ইচ্ছে পূরণ
আজকে একটা ছোট্ট ছেলের গল্প বলি শোন । একটা ছোট্ট ছেলে, বয়স আট কি দশ । বাড়িতে ঠাকুমাও নেই আবার কোন বোনও নেই তাই ঠাকুর ঘরের সব কাজ তাকেই করতে হতো । আগে অবশ্য তার মা নিজে করতেন কিন্তু এখন আর করেন না । মা সবসময় বলেন, “খোকা, এখন তুমি যথেষ্ট বড় হয়ে গেছ, তাই ঠাকুরের কাজ তোমাকেই করতে হবে।‘ খোকা অবশ্য এ নিয়ে মন খারাপ করেন না, বরঞ্চ বেশ খুশী মনে, সকালে ঠাকুর জাগায়, ফুল তুলে, স্কুলে জাওয়ার আগে স্নান সেরে ঠাকুর ঘরে ঠাকুরকে পুজো দিয়ে তবেই সে খেয়ে দেয়ে স্কুলে যায় । এ কাজগুলো তার বেশ ভালোই লাগে, উপরন্তু মামা বাড়ির দিদা বলে গেছেন, মন প্রান দিয়ে ঠাকুরকে পুজো করলে, ঠাকুর দেখা দেন, আশীর্বাদ করেন এমনকি মনের আশা পুরণ করেন । বাবা একদিন গল্প করেছিলেন, রামকৃষ্ণ তাঁর ছোট বেলায় ঠাকুর সেবা দিয়ে ঠাকুর খাচ্ছেন না দেখে লাঠি নিয়ে মারতে গেছিলেন বলে ঠাকুর এসে খেয়েছিলেন । তাই খোকা, মন প্রাণ দিয়ে ঠাকুর সেবা করেন, যথেষ্ট ভক্তি ভরে পূজো আর্চ্চা করেন । মা যেমন যেমন করে পূজো দিতে বলেন সে ঠিক সেভাবেই পূজো দেয় । ঠাকুর ঘরে দরজায় খিল দিয়ে, ঠাকুরের কাছে নিজের মনের কথা বলে, কোন কোন সময় মায়ের সঙ্গে রাগ করলে কেঁদে কেঁদে ঠাকুরের কাছে বিচার প্রার্থীও হয়, গত বছর পরীক্ষায় ফার্ষ্ট হতে পারেনি বলে বাবার বকুনি খেয়ে ঠাকুরকে বলে রেখেছে, এমনিতে এবছর শুধু দু’নম্বরের জন্য প্রথম হতে পারেনি তবে আগামী বছর যদি এমন হয় তবে সকলকে না দেখিয়ে ঠাকুরকে তিন দিন লবণ খাইয়ে দেবেন । খোকা বেশ টের পায়। ঠাকুর তার কথা শোনে, কখনো কখনো মুচকি মুচকি হাসে কিন্তু এখনো সরাসরি কথা হয় নি । তার বিশ্বাস, সে যেহেতু মন প্রান দিয়ে বিশ্বাস ভরে ঠাকুর সেবা দেন তাই একদিন না একদিন ঠাকুর তার সঙ্গে কথা বলবেনই । ঠাকুর ঘরে রোজকার মতো নকুলদানা, কিসমিস দিয়ে ভোগ লাগিয়ে সে প্রায়ই ঠাকুরের বিগ্রহ মানে ছবির দিকে একমনে তাকিয়ে থাকে, বিরবির করে ঠাকুরকে অনুরোধ করে, ‘ঠাকুর খাও, ঠাকুর আমার সঙ্গে কথা বল, আমাকে দয়া কর,আমায় দেখা দাও’ ইত্যাদি ইত্যাদি । কোন কোন দিন পূজো দিতে দেরী হয়ে যাচ্ছে দেখে মা এসে বকুনি দিয়ে যায় কিন্তু কেউ কোন দিন খোকার মনের বিশ্বাস আর আচরণের তফাৎ লক্ষ্য করে নি । এভাবেই দিন যাচ্ছিল, খোকা এবারে আরেকটু বড় হল, কিছু বুজতে শুরু করেছে , চাহিদা দিনে দিনে বাড়ছে ঠিকই কিন্তু ঠাকুর সাড়া দিচ্ছে না । শেষে একদিন যখন খোকা ঠাকুর ঘরে হত্যে দিলেন মানে পূজো দিয়ে প্রণাম করে ঠাকুরকে মনে মনে বললেন, “ঠাকুর তুমি দেখা না দিলে বা কথা না বললে আমি আর এই প্রণাম থেকে উঠবো না, ভাত খাবো না, স্কুলে যাবো না’; তখন ঠাকুর অগত্যা দৈববাণী করলেন,”আরে বোকা ছেলে উঠ, ঠাকুরকে মনের বিশ্বাস আর দৃঢ়তায় পাওয়া যায়, কল্পনায় কাছে পেতে হয়, ঠাকুর এমনি এমনি আসে না, তুর ভক্তি , নিষ্ঠা , শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসে আমি তুষ্ট বটে কিন্তু আমি তো তুকে দেখা দিতে পারবো না তবে এখন থেকে জেনে রাখ, তুই যখনি দু-চোখ বুজে আমার এই বিগ্রহের সামনে প্রণাম করে কিছু চাইবি আমি তুর সেই চাওয়াকে পূরণ করবো, মনে রাখবি তুর এই চাওয়া যেন মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়, তাতে যেন কারো অমঙ্গল না হয় আর তুর এই চাওয়া পাওয়ার কথা যেন আর কেউ না জানে; আমার এই শর্ত ভঙ্গ হলে কিন্তু তুই শত চেষ্টা করেও মনের আশা যেমন আর পূরণ করতে পারবি না তেমনি আমার দেখাও পাবি না।“ খোকা প্রণাম সেরে উঠে চারিদিকে তাকিয়ে কাউকে দেখতে পেল না, সে লক্ষ্য করলো বাবা বাড়িতে নেই, মা রান্না ঘরে যেমন রান্না করছে ঠিক তেমনি ব্যাস্ত আছেন । তাহলে কি সত্যি সত্যিই ঠাকুর কথা বললো ! ভাবতে ভাবতে আর কোন সঠিক উত্তর না পেয়ে খোকা ঠাকুরের সেই দৈববাণী গুলোর কথা আরেক বার ভালো করে ভাবলো, মনের রাখার জন্য দুচোখ বুজে ঠাকুরকে আরেক বার প্রণাম করলো । খোকার কোন পড়া যদি বার বার পড়েও মুখস্থ না হয় তখন সে এমন করে , দুচোখ বুজে ঠাকুরকে প্রণাম করে পড়াটা মুখে আউড়ালে মুখস্ত হয়ে যায়, খোকা এখানেও তাই করলো । এবারে সে এই কথাগুলোর সত্যতা জাচাইয়ের জন্য মনে মনে একটা ফন্দি আটলো । সে জানে তার বাবা মা খুব সচেতন অভিভাবক তাই তাকে স্কুলে কখনো বাইড়ের খাবার খেতে দেন না এমনকি কোন টাকা পয়সাও দেয় না কিন্তু তার খুব শখ স্কুলের পাশের হীরু কাকুর দোকান থেকে লেইজারের সময়ে টিফিন কিনে খাবে । তা সে আজকে ঠাকুরের কাছে প্রনাম করে মনে মনে টিফিন খাওয়ার জন্য দশ টি টাকা চাইলো । পূজো শেষে খাওয়া দাওয়া করে খোকা যখন স্কুলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত ঠিক তখনি তার একটা দাদু আসলো ওদের বাড়িতে বেড়াতে, দাদু মানে বাবার কাকু, খোকাকে খুব আদর করে, খোকা স্কুলের জন্য বেড়িয়ে যাচ্ছে দেখে মায়ের অগোচরেই তাকে দশটি টাকা দিলো স্কুলে টিফিন করার জন্য । খোকা তো খুব খুশী হলো এবং মনে মনে ঠাকুরকে ধন্যবাদ জানালো । স্কুলে গিয়েই সে টিফিন টাইমের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগলো, স্কুলে ঢোকার সময়েই হীরু কাকুর দোকানের দিকে তাকিয়ে মনে মনে একটা পরিকল্পনা করে রেখেছিল সে, আজ বেশ মজা করে পুরী-সব্জি খাবে সে । কিন্তু কি ভাগ্য ! আজকে টিফিন টাইমের একটু আগে হেডস্যার এসে জানিয়ে দিয়ে গেলো, কে যেন একজন গন্যমান্য ব্যাক্তি এসেছে, যার জন্য আজকে কোন ব্রেক হবে না । মন খারাপ করেই সব ক্লাস শেশ করে খোকা বাড়ি আসলো । ঠাকুরকে রাতের পূজোর সময়েই অভিযোগটা যদিও জানিয়ে রেখেছিল তবে পরেরদিন স্কুলে যাবার আগে ঠাকুরকে বেশ শাঁসিয়ে গেলো, আজকে যদি টিফিন আওয়ার না পরে তবে রাত্তিরে এসে কিন্তু লবন ভোগ দেবো । খোকা যথারীতি স্কুলে গেলো, চার ক্লাসের শেষে টিফিনের ঘন্টা বাজতেই জানা গেলো গতকাল যে অতিথি এসেছিল, উনারা খুশী হয়ে আজকে স্কুলের সকল ছাত্র ছাত্রীদের জন্য স্বাস্থ্যকর টিফিনের ব্যবস্থা করে গেছেন তাই আজকে আর স্কুলের গেইট খোলা হবে না, সবাই স্কুলেই টিফিন করবে । খোকা স্কুলের টিফিন খেল, বেশ সুস্বাদু বটে কিন্তু হীরু কাকুর দোকানের খাবার খাওয়ার ইচ্ছাটা তার পূরণ হলো না বলে মনটা খারাপ ছিল । বাড়িতে এসে রাত্তিরে ঠাকুর পূজো দেয়ার সময়ে লবনের কথা মনে হলেও খোকা নিজে নিজেই হেসে ফেললো, ঠাকুরতো টিফিন আওয়ারের ব্যবস্থা ঠিকই করেছেন কিন্তু হীরু কাকুর দোকানের টিফিন খাবে সে কথাতো আর ঠাকুরকে বলা হয় নি, তাই বোধহয় আজকেও আশাটা পূরণ হলো না । পরেরদিন স্কুলে যাবার সময় খোকা ঠাকুরকে প্রণাম করে জানালেন, আজকে যদি আমি টিফিন আওয়ারে হীরু কাকুর দোকানে না খেতে পারি তবে ঠাকুর রাত্তিরে এসে পূজোই দেব না তোমাকে । খোকা যেন ঠাকুরের মুখের সেই মুচকি মুচকি হাসিটা আজকে আবার দেখতে পেলেন, বুজলেন আজকে আর অন্যথা হবে না । স্কুলে গেলেন, ক্লাস করলেন, টিফিন আওয়ার এলো, ঘণ্টা বাজলো সবার সঙ্গে হৈ হৈ করে গেইটের বাইড়ে হীরু কাকুর দোকানে গেলো সে, আজকে পুরী-সব্জি খাবেই । কিন্তু হায় ! আজকে নাকি অক্ষয় তৃতীয়া, হীরু কাকু আজকে দোকানে পূজো দিয়েছে তাই সকলকে ফলমূলের প্রসাদ খাওয়াচ্ছেন, আজকে কোন টিফিনের ব্যবস্থা নেই । খোকা পকেটে হাত দিয়ে দাদুর দেওয়া দশ টাকার নোটটাকে হাতের আঙ্গুল দিয়ে কয়েকবার ঘষলেন, ভাবছিলেন ফেলে দেবে কিন্তু না শেষ পর্যন্ত আগামীকাল শেষ চেষ্টা করবে বলে ঠিক করে প্রসাদ খেয়ে স্কুলে ফিরে গেলো । এভাবেই তিন দিন গত হয়ে গেল, রাতে পূজা নে দেবার কথা খোকা ভাবেনি কেননা সে তো হীরু কাকুর দোকানের খাবারই খেয়েছে তাই ঠাকুরের কোন দোষ সে খুঁজে পেলো না । পরের দিন আবার স্কুলে জাওয়ার সময় একেবারে স্পষ্ট করে আস্তে ধীরে ঠাকুরের কাছে প্রণাম করে বললনে, ‘ঠাকুর আজকে স্কুলে যাচ্ছি, সবগুলো ক্লাস হওয়া চাই, টিফিন আওয়ার হতে হবে, আমি হীরু কাকুর দোকানে যাবো, আমার পকেটে যে দশটি টাকা আছে তা দিয়ে আমি হীরু কাকুর দোকান থেকে পুরী –সব্জি কিনতে চাই, যদি তা না হয় তবে বুজবে আমি কেমন দুষ্ট ছেলে, আজকে রাত্তিরে এসে তোমাকে আমি ভেঙ্গেও ফেলতে পারি’। আজকেও কথাগুলো বলে সে আবার ঠাকুরের মুখের দিকে তাকালো, ঠাকুরের মুখের সেই মুচকি মুচকি হাসিটা দেখে সেও হাসি মুখে স্কুলে গেলো, না আজকে আর কোন অন্যথা হয় নি, টিফিন আওয়ার হল, হীরু কাকুর দোকানে গিয়ে সে টিফিন নিল আর মনে মনে ভাবছে শেষ পর্যন্ত আজকে তার আশা পূরণ হলো কিন্তু ঠি তখনি দেখলো দোকানের বাইড়ে একটা বাচ্চা ছেঁড়া ময়লা জামা কাপড় পরে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে আর তার বড় বোনটা যে কিনা খোকার প্রায় সমবয়সী, সেও ছেঁড়া ময়লা পোশাকেই আছে, বাচ্চাটাকে