মৃত্যু চিরসত্য তবু প্রেম অবিনশ্বর
[শাখা: ছোটগল্প]
------------------------------------------
•| ১৩ ফাল্গুন |
সন্ধ্যা ছ'টা আঁধার ছুঁই ছুঁই, বাইরে ছিরিছিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে হঠাৎ! ২৭ বছর বয়সি রুপম এবং ২৫ বছর বয়সি নীলা হুড়মুড় করে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে একইসাথে বাড়ি ফিরছিল। নিয়ম করে তারা সপ্তাহে যেকোনো দুইদিন বাইরে একসঙ্গে ঘুরতে বের হয়, আজও তাই। অবশ্য প্রত্যেকবার রুপম জোরপূর্বক নীলাকে ঘুরতে যাওয়ার জন্য বাধ্য করলেও আজ নীলা রুপমের বায়না করার আগেই সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিল কারণ আজ নীলার জন্য একটি বিশেষ দিন। তাই নীলা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল আজ তাদের দুজনের কাপড়েরই রং হবে নীল। হিসেব অনুযায়ী রুপমের গায়ে নীল পাঞ্জাবি ও নীলার গায়ে নীল শাড়ি।অসীম আকাশজুড়ে লেপ্টে থাকা বিস্তৃত বিরামহীন নীলিমার দুই খণ্ড নীল যেনো মাটিতে নেমে এসেছে এমনতরো দেখতে লাগছিল তাদের!!
তবে আজ তারা বাড়িতে সবকিছু জানিয়ে তারপর বাইরে বেরিয়েছিল কিন্তু দুজনের বাড়ি থেকেই সন্ধ্যার পূর্বে ফিরে আসার আদেশজারি করা হয়েছিল ফলে বেলাশেষে ফিরতে সামান্য দেরী হয়ে যাওয়ায় দুজনেরই সময়ের তাড়া লেগে যায়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পরস্পর বিপরীত অভিমুখী দুইটি ব্যাস্ত মহাসড়ক পার হওয়ার পরপরই,
প্রায় পাশাপাশি দুজনের বাড়ি অবস্থিত।
সময়ের তাড়নায় বৃষ্টির জলে কাকভেজা হয়ে জলদি বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে তারা একইসঙ্গে সড়কদ্বয় অতিক্রম করছিল যদিও রুপম নীলাকে ডানপাশে কিছুটা পেছনে রেখে সামান্য এগিয়ে ছিলো। প্রথম সড়কটি অতিক্রম করার মাঝপথে রুপম তাঁর পেছন দিক থেকে মেয়েলি কন্ঠে একটি জোরালো চিৎকার শুনতে পেয়ে হকচকিয়ে ঘুরে তাকায় আর পরক্ষণে তাঁর দিকে ধেয়ে আসা একটি প্রকান্ড বাসের ধাক্কায় সে মুখ থুবড়ে অনেকটা দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ে।
শরীরের প্রায় সমস্ত অংশই কমবেশি আহত হয় কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অনেক জোরে ধাক্কা লাগার ফলপ্রসূ রুপমের মস্তিষ্ক গুরুতরভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।
•| সাড়ে তিন বছর পর |
এতকিছুর পরেও বলতে হয় রুপম তার অদৃষ্টক্রমেই বেঁচে আছে। তবে তাঁর অনেকখানি স্মৃতিশক্তি চিরতরে বিনষ্ট হয়ে গেছে। এখন বাবা, মা একমাত্র বোন এবং মুষ্টিমেয় কিছু স্বজন ব্যতীত অন্য কারো কথাই তার মনে নেই।এমনকি তাঁর অজস্র বন্ধুবান্ধবদের বেশিরভাগকেই এখন সে চিনতে পারে না। তাঁর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জিবনে ফিরে আসতে প্রায় সাড়ে তিন বছর লেগে যায় এবং এই সময়কালের মধ্যেই তাঁর বাবার মৃত্যু ঘটে ফলে সে আরো ব্যাথিত হয়ে পড়ে।
প্রায় চার মাস কেটে গেল রুপম একটি উৎকৃষ্ট মানের সফটওয়্যার ফার্মে ভালো বেতনের কর্মচারী হিসেবে চাকরি পেয়েছে। অফিসের উধ্বর্তন কর্মকর্তা ছিলেন তাঁর বাবার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাই বলতে গেলে রুপম চাকরিটি স্বজনপ্রীতির পরিপ্রেক্ষিতেই পেয়েছিল।
চার মাস আগে রুপম সুস্থ হওয়ার পরপর যখন কোনো চাকরির ঝড়ঝামেলা ছিলো না, তখন নিজের অজান্তেই তার একটি রোজকার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। আসলে তাঁর অভ্যাসটি নব্য নয় বরং প্রাক্তন অভ্যাস। তার বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে যাওয়ার মতো কিছুটা দূরে, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম মূল সড়কদ্বয়ের বিপরীত পাশে স্নিগ্ধতা বিরাজিত কোমল পরিবেশে আচ্ছন্ন একটি ছোট্ট ক্যাফে রয়েছে। "ক্যাফে ঐন্দ্রিলা"
বাইরের ধূলোবালি আর জঞ্জালময় আঁকাবাঁকা জীবনের রেশ কাটানো ক্যাফের অভ্যন্তরীণ চার দেয়ালে বন্দী দুনিয়াটা বড্ড বেশী ভালো লাগতো রুপমের।
