গল্প
""সীমান্তের ওপারে""
.
লিখাঃসাদ্দাম হোসেন
.
সকাল বেলা।
সুর্য উঠবে উঠবে। তার আগেই জেগে উঠলেন
হেকিমুদ্দীনের স্ত্রী। পাশের ঘরের
চাটইয়ে মোড়ানো বেড়াটা খুলে পড়ছে দেখেই
ছ্যাঁত করে উঠল বুকটা।
মন বলছে, কোন সর্বনাশ ঘটেছেই।তারপর হাউমাউ
করে কান্না শুরু। বিরক্ত হয়ে জেগে উঠলো সবাই।
কেমন অদ্ভুদ কাকা করছে কেন সকালবেলা?
সকালের কাকডাকা কাকা শব্দটাও তার
চেয়ে মধুর।
ছয় বছরের ছোট্ট ছেলেটা চোখ
কচলাতে কচলাতে বলে, কি হইছে মা?
"শিয়ালে আমার সর্বনাশ কইরালচ্চে" জবাব দেয়
হেকিমুদ্দীনের স্ত্রী। জবাব নয়, রীতিমত
আহাজারি।
একটুকরো খন্ড দ্বিপের মত উচু জায়গায়
হেকিমুদ্দীনের বাড়ি। চারপাশ নিচু জমি।
তারপাশে দু একটা বাশের ঝাড়, ঘন জঙ্গল।
দিনের বেলায় শিয়াল ডাকে।
হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া ধ্বনিতে মাতামাতি করে শিয়ালগুলো।
যেন, এটা শিয়ালের রাজ্য, হেকিমুদ্দীন আর
তার পরিবারের বাকি পাঁচ জন মনুষ এদের
রাজ্যে অদ্ভুদ প্রানী। কিছু কিছু শিয়াল কখনও
কখনও, ড্যাবড্যাব
করে তাকিয়ে থাকে হেকিমুদ্দীনের দিকে।
কখনও দুপুরে, কখনও রাতে। রাতের বেলায়
শিয়ালগুলির চোখ জ্বলজ্বল করে। দুর
থেকে বোঝা যায়। দুনিয়ার
মধ্যে সবচাইতে বিরক্তিকর প্রানী হল শিয়াল,
হেকিমুদ্দীনের বাড়ির লোকজনের ধারনা।
হেটে চলছেন দুইজন, হেকিমুদ্দীন আর কাশেম
মিয়া। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে রাস্তা। আগে ছিল
না। কাশেম মিয়ারা যখন এখানে আসে তখন
জঙ্গল কেটে রাস্তা বাসায় ওরা।
দৌড়ে আসা একটা পাঁতিশিয়াল হঠাৎ
থমকে যায়। কাশেম মিয়া কে দেখে মিটমিট
করে। অবাক হয়ে যায় শিয়ালটা। শিয়ালের
রাজ্যে দুপায়ের মানুষ
দেখে চমকে উঠে প্রকম্পিত পাঁতিশিয়াল। একটু
ভয় দেখালে লেজ গুটিয়ে পিছনের দিকে ভোঁ-
দৌড় দেয়।
কাশেম মিয়া মতবাদ দেয়,
পাঁতিশিয়ালগুলি সত্যিই ভীতু। অন্যান্য
শিয়ালের চেয়ে আলাদা।
-হ, সম্মতি জানায় হেকিমুদ্দীন।
-জানেন কাশেম বাই, আমগোর ছাগলের
বাচ্চাটারে শেয়ালে টাইন্যা নিছে গা।
আবেগজড়ানো কন্ঠে বিড়বিড় করে আরও
জানি কি বলছে হেকিমুদ্দীন।
বোঝা যাচ্ছে না। কষ্টের সময় গলাদিয়ে স্পষ্ট
করে কথা বলা অনেকটাই কষ্ট।
-কুন সময়? প্রশ্ন করে মুখ তুলে তাকায় কাশেম।
-রাইতের বেলায়।
-আল্লার মাল আল্লা নিছেগা,
চিন্তা কইরো না মিয়া,
কপালটা তো নিতে পারবো না।
হিছাবে ফিসালিল্লাহ্। ছাইড়া দেও। একটু
বোঝাবার চেষ্টা করে কাশেম। তার
বিপদে হেকিমুদ্দীনের কাছ থেকেও এমন
জ্ঞাণ-গর্ভ বক্তব্য শোনা যায়। জ্ঞানী লোকও
বিপদে পড়লে, অন্যরাই সাহস দেয়, পরামর্শ দেয়।
এটাই নিয়ম। বিশেষ
করে ডাংগাপাড়া গ্রামের।
সীমান্তবর্তী একটা গ্রাম। বছর ত্রিশেক আগেও
পুরো গ্রামটাই জঙ্গল ছিলো। বড়বড় ছাতিম
গাছের রাজত্বে বাস করতো শতশত প্রজাতির
গাছপালা। পেচা-ছুচা জাতীয় বিনিদ্র রাত
জাগা পাখিদের মোটামুটি স্বাধীন রাজ্য।
শিয়াল বনবেড়াল রকমের প্রাণিরাও দিনের
বেলায় নিশ্চিন্তে ঘুড়তো। রাত তো দুরের
কথা দিনের বেলায়ও একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ
এই জঙ্গলে ঢুকবে না, বিষয়টা শিয়াল,
বনবিড়ালরাও জানতো।
বাশের ঝাড়ে আবৃত একটা জঙ্গলে মানুষ বাস
করার যখন চিন্তা করলো, তখন দুঃচিন্তায় অস্থির
পাশের গ্রামের লোকজন।
জানা গেল, ময়মনসিংহ ও জামালপুরের কিছু
লোকজন স্বাধীনতার পর এখানে আসতে চাচ্ছে।
বাড়ি করবে। ঘড় বানাবে।
প্রশ্ন তুললেন গ্রামের মোড়ল। "ময়মনসিংহের
মাইনষি গুলা ভালো নোয়ায়, আসির চায়
ক্যানে, আজাকারও হবার পায়!!"
সবার মনে প্রশ্ন জাগে। অজানা মানুষদের
নিয়ে যে কোন শংকা করা স্বাভাবিক। কেউ
জানে না, ওরা কেমন, আর স্বাধীনতার পরপরেই
কেন আসতে চাচ্ছে ওরা।
রাজাকার নয়তো?
তাহলে কেন ওখানে ওদের থাকতে দিচ্ছে না?
ওরা কি ইচ্ছা করেই আসছে? ইচ্ছা করে কেউ
কি জন্মস্থান ছাড়ে?