মারছে , তবুও বাচ্চাটা জেদ ধরেছে সে দোকানের পুরী খাবেই, যদিও অন্য কেউ সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করছে না কন্তু খোকা এই দৃশ্যটা দেখে আর নিজে খেতে পারলো না,হাতের টিফিনটা সেই বাচ্চাটাকে দিয়ে দিলো এবং সে ক্লাসরুমে ফিরে গিয়ে নিজে মায়ের দেয়া টিফিন খেয়ে নিলো । আজকে বাড়িতে এসে আর কোন অভিযোগ জানালো না কাউকে । পরের দিন ঠাকুরকে প্রণাম করে কাঁদো কাঁদো ভাবে ঠাকুরের কাছে জানতে চাইল, কেমন এমন হল ! কোন উত্তর না পেয়ে সে যখন সিদ্ধান্ত নিল, আজকে আর স্কুলে যাবে না, ভাত খাবে না, তখন ঠাকুর আবার আগের মতোই আরেকটা দৈববাণী ক্রলেন,”খোকা, আমি কিন্তু আমার কথা রেখেছি, তুই দশ টাকা চেয়েছিলি, পেয়েছিস, এছাড়াও যেদিন যেরকম ভাবে বলেছিস, তুর মনের আশা কিন্তু পূরণ হয়েছে ।‘ খোকা কিছুতেই বুজে উঠতে পারলো না, একটা সাধারন ইচ্ছাও পূরণ করতে পারলো না সে , কেন ?, ঠাকুরকে আবার প্রশ্ন করলো, ঠিক আছে কিন্তু আমার এই ইচ্ছা পূরণে ভেলকিবাজি হল কেন, প্রতারণা কেন ? আমি কেন সেই টিফিনটা খেতে পারলাম না ? এই বুজি আমার বিশ্বাস আর ভক্তির ফল ? ঠাকুর আবার বললেন,” সব কিছুরই একটা নির্দিষ্ট সময় আছে, কোন কিছুই সময়ের আগে যেমন চাওয়া ভাল নয় তেমনি পাওয়াও ভাল নয় । তুই, যে টিফিনটা খেতে চাইছিলি তাতে না আছে কোন মহৎ উদ্দেশ্য না আছে কোন ভাল পরিকল্পনা । বাবা মায়ের কথার অবাধ্য হওয়ার কি কোন প্রয়োজন আছে ! তাতে কি আরোও কোন ভাল হতে পারে ! এটা হচ্ছে অপরিণত চাওয়া¸ যদিও তুই তুর অপরিণত বয়সের অবুজ মনের পবিত্র ভক্তি দিয়ে আমার মন জয় করতে পেরেছিস কিন্তু এই ভক্তির ফল হিসেবে পাওয়া এই আশীর্বাদ অন্য অনেক ভাবে নিজের ও পরিবারের এমন কি সমাজ ও দেশের ভালো চাওয়ার মধ্যে দিয়ে পূরন করতে পারতি ! কিন্তু তুই যেহেতু এখনো অনেক অনেক বেশী অপরিণত তাই তুর চাওয়ার মধ্যেও সেই অপরিনত ভাবটা ছিল, তাই আজকে থেকে মনে রাখবি, প্রকৃতির নিয়ম হচ্ছে বড় নিয়ম, তার উপরে আর কোন চাওয়া পাওয়া হচ্ছে অনিয়ম, তাই অনুশাসনের ধারাকে মান্যতা দিয়েই সময়ের সাথে পৃথিবী যেমন সূর্যের চারিদিকে নির্দিষ্ট নিয়মে ঘুরে তেমনি মানুষও, তার বাইড়ে গেলেই ভেলকিবাজি পেতে হয়, তুই সুবোধ বালক, ভাল করে পড়াশোনা করলে জীবনে অনেক বড় হয়ে সমাজকে আগামীর পথ দেখাবি, এই হল আমার বর বা আশীর্বাদ, নিয়মিত পূজো দিবি কিন্তু আর কোন দিন কিছু চাইবি না , যা পাওয়ার তা প্রকৃতির নিয়মেই পাবি তবে কথোর পরিশ্রম বা সাধানার বিকল্প নাই, মনে রাখবি”। এই কথাগুলো বলেই সেই যে ঠাকুরের দৈববাণী শেষ হলো, আর কোণদিন শোনা গেল না কিন্তু এখন আর খোকার এরূপ কোন দৈববাণী শোনার আগ্রহও নেই । যেমন চলছিল রোজকার পূজা তেমনি চলছে খুশীম্নে আপনমনে ।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
প্রিয় গল্পকার ও কবির জন্য শুভেচ্ছা অঢেল।