সিস্টার
#গল্প
সিসটার
হুসাইন দিলাওয়ার
রাত ১ টা ছুঁই ছুঁই ।
শ্যামলী ওভারব্রিজ ।
ঢাকা শহরের ব্যস্ততম ওভার ব্রিজগুলোর মধ্যে একটি । ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আলোকিত রাজপথ । রাস্তায় জনমানুষের অস্তিত্ব চোখে পড়ে না ।
সশব্দে Pulsar 150 C&G মডেলের বাইক এসে থামল শ্যামলী সিনেমা হলের সামনে ।
বাইকের ট্যাঙ্কিতে বসা চার পাঁচ বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে । চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে সে লকডাউনের শহর দেখে । মাঝেমধ্যে পাপা পাপা বলে খিলখিল করে হাসে । দুর্বোধ্য আওয়াজ করে ।
মন্থর গতিতে একটা পুলিশ পিকআপ এসে থামল শ্যামলী হলের সামনে । পিকআপের নীল রঙের বডিতে সাদা কালিতে লেখা আদাবর থানা ।
আসুরিক গতিতে সুনশান রাতের নিরবতা ভেঙে ছুটে চলছে উত্তরবঙ্গগামী ট্রাক-লরি ।
কয়েকটা প্রাইভেট গাড়িও সা সা করে ছুটে যাচ্ছে ।
পুলিশ ভ্যানের সামনে সিটে বসে থাকা অফিসার নামে না । নামে দুই জন হাবিলদার । সন্দিগ্ধ চোখে তাকায় বাচ্চা সমেত বাইক চালকের দিকে । জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে তারা বোধহয় হতোদ্যম হল ।
বাইকের হ্যাড লাইটে ওপরে লাগানো লাল স্টিকারে হলুদ রঙে লেখা প্রেস । তাতে বাংলাদেশের প্রথম সারির একটি পত্রিকার মনোগ্রাম । তাছাড়া হাবিলদাররাও মোটামুটি মানুষ চেনে । কে চোর , কে সাধু ।
অমিত পুলিশের গতিবিধি তেমন গা করে না ।
কারণ সে ক্রাইম রিপোর্টার । রাতের আঁধারে তার চলাচল । থানায় থানায় তার নিত্য আসা যাওয়া । তার ছোট্ট মেয়েটার সাথে মিষ্টি খুনসুটিতে মাতে অমিত ।
একজন হাবিলদার প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল । লম্বা একটা সুখ টান দিয়ে একদলা ধুঁয়া আকাশে ফুঁকে দিল । সাদা ধুয়ার কুণ্ডলী বেশিক্ষণ থাকল না । বেশ জোরেই বাতাস বইছে । হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ।
নেনে ভাই , টানেন ।
নিজের অর্ধেক খাওয়া সিগারেট সঙ্গীকে অফার করে প্রথমজন ।
অপরজন শশব্যস্ত হয়ে বলে-- না না ভাইজান ।
সিগারেট খাওন ছাইড়া দিছি । কালকা আজহারী সাহেবের ওয়াজ শোনার পর তওবা করছি । আর সিগারেট মুখে নিমু না । তাছাড়া আপনের ভাবিও বকাঝকা করে । সকালে ফেইসবুকে দেখলাম দু'মুঠো ভাতের জন্য ভুখা মিছিল করছে কত মানুষ । খাবার না পায়া কত লোক মারা যাচ্ছে । তাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি আর ধুঁয়া ফুঁকে টাকা বরবাদ করব না ।
অপর সঙ্গীর মনের প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট করে বুঝা গেল না , তবে তিনি তৎক্ষণাৎ অর্ধেক খাওয়া সিগারেটা ছুঁড়ে ফেললেন । বুটের চাপে আগুনটা নেভালেন । তারপর মুখে মাস্ক লাগিয়ে পিকআপে গিয়ে উঠলেন ।
গুড়গুড় গতিতে গাড়িটা রিং রোডের দিকে মোড় নিল ।
ওভারব্রিজের সিঁড়ির নিচের জায়গাটায় একটা করমচা গাছে । তাদে ফুল ফুটেছে । করমচা ফুল দেখতে অনেকটা শিউলি ফুলের মত ।
অমিত তার মেয়ের সাথে মেতে ছিলেন।
এমন সময় খিলখিল আওয়াজের অট্টহাসহ্যে সে ধাতস্থ হল । বোরকা পড়া এক মহিলা তার গাঘেঁষে দাঁড়িয়েছে ।
অমিতই আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল :
: আপনার নাম কি ?
: নাম শুনে কাম কি ?
: কাম তো হতেও পাড়ে ।
: আপনি যে কামের লোক না, তা আমার বুঝা শ্যাষ ।
: আচ্ছা, কেমন করে বুঝলেন ?
: নিজের মেয়েরে ধইরা কেউ কাম করতে আহে নাকি ছার । বলেই আবার অট্টহাসিতে নিরব পরিবেশটা গমগমিয়ে দিল । হাসির শেষ রেশটুকি কেমন যেন করুণ কান্নার মত টেকল অমিতের কানে ।
: এখন তো পুরো শহর লকডাউন, তবুও তুমি বেরিয়েছ ।
: প্যাট তো লকডাউন ঠকডাউন মানে না ছার ।
তাদের কথার মাঝখানেই একটা এ্যাম্বুলেন্স এসে থামল । রাতের অতিথি চোখের পলকে অন্তর্ধান হয়ে গেল । এ্যাম্বুলেন্সের দরজা খুলে ঈষৎ নীল বর্ণের পিপিই মোড়ানো রবোটিক টাইপের একজন মানুষ এসে বাইকের কাছে দাঁড়াল ।
অমিত কৌতুক মিশ্রিত গলায় বলল --
: একি, তুমি এ্যাম্বুলেন্সে করে এলে যে ? তুমি কি আসলেই আমার সেলিনা, নাকি আবার ভূত টূত ?
: আর বলো না, কাজের চাপে মরে ভূত হওয়ার যোগাড় । স্টাফ গাড়ির ট্রাইভার ছুটিতে আছে । অগত্যা এ্যাম্বুলেন্সে আসতে হল ।
পরিচিত গলার আওয়াজ পেয়ে মেয়েটা মা মা করে হুমড়ি দুমড়ি করে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল ।
: এ্যই, ওকে ধর ধর । একেবারে গোসল টোসল না করে কোলে নেয়া যাবে না । কি এক ভাইরাস । আমার পিপিইতে যে করোনার জীবাণু লেগে নাই তার কি গ্যারান্টি !
: হুম ঠিক বলেছ । আজ সারাদিন তার দাদিকে খুব জ্বালিয়েছে । সেই বিকেল থেকেই নাকি মা মা করে কান্নাকাটি করেছে ।
সেলিনার মনের গভীর গহন থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসের বের হয়ে আসে ।
আমার শরীরটা কেমন যেন ম্যাজম্যাজ করছে বলতে বলতে অমিতের ডান কাঁধে হাত রেখে ব্যাক সিটে বসে সেলিনা ।
মেয়েকে সামলিয়ে বাইক স্টার্ট দেয় অমিত ।
ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আলোকিত রাতের রাজপথে মাড়িয়ে এগিয়ে যায় তারা আপন আলয়ে ।
অমিতের ঘুম ভাঙল বেলা ১১ টায় ।
বিছানায় শুয়ে চোখ মেলে দক্ষিণ দিকের জানাটায় তাকায় সে । ঘুম ভেঙেই জানালার দিকে তাকিয়ে থাকা তার অভ্যাস হয়ে গেছে ।
আধো ঘুম আধো জাগ্রত অবস্থায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর আড়মোড়া ভেঙে ওয়াশরুমে যায় ।
আজ আচমকা সেলিনাকে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধাক্কা খেল অমিত ।
তার তো এ সময় বাসায় থাকার কথা না । সেলিনা অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে জানালা লাগোয়া কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে । লাল ফুলে থইথই গাছটা ।
তার দু'চোখের অশ্রুধারা থুতুনিতে জমে ফোটায় ফোটায় ঝরছে মোজাইক করা মেঝেতে ।
অমিত চোখ বন্ধ করে অনুমান করার চেষ্টা করল । সেলিনার মন খারাপের হেতু কি হতে পারে ?
সেলিনা বেশ শক্ত প্রকৃতির মেয়ে । সে পান্থপথের দিকে একটা স্বনামধন্য প্রাইভেট হাসপাতালের নার্স ।
সেলিনাকে বিয়ে করতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয় অমিতকে । তার মরহুম পিতা জীবনের অন্তিমকাল পর্যন্তও ছেলের বউ হিসেবে একজন নার্সকে মেনে নিতে পারেনি । প্রতিবেশী, বন্ধুমহল, শ্বশুর বাড়ির কানাঘুষা শুনে অভ্যস্ত সেলিনা । কিন্তু আজ হঠাৎ কি হল ?
চিন্তা করে কোন কূল কিনারা পেল না অমিত ।
নিঃশব্দে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে ঢোকে ।
ফ্রেস হয়ে মায়ের রুমে যায় । দাদি নাতি মিলে মিষ্টি খেলায় মেতেছে ।
তাই তাই তাই
মা মা বাড়ি যাই
মামি দিল দুধভাত
পেট পুরে খাই ।
তিতলিকে কোলে তুলে আদর করে অমিত ।
ব্যাডরুমে এসে দেখে সেলিনা বসে আছে । আলুথালু চুলে তাকে বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে ।
অমিত তাকে জড়িয়ে ধরতে হাত বাড়ায় । কিন্তু সেলিনা তাকে এক রকম ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল ।
ঘটনার আকস্মিকতায় অমিত আশ্চর্যবোধক চোখে চেয়ে আছে ।
তোমরা কেউ আমাকে ছোঁবে না । আমি বোধহয় করোনা এফেক্টেড হয়ে গেছি অমিত । প্রায় সবগুলো লক্ষণই আমার শরীরে উপস্থিত । সারা রাত আমার চিন্তায় ঘুম হয়নি ।
বলেই হু হু করে কান্নায় ভেঙে পড়ে সেলিনা ।
আচ্ছা আগে রিপোর্ট তো আসুক তারপর নাহয় কেঁদ । তুমি না রোগীদের অভয় দাও, তাদের বেঁচে থাকতে প্রলুব্ধ কর । তুমিই যদি এমন হতাশ হও, তাহলে কে তোমাকে বুঝাবে বল ।
মাঝখানে বিভীষিকাময় দুটি রাত অতিবাহিত হয়ে যায় ।
আজ অন্য রকম সকাল ।
চৈত্রের সোনাঝরা রোদে আলোকিত পারিপার্শ্বিকতা ।
ঘুম থেকে উঠেই ইলিশের ম ম করা গন্ধ পায় অমিত । বিছানা থেকে নেমেই কিচেনে উঁকি দেয় । সেলিনা মনোযোগ দিয়ে সর্ষে ইলিশ রান্না করছে । তিতলি এক হাতে পুতুল আর অন্যহাতে মায়ের শাড়ির নিচ দিকটা ধরে আছে ।
: এই যে সিস্টার কি রান্না হচ্ছে ?
: তোমার প্রিয় সর্ষে ইলিশ ।
: ওয়াও । তোমার হাতে সর্ষে ইলিশ মানে...
: থাক থাক । আর পাম দিতে হবে না ।
: লোকে তোমাকে বলে সিসটার, কিন্তু আমি তোমার নতুন একটা পদবী দিলাম---
লেডি উইথ দ্য
সর্ষে ইলিশ !
বলেই হা হা করে হেসে উঠল অমিত ।
তোমার আজ ডিউটি নেই ?
: নাহ, ছুটি নিয়েছি আজ । আচ্ছা, রাতে যে তোমারা কাছে রিপোর্টগুলো দিলাম কই রেখেছে ? পাচ্ছি না ।
: আরেহ ওসব রিপোর্ট আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি । ঐ রিপোর্টগুলো কি আর ফেলনা বল । যা ধকল গেল এই দু'দিন ।
সত্যি সেলি তোমার করোনা টেস্ট নেগেটিভ আসায় আমি যে কি খুশি হয়েছিলাম তখন, বলে বুঝানো যাবে না ।
গভীর আস্থা আর ভালোবাসার চোখে অমিতদের দিকে তাকায় সেলিনা । তারপর বলল---
: হয়েছে হয়েছে এখন যাও ফ্রেশ হয়ে আস ।
সব রান্না বান্না কমপ্লিট ।
অমিত মুখ ফেরাতেই তিতলি পাপা পাপা বলে তারস্বরে কেঁদে উঠল । সাথে সাথে অমিত আর সেলিনা হা হা করে শশব্দে হেসে উঠল ।
উৎসর্গ : এই ভীষণ মহামারির দিনে কর্মরত সকল নার্সকে 💚
সিসটার
হুসাইন দিলাওয়ার
রাত ১ টা ছুঁই ছুঁই ।
শ্যামলী ওভারব্রিজ ।
ঢাকা শহরের ব্যস্ততম ওভার ব্রিজগুলোর মধ্যে একটি । ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আলোকিত রাজপথ । রাস্তায় জনমানুষের অস্তিত্ব চোখে পড়ে না ।
সশব্দে Pulsar 150 C&G মডেলের বাইক এসে থামল শ্যামলী সিনেমা হলের সামনে ।
বাইকের ট্যাঙ্কিতে বসা চার পাঁচ বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে । চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে সে লকডাউনের শহর দেখে । মাঝেমধ্যে পাপা পাপা বলে খিলখিল করে হাসে । দুর্বোধ্য আওয়াজ করে ।
মন্থর গতিতে একটা পুলিশ পিকআপ এসে থামল শ্যামলী হলের সামনে । পিকআপের নীল রঙের বডিতে সাদা কালিতে লেখা আদাবর থানা ।
আসুরিক গতিতে সুনশান রাতের নিরবতা ভেঙে ছুটে চলছে উত্তরবঙ্গগামী ট্রাক-লরি ।
কয়েকটা প্রাইভেট গাড়িও সা সা করে ছুটে যাচ্ছে ।
পুলিশ ভ্যানের সামনে সিটে বসে থাকা অফিসার নামে না । নামে দুই জন হাবিলদার । সন্দিগ্ধ চোখে তাকায় বাচ্চা সমেত বাইক চালকের দিকে । জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে তারা বোধহয় হতোদ্যম হল ।
বাইকের হ্যাড লাইটে ওপরে লাগানো লাল স্টিকারে হলুদ রঙে লেখা প্রেস । তাতে বাংলাদেশের প্রথম সারির একটি পত্রিকার মনোগ্রাম । তাছাড়া হাবিলদাররাও মোটামুটি মানুষ চেনে । কে চোর , কে সাধু ।
অমিত পুলিশের গতিবিধি তেমন গা করে না ।
কারণ সে ক্রাইম রিপোর্টার । রাতের আঁধারে তার চলাচল । থানায় থানায় তার নিত্য আসা যাওয়া । তার ছোট্ট মেয়েটার সাথে মিষ্টি খুনসুটিতে মাতে অমিত ।
একজন হাবিলদার প্যান্টের পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরাল । লম্বা একটা সুখ টান দিয়ে একদলা ধুঁয়া আকাশে ফুঁকে দিল । সাদা ধুয়ার কুণ্ডলী বেশিক্ষণ থাকল না । বেশ জোরেই বাতাস বইছে । হঠাৎ বৃষ্টি হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ।