রুপম প্রায় নিত্যদিন বিকেল ৩:৩০ থেকে ৫:৩০ পর্যন্ত ক্যাফে ঐন্দ্রিলার স্মোকিং জোনে বসে খানিকক্ষণ ধোঁয়া উড়িয়ে দুই কাপ কফিতে চুমুক তারপর কবিতা, গান, গল্প যখন যা মনে আসতো নোটপ্যাডে হুটহাট লিখে নিতো। অবশ্য লেখালেখির প্রতি আকস্মিক অনুরাগটা তাঁর আজকালই জন্মেছে বটে। এই অভ্যাসগুলো তাঁর কাছে এতটা প্রিয় বনে গিয়েছিল যে, রুপম চাইলেও কিছুতেই ত্যাগ করতে পারছিল না।তাই চাকরিতে যোগদানের পর সপ্তাহে দুইদিন (বুধবার ও শুক্রবার) রুপম নিয়ম করে ক্যাফে ঐন্দ্রিলাতে যায়। বাকি দশজনের ন্যায় সপ্তাহান্তিক কাল হিসেবে শুক্রবারই সে অন্যান্য দিনের তুলনায় ক্যাফেতে বসে থাকা বেশি উপভোগ করে। এইভাবে অফিস, ক্যাফে ঐন্দ্রিলা, বাড়ি ফেরার একলা পথটুকু এবং নিজের বাড়ি ব্যতিরেকে অন্য কোথাও তাঁর বিচরণ তেমন দৃষ্টিগোচর হয় না। এমনকি সে ঐ চরম দুর্ঘটনাটি ঘটার পর থেকে সবার সাথে কথোপকথনও খুব কমিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু চুপচাপ থাকার ফলপ্রসূ সে অনেক ভাবুক হয়েগিয়েছিল, এখানকার মোদ্দাকথা হলো - মানুষ স্বভাবতই বাঁচাল জাতের প্রাণী। প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব ভাষা আছে আর সেই ভাষার ব্যাবহারে মানুষ পরস্পরের সনে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে নিত্য নানান আলাপচারিতা চালায়। কিন্তু এছাড়াও মানুষের আরেকটি অনন্য গুণ হলো, মানুষ নিজের সাথে অর্থাৎ মানুষ আপন সত্তার সাথে নিরবে কথা বলতে পারে। একেবারে চুপচাপ মানুষ কখনোই থাকতে পারে না। হয় সে নিজের সনে তাঁর না বলা কথাগুলো বলবেই বলবে নাহয় অন্য একজন মানুষের সনে। অবশ্য রুপমের ভাবুক হয়ে যাওয়ার কারণ হয়তো লেখালেখি।
এইভাবে, হঠাৎ একদিন শুক্রবার একটু ব্যতিক্রম ঘটলো, রুপম সেদিন প্রায় ৩ টার আগ থেকেই ভীষণ আনমনা হয়ে একনাগাড়ে ক্যাফেতে বসেছিল। এভাবে সময় বইতে বইতে ঘড়ির কাঁটা ৫:৩০ ছুঁয়েছে। এবার তার যাওয়ার পালা। কিন্তু সেদিন বাইরে দুপুর থেকেই বড্ড দমকা হাওয়া দিচ্ছিল।রুপম ক্যাফে থেকে বেরিয়ে দেখে বাইরে প্রচুর ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ অনেকদিন পর উষ্ণতায় স্তম্ভিত পাথুরে শহরের বুকে অকস্মাৎ বৃষ্টি দেখতে পেয়ে রুপমের চোখে যেনো বহুকাল যাবৎ বন্দী পড়ে থাকা আনন্দের পরজীবী ভেসে উঠেছে। তৎক্ষণাৎ সে কোনোকিছুকে গ্রাহ্য না করে বৃষ্টিস্নাতে নেমে পড়লো। এ যেনো বেতালা আকাশ হতে সহসা সর্গ ভেঙে পড়েছে। রুপম অনেকটা আধখোলা চোখে বৃষ্টিস্নাত উপভোগ করতে করতে বাড়ি ফেরার পথটা ধরে একলা হাঁটছিলো। সে বাড়ি ফেরার ঐ পথটুকুতে কারো সঙ্গ নেওয়া মোটেই পছন্দ করে না, তাই রোজকার মতো আজও সে আনমনে একলা হাঁটছিলো। হঠাৎ রুপমের মনে হলো, গা ঘেঁষে ঘেঁষে তার ডানপাশে কেউ যেনো হাঁটছে। ঠিক পরক্ষনেই খুব আলতো সুরে আদরী কন্ঠে সে একটি ডাক শুনতে পেলো, "রৌম !!!"
রুপমের শিরদাঁড়া বেয়ে যেনো অগ্নি কম্পন বয়ে গিয়েছিল। কেনো যেনো তাঁর মনে ধরলো,হাজার বছর আগে কেউ একজন তাকে এই নামে ডাকতো। সে সম্পূর্ণ মনে করতে না পারলেও নামটির সাথে যেনো তার অনেকদিনের পরিচয় ছিলো।
ডাক শুনতে পেয়ে তবুও সে হেঁটেই চলছিল, কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। কিন্তু এবার সে আধখোলা চোখে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে ঝাপসা দেখতে পায়, ঝড়ো বাতাসে একটি শাড়ীর আঁচল উড়ছে তাঁর ডান পাশে।
নীল শাড়ি পরা কেউ!!
সে অতিভিষম ঘাবড়ে গিয়ে ডানে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেলো, নীল শাড়ি পরনে এক চাঁদনী রূপবতী হরিণীর ন্যায় টানা টানা চোখ নিয়ে তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
আর রুপম জিজ্ঞাসু চোখে রূপবতীকে বলে বসলো "কেমন আছো?"
কিন্তু অপরিচিত কারো সঙ্গে তার এমনতরো হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। কারণ রুপম তার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। রুপম নিজেও ঐ রূপবতীটিকে চিনতে পারে নি। কিন্তু সে যখন ঘাবড়ে গিয়ে ঐ রূপবতীর দিকে ঘুরে তাকিয়েছিল তখন তাঁর ঐ টানা টানা চোখদুটোর ভেতরে রুপম ক্ষণিকের জন্য যেনো তাঁর হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর এক রঙিন মানচিত্র দেখতে পেয়ে যায়। তাঁর অনুভূত হচ্ছিলো, সমস্ত শরীর হতে যেনো সে তাঁর নিজের করায়ত্ত ভুলে যাচ্ছে। তাই সে অজান্তেই ঐ রূপবতীকে প্রশ্ন করে বসে, "কেমন আছো?"
