শবে বরাত
আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম...।
ফজরের আজান শেষ হয় ।
পূব আকাশ ফর্সা হয়ে আসে ।
বাঁশ বাগানে অগণিত পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে কুলসুমের । শাড়িটা ঠিকঠাক করে খাট থেকে নামে ।
পাশের ঘরের দরজা ভিতর থেকে লাগানো । সুজন এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি । আজকের দিনটা পেরুলেই শবেবরাতের রাত । বড় বরকতময় এই রাত । আল্লাহর দরবারে খালেস দিলে কোন কিছু চাইলে তিঁনি কবুল না করে পারেন না ।
এই দিনে ভাল মন্দ কিছু খাওয়া ইবাদতের মতই জ্ঞান করে এই গ্রামের মানুষেরা । কুলসুমও এ গাঁয়ের একজন ।
ছলা মুড়ি, হালুয়া কিংবা গোশত রুটি খাওয়া চায় । সকালের মৃদল বাতাসে ভেসে আসে রান্নার সুবাস । উঠানের হাঁস মুরগির খোঁয়াড়ের দরজা খুলে দেয় কুলসুম । প্যাক প্যাক শব্দ করতে করতে বের হয় দুটো হাঁস । কয়েকটা মুরগি ।
কাঁচের বোতল থেকে বিদ্যুৎ কালো নিমের মাজন নিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে কল পাড়ে যায় । অযু করে ফজরের নামাজ আদায় করে ।
নামাজ শেষ হতেই হাজারো চিন্তা খেলা করে তার মাথায় । সুজনের বাপের কথা মনে হয়, শবে বরাতের দিনে ভালমন্দ কিছু খাবার কথা মনে হয়, মহামারির দিনে মসজিদে এক কেজি জিলাপি দেওয়ার কথাও ভাবে কুলসুম ।
কিন্তু মুসল্লিরা কি মসজিদে আসে এখনো ?
কালকে নাকি মাইকিং করে বাড়িতে নামাজ পড়ার কথা বলে দিয়েছে । এমনটাই বলেছিল সুজন ।
বাঁসি থালা-বাসন কয়টা ধুয়ে সে ব্যাগ হাতে মেম্বরের বাড়ির দিকে রওনা হয় । আজও শেষমেষ চাল পাবে কিনা, মনে তার সন্দেহ ।
কী ধকলটাই না কাল গেল ।
মেম্বারের দেওয়া রিলিফের কার্ডটা শাড়ির কোণে বাঁধা । একবার হাত ছুঁয়ে পরখ করে । নিয়েছে কিনা ।
কাল দশটায় ইউনিয়ন কাউন্সিলে গিয়েছিল সে । নির্ধারিত সময়ে পৌঁছায় কুলসুম ।
ইউনিয়ন কাউন্সিলের মাঠে মানুষের সমাগম দেখে তার চোখ কপালে উঠে যায় ।
এত অভাবী মানুষ দুনিয়ায় !
তাদের জন্য দুঃখ করে নিজের দুঃখটা ভুলে থাকার চেষ্টা করে ।
লাইনে দাঁড়ায় কুলসুম ।
এ তার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা ।
সুজনের বাবা টাকা পাঠাতে পারছে না । কাজ নাই, কারখানা বন্ধ । মহামারি এ অসুখ ছড়িয়ে পড়ায় এই কয়দিনে অনেক কিছু শিখেছে কুলসুম ।
সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ে অনেকটা । ক্ষুধায় তার নাড়িভুঁড়ি হজম হওয়ার যোগাড় হয় । কিন্তু লাইনে ছেড়ে বের হবার সাহস পায় না কুলসুম । পাছে কেউ এসে তার জায়গায় দাঁড়িয়ে যায় । তাহলে সারাদিনের পরিশ্রমই মাটি । এবার স্যান্ডেলের ওর বসে চটের ব্যাগটা মাথার ওপরে ধরে সে । চৈত্রের কাঠফাটা রোদ । আর পাঁচজনের পরেই সে চাল পাবে । খুশিতে মনটা ডগমগ করে উঠে তার । কিন্তু ইউনিয়ন কাউন্সিলের সচিব আর মেম্বাররা এমন কানেকানে ফিসফাস শুরু করল কেন ?
তাদের চোখের ভাষাও কুলসুমের কাছে সুবিধার ঠেকল না । কিছুক্ষণ পর চেয়ারম্যান সাহেব হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দিল--- চাউল শেষ হয়ে গেছে । যারা পায়নি তারা নিজ নিজ ওয়ার্ডের মেম্বার সাহেবের সাথে যেন দেখা করে ।
কাল চেয়াম্যানের এই ঘোষণা শুনার পর কুলসুমের যে কি খারাপটাই না লেগেছিল । প্রচন্ড একটা ভোঁতা বিবমিষায় মাথা ঝিম ধরে যায় । খালি পেট গ্যাস জমে টইটম্বুর । বাড়িতে এসেই সে হড়হড় করে বমি করে । বুক জ্বালা শুরু হলে
রাতে ভালমত ঘুমও হয়নি তার ।
তাই আজ দ্বিধান্বিত মনে মেম্বারের বাড়ির দিকে পা বাড়ায় কুলসুম ।
২
সুজন ঘুম থেকে উঠে রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে । কোন রকম চোখে-মুখে পানি ছিনিয়ে সে রান্না ঘরে যায় । ডেকচিতে রাখা পান্তা ভাত স্টিলের বাটিতে নিয়ে একটা কাঁচা মরিচ আর লবণ দিয়ে গো গ্রাসে গিলতে থাকে । সব পান্তা সাবাড় করে দেয় সে । তারপরও তার টিকমত পেট ভরে না । দরজা ভেজিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় সুজন। পাশের খেতেই করিম শেখের শ্যালো মেশিন চলছে ।
এক নাগাড়ে ভ্যাট ভ্যাট ভ্যাট শব্দ ।
অবচেতনে সুজন ঐ ছন্দে একটা গান শুনে---
আরে সুজন বন্ধু
ওরে সুজন বন্ধু
সুজন বন্ধু সুজন বন্ধু....।
শ্যালো মেশিনের কাছে এসে আজলা ভরে পানি খায় সে ।
চৌধুরী বাড়ির দুজন কামলা মস্ত একটা ষাঁড় মেশিনের পানিতে গোসল করাচ্ছে । শবে বরাত উপলক্ষে গরুটা কয়েকজন মিলে কেনে ।
তবে সব উদ্যোগ আয়োজন জলিল চৌধুরীর ।
কোরানার ভয়ে সবাই ত্রস্ত ।
প্রথমে গরু জবেহ করার কথাটা প্রতিবারের মত আগ বাড়িয়ে কেউ তোলে না এবার ।
তারপরও সাওয়াব হাছিলের উদ্দেশ্যে এ আয়োজন ।
সবাই মাস্ক পরেছে । সুজনেরও একটা মাস্ক আছে । তবে সে সেটা বাড়িতে রেখে এসেছে ।
সে সাদা একটা সুতির কাপড় নাকে পেঁচিয়ে রেখেছে । হাত ধোওয়ার জন্য সাবান এবং গোশত কাটা ও ভাগ করার সময় সবাই দূরত্ব বজায় রাখে । সুজন বেশ আগ্রহ নিয়ে এটা ওটা করে ।
যোহরের আজান ভেসে আসে গ্রামের জামে মসজিদ থেকে ।
মুয়াজ্জিমের কন্ঠে কান্না জড়ানো দরদ ।
আজান শেষে মাইকে সবাইকে যার যার বাড়িতে নামাজ পড়ার এলান দেন তিনি ।
বাড়ির উঠোনে নিরন্ন মুখে কি যেন ভাবে কুলসুম । বড় নির্দয়ভাবে আজও তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে ।
এমন সময় মা মা বলে এক রকম চিৎকার করে বাড়িতে প্রবেশ করে সুজন।
হাতে কলার পাতায় মোড়ানে কি যেন ।
লুঙ্গিতে ফুটবলের মত গোল করে কি যেন ধরে আছে সুজন ।
সুজন স্বগত স্বরে বলে দেখ্ দেখ্ মাও---
গোশ, গোশ এই দেখ চালও ।
এই দৃশ্য দেখে ময়ের দুচোখে আনন্দন অশ্রু ঝরতে আরম্ভ করে ।
কিন্তু কাল কি হবে ।
অনাগত ভবিষ্যতের অজানা আশঙ্কায় আবার তার মুখে কালো মেঘ জমে ।
#গল্প: শবে বরাত
#হুসাইন দিলাওয়ার
ফজরের আজান শেষ হয় ।
পূব আকাশ ফর্সা হয়ে আসে ।
বাঁশ বাগানে অগণিত পাখির কলকাকলিতে ঘুম ভাঙে কুলসুমের । শাড়িটা ঠিকঠাক করে খাট থেকে নামে ।
পাশের ঘরের দরজা ভিতর থেকে লাগানো । সুজন এখনো ঘুম থেকে ওঠেনি । আজকের দিনটা পেরুলেই শবেবরাতের রাত । বড় বরকতময় এই রাত । আল্লাহর দরবারে খালেস দিলে কোন কিছু চাইলে তিঁনি কবুল না করে পারেন না ।
এই দিনে ভাল মন্দ কিছু খাওয়া ইবাদতের মতই জ্ঞান করে এই গ্রামের মানুষেরা । কুলসুমও এ গাঁয়ের একজন ।
ছলা মুড়ি, হালুয়া কিংবা গোশত রুটি খাওয়া চায় । সকালের মৃদল বাতাসে ভেসে আসে রান্নার সুবাস । উঠানের হাঁস মুরগির খোঁয়াড়ের দরজা খুলে দেয় কুলসুম । প্যাক প্যাক শব্দ করতে করতে বের হয় দুটো হাঁস । কয়েকটা মুরগি ।
কাঁচের বোতল থেকে বিদ্যুৎ কালো নিমের মাজন নিয়ে দাঁত ঘষতে ঘষতে কল পাড়ে যায় । অযু করে ফজরের নামাজ আদায় করে ।
নামাজ শেষ হতেই হাজারো চিন্তা খেলা করে তার মাথায় । সুজনের বাপের কথা মনে হয়, শবে বরাতের দিনে ভালমন্দ কিছু খাবার কথা মনে হয়, মহামারির দিনে মসজিদে এক কেজি জিলাপি দেওয়ার কথাও ভাবে কুলসুম ।
কিন্তু মুসল্লিরা কি মসজিদে আসে এখনো ?
কালকে নাকি মাইকিং করে বাড়িতে নামাজ পড়ার কথা বলে দিয়েছে । এমনটাই বলেছিল সুজন ।
বাঁসি থালা-বাসন কয়টা ধুয়ে সে ব্যাগ হাতে মেম্বরের বাড়ির দিকে রওনা হয় । আজও শেষমেষ চাল পাবে কিনা, মনে তার সন্দেহ ।
কী ধকলটাই না কাল গেল ।
মেম্বারের দেওয়া রিলিফের কার্ডটা শাড়ির কোণে বাঁধা । একবার হাত ছুঁয়ে পরখ করে । নিয়েছে কিনা ।
কাল দশটায় ইউনিয়ন কাউন্সিলে গিয়েছিল সে । নির্ধারিত সময়ে পৌঁছায় কুলসুম ।
ইউনিয়ন কাউন্সিলের মাঠে মানুষের সমাগম দেখে তার চোখ কপালে উঠে যায় ।
এত অভাবী মানুষ দুনিয়ায় !
তাদের জন্য দুঃখ করে নিজের দুঃখটা ভুলে থাকার চেষ্টা করে ।
লাইনে দাঁড়ায় কুলসুম ।
এ তার জীবনের প্রথম অভিজ্ঞতা ।
সুজনের বাবা টাকা পাঠাতে পারছে না । কাজ নাই, কারখানা বন্ধ । মহামারি এ অসুখ ছড়িয়ে পড়ায় এই কয়দিনে অনেক কিছু শিখেছে কুলসুম ।
সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ে অনেকটা । ক্ষুধায় তার নাড়িভুঁড়ি হজম হওয়ার যোগাড় হয় । কিন্তু লাইনে ছেড়ে বের হবার সাহস পায় না কুলসুম । পাছে কেউ এসে তার জায়গায় দাঁড়িয়ে যায় । তাহলে সারাদিনের পরিশ্রমই মাটি । এবার স্যান্ডেলের ওর বসে চটের ব্যাগটা মাথার ওপরে ধরে সে । চৈত্রের কাঠফাটা রোদ । আর পাঁচজনের পরেই সে চাল পাবে । খুশিতে মনটা ডগমগ করে উঠে তার । কিন্তু ইউনিয়ন কাউন্সিলের সচিব আর মেম্বাররা এমন কানেকানে ফিসফাস শুরু করল কেন ?
তাদের চোখের ভাষাও কুলসুমের কাছে সুবিধার ঠেকল না । কিছুক্ষণ পর চেয়ারম্যান সাহেব হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দিল--- চাউল শেষ হয়ে গেছে । যারা পায়নি তারা নিজ নিজ ওয়ার্ডের মেম্বার সাহেবের সাথে যেন দেখা করে ।
কাল চেয়াম্যানের এই ঘোষণা শুনার পর কুলসুমের যে কি খারাপটাই না লেগেছিল । প্রচন্ড একটা ভোঁতা বিবমিষায় মাথা ঝিম ধরে যায় । খালি পেট গ্যাস জমে টইটম্বুর । বাড়িতে এসেই সে হড়হড় করে বমি করে । বুক জ্বালা শুরু হলে
রাতে ভালমত ঘুমও হয়নি তার ।
তাই আজ দ্বিধান্বিত মনে মেম্বারের বাড়ির দিকে পা বাড়ায় কুলসুম ।
২
সুজন ঘুম থেকে উঠে রাজ্যের ক্ষুধা নিয়ে । কোন রকম চোখে-মুখে পানি ছিনিয়ে সে রান্না ঘরে যায় । ডেকচিতে রাখা পান্তা ভাত স্টিলের বাটিতে নিয়ে একটা কাঁচা মরিচ আর লবণ দিয়ে গো গ্রাসে গিলতে থাকে । সব পান্তা সাবাড় করে দেয় সে । তারপরও তার টিকমত পেট ভরে না । দরজা ভেজিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় সুজন। পাশের খেতেই করিম শেখের শ্যালো মেশিন চলছে ।
এক নাগাড়ে ভ্যাট ভ্যাট ভ্যাট শব্দ ।
অবচেতনে সুজন ঐ ছন্দে একটা গান শুনে---
আরে সুজন বন্ধু
ওরে সুজন বন্ধু
সুজন বন্ধু সুজন বন্ধু....।
শ্যালো মেশিনের কাছে এসে আজলা ভরে পানি খায় সে ।
চৌধুরী বাড়ির দুজন কামলা মস্ত একটা ষাঁড় মেশিনের পানিতে গোসল করাচ্ছে । শবে বরাত উপলক্ষে গরুটা কয়েকজন মিলে কেনে ।
তবে সব উদ্যোগ আয়োজন জলিল চৌধুরীর ।
কোরানার ভয়ে সবাই ত্রস্ত ।
প্রথমে গরু জবেহ করার কথাটা প্রতিবারের মত আগ বাড়িয়ে কেউ তোলে না এবার ।
তারপরও সাওয়াব হাছিলের উদ্দেশ্যে এ আয়োজন ।
সবাই মাস্ক পরেছে । সুজনেরও একটা মাস্ক আছে । তবে সে সেটা বাড়িতে রেখে এসেছে ।
সে সাদা একটা সুতির কাপড় নাকে পেঁচিয়ে রেখেছে । হাত ধোওয়ার জন্য সাবান এবং গোশত কাটা ও ভাগ করার সময় সবাই দূরত্ব বজায় রাখে । সুজন বেশ আগ্রহ নিয়ে এটা ওটা করে ।
যোহরের আজান ভেসে আসে গ্রামের জামে মসজিদ থেকে ।
মুয়াজ্জিমের কন্ঠে কান্না জড়ানো দরদ ।
আজান শেষে মাইকে সবাইকে যার যার বাড়িতে নামাজ পড়ার এলান দেন তিনি ।
বাড়ির উঠোনে নিরন্ন মুখে কি যেন ভাবে কুলসুম । বড় নির্দয়ভাবে আজও তাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে ।
এমন সময় মা মা বলে এক রকম চিৎকার করে বাড়িতে প্রবেশ করে সুজন।
হাতে কলার পাতায় মোড়ানে কি যেন ।
লুঙ্গিতে ফুটবলের মত গোল করে কি যেন ধরে আছে সুজন ।
সুজন স্বগত স্বরে বলে দেখ্ দেখ্ মাও---
গোশ, গোশ এই দেখ চালও ।
এই দৃশ্য দেখে ময়ের দুচোখে আনন্দন অশ্রু ঝরতে আরম্ভ করে ।
কিন্তু কাল কি হবে ।
অনাগত ভবিষ্যতের অজানা আশঙ্কায় আবার তার মুখে কালো মেঘ জমে ।
#গল্প: শবে বরাত
#হুসাইন দিলাওয়ার
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
ন্যান্সি দেওয়ান ০৩/০৫/২০২০Darun...
-
অধীতি ১২/০৪/২০২০বাহ,সুন্দর লিখেছেন।কি অপূর্ব প্রকাশ ভঙ্গি।
-
স্বপন রোজারিও (মাইকেল) ১২/০৪/২০২০সুন্দর
-
আব্দুল হক ১০/০৪/২০২০অনেক ভালো
-
ফয়জুল মহী ০৯/০৪/২০২০Good
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ০৯/০৪/২০২০ভালো।