নেনে ভাই , টানেন ।
নিজের অর্ধেক খাওয়া সিগারেট সঙ্গীকে অফার করে প্রথমজন ।
অপরজন শশব্যস্ত হয়ে বলে-- না না ভাইজান ।
সিগারেট খাওন ছাইড়া দিছি । কালকা আজহারী সাহেবের ওয়াজ শোনার পর তওবা করছি । আর সিগারেট মুখে নিমু না । তাছাড়া আপনের ভাবিও বকাঝকা করে । সকালে ফেইসবুকে দেখলাম দু'মুঠো ভাতের জন্য ভুখা মিছিল করছে কত মানুষ । খাবার না পায়া কত লোক মারা যাচ্ছে । তাই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি আর ধুঁয়া ফুঁকে টাকা বরবাদ করব না ।
অপর সঙ্গীর মনের প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট করে বুঝা গেল না , তবে তিনি তৎক্ষণাৎ অর্ধেক খাওয়া সিগারেটা ছুঁড়ে ফেললেন । বুটের চাপে আগুনটা নেভালেন । তারপর মুখে মাস্ক লাগিয়ে পিকআপে গিয়ে উঠলেন ।
গুড়গুড় গতিতে গাড়িটা রিং রোডের দিকে মোড় নিল ।
ওভারব্রিজের সিঁড়ির নিচের জায়গাটায় একটা করমচা গাছে । তাদে ফুল ফুটেছে । করমচা ফুল দেখতে অনেকটা শিউলি ফুলের মত ।
অমিত তার মেয়ের সাথে মেতে ছিলেন।
এমন সময় খিলখিল আওয়াজের অট্টহাসহ্যে সে ধাতস্থ হল । বোরকা পড়া এক মহিলা তার গাঘেঁষে দাঁড়িয়েছে ।
অমিতই আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল :
: আপনার নাম কি ?
: নাম শুনে কাম কি ?
: কাম তো হতেও পাড়ে ।
: আপনি যে কামের লোক না, তা আমার বুঝা শ্যাষ ।
: আচ্ছা, কেমন করে বুঝলেন ?
: নিজের মেয়েরে ধইরা কেউ কাম করতে আহে নাকি ছার । বলেই আবার অট্টহাসিতে নিরব পরিবেশটা গমগমিয়ে দিল । হাসির শেষ রেশটুকি কেমন যেন করুণ কান্নার মত টেকল অমিতের কানে ।
: এখন তো পুরো শহর লকডাউন, তবুও তুমি বেরিয়েছ ।
: প্যাট তো লকডাউন ঠকডাউন মানে না ছার ।
তাদের কথার মাঝখানেই একটা এ্যাম্বুলেন্স এসে থামল । রাতের অতিথি চোখের পলকে অন্তর্ধান হয়ে গেল । এ্যাম্বুলেন্সের দরজা খুলে ঈষৎ নীল বর্ণের পিপিই মোড়ানো রবোটিক টাইপের একজন মানুষ এসে বাইকের কাছে দাঁড়াল ।
অমিত কৌতুক মিশ্রিত গলায় বলল --
: একি, তুমি এ্যাম্বুলেন্সে করে এলে যে ? তুমি কি আসলেই আমার সেলিনা, নাকি আবার ভূত টূত ?
: আর বলো না, কাজের চাপে মরে ভূত হওয়ার যোগাড় । স্টাফ গাড়ির ট্রাইভার ছুটিতে আছে । অগত্যা এ্যাম্বুলেন্সে আসতে হল ।
পরিচিত গলার আওয়াজ পেয়ে মেয়েটা মা মা করে হুমড়ি দুমড়ি করে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল ।
: এ্যই, ওকে ধর ধর । একেবারে গোসল টোসল না করে কোলে নেয়া যাবে না । কি এক ভাইরাস । আমার পিপিইতে যে করোনার জীবাণু লেগে নাই তার কি গ্যারান্টি !
: হুম ঠিক বলেছ । আজ সারাদিন তার দাদিকে খুব জ্বালিয়েছে । সেই বিকেল থেকেই নাকি মা মা করে কান্নাকাটি করেছে ।
সেলিনার মনের গভীর গহন থেকে একটা দীর্ঘশ্বাসের বের হয়ে আসে ।
আমার শরীরটা কেমন যেন ম্যাজম্যাজ করছে বলতে বলতে অমিতের ডান কাঁধে হাত রেখে ব্যাক সিটে বসে সেলিনা ।
মেয়েকে সামলিয়ে বাইক স্টার্ট দেয় অমিত ।
ল্যাম্পপোস্টের আলোয় আলোকিত রাতের রাজপথে মাড়িয়ে এগিয়ে যায় তারা আপন আলয়ে ।
অমিতের ঘুম ভাঙল বেলা ১১ টায় ।
বিছানায় শুয়ে চোখ মেলে দক্ষিণ দিকের জানাটায় তাকায় সে । ঘুম ভেঙেই জানালার দিকে তাকিয়ে থাকা তার অভ্যাস হয়ে গেছে ।
আধো ঘুম আধো জাগ্রত অবস্থায় কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর আড়মোড়া ভেঙে ওয়াশরুমে যায় ।
আজ আচমকা সেলিনাকে জানালায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ধাক্কা খেল অমিত ।
তার তো এ সময় বাসায় থাকার কথা না । সেলিনা অপলক নয়নে তাকিয়ে আছে জানালা লাগোয়া কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে । লাল ফুলে থইথই গাছটা ।
তার দু'চোখের অশ্রুধারা থুতুনিতে জমে ফোটায় ফোটায় ঝরছে মোজাইক করা মেঝেতে ।
অমিত চোখ বন্ধ করে অনুমান করার চেষ্টা করল । সেলিনার মন খারাপের হেতু কি হতে পারে ?
সেলিনা বেশ শক্ত প্রকৃতির মেয়ে । সে পান্থপথের দিকে একটা স্বনামধন্য প্রাইভেট হাসপাতালের নার্স ।
সেলিনাকে বিয়ে করতে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয় অমিতকে । তার মরহুম পিতা জীবনের অন্তিমকাল পর্যন্তও ছেলের বউ হিসেবে একজন নার্সকে মেনে নিতে পারেনি । প্রতিবেশী, বন্ধুমহল, শ্বশুর বাড়ির কানাঘুষা শুনে অভ্যস্ত সেলিনা । কিন্তু আজ হঠাৎ কি হল ?
চিন্তা করে কোন কূল কিনারা পেল না অমিত ।
নিঃশব্দে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে ঢোকে ।
ফ্রেস হয়ে মায়ের রুমে যায় । দাদি নাতি মিলে মিষ্টি খেলায় মেতেছে ।
তাই তাই তাই
মা মা বাড়ি যাই
মামি দিল দুধভাত
পেট পুরে খাই ।
তিতলিকে কোলে তুলে আদর করে অমিত ।
ব্যাডরুমে এসে দেখে সেলিনা বসে আছে । আলুথালু চুলে তাকে বেশ স্নিগ্ধ দেখাচ্ছে ।
অমিত তাকে জড়িয়ে ধরতে হাত বাড়ায় । কিন্তু সেলিনা তাকে এক রকম ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল ।
ঘটনার আকস্মিকতায় অমিত আশ্চর্যবোধক চোখে চেয়ে আছে ।