রুপমের প্রশ্নটি শুনে রূপবতীর মুখে এক অনন্য ধাঁচের মুচকি হাসি ফুটে উঠে যেনো অঘণের পূর্ণিমার চাঁদ তার রূপের তীব্রতায় দ্বি-খণ্ড হয়ে গিয়েছে! রূপবতীর অধরবিম্বকজুড়ে এমন তেজস্বী হাসি দেখতে পেয়ে রুপম নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছিল। অতঃপর সে তাঁর এতদিন ধরে জমতে থাকা বুকচাপানো অজস্র, অগণনীয়, পাহাড় সমপরিমাণ না বলা কথাগুলো বিড়বিড় করে অনর্গল বলতে শুরু করলো ঐ রূপবতীকে। এভাবে সারাটা পথ রুপম ঐ রূপবতীর চোখের দিকে চেয়ে থেকে বিরামহীনভাবে একের পর এক না বলা কথার বন্যা বইয়ে দিয়েছিল সেদিন।
কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় এই যে, সারাটা পথ সে একলাই কথা বলেছে, ঐ রূপবতী কোনো কথাই বলেনি শুধু রুপমের প্রত্যেক কথার শেষে কথার বিষয়বস্তু অনুযায়ী প্রয়োজনমাফিক মুচকি হাসি টেনেছে এবং যখনই রুপম তার বাড়ির কাছাকাছি আসতে শুরু করলো ধীরে ধীরে বুঝতে লাগলো তার ডানপাশে এখন আর কেউ নেই। যেহেতু রুপম সেই থেকেই অনেক আনমনা স্বভাবের ছিলো তাই অতো কিছু মাথায় না ঢুকিয়ে সোজা বাড়ি চলে গেলো।
ঠিক এইভাবে রোজ শুক্রবার ক্যাফে থেকে বাড়ি ফেরার পথে ঘড়ির কাঁটা যখন সন্ধ্যা ৬:০০টা ছুঁই ছুঁই, তখনই রুপম তার ডানপাশে সেই রূপবতীকে দেখতে পেতো। তারপর সারাটা পথ একলাই ঐ রূপবতীর সঙ্গে বিড়বিড় করতে করতে বাড়ি ফিরতো। এসব কর্মকাণ্ড তার সাপ্তাহিক জীবনের অতি আবশ্যিক কাজ হয়ে গিয়েছিল। ঝড়,বৃষ্টি,রোদ, দুর্যোগ যাই থাকুক না কেনো রুপম এবং ঐ রূপবতীর দেখা হওয়া আটকানোর সামর্থ্য কারুরই ছিলো না। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, রুপম যখনই ঐ রূপবতীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাড়ি ফিরতো রাস্তার আশেপাশের মানুষ তখন কেমন যেনো অাশ্চর্যিত জিজ্ঞাসু চোখে তাঁর দিকে চেয়ে থাকতো আর রুপমও কখনো ঐ রূপবতীর কাছ থেকে তাঁর কোনো কথার বা কোনো প্রশ্নের জবাব প্রত্যাশা করেনি বরং রূপবতীটির বাকরুদ্ধ স্বভাবই তার বেশি ভালো লাগতো। তবে এমনও নয় যে, ঐ রূপবতী একেবারেই নিশ্চুপ থাকতো, কথা বলতে বলতে রুপম যখন হঠাৎ চুপ করে যেতো তখন সে রুপমকে "রৌম" বলে ডাক দিয়ে সাড়া জাগিয়ে দিতো। এইভাবে দিন কাটতে কাটতে রুপম একসময় সপ্তাহের প্রতি শুক্রবারে ঐ রূপবতীর শাড়ীর সঙ্গে মিল রেখে নীল পাঞ্জাবি পড়া শুরু করে দিয়েছিলো আর রোজ ক্যাফেতে বসে নব্য নতুন কবিতা লিখতো আর সন্ধ্যে নামার পর ফেরার পথে রূপবতীকে শোনাতো।
•| ১৩ ফাল্গুন ( প্রায় চার বছর পর) |
আজ শুক্রবার, রুপমের জন্মদিন। ভোরে ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই পরিবারের সকলের কাছ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা গ্রহণ করে। তাঁর ছোটো বোন তাকে একটি বই উপহার দিয়েছিল। বইটির নাম হলো "মৃত্যু চিরসত্য হলেও প্রেম কিন্তু অবিনশ্বর"।
তারপর বাদবাকি সব কাজকর্ম সম্পাদন করে মাঝদুপুর ৩ টার দিকে একটি নতুন নীল পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে নোটপ্যাড, ফোনসহ প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী একটি পুরনো চকচকে চামড়ার ছোটো ব্যাগে পুরে ব্যাগটি তার বাম কাঁধ থেকে ডান পাশে কোমর পর্যন্ত ঝুলিয়ে দিয়ে ক্যাফের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। আজকের দিনটি তার কাছে খুব উৎফুল্লময়। তাই সারাটা বিকেলজুড়ে সে একনাগাড়ে ১৩টি কবিতা লিখে ফেললো তার জন্মদিনের তারিখের সাথে মিল রেখে। আর প্রত্যেকটি কবিতাই ছিলো ঐ রূপবতীকে নিয়ে।
রুপম গোপনে ভেবে রাখলো ঐ রূপবতীকে এই ১৩টি কবিতা উৎসর্গ করে আজকের দিনটি চিরস্মরণীয় করে রাখবে।
গোধুলীর আকাশ বেয়ে সন্ধ্যা নামার বন্দোবস্ত হতে শুরু করলে রুপম আর দেরি না করে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে এগোতে থাকে। আজ সারাদিন শহরের আকাশজুড়ে তুলোর মতো ধপধপে ঘন সাদা মেঘেদের আনাগোনা ছিল। রুপম ক্যাফে থেকে বের হওয়া মাত্রই চারপাশে হঠাৎ ছিরিছিরি বৃষ্টি শুরু হলো। তার আরো আনন্দ অনুভূত হতে লাগলো। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর রুপম হাতঘড়ি দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়। ঘড়িতে বাজছে ৬টা১৫ মিনিট। কিন্তু এখনও সেই রূপবতীর কোনো দেখা নেই। রুপম একধরনের অসহনীয় অস্বস্তিবোধ করতে লাগলো। বৃষ্টিভেজা অবস্থায়ই যেনো সে ঘামছে। তবুও রুপম ধৈর্য ধরে ঐ একলা পথটাতে রাত ৮:০০টা পর্যন্ত অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলো। কিন্তু ঐ রূপবতীর কোনো দেখা আজ সে পায়নি।
রুপম ভীষণ বিমর্ষ হয়ে বিষন্নচিত্তে বাড়িতে তার মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। তাঁর মা তাঁর মাথায় আলতো স্পর্শে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ঐ মুহূর্তে হঠাৎ রুপম তার মায়ের মুখে একটি হতাশাজনক কথা শুনতে পেলো। রুপম বুঝতে না পেরে পুণরায় জিজ্ঞেস করলে তার মা বললেন,
"সেদিন যদি তোরা দুজন ওভাবে ঘুরতে না বেরিয়ে বরং বাড়িতেই থাকতি তাহলে অন্তত আজ এমন দিন দেখতে হতো না!"
রূপম আবার জিজ্ঞেস করে, "কাদের কথা বলছো মা?"
"তোদের কথাই বলছি। তুই আর নীলা। নীলা যদি আজ বেঁচে থাকতো তাহলে তোকে বড্ড ভালোবাসতো জানিস!"
মায়ের কথা শুনার পর রুপম হকচকিয়ে উঠে বসে পড়ে। তৎক্ষণাৎ তাঁর মাথার ভেতর এক অস্বাভাবিক যন্ত্রণা অনুভূত হতে শুরু করে এবং সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে সে তার ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। তার চোখদুটো অনেকটা জোর করেই বন্ধ হয়ে আসছিল। চোখ বন্ধ করতেই তার পরিষ্কার মনে পড়ে যায়,
"সেদিন শুক্রবার সন্ধ্যা ছ'টার সময় সে আর নীলা একসঙ্গে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে সড়ক পার হচ্ছিলো। হঠাৎ পেছন থেকে নীলার "রৌম" বলে জোরালো চিৎকার শুনতে পেয়ে রুপম যখন পেছনে ঘুরে তাকায় দেখতে পায় নীলার শরীর আস্ত একটি ট্রাকের চাকার নিচে পড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে এবং পরক্ষনেই সে একটি প্রকান্ড বাসের ধাক্কায় দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে"।
এরপরে রুপমের জীবনে আরো শয়ে শয়ে শুক্রবার এলেও ওই নীল শাড়ী পরিহিত রূপবতীর দেখা আর কখনো সে পায়নি। তবে প্রত্যেক শুক্রবার রুপম নিয়ম করে ক্যাফে ঐন্দ্রিলায় বিকেল যাপন করতে কখনো ভুলে না।
সেই রূপবতীকে নিয়ে লেখা ১৩টি কবিতার মধ্যে শেষ কবিতাটির নাম ছিলো "অন্তর্মিলহীন আকাশ তুমি" ...
থমকে ক্ষয়ে যাচ্ছি শতাব্দীর নাট্যমঞ্চ পেছনে ফেলে
সামনে চন্দ্রস্থ রোদে আলোকিত
নির্জনতায় কণ্টকাকীর্ণ খোলা
নিরন্তর পথ; অথচ সেথায়
কোথাও, এই নির্লিপ্ত পা দুটো ঠেসবার জায়গা নেই।
কখনো কখনো ঘাসের ডগায় ছোট্ট শীতবিন্দু হয়ে
ঘুমন্ত বাঁদুরের মতো কিম্ভূত
আটকে থাকি নিগূঢ়তম নীলে।
যাতে আর পাঁচ সাতটে বিষাক্ত
চোখের দংশনে বারবার অন্ধ না হই; না পারিনা !
অথবা একাকী শ্রাবণের অবসন্নতা আঙুলে তুলে
জীবন্মৃত এই নগ্ন হাত দুটো
গ্রাম্য বাউলের মতো অনেকটা
অনুভূমিক চিরস্থায়ী উদ্যত,
আমি নিবৃত্তে নিভে যাচ্ছি, লীন হচ্ছি আসমানি বুলেটে।
জানো?
এথায় অগুন্তি শূন্যতামুখী উঁচু নিচু বাক্সের গর্ভে
স্যাঁতসেঁতে আলোকরেখা ডিঙিয়ে একটা ক্যাকটাসের
অলীক অনড় দৃঢ় চোখে; আমি প্রায়ই তোমাকে ছুঁই ।
কখনোসখনো আষাঢ়ী আকাশের আসন্ন
মেঘের ন্যায়; তোমার আড়ষ্ট চুল আমার চিলতে জানালা
হাঁকিয়ে ক্রমশ ঝড় তোলে।আবার হঠাৎ কখনো
নির্বাক ঐ পৌরাণিক দুপুরের বৈরাগী উষ্ণতায়
এখানকার অন্তঃসারশূন্য নির্লিপ্ততার
গুপ্তঘাতি আগুনের চর্বনে ভাঙতে ভাঙতে
তোমার ন্যুব্জ নীলাভ দেহের নগ্নতা পাকড়ে
টুকরো ছাইয়ের মতো অধীর বেঁচে রই।
জানো? নিথর মর্গ থেকে শুরু করে ফাঁসির মঞ্চ অবধি
ল্যাম্পপোস্টের ধূসরতা কিংবা বলয়বেষ্টিত শনি
এথা কোথাও কিছু নাই; তবুও তোমারে খুঁজি।
কলম বল্লম সদা তোমাতেই জড়িয়ে রাখি
যাতে মৃত বৃক্ষের মতো জীবন্ত হয়ে না উঠি !
ওরাও কথা বলে, তুমি জানো আর আমি জানি।
------------------------------------------
•| ১৩ ফাল্গুন |
সন্ধ্যা ছ'টা আঁধার ছুঁই ছুঁই, বাইরে ছিরিছিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে হঠাৎ! ২৭ বছর বয়সি রুপম এবং ২৫ বছর বয়সি নীলা হুড়মুড় করে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে একইসাথে বাড়ি ফিরছিল। নিয়ম করে তারা সপ্তাহে যেকোনো দুইদিন বাইরে একসঙ্গে ঘুরতে বের হয়, আজও তাই। অবশ্য প্রত্যেকবার রুপম জোরপূর্বক নীলাকে ঘুরতে যাওয়ার জন্য বাধ্য করলেও আজ নীলা রুপমের বায়না করার আগেই সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিল কারণ আজ নীলার জন্য একটি বিশেষ দিন। তাই নীলা আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল আজ তাদের দুজনের কাপড়েরই রং হবে নীল। হিসেব অনুযায়ী রুপমের গায়ে নীল পাঞ্জাবি ও নীলার গায়ে নীল শাড়ি।অসীম আকাশজুড়ে লেপ্টে থাকা বিস্তৃত বিরামহীন নীলিমার দুই খণ্ড নীল যেনো মাটিতে নেমে এসেছে এমনতরো দেখতে লাগছিল তাদের!!
তবে আজ তারা বাড়িতে সবকিছু জানিয়ে তারপর বাইরে বেরিয়েছিল কিন্তু দুজনের বাড়ি থেকেই সন্ধ্যার পূর্বে ফিরে আসার আদেশজারি করা হয়েছিল ফলে বেলাশেষে ফিরতে সামান্য দেরী হয়ে যাওয়ায় দুজনেরই সময়ের তাড়া লেগে যায়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পরস্পর বিপরীত অভিমুখী দুইটি ব্যাস্ত মহাসড়ক পার হওয়ার পরপরই,
প্রায় পাশাপাশি দুজনের বাড়ি অবস্থিত।
সময়ের তাড়নায় বৃষ্টির জলে কাকভেজা হয়ে জলদি বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে তারা একইসঙ্গে সড়কদ্বয় অতিক্রম করছিল যদিও রুপম নীলাকে ডানপাশে কিছুটা পেছনে রেখে সামান্য এগিয়ে ছিলো। প্রথম সড়কটি অতিক্রম করার মাঝপথে রুপম তাঁর পেছন দিক থেকে মেয়েলি কন্ঠে একটি জোরালো চিৎকার শুনতে পেয়ে হকচকিয়ে ঘুরে তাকায় আর পরক্ষণে তাঁর দিকে ধেয়ে আসা একটি প্রকান্ড বাসের ধাক্কায় সে মুখ থুবড়ে অনেকটা দূরে ছিটকে গিয়ে পড়ে।
শরীরের প্রায় সমস্ত অংশই কমবেশি আহত হয় কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অনেক জোরে ধাক্কা লাগার ফলপ্রসূ রুপমের মস্তিষ্ক গুরুতরভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়।
•| সাড়ে তিন বছর পর |
এতকিছুর পরেও বলতে হয় রুপম তার অদৃষ্টক্রমেই বেঁচে আছে। তবে তাঁর অনেকখানি স্মৃতিশক্তি চিরতরে বিনষ্ট হয়ে গেছে। এখন বাবা, মা একমাত্র বোন এবং মুষ্টিমেয় কিছু স্বজন ব্যতীত অন্য কারো কথাই তার মনে নেই।এমনকি তাঁর অজস্র বন্ধুবান্ধবদের বেশিরভাগকেই এখন সে চিনতে পারে না। তাঁর পুরোপুরি সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জিবনে ফিরে আসতে প্রায় সাড়ে তিন বছর লেগে যায় এবং এই সময়কালের মধ্যেই তাঁর বাবার মৃত্যু ঘটে ফলে সে আরো ব্যাথিত হয়ে পড়ে।
প্রায় চার মাস কেটে গেল রুপম একটি উৎকৃষ্ট মানের সফটওয়্যার ফার্মে ভালো বেতনের কর্মচারী হিসেবে চাকরি পেয়েছে। অফিসের উধ্বর্তন কর্মকর্তা ছিলেন তাঁর বাবার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তাই বলতে গেলে রুপম চাকরিটি স্বজনপ্রীতির পরিপ্রেক্ষিতেই পেয়েছিল।
চার মাস আগে রুপম সুস্থ হওয়ার পরপর যখন কোনো চাকরির ঝড়ঝামেলা ছিলো না, তখন নিজের অজান্তেই তার একটি রোজকার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। আসলে তাঁর অভ্যাসটি নব্য নয় বরং প্রাক্তন অভ্যাস। তার বাড়ি থেকে পায়ে হেঁটে যাওয়ার মতো কিছুটা দূরে, ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম মূল সড়কদ্বয়ের বিপরীত পাশে স্নিগ্ধতা বিরাজিত কোমল পরিবেশে আচ্ছন্ন একটি ছোট্ট ক্যাফে রয়েছে। "ক্যাফে ঐন্দ্রিলা"
বাইরের ধূলোবালি আর জঞ্জালময় আঁকাবাঁকা জীবনের রেশ কাটানো ক্যাফের অভ্যন্তরীণ চার দেয়ালে বন্দী দুনিয়াটা বড্ড বেশী ভালো লাগতো রুপমের।
রুপম প্রায় নিত্যদিন বিকেল ৩:৩০ থেকে ৫:৩০ পর্যন্ত ক্যাফে ঐন্দ্রিলার স্মোকিং জোনে বসে খানিকক্ষণ ধোঁয়া উড়িয়ে দুই কাপ কফিতে চুমুক তারপর কবিতা, গান, গল্প যখন যা মনে আসতো নোটপ্যাডে হুটহাট লিখে নিতো। অবশ্য লেখালেখির প্রতি আকস্মিক অনুরাগটা তাঁর আজকালই জন্মেছে বটে। এই অভ্যাসগুলো তাঁর কাছে এতটা প্রিয় বনে গিয়েছিল যে, রুপম চাইলেও কিছুতেই ত্যাগ করতে পারছিল না।তাই চাকরিতে যোগদানের পর সপ্তাহে দুইদিন (বুধবার ও শুক্রবার) রুপম নিয়ম করে ক্যাফে ঐন্দ্রিলাতে যায়। বাকি দশজনের ন্যায় সপ্তাহান্তিক কাল হিসেবে শুক্রবারই সে অন্যান্য দিনের তুলনায় ক্যাফেতে বসে থাকা বেশি উপভোগ করে। এইভাবে অফিস, ক্যাফে ঐন্দ্রিলা, বাড়ি ফেরার একলা পথটুকু এবং নিজের বাড়ি ব্যতিরেকে অন্য কোথাও তাঁর বিচরণ তেমন দৃষ্টিগোচর হয় না। এমনকি সে ঐ চরম দুর্ঘটনাটি ঘটার পর থেকে সবার সাথে কথোপকথনও খুব কমিয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু চুপচাপ থাকার ফলপ্রসূ সে অনেক ভাবুক হয়েগিয়েছিল, এখানকার মোদ্দাকথা হলো - মানুষ স্বভাবতই বাঁচাল জাতের প্রাণী। প্রতিটি মানুষেরই নিজস্ব ভাষা আছে আর সেই ভাষার ব্যাবহারে মানুষ পরস্পরের সনে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে নিত্য নানান আলাপচারিতা চালায়। কিন্তু এছাড়াও মানুষের আরেকটি অনন্য গুণ হলো, মানুষ নিজের সাথে অর্থাৎ মানুষ আপন সত্তার সাথে নিরবে কথা বলতে পারে। একেবারে চুপচাপ মানুষ কখনোই থাকতে পারে না। হয় সে নিজের সনে তাঁর না বলা কথাগুলো বলবেই বলবে নাহয় অন্য একজন মানুষের সনে। অবশ্য রুপমের ভাবুক হয়ে যাওয়ার কারণ হয়তো লেখালেখি।
এইভাবে, হঠাৎ একদিন শুক্রবার একটু ব্যতিক্রম ঘটলো, রুপম সেদিন প্রায় ৩ টার আগ থেকেই ভীষণ আনমনা হয়ে একনাগাড়ে ক্যাফেতে বসেছিল। এভাবে সময় বইতে বইতে ঘড়ির কাঁটা ৫:৩০ ছুঁয়েছে। এবার তার যাওয়ার পালা। কিন্তু সেদিন বাইরে দুপুর থেকেই বড্ড দমকা হাওয়া দিচ্ছিল।রুপম ক্যাফে থেকে বেরিয়ে দেখে বাইরে প্রচুর ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ অনেকদিন পর উষ্ণতায় স্তম্ভিত পাথুরে শহরের বুকে অকস্মাৎ বৃষ্টি দেখতে পেয়ে রুপমের চোখে যেনো বহুকাল যাবৎ বন্দী পড়ে থাকা আনন্দের পরজীবী ভেসে উঠেছে। তৎক্ষণাৎ সে কোনোকিছুকে গ্রাহ্য না করে বৃষ্টিস্নাতে নেমে পড়লো। এ যেনো বেতালা আকাশ হতে সহসা সর্গ ভেঙে পড়েছে। রুপম অনেকটা আধখোলা চোখে বৃষ্টিস্নাত উপভোগ করতে করতে বাড়ি ফেরার পথটা ধরে একলা হাঁটছিলো। সে বাড়ি ফেরার ঐ পথটুকুতে কারো সঙ্গ নেওয়া মোটেই পছন্দ করে না, তাই রোজকার মতো আজও সে আনমনে একলা হাঁটছিলো। হঠাৎ রুপমের মনে হলো, গা ঘেঁষে ঘেঁষে তার ডানপাশে কেউ যেনো হাঁটছে। ঠিক পরক্ষনেই খুব আলতো সুরে আদরী কন্ঠে সে একটি ডাক শুনতে পেলো, "রৌম !!!"
রুপমের শিরদাঁড়া বেয়ে যেনো অগ্নি কম্পন বয়ে গিয়েছিল। কেনো যেনো তাঁর মনে ধরলো,হাজার বছর আগে কেউ একজন তাকে এই নামে ডাকতো। সে সম্পূর্ণ মনে করতে না পারলেও নামটির সাথে যেনো তার অনেকদিনের পরিচয় ছিলো।
ডাক শুনতে পেয়ে তবুও সে হেঁটেই চলছিল, কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। কিন্তু এবার সে আধখোলা চোখে সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে ঝাপসা দেখতে পায়, ঝড়ো বাতাসে একটি শাড়ীর আঁচল উড়ছে তাঁর ডান পাশে।
নীল শাড়ি পরা কেউ!!
সে অতিভিষম ঘাবড়ে গিয়ে ডানে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেলো, নীল শাড়ি পরনে এক চাঁদনী রূপবতী হরিণীর ন্যায় টানা টানা চোখ নিয়ে তার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
আর রুপম জিজ্ঞাসু চোখে রূপবতীকে বলে বসলো "কেমন আছো?"
কিন্তু অপরিচিত কারো সঙ্গে তার এমনতরো হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। কারণ রুপম তার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। রুপম নিজেও ঐ রূপবতীটিকে চিনতে পারে নি। কিন্তু সে যখন ঘাবড়ে গিয়ে ঐ রূপবতীর দিকে ঘুরে তাকিয়েছিল তখন তাঁর ঐ টানা টানা চোখদুটোর ভেতরে রুপম ক্ষণিকের জন্য যেনো তাঁর হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর এক রঙিন মানচিত্র দেখতে পেয়ে যায়। তাঁর অনুভূত হচ্ছিলো, সমস্ত শরীর হতে যেনো সে তাঁর নিজের করায়ত্ত ভুলে যাচ্ছে। তাই সে অজান্তেই ঐ রূপবতীকে প্রশ্ন করে বসে, "কেমন আছো?"
