www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গোপলার কথা - ৪০

কালো অক্ষরেই আলো
-------------------
আমি ছোটবেলায় কোনদিন বিশেষ খুব একটা খেলাধূলা করিনি। তখন টিউশনের রেওয়াজ ছিল না। তাই কারো কাছে টিউশন পড়ি নি। তবে বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে নিজস্ব প্রাণের টানে ক্লাসের বই বার বার পড়তাম।
আমি গাছে উঠতে পারি না। ঘুড়ি ওড়াতে শিখি নি। কাঁচের গুলি খেলা একটু আধটু পারতাম তবে সবাই আমাকে ঠকিয়ে দিত। তাই সময় পেলে নিজে খুব একটা খেলি নি। অন্যদের খেলা দেখতাম। দু এক দানের পরেই চলে আসতাম। বিল পুকুরের ধারে ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে কৈ মাছ উঠত। আমি ধরতে পারতাম না। তাই আর খুব একটা চেষ্টাও করতাম না। ঘরের কোণে কোনদিন রান্নাবাটি খেলি নি। আমি জীবনে কোনদিন কোন পুতুল পাই নি। পুতুল পুতুল খেলাও খেলি নি। যেটুকু ফুটবলে লাথি মেরেছি তা সৈভাগ্যক্রমে। আমাকে কেউ খেলতে নিত না। কিংবা খেলতে পেলেও শুধু দৌড়েছি বা গোল পোষ্টে দাঁড়িয়েছি। পায়ে বল পেতাম না বা পেলেও সদ্ব্যবহার করতে পারতাম না। ভাঙা কাঠের বা তাল পাতার গোড়ার দিকের দাঁত বের করা অংশ বাদ দিয়ে তাকে ব্যাট বানিয়ে পলিথিন প্যাকেট পোটলা করে বল বানিয়ে ক্রিকেট খেলত অনেকে। আমি তাতে শুধু মাঠের ধারে দাঁড়িয়ে থাকতাম। খেলতে পারতাম না। আমার মত অনেক ছেলেরা মেয়েরা সারাদিন মাঠ ঘাট দাপিয়ে বেড়াত। শুধু খেলা আর খেলা। আমি এরকম করতাম না। সেই সময়টুকু আমি পড়ার চেষ্টা করতাম।
স্কুলের খেলাধূলায় আমার অংশগ্রহণ ছিল না। দু একবার দৌড়াদৌড়িতে অংশ নিয়ে কিছুই পারতাম না। অনেকেই এসবের জন্য পুরস্কার নিত। আমি হাঁ-করে দেখতাম। আমি হাতের লেখা, আবৃত্তি, বিতর্ক, শ্রুতিলিখন, গল্প লেখা ইত্যাদি বিষয়ে অংশ নিতাম। মাঝে মধ্যে দু একটা পুরস্কার পেতাম। 
পুকুরে একডুবে অনেকেই তলার পাঁক তুলে আনতে পারত। আমি পারতাম না। বাকীরা বলত - ভেদা (বোকা) ছেলে। শালুক তুলতে ডিঙি বেয়ে অনেকেই চলে যেত অনেকদূর। আমি পারতাম না। ডিঙির ব্যালেন্স রাখতে পারতাম না। নিজেদের সাইকেল ছিল না। এর ওর কাছে একটু আধটু পেয়েছি কিন্তু চালানো শিখতে পারি নি। সাইকেল চালানো শিখেছি তিরিশের পরে। নিজের আয়ে সাইকেল কিনে।
একাদোক্কা গোল্লাছুট কিত্ কিত্ এসব খেলা আমি খেলতাম খুব কম। বিশেষ মনে পড়ে না। তাছাড়া এসব ভাল পারতাম না। পাঁচ গুটি খেলায় অনেকেই হাতের উল্টো পিঠে পাঁচটা গুটি রাখতে পারত। আমি একটাও পারতাম না। তাই এসব আমি অনেককে খেলতে দেখেছি। কিন্তু নিজে খুব একটা খেলি নি। সেই সময়টুকু পড়াশুনাতে মন দেওয়ার চেষ্টা করেছি।
বাড়ির কাজকর্মে নিয়মিত হাত লাগিয়েছি। ধান রোয়া, ধান কাটা, জমিতে সার ছড়ানো, মাটি কোপানো, জল সেচ, আল দেওয়া, কাদা ক্ষেত সমান করা, বাজার হাট করা, কলমী শাক শুশনি শাক তুলে আনা, বেগুন লঙ্কার চাষ করা, মায়ের সাথে রান্নায় সহযোগিতা করা ইত্যাদি সব কাজ করেছি। এর বাইরে যখন যেটুকু সময় পেয়েছি সেই শিশুবেলা থেকে পড়াশুনা করেছি। ক্লাসের পড়া তো করতাম। তার বাইরে তখন থেকে নিজস্ব তাগিদে লাইব্রেরীর সদস্য ছিলাম। খুব কবিতা মুখস্থ করতাম আর আবৃত্তি করতাম। পাড়ার লোকেরা বলত - ছেলেটা কি রে? সবসময় পড়া আর পড়া। পাগল হয়ে যাবে দেখছি।
পাগল কিন্তু হই নি।
এই পড়ার ইচ্ছে বা তাগিদে আমাকে কেউ জোর করে নি। খুব সুন্দর আঁকতে পারতাম। তবে তা শুধু পেনসিলে বা কলমে। আমি কোনোদিন আঁকার জন্য কোন রঙ পাই নি।
এই যে এত খেলা বা কোন খেলাই আমি খেলি নি। শুধু পড়া পড়া করে গেছি। শিশুকালের বাল্যখিল্যতা করি নি। উন্মুক্ত আকাশের সাথে বইয়ের কালো অক্ষরে যুক্ত হয়েছি। তাতে কিছু একটা করে আজ সমাজের বুকে এগিয়ে আসতে পেরেছি।
কিন্তু যারা সেদিন আমার বাল্যজীবনে ছিল, সেইসব শিশুখেলায় খুব এক্সপার্ট ছিল, সারাদিন মাঠে ঘাটে দাপিয়ে খেলত। তারা এখন চাষবাস করে। প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া করে। আমাকে যেভাবে খেলায় ধাপ্পাবাজি করত আজও এর ওর সঙ্গে পার্টি পলিটিক্স আর ধাপ্পাবাজি করে। হিংসে করে মারামারি করে।
তারা তো বইয়ের ভার থেকে দূরেই ছিল। শিশুকাল ঘুড়ি উড়িয়ে, দৌড় ঝাঁপ করে, রান্নাবাটি খেলে, বর বউ খেলে কাটিয়েছে শিশুকাল খুব এনজয় করেছে, তাহলে তারা পিছিয়ে পড়ল কেন? চাকরি বাকরি হোক কিংবা মানবিকতা কোন কিছুতেই তারা এগিয়ে যেতে পারে নি।
তারা প্রায়ই স্কুল বন্ধ করত। আজ বৃষ্টির জন্য, কাল খরার জন্য, পরশু শীতের জন্য। আমি কখনও স্কুল বন্ধ করি নি। তাদের মত আমার শৈশব, আমার শিশুকাল বইয়ের ভার বিহীনে কাটে নি। আরো বই আমাকে টানত। পড়তাম। পড়ে বুঝেছি যা জানতে চাই, যা জানতে চাই না সব আছে বইয়ে। এখন মনে হচ্ছে সেই শৈশবে কেন আরও পড়ি নি। এখন পড়ার আগ্রহে সেই ধৈর্য এখন আর খুঁজে পাচ্ছি না। এখন যারা বলছেন পড়ার ভারে শিশুকাল হারিয়ে যাচ্ছে তাদের কাছে এ আমার বিনীত প্রশ্ন।
তাই শিশুদের মধ্যে বইয়ের ভার বেশি বেশি করে চিৎকার করবেন না। পড়ে কেউ কোনদিন পাগল হয় নি। হবেও না। এই ভার ছেড়ে দিলে শৈশব কেটে যাবে তারপর পড়বে বেকায়দায়। বরং শৈশবের ভার বহন পরবর্তীতে যখন অনেক অনেক পড়া শুরু হবে কিংবা পড়ার বাইরে নিজের গুরুদায়িত্ব বাড়বে তখন তা কখনওই তার কাছে ভারী মনে হবে না।
নিজের বই নিজে বইছে। নিজের বই নিজে মুখ গুঁজে পড়ছে। আরও গুচ্ছের নানা রকমের বই পড়তে হচ্ছে। ক্ষতি কি? কষ্ট হচ্ছে। হোক। কে বলেছে ছেলেটি বা মেয়েটি কষ্ট সহ্য করতে চায় না? কে বলেছে কষ্ট করতে পারবে না? সে চায় আপনার মত কষ্ট করেই বড় হতে। কষ্টকে অনুভব করে বড় হলে ও আরো বেশি বড় হওয়া বুঝবে। এসব যে কোন শিশুবেলা বুঝতে চায়, অনুভূত হতে চায়। কেউ কি শুনেছে পড়ার চাপে ছেলে কিংবা মেয়েটি সুইসাইড করেছে? কেউ সুইসাইড করে পড়ার জন্য নয়, তার ফলাফলের চাপ দেওয়ার জন্য। বাবা মা বা অভিভাবকের এই চাপ সুইসাইডের অন্যতম কারণ।
'আমার মত তোমাকে কষ্ট করতে হবে না' বলে তাকে দূরে সরিয়ে রাখবেন না। তার ব্যাগ তাকে বইতে দিন। তার কাছ থেকে কেড়ে নেবেন না। তার পড়া তাকে আরো বেশি করে পড়তে দিন। ওটা কাজে লাগবে না, পড়তে হবে না। রেখে দাও বলে তাকে সরিয়ে রাখবেন না।
কে বলেছে বেশি পড়া শিশুটির শৈশব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে? পড়া থেকে সরিয়ে, বই থেকে সরিয়ে, কত আর পড়বে বলে আপনি তার শৈশব নষ্ট করে দিচ্ছেন না তো? বেশি বেশি পড়ার ধৈর্য্য, মনে রাখার দুর্দান্ত ক্ষমতা ইত্যাদির বয়স কিন্তু একমাত্র শৈশব। বয়সকালে আপনি কি তা পারবেন?   
শৈশব যেমন আকাশ মাটি সবুজ দেখার বয়স, তেমনি জীবনকে চেনার বয়স। এই জীবন চেনার সহজ এবং প্রধান অবস্থান বই পড়া। কালো অক্ষরই জীবনে আলোর সন্ধান। যে যতটা এই কালোর সাথে পরিচিত ততটাই জীবন দর্শনে সে অগ্রবর্তী।
আপনি শৈশবকে যতটা ভারমুক্ত রাখার প্রয়াস করবেন ততটাই সে ফাঁকি বা ফোকটে পাওয়ার উপলব্ধি অর্জন করবে। আজকাল দিকে দিকে কাটমানি, পারসেণ্টেজ, কমিশন, বখরা ইত্যাদির যে উৎপাত শুরু হয়েছে তা এই ভারমুক্ত জীবন ভাবনা থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রবাহিত হচ্ছে না তো? ভেবে দেখবেন।
স্কুলের পড়ার সাথে নাচ, গান, আবৃত্তি, আঁকা, হাতের কাজ সবকিছু শেখানো উচিত। যতটুকু পারবে। পড়াশুনার এবং পড়াশুনা জাতীয় বিষয়ে শৈশব ব্যস্ত থাকুক। বাবা মা যেমন সারাদিন অফিস ও সংসার সম্পর্কে ব্যস্ত থাকে তেমনি। এই ব্যস্ততায় কেটে যাওয়া সময় শৈশব ঠিক তার নিজস্ব বুঝে নেবে। আমরা বড়রা 'হায় হায় ছেলেটা কত কষ্ট করছে, মেয়েটা আর কত করবে' এই ভাবনায় নানান ভারমুক্ত দিক খুঁজে শৈশবকে সরিয়ে দিচ্ছি।
কর্ম চঞ্চল শিশুটি কিন্তু এই ভারমুক্ত অবস্থানে ঠিক তার ভার জুটিয়ে নেয়।
কি রকম? যখন সে দিনের যে সময়ে পড়ছে না বা পড়া জাতীয় কিছু করছে না সেই সময়ে যেটা তার দেখা উচিত নয় তাই দেখে। যেটা তার ভাবা উচিত নয় তাই ভাবে। যেটা তার করা উচিত নয় তাই সে করে। অনেকটা বড়দের অনুকরণে, বড়দের মত, বড় হয়ে গেছে ভেবে।
কেন না সে ভারমুক্ত হতে চায় না, তাই। যা দেখছে যা শুনছে যা বলছে তাতেই সে ভারী হচ্ছে। আর এই বড়দের মত করে ভাবতে থাকা বিষয় ভাবনায় ভারী হওয়ার জন্য তার বুদ্ধি, তার ভাবনা সবসময় নিষিদ্ধের দিকে হাত বাড়ায়। এবং তা লুকিয়ে রপ্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করে। অর্থাৎ সে আরো ভারী হয়ে ওঠে। আপনি যেভাবে তাকে চাপমুক্ত করতে চেয়েছেন সেটাই উল্টে শিশুর বুদ্ধিতে চাপ বৃদ্ধি ঘটাল। তাহলে লাভটা কি হল? এখন তারই পরিণামে মোবাইল, ইণ্টারনেট, ট্যাব, অ্যাপ্স এবং গেম, প্রাণঘাতী গেম ইতাদি ধীরে ধীরে ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করছে।   
তাই খাওয়ার ব্যাপারে, পোশাকের ব্যাপারে, চলা, বলা, দেখা, শোনা ইত্যাদি আদব কায়দার সামাজিক ভার শিশুকালের উপর না চাপিয়ে বই পড়ার ভার চাপান। তাহলে তা কখনওই শিশুকালের কাছে ভারী মনে হবে না।
মনোবিদ, তাত্ত্বিক, কাউন্সেলার, অভিজ্ঞ, শিক্ষাবিদ ইত্যাদি সম্প্রদায় কোনভাবে প্রত্যক্ষ অবস্থানে যুক্ত না হয়ে শুধুমাত্র এক্সপেরিমেণ্টাল মন্তব্য ও ব্যাখ্যা দেন। যা কোনভাবেই খুব একটা কার্যকরী না। যে শিশুকাল পড়ার ভারে ন্যুজ্ব সেই অতিক্রম করেছে হাজার পথ নিজের মেরুদণ্ড সোজা করে।
তাছাড়া শিশুকাল সম্পর্কে বা শিশুদের মানুষ করার ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোন তত্ত্ব, থিওরি বা অবস্থান নেই। কবিতা গল্প, উপন্যাস, আঁকা, আবৃত্তি, গান ইত্যাদির যেমন রূপরেখা আছে সেই অনুযায়ী এগিয়ে তাকে ভেঙে চূরে আবার নতুন অবস্থানে আনা যায়। কিন্তু শিশু মানুষ করা ফ্যামিলি অনুযায়ী, সমাজ অনুযায়ী, অবস্থান অনুযায়ী সর্বদাই পরিবর্তনশীল। কেউ বলতে পারবে না রবীন্দ্রনাথের মা এ রকম মানুষ করেছিল তুমি এভাবে মানুষ করলে ছেলে তোমার রবীন্দ্রনাথ হয়ে যাবে, তোমার মেয়ে মাদাম কুরী হয়ে যাবে কিংবা বিদ্যাগাসর হবেই হবে, না হলে রামমোহন তো নিশ্চয়ই হবে।  
কিন্তু একটা ব্যাপারে সবাই একমত হবেন যে রবীন্দ্রনাথ, বিদ্যাসাগর, মাদাম কুরী কিংবা মাদার টেরিজার মত ভাবনায় বড় করতে হলে শিশুকে শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে তা কখনই বই থেকে দূরে সরিয়ে নয়। বইয়ের কালো অক্ষরই সবুজ আগামীর পথ পরিক্রমা। তাই পড়া এবং পড়া সংক্রান্ত বিষয়ের সঙ্গে যে শিশুকাল যত বেশি জড়িয়ে থাকবে সেই শিশুকাল ততবেশি অগ্রবর্তী হবেই হবে। 
অথচ শৈশব যদি না চায় সে নিজেই সরে আসবে। কেন না পড়াশুনা বা এই পড়াশুনার আঙ্গিক কোন শিশুকাল 'হ্যাঁ' বলবেই না। সবসময় না না করবেই। একটু জোর করে ধরে বেঁধে করাতে হয়। স্কুল থেকে, বাড়ি থেকে বা টিউশন থেকে সেই জোর বা চাপ ধরে রাখতে হবে।   
পড়াশুনা বা তার আনুসঙ্গিক ব্যাপারে শিশুটির সাথে মিশে আপনি এগিয়ে নিয়ে চলুন। যদি আপনি তার পড়াশুনা ও পড়াশুনা সংক্রান্ত আনুসঙ্গিকের সাথে যুক্ত থাকেন তাহলে  ঠিক জেনে যাবেন আপনার শিশুটির কেমন বহন ক্ষমতা। সে সেই অনুযায়ী তার ভার কাঁধে তুলে নেবে।
আমাদের ভাবার দরকার নেই। সব শিখুক। ব্যস্ত থাকুক তারপর তার আগ্রহ অনুযায়ী নিজে খুঁজে নেবে কি তার চাই, আর কি চাই না।
এই সব শেখার মধ্যে আবার বিতর্ক। কেন না আমরা বড়রা শিশুটিকে সব কিছুতেই পারঙ্গম করার প্রয়াসে লেগে থাকি। সে নাচ হোক গান হোক আবৃত্তি হোক কিংবা স্কুলের পরীক্ষা সবেই নাম্বর ওয়ান বা তার কাছাকাছি হতেই হবে। ফলে কোন শৈশব সেই চাপ নিতে পারে না।
তোমাকে ক্লাসে ফার্স্ট হতেই হবে, ৯৫ এর নীচে নামা চলবে না, গানে একেবারে প্রাণ ঢেলে গাইতে হবে লতার মত, নাচে ডোনাকে ভুলে গেলে চলবে না, আবৃত্তিতে ঊর্মিমালা কি রকম বলছে শুনতে পাস নি, যোগেন চৌধুরীর ছবিটা দেখ তারপর রঙ দে ইত্যাদি ইত্যাদি।
নাচ গান আবৃত্তি আঁকা ইত্যাদি শুধু শুধু শেখা যাবে না। শিখলেই প্রাইজ ঘরে আনতেই হবে। চ্যারিটি শো করতেই হবে। খুব ভাল হতেই হবে। হয় ১০০ শতাংশ হতেই হবে নয় তো তুমি জিরো। বাবা মায়ের, আত্মীয় স্বজনের, পাড়া প্রতিবেশীর এই মানসিকতাই হল শিশুটির কাছে আসল ভার। শিশুটিও কোন বিষয়ের মধ্যমমানকে ফেলিওর ভাবে। ভাবতে শেখে সে সত্যি সত্যি জিরো। এর থেকে মুক্তি দিন। সমস্ত শৈশব সেটাই চায়।
এ রকম প্রতিটি পদক্ষেপে প্রত্যাশা করুক শিশু নিজে। অভিভাবক নয়। অভিভাবক কর্মযজ্ঞের রাশ ধরে রাখবেন। চেষ্টার সাথে লেগে থাকবেন। ফল চেষ্টার সমানুপাতিকে লাভ হবেই হবে।
ভার কমাতে গিয়ে কোনমতেই যেন পড়াশুনা, বই কিংবা পড়াশুনা সংক্রান্ত বিষয় থেকে শিশুটির মুখ না ঘুরে যায়। কোন জীবনই ভার মুক্ত নয়। সহজ কর্ম পথে যদি খাবার সংগৃহীত না হয় তাহলে সে ঘুর পথে সংগ্রহ করবেই। খিদে বসে থাকবে না। এই ঘুর পথ দিনকে দিন বাড়ছে। কেন না কর্ম জীবনের পথে অন্য খেলা। সে রকম প্রাণ চঞ্চল শিশু একটু বুঝতে শিখে যদি মুখ ঘুরিয়ে নেয় কালো অক্ষর থেকে ( অর্থাৎ পড়ছে কিন্ত চেষ্টা কম) তাহলে ফেরানো খুব মুশকিল। কেন না সে তার চেষ্টা পড়াশুনা বাদ দিয়ে অন্য অবস্থানে ব্যয় করছে। যা সমাজের পক্ষে হানিকারক।   
পড়াশুনা এবং পড়াশুনা সংক্রান্ত বিষয় কখনওই শৈশবের কাছে ভার নয়। ভার হতেই পারে না। বড়রা, বাবা মায়েরা যদি বৃহৎ আশা করার আকাঙ্ক্ষায় শিশুটির কাছে ভারী না হয়ে ওঠে। তাহলে শৈশব তার নিজস্ব দিশা খুঁজে পাবে।
সব বাবা মা চায় তার সন্তান মানুষ হয়ে উঠুক। মানুষ হোক মানে কি? প্রথমেই সব বাবা মা চাইবে তার সন্তান সমাজের বুকে কিছু একটা পেশার সঙ্গে যুক্ত হোক। পরিণত বয়সে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াক। অর্থাৎ কিছু আয় উপায় করুক।
তার পর সেই আয় উপায়ের মাধ্যমে সৎ থাকুক, সহানুভূতিশীল হয়ে উঠুক, মানবিক বোধ জাগ্রত হোক, দয়া মায়া প্রেম পরিপূর্ণ হোক ইত্যাদি ইত্যাদি ভাবনা বাবা মা ভাববে ছেলে মেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পর।
কিন্তু যদি নিজের পায়ে দাঁড়ালো না, আয় উপায় করল না, কোন পেশার সাথে যুক্ত হল না তাহলে সৎ থাকা, সহানুভূতিশীল হওয়া, মানবিক হওয়া, দয়া মায়া প্রেম ইত্যাদি কিভাবে হবে? কি করে হবে? কিংবা হয়েও কি করবে?
আবার কিছু আয় উপায় করে, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে হয়তো সেই ছেলে মেয়ের সৎ, সহানুভূতিশীল, মানবিক, দয়া, মায়া প্রেম ইত্যাদিতে কিছু ঘাটতি থেকে গেল। থেকে যেতেই পারে। তাতে সমাজের সাথে থেকে সে সেসব শিখে যেতেই পারে।
আমার ছেলেকে মেয়েকে আমি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়র প্রফেসর শিক্ষক করে গড়ে তুলব না। শুধু মানুষ করে গড়ে তুলব। মানে কি? এর কোন মানে হয় না। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়র প্রফেসারের সাথে সাথে কিছু মানবিক গুণ গড়ে দেওয়ার চেষ্টা করব। এরকমই ভাবা উচিত।
আপনি বাবা মা হিসেবে কোনটা চাইবেন? আমার সন্তান সৎ সহানুভূতিশীল দয়া মায়া প্রেমেই থাকুক। না কি দুটোই চাইবেন।
হ্যাঁ, চাইবেন। দুটোই চাইবেন। নিশ্চয় চাইবেন। আর আয় উপায় এবং মানবিক দুটোই গড়ে উঠবে 'কালো অক্ষরে আলো'তে। পড়াতেই সব আছে। বইয়ে সব আছে। শুধু কিনে এনে তাকে সাজিয়ে রাখলে হবে না। নিজেকে পড়তে হবে সন্তানকে পড়াতে হবে। পড়া ও পড়ার আনুসঙ্গিক দুটোই দেবে।
বই বাদ দিয়ে, বইয়ের কালো অক্ষর বাদ দিয়ে আপনি এমন একটা অবস্থান, প্রফেশন কিংবা চরিত্রের কথা বলতে পারবেন? যেখানে সে বইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিহ্ন করেও স্কলার। বই বাদ দিয়ে, পড়শুনা ছাড়া কোন কিছুই হয় না। হতে পারে না। তাই যে যত এর ভারে ন্যূজ হয়ে পড়বে ততই তার মেরুদণ্ড খাড়া হবে।
কিন্তু আপনার সন্তানের চেয়ে বাবা মা হিসেবে আপনার প্রত্যাশা আকাশচুম্বী হয়ে যায় তাই আপনার সন্তান বই থেকে শুধু উপার্জনটি নেয় মানবিক নেয় না। কেন না আপনিও চান সমাজের বুকে আপনার সন্তান যেন আরও সুখ স্বাচ্ছন্দে থাকে। আবার দোষ চেপে যায় সন্তানের উপর।
ভার ভার বইয়ের ভার, এ চিৎকার কে করে? হয় জ্ঞানী গুণী নয় বাবা মা নয় তো বাইরের অবস্থান। অথচ এই ভার চাপায় জ্ঞানী গুণী কমিটি। ছেলে মেয়ের দিক থেকে সেই সব শুধু বয়ে বেড়ানো।
টিন এজ বয়সকে একবার বলে দেখুন না "জি লে আপনি জিন্দেগী"। কি হয় দেখুন তারপর? পাখনা মেলে সে কোথায় যাবে? যত রকমের বদ আছে খুঁজে খুঁজে বের করে তার মধ্যে খুব সহজেই ঢুকে যাবে। প্রথমেই সে ত্যাগ করবে বই এবং বই সংক্রান্ত কোন কিছু। ত্যাগ যদিও না করে যাই হোক করে যতটা কম করা যায় তাই করবে।
"জি লে আপনি জিন্দেগী" সব অভিভাবক বলে বলতে চায় তখন যখন সে জীবনে পায়ে দাঁড়ায়। এই পায়ে দাঁড়ানো পর্যন্ত সময় হল দ্বাদশ পর্যন্ত। এখানে এসেই নির্ধারিত হয় তার পরবর্তী পথ কি? তার জীবন খাত কিভাবে বইবে? তারও বাইরে দু একটা এক্সসেপশন বাদ দেওয়াই ভাল।
তাই পায়ে দাঁড়ানোর সময় পর্যন্ত কিংবা নিজস্ব বোধ তৈরি হওয়া পর্যন্ত ভার তো বইতেই হবে। বাবা মা-এর কথা শুনে কালো অক্ষরেই আলো খুঁজতে হবে। না হলে শিশুটি বড় হবে না। এই আঠারোর আগে পর্যন্ত বা বোধ তৈরি হওয়ার আগে পর্যন্ত আমি কখনই বলব না 'জি লে আপনি জিন্দেগী'। যতই টিন এজ বলুক " তুমি আমার জীবনটা স্পয়েল করে দিলে"।
বিষয়শ্রেণী: সমসাময়িক
ব্লগটি ৯৯৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৯/০৭/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • আ'বিরু সাবীল ৩০/০৭/২০১৭
    আপনার ফ্ল্যাশব্যাক তো অসাধারন। অ্যা'ম ইম্প্রেস্ড! অভিভাবকদের সুন্দর পরামর্শ দেয়ার জন্যে অনেক ধন্যবাদ। শুভকামনা নিরন্তর।
 
Quantcast