আর মুল সমস্যাটা হল ভাষা। এখাকার মানুষজন
রংপুরিয়া ভাষায় কথা বলে। আর ওরা অন্য
ভাষায়। ভাইকে বাই বলে, ভাতকে বাত বলে,
পানি কে ফানি বলে, আবার জামালপুরের
লোকজন বলে 'হানি'।
এদের সাথে মিলবে না, স্রেফ জানিয়ে দেয়
মোড়ল সাহেব।
যেমনই হোক, ওরা আসলে, পাশের জঙ্গলটা আর
জঙ্গল থাকবে না। বিশাল বড় গ্রাম হবে। আর নতুন
লোকজনদের যেকোন কাজে ইচ্ছামত
লাগাতে পারবে।
শুনেছি ওরা নাকি ভালো পরিশ্রমী।
মেহমানদারি ও ভালো। গত
মাসে ওখানে গিয়েছিলাম। আসলে ভালো বই
মন্দ হবে না। মোড়লকে বুঝিয়ে বলে মতিন
হাজী।
তারপর কাশেম আর হেকিমুদ্দীনের বাপ-
দাদারা এই গ্রামে। সাথে আরও অনেকেই
এসেছিলো। কেউ কেউ পালিয়ে গেছে। জঙ্গল
কেটে গ্রাম বানানের চেয়ে পালানোই উত্তম।
জীব-জন্তুর খাদ্য হওয়ার
চেয়ে না খেয়ে মরা ভালো। আর অনেকেরই
যাওয়া হয় নি।
তারপর জঙ্গলটা গ্রাম হলো। দু'একটা বাশেরঝাড়
আছে, এগুলি সাফ করা হয় নি। গ্রামের
লোকজনের কাজে লাগতো একসময়। এখন দখল
হয়ে গেছে।
এই গল্পগুলিই করতে থাকে কাশেম আর রহিম
মিয়া। জানা গল্প। তবুও বার বার
শুনতে ভালো লাগে। বলতেও গর্ব হয়। সাহসী গল্প,
জঙ্গল কেটে গ্রাম বানানের গল্প। বাপ-
দাদারা একটু বেশিই গর্ববোধ করতো গল্প বলার
সময়।
গল্প করতে করতে একটা বড় রাস্তায় এসেছে ওরা।
সেই সময় সবাই মিলে জঙ্গলের ভিতরে এই
রাস্তাটা বানিয়েছিল। তারপর এটাই গ্রামের
প্রধান রাস্তা।
আজ বেশি দুশ্চিন্তায় পড়েছে কাশেম। মোড়লের
ছেলে যে কি করতে বলবে কে জানে!! আবার
হেকিমুদ্দীনের ছাগলের বাচ্চাটাও গেছে।
তার চেয়ে হেকিমুদ্দীনের বউটার
কান্না সামলানো কঠিন। বড় আবেগি মহিলা।
এমন ভাবে কাদে যেন, শিয়াল মহিলাকেই
ধরে খাচ্ছে, ছাগলের বাচ্চাকে না।
ধীরে ধীরে হাটছে কাশেম মিয়া।
যাই বলুক না কেন, কাশেম আর
হেকিমুদ্দীনকে শুনতে হবে। মানতেও হবে। একসময়
মোড়লের কথা শুনতে হতো বাপ-দাদাদের। আর
এখন মোড়ল মারা যাবার পর মোড়ল-পুত্রের
কথা শুনতে হয়। কাশেম মিয়াদের করার কিছু
থাকে না। অবশ্য তেমন কিছু না, ব্যাবসার
কাজে যখন যা দরকার তা করতে ডাক পড়ে। আর
তখন ভালো টাকা পয়সাও দেয় মোড়ল-পুত্র।
হেসে হেসে কথাও বলে। জঙ্গল-
কাটা মাটিতে আগে কোন চাষাবাদ হতো না।
এখন হয়, তাই হেকিমুদ্দীন আর মোড়ল-পুত্রের
ব্যাবসার সাথে থাকতে চায় না। কিন্তু, কাশেম
বোঝে, ওদের সাথে পারা যাবে না।
হেকিমুদ্দীন জেদ করে, ও আর মোড়ল-পুত্রের
সাথে নাই। জীবনের ঝুকি নিয়ে ও ব্যাবসায়
যাবে না।
কিন্তু, এই বছর কেমন করে চলবে! ফসলও নষ্ট
হয়ে গেছে। পরিবারের সবাই খাবে কি?
পরবে কি? বৃদ্ধা মায়ের কোন অসুখ হলে? শত
চিন্তা করে মোড়ল-পুত্রের বাড়িতে গেল
হেকিমুদ্দীন। মরার ভয়ে যেতে না চাইলেও,
বেচে থাকার তাগিদে ওকে যেতে হয়।
মোড়ল বাড়ির অন্দর মহলে সিদ্ধান্ত হল, কাশেম
মিয়া আর হেকিমুদ্দীন দুজন যাবে মাল আনতে।
দু'জনের মধ্যে বোঝাপড়াটাও দারুন। একজনের
চোখের ইশারাটাও আরেকজন বুঝতে পারে।
এবারের কাজে বেশ লাভ হবে। অনেক
বেশি মজুরি দেবার আশ্বাসও দিলেন মোড়ল-
পুত্র। ওদের অল্প একটু কাজ, মাত্র কয়েক ঘন্টার। শুধু
কাঁটাতারের বেড়া পার হবে আর মাল
নিয়ে চলে আসবে। কিন্তু, সাবধানে! সতর্ক
করে মোড়ল-পুত্র।
ওইদিনই, গভীর রাত। চারদিক শুনশান নীরবতা।
দু'চারটে শিয়াল ডাকছে।
কয়েকটা পাঁতিশিয়াল দৌড়াদৌড়ি করছে।
জোনাকি পোকায় ভরে আছে পুরো জঙ্গলটা।
রাস্তার পাশটাও। ভীষন
ভালো লাগছে কাশেমের।
-কি সুন্দর জোনাহি পুকাগুলা না! হঠাৎ
বলে উঠে কাশেম মিয়া।
-জীবনে কি জুনাক দেহ নাই মিয়া,
কাজে আইছো প্যাচাল পারবা না। সতর্ক
করে হেকিমুদ্দীন। একটু সতর্ক হওয়া উচিত,
কাজটা সহজ কিন্তু, জীবনের ঝুকিও আছে।
দুইজন হাটছে সীমান্তের অভিমুখে। ভারতের
কাঁটাতারের
ওপাশে দুইটা বস্তা থাকবে একটা বট গাছের
নীচে। বট গাছটা হেকিমুদ্দীনের
বাড়ি থেকেও দেখা যায়। অনেক দিনের
গাছটা।
বাপ-দাদারাও বড় বটগাছটার কথা বলতো। এই
গাছ হল নিশানা।
যারা ব্যাবসা করে তারা কাঁটাতারের
বেড়ার ওপাশে ভারতের এই
গাছটাকে ভালো করেই চিনতো। ভারতের
ব্যাবসায়ীরা ওখানে মালপত্র রাখতো, আর খবর
দিতো বাংলাদেশি ব্যাবসায়ীদের। রাতের
কোন এক প্রহরে ওগুলো নিয়ে আসা হত। কোন
দেশের সরকারকে ট্যাক্স দিতে হয়
না বলে ব্যাবসাটা লাভজনক। কাশেমের বাপ-
দাদারা যখন মোড়লবাড়ির কাজ করতো, তখন
একদিনে দু'টি বস্তা এনেছিল কাশেমের বাপ।
সেই বস্তায় কি ছিল কেউ জানতো না।
কাশেমের বাপও না। যারা রেখেছিল
তারা জানতো আর মোড়ল জানতো। অনেক
টাকাও পেয়েছিল মজুরি হিসাবে। তারপর
থেকে মোড়ল রাতারাতি বড় লোক। দালান
দিয়েছিল বাড়িতে। অবাক করা কান্ড!