রুপমের প্রশ্নটি শুনে রূপবতীর মুখে এক অনন্য ধাঁচের মুচকি হাসি ফুটে উঠে যেনো অঘণের পূর্ণিমার চাঁদ তার রূপের তীব্রতায় দ্বি-খণ্ড হয়ে গিয়েছে! রূপবতীর অধরবিম্বকজুড়ে এমন তেজস্বী হাসি দেখতে পেয়ে রুপম নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছিল। অতঃপর সে তাঁর এতদিন ধরে জমতে থাকা বুকচাপানো অজস্র, অগণনীয়, পাহাড় সমপরিমাণ না বলা কথাগুলো বিড়বিড় করে অনর্গল বলতে শুরু করলো ঐ রূপবতীকে। এভাবে সারাটা পথ রুপম ঐ রূপবতীর চোখের দিকে চেয়ে থেকে বিরামহীনভাবে একের পর এক না বলা কথার বন্যা বইয়ে দিয়েছিল সেদিন।
কিন্তু বিস্ময়ের বিষয় এই যে, সারাটা পথ সে একলাই কথা বলেছে, ঐ রূপবতী কোনো কথাই বলেনি শুধু রুপমের প্রত্যেক কথার শেষে কথার বিষয়বস্তু অনুযায়ী প্রয়োজনমাফিক মুচকি হাসি টেনেছে এবং যখনই রুপম তার বাড়ির কাছাকাছি আসতে শুরু করলো ধীরে ধীরে বুঝতে লাগলো তার ডানপাশে এখন আর কেউ নেই। যেহেতু রুপম সেই থেকেই অনেক আনমনা স্বভাবের ছিলো তাই অতো কিছু মাথায় না ঢুকিয়ে সোজা বাড়ি চলে গেলো।
ঠিক এইভাবে রোজ শুক্রবার ক্যাফে থেকে বাড়ি ফেরার পথে ঘড়ির কাঁটা যখন সন্ধ্যা ৬:০০টা ছুঁই ছুঁই, তখনই রুপম তার ডানপাশে সেই রূপবতীকে দেখতে পেতো। তারপর সারাটা পথ একলাই ঐ রূপবতীর সঙ্গে বিড়বিড় করতে করতে বাড়ি ফিরতো। এসব কর্মকাণ্ড তার সাপ্তাহিক জীবনের অতি আবশ্যিক কাজ হয়ে গিয়েছিল। ঝড়,বৃষ্টি,রোদ, দুর্যোগ যাই থাকুক না কেনো রুপম এবং ঐ রূপবতীর দেখা হওয়া আটকানোর সামর্থ্য কারুরই ছিলো না। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো, রুপম যখনই ঐ রূপবতীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে বাড়ি ফিরতো রাস্তার আশেপাশের মানুষ তখন কেমন যেনো অাশ্চর্যিত জিজ্ঞাসু চোখে তাঁর দিকে চেয়ে থাকতো আর রুপমও কখনো ঐ রূপবতীর কাছ থেকে তাঁর কোনো কথার বা কোনো প্রশ্নের জবাব প্রত্যাশা করেনি বরং রূপবতীটির বাকরুদ্ধ স্বভাবই তার বেশি ভালো লাগতো। তবে এমনও নয় যে, ঐ রূপবতী একেবারেই নিশ্চুপ থাকতো, কথা বলতে বলতে রুপম যখন হঠাৎ চুপ করে যেতো তখন সে রুপমকে "রৌম" বলে ডাক দিয়ে সাড়া জাগিয়ে দিতো। এইভাবে দিন কাটতে কাটতে রুপম একসময় সপ্তাহের প্রতি শুক্রবারে ঐ রূপবতীর শাড়ীর সঙ্গে মিল রেখে নীল পাঞ্জাবি পড়া শুরু করে দিয়েছিলো আর রোজ ক্যাফেতে বসে নব্য নতুন কবিতা লিখতো আর সন্ধ্যে নামার পর ফেরার পথে রূপবতীকে শোনাতো।
•| ১৩ ফাল্গুন ( প্রায় চার বছর পর) |
আজ শুক্রবার, রুপমের জন্মদিন। ভোরে ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই পরিবারের সকলের কাছ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা গ্রহণ করে। তাঁর ছোটো বোন তাকে একটি বই উপহার দিয়েছিল। বইটির নাম হলো "মৃত্যু চিরসত্য হলেও প্রেম কিন্তু অবিনশ্বর"।
তারপর বাদবাকি সব কাজকর্ম সম্পাদন করে মাঝদুপুর ৩ টার দিকে একটি নতুন নীল পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে নোটপ্যাড, ফোনসহ প্রয়োজনীয় সব সামগ্রী একটি পুরনো চকচকে চামড়ার ছোটো ব্যাগে পুরে ব্যাগটি তার বাম কাঁধ থেকে ডান পাশে কোমর পর্যন্ত ঝুলিয়ে দিয়ে ক্যাফের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। আজকের দিনটি তার কাছে খুব উৎফুল্লময়। তাই সারাটা বিকেলজুড়ে সে একনাগাড়ে ১৩টি কবিতা লিখে ফেললো তার জন্মদিনের তারিখের সাথে মিল রেখে। আর প্রত্যেকটি কবিতাই ছিলো ঐ রূপবতীকে নিয়ে।
রুপম গোপনে ভেবে রাখলো ঐ রূপবতীকে এই ১৩টি কবিতা উৎসর্গ করে আজকের দিনটি চিরস্মরণীয় করে রাখবে।
গোধুলীর আকাশ বেয়ে সন্ধ্যা নামার বন্দোবস্ত হতে শুরু করলে রুপম আর দেরি না করে ক্যাফে থেকে বেরিয়ে বাড়ির পথে এগোতে থাকে। আজ সারাদিন শহরের আকাশজুড়ে তুলোর মতো ধপধপে ঘন সাদা মেঘেদের আনাগোনা ছিল। রুপম ক্যাফে থেকে বের হওয়া মাত্রই চারপাশে হঠাৎ ছিরিছিরি বৃষ্টি শুরু হলো। তার আরো আনন্দ অনুভূত হতে লাগলো। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পর রুপম হাতঘড়ি দেখে স্তম্ভিত হয়ে যায়। ঘড়িতে বাজছে ৬টা১৫ মিনিট। কিন্তু এখনও সেই রূপবতীর কোনো দেখা নেই। রুপম একধরনের অসহনীয় অস্বস্তিবোধ করতে লাগলো। বৃষ্টিভেজা অবস্থায়ই যেনো সে ঘামছে। তবুও রুপম ধৈর্য ধরে ঐ একলা পথটাতে রাত ৮:০০টা পর্যন্ত অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকলো। কিন্তু ঐ রূপবতীর কোনো দেখা আজ সে পায়নি।
রুপম ভীষণ বিমর্ষ হয়ে বিষন্নচিত্তে বাড়িতে তার মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। তাঁর মা তাঁর মাথায় আলতো স্পর্শে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। ঐ মুহূর্তে হঠাৎ রুপম তার মায়ের মুখে একটি হতাশাজনক কথা শুনতে পেলো। রুপম বুঝতে না পেরে পুণরায় জিজ্ঞেস করলে তার মা বললেন,
"সেদিন যদি তোরা দুজন ওভাবে ঘুরতে না বেরিয়ে বরং বাড়িতেই থাকতি তাহলে অন্তত আজ এমন দিন দেখতে হতো না!"
