www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সম্পর্কের গেঁড়ো

এখন আর সেই আগের মতো ব্যস্ত নই, তবে আভিজাত্যে ঘাটতি নেই । পেশাগত ভাবেও অনেকটা ম্যাচিয়ুর তাই এখন আগের মতো খুব খুব বেশী খাটাখাটি না করলেও ব্যাবসা বাণিজ্য মন্দ বলা যায় না । শারীরিক ভাবে ততটা ষ্ট্যাবল নই বলে এখন নিয়ম করে ভোর বেলা হাটাহাটি করা, শরীর চর্চ্চা করা, সময় মতো অসুধ খাওয়া এমনকি স্নান-খাওয়া-ঘুম এগুলো একেবারে রুটিন মাফিক চলে বটে । এত বেশী শৃঙ্খলাপূর্ণ জীবনে আছি বলেই বিশেষ করে কৈশোরের সেই সব অবহেলিত, বেপরোয়া জীবন যাপনের কথাগুলো স্মৃতিপটে ভেসে উঠে বার বার । আজকে ভোর বেলা হাঁটতে বেড়োতে একটু দেরী হয়ে গেছিল বটে তবে ততটাও দেরী হয় নি , যথারীতি ভোরের স্নিগ্ধ হাওয়ায় শরতের শিশির ভেজা সকাল রুপালী সূর্য রশ্মী গায়ে মেখে গায়ের কাঁচা রাস্তায় যখন মনে মনে আমার প্রতিদিনের সঙ্গীদের মিস করছিলাম ঠিক তখনি পেছন থেকে একটা বয়স্ক মানুষের মিষ্টি আহ্বান কানে ঠেকলো ,'বাবু শুনছেন?' আমি পেছন ফিরে তাকালাম , ৬০/৬৫ বয়সের একটা লোক, গায়ে আধ ময়লা পায়জামা পাঞ্জাবী, মুখ ভর্ত্তি খোঁচা খোঁচা সাদা দাড়ি, হাতে একটা লম্বা ছাতা নিয়ে এগিয়ে আসছেন । আমি ফিরে তাকাতেই আমার দিকে তার দৃষ্টি দেখে নিশ্চিত হলাম, তার এই আহ্বান আমাকে উদ্দেশ্য করেই ছিল । লোকটাকে আমার বেশ চেনা চেনা লাগছিল বটে কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছিলাম না । ততক্ষণে আমাদের দুরত্ব অনেকটা কমে গেছে, সেই বয়স্ক লোকটা আরোও দু-কদম এগিয়ে এসে ছাতা সহ হাতটা এমন ভঙ্গিতে উপরে দিকে তুললেন যেন উনি আমার নমস্কারের প্রতিউত্তর দিচ্ছেন, যদিও আমি নমস্কার জানাইনি তবে ভঙ্গিটা দেখে আমার কর্তব্য অনুভূতি জাগ্রত হলো, নমস্কার জানানো উচিৎ ছিলো এই ভেবে এবারে বললাম,'নমস্কার কাকু, কিন্তু আমি ঠিক আপনাকে...' না আর বেশী এগোতে হল না, উনি বুজে গেছেন যে, আমি উনাকে চিনতে পারিনি । তাই একগাল হেসে উনি বললেন,'বাবু, আমি যদি ভুল না করি, আপনি বোধহয় লিঙ্কন বাবু, মোটরষ্ট্যান্ডে আপনাদের একটা ষ্টেশনারী দোকান ছিল ?"
বুজতে পারলাম, ভদ্রলোক অনেক দিন আগের কথা বলছেন । আমি যখন সবে মাত্র মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছিলাম তখন আমি আমার বাবাকে সাহায্য করতে দুপুর বেলা নিয়মিত দোকানে যেতাম । সেই সময়ের কথাই উনি বলছেন । এক লহমায় অনেক কিছুই মনে পরে গেল, তখন যেহেতু আমি প্রায় মাস কয়েকের জন্য একেবারে অবসর , দুপুর বেলা দোকানেও খুব একটা ভিড় থাকতো না এবং বাবা যেহেতু ভোর বেলায় গিয়ে দোকান খুলতেন তাই ১১/১২ টার দিকে আমি দোকানে গেলে বাবা সেই সময়ে বাড়ি এসে স্নান খাওয়া শেষ করে একটু রেষ্ট নিয়ে দোকানে গেলে আমার ছুটি হতো । যদিও কালের চাকায় এখন আমার বাবাও নেই, সেই দোকানও নেই আর আমিও সেই ব্যবসার ধারে কাছেও নেই, তবুও সেই সময়টাও তো আমার জীবনেরই একটা অঙ্গ ! মনে করার চেষ্টা করছিলাম, লোকটা কে ! সেই সময়ে আমার বেশ কিছু বয়স্ক বন্ধু ছিল, ওদের সাথে বন্ধুত্ব হওয়ার পেছনেও একেকটা কাহিনী ছিল । একজন ছিল, জ্যোতিষী, বড় মাপের কিছু না, একদিন দুপুর বেলা ভীষন তৃষ্ণা আর ক্ষুদা নিয়ে আমার দোকানের সামনে এসে সেদিনের করুন কাহিনী বলেছিল, আমি আমার টিফিনের কিছু খাবার মানে একটা রুটি ও জল দিয়েছিলাম বলে সেই যে বন্ধু হল, তারপর রোজদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে হতো তার , রোজ একটা করে আমার ভবিষ্যৎ বানী করতো, এখন প্রায় সব গুলিই সত্য না হলেও অনেক গুলোই ফলেছে বলতে পারি । একজন ছিল সম্ভ্রান্ত ঘরের কিন্তু হালে ভিক্ষুক ধরনের একটা লোক, তাকেও মঝে মধ্যে আমি চা খাওয়াতাম বলে এক সময়ে ভীষন বন্ধুত্ব হয়ে গেছিল । আরেক জন মাঝ বয়সী ভদ্রলোক ছিল, যার কাছ থেকে বই ভাড়া নিয়ে পড়তাম মানে সে সময়ে শহরে এই রেওয়াজটা ছিল । উনি কিছু চটি বই যেমন বাল্যশিক্ষা, ধারাপাত, সহজ বাংলা পাঠ এই ধরনের ছোট ছোট বই, পঞ্জিকা ইত্যাদি সহ আরো কিছু ছোট ছোট গল্পের বই যেগুলোর মূল্য খুব বেশীদুর হলে ২০/২৫ টাকা, এগুলো গাড়িতে গাড়িতে বিক্রি করতেন , আর যারা স্থায়ী দোকানদার যারা বই পড়তে আগ্রহী মানে ব্যবসার ফাঁকে ফাঁকে অবসর সময়ে গল্পের বই পরেন তাদেরকে উনি উনার কাছ থেকে পাঠকের পছন্দের বইটি এক দিন মানে ২৪ ঘন্টার জন্য ভাড়া দিতেন, ভাড়া ছিল মাত্র এক টাকা । বই গুলোও ছিল খুব মজার মজার, লেখক কে জানি না তবে নামগুলো ছিল এরকম, বারো হাত কাকুড়ের তের হাত বিচি , পেত্নীর বিয়ে, হামদু ভুতের গল্প ইত্যাদি ইত্যাদি । প্রসঙ্গতঃ বলে রাখি , তখনকার সময়ে মোবাইল ফোন ছিল না , আর ছিল না বলেই মানুষের অবসর সময় কাটানোর একটা দারুণ সঙ্গী ছিল বই । এই বই ভাড়ার প্রসঙ্গটি মনে আসতেই আমার সামনে দাঁড়ানো বয়স্ক ভদ্রলোকের কথা মনে পরে গেলো , হ্যাঁ উনিই সেই লোক, দিনের পর দিন আমি যার কাছ থেকে বই ভাড়া নিয়ে পড়তাম, আমার আগ্রহ দেখে উনার বাড়ি