বাবা মারা যাবার সময় কাশেমকে নিষেধ
করেছিল পাচার ব্যাবসা করতে। কিন্তু,
পরিস্থিতি কখনও কখনও এমন যে বাবার কথাও
রাখা যায় না। তাই বলে কাশেম মিয়া বাবার
অবাধ্য সন্তান নয়। কাশেম এখন বাবা হয়েছে,
মোটামুটিভাবে বয়সী লোক বলা যায়। কিন্তু
বাবার জন্য মাঝেমাঝেই চোখদিয়ে টুপ
করে পানি পড়ে যায়। বাবা হলেও
কি বাবাকে ভোলা যায়!
ভাবতে থাকে কাশেম মিয়া।
হঠাৎ কাশেমের ডান হাত খপ
করে ধরে থামিয়ে দেয় হেকিমুদ্দীন।
কাঁটাতারের বেড়ার পাশে একটা মানুষ,
অন্ধকার হলেও বোঝা যাচ্ছে। সম্ভবত বিএসএফ।
কিছুক্ষণ অপলক
তাকিয়ে থেকে ভালো করে দেখলো ওরা।
হাতে যে বন্দুক আছে সেটা নিশ্চিত হল কাশেম।
এই সময় বেড়া পার হওয়ার চেষ্টাই
করা যাবে না। দেখতে হবে কখন বিএসএফ
সরে যায়। তারপর ঢুকতে হবে। ভারতীয়
বিএসএফরা হারামি হয়ে গেছে। আগে পাচার
দেখলে তেমন কিছু করতো না, এখন
গুলি করে দেয়। যায় দিন ভালো, আসে দিন
খারাপ। এইতো গত বছরেই একটা বিধবার
ছেলেকে গুলি করেছিল বিএসএফ। মরে গেছে,
লাশটা ধরে বিধবাটার কি কান্না! এখন খুবই
দুর্দশা বিধবাটার।
কাশেম কিংবা হেকিমুদ্দীন
মরে গেলে সংসারের কি হবে! বউটা বড়
সাদাসিধা, সংসার চালানোর মত না।
ভাবতে ভাবতে বিসএফের গতিবিধি দেখছিল
কাশেম। কাঁটাতারের ওপাশের
জায়গাটা অন্যরকম, দেখলেই বোঝা যায়
বাংলাদেশ না। পাঁকা রাস্তা আছে,
বাংকার আছে, টাওয়ার আছে। সারা দিন-রাত
বিএসএফ টহল দেয়। বন্দুক কাধে আর
একটা বাইসাকেল নিয়ে সারা রাস্তা টহল দেয়
ওরা। হেকিমুদ্দীনের বড়িটা কাঁটাতারের খুব
কাছে বলেই ও সবই দেখে, জানে।
একেবারে মুখস্ত।
হঠাৎ বিএসএফটা হেটে হেটে টাওয়ারের
দিকে চলে যায়। স্পষ্ট দেখতে পায় কাশেম। এই
সুযোগে ভারতে ঢোকা উচিত। সুযোগ সব সময়,
সবার ভাগ্যে আসে না।
অগ্রসর হয় দু'জন।
কাঁটাতারের বেড়ার একেবারে কাছাকাছি।
ওরা একটা ছোট্ট কালভার্টের
ভিতরে ঢুকে গেল।
কালভার্টটা উত্তর-দক্ষিণ বরাবর। ভারতের
পানি বের হবার জন্যই এই কালভার্ট। এর
উপরে কাঁটাতারের বেড়া, পাকা রাস্তা।
অনেক লম্বা কালভার্ট, সোজা মাটির নিচ
দিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত। বর্ষাকাল বাদে সবসময় এই
কালভার্টের ভিতর দিয়েই পার হওয়া সহজ।
বর্ষার সময় পানি থাকে, পানির স্রোতও
মারাত্মক।
স্তব্ধ চারদিকের এই শান্ত রাতে হঠাৎ
একটা শিয়াল চেঁচিয়ে উঠলো।
শিয়ালটা কালভার্টের ভিতরেই ছিল। মানুষ
দেখে আঁতকে উঠল ওটা।
সোজা ভো দৌড়ে কালভার্ট
থেকে বেরিয়ে গেল। যাবার পর
চেঁচামেচি টা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে।
আরও অনেক শিয়াল একত্র হয়ে কালভার্টের
মুখে চেঁচামেচি করছে। ভয় পাচ্ছে হেকিমুদ্দীন।
শিয়ালের
চেঁচামেচিতে যদি বিএসএফরা সন্দেহ করে?
যদি কালভার্টের ভিতরে লাইট
মেরে ভিতরটা পরীক্ষা করে?
কাঁপতে থাকে হেকিমুদ্দীন। কিছুক্ষণ কাশেম
সিদ্ধান্ত নেয় মাথা বের
করে পরিবেশটা দেখবে ও। বিএসএফ
আশেপাশে না থাকলে বের হবে তারা।
সোজা বটতলায় যাবে আর বস্তাদুটি নিয়ে ফুট্টুস
দিবে।
মাথা তুলে এদিক ওদিক তাকায় কাশেম মিয়া।
আশেপাশে কেউ নেই। সব ঠান্ডা। টহল-
ফাড়িতেও কোন বিএসএফ নেই। শালার
পুতেরা ডিউটি না দিয়া কি করে, কই যায়!
ভারতের সরকারের টাকা খরচ করে কি লাভ হয়!
মনে মনে ধ্বিক্কার জানায় বিএসএফদের।
মিয়া বাই, অহন যাওন যাইবো, হেকিমুদ্দীন
কে ডাকে কাশেম মিয়া। হেকিমুদ্দীনও
সাড়া দেয় কোন শব্দ ছাড়াই,
বুঝতে পারে কাশেম মিয়া। দুজনের
বোঝাপড়াটা দারুন!
চারদিক আধার। রাত বাড়ছে।
শিয়ালগুলো অসম্ভবরকম চীৎকার করছে।
মাথাটা বের করলো কাশেম। সোজা উপর
থেকে খপ করে শার্টের কলার
চেপে ধরলো কেউ।
মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলো কয়েকটা বিএসএফ
বন্দুক তাক করে আছে ওর দিকে, একজন কলার
ধরে টেনে বাহির করার চেষ্টা করছে। অর্ধেক
শরীর কালভার্টের ভিতরে থাকা অবস্থায় সব
বুঝে গেল কাশেম মিয়া।
পিছনে লাথি মারে ও। লাথিটা কালভার্টের
ভিতরে থাকা হেকিমুদ্দীনের নাকে-
মুখে লাগে। লাথির অর্থটা বুঝতে বিন্দুমাত্র ভুল
করলো না হেকিমুদ্দীন। পরিস্থিতি টের
পেয়ে চুপটি করে কালভার্টের
ভিতরে বসে থাকলো ও। শালার শিয়াল
গুলা কপাল পুড়ছে আজ,
মনে মনে শিয়ালেকে গালিদিয়ে চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার
করে হেকিমুদ্দীন।
কাশেম মিয়াকে টেনে বের করলো ওরা।
গালি-গালাজের অঝোর ধারা বইছে,বিভিন্ন
ভাষায়। সব ভাষা বুঝতে পারে না কাশেম
মিয়া। মনে হয় একটা আসামের বিএসএফ ছিল,
বাংলা জানতো। ওর খাঁটি বাংলায়
পড়া গালিগুলো হজম করছে কাশেম মিয়া।
জিজ্ঞেস করা হল, কাশেম মিয়া একা কিনা?
ওর সাথে কে?
বাংলা জানা বিএসএফটা জিজ্ঞেস করলো।
স্যার, আমি একাই আইছি। কেউ নাই আমার
সাথে। ঐ বটগাছটার নিচে বস্তাটা নিবার
লাইগা আইছি।
মাফ কইরা দেন!! অকাতরে আকুতি করে কাশেম
মিয়া।
স্যার, একাই আইছি, এই মিথ্যাটা বলায় হাফ
ছেড়ে বাঁচে হেকিমুদ্দীন।কিন্তু,
মিথ্যাটা কেন বলছে কাশেম, কারনটা বুঝতে ভুল
হয় না ওর। ভিতর থেকে বোঝা যাচ্ছে, কাশেম
মিয়াকে চড়-থাপ্পড় দিচ্ছে ওরা।
পরিস্থিতি নিশ্চয়ই খারাপ।
ইচ্ছা হচ্ছে, ও নিজেই বের
হয়ে বিএসএফকে বুঝিয়ে বলবে, ওরা আসল কেউ
না। ওরা গরীব, নীরিহ। দুজনের বাড়িতেই
বৃদ্ধা মা আছে, পরিবার আছে, ফ্যালফ্যাল
করে তাকিয়ে থাকা একটা ছোট্ট ছেলে আছে।
আমাদের মাইরেন না। বাচ্চাগুলা পুষবে কে!
বৃদ্ধা মায়ের অসুখ হলে কে দেখবে! আমাদের
ছাইরা দেন, ভালো হইয়া যামু।
আপনারা আমাদের বাপ লাগেন, ছাইড়া দেন!
আল্লার দোহাই, মাফ কইরা দেন।
কিন্তু, বের হবার সাহস হল না হেকিমুদ্দীনের।
আল্লাহ্ কে ডাকতে থাকলো। বিপদের সময়
আল্লাহর নাম তারাতারি মুখে আসে। মনের
অজান্তেই।
তারপর।
ভোরে চুপচুপ করে বাড়ির
দিকে ফিরলো হেকিমুদ্দীন। সব নীরব, স্তব্ধ।
কোথাও কোন শিয়াল নেই। জোনাকির
আলো চোখেই পড়ছে না ওর। ও জঙ্গলের ভিতর
দিয়েই বাড়ির দিকে আসছে, কোথাও কোন
সাপ নেই, বিষাক্ত কোন প্রাণিই নেই। চোখের
সামনে ঝোপের মধ্যে একটা ছাগলের বাচ্চার
চামড়া পড়ে আছে। কোন একটা শিয়াল মনে হয়
কারও সর্বনাশ করেছে। চোখে পড়লেও গুরুত্ব
দিলো না হেকিমুদ্দীন।
হেটেই চলছে ও। কাশেম মিয়াটা বড় স্বার্থপর!
একাই চলে গেল, ডাকলোও না একবার।
মিথ্যাবাদী কাশেমের প্রতি অকারনেই
রেগে যাচ্ছে হেকিমুদ্দীন।
একাই হাটছে, কানে কিছুই শুনছে না ও। কিন্তু,
স্তব্ধ হয়ে হাটছে আর ভাবছে, কাশেম মিয়া এত
স্বার্থপর মিথ্যাবাদী হইল ক্যামনে! যাবার
বেলা ডাকলোও না!
পরদিন, বিকেলবেলা।
সুর্য টা ঢলে পড়ছে পশ্চিমে। দিন শেষ
হয়ে আসছে। বিজিবি-বিএসএফের মধ্যে বৈঠক
ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেল। বিষয় কাশেম মিয়া।
সাদাসিধা একটা মানুষকে নিয়ে দুদেশের
বড়সড় বৈঠক। হাসি-খুশি মনে বিএসএফরা বিদায়
নিলো, বাংলাদেশের পক্ষে বিজিবিও
হ্যান্ডশেক করলো। দুপক্ষই আশ্বাস দিলেন,
যা ঘটেছে তা আর ঘটতে দেয়া হবে না।
বৈঠকে কাশেম মিয়াও ছিল। অপরাধীটা কোন
কথা বলে নি। চুপচাপ করে সবার
মাঝে একটা কফিনে শুয়ে ছিল।
.
লিখাঃসাদ্দাম হোসেন
.
সকাল বেলা।
সুর্য উঠবে উঠবে। তার আগেই জেগে উঠলেন
হেকিমুদ্দীনের স্ত্রী। পাশের ঘরের
চাটইয়ে মোড়ানো বেড়াটা খুলে পড়ছে দেখেই
ছ্যাঁত করে উঠল বুকটা।
মন বলছে, কোন সর্বনাশ ঘটেছেই।তারপর হাউমাউ
করে কান্না শুরু। বিরক্ত হয়ে জেগে উঠলো সবাই।
কেমন অদ্ভুদ কাকা করছে কেন সকালবেলা?
সকালের কাকডাকা কাকা শব্দটাও তার
চেয়ে মধুর।
ছয় বছরের ছোট্ট ছেলেটা চোখ
কচলাতে কচলাতে বলে, কি হইছে মা?
"শিয়ালে আমার সর্বনাশ কইরালচ্চে" জবাব দেয়
হেকিমুদ্দীনের স্ত্রী। জবাব নয়, রীতিমত
আহাজারি।
একটুকরো খন্ড দ্বিপের মত উচু জায়গায়
হেকিমুদ্দীনের বাড়ি। চারপাশ নিচু জমি।
তারপাশে দু একটা বাশের ঝাড়, ঘন জঙ্গল।
দিনের বেলায় শিয়াল ডাকে।
হুক্কাহুয়া হুক্কাহুয়া ধ্বনিতে মাতামাতি করে শিয়ালগুলো।
যেন, এটা শিয়ালের রাজ্য, হেকিমুদ্দীন আর
তার পরিবারের বাকি পাঁচ জন মনুষ এদের
রাজ্যে অদ্ভুদ প্রানী। কিছু কিছু শিয়াল কখনও
কখনও, ড্যাবড্যাব
করে তাকিয়ে থাকে হেকিমুদ্দীনের দিকে।
কখনও দুপুরে, কখনও রাতে। রাতের বেলায়
শিয়ালগুলির চোখ জ্বলজ্বল করে। দুর
থেকে বোঝা যায়। দুনিয়ার
মধ্যে সবচাইতে বিরক্তিকর প্রানী হল শিয়াল,
হেকিমুদ্দীনের বাড়ির লোকজনের ধারনা।
হেটে চলছেন দুইজন, হেকিমুদ্দীন আর কাশেম
মিয়া। জঙ্গলের মাঝ দিয়ে রাস্তা। আগে ছিল
না। কাশেম মিয়ারা যখন এখানে আসে তখন
জঙ্গল কেটে রাস্তা বাসায় ওরা।
দৌড়ে আসা একটা পাঁতিশিয়াল হঠাৎ
থমকে যায়। কাশেম মিয়া কে দেখে মিটমিট
করে। অবাক হয়ে যায় শিয়ালটা। শিয়ালের
রাজ্যে দুপায়ের মানুষ
দেখে চমকে উঠে প্রকম্পিত পাঁতিশিয়াল। একটু
ভয় দেখালে লেজ গুটিয়ে পিছনের দিকে ভোঁ-
দৌড় দেয়।
কাশেম মিয়া মতবাদ দেয়,
পাঁতিশিয়ালগুলি সত্যিই ভীতু। অন্যান্য
শিয়ালের চেয়ে আলাদা।
-হ, সম্মতি জানায় হেকিমুদ্দীন।
-জানেন কাশেম বাই, আমগোর ছাগলের
বাচ্চাটারে শেয়ালে টাইন্যা নিছে গা।
আবেগজড়ানো কন্ঠে বিড়বিড় করে আরও
জানি কি বলছে হেকিমুদ্দীন।
বোঝা যাচ্ছে না। কষ্টের সময় গলাদিয়ে স্পষ্ট
করে কথা বলা অনেকটাই কষ্ট।
-কুন সময়? প্রশ্ন করে মুখ তুলে তাকায় কাশেম।
-রাইতের বেলায়।
-আল্লার মাল আল্লা নিছেগা,
চিন্তা কইরো না মিয়া,
কপালটা তো নিতে পারবো না।
হিছাবে ফিসালিল্লাহ্। ছাইড়া দেও। একটু
বোঝাবার চেষ্টা করে কাশেম। তার
বিপদে হেকিমুদ্দীনের কাছ থেকেও এমন
জ্ঞাণ-গর্ভ বক্তব্য শোনা যায়। জ্ঞানী লোকও
বিপদে পড়লে, অন্যরাই সাহস দেয়, পরামর্শ দেয়।
এটাই নিয়ম। বিশেষ
করে ডাংগাপাড়া গ্রামের।
সীমান্তবর্তী একটা গ্রাম। বছর ত্রিশেক আগেও
পুরো গ্রামটাই জঙ্গল ছিলো। বড়বড় ছাতিম
গাছের রাজত্বে বাস করতো শতশত প্রজাতির
গাছপালা। পেচা-ছুচা জাতীয় বিনিদ্র রাত
জাগা পাখিদের মোটামুটি স্বাধীন রাজ্য।
শিয়াল বনবেড়াল রকমের প্রাণিরাও দিনের
বেলায় নিশ্চিন্তে ঘুড়তো। রাত তো দুরের
কথা দিনের বেলায়ও একজন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ
এই জঙ্গলে ঢুকবে না, বিষয়টা শিয়াল,
বনবিড়ালরাও জানতো।
বাশের ঝাড়ে আবৃত একটা জঙ্গলে মানুষ বাস
করার যখন চিন্তা করলো, তখন দুঃচিন্তায় অস্থির
পাশের গ্রামের লোকজন।
জানা গেল, ময়মনসিংহ ও জামালপুরের কিছু
লোকজন স্বাধীনতার পর এখানে আসতে চাচ্ছে।
বাড়ি করবে। ঘড় বানাবে।
প্রশ্ন তুললেন গ্রামের মোড়ল। "ময়মনসিংহের
মাইনষি গুলা ভালো নোয়ায়, আসির চায়
ক্যানে, আজাকারও হবার পায়!!"
সবার মনে প্রশ্ন জাগে। অজানা মানুষদের
নিয়ে যে কোন শংকা করা স্বাভাবিক। কেউ
জানে না, ওরা কেমন, আর স্বাধীনতার পরপরেই
কেন আসতে চাচ্ছে ওরা।
রাজাকার নয়তো?
তাহলে কেন ওখানে ওদের থাকতে দিচ্ছে না?
ওরা কি ইচ্ছা করেই আসছে? ইচ্ছা করে কেউ
কি জন্মস্থান ছাড়ে?