রূপম আবার জিজ্ঞেস করে, "কাদের কথা বলছো মা?"
"তোদের কথাই বলছি। তুই আর নীলা। নীলা যদি আজ বেঁচে থাকতো তাহলে তোকে বড্ড ভালোবাসতো জানিস!"
মায়ের কথা শুনার পর রুপম হকচকিয়ে উঠে বসে পড়ে। তৎক্ষণাৎ তাঁর মাথার ভেতর এক অস্বাভাবিক যন্ত্রণা অনুভূত হতে শুরু করে এবং সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে গিয়ে সে তার ঘরের দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে। তার চোখদুটো অনেকটা জোর করেই বন্ধ হয়ে আসছিল। চোখ বন্ধ করতেই তার পরিষ্কার মনে পড়ে যায়,
"সেদিন শুক্রবার সন্ধ্যা ছ'টার সময় সে আর নীলা একসঙ্গে বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে সড়ক পার হচ্ছিলো। হঠাৎ পেছন থেকে নীলার "রৌম" বলে জোরালো চিৎকার শুনতে পেয়ে রুপম যখন পেছনে ঘুরে তাকায় দেখতে পায় নীলার শরীর আস্ত একটি ট্রাকের চাকার নিচে পড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে এবং পরক্ষনেই সে একটি প্রকান্ড বাসের ধাক্কায় দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে"।
এরপরে রুপমের জীবনে আরো শয়ে শয়ে শুক্রবার এলেও ওই নীল শাড়ী পরিহিত রূপবতীর দেখা আর কখনো সে পায়নি। তবে প্রত্যেক শুক্রবার রুপম নিয়ম করে ক্যাফে ঐন্দ্রিলায় বিকেল যাপন করতে কখনো ভুলে না।
সেই রূপবতীকে নিয়ে লেখা ১৩টি কবিতার মধ্যে শেষ কবিতাটির নাম ছিলো "অন্তর্মিলহীন আকাশ তুমি" ...
থমকে ক্ষয়ে যাচ্ছি শতাব্দীর নাট্যমঞ্চ পেছনে ফেলে
সামনে চন্দ্রস্থ রোদে আলোকিত
নির্জনতায় কণ্টকাকীর্ণ খোলা
নিরন্তর পথ; অথচ সেথায়
কোথাও, এই নির্লিপ্ত পা দুটো ঠেসবার জায়গা নেই।
কখনো কখনো ঘাসের ডগায় ছোট্ট শীতবিন্দু হয়ে
ঘুমন্ত বাঁদুরের মতো কিম্ভূত
আটকে থাকি নিগূঢ়তম নীলে।
যাতে আর পাঁচ সাতটে বিষাক্ত
চোখের দংশনে বারবার অন্ধ না হই; না পারিনা !
অথবা একাকী শ্রাবণের অবসন্নতা আঙুলে তুলে
জীবন্মৃত এই নগ্ন হাত দুটো
গ্রাম্য বাউলের মতো অনেকটা
অনুভূমিক চিরস্থায়ী উদ্যত,
আমি নিবৃত্তে নিভে যাচ্ছি, লীন হচ্ছি আসমানি বুলেটে।
জানো?
এথায় অগুন্তি শূন্যতামুখী উঁচু নিচু বাক্সের গর্ভে
স্যাঁতসেঁতে আলোকরেখা ডিঙিয়ে একটা ক্যাকটাসের
অলীক অনড় দৃঢ় চোখে; আমি প্রায়ই তোমাকে ছুঁই ।
কখনোসখনো আষাঢ়ী আকাশের আসন্ন
মেঘের ন্যায়; তোমার আড়ষ্ট চুল আমার চিলতে জানালা
হাঁকিয়ে ক্রমশ ঝড় তোলে।আবার হঠাৎ কখনো
নির্বাক ঐ পৌরাণিক দুপুরের বৈরাগী উষ্ণতায়
এখানকার অন্তঃসারশূন্য নির্লিপ্ততার
গুপ্তঘাতি আগুনের চর্বনে ভাঙতে ভাঙতে
তোমার ন্যুব্জ নীলাভ দেহের নগ্নতা পাকড়ে
টুকরো ছাইয়ের মতো অধীর বেঁচে রই।
জানো? নিথর মর্গ থেকে শুরু করে ফাঁসির মঞ্চ অবধি
ল্যাম্পপোস্টের ধূসরতা কিংবা বলয়বেষ্টিত শনি
এথা কোথাও কিছু নাই; তবুও তোমারে খুঁজি।
কলম বল্লম সদা তোমাতেই জড়িয়ে রাখি
যাতে মৃত বৃক্ষের মতো জীবন্ত হয়ে না উঠি !
ওরাও কথা বলে, তুমি জানো আর আমি জানি।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
নহাজা য়াজিনা ১৬/০৮/২০২১সুন্দর!
-
ফয়জুল মহী ০৩/০৮/২০২১Excellent
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ০২/০৮/২০২১গল্প।