www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

এক মুঠো স্নেহ

আজ শনিবার । যেদিন থেকে মানুষ সপ্তাহের সৃষ্টি করেছে, যেদিন থেকে ক্যালেন্ডার সৃষ্টি হয়েছে, সেদিন থেকেই ঘুড়ে ঘুড়ে এইরকম শনিবার আসে । সকালে সূর্য উঠে, পাখিদের কলতানে মুখরিত হয় চারপাশ , নির্জন দুপুরের পরে বিকেলের ক্লান্ত সূর্য লম্বা ছায়া দিয়ে ধীরে ধীরে লাল হয়ে গোধূলির হাত ধরে ডুবে যায় পশ্চিমে । ক্ষুসুধা সুন্দরী দেবীর জীবনেও কম করে দুই-আড়াই হাজার শনিবার এসেছিল, আরও যে কতগুলো আসবে , কে জানে ! কিন্তু আজকের শনিবারটা একটু অন্য রকম, ভোর তিনটের সময়েই ঘুম ভেঙ্গে গেছে, বাইড়ে আঁধার কাটেনি বলে বিছানাতেই ছিল, বিরক্তির এপাশ-ওপাশ করেছে ।একটু আলো চোখে পরতেই তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে একেবারে কল তলায় স্নান সেরে, ফুল জল এনে ঠাকুর ঘরে পূজাপাঠ শেষ করে এসে উনুনে রান্না চাপালো । তর যেন আর সইছে না । কিন্তু সূর্য তখনো পুবাকাশে উঁকি দেয়নি ।তাতে কি ! ছেলে বাড়ি আসার আগেই যে রান্নাবান্না শেষ করতে হবে ক্ষুসুধা দেবীর ।
আজ প্রায় তিন মাস গত হতে চলেছে । ছেলেটা বাড়ি আসছে না । চাকরীটা পাওয়ার আগে বাড়িতেই থাকতো সে, তখন দু-চারদিন দেখা না হলেও আপত্তি ছিলনা এমনকি চাকরি পাওয়ার পরেও রোজ বাড়ি থেকেই আসা যাওয়া করতো তখনো শনিবারের এত গুরুত্ব ছিল না , কিন্তু ছেলের কি এক প্রমোশান হল শনিবার ছাড়া আর বাড়িতে আসতেই পারে না ।মা-ছেলের ছোট্ট সংসার, সেটাও দু-ভাগ হল । কোয়ার্টারে সারাটা সপ্তাহ কি খায় না খায় দেখে না ক্ষুসুধা , শনিবারে রাত্রিবেলা আসে আবার রবিবার বিকেলেই চলে যেতে হয় তাই এই দু-বেলা ছেলেকে নিজের হাতে একটু ভালমন্দ রেঁধে খাওয়ানোর নেশায় পেয়ে বসেছে ক্ষুসুধা দেবীর । শনিবার এলেই একে ওকে দিয়ে বাজার থেকে আনিয়ে মোচার ঘণ্ট, বক ফুলের বড়া, জলপাইয়ের ডাল ইত্যাদি রান্না করে রাখতো, ছেলে যখন আসতো, পাশে বসে থেকে ছেলের তৃপ্তিটাকে উপভোগ করতো আর মাতৃত্বের স্নেহের টানে চোখের কোণে যে জলটুকু জমা হতো তাকে গোপন রেখে ছেলের সাথে সারাটা সপ্তাহের সুখদুঃখের গল্প হতো , গল্প হতো পাড়ার মধ্যে কবে কোথায় কি হয়েছে, কি হবে আর কি কি হতে পারে ইত্যাদি ইত্যাদি । না, আজ অব্দি ক্ষুসুধা দেবী ছেলেকে বিয়ের কথা বলে নি, বলে নি মানে প্রয়োজন বোধ করে নি । কত আর বয়স ! সবে চব্বিশ পেড়িয়ে পঁচিশে পা দিয়েছে, এক্ষুণি বিয়ের কথা বলার সময় হয়েছে বলে মনে করেনি । আরো কয়েক বছর যাক, মা ছেলের এই জীবনে মা আর ক’দিন কাছে পেয়েছে ছেলেকে ! তবুও মনে মনে ঠিক করে রেখেছে, হেমকাকা, মানে যার বাড়িতে এই ক্ষুসুদা দেবী ঝিয়ের কাজ করতো, উনার নাতিনটা বেশ সুন্দরী, চেহারায় একটা লক্ষীর ছাপ আছে, দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে, মাসী বলে ডাক দিলে খুব আপন আপন লাগে । ছেলে যখন চাকরি একটা পেয়ে গেছে, সুযোগ বুজে আলাপ দেওয়া যাবে । না করার প্রশ্নই আসে না । এমন সুন্দর ছোট্ট সংসারের কথাইতো হেমকাকারও