থেকেও বেশ কিছু রবীন্দ্র রচনাবলী,শরৎ রচনা সমগ্র এনে আমাকে দিতো । এসব বই নাকি উনার মেয়ে পড়তেন । মনে পরে যাওয়াতে আমার তো ভীষন ভীষন ভালো লাগছিল উনার সাথে দেখা হয়ে, পা ছুঁয়ে প্রণাম করলাম, জড়িয়ে ধরে ষ্ট্যান্ডের কাছে চায়ের দোকানে নিয়ে গেলাম যদিও তখনো চায়ের দোকান খোলা হচ্ছিল মাত্র । অনেকক্ষণ পাশাপাশি বসলাম, স্মৃতির পাতার অমলিনতা কাকে বলে উনি উনার গল্পে গল্পে বুজিয়ে দিলেন আমায়, ছোট ছোট প্রতিটি মুহুর্ত নিখুত ভাবে বর্ণনা করলেন । আমি সেই দিন গুলোতে হারিয়ে গেলাম আফসোস হল কিনা জানিনা কিন্তু ভীষন আবেগ জেগে উঠেছে আমার । উনি আমার বর্তমান অবস্থা,মা-বাবার কথা সব কিছুর খোঁজ নিলেন আমিও নিলাম । কালের পরিবর্তনে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন উনি আর সেই বইয়ের ব্যবসা করেন না, সেই ব্যবসার অস্ত্বিত্ত্বও এখন আর নেই , যেমন নেই টেলিফোন বুথ বা পি সি ও অনেকটা এইরকম। উনার মেয়েটা ভীষণ মেধাবী ছিল বটে কিন্তু অভাবের কারনে মেয়েটাকে অল্প বয়সেই পাত্রস্থ করে দিয়েছিলেন উনি, যদিও পেশায় শিক্ষক স্বামীর গৃহে ভালোই আছেন মেয়ে । একটা ছেলে ছিল ছোট বেলা থেকেই কিছুটা বখাটে টাইপের, এখন সে বাড়ির সামনে একটা মুদি মালের দোকান দিয়েছে, বাপ-ব্যাটায় দুজনে মিলে দোকান চালায় । মেয়ের বাড়ি এই গ্রামেরই আমাদের বাড়ির অনেক পরে একটা পাড়ায়, সেখানেই গতকাল এসেছিল , আজকে ফিরে যবার সময় আমাকে দেখেই চিনতে পেরে গেছেন । বেশ কিছুক্ষণ সময় কেটে গেলো, এক সময় উনি যেতে চাইলেন, বাড়ি গিয়ে দোকানে বসতে হবে । আমি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা গাড়িতে উঠা অব্দি অপেক্ষা করলাম, গাড়িটা যতক্ষণ চোখে দেখা যাচ্ছিল আমি একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম সেদিকে । গাড়িটা চোখের আড়াল হতেই বুকের ভেতটায় হু হু করে উঠলো, কী যেন এক শূণ্যতায় ভরে আছে হৃদয়টা । এক সময় চোখের কোণে জমা অশ্রুর উপস্থিতি টের পেলাম । এ যেন এক গভীর আত্মার বাঁধন , অসম্ভব আন্তরিকতার এই সব আত্মীয়তা আজকাল কতটা আছে আমি জানি না । কিন্তু একটা মানুষের নাড়ির টান কতটা গভীর হলে এমন আপন বোধ মানুষের অন্তরকে নাড়া দেয় জানি না । হয়তো এই সম্পর্কের ব্যখ্যা আমার সাধ্যের বাইড়ে কিন্তু এই সমস্ত ছোট ছোট সম্পর্কগুলো আমাদের মতো মানুষগুলো যারা একটু আবেগ প্রবণ তাদের কাছে সাংঘাতিক গুরুত্ব নিয়ে আসে । বেঁচে থাকুক আমার বই কাকু, বেঁচে থাকুক আমার কৈশোর, এভাবেই স্মৃতির ক্যানভাস ভরা থাক ভুলতে না পারা ছোট ছোট সম্পর্কের গেঁড়োয় ।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৩৯ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০৭/১১/২০২৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast