www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

গোপলার কথা - ৩৬

ইচ্ছেপূরণ
---------

ইচ্ছেপূরণ আসলে রূপকমাত্র। ইচ্ছের কোন লিমিট নেই। আগে বলা হত স্কাই ইজ দি লিমিট। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাও ছাড়িয়ে গেছে। শেষ নেই।
একটুমুঠো খাবারের জন্য কি আকুল প্রার্থনা। যেই খাবারটুকু পেল। অমনি শোয়ার ধান্ধা। শোয়ার জন্য কি আর লাগে। একটা বিছানা। সেই জায়গাটুকু পেয়েই ইচ্ছেতে এসে গেল বিলাস ভাবনা। তারপর তাতে এল নানা ইচ্ছের বলয়। জমানোর ইচ্ছে। এই বলয়ের শুরু নেই শেষ নেই। জমানো পরিমাণের শেষ নেই শুরু নেই। ফলে ইচ্ছের দফারফা। তার পূরণ দিগন্ত ছাড়িয়ে অপরিণামদর্শী হয়ে পড়ছে।
ইচ্ছেপূরণ করতে চাইলে ইচ্ছের বাঁধন দেওয়া দরকার। প্রশ্ন যদি আসে কি চাই, কি ইচ্ছে?
কতজন ঠিক মত উত্তর দিতে পারবেন? যা চাইবে পরক্ষণে মনে হবে - এমা! আর একটু কেন বেশি চাইলাম না। প্রত্যেকে জানে তার যোগ্যতা কতটুকু। তবুও ইচ্ছেকে ছাপিয়ে যাওয়ার বড় ইচ্ছে জাগে। ফলে কোন লিমিট নাই।
আপনার কি চাই? এখন সব ব্যবস্থা আছে। যা চাইবেন সেভাবে নিজেকে গড়ে তুলুন। ব্যাস।
একটা ব্যাপারে সবাই প্রায় একমত। সবাই হতে চায় কোটিপতি। কোন বনেগা ক্রোড়পতি? এর উত্তরে, কোন ইচ্ছেতেই না নেই। আবার হ্যাঁ-র কোন লিমিট নেই। তো কিভাবে সামাল দেবেন? ফলে লম্বা রেসের ঘোড়া ছুটছে। ইচ্ছে আছে পূরণ নেই। অতৃপ্তি যেন বাসা বেঁধে বসে আছে।
ক্রোড়পতির আবার নানান দিক। ইচ্ছেপূরণের ঘুঁটি সাজিয়ে বসে আছে। বিন্দাস। যা হতে চাইছে এক লহমায় হয়ে যাচ্ছে। এই তো রাস্তার ধারে ছিল; এখন মাঝ রাস্তায় রাস্তা হয়ে বসে আছে। সব কিছু হওয়া যায়। অবশেষে তারও দেখি ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে না। সেও বলছে প্রাচুর্যের পাশে আমি শুধু নুড়ি কুড়িয়ে পেলাম।
কিংবা সবাই চায় সর্বোচ্চ সম্মান। সে নোবেল অস্কার একাডেমি ডিলিট যতটুকু পাওয়া যায়। যতই সমালোচনা হোক, ক'জন বলে 'না ভাই, আমি এটি পাওয়ার যোগ্য নই।' বলে। নিশ্চয় বলে। এ রকম প্রচুর উদাহরণ আছে।
ইচ্ছেতে আর একটু অন্য ভাবনা আছে তা হল জ্ঞান অর্জন, পারদর্শী ভাবনা। ভাল কাজের মধ্যে ইচ্ছের উড়ালপুল ডিঙিয়ে যায় দিগন্ত থেকে দিগন্ত। এ আলোচনা তাদের জন্য নয়।
আসলে সমস্ত ইচ্ছে থাকে মনে। সেই মনের বাঁধনে অনেকেই অনেকটাই পিছিয়ে। চাই চাই স্বভাবের বিস্তার আকাশ ছোঁয়া। পেরিয়ে যাচ্ছে আকাশগঙ্গা। সিদ্ধ ছাড়া মনের বাঁধন কখনই সম্ভব নয়। যেমন একেবারে ছা-পোষা জীবন লোভী মানুষেরা সেই অবস্থানে অনেকটাই এগিয়ে। তাদের ইচ্ছে পূরণ হয়ে থাকে। যা পায় তাতে এত প্রশান্তি ও সন্তুষ্টি এনে দেয় তা শুধু ইচ্ছে জানে আর পূরণ বোঝে।
এই কদিন আগে একটা ছেলে এসেছিল। বয়স কত হবে? এই বড় জোর তেরো চৌদ্দ। সুন্দর করে চুল ছাটা। চারিদিক ছোট ছোট। মাঝখানে ইয়া বড় ঝুঁটি। আমার পাশে এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তি ছিলেন। জিজ্ঞেস করে বসলেন - বাহ, দারুণ তো। খুব সুন্দর চুলের ছাঁট দিয়েছিস তো? কোন ক্লাসে পড়িস?
বলল - আমি পড়ি না। কাজ করি।
প্রাজ্ঞ বললেন - দেখতে সুন্দর তুই। সুন্দর ছাঁট দিয়েছিস। পড়াশুনা না জানলে চলবে?
আমি পাশে ছিলাম। বললাম - ঢের চলবে? ওর পৈত্রিক বাড়ি আছে। দু চাকা মোটরবাইক আছে। কিছুদিন পরে চার চাকা কিনবে। যে কোন সুন্দরী দেখে মেয়ে বিয়ে করতে পারবে। যে কোন অনুষ্ঠান ওই অরগানইজ করবে। পার্টি দেবে। আর কি চাই? এবং যদি সুযোগ আসে জমানো/ধার করা/লোন নেওয়া পয়সায় এখানে ওখানে কিছু খাবার বস্ত্র ইত্যাদি বিতরণ/চাঁদ দিয়ে, দান করে সমাজের সামনে চলে আসবে। এবং বিখ্যাতও হয়ে যেতে পারে। আর কি চাই?
প্রাজ্ঞ তর্ক শুরু করল। এ সব কি এতই সহজলভ্য? আমি বলল - হ্যাঁ। তাই তো হচ্ছে আশেপাশে। ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম - এখন কত আয় করিস?
দীপ্ত মুখে সে বলল - তা প্রায় দশ বারো তো হবে? এখন লেবারে আছি। এরপরে মিস্ত্রী তারপর কণ্ডাক্টর।
প্রাজ্ঞ আর আমার মধ্যে মুখোমুখি। পড়াশুনা করতে করতে কিংবা পড়াশুনা শেষ করে কোথায় গিয়ে কত বয়সে আপনার এতটা আসবে? ফোন আসুক বা না আসুক ওর কাছে এখন বড় স্মার্টফোন। আপনি বা আপনার ছেলে কবে এসব পেয়েছে? এই বয়সে ও যা ইচ্ছে খুশি নিজের পূরণ নিজে করছে। খিস্তি খেউড় মদ মাংস এবং সবকিছু ওর হাতের মুঠোয়। চাইলেই হাজির। তিন চারটে মেয়ের সাথে প্রেম প্রেম খেলা খেলে। নিজে আয় করে ইচ্ছেকে প্রাণ ভরে পূরণ করে। যেকোন জায়গায় গাড়ি করে বিন্দাস চলে যাচ্ছে।
পড়তে পড়তে প্রাজ্ঞ হয়ে কোনো সময়ই আপনি এই ইচ্ছের ধারে কাছে যেতে পারবেন না। অথচ এসব আদিম চাহিদা মানুষের মনে ঘোরে ফেরে। একটু আধটু করার ইচ্ছে জাগে। করেও। আমরা সভ্যতা সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে তাকে দাবিয়ে রাখি।
সেটা অবশ্যই ভাল। তবে এও যে খুব খারাপ করে ফেলছে তা তো নয়। সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে বুঝে শুনে শ্রম দিয়ে জীবন চালায়। ইচ্ছে পূরণ করে। সাথে ইচ্ছের পূরণ করে।
আমার আপনার পড়াশোনা করার মূল মোটিভটা কি? সুস্থ সমাজে সুস্থভাবে দুমুঠো খেয়ে পরে বাঁচা। সমাজকে বাঁচিয়ে রাখা। সভ্যতা সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা। শিক্ষার সমানুপাতে এগিয়ে সেভাবে থাকা যাচ্ছে কি? বাঁচা যাচ্ছে কি? ইচ্ছের পরিপূরণে শিক্ষার মর্যাদাকে সুউচ্চ ভাবনায় প্রতিফলিত হচ্ছে কি? তাহলে?
