www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

স্মৃতিকথা

আমার মনে পড়ে ঐদিন আমাকে ফিরে আসতে দেখে --আম্মু বুকে টেনে নিয়ে কান্না জুড়ে দিয়েছিল ! অনেকক্ষণ ধরে বুকে চেপে রেখে মাথায় হাত বুলাল। আদর করল। আব্বুকে দেখলাম চেয়ারে বসে আছে । তাঁর চেহারায় কেমন যেন একটা আনুশোচনার ভাব। যদিও মুখে কিছুই বলছিলনা।
: আম্মু বলল--'পাজি ছেলে সারাদিন না খেয়ে কই ছিলি?'
আমিও সেদিন চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি ।
ক্ষুধা আর অভিমানে তলপটের কান্নাগুলো নিরবে চোখ ফেটে বেরিয় পড়েছিল।
সেদিনের সে ঘটনার পর অবশ্য আমি আব্বু-আম্মুর বাধ্যগত সন্তান হিসেবে পরিগণত হয়েছিলাম। আব্বুও বোধহয় মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আর আমাকে মারবে না।
তাই ছোট্ট বেলায় আমার হারিয়ে যাওয়ার ঘটনাটা প্রায়শই চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

তখন ছিল রমজান মাস । শেষের কয়েকটা রোজা বাকি আছে মাত্র । আর কয়েকদিন পরেই ঈদ। চৌত্র মাসের রোজা!
আকাশ থেকে আগুন ঝড়ছে যেন। দীর্ঘ সময় আর তীব্র গরমে অনেকেরই নাকাল অবস্থা।
আমি তখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ি। তখন দুষ্টের সরদার হিসেবে কয়েক গ্রাম জুড়ে আমার বেশ কু-নাম ছিল! ছোট্ট বেলায় এত্ত দুষ্টুমি করেছি যে এখনো গ্রামের লোকজনের সেসব কথা স্মরণে আছে । বিশেষত যে সব লোক আমার ত্রিমাত্রিক দুষ্টুমিগুলো কাছ থেকে দেখেছে তারা -- "বলে তুই এত ভালো হলি কি করে রে পাজির হদ্দ ? " তখন আমি খুব বিব্রতবোধ করি।

সে-সময় সারাদিন বন্ধুদের নিয়ে সারা পাড়া মাতিয়ে রাখতাম। দলবেঁধে ক্রিকেট, ফুটবল, লুকোচুরি আর কত খেলাই না খেলতাম। আমাদের বাড়ির পাশেই একটা পুকুর ছিল। তাতে সারা বছর পানি থাকত। পাড়ে ছিল বড়-ছোট বেশকিছু গাছ
। পুকুর পাড়ের গাছে চড়ে পুকুরে লাফালাফি - দাপাদাপি চলত হরদম।
কার গাছের মৌসুমি ফল পেঁকেছে তার খবরও আসত আমার কাছে ...।

একদিন অনেকক্ষণ পুকুরে গোসল করে গায়ে জ্বব বাঁধিয়ে ফেললাম। সারারাত কি যে যন্ত্রণা! জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বকছিলাম।