তোমরা কেউ আমাকে ছোঁবে না । আমি বোধহয় করোনা এফেক্টেড হয়ে গেছি অমিত । প্রায় সবগুলো লক্ষণই আমার শরীরে উপস্থিত । সারা রাত আমার চিন্তায় ঘুম হয়নি ।
বলেই হু হু করে কান্নায় ভেঙে পড়ে সেলিনা ।
আচ্ছা আগে রিপোর্ট তো আসুক তারপর নাহয় কেঁদ । তুমি না রোগীদের অভয় দাও, তাদের বেঁচে থাকতে প্রলুব্ধ কর । তুমিই যদি এমন হতাশ হও, তাহলে কে তোমাকে বুঝাবে বল ।
মাঝখানে বিভীষিকাময় দুটি রাত অতিবাহিত হয়ে যায় ।
আজ অন্য রকম সকাল ।
চৈত্রের সোনাঝরা রোদে আলোকিত পারিপার্শ্বিকতা ।
ঘুম থেকে উঠেই ইলিশের ম ম করা গন্ধ পায় অমিত । বিছানা থেকে নেমেই কিচেনে উঁকি দেয় । সেলিনা মনোযোগ দিয়ে সর্ষে ইলিশ রান্না করছে । তিতলি এক হাতে পুতুল আর অন্যহাতে মায়ের শাড়ির নিচ দিকটা ধরে আছে ।
: এই যে সিস্টার কি রান্না হচ্ছে ?
: তোমার প্রিয় সর্ষে ইলিশ ।
: ওয়াও । তোমার হাতে সর্ষে ইলিশ মানে...
: থাক থাক । আর পাম দিতে হবে না ।
: লোকে তোমাকে বলে সিসটার, কিন্তু আমি তোমার নতুন একটা পদবী দিলাম---
লেডি উইথ দ্য
সর্ষে ইলিশ !
বলেই হা হা করে হেসে উঠল অমিত ।
তোমার আজ ডিউটি নেই ?
: নাহ, ছুটি নিয়েছি আজ । আচ্ছা, রাতে যে তোমারা কাছে রিপোর্টগুলো দিলাম কই রেখেছে ? পাচ্ছি না ।
: আরেহ ওসব রিপোর্ট আমি যত্ন করে রেখে দিয়েছি । ঐ রিপোর্টগুলো কি আর ফেলনা বল । যা ধকল গেল এই দু'দিন ।
সত্যি সেলি তোমার করোনা টেস্ট নেগেটিভ আসায় আমি যে কি খুশি হয়েছিলাম তখন, বলে বুঝানো যাবে না ।
গভীর আস্থা আর ভালোবাসার চোখে অমিতদের দিকে তাকায় সেলিনা । তারপর বলল---
: হয়েছে হয়েছে এখন যাও ফ্রেশ হয়ে আস ।
সব রান্না বান্না কমপ্লিট ।
অমিত মুখ ফেরাতেই তিতলি পাপা পাপা বলে তারস্বরে কেঁদে উঠল । সাথে সাথে অমিত আর সেলিনা হা হা করে শশব্দে হেসে উঠল ।
উৎসর্গ : এই ভীষণ মহামারির দিনে কর্মরত সকল নার্সকে 💚
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মশিউর ইসলাম (বিব্রত কবি) ০২/০৫/২০২০ওয়াও বেশ ভালো
-
পরিতোষ ভৌমিক ২ ৩০/০৪/২০২০খুব সুন্দর মর্মস্পর্শী একটি লেখা । স্যালুট যাদের উদ্দ্যেশ্যে লেখা এবং যিনি লিখেছেন ।
-
মোহন দাস (বিষাক্ত কবি) ২৬/০৪/২০২০বেশ...
-
স্বপন রোজারিও (মাইকেল) ২৫/০৪/২০২০খুব সুন্দর লেখনী। এগিয়ে যান।
-
ফয়জুল মহী ২৫/০৪/২০২০অনন্যসাধারণ লেখা। শুভেচ্ছা ।
-
মোঃআব্দুল্লাহ্ আল মামুন ২৫/০৪/২০২০হুম ভালো
-
কুমারেশ সরদার ২৫/০৪/২০২০সাধু সাধু