আসলে এই বাঁচার অবস্থানে ইচ্ছে পূরণ পুরোপুরি পাল্টে গেছে। আর এসে গেছে ফোকটবাজি। কম শ্রমে সংস্কৃতির ধারাপৃষ্ঠায় ইচ্ছের পূরণ করে যাচ্ছে অনেকেই।
দু চার ছত্র লিখে কবি, পাঁচ সাতটা বই বের করে সাহিত্যিক, দু চার কলি গেয়েই গায়ক, ডিগ্রী হাসিল করে অফিসার, বুদ্ধির চাতুরীতে রাজনীতি, কিছু সোর্সে দপ্তরী, হা হা করে হেসেই হাস্যকৌতুকী, চোখ মুখ কপালে তুলেই অভিনেতা এবং অন্যান্য তো আছে। এর সমানুপাতে সহজলভ্য হচ্ছে গাড়ি বাড়ি ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, যা অসীম থেকে সীমাহীন। আর সব ক্ষেত্রে ইচ্ছে পূরণ হচ্ছে নির্দ্বিধায়।
পাশের ছেলেটি ঘুড়ি উড়িয়ে বাবু বাবু করে আমার পাশ দিয়ে হুস করে চার চাকা নিয়ে বেরিয়ে গেল। আর আমি? বই খুঁটে রাতদিন এক করে পরীক্ষার খাতা আরো তথ্যবহুল করে ভাঙা রাস্তায় খুঁড়িয়ে হাঁটছি, বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। বাস এল। আমাকে ধাক্কা দিয়ে আমার পেছনের লোককে বলল - কি মুখার্জীবাবু এখানে? আসুন আসুন।
তাকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ইচ্ছের কোন অভিযোগপত্র নেই। অতএব যে অভিযোগ গৃহীত হয় নি, হবে না তার কোন পূরণ নেই। অতএব আমি রাস্তায়। কিন্তু কতক্ষণ থাকব আমি? কেনই বা থাকবো? কেনই বা আমার ইচ্ছে পূরণ থেকে মাত্র দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে থাকবে।
যারা হল্লা করছিল তারা খারাপ আর চুপচাপ যারা ছাপ দিচ্ছিল তারা ধোয়া তুলসীপাতা? একটু পরে ধুয়ে ফেলা অবস্থানে ইচ্ছের পূরণে আগুন জ্বালচ্ছে তার বেলায়? অনেক পরে যখন সেটা প্রকাশ্য হচ্ছে তখন সেই সব ইচ্ছে পূরণ সব সুখের ভোগের চূড়ান্তে। আর নামানো যায় না। সেই সব ইচ্ছে পূরণ আর নামতে চায় না।
ফলে বসে থাকবে কে? ইচ্ছে হল আর তা পূরণ করতে কতটা পর্যন্ত এগোন যায়? কেন ভাবব এসব? তার চেয়ে পেয়ে যায় পথে লেবার ছেলেটি এগিয়ে যায়। তার সাথে আরো অনেকে। দেখছে একেবারে কাঁচা ইচ্ছে পূরণ।
কত আর হ্যাপা সহ্য করা যায়? না না এভাবে নয়? যদি কিছু হয়? আর লোকে কি বলবে? ইত্যাদি। এসব করতে করতে ইচ্ছে নিজে হাত পা গুটিয়ে বসে যায়।
তবে প্রাজ্ঞের ইচ্ছের দিক আলাদা। আমার প্রাজ্ঞতা তেমন দিশা খোঁজে। পূরণ সেখানে শুধু হৃদয় পূরণ। সেখানে বার বার হৃদয় বলে 'আমি তো এটুকুই পারি তাই এই আমার পরম পাওয়া।'
ভাঙা বাস রাস্তাই আমার চলার মসৃণ পথ। কি করব? কোথায় যাব হুস করে রাস্তা ডিঙিয়ে রাস্তায়। চলা শিখছি, চলেছি নিজের পায় এর চেয়ে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে।
গাড়ি বাড়ি কোটি নিয়ে আমি কি করব? এতে শিশির পড়ার শব্দ নেই, ফোটা শালুক ফুলের হাসি নেই, ডিঙি বেয়ে চলা সেই ছেলেটির ভাটিয়ালি নেই, ঘাস ফুলের ঝুমকো নেই, মুখ বাড়িয়ে দেখা পরিচিতের খুঁনসুটি নেই, পথ হারানো নাবিকের আমাকে পাওয়া আর্তি নেই, চকিত হরিণের শ্বাস নেই, আর কোথাও কেন জানি না আমি নেই।
আমি জানি এগুলো কোন ইচ্ছে নয় কোন পূরণ নয়। কিন্তু এই ইচ্ছের জন্য লক্ষ কোটি যুগ অনেকেই আবর্তিত হয়েছে আর অযুত নিযুত কাল আবর্তিত হবে অনেকেই। সেই ইচ্ছের জন্য অনন্ত চলেছে অনন্তকালে। পূরণ হচ্ছে অসীম অনাদি। আর কি চাই?
তাহলে আপনার ইচ্ছে কি?
বিষয়শ্রেণী: অভিজ্ঞতা
ব্লগটি ৮৮৬ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১০/০৫/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • রাজা অধিকারী ৩০/০৫/২০১৭
    খুব সুন্দর
  • পরশ ১০/০৫/২০১৭
    ভাল
 
Quantcast