অনেক রাতে আব্বু ডাক্তার ডেকে আনলেন।
ডাক্তার আংকেল ব্যবস্থাপত্র লিখে পইপই করে নিষেধ করে দিলেন পুকুরে গোসল করা যাবে না। বিশ্রামে থাকতে হবে।
পরের দিন সকালেই অবশ্যি আমার জ্বর পড়ে গেল। শরীর একটু ভাল হয়ে যেতেই খুব বাইরে ঘুরতে যেতে ইচ্ছা করছিল। আমার চঞ্চল মন শুয়ে বসে থাকতে চাইত না।
কিন্তু আম্মু আর কাজের বুয়ার পাহারাদারিতায় ঘর থেকে বের হওয়ার জো ছিলনা ।
এদিকে ছেলেদের পুকুরে ঝাপাঝাপির শব্দ কানে আসতেই মনটা আনচান করে ওঠে!
ইস, যদি পুকুরের পানিতে কিছুক্ষণ সাঁতার কাটতে পারতাম!
নাহ্, এভাবে ঘরবন্দি থাকা যায় না । বদ্ধঘরে মন একেবার টিকে না ।
এবার জানালা দিয়ে আম আম্মু আর বুয়ার অস্থান লক্ষ্য করতে লাগলাম।
কখন বাইরে যায়। পাহারা দিতে লাগলাম। বুয়া আর আম্মু ইফতারি তৈরি করতে রান্নাঘরে ডুকল। এই তো সুযোগ। দিলাম ভো দৌড়!
পুকুর পাড়ে এসে বন্ধুদের গোসল করা দেখতে লাগলাম । পুকুরে নামতে খুব মন চাইছে, কিন্তু আব্বু আর ডাক্তার আংকেলের নিষেধ অমান্য করার সাহসও পাচ্ছিলাম না।
আবার মনে মনে পুকুরে নামতে আমার তর সইছিলানা। পুকুরে নামব কি নামব না ; আটপাঁচ ভাবছি... । কিছুক্ষণ পরে ডাক্তারের বারণ ভুলে পুকুরে দিলাম লাফ!
পুকুরের পানিতে গা এলিয়ে দিলাম।
আঃ কি আরাম!
যারা আগে থেকেই পুকুরে গোসল করছিল তারা ঘটনার আকস্মিকতায় অবাক হয়ে গেল। পরমুহূর্তেই তারা আমার সাথে যোগ দিল।
গোসল করতে করতে প্রায় কয়েকটা ঘন্টা মুহূর্তেই চল গেল। হটাৎ দেখি বাঁশের কঞ্চি হাতে আম্মু তেড়ে আসছে।
'এই যাঃ আম্মু দেখে ফেলল ; কপালে আজ কি যে আছে। '
আমি পুকুরের অন্য পাড় দিয়ে উঠে এসে দিলাম দৌঁড়।
সে যাত্রায় বেঁচে গেলেও ভয়ে বাড়িতে ঢুকতে সাহস পাচ্ছিলাম না। তাই ছোট কাকুর বাড়িতে আমার কাকাতো ভাইদের সাথে লুকোচুরি খেলতে আরম্ভ করলাম। এদিকে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হব হব করছে। ইফতারির সময় খুব নিকটে।
আমাদের বাড়ির একটা রেওয়াজ ছিল রোজা না করলেও সবার সাথে বসে ইফতারি করা।
রোজা না করলেও ছোটবড় সবাই একসাথে বসে ইফতার করতে হতো।

কাকুর বাড়ির আঙিনায় আমরা সবাই মিলে লুকোচুরি খেলায় এত মত্ত হয়ে ছিলাম যে আম্মুর হাঁক ডাক শুনতে পায়নি। যদিও কাকুদের বাড়ি আর আমদের বাড়ি বেশি দূরে নয়।
তখন আমার লুকোনোর পালা।
আমি একটা গাছের মগডালে পাতার ফাঁকে লুকিয়ে ছিলাম। এদিকে আম্মু ডাকতে ডাকতে হয়রান।

হঠাৎ দেখি আমার বাকি খেলার সাথিরা দুদ্দাড় করে দৌড়ে পালাচ্ছে।
নিচে কি হচ্ছে তা দেখার জন্য নিতে নেমে আসতেই দেখি আব্বু রুদ্র মূর্তি ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে।
আব্বুকে লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মনে মনে দোয়া দরূদ পড়তে লাগলাম।
যদিও শেষ রক্ষা হয়নি।
সেদিন রাতে আব্বু আমাকে আচ্ছা মত প্যাঁদানি দিল।
যদিও ইতোপূর্বেও আব্বুর হাতে বহুবার উত্তম অাধ্যম খেয়েছিলাম বৈকি।
কিন্তু ওদিনের আব্বুর মাইর আর বোকাঝোকায় কেন যেন খুবি অভিমান করলাম। সাথে মনে হয় একটু আপমানবোধও কাজ করেছিল।
ঐদিন সারারাত ভাতন খাইনি।
আম্মু এসে ইনিয়েবিনি আম্মু এসে ইনিয়েবিনিয়ে কত চেষ্টা করল, কিন্তু আমি খাইনি।

আমার শুধু মনে হতে লাগল আমাকে কেউ ভালোবাসা না ! আমি আর এই বাড়িতে এক মুহূর্তও থাকব না। কালই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। কোথায় যাবো তা অবশ্যি ঠিক করা হয়ে ওঠেনি । তবে শুনেছি ঢাকায় নাকি বড় মামা থাকে । আমি ঢাকায় চলে যাবো। বড় মামা আমাকে কত আদর করে! আমাদের বাড়িতে আসলে কত্ত কিছুই না নিয়ে আসে আমার জন্য। প্রতি ঈদে তো জামাকাপড় কিনে দেয়।
সেদিন রাতেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলাম হারিয়ে যাবো।
ব্যাগে একসেট কাপড় আর বিপদেআপদে ব্যবহার করার জন্য একটা স্ক্রু ড্রাইভার ডুকিয়ে নিয়েছিলাম।
কেন যেন তখন আমার কাছে মনে হয়ে ছিল এই স্ক্রু ড্রাইভার দিয়ে হাতিও ঘায়েল করা সম্ভব। মানুষ তো বটেই।
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম।
আমাদের গ্রামের পথ পেড়িয়ে রানীর হাটে এসে পৌঁছালাম। রানীর হাট একটা ছোট মফস্বল। এই হাটে আমি আগেও আব্বুর সাথে এসেছি অনেকবার। কিন্তু কখনো হেঁটে আসিনি। রানীর হাটের দূরত্ব আমাদের গ্রাম থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার। তাই কত ঘন্টা যে হেঁটেছি সে-সময় ঘড়ি না থাকায় আন্দাজ করতে পারিনি।
গ্রাম থেকে রানীর হাটে পর্যন্ত এই রাস্তাটা আমার মোটামুটি চেনা। সেদিন আমি মনে মনে কল্পনা করেছিলাম : আগে জেলা শহরে যাবো, সেখান থেকে বাসে করে সোজা ঢাকা। মুশকিল হলো জেলা শহরে যাওয়া রাস্তাটা আমার তেমন চেনা ছিলনা । অনেক দিন আগে আব্বুর সাথে মোটরসাইকেল করে একবার জেলা শহরে গিয়েছিলাম। তাই পথটা আবছা আবছা মনে আছে।
পকেটে মাত্র দশ টাকার একটা নোট। তাই দিয়ে রানীর হাটে দশ টাকা দিয়ে দু'টা পরোটা খেয়েছিলাম। আব্বু হাটে নিয়ে আসলে যে- হোটেলটায় আমাকে মিষ্ট, সন্দেশ, জিলিপি খাওয়াত ঐটায় ; খাওয়া শেষ করে আবার হাঁটতে শুরি করলাম।
মাথা হেঁট করে পিচঢালা বড় রাস্তা দিয়ে শুধু হাঁটছি আর হাঁটছি।
এদিকে কখন যে সূর্যটা পশ্চিম আকাশে অনেকটা হেলে পড়েছে। খেয়াল রাখিনি। আসলে তখন আমি অভিমানের ঘোরে মগ্ন ছিলাম। দিনের আলোকে আস্তে আস্তে গ্রাস করতে চাইছে আঁধার। চারপাশটা কেমন যেন ফিকে হয়ে আসছিল। এদিকে কাল রাত থেকে পরোটা ছাড়া কিছুই পেটে পড়েনি। মাঝপথে একটা মসজিদের টিউবওয়েলে পানি খেয়েছিলাম এই-যা। আর পাদু'টাও আর সইছে না। ব্যথায় টনটন করছে। মাথা ব্যথা অনুভব করলাম। তখন মনে হয়েছিল --
পৃথিবীটা যেন ছোট হয়ে আসছে। মায়ের মুখটা মনে পড়তেই বুকের মধ্যে একটা চিনচিন ব্যথা অনুভব করলাম। এদিকে রাস্তার আশেপাশে একটা বাড়িও নেই। রাস্তার দু'পাশে জঙ্গলের মত একটা জায়গা। কেমন গা শিরশির করা একটা পরিবেশ। ব্যগ থেকে স্ক্রু ড্রাইভার বের করে হাতের মুঠোয় রাখলাম। যেন আগাম লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা। যদিও প্রতিপক্ষ সম্পর্কে কোন ধারণায় ছিলনা তখন।
হটাৎ খুব মন খারাপ হয়ে ওঠেছিল!
রাস্তার পাশে বসে কাঁদতে লাগলাম।
এমন সময় আমার নাম ধরে কে যে ডাকল!
আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি পল্লব দা। সাইকেল নিয়ে সিটে বসা অবস্থায় পা মাটিতে রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
পল্লব দা কে দেখে আমি ডুকরে কেঁদে ওঠলাম।
পল্লব দা'কে কেঁদে কেঁদে বললাম : আম্মুর কাছে যাবো!
পল্লব দা আমাদের গ্রামের দাদা। মাঝেমধ্যে আমাদের সাথে ক্রিকেটও খেলত। আমাকে খুবই আদর করত।
সেদিন জেলা শহরে কি যেন একটা কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছিল।
সেই পল্লব দাদার সাথে এখনো দেখা হলে আমাকে বলে -- "তুই কি পালিয়ে গিয়ে মেকানিকের কাজ করতে চেয়েছিলি নাকি রে, নাইলে ঐদিন স্ক্রু ড্রাইভারটা নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছিলি ক্যান.? "
পল্লব দা'কে কে বুঝাবে যে ওটা ছিল আমার আত্নরক্ষার অস্ত্র!
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৭৭৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২০/১১/২০১৭

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • Rabia Onti ০৬/১২/২০১৭
    অনেক সুন্দর গল্প
  • ধন্যবাদ প্রিয়...
  • সোলাইমান ২১/১১/২০১৭
    গল্প পাঠে মুগ্ধ হলাম।
    সুন্দর উপস্থাপনা।
    প্রিয় কবিকে প্রীতি ও শুভেচ্ছা জানাই।
  • অপূর্ব লেখা
 
Quantcast