স্বপ্নে । নাতিনটার মাথায় হাত দিয়ে বলতেন,”আমি তুর জন্য একটা নাতজামাই এনে ঘরজামাই করে রাখবো, তুই তো আমার একমাত্র ওয়ারিশ”। ক্ষুসুধা দেবীর স্বামী অসুস্থ ছিল বলে নিজে মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে সংসার চালাতো, স্বামীর চিকিৎসা করাতো । মেধাবী ছেলের পড়াশোনার খরচ চালানো যেমন সম্ভব ছিল না আবার মা যে ঝিয়ের কাজ করে সে কথা ছেলে যেন না জানে সে জন্যেই ছেলেকে বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে । ভাগ্যের কি পরিহাস, ছেলেটা কলেজ শেষ করলো অমনি বাবা মারা গেলো । মায়ের কথা ভেবে ছেলে যখন বাড়িতে আসলো বছর ঘুরতে না ঘুরতেই চাকরিটা হয়ে গেলো, এই অব্দি যদিও ঠিকঠাক ছিল সবই কিন্তু ছেলের প্রমোশান সব হিসেব নিকেশ পাল্টে দিলো । যদিও ক্ষুসুধা দেবীর একমাত্র ছেলে দ্বৈপায়ন মায়ের একেবারে আঁচলের ছেলে । মা’কে ছাড়া পৃথিবীর অস্তিত্ব কতটুকু তা ভেবে দেখেনি কোনদিন । তবুও মা ছেলের এই দূরত্ব যেন মাতৃত্বের টান, সন্তানের স্নেহকে অনেক অনেকগুন বেশী বাড়িয়ে দিয়েছে । ছেলে যখন মামার বাড়িতে ছিলো, যখন ভবিষ্যৎ গড়তে ব্যস্ত, তখন কিন্তু এই নাড়ির টান এতটা উপলব্ধি করতে পারেনি ক্ষুসুধা দেবী । বাড়ির পশ্চিম দিকের সাগর কলার ছড়িটা পাকা দেখলেই ছেলের কথা মনে হতো, বাপের বাড়ি যেতে তো আর বাঁধা ছিলো না কিন্তু এখন ছেলে কোথায় চাকরি করে সেটাও ভালো করে জানে না ক্ষুসুধা দেবী , যদিও ছেলে জায়গার নামটা বলে কিন্তু মনে রাখতে পারে না ।
ক্ষুসুধা দেবী আজকে এত সকাল সকাল কেনো উঠলেন, কেন রান্না চাপালেন ! নাহ, এসব প্রশ্নের কোন জবাব পাওয়া যাবে না এখানে, কেননা এই তৎপরতার মধ্যে আছে মাতৃস্নেহের উছলতা, নাড়ির মধ্যে রক্ত প্রবাহের উদ্বেল আবেগ । এবারে সূর্য পুবাকাশে সোনালী আভা ছড়িয়ে ধীরে ধীরে উর্দ্ধাকাশে যাত্রা শুরু করেছে । ক্ষুসুধা দেবী উনুনের আঁচ কমিয়ে বাড়ির দক্ষিন দিকের বেড়া থেকে একমুঠো তেলাকুচা পাতা নিয়ে আসলেন । অল্প তেলে এই তেলাকুচা পাতা ভাজা দ্বৈপায়নের খুব প্রিয় কি করছে এখন দ্বৈপায়ন ! ছেলে কি ঘুম থেকে উঠেছে ! নিশ্চয়ই অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরী হচ্ছে এখন । অফিস সেরে তিন ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে তবেই বাড়ি ফিরবে সে । যদিও সে বলেছে, শনিবারে অফিসের কাজ একটু তাড়াতাড়ি শেষ করে বেলাবেলি বাড়ি আসার চেষ্টা করে । আজকে কি সন্ধ্যার আগে বাড়িতে আসতে পারবে সে ! মায়ের মন, কত কিছু ভাবে সারাক্ষণ ! ভাবতে ভাবতে নিজের অজান্তেই খারাপ ভাবনাও এসে গ্রাস করে মাঝে মাঝে, পরক্ষনেই আবার নিজেকে নিজেই ধমক দেয়, এসব কি ভাবছি আমি ! এভাবেই বেলা বাড়তে বাড়তে একসময় সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয় ।
--------চলবে ।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ২৬৩ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১৬/১০/২০২৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast