গোপলার কথা - ২৫
পড়ার বাইরে পড়া
-------------
চাপ বাড়ছে। তা বলে ভেবো না চাপ না বাড়ালে খুব ভাল হবে। ভারি ভারি ব্যাগ, স্কুলে অনেক পড়া ছেলেমেয়েরা অতীষ্ট হয়ে উঠছে। সেই সাথে পড়া করিয়ে দেওয়া ইত্যাদিতে বাবা মায়ের উপর চাপ বাড়ছে।
এক্ষেত্রে প্রায়ই দু রকমের অবস্থান দেখা যায়। পড়তে পড়তে ছেলে মেয়ে ঢুলে ঢুলে পড়ছে দেখে বাবা মায়ের কেউ একজন বলবেই - এবার ছেড়ে দাও। বেচারা কত পড়বে।
অন্যজন ঝাঁঝিয়ে উঠবে - তোমার আস্কারাতেই গোল্লায় গেল। আর ছেলে বা মেয়ে প্রশ্রয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ল। শেষমেশ পড়া জায়গা ছেড়ে দিল।
এভাবে প্রশ্রয়ের পাল্লা ভারী হতে থাকলে সেই প্রশ্রয় জায়গা বদল করে পড়ার বাইরে অন্য জায়গায় আস্তানা গাড়লে পড়া আর সঠিক পথ পাবে না।
ক্লাসের পড়ায় বেশির ভাগ ছেলে মেয়ে শুধুই পড়ে মুখস্ত করে নম্বর পায়। সেই পড়া বেশির ভাগ তারা আত্মস্থ করে না। ফলে যে কবিতা গল্প অঙ্ক বিজ্ঞান পড়ে এক ক্লাস পেরিয়ে অন্য ক্লাসে গেলে অমনি প্রায় সব ভুলে যায়। যদিও বা কিছু মনে থাকে বা মনে রাখে তা অতি সামান্য। অনেক ক্ষেত্রে তাদের সেই বিষয় বা সেই বিষয়ের সেই পাঠটি পড়তে ভাল নাও লাগতে পারে। তাও পড়তে হয়। তাই সেই সব পড়া তারা আত্মস্থ করেই না।
কিন্তু পড়ার বাইরে যে পড়া যেমন নাচ গান আবৃত্তি আঁকা খেলাধুলা ব্যায়াম বাদ্যযন্ত্র গল্প কবিতা পড়া অথবা নিজে লেখা এবং সমবয়সী আড্ডা ইত্যাদি আরও অনেক ক্রিয়েটিভ বিষয় আছে যা পড়ার বাইরে মস্ত বড় পড়া। সেই পড়ার বাইরের পড়ায় কেউ যদি একটু আধটু চর্চা করে তাহলেও তার স্কুলের পড়া হবে। তাই তো প্রতিটি স্কুলে এই ক্রিয়েটিভ অ্যাক্টিভিটির ব্যবস্থা আছে। আমাদের তাতে সঙ্গত দিতে হবে।
কেন না, কোনো না কোনো দিক তার ভাল লাগবেই। সেই বিষয় নিয়ে স্বপ্ন দেখবে। তাই সে সেটাকে আত্মস্থ করবে। মানে মনোনিবেশ করবে। এই 'পড়ার বাইরের পড়া'য় মনোনিবেশ অবশ্যই পড়ার মধ্যেও ঢলে পড়বেই।
যদি নাও ঢলে পড়ে তাও সেই ছেলে মেয়ে নিজস্ব সংস্কার পথ থেকে বিচ্যুত হবে না। তাই এক প্রকার জোর করে হলেও এ সব চর্চা ছোট থেকেই অল্প বিস্তর ছেলে মেয়েদের উপর চাপাতেই হবে।
এবং তাতে বাবা মা এবং ফ্যামিলির সবার সহমত থাকা দরকার। শুধু মা বা শুধু বাবা বা শুধু পরিবারের অন্য কেউ একটু জোর করছে কিন্তু বাদ বাকীদের সহমত নেই তাহলে ছেলে বা মেয়ের কষ্ট হচ্ছে ভেবে সম্মতি না থাকলে পরবর্তীতে সেই ছেলে মেয়ে আদৌ তা গ্রহণ করবে না। কেন না, শিশু বা টিন এজ সব সময় প্রশ্রয়ের দিকে ঝোঁকে।
আবার এই জোর করে 'পড়া বাইরে পড়া'তে নিয়ে গেলে আপনাকেও খাটতে হবে (সে আপনি এমনি স্কুলের পড়াতেও দুবেলা খাটছেন, ছেলে মেয়ের সাথে চরকির মত ঘুরছেন)।
শুধু স্কুলে পড়ার ক্ষেত্রে ছেলে মেয়ের সাথে আপনি যে শ্রমটা দিচ্ছেন তাতে মাঝে মাঝে মনে হবে এত খাটলাম ছেলে মেয়ে এসব বুঝল না। কিন্তু 'পড়ার বাইরে পড়া'য় যে শ্রম আপনি দেবেন সেই শ্রমের কথা ছেলে মেয়ে রিয়েলাইজ করবে। স্বপ্ন দেখতে শিখবে। যখন সে তার নিজস্ব বোধে অ্যাক্টিভিটি বুঝবে। অর্থাৎ এই জোর করা রিভার্স হয়ে আপনার কাছে ফিরে আসবে। আপনার শ্রমের মূল্য বুঝে আপনাকে বুঝতে শিখবে। পরবর্তীতে মনুষ্য বোধ উপলব্ধি করবে।
না হলে হাইফাই ডিগ্রী, শিক্ষিত যোগ্যসম্পন্ন অফিসার আমলা সব হবে কিন্তু বাবা মায়ের ঠাঁইও বৃদ্ধাশ্রমে হবে। তাই স্কুলের পড়ার সমান্তরালে উপলক্ষ্য হিসাবে 'পড়ার বাইরে পড়া'য় ছেলেমেয়েদের অন্তত কিছুটা উজ্জীবিত করা উচিত। লক্ষ্য কিন্তু অবশ্যই স্কুলের পড়া।
অনেকের মতে কখন করবে? স্কুলের যা চাপ, মাসে মাসে পরীক্ষা, ক্লাস স্টেষ্ট, হোম ওয়ার্ক কত করবে। একটু খেলার সময় পেল না। কিন্তু দেখা যায় বেশির ভাগ বিকেলের দিকে একটু ছোট থাকলে বাবা মায়ের সাথে, বড় হলে নিজে নিজে এমনই ঘোরে। বিকেলের বন্ধুদের সাথে ঘোরা ও খেলাধূলা করা ছাড়াও। সেই সময় পড়া সংক্রান্ত কিছুই করে না। নো ক্রিয়েটিভ।
যদি বিষয় পাল্টে, অবস্থান পাল্টে পড়াশোনাকে পড়ার বাইরে বা পড়াশুনার ভেতরের ভাবনায় ঢুকে গেলে বা ঢুকানোর চেষ্টা করার কথা ভাবলে অনেক ভাবে পড়ানো যায়।
যেহেতু শিশু ও টিন এজের মধ্যে এই অবস্থান তৈরির সময়। তাই একটু চাপ দেওয়া যেতেই পারে।
আসলে এই চাপ দেওয়া তারই ভালোর জন্য। স্বপ্নের জন্য। স্বপ্ন দেখানোর সহজ রাস্তা এই 'পড়ার বাইরে পড়া'। স্বপ্ন দেখতে না শিখলে জীবনকে আঁকড়ে ধরে বড় হবে কি করে?
অনেকেই এই স্বপ্ন দেখে না। হাতের কাছে যা পায় তাই শেখে কিংবা বাবা মা যা করে কিংবা বাবা মা যা হতে পারে নি তাই হওয়ার জন্য চাপ দেয়। স্বপ্ন দেখায়। এই স্বপ্ন দেখানোর সময় যদি কোন টিন এজ বাবা মাকে বোঝায় বা বোঝানোর চেষ্টা করে আমি অন্য একটা কিছু হতে চাই তাহলে কোন বাবা মা না করে না। যেমন সিনেমায় নাটকে নভেলে দেখি বাবা মা ছেলে মেয়েকে সেইসব হতে বাধা দেয়। বাস্তবে কিন্তু তা হয় না।
কোন টিন এজ এরকম কোন স্বপ্ন দেখেই না। তখন সে নেশার ঘোরে থাকে। বড়দের মত অন্ধকারে কিছু করার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। টিন এজ পেরিয়ে যখন সে জীবন বোঝে, জীবনের হিসেব বোঝে, বাঁচা বোঝে তখন সময় পেরিয়ে যায়। স্বপ্নকে হাতড়ে বেড়ায়। খোঁজে। বাবা মাকে বলে, তোমরা চেয়েছিলে তাই চেষ্টা করেছি। না হলে আমার ইচ্ছে ছিল না।
তাহলে কি ইচ্ছে ছিল?
তার কোন সদ্দুত্তর মেলে না। সেজন্য টিন এজের আগে অনেককটা এই 'পড়ার বাইরে পড়া'র বেঁধে রাখলে কোন না কোন দিকে কিংবা তার নিজস্ব পড়ার মধ্যে সে নিজের জীবন নিজের বাঁচা খুঁজে পাবে। স্বপ্ন দেখতে শিখবে। আমি এটা হতে চাই এবং হবই।
তাছাড়া আমাদের ব্রেণ(Brain) যত বেশি খাটবে ততই সে উজ্জীবিত হবে। ঘুমিয়ে রাখলে ঘুমিয়েই থাকবে। শরীরের ঘুম নিজস্ব নিয়মে হবে। ব্রেণকে (Brain) যদি নিরপেক্ষ রেখে, নিস্তেজ করে রেখে দেওয়া হয় তাহলে তার আলস্য শরীরে ছড়িয়ে পড়বে। ঘুম জেঁকে ধরবে। আর ব্রেণ(Brain) যদি উজ্জীবিত থাকে আরও কিছু চাই ভাবনার টেনশনে থাকে তাহলে সে তার ক্লান্তিতে শরীরকে বলে ঠিক বিশ্রাম করে নেবে। তাতে শরীর তার চাপ ঠিকই বুঝতে পারবে।
তাই আমরা যেন আদরের শিশুকে বেশি খাটিয়ে নেওয়ার অজুহাত প্রশ্রয়ে তাকে পড়া বা 'পড়ার বাইরে পড়া' থেকে বিচ্যুত না করে ফেলি।
ব্রেণের বিশ্রাম বলে কিছু হয় না। যেটুকু হয় তা কেবল শরীরের। পড়ায় বিরক্তি এলেই ছেলে মেয়ে আর তাই পড়তে চায় না। অর্থাৎ ব্রেণ আর চাইছে না তাই ছেলে মেয়ের হাই উঠে, ঘুম পায়। তাই ব্রেণকে চাঙা রাখা দরকার।
দেখবেন, যারা পড়াশোনায় র্যাঙ্ক করে তারা বলে অত পড়ার দরকার নেই। সারাদিন মুখ গুঁজে তারা নাকি পড়েই না।
কিন্তু তারা অন্য কিছু বিষয়ে বেশ ইন্টারেস্টেট। যেমন উপন্যাস পড়তে, গল্প পড়তে ভালোবাসে বা গান করতে ভালোবাসে বা গান শুনতে ভালোবাসে বা যোগ ব্যায়াম ভালোবাসে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ গুলো সবই পড়া। পড়ার বৃত্ত। কনসেনটেশন।
অর্থাৎ সে পড়াশোনার বৃত্তে অবস্থান করে। তাই তার রেজাল্ট খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা কম। এছাড়া জীবনে চলার পথে ভুল রাস্তায় সে যাবেই না। সে স্কুলের পড়ার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয় না। যতটুকু তাতেই একশ ভাগ। তাই সারাদিন মুখ গুঁজে পড়ার দরকার নেই।
অর্থাৎ এই 'পড়ার বাইরের পড়া'র চর্চা করাতে উপযুক্ত সময় বয়স শিশু থেকে টিন এজে বা পনের ষোলর আগে। দিনের হিসেবে দেখবেন অনেক পড়াশুনার পরেও প্রচুর সময় থাকে এই সব 'পড়ার বাইরের পড়া'র জন্য। ক্লাসের পড়ার বাইরের পড়াও কিন্তু পড়ার বৃত্তের মধ্যেই ছেলে মেয়েদের রাখা।
না হলে ক্লাসে ভাল পড়াশুনা করা ছেলে মেয়ে অনেকেই ভুল রাস্তায় চলে যায়। শেষে তার জীবনটাই বৃথা হয়ে যায়। কিছুতেই নিজস্ব রাস্তাটা খুঁজে পায় না।
টিন এজের শেষের দিকে বা পনের ষোলর পরে পরেই তার মধ্যে প্রেস্টিজ বা একগুঁয়ে না বলা না দেখা না শোনা কাজ করার জেদ ও অহঙ্কার ইত্যাদি চলে আসে।
তখন আর ভুল ঠিক ভাল মন্দ তার মাথায় কাজ করে না। কারও কথা এমন কি নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবার অবকাশ থাকে না। সে যেদিকে যাবে মনে করে সেদিকেই যায়। যে কাজ করবে মনে করে, করেই। তার এই জেদ বা অহঙ্কার আমাদেরও আগামী অহঙ্কার এবং অলঙ্কারও বটে। কিন্তু এটা যেন কোন মতে ভুল না হয়ে যায়। কোন অপ অবস্থান না গ্রহণ করে।
তাও আমরা সে সব না বুঝে, বৃথাই তাকে দোষ দিই। তার আগের অবস্থানের জন্য বর্তমানের এই অবস্থিতি। এটা ভেবে দেখি না। এই আগের অবস্থানের জন্য তো আমরাই সম্পূর্ণরূপে দায়ী। তাহলে?
আর একটা বিষয়, নবম স্ট্যাণ্ডার্ডের পরেই ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ তৈরির বড় পরীক্ষায় বসতে হয়। এর জন্য ভাল রকম প্রস্তুতির দরকার হয়। তাই এই নবমের আগে 'পড়ার বাইরে পড়া'র জন্য যে সময়টা পাওয়া যায় তা আর পাওয়া যায় না। অনেকে অবশ্য তাও ধরে রাখে যারা আগে থেকে এসবে অভ্যস্ত।
তাই যে টুকু পারা যায় তা ওই টিন এজের আগে বা পনের ষোলর আগেই করিয়ে নিতে হবে। এই আগের সময়ে যে যতটা 'পড়ার বাইরে পড়া'তে আবদ্ধ হবে ঠিক ততটাই সে জীবন পথে আরো এগিয়ে যাবে। পড়াশুনায় সে যতটা এগিয়ে যাক না কেন ভুল পথে যাবে না।
কেন না আমাদের ছেলে মেয়েকে বড় করার একটাই উদ্দেশ্য থাকে যে সে যেন মানুষ হয়। এই মানুষ করার রাস্তা হল পড়া তো করবেই তার সাথে 'পড়ার বাইরে পড়া' যতটা বেশি পড়ানো।
কিছুতেই যেন নিষিদ্ধ তাকে না টানে। সমাজে এই নিষিদ্ধ অকথা কুকথা কুরঙ্গ কু-চিত্র সবই আছে থাকবে। বরং দিন কে দিন আরও প্রকাশ্য হয়ে পড়ছে। এ সব থেকে আমাদের ছেলে মেয়েদের দূরে রাখতেও পারব না কিংবা রাখা যায় না।
কিন্তু তার মুখটা এ সব থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই পারি। সেটা হল 'পড়ার বাইরে পড়া'। এই 'পড়ার বাইরে পড়া'য় বেঁধে রাখার সবচেয়ে বহুল প্রচারিত অবস্থান হল বই পড়ানো। যে কোন বই। ছোটদের বড়দের এমন কোন কথা নয়। বই পড়ানো বা বই পড়ানোর নেশা ধরানো।
কালো অক্ষরেই কালো দূর করা যায়। যে যত বেশি এই কালোতে ঢুকে গেছে তার জীবন থেকে ততটাই কালো দূর হয়ে গেছে। অন্য যে কোন দিকেও এই কালো অক্ষর বা বই আছেই। একে বৃত্ত করেই নাচ গান আঁকা সাঁতার ব্যায়াম ফুটবল ক্রিকেট ক্যারাটে এমন কি গুরুজনকে শ্রদ্ধা ভক্তি ম্যানার সামাজিক সবই এই 'পড়ার বাইরে পড়া'।
নিউক্লিয়ার ফ্যামেলিতে একে অপরের সাথে কিভাবে মিশতে হয়? কথা বলতে হয়, শ্রদ্ধা করতে হয়, ভাব বিনিময় করতে হয় ইত্যাদি ছোটরা জানতেই পারে না। এই গল্প উপন্যাস কবিতা পড়ে সেই ধারণা সহজেই তৈরি হতে পারে।
অর্থাৎ ক্রিয়েটিভিটি। ক্রিয়েটিভ ভাবনার আর একটা দিক হল ভাবতে শেখা। একই অবস্থান আর একটু ভাবলে অন্য রকম হয়ে যায়। এই যে দুর্নীতি অন্যায় অত্যাচার লেনদেন কুক্ষিগত এসবে কতটুকু ভাবনা থাকে।
ধ্বংসের একটাই দিক। কিন্তু সৃষ্টির হাজার মুখ লক্ষ কোটি দিক দিশা।
তাই আগামীকে ভাবতে হবে ভাবাতে হবে এই 'পড়ার বাইরের পড়া' দিয়ে। ক্লাসের পড়া তো পড়লেই সে পারবে। সে আত্মস্থ করুক বা না করুক। অত ভাবার সে রকম কিছু নেই। কিন্তু 'পড়ার বাইরের পড়া'তে কিছু ভাবনা তো থাকেই। আর কিছু নিজে ভাবে, কিছু অন্যকে ভাবায়।
একক এই ভাবনা সমাজ গড়ার একটা মাধ্যমও বটে। 'পড়ার বাইরে পড়া'য় যে সমাজ গোষ্ঠী আগ্রহী বা এগিয়ে তারা এই নাই নাই সমাজ চিত্রে কখনই পিছিয়ে পড়বে না বা ভুল পথে যাবে না।
এই 'পড়ার বাইরে পড়া'য় কি রসদ আছে সেটা বোঝানোর জন্য একটা অবস্থান পর্যন্ত ছেলে মেয়েকে টেনে নিয়ে যেতে হবে। স্বপ্ন দেখাতে হবে। প্রজন্ম যদি স্বপ্ন দেখাতে শিখে যায় তখন সে নিজেই তার জেদের বশে তা করবে।
অনেকে চিত্র প্রদর্শনীতে গিয়ে বলে কি সব এঁকেছে কে জানে? এই 'কি সব' বুঝতে হলে সেই অবস্থানে পৌঁছতে হবে।
গল্প কবিতা পড়ার জন্য যেমন স্থিতধী হতে হয় তেমনি লেখার জন্য আরো বোদ্ধা হতে হয়। সেই অবস্থান পর্যন্ত আমাদের ছেলেমেয়েদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। গান, আবৃত্তি, খেলাধূলা ও অন্যান্য ক্রিয়েটিভ অবস্থানে। তারপর সে এই সব 'পড়ার বাইরে পড়া'য় রসদ পেয়ে গেলে, স্বপ্ন দেখতে শিখে গেলে আমাদের আর কোন দায়িত্ব থাকে না।
সে তারপরে নিজেই এগিয়ে যাবে নিজস্ব মহিমায়, স্বপ্ন সফল করার তাগিদে। ঠিক একই রকমভাবে 'পড়ার বাইরে পড়া' বাদ দিয়ে নিজস্ব স্কুলের পড়ারও সে রসদ খুঁজে পাবে। কিন্তু শুধু স্কুলের পড়ার মধ্যে পথ ভুল হতেই পারে।
এবার আসা যাক এই ভুল পথ কি? বিড়ি, সিগারেট, গুটখা, মদের নেশা, নেটে পর্ণো দেখা, গুণ্ডামি, মাতলামি, খারাপ বন্ধুদের সাথে মেশা কিংবা ছেলে মেয়ের পাল্লায় পড়া অথবা মেয়ে ছেলের পাল্লায় পড়া- ওই যাকে বলে প্রেমে পড়া। ইত্যাদি প্রায় সবই টিন এজের সাধারণ ধর্ম। যা আশেপাশে ক্রমাগত ঘটে চলেছে। যতই দেখে রাখি না কেন, লুকিয়ে তারা একটু আধটু এসব করবে। কিন্তু এই একটু আধটু যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়ে যায় সেটা দেখার দায়িত্ব বাবা মায়ের সাথে আমাদের পারিপার্শ্বিকের।
শুধু না না বলে, খারাপ ও সব, বাজে ছেলেরা এসব করে, সমাজের ক্ষতিকারক কিংবা smoking is injurious to health লিখে দিলেও টিন এজ ওসবের দিকে ঝুঁকবেই। একটু তো পরখ করবেই।
কিন্তু এই 'পড়ার বাইরে পড়া' দিয়ে তাকে এর থেকে বাঁচানো যেতে পারে। উপদেশ কেউ শোনে না। কিন্তু সেই উপদেশ যদি কেউ উপলব্ধি করে তাহলে তার থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারে। আর এই উপলব্ধি তৈরির অন্যতম হাতিয়ার হল 'পড়ার বাইরে পড়া'।
পড়তে পড়তে কত কি যে শেখা যায়, ভাবা যায়, বলা যায়, দেখা যায়, আঁকা যায় তা আর বলার নয়। পড়ার আবার নানান মাধ্যম বই পড়া, বই লেখা, ছবি আঁকা, ছবি দেখা, গান গাওয়া, গান শোনা, আবৃত্তি করা, কবিতা লেখা, গল্প উপন্যাস পড়া, গল্প উপন্যাস লেখা ইত্যাদি হাজারও মাধ্যম।
সেই হিসেবে বলতেই পারি একজন ইঞ্জিনিয়ারও একজন বড় কবি। সৃষ্টিশীল অবস্থানে মেতে ওঠা সমস্ত মনই কবি। এই সৃষ্টিশীল মন তৈরি পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের।
'পড়ার বাইরে পড়া'র এই মাধ্যমের যে কোন একটায় বুঁদ করিয়ে দেওয়া গেলে বা বুঁদ হয়ে গেলে ক্লাসের পড়া সেই ছেলেমেয়ের কাছে কিছুই না। অনেক নম্বর কিছুই না। সব আসবে। হেঁটে হেঁটে আসবে। বাড়ি বয়ে আসবে। সেই সাথে ছেলেমেয়ে তার নিজস্ব রাস্তা খুঁজে পাবে।
'পড়ার বাইরে পড়া'য় যাতে অসঙ্গতি অ-সংস্কৃতি না নিয়ে আসে সেটাও দেখার দায়িত্ব বাবা মায়ের, সমাজের। আর এর উপযুক্ত সময় টিন এজের প্রারম্ভে। এই সময়টুকু বয়ে গেলে আর তাকে দিয়ে কিছু করানো অনেকটাই প্রেসার ক্রিয়েট করা।
না বুঝে আমরা এই টিন এজের শেষের সময়টাতে অনেকেই বকাবকি করি। এর ওর কাছে গল্প করি - জানিস, ছেলেটা আমার কথা শুনছে না। মেয়েটা না কেমন যেন হয়ে গেছে। চুপচাপ থাকে। আজকাল আর কোন কথার তেমন জবাব দেয় না। কি করি বল, মোটেই পড়তে চায় না। কি করে ভাল রেজাল্ট হবে বল।
অথচ আমরা কেউ চিন্তা করি না স্কুলের 'পড়ার বাইরে পড়া'য় আমরা তাকে কতটা জোর করেছি। আজ যে আমরা তার স্কুলের পড়ার জন্য চেষ্টা করছি। বাইরের পড়ার মধ্যেও স্কুলের সেই সব পড়া ছিল, আছে। ভাবনার অবকাশ আছে।
বাংলায় মনোযোগ করলেও ভালভাবে অঙ্ক করা যায়। রচনা, ভাবসম্প্রসারণ, ভাবার্থ, চরিত্র বিশ্লেষণ, সংলাপ, রিপোর্টিং গল্প লেখা, বক্তব্য, কুইজ ইত্যাদি নানান বিষয় স্কুলের পড়ার মধ্যে আছে যা 'পড়ার বাইরে পড়া'তে আছে।
আর একটা ব্যাপার ভাবা যেতেই পারে, তা হল মনুষ্যত্ব। স্কুলের পড়াশোনা কেবল ডিগ্রী ও ক্লাসের সীমিত বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। 'পড়ার বাইরের পড়া' আস্তে আস্তে কমছে বলেই সমাজের বুকে মনুষ্যত্বহীন চিত্র আরও প্রকট হচ্ছে। তাই সমস্ত ছেলেমেয়েদের মধ্যে স্কুলের 'পড়ার বাইরের পড়া'য় আরো বেশি মনোযোগী করা দরকার। স্কুলের পড়ার সমান্তরালে। তবেই সে জীবনে মনুষ্যত্বের মূল্যায়ন বুঝবে। এমন কি ভবিষ্যতে সেই সব ছেলেমেয়েরা তার মা বাবাকে হয়তো বা দেখবে কিংবা যদি নাও দেখে তবু সে তার নিজস্ব জীবন রচনার শৈলী বুঝে নেবে। এও বা কম কি?
আমাকে আমার ছেলেমেয়ে দেখবে এ ভাবনা নিজের কাছে নিজের পরাজয় ছাড়া কিছুই না। আমি নিজেই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত স্বাবলম্বী থাকব আমার এ ভাবনা আমাকে আরও জীবনী করে বাঁচিয়ে রাখবে।
এরপর আছে, পড়া থেকে ব্রেক। কেউ একটানা কোন কাজ করতে পারে না। একঘেঁয়ে লাগে। আমরা যে কাজ করি তার থেকে রেহাই পেতে সিরিয়াল দেখি, খবর শুনি, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিই, ফোন করি। এছাড়াও আরও অনেক এটা ওটা করি। সেই রকম পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েরা পড়ার ফাঁকে কি করবে? বড়রা তাকে কি করতে দেখলে খুশি হবে?
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তেমন কিছু যুতসই আমরা ছেলে মেয়েদের সামনে তুলে ধরতে পারি না। তাই তারা ভিডিও গেম খেলে, নেট চর্চা করে, ফেসবুক করে, হোয়াটস অ্যাপ্স করে, আরো অন্যান্য অকাজ কুকাজ করে। যা পড়া তো নয়। সেই সাথে 'পড়ার বাইরে পড়া'ও নয়। কিংবা নানা সব অসৎ সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
অর্থাৎ এই ফাঁক সময়ে, একঘেঁয়ে থেকে রেহাই দিতে, আরও প্রাণবন্ত হয়ে পড়ায় মনোনিবেশের জন্য অবশ্যই এই 'পড়ার বাইরে পড়া' খুব জরুরী।
পড়তে ভাল লাগছে না একটু ছবি আঁক, সৎ পাত্র কবিতাটি বলো দেখি, কিংবা মম চিত্তে নিতি নৃত্যে গানটা দুজনে করি আয়। চল, একটু বাইরে ফুটবল খেলে আসি, জায়গা নেই বল ছোঁড়াছুঁড়ি করা যেতেই পারে কিংবা একটু দাবা খেলি বা ছক্কা খেলি ইত্যাদি। মাঝে মাঝে টুরে কোথাও দুচার দিন/আট দশ দিন বেড়াতে যাওয়া যেতে পারে।
'পড়ার বাইরে পড়া'য় এ রকম নানা উপাদান আছে। এই অবস্থানের সাথে ছেলেমেয়েদের যত বেশি করে পরিচিত করানো যাবে ততই তার পড়ার সার্থকতা সে খুঁজে পাবে। না হলে ভাল রেজাল্ট আসবে, উচ্চ শিক্ষিত হবে, ডিগ্রী আসবে। সাথে সাথে কিছু ভুল পথ এবং মনুষ্যত্বহীনতা আরও বেশি করে আমাদের সমাজকে জড়িয়ে ধরবে।
তবে কখনই এই 'পড়ার বাইরের পড়া' যেন ক্লাসের পড়াকে ছাড়িয়ে না যায় সেদিকেও দৃষ্টি দেওয়া জরুরী।
ছাত্র জীবনে পড়াটাই একমাত্র লক্ষ্য। আর এই 'পড়ার বাইরে পড়া' একেবারেই উপলক্ষ্যমাত্র। লক্ষ্যকে আরও মজবুত উপযুক্ত ও পরিণত করার জন্য উপলক্ষ্য। উপলক্ষ্য বিশেষ অবস্থানে তার পড়ার সাথে এগিয়ে যেতেই পারে। তখন তার মর্যাদা অন্যভাবে নির্ণীত হবে।
ছেলেমেয়েদের তাই ক্লাসের নিজস্ব 'পড়ার বাইরের পড়া'য় মোটিভেট করতে হবে। তা না হলে আপনি না চাইলেও মোটিভেট হচ্ছে অন/অফ লাইন গেমে। ভয়ঙ্কর গেমে।
তাহলে ছেলে মেয়ের পড়াশুনায় ভার কমানোর জন্য আপনি চেষ্টা করছেন, ভাল কথা। কিন্ত ভার কমছে কি? কোনদিকে ঝুঁকছে। পড়া এবং 'পড়ার বাইরে পড়া'য় যতটা সে ব্যস্ত থাকবে ততটাই সে অন/অফ লাইন বা এই জাতীয় অবস্থান থেকে দূরে থাকবে।
পড়াশুনা যার কাছে ভারি সেই ছাত্র/ছাত্রী পড়াশুনার চিন্তাভাবনায় আছে তো? ভেবে দেখবেন।
-------------
চাপ বাড়ছে। তা বলে ভেবো না চাপ না বাড়ালে খুব ভাল হবে। ভারি ভারি ব্যাগ, স্কুলে অনেক পড়া ছেলেমেয়েরা অতীষ্ট হয়ে উঠছে। সেই সাথে পড়া করিয়ে দেওয়া ইত্যাদিতে বাবা মায়ের উপর চাপ বাড়ছে।
এক্ষেত্রে প্রায়ই দু রকমের অবস্থান দেখা যায়। পড়তে পড়তে ছেলে মেয়ে ঢুলে ঢুলে পড়ছে দেখে বাবা মায়ের কেউ একজন বলবেই - এবার ছেড়ে দাও। বেচারা কত পড়বে।
অন্যজন ঝাঁঝিয়ে উঠবে - তোমার আস্কারাতেই গোল্লায় গেল। আর ছেলে বা মেয়ে প্রশ্রয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ল। শেষমেশ পড়া জায়গা ছেড়ে দিল।
এভাবে প্রশ্রয়ের পাল্লা ভারী হতে থাকলে সেই প্রশ্রয় জায়গা বদল করে পড়ার বাইরে অন্য জায়গায় আস্তানা গাড়লে পড়া আর সঠিক পথ পাবে না।
ক্লাসের পড়ায় বেশির ভাগ ছেলে মেয়ে শুধুই পড়ে মুখস্ত করে নম্বর পায়। সেই পড়া বেশির ভাগ তারা আত্মস্থ করে না। ফলে যে কবিতা গল্প অঙ্ক বিজ্ঞান পড়ে এক ক্লাস পেরিয়ে অন্য ক্লাসে গেলে অমনি প্রায় সব ভুলে যায়। যদিও বা কিছু মনে থাকে বা মনে রাখে তা অতি সামান্য। অনেক ক্ষেত্রে তাদের সেই বিষয় বা সেই বিষয়ের সেই পাঠটি পড়তে ভাল নাও লাগতে পারে। তাও পড়তে হয়। তাই সেই সব পড়া তারা আত্মস্থ করেই না।
কিন্তু পড়ার বাইরে যে পড়া যেমন নাচ গান আবৃত্তি আঁকা খেলাধুলা ব্যায়াম বাদ্যযন্ত্র গল্প কবিতা পড়া অথবা নিজে লেখা এবং সমবয়সী আড্ডা ইত্যাদি আরও অনেক ক্রিয়েটিভ বিষয় আছে যা পড়ার বাইরে মস্ত বড় পড়া। সেই পড়ার বাইরের পড়ায় কেউ যদি একটু আধটু চর্চা করে তাহলেও তার স্কুলের পড়া হবে। তাই তো প্রতিটি স্কুলে এই ক্রিয়েটিভ অ্যাক্টিভিটির ব্যবস্থা আছে। আমাদের তাতে সঙ্গত দিতে হবে।
কেন না, কোনো না কোনো দিক তার ভাল লাগবেই। সেই বিষয় নিয়ে স্বপ্ন দেখবে। তাই সে সেটাকে আত্মস্থ করবে। মানে মনোনিবেশ করবে। এই 'পড়ার বাইরের পড়া'য় মনোনিবেশ অবশ্যই পড়ার মধ্যেও ঢলে পড়বেই।
যদি নাও ঢলে পড়ে তাও সেই ছেলে মেয়ে নিজস্ব সংস্কার পথ থেকে বিচ্যুত হবে না। তাই এক প্রকার জোর করে হলেও এ সব চর্চা ছোট থেকেই অল্প বিস্তর ছেলে মেয়েদের উপর চাপাতেই হবে।
এবং তাতে বাবা মা এবং ফ্যামিলির সবার সহমত থাকা দরকার। শুধু মা বা শুধু বাবা বা শুধু পরিবারের অন্য কেউ একটু জোর করছে কিন্তু বাদ বাকীদের সহমত নেই তাহলে ছেলে বা মেয়ের কষ্ট হচ্ছে ভেবে সম্মতি না থাকলে পরবর্তীতে সেই ছেলে মেয়ে আদৌ তা গ্রহণ করবে না। কেন না, শিশু বা টিন এজ সব সময় প্রশ্রয়ের দিকে ঝোঁকে।
আবার এই জোর করে 'পড়া বাইরে পড়া'তে নিয়ে গেলে আপনাকেও খাটতে হবে (সে আপনি এমনি স্কুলের পড়াতেও দুবেলা খাটছেন, ছেলে মেয়ের সাথে চরকির মত ঘুরছেন)।
শুধু স্কুলে পড়ার ক্ষেত্রে ছেলে মেয়ের সাথে আপনি যে শ্রমটা দিচ্ছেন তাতে মাঝে মাঝে মনে হবে এত খাটলাম ছেলে মেয়ে এসব বুঝল না। কিন্তু 'পড়ার বাইরে পড়া'য় যে শ্রম আপনি দেবেন সেই শ্রমের কথা ছেলে মেয়ে রিয়েলাইজ করবে। স্বপ্ন দেখতে শিখবে। যখন সে তার নিজস্ব বোধে অ্যাক্টিভিটি বুঝবে। অর্থাৎ এই জোর করা রিভার্স হয়ে আপনার কাছে ফিরে আসবে। আপনার শ্রমের মূল্য বুঝে আপনাকে বুঝতে শিখবে। পরবর্তীতে মনুষ্য বোধ উপলব্ধি করবে।
না হলে হাইফাই ডিগ্রী, শিক্ষিত যোগ্যসম্পন্ন অফিসার আমলা সব হবে কিন্তু বাবা মায়ের ঠাঁইও বৃদ্ধাশ্রমে হবে। তাই স্কুলের পড়ার সমান্তরালে উপলক্ষ্য হিসাবে 'পড়ার বাইরে পড়া'য় ছেলেমেয়েদের অন্তত কিছুটা উজ্জীবিত করা উচিত। লক্ষ্য কিন্তু অবশ্যই স্কুলের পড়া।
অনেকের মতে কখন করবে? স্কুলের যা চাপ, মাসে মাসে পরীক্ষা, ক্লাস স্টেষ্ট, হোম ওয়ার্ক কত করবে। একটু খেলার সময় পেল না। কিন্তু দেখা যায় বেশির ভাগ বিকেলের দিকে একটু ছোট থাকলে বাবা মায়ের সাথে, বড় হলে নিজে নিজে এমনই ঘোরে। বিকেলের বন্ধুদের সাথে ঘোরা ও খেলাধূলা করা ছাড়াও। সেই সময় পড়া সংক্রান্ত কিছুই করে না। নো ক্রিয়েটিভ।
যদি বিষয় পাল্টে, অবস্থান পাল্টে পড়াশোনাকে পড়ার বাইরে বা পড়াশুনার ভেতরের ভাবনায় ঢুকে গেলে বা ঢুকানোর চেষ্টা করার কথা ভাবলে অনেক ভাবে পড়ানো যায়।
যেহেতু শিশু ও টিন এজের মধ্যে এই অবস্থান তৈরির সময়। তাই একটু চাপ দেওয়া যেতেই পারে।
আসলে এই চাপ দেওয়া তারই ভালোর জন্য। স্বপ্নের জন্য। স্বপ্ন দেখানোর সহজ রাস্তা এই 'পড়ার বাইরে পড়া'। স্বপ্ন দেখতে না শিখলে জীবনকে আঁকড়ে ধরে বড় হবে কি করে?
অনেকেই এই স্বপ্ন দেখে না। হাতের কাছে যা পায় তাই শেখে কিংবা বাবা মা যা করে কিংবা বাবা মা যা হতে পারে নি তাই হওয়ার জন্য চাপ দেয়। স্বপ্ন দেখায়। এই স্বপ্ন দেখানোর সময় যদি কোন টিন এজ বাবা মাকে বোঝায় বা বোঝানোর চেষ্টা করে আমি অন্য একটা কিছু হতে চাই তাহলে কোন বাবা মা না করে না। যেমন সিনেমায় নাটকে নভেলে দেখি বাবা মা ছেলে মেয়েকে সেইসব হতে বাধা দেয়। বাস্তবে কিন্তু তা হয় না।
কোন টিন এজ এরকম কোন স্বপ্ন দেখেই না। তখন সে নেশার ঘোরে থাকে। বড়দের মত অন্ধকারে কিছু করার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। টিন এজ পেরিয়ে যখন সে জীবন বোঝে, জীবনের হিসেব বোঝে, বাঁচা বোঝে তখন সময় পেরিয়ে যায়। স্বপ্নকে হাতড়ে বেড়ায়। খোঁজে। বাবা মাকে বলে, তোমরা চেয়েছিলে তাই চেষ্টা করেছি। না হলে আমার ইচ্ছে ছিল না।
তাহলে কি ইচ্ছে ছিল?
তার কোন সদ্দুত্তর মেলে না। সেজন্য টিন এজের আগে অনেককটা এই 'পড়ার বাইরে পড়া'র বেঁধে রাখলে কোন না কোন দিকে কিংবা তার নিজস্ব পড়ার মধ্যে সে নিজের জীবন নিজের বাঁচা খুঁজে পাবে। স্বপ্ন দেখতে শিখবে। আমি এটা হতে চাই এবং হবই।
তাছাড়া আমাদের ব্রেণ(Brain) যত বেশি খাটবে ততই সে উজ্জীবিত হবে। ঘুমিয়ে রাখলে ঘুমিয়েই থাকবে। শরীরের ঘুম নিজস্ব নিয়মে হবে। ব্রেণকে (Brain) যদি নিরপেক্ষ রেখে, নিস্তেজ করে রেখে দেওয়া হয় তাহলে তার আলস্য শরীরে ছড়িয়ে পড়বে। ঘুম জেঁকে ধরবে। আর ব্রেণ(Brain) যদি উজ্জীবিত থাকে আরও কিছু চাই ভাবনার টেনশনে থাকে তাহলে সে তার ক্লান্তিতে শরীরকে বলে ঠিক বিশ্রাম করে নেবে। তাতে শরীর তার চাপ ঠিকই বুঝতে পারবে।
তাই আমরা যেন আদরের শিশুকে বেশি খাটিয়ে নেওয়ার অজুহাত প্রশ্রয়ে তাকে পড়া বা 'পড়ার বাইরে পড়া' থেকে বিচ্যুত না করে ফেলি।
ব্রেণের বিশ্রাম বলে কিছু হয় না। যেটুকু হয় তা কেবল শরীরের। পড়ায় বিরক্তি এলেই ছেলে মেয়ে আর তাই পড়তে চায় না। অর্থাৎ ব্রেণ আর চাইছে না তাই ছেলে মেয়ের হাই উঠে, ঘুম পায়। তাই ব্রেণকে চাঙা রাখা দরকার।
দেখবেন, যারা পড়াশোনায় র্যাঙ্ক করে তারা বলে অত পড়ার দরকার নেই। সারাদিন মুখ গুঁজে তারা নাকি পড়েই না।
কিন্তু তারা অন্য কিছু বিষয়ে বেশ ইন্টারেস্টেট। যেমন উপন্যাস পড়তে, গল্প পড়তে ভালোবাসে বা গান করতে ভালোবাসে বা গান শুনতে ভালোবাসে বা যোগ ব্যায়াম ভালোবাসে ইত্যাদি ইত্যাদি। এ গুলো সবই পড়া। পড়ার বৃত্ত। কনসেনটেশন।
অর্থাৎ সে পড়াশোনার বৃত্তে অবস্থান করে। তাই তার রেজাল্ট খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা কম। এছাড়া জীবনে চলার পথে ভুল রাস্তায় সে যাবেই না। সে স্কুলের পড়ার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয় না। যতটুকু তাতেই একশ ভাগ। তাই সারাদিন মুখ গুঁজে পড়ার দরকার নেই।
অর্থাৎ এই 'পড়ার বাইরের পড়া'র চর্চা করাতে উপযুক্ত সময় বয়স শিশু থেকে টিন এজে বা পনের ষোলর আগে। দিনের হিসেবে দেখবেন অনেক পড়াশুনার পরেও প্রচুর সময় থাকে এই সব 'পড়ার বাইরের পড়া'র জন্য। ক্লাসের পড়ার বাইরের পড়াও কিন্তু পড়ার বৃত্তের মধ্যেই ছেলে মেয়েদের রাখা।
না হলে ক্লাসে ভাল পড়াশুনা করা ছেলে মেয়ে অনেকেই ভুল রাস্তায় চলে যায়। শেষে তার জীবনটাই বৃথা হয়ে যায়। কিছুতেই নিজস্ব রাস্তাটা খুঁজে পায় না।
টিন এজের শেষের দিকে বা পনের ষোলর পরে পরেই তার মধ্যে প্রেস্টিজ বা একগুঁয়ে না বলা না দেখা না শোনা কাজ করার জেদ ও অহঙ্কার ইত্যাদি চলে আসে।
তখন আর ভুল ঠিক ভাল মন্দ তার মাথায় কাজ করে না। কারও কথা এমন কি নিজের ভবিষ্যতের কথা ভাবার অবকাশ থাকে না। সে যেদিকে যাবে মনে করে সেদিকেই যায়। যে কাজ করবে মনে করে, করেই। তার এই জেদ বা অহঙ্কার আমাদেরও আগামী অহঙ্কার এবং অলঙ্কারও বটে। কিন্তু এটা যেন কোন মতে ভুল না হয়ে যায়। কোন অপ অবস্থান না গ্রহণ করে।
তাও আমরা সে সব না বুঝে, বৃথাই তাকে দোষ দিই। তার আগের অবস্থানের জন্য বর্তমানের এই অবস্থিতি। এটা ভেবে দেখি না। এই আগের অবস্থানের জন্য তো আমরাই সম্পূর্ণরূপে দায়ী। তাহলে?
আর একটা বিষয়, নবম স্ট্যাণ্ডার্ডের পরেই ছেলে মেয়েদের ভবিষ্যৎ তৈরির বড় পরীক্ষায় বসতে হয়। এর জন্য ভাল রকম প্রস্তুতির দরকার হয়। তাই এই নবমের আগে 'পড়ার বাইরে পড়া'র জন্য যে সময়টা পাওয়া যায় তা আর পাওয়া যায় না। অনেকে অবশ্য তাও ধরে রাখে যারা আগে থেকে এসবে অভ্যস্ত।
তাই যে টুকু পারা যায় তা ওই টিন এজের আগে বা পনের ষোলর আগেই করিয়ে নিতে হবে। এই আগের সময়ে যে যতটা 'পড়ার বাইরে পড়া'তে আবদ্ধ হবে ঠিক ততটাই সে জীবন পথে আরো এগিয়ে যাবে। পড়াশুনায় সে যতটা এগিয়ে যাক না কেন ভুল পথে যাবে না।
কেন না আমাদের ছেলে মেয়েকে বড় করার একটাই উদ্দেশ্য থাকে যে সে যেন মানুষ হয়। এই মানুষ করার রাস্তা হল পড়া তো করবেই তার সাথে 'পড়ার বাইরে পড়া' যতটা বেশি পড়ানো।
কিছুতেই যেন নিষিদ্ধ তাকে না টানে। সমাজে এই নিষিদ্ধ অকথা কুকথা কুরঙ্গ কু-চিত্র সবই আছে থাকবে। বরং দিন কে দিন আরও প্রকাশ্য হয়ে পড়ছে। এ সব থেকে আমাদের ছেলে মেয়েদের দূরে রাখতেও পারব না কিংবা রাখা যায় না।
কিন্তু তার মুখটা এ সব থেকে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতেই পারি। সেটা হল 'পড়ার বাইরে পড়া'। এই 'পড়ার বাইরে পড়া'য় বেঁধে রাখার সবচেয়ে বহুল প্রচারিত অবস্থান হল বই পড়ানো। যে কোন বই। ছোটদের বড়দের এমন কোন কথা নয়। বই পড়ানো বা বই পড়ানোর নেশা ধরানো।
কালো অক্ষরেই কালো দূর করা যায়। যে যত বেশি এই কালোতে ঢুকে গেছে তার জীবন থেকে ততটাই কালো দূর হয়ে গেছে। অন্য যে কোন দিকেও এই কালো অক্ষর বা বই আছেই। একে বৃত্ত করেই নাচ গান আঁকা সাঁতার ব্যায়াম ফুটবল ক্রিকেট ক্যারাটে এমন কি গুরুজনকে শ্রদ্ধা ভক্তি ম্যানার সামাজিক সবই এই 'পড়ার বাইরে পড়া'।
নিউক্লিয়ার ফ্যামেলিতে একে অপরের সাথে কিভাবে মিশতে হয়? কথা বলতে হয়, শ্রদ্ধা করতে হয়, ভাব বিনিময় করতে হয় ইত্যাদি ছোটরা জানতেই পারে না। এই গল্প উপন্যাস কবিতা পড়ে সেই ধারণা সহজেই তৈরি হতে পারে।
অর্থাৎ ক্রিয়েটিভিটি। ক্রিয়েটিভ ভাবনার আর একটা দিক হল ভাবতে শেখা। একই অবস্থান আর একটু ভাবলে অন্য রকম হয়ে যায়। এই যে দুর্নীতি অন্যায় অত্যাচার লেনদেন কুক্ষিগত এসবে কতটুকু ভাবনা থাকে।
ধ্বংসের একটাই দিক। কিন্তু সৃষ্টির হাজার মুখ লক্ষ কোটি দিক দিশা।
তাই আগামীকে ভাবতে হবে ভাবাতে হবে এই 'পড়ার বাইরের পড়া' দিয়ে। ক্লাসের পড়া তো পড়লেই সে পারবে। সে আত্মস্থ করুক বা না করুক। অত ভাবার সে রকম কিছু নেই। কিন্তু 'পড়ার বাইরের পড়া'তে কিছু ভাবনা তো থাকেই। আর কিছু নিজে ভাবে, কিছু অন্যকে ভাবায়।
একক এই ভাবনা সমাজ গড়ার একটা মাধ্যমও বটে। 'পড়ার বাইরে পড়া'য় যে সমাজ গোষ্ঠী আগ্রহী বা এগিয়ে তারা এই নাই নাই সমাজ চিত্রে কখনই পিছিয়ে পড়বে না বা ভুল পথে যাবে না।
এই 'পড়ার বাইরে পড়া'য় কি রসদ আছে সেটা বোঝানোর জন্য একটা অবস্থান পর্যন্ত ছেলে মেয়েকে টেনে নিয়ে যেতে হবে। স্বপ্ন দেখাতে হবে। প্রজন্ম যদি স্বপ্ন দেখাতে শিখে যায় তখন সে নিজেই তার জেদের বশে তা করবে।
অনেকে চিত্র প্রদর্শনীতে গিয়ে বলে কি সব এঁকেছে কে জানে? এই 'কি সব' বুঝতে হলে সেই অবস্থানে পৌঁছতে হবে।
গল্প কবিতা পড়ার জন্য যেমন স্থিতধী হতে হয় তেমনি লেখার জন্য আরো বোদ্ধা হতে হয়। সেই অবস্থান পর্যন্ত আমাদের ছেলেমেয়েদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। গান, আবৃত্তি, খেলাধূলা ও অন্যান্য ক্রিয়েটিভ অবস্থানে। তারপর সে এই সব 'পড়ার বাইরে পড়া'য় রসদ পেয়ে গেলে, স্বপ্ন দেখতে শিখে গেলে আমাদের আর কোন দায়িত্ব থাকে না।
সে তারপরে নিজেই এগিয়ে যাবে নিজস্ব মহিমায়, স্বপ্ন সফল করার তাগিদে। ঠিক একই রকমভাবে 'পড়ার বাইরে পড়া' বাদ দিয়ে নিজস্ব স্কুলের পড়ারও সে রসদ খুঁজে পাবে। কিন্তু শুধু স্কুলের পড়ার মধ্যে পথ ভুল হতেই পারে।
এবার আসা যাক এই ভুল পথ কি? বিড়ি, সিগারেট, গুটখা, মদের নেশা, নেটে পর্ণো দেখা, গুণ্ডামি, মাতলামি, খারাপ বন্ধুদের সাথে মেশা কিংবা ছেলে মেয়ের পাল্লায় পড়া অথবা মেয়ে ছেলের পাল্লায় পড়া- ওই যাকে বলে প্রেমে পড়া। ইত্যাদি প্রায় সবই টিন এজের সাধারণ ধর্ম। যা আশেপাশে ক্রমাগত ঘটে চলেছে। যতই দেখে রাখি না কেন, লুকিয়ে তারা একটু আধটু এসব করবে। কিন্তু এই একটু আধটু যেন মাত্রাতিরিক্ত না হয়ে যায় সেটা দেখার দায়িত্ব বাবা মায়ের সাথে আমাদের পারিপার্শ্বিকের।
শুধু না না বলে, খারাপ ও সব, বাজে ছেলেরা এসব করে, সমাজের ক্ষতিকারক কিংবা smoking is injurious to health লিখে দিলেও টিন এজ ওসবের দিকে ঝুঁকবেই। একটু তো পরখ করবেই।
কিন্তু এই 'পড়ার বাইরে পড়া' দিয়ে তাকে এর থেকে বাঁচানো যেতে পারে। উপদেশ কেউ শোনে না। কিন্তু সেই উপদেশ যদি কেউ উপলব্ধি করে তাহলে তার থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারে। আর এই উপলব্ধি তৈরির অন্যতম হাতিয়ার হল 'পড়ার বাইরে পড়া'।
পড়তে পড়তে কত কি যে শেখা যায়, ভাবা যায়, বলা যায়, দেখা যায়, আঁকা যায় তা আর বলার নয়। পড়ার আবার নানান মাধ্যম বই পড়া, বই লেখা, ছবি আঁকা, ছবি দেখা, গান গাওয়া, গান শোনা, আবৃত্তি করা, কবিতা লেখা, গল্প উপন্যাস পড়া, গল্প উপন্যাস লেখা ইত্যাদি হাজারও মাধ্যম।
সেই হিসেবে বলতেই পারি একজন ইঞ্জিনিয়ারও একজন বড় কবি। সৃষ্টিশীল অবস্থানে মেতে ওঠা সমস্ত মনই কবি। এই সৃষ্টিশীল মন তৈরি পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের।
'পড়ার বাইরে পড়া'র এই মাধ্যমের যে কোন একটায় বুঁদ করিয়ে দেওয়া গেলে বা বুঁদ হয়ে গেলে ক্লাসের পড়া সেই ছেলেমেয়ের কাছে কিছুই না। অনেক নম্বর কিছুই না। সব আসবে। হেঁটে হেঁটে আসবে। বাড়ি বয়ে আসবে। সেই সাথে ছেলেমেয়ে তার নিজস্ব রাস্তা খুঁজে পাবে।
'পড়ার বাইরে পড়া'য় যাতে অসঙ্গতি অ-সংস্কৃতি না নিয়ে আসে সেটাও দেখার দায়িত্ব বাবা মায়ের, সমাজের। আর এর উপযুক্ত সময় টিন এজের প্রারম্ভে। এই সময়টুকু বয়ে গেলে আর তাকে দিয়ে কিছু করানো অনেকটাই প্রেসার ক্রিয়েট করা।
না বুঝে আমরা এই টিন এজের শেষের সময়টাতে অনেকেই বকাবকি করি। এর ওর কাছে গল্প করি - জানিস, ছেলেটা আমার কথা শুনছে না। মেয়েটা না কেমন যেন হয়ে গেছে। চুপচাপ থাকে। আজকাল আর কোন কথার তেমন জবাব দেয় না। কি করি বল, মোটেই পড়তে চায় না। কি করে ভাল রেজাল্ট হবে বল।
অথচ আমরা কেউ চিন্তা করি না স্কুলের 'পড়ার বাইরে পড়া'য় আমরা তাকে কতটা জোর করেছি। আজ যে আমরা তার স্কুলের পড়ার জন্য চেষ্টা করছি। বাইরের পড়ার মধ্যেও স্কুলের সেই সব পড়া ছিল, আছে। ভাবনার অবকাশ আছে।
বাংলায় মনোযোগ করলেও ভালভাবে অঙ্ক করা যায়। রচনা, ভাবসম্প্রসারণ, ভাবার্থ, চরিত্র বিশ্লেষণ, সংলাপ, রিপোর্টিং গল্প লেখা, বক্তব্য, কুইজ ইত্যাদি নানান বিষয় স্কুলের পড়ার মধ্যে আছে যা 'পড়ার বাইরে পড়া'তে আছে।
আর একটা ব্যাপার ভাবা যেতেই পারে, তা হল মনুষ্যত্ব। স্কুলের পড়াশোনা কেবল ডিগ্রী ও ক্লাসের সীমিত বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। 'পড়ার বাইরের পড়া' আস্তে আস্তে কমছে বলেই সমাজের বুকে মনুষ্যত্বহীন চিত্র আরও প্রকট হচ্ছে। তাই সমস্ত ছেলেমেয়েদের মধ্যে স্কুলের 'পড়ার বাইরের পড়া'য় আরো বেশি মনোযোগী করা দরকার। স্কুলের পড়ার সমান্তরালে। তবেই সে জীবনে মনুষ্যত্বের মূল্যায়ন বুঝবে। এমন কি ভবিষ্যতে সেই সব ছেলেমেয়েরা তার মা বাবাকে হয়তো বা দেখবে কিংবা যদি নাও দেখে তবু সে তার নিজস্ব জীবন রচনার শৈলী বুঝে নেবে। এও বা কম কি?
আমাকে আমার ছেলেমেয়ে দেখবে এ ভাবনা নিজের কাছে নিজের পরাজয় ছাড়া কিছুই না। আমি নিজেই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত স্বাবলম্বী থাকব আমার এ ভাবনা আমাকে আরও জীবনী করে বাঁচিয়ে রাখবে।
এরপর আছে, পড়া থেকে ব্রেক। কেউ একটানা কোন কাজ করতে পারে না। একঘেঁয়ে লাগে। আমরা যে কাজ করি তার থেকে রেহাই পেতে সিরিয়াল দেখি, খবর শুনি, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিই, ফোন করি। এছাড়াও আরও অনেক এটা ওটা করি। সেই রকম পড়াশোনা করা ছেলেমেয়েরা পড়ার ফাঁকে কি করবে? বড়রা তাকে কি করতে দেখলে খুশি হবে?
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তেমন কিছু যুতসই আমরা ছেলে মেয়েদের সামনে তুলে ধরতে পারি না। তাই তারা ভিডিও গেম খেলে, নেট চর্চা করে, ফেসবুক করে, হোয়াটস অ্যাপ্স করে, আরো অন্যান্য অকাজ কুকাজ করে। যা পড়া তো নয়। সেই সাথে 'পড়ার বাইরে পড়া'ও নয়। কিংবা নানা সব অসৎ সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে।
অর্থাৎ এই ফাঁক সময়ে, একঘেঁয়ে থেকে রেহাই দিতে, আরও প্রাণবন্ত হয়ে পড়ায় মনোনিবেশের জন্য অবশ্যই এই 'পড়ার বাইরে পড়া' খুব জরুরী।
পড়তে ভাল লাগছে না একটু ছবি আঁক, সৎ পাত্র কবিতাটি বলো দেখি, কিংবা মম চিত্তে নিতি নৃত্যে গানটা দুজনে করি আয়। চল, একটু বাইরে ফুটবল খেলে আসি, জায়গা নেই বল ছোঁড়াছুঁড়ি করা যেতেই পারে কিংবা একটু দাবা খেলি বা ছক্কা খেলি ইত্যাদি। মাঝে মাঝে টুরে কোথাও দুচার দিন/আট দশ দিন বেড়াতে যাওয়া যেতে পারে।
'পড়ার বাইরে পড়া'য় এ রকম নানা উপাদান আছে। এই অবস্থানের সাথে ছেলেমেয়েদের যত বেশি করে পরিচিত করানো যাবে ততই তার পড়ার সার্থকতা সে খুঁজে পাবে। না হলে ভাল রেজাল্ট আসবে, উচ্চ শিক্ষিত হবে, ডিগ্রী আসবে। সাথে সাথে কিছু ভুল পথ এবং মনুষ্যত্বহীনতা আরও বেশি করে আমাদের সমাজকে জড়িয়ে ধরবে।
তবে কখনই এই 'পড়ার বাইরের পড়া' যেন ক্লাসের পড়াকে ছাড়িয়ে না যায় সেদিকেও দৃষ্টি দেওয়া জরুরী।
ছাত্র জীবনে পড়াটাই একমাত্র লক্ষ্য। আর এই 'পড়ার বাইরে পড়া' একেবারেই উপলক্ষ্যমাত্র। লক্ষ্যকে আরও মজবুত উপযুক্ত ও পরিণত করার জন্য উপলক্ষ্য। উপলক্ষ্য বিশেষ অবস্থানে তার পড়ার সাথে এগিয়ে যেতেই পারে। তখন তার মর্যাদা অন্যভাবে নির্ণীত হবে।
ছেলেমেয়েদের তাই ক্লাসের নিজস্ব 'পড়ার বাইরের পড়া'য় মোটিভেট করতে হবে। তা না হলে আপনি না চাইলেও মোটিভেট হচ্ছে অন/অফ লাইন গেমে। ভয়ঙ্কর গেমে।
তাহলে ছেলে মেয়ের পড়াশুনায় ভার কমানোর জন্য আপনি চেষ্টা করছেন, ভাল কথা। কিন্ত ভার কমছে কি? কোনদিকে ঝুঁকছে। পড়া এবং 'পড়ার বাইরে পড়া'য় যতটা সে ব্যস্ত থাকবে ততটাই সে অন/অফ লাইন বা এই জাতীয় অবস্থান থেকে দূরে থাকবে।
পড়াশুনা যার কাছে ভারি সেই ছাত্র/ছাত্রী পড়াশুনার চিন্তাভাবনায় আছে তো? ভেবে দেখবেন।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
জে এস সাব্বির ৩১/০৫/২০১৬
-
পরশ ১৮/০৫/২০১৬খুব সুন্দর
-
প্রবাল ১৫/০৫/২০১৬খুব ভাল লাগল, শুভেচ্ছা রইল।
-
আজকের চাকরির বাজার বিডি.কম ১২/০৫/২০১৬দারুন।।।
আপনার "গোপলার কথা" সিরিজটা অসাধারণ ।চালিয়ে যান ।ভাল লাগা জানবেন ।