আর মুল সমস্যাটা হল ভাষা। এখাকার মানুষজন
রংপুরিয়া ভাষায় কথা বলে। আর ওরা অন্য
ভাষায়। ভাইকে বাই বলে, ভাতকে বাত বলে,
পানি কে ফানি বলে, আবার জামালপুরের
লোকজন বলে 'হানি'।
এদের সাথে মিলবে না, স্রেফ জানিয়ে দেয়
মোড়ল সাহেব।
যেমনই হোক, ওরা আসলে, পাশের জঙ্গলটা আর
জঙ্গল থাকবে না। বিশাল বড় গ্রাম হবে। আর নতুন
লোকজনদের যেকোন কাজে ইচ্ছামত
লাগাতে পারবে।
শুনেছি ওরা নাকি ভালো পরিশ্রমী।
মেহমানদারি ও ভালো। গত
মাসে ওখানে গিয়েছিলাম। আসলে ভালো বই
মন্দ হবে না। মোড়লকে বুঝিয়ে বলে মতিন
হাজী।
তারপর কাশেম আর হেকিমুদ্দীনের বাপ-
দাদারা এই গ্রামে। সাথে আরও অনেকেই
এসেছিলো। কেউ কেউ পালিয়ে গেছে। জঙ্গল
কেটে গ্রাম বানানের চেয়ে পালানোই উত্তম।
জীব-জন্তুর খাদ্য হওয়ার
চেয়ে না খেয়ে মরা ভালো। আর অনেকেরই
যাওয়া হয় নি।
তারপর জঙ্গলটা গ্রাম হলো। দু'একটা বাশেরঝাড়
আছে, এগুলি সাফ করা হয় নি। গ্রামের
লোকজনের কাজে লাগতো একসময়। এখন দখল
হয়ে গেছে।
এই গল্পগুলিই করতে থাকে কাশেম আর রহিম
মিয়া। জানা গল্প। তবুও বার বার
শুনতে ভালো লাগে। বলতেও গর্ব হয়। সাহসী গল্প,
জঙ্গল কেটে গ্রাম বানানের গল্প। বাপ-
দাদারা একটু বেশিই গর্ববোধ করতো গল্প বলার
সময়।
গল্প করতে করতে একটা বড় রাস্তায় এসেছে ওরা।
সেই সময় সবাই মিলে জঙ্গলের ভিতরে এই
রাস্তাটা বানিয়েছিল। তারপর এটাই গ্রামের
প্রধান রাস্তা।
আজ বেশি দুশ্চিন্তায় পড়েছে কাশেম। মোড়লের
ছেলে যে কি করতে বলবে কে জানে!! আবার
হেকিমুদ্দীনের ছাগলের বাচ্চাটাও গেছে।
তার চেয়ে হেকিমুদ্দীনের বউটার
কান্না সামলানো কঠিন। বড় আবেগি মহিলা।
এমন ভাবে কাদে যেন, শিয়াল মহিলাকেই
ধরে খাচ্ছে, ছাগলের বাচ্চাকে না।
ধীরে ধীরে হাটছে কাশেম মিয়া।
যাই বলুক না কেন, কাশেম আর
হেকিমুদ্দীনকে শুনতে হবে। মানতেও হবে। একসময়
মোড়লের কথা শুনতে হতো বাপ-দাদাদের। আর
এখন মোড়ল মারা যাবার পর মোড়ল-পুত্রের
কথা শুনতে হয়। কাশেম মিয়াদের করার কিছু
থাকে না। অবশ্য তেমন কিছু না, ব্যাবসার
কাজে যখন যা দরকার তা করতে ডাক পড়ে। আর
তখন ভালো টাকা পয়সাও দেয় মোড়ল-পুত্র।
হেসে হেসে কথাও বলে। জঙ্গল-
কাটা মাটিতে আগে কোন চাষাবাদ হতো না।
এখন হয়, তাই হেকিমুদ্দীন আর মোড়ল-পুত্রের
ব্যাবসার সাথে থাকতে চায় না। কিন্তু, কাশেম
বোঝে, ওদের সাথে পারা যাবে না।
হেকিমুদ্দীন জেদ করে, ও আর মোড়ল-পুত্রের
সাথে নাই। জীবনের ঝুকি নিয়ে ও ব্যাবসায়
যাবে না।
কিন্তু, এই বছর কেমন করে চলবে! ফসলও নষ্ট
হয়ে গেছে। পরিবারের সবাই খাবে কি?
পরবে কি? বৃদ্ধা মায়ের কোন অসুখ হলে? শত
চিন্তা করে মোড়ল-পুত্রের বাড়িতে গেল
হেকিমুদ্দীন। মরার ভয়ে যেতে না চাইলেও,
বেচে থাকার তাগিদে ওকে যেতে হয়।
মোড়ল বাড়ির অন্দর মহলে সিদ্ধান্ত হল, কাশেম
মিয়া আর হেকিমুদ্দীন দুজন যাবে মাল আনতে।
দু'জনের মধ্যে বোঝাপড়াটাও দারুন। একজনের
চোখের ইশারাটাও আরেকজন বুঝতে পারে।
এবারের কাজে বেশ লাভ হবে। অনেক
বেশি মজুরি দেবার আশ্বাসও দিলেন মোড়ল-
পুত্র। ওদের অল্প একটু কাজ, মাত্র কয়েক ঘন্টার। শুধু
কাঁটাতারের বেড়া পার হবে আর মাল
নিয়ে চলে আসবে। কিন্তু, সাবধানে! সতর্ক
করে মোড়ল-পুত্র।
ওইদিনই, গভীর রাত। চারদিক শুনশান নীরবতা।
দু'চারটে শিয়াল ডাকছে।
কয়েকটা পাঁতিশিয়াল দৌড়াদৌড়ি করছে।
জোনাকি পোকায় ভরে আছে পুরো জঙ্গলটা।
রাস্তার পাশটাও। ভীষন
ভালো লাগছে কাশেমের।
-কি সুন্দর জোনাহি পুকাগুলা না! হঠাৎ
বলে উঠে কাশেম মিয়া।
-জীবনে কি জুনাক দেহ নাই মিয়া,
কাজে আইছো প্যাচাল পারবা না। সতর্ক
করে হেকিমুদ্দীন। একটু সতর্ক হওয়া উচিত,
কাজটা সহজ কিন্তু, জীবনের ঝুকিও আছে।
দুইজন হাটছে সীমান্তের অভিমুখে। ভারতের
কাঁটাতারের
ওপাশে দুইটা বস্তা থাকবে একটা বট গাছের
নীচে। বট গাছটা হেকিমুদ্দীনের
বাড়ি থেকেও দেখা যায়। অনেক দিনের
গাছটা।
বাপ-দাদারাও বড় বটগাছটার কথা বলতো। এই
গাছ হল নিশানা।
যারা ব্যাবসা করে তারা কাঁটাতারের
বেড়ার ওপাশে ভারতের এই
গাছটাকে ভালো করেই চিনতো। ভারতের
ব্যাবসায়ীরা ওখানে মালপত্র রাখতো, আর খবর
দিতো বাংলাদেশি ব্যাবসায়ীদের। রাতের
কোন এক প্রহরে ওগুলো নিয়ে আসা হত। কোন
দেশের সরকারকে ট্যাক্স দিতে হয়
না বলে ব্যাবসাটা লাভজনক। কাশেমের বাপ-
দাদারা যখন মোড়লবাড়ির কাজ করতো, তখন
একদিনে দু'টি বস্তা এনেছিল কাশেমের বাপ।
সেই বস্তায় কি ছিল কেউ জানতো না।
কাশেমের বাপও না। যারা রেখেছিল
তারা জানতো আর মোড়ল জানতো। অনেক
টাকাও পেয়েছিল মজুরি হিসাবে। তারপর
থেকে মোড়ল রাতারাতি বড় লোক। দালান
দিয়েছিল বাড়িতে। অবাক করা কান্ড!
বাবা মারা যাবার সময় কাশেমকে নিষেধ
করেছিল পাচার ব্যাবসা করতে। কিন্তু,
পরিস্থিতি কখনও কখনও এমন যে বাবার কথাও
রাখা যায় না। তাই বলে কাশেম মিয়া বাবার
অবাধ্য সন্তান নয়। কাশেম এখন বাবা হয়েছে,
মোটামুটিভাবে বয়সী লোক বলা যায়। কিন্তু
বাবার জন্য মাঝেমাঝেই চোখদিয়ে টুপ
করে পানি পড়ে যায়। বাবা হলেও
কি বাবাকে ভোলা যায়!
ভাবতে থাকে কাশেম মিয়া।
হঠাৎ কাশেমের ডান হাত খপ
করে ধরে থামিয়ে দেয় হেকিমুদ্দীন।
কাঁটাতারের বেড়ার পাশে একটা মানুষ,
অন্ধকার হলেও বোঝা যাচ্ছে। সম্ভবত বিএসএফ।
কিছুক্ষণ অপলক
তাকিয়ে থেকে ভালো করে দেখলো ওরা।
হাতে যে বন্দুক আছে সেটা নিশ্চিত হল কাশেম।
এই সময় বেড়া পার হওয়ার চেষ্টাই
করা যাবে না। দেখতে হবে কখন বিএসএফ
সরে যায়। তারপর ঢুকতে হবে। ভারতীয়
বিএসএফরা হারামি হয়ে গেছে। আগে পাচার
দেখলে তেমন কিছু করতো না, এখন
গুলি করে দেয়। যায় দিন ভালো, আসে দিন
খারাপ। এইতো গত বছরেই একটা বিধবার
ছেলেকে গুলি করেছিল বিএসএফ। মরে গেছে,
লাশটা ধরে বিধবাটার কি কান্না! এখন খুবই
দুর্দশা বিধবাটার।
কাশেম কিংবা হেকিমুদ্দীন
মরে গেলে সংসারের কি হবে! বউটা বড়
সাদাসিধা, সংসার চালানোর মত না।
ভাবতে ভাবতে বিসএফের গতিবিধি দেখছিল
কাশেম। কাঁটাতারের ওপাশের
জায়গাটা অন্যরকম, দেখলেই বোঝা যায়
বাংলাদেশ না। পাঁকা রাস্তা আছে,
বাংকার আছে, টাওয়ার আছে। সারা দিন-রাত
বিএসএফ টহল দেয়। বন্দুক কাধে আর
একটা বাইসাকেল নিয়ে সারা রাস্তা টহল দেয়
ওরা। হেকিমুদ্দীনের বড়িটা কাঁটাতারের খুব
কাছে বলেই ও সবই দেখে, জানে।
একেবারে মুখস্ত।
হঠাৎ বিএসএফটা হেটে হেটে টাওয়ারের
দিকে চলে যায়। স্পষ্ট দেখতে পায় কাশেম। এই
সুযোগে ভারতে ঢোকা উচিত। সুযোগ সব সময়,
সবার ভাগ্যে আসে না।
অগ্রসর হয় দু'জন।
কাঁটাতারের বেড়ার একেবারে কাছাকাছি।
ওরা একটা ছোট্ট কালভার্টের
ভিতরে ঢুকে গেল।
কালভার্টটা উত্তর-দক্ষিণ বরাবর। ভারতের
পানি বের হবার জন্যই এই কালভার্ট। এর
উপরে কাঁটাতারের বেড়া, পাকা রাস্তা।
অনেক লম্বা কালভার্ট, সোজা মাটির নিচ
দিয়ে অনেকদূর পর্যন্ত। বর্ষাকাল বাদে সবসময় এই
কালভার্টের ভিতর দিয়েই পার হওয়া সহজ।
বর্ষার সময় পানি থাকে, পানির স্রোতও
মারাত্মক।
স্তব্ধ চারদিকের এই শান্ত রাতে হঠাৎ
একটা শিয়াল চেঁচিয়ে উঠলো।
শিয়ালটা কালভার্টের ভিতরেই ছিল। মানুষ
দেখে আঁতকে উঠল ওটা।
সোজা ভো দৌড়ে কালভার্ট
থেকে বেরিয়ে গেল। যাবার পর
চেঁচামেচি টা ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে।
আরও অনেক শিয়াল একত্র হয়ে কালভার্টের
মুখে চেঁচামেচি করছে। ভয় পাচ্ছে হেকিমুদ্দীন।
শিয়ালের
চেঁচামেচিতে যদি বিএসএফরা সন্দেহ করে?
যদি কালভার্টের ভিতরে লাইট
মেরে ভিতরটা পরীক্ষা করে?
কাঁপতে থাকে হেকিমুদ্দীন। কিছুক্ষণ কাশেম
সিদ্ধান্ত নেয় মাথা বের
করে পরিবেশটা দেখবে ও। বিএসএফ
আশেপাশে না থাকলে বের হবে তারা।
সোজা বটতলায় যাবে আর বস্তাদুটি নিয়ে ফুট্টুস
দিবে।
মাথা তুলে এদিক ওদিক তাকায় কাশেম মিয়া।
আশেপাশে কেউ নেই। সব ঠান্ডা। টহল-
ফাড়িতেও কোন বিএসএফ নেই। শালার
পুতেরা ডিউটি না দিয়া কি করে, কই যায়!
ভারতের সরকারের টাকা খরচ করে কি লাভ হয়!
মনে মনে ধ্বিক্কার জানায় বিএসএফদের।
মিয়া বাই, অহন যাওন যাইবো, হেকিমুদ্দীন
কে ডাকে কাশেম মিয়া। হেকিমুদ্দীনও
সাড়া দেয় কোন শব্দ ছাড়াই,
বুঝতে পারে কাশেম মিয়া। দুজনের
বোঝাপড়াটা দারুন!
