www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

দুঃস্বপ্নের ক্যানভাসে

শেষরাতে ধরড়মড়িয়ে উঠে বসলো সফিকুল হাসান ।  আবার সেই পুরনো দুঃস্বপ্নটা । ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। বিছানা থেকে নেমে ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা এক গ্লাস পানি খেলেন । 
নাহ্,  রাতে আর ঘুম আসবে বলে মনে হয়না ।  মার্চ মাস এলেই যেন দুঃস্বপ্নটা বেশি তাড়া করে ।
বেলকনিতে গিয়ে পায়চারি করতে লাগলেন তিনি । বয়স ষাট্  ছুই ছুই , ঢাকার একটি সরকারি কলেজে দর্শন পড়ান । মাথায় তেল চিকচিকে টাক । চোখে সবসময় ক্লান্তির ছাপ ।  মনে মনে আওড়ালেন --
সেই পুরনো স্মৃতি,  ৪৭ বছর হতে চলল ঘটনাটা ঘটার ।
থ্রী নট থ্রী .303 রাইফেল। একটি আকুতি,  অতঃপর আর্তনাদ ।  তার হাতে একটি মানুষের মৃত্যু !  মৃত তরুণটির চোখ জুড়ে   বিস্ময় আর ভয় । 
ছাত্র জীবনে চৈনিক বামপন্থি রাজনীতির একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন  প্রফেসর সফিকুল হাসান ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বামপন্থি একটি পত্রিকায় লেখালেখি করতেন ।  খুব সক্রিয় রাজনীতি না করলেও মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন শোষণ মুক্তির জন্য প্রয়োজন  মাওয়ের দর্শন ও  বিপ্লব । দেখতে দেখতে এলো মুক্তিযুদ্ধের দিন ।  সোহরাওয়ার্দীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্র নিনাদ ঐতিহাসিক ভাষণ। আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে ।  তবে তখন  শেখ মুজিব কিংবা তার দলের প্রতি আস্থা  রাখতে পারেনি হাসান সাহেবরা । তাদের মনে হতো -- "আওয়ামীলীগ একটি ডানপন্থী,  সুবিধাবাদী দল ।"  তাই তারা আলাদা পদ্ধতিতে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্তে অটল । 
সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং বিশেষ করে ভারতের সাহায্যকে তারা স্বাগত জানালেও সে প্রশ্নে তাদের সন্দেহ ছিল, সংশয় ছিল। তারা কোনো পর্যায়েই চাইনি যে ভারতের সেনাবাহিনী আমাদের যুদ্ধে সরাসরি অংশ নিক।
যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও পরিবার রক্ষার ভার কাঁধে পড়ায় যুদ্ধে যাওয়া হয়নি তার। ১৯৭১ সালে যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয় তখন পালিয়ে ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয় সফিকুল হাসান । 
একটা সিগারেট ধরালেন । ল্যাম্পপোস্টের আলোয়া একটা আলো-আঁধারি পরিবেশ ।  বেলকনির গ্রিলের ফাঁক দিয়ে সিগারেটের ধুঁয়া ছেড়ে পায়চারি করতে করতে তার স্মৃতিপটে ভেসে উঠে উদ্বাস্তু জীবনের স্মৃতিগুচ্ছ ।  সে এক দুর্যোগের দিন বটে ।
খেয়ে না খেয়ে উদ্বাস্তুপুনর্বাসন কেন্দ্রে পরে থাকা ।  আর কত আপন স্বজনের মৃত্য সংবাদ শুনা ।
১৬ ডিসেম্বর যখন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়  দেরি না করে সপরিবারে ঢাকায় ফিরে আসে শফিক সাহেব । মিরপুরে তখনও আত্মসমর্পণ করেনি পাক বাহিনী । এখবর   তখনি হাসান সাহেবের সত্তা জুড়ে প্রবল উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়ল  ।  ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধে যেতে না পারার বিষাদ ।  তিনি যুদ্ধে যেতে পারেনি কারণ তাকে তার পরিবারকে বাঁচারর জন্য পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে ।
২৪ ডিসেম্বর ।
 ঢাকায় তখন মুক্তিবাহিনীর প্রবল উচ্ছ্বাস।  বেছে বেছে বিহারী,পাঞ্জাবী,  রাজাকার হত্যার উদ্দীপনা । পাকিস্তান সমর্থক আর অবাঙালীদের প্রতি জিঘাংসু হাওয়া বইছে সর্বত্র ।
তখন তার এক বন্ধুর কাছ থেকে থ্রী নট থ্রী  সংগ্রহ করে  হাসান । রাইফেল হাতে যেন যুদ্ধের পানে সাওয়ার হচ্ছেন । হত্যা নেশার মাদকতায় ছেয়ে আছে তন্ত্রীগুলো । মোহাম্মদপুরের বিহারী পল্লীগুলোতে তখন ভুতুড়ে অবস্থা ।  কিন্তু থ্রী নট থ্রী .303 রাইফেল হাতে আর কাহাতক স্থির থাকা যায় ?
একটি লাশ চায়! 
বুর্জোয়া গোষ্ঠীর কারো লাশ। অথবা তাদের ঘারনার কেউ হলেও হবে ।
পাকিস্তানিদের  শোষণ- নির্যাতনের ইতিহাসের কথা স্মরণে আসতেই ঘৃনায় রি রি করে উঠে সারা শরীর।
মোহাম্মদপুরের বিহারী পল্লী থেকে একটি সন্ত্রস্ত বালককে আসতে দেখা যায় ।  কাঁধে একটি ব্যাগ ।  পড়নে পাজামা আর শার্ট।
সফিকুল হাসানসহ তার যুদ্ধজয়ী তিনজন মুক্তিযোদ্ধার সমর সজ্জার  সামনে আসতেই চমকে উঠে বালকটি । বয়স ১২/১৩ হবে । গড়ন দেখে আন্দাজ করা  যায় এদেশীয় নয়।
এই তো শিকার!
থ্রী নট থ্রী  উচিঁয়ে ধরে শফিকুল হাসান ।
তারপর একটি গুলির শব্দ ।
একটি দেহের পতন ।
একটি অসম্পূর্ণ  আর্তনাদ !
হয়তো মা হয়তো আম্মি হবে শব্দটা ।
বালকটি নিস্তেজ হয়ে পড়ল।
আর তখনি সম্বিৎ ফিরে পায় হাসান । একটি মানুষ হত্যা  -- কেমনে সম্ভব তার দ্বারা ?  যেন তিনি বাস্তবে ফিরে এলেন ।
আর তখনি বুক থেকে হড়হড়িয়ে একটি দুঃখের হাওয়া চোখ ফেটে বের হতে লাগল।  তারপর অনেক চেষ্টা করেছেন তিনি সেই স্মৃতি ভুলে থাকতে ।  কাজ হয়নি । মার্চ মাস এলেই সেই স্মৃতি সেই দুঃস্বপ্ন তারা করে ফেরে সফিকুল হাসানকে ।
হয়তো ছেলেটির কোন পাপ ছিলনা, হয়তো ছেলেটি বাঙালীই ছিল ।
এমন প্রশ্নে মর্ম জ্বালায় দাহ হতে থাকে শফিকুল হাসান । হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে একটি মানব সন্তানকে হত্যা করা কারো কারো পক্ষে খুবই দুঃসাধ্য কাজ । আর তিনি তাদেরি দলের কেউ ।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৬৪৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৯/০৩/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • ভালো লাগলো।
 
Quantcast