনের আলো কাজে লাগাও। তাহলে তুইও দিনের মত হবি।
তারা বলে - তাহলে বাবা রাতের স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না। সেও তো কম যায় না।
গদাই অতশত বোঝাতে পারে না। বলে - সে তো সূর্য আছে বলে। চাঁদও সুন্দর।
চোখ জুড়িয়ে আসে গদাইয়ের। আর ঘুমে কাদা হয়ে যায়।
পরের দিন খাল পাড়ের ধারে লকলকিয়ে ওঠা কলমিশাক তুলে আনে মলিনা। এ রকম খাস খাল বিল আছে। পুকুর আছে। মালিকানাও আছে। অক্ষয়জ্যেঠু রবিকাকা সত্যবাবু এদের নিজস্ব দালান বাড়ি উঠোন পুকুর আমগাছ জামগাছ সব্জি চাষ সব সব আছে। তবু কেমন যেন দুঃখী দুঃখী। সারাদিন ফিটফাট পোশাক পরে, ছেলেমেয়েরা স্কুলে যায়, একে ওকে হুকুম জারি করে তবু কি যেন একটা নেই নেই ভাব। সব আছে অথচ নেই নেই। আর মলিনার কিছু নেই তাই নেই নেই বলার সুযোগ নেই।
কেন না একটা দুটো জামা কাপড়। ফিটফাট হওয়ার সুযোগ নেই। ভাতের সঙ্গে যা পায় তাই খায়। আলাদা চয়েস করার সুযোগ নেই। তাছাড়া কতদিন রুটি খাওয়া হয় নি। আটার অনেক দাম। গম ভেঙে আটা করতে আবার অনেক ঝামেলা। তার চেয়ে ভাতই ঠিক আছে। চাল কেনো আর ফোটাও।
সেবার বংশীদের পুকুরে মাছ মরল। সেই মরা মাছ এনে দিব্যি রান্না করে খেয়ে নিল। আর এই যে কলমী শাক দীপন খেতে ভালোবাসে। মলিনাও জেনে গেছে কড়াই খুব গরম করে নিলে আর শেষের দিকে ভাজা ভাজা হয়ে গেলে যদি তেল দেওয়া হয় তবে তেলও কম লাগে আর তেলের স্বাদও লাগে।
দুপুরে তাই খেতে বসে গদাই বলে - অনেকদিন পরে দুপুরে একসাথে বসে খাচ্ছি। সনাতনমুদি ভালো লোক। দোকানের মালপত্র বয়ে দেওয়ার কাজ শেষ হতেই ছেড়ে দিল। বলল - যা বাড়ি যা। তোর সোনার টুকরো ছেলেমেয়েদের সাথে একসঙ্গে খাবি যা। খাওয়ার জন্য এক্সট্রা টাকাও দিল।
তারা বলে - বাবা, ভাইকে একটা জামা কিনে দাও। ভালো রেজাল্ট করল তারপর কিছু দাও নি।
খাওয়া না থামিয়ে গদাই একবার তারাকে দেখে আর একবার মলিনাকে। মলিনার চোখের ইশারায় গদাই বুঝে যায়। আসলে তারা তার নিজের ছিঁড়ে যাওয়া জামার কথা বলছে।
কেউ আর কিছু বলে না। শুধু অজিত বলে - মা, আর একটু কলমিশাক হবে।
দীপন কার সাথে খেলবে বলে বেরিয়ে যায়। তারার ঘুম ঘুম ভাব আসে। অজিত প্রথমে পেনসিল দিয়ে তারপর পেন দিয়ে খুব সুন্দর ছবি আঁকে। তারাকে বলে - দেখ দিদি দেখ। কেমন হয়েছে?
তারা যেমনই হোক প্রথমেই বলবে - বাহ। সুন্দর হয়েছে। আজও তাই বলে। তারপর ভাল করে খুঁটিয়ে দেখে। বোঝার চেষ্টা করে গাছ পাখি পাহাড় নদীর মাঝে মানুষটিকে অজিত যেন আকাশ দেখাতে চাইছে। আলাদা করে কিছু নেই তবু মানুষের এই প্রকৃতির মাঝে যে জীবন আছে তা বুঝতে শিখেছে অজিত। আর তারা সে রকম আঁকতে পারে না তবে আঁকাকে বুঝতে শেখাও চাট্টিখানি কথা নয়।
পেছনে খড়ের গাদা থেকে শুকনো খড় বেছে ঘরে আনতে আনতে মলিনা ভাই বোনের এসব দেখে। এই খড়, কুড়িয়ে পাওয়া পাটকাঠি, শুকনো গাছের ডাল পাতা দিয়ে উনুন জ্বালতে হয়। দুবেলা ভাত ডাল তরকারি। সব দায়িত্ব মলিনার। অন্য কেউ মাথা ঘামায় না। আর ঘামাবেই বা কেন? বাদবাকি সবাই যে যার ভাবনা ভাবছে। ভাবনা পাল্টাপাল্টি করে নিলে মলিনা কি অজিতের মত ছবি আঁকতে পারবে?
পারবে না। কেন না মলিনা অতশত ভাবে না। আবার রাত্রি আসে। প্রতিদিন আসে। প্রতিদিন আজকে খাবার কি পাবে? রান্না কি হবে? ভাবতে ভাবতে ভাবনা হাত লাগায়। যোগালির কাজ, যোগাড়ের কাজ আর কাজের যোগাড় এসব কিছু করতে করতে রান্না হয় খাওয়া হয় আর সবাই ঘুমোতে যায়।
চাঁদ ওঠে। গাছের ফাঁকে তার জ্যোৎস্নায় ঝলমল করে ওঠে মাটির পৃথিবী। সেই পৃথিবীতে অজিত দীপন সকলে স্কুলে যায়। পায়ে হেঁটে। কোন কোন দিন ছুটি পায় গদাই। কেউ জনমজুরের জন্য ডাকে না। গ্রামের মাটি কাটার কাজ বন্ধ। বাঁধ উঁচু এখন আর হচ্ছে না। পাকা বাড়ির যোগালির কাজে যেতে মন চাইছে না। খুব খাটুনি। তাই গদাই ঘরে থেকে অজিত দীপন ও তারার স্কুল যাওয়া দেখে। একটা জুতো এনে দিতে পারে নি। ব্যাগগুলো ছেঁড়া। তার জন্য মানুষের কাছে কাছে হাত পাতে। কিন্তু অসৎ কিছু ভাবনা মনে আসে নি।
তাছাড়া মানুষের কাছে হাত পাতবে না তো কার কাছে হাত পাতবে? নিজের ও পরিবারের খাওয়া পরার মাপ না মেপে সংসার করে ফেলেছে। সেই সংসারকে মাঝ পথে তো ছেড়ে দিতে পারে না। বয়ে নিয়ে যেতেই হবে। এই বয়ে নিয়ে যাওয়ার নাম জীবন। এটুকু না থাকলে আর থাকল কি? এই যে অজিত স্কুলে যাচ্ছে সে কি জানে পড়তে পড়তে একদিন অনেক টাকা আয় করবে নাকি অনেক জ্ঞান অর্জন করবে? জ্ঞানের কি কাজ যদি না প্রয়োগ হয়? টাকারও কি কাজ যদি নিজের আঁটোসাঁটোতেই জীবন বয়ে যায়। আবার পরের জন্য বিলিয়ে দেওয়াও কি বুদ্ধিমানের কাজ?
এসব ভাবতে ভাবতে ঘরের দরজা জুড়ে বসে গদাই। সামনের পুকুর থেকে এক ঝলক বাতাস আসে। মনে খুশির হিল্লোল বয়ে যায়। গদাই ডাকে - মলি, এসো বসি। নরম রোদ। আর দেখো, এখনও উধাও হয়ে যায় নি সবুজ।
মলিনা হাসে। মানুষটা সারা জীবন শুধু খেটে গেল। ভাল ভাল পরা খাওয়া থাকা পায় নি কিন্তু এমন মানুষ কি সবাই পায়? বলে - কি ব্যাপার? হঠাৎ কেমন উদাস হয়ে পড়ছ।
গদাই নিজেকে বাঁশ বাঁধানো দরজার পাল্লায় এলিয়ে দেয়। বলে - উদাস নয়। মানুষ করা ও মানুষ হওয়ার চর্চা ভাবছি। ছেলেমেয়েকে কি মানুষ করতে পারব? খিদের এই রাজত্বে পূর্ণিমার চাঁদ কি তার জ্যোৎস্না দিতে পারবে? নাকি রুটির মত গোল হয়ে আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে আকাশে থেকে যাবে?
মলিনা বলে - তোমার কথা বুঝতে পারি না। এত বড় বড় কথা কোথায় শিখলে? কোন স্কুলে গিয়েছিলে?
- শিখতে হলে স্কুলে যেতে হয় না। মানুষের মাঝেই বিশ্ববিদ্যালয়। আমি তো মানুষের মাঝে রোজ কাজ করি।
সংসারের এটা ওটা করতে করতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয়। কুপি জ্বেলে গোল হয়ে বসে গদাই ও তার সংসার। সবার মুখে আকাঙ্ক্ষা স্পষ্ট হয়ে ওঠে সারা পৃথিবী জুড়ে। ঘরে ঘরে।
(২)
পৃথিবী জুড়ে এত ঘর। একতলা দোতলা পাঁচতলা দশ বিশ তিরিশ চল্লিশ। তবু কত মানুষ থাকে নীচ থেকে উপরে। সেই তো ঘরের ভেতরে ছোট্ট একটা খোপের মধ্যে। এই সাততলা বিল্ডিং-এ কত কামরা। প্রত্যেকটার নম্বর দেওয়া। নামও দেওয়া। রিসেপশনে খোঁজ করলে সব পাওয়া যাবে।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ন্যান্সি দেওয়ান ১১/০৯/২০২১Nice
-
ফয়জুল মহী ১০/০৯/২০২১সমৃদ্ধ অনুভূতির সৃজন।
-
স্বপন রোজারিও (মাইকেল) ১০/০৯/২০২১Nice post. Thanks.
-
নবীন মাহমুদ ১০/০৯/২০২১অসম্ভব সুন্দর ।
বাস্তবতার এক নিবিড় ছোঁয়ায় মরা গল্পটি।
শুভেচ্ছা রইলো