চারদিক আধার। রাত বাড়ছে।
শিয়ালগুলো অসম্ভবরকম চীৎকার করছে।
মাথাটা বের করলো কাশেম। সোজা উপর
থেকে খপ করে শার্টের কলার
চেপে ধরলো কেউ।
মাথা তুলে তাকিয়ে দেখলো কয়েকটা বিএসএফ
বন্দুক তাক করে আছে ওর দিকে, একজন কলার
ধরে টেনে বাহির করার চেষ্টা করছে। অর্ধেক
শরীর কালভার্টের ভিতরে থাকা অবস্থায় সব
বুঝে গেল কাশেম মিয়া।
পিছনে লাথি মারে ও। লাথিটা কালভার্টের
ভিতরে থাকা হেকিমুদ্দীনের নাকে-
মুখে লাগে। লাথির অর্থটা বুঝতে বিন্দুমাত্র ভুল
করলো না হেকিমুদ্দীন। পরিস্থিতি টের
পেয়ে চুপটি করে কালভার্টের
ভিতরে বসে থাকলো ও। শালার শিয়াল
গুলা কপাল পুড়ছে আজ,
মনে মনে শিয়ালেকে গালিদিয়ে চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার
করে হেকিমুদ্দীন।
কাশেম মিয়াকে টেনে বের করলো ওরা।
গালি-গালাজের অঝোর ধারা বইছে,বিভিন্ন
ভাষায়। সব ভাষা বুঝতে পারে না কাশেম
মিয়া। মনে হয় একটা আসামের বিএসএফ ছিল,
বাংলা জানতো। ওর খাঁটি বাংলায়
পড়া গালিগুলো হজম করছে কাশেম মিয়া।
জিজ্ঞেস করা হল, কাশেম মিয়া একা কিনা?
ওর সাথে কে?
বাংলা জানা বিএসএফটা জিজ্ঞেস করলো।
স্যার, আমি একাই আইছি। কেউ নাই আমার
সাথে। ঐ বটগাছটার নিচে বস্তাটা নিবার
লাইগা আইছি।
মাফ কইরা দেন!! অকাতরে আকুতি করে কাশেম
মিয়া।
স্যার, একাই আইছি, এই মিথ্যাটা বলায় হাফ
ছেড়ে বাঁচে হেকিমুদ্দীন।কিন্তু,
মিথ্যাটা কেন বলছে কাশেম, কারনটা বুঝতে ভুল
হয় না ওর। ভিতর থেকে বোঝা যাচ্ছে, কাশেম
মিয়াকে চড়-থাপ্পড় দিচ্ছে ওরা।
পরিস্থিতি নিশ্চয়ই খারাপ।
ইচ্ছা হচ্ছে, ও নিজেই বের
হয়ে বিএসএফকে বুঝিয়ে বলবে, ওরা আসল কেউ
না। ওরা গরীব, নীরিহ। দুজনের বাড়িতেই
বৃদ্ধা মা আছে, পরিবার আছে, ফ্যালফ্যাল
করে তাকিয়ে থাকা একটা ছোট্ট ছেলে আছে।
আমাদের মাইরেন না। বাচ্চাগুলা পুষবে কে!
বৃদ্ধা মায়ের অসুখ হলে কে দেখবে! আমাদের
ছাইরা দেন, ভালো হইয়া যামু।
আপনারা আমাদের বাপ লাগেন, ছাইড়া দেন!
আল্লার দোহাই, মাফ কইরা দেন।
কিন্তু, বের হবার সাহস হল না হেকিমুদ্দীনের।
আল্লাহ্ কে ডাকতে থাকলো। বিপদের সময়
আল্লাহর নাম তারাতারি মুখে আসে। মনের
অজান্তেই।
তারপর।
ভোরে চুপচুপ করে বাড়ির
দিকে ফিরলো হেকিমুদ্দীন। সব নীরব, স্তব্ধ।
কোথাও কোন শিয়াল নেই। জোনাকির
আলো চোখেই পড়ছে না ওর। ও জঙ্গলের ভিতর
দিয়েই বাড়ির দিকে আসছে, কোথাও কোন
সাপ নেই, বিষাক্ত কোন প্রাণিই নেই। চোখের
সামনে ঝোপের মধ্যে একটা ছাগলের বাচ্চার
চামড়া পড়ে আছে। কোন একটা শিয়াল মনে হয়
কারও সর্বনাশ করেছে। চোখে পড়লেও গুরুত্ব
দিলো না হেকিমুদ্দীন।
হেটেই চলছে ও। কাশেম মিয়াটা বড় স্বার্থপর!
একাই চলে গেল, ডাকলোও না একবার।
মিথ্যাবাদী কাশেমের প্রতি অকারনেই
রেগে যাচ্ছে হেকিমুদ্দীন।
একাই হাটছে, কানে কিছুই শুনছে না ও। কিন্তু,
স্তব্ধ হয়ে হাটছে আর ভাবছে, কাশেম মিয়া এত
স্বার্থপর মিথ্যাবাদী হইল ক্যামনে! যাবার
বেলা ডাকলোও না!
পরদিন, বিকেলবেলা।
সুর্য টা ঢলে পড়ছে পশ্চিমে। দিন শেষ
হয়ে আসছে। বিজিবি-বিএসএফের মধ্যে বৈঠক
ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গেল। বিষয় কাশেম মিয়া।
সাদাসিধা একটা মানুষকে নিয়ে দুদেশের
বড়সড় বৈঠক। হাসি-খুশি মনে বিএসএফরা বিদায়
নিলো, বাংলাদেশের পক্ষে বিজিবিও
হ্যান্ডশেক করলো। দুপক্ষই আশ্বাস দিলেন,
যা ঘটেছে তা আর ঘটতে দেয়া হবে না।
বৈঠকে কাশেম মিয়াও ছিল। অপরাধীটা কোন
কথা বলে নি। চুপচাপ করে সবার
মাঝে একটা কফিনে শুয়ে ছিল।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
জাহিদুর রহমান ০৬/০২/২০১৫ভালো লাগল ।
-
ডিবেটার সাদ্দাম হোসেন ০৬/০২/২০১৫সবাইকে ধন্যবাদ।।
এই গল্পটা বই মেলায় এসেছে____
লেখচিত্র প্রকাশনি থেকে প্রকাশিত বইয়ে, এই গল্পটাও থাকছে____ -
কপিল দেব ২৯/০১/২০১৫সুন্দর লেখা ।
-
হাসান কামরুল ২৯/০১/২০১৫ভালো লাগলো। চমৎকার লেখার হাত।
-
ইঞ্জিনিয়ার সজীব ইমাম ২৭/০১/২০১৫সময় নিয়ে পড়লাম।
-
আবিদ আল আহসান ২৭/০১/২০১৫চমৎকার
-
সবুজ আহমেদ কক্স ২৭/০১/২০১৫ভালো হয়েছে কবি সাদ্দাম হোসেন
-
অ ২৬/০১/২০১৫বেশ ভালো লাগল ।
-
সবুজ আহমেদ কক্স ২৬/০১/২০১৫valo laglo