www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

কেতকী ২

কেতকী যেন একটা নারীর রূপক নাম ।এই কেতকীকে বিমান প্রথম যেভাবে আবিষ্কার করেছিলো, সেই দিনের কথা কিন্তু বিন্দুমাত্র ভুলেনি সে । যদিও ছাতা ছিল এবং যখন একটু একটু বৃষ্টি ঝরছিল তখন বিমান ছাতা মাথায় দিয়েই হাটতে হাটতে যাচ্ছিল আর ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি' শব্দটি নিয়ে মনে মনে উৎস খুঁজতে খুঁজতে বিশ্লেষণে যাওয়ার আগেই ঝম ঝম করে বৃষ্টি নেমে আসলো । অগত্যা রাস্তার পাশের রেলিং ধরে একটা বড় বিল্ডিংএর ধার ঘেঁষে দাঁড়ালো । পাশেই ছিলো এক ফুচকাওয়ালা, পলিথিন দিয়ে দোকান ঢেকে রেখেছে, অত্যুৎসাহী কিছু ক্রেতা বৃষ্টির মধ্যেই ছাতা মাথায় পাতার বাটি হাতে দাঁড়িয়ে আছে । কেতকীও বোধহয় সেই দলেই ছিল কিন্তু ছাতা ছিল না, বৃষ্টি নামতেই ধুরমুর করে একেবারে বিমানের পাশে এসে দাঁড়ালো এবং এক সময় বৃষ্টির ঝাপটা খেয়ে একেবারে তার ছাতার তলায় নিজেকে ঠাই করে নিল । সাদা পোশাকে ভেজা শরীরের সেই কেতকীর মোহময়ী রূপ দেখে বিমান এতটাই হকচকিয়ে গিয়েছিল যে, বেশ অনেকক্ষণ কোন কথাই বলতে পারেনি সে ।চোখ বুজে কেতকীর গায়ের গন্ধ অনুভব করতে করতেই হারিয়ে গেছিল বিমান ।ভালো লাগার এক পর্বে বিমানের সমস্ত দেহের গ্রন্থিগুলো ব্যাথায় যেন টন টন করে উঠেছে । সম্বিৎ ফিরলো কেতকীর মিষ্টি সুরের প্যানপ্যানানি শোনে,"ঈশ,ভিজে কাক হয়ে গেলাম, এখন যে কি করি !" এবার বিমান কিছুটা যেন বিচলিত হল, 'আরো সরে আসুন' বলতে বলতে ছাতাটা প্রায় সবটাই কেতকীর মাথার উপরে মেলে ধরেছে দেখে কেতকীর চোখে দুষ্টমিষ্টি প্রশ্ন এঁকে উপরের দিকে একবার তাকালো তবে কিছু বলল না ।বৃষ্টিটা বেশ কিছুক্ষণ একনাগাড়ে ঝরে ঝরে যখন ক্লান্ত, রাস্তায় যখন জল জমে গেছে, গাড়ি চলাচল প্রায় বন্ধ তখনকার ঐ বিরক্তি দিয়ে শুরু হয়েছিল দুজনের কথাবলা এবং পথচলা । সেই থেকে আর থামেনি কোথাও । পাশাপাশি কাছাকাছি চলতে চলতে বিমান ভালবেসে ফেলেছিল কেতকীকে, কেতকীর মনের কথা বলা হয়নি অনেক দিন । মাঝে মাঝে হারিয়ে যেতো কেতকী । পাগলের মতো হন্যে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে যখন ক্লান্ত হতো বিমান, ঠিক তখনই আবার কেতকী আসতো বিমানের ভালোবাসার জগতে, বিমানের আশেপাশে। কোনদিন অতীত বলেনি, জানতেও চায়নি সে । বিমান শুধু জানতো কেতকী পড়াশোনার পাশাপাশি একটা ছোট কোম্পানিতে কাজ করে । কি পড়াশোনা করে ? দু-একবার যে জানতে চায়নি বিমান তা নয়, তবে এড়িয়ে গেছে সে উত্তর।কি কাজ করে ? তাও যে জানতে চায়নি তা নয়, সে প্রশ্নের উত্তরও দেয়নি কোনদিন ।তবে দুজনের ঘনিষ্ঠ মুহুর্তে কেতকী চুপ থাকতো বেশী, যদিও বিমান নিজেও বেশী কথা বলতে পছন্দ করতো না, তবুও নীরবতা ভেঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বেশ কয়েকবার কেতকীর চোখের কোণে জমা জল দেখেছে । চেহারায় দেখেছে উত্তর আকাশের কালো মেঘের ঘনঘটার মতো কদাকার রূপ । একদিন বিমানের বুকে যখন কেতকীর মাথা ঠেকিয়ে আকাশ দেখার মতো করে বসেছিল ময়দানের এক কোণে, বিমান চুলে বিলি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করেছিল ;

- কেতকী ?

-হুম ,

-তোমি তো কোনদিন তোমার বাড়ির কথা বল্লেনা !

-না, জেনে লাভ কি বলো ! আমি যখন তোমার সঙ্গে চলে যাবো, তখন তো আর আমার সঙ্গে কেউ যাবে না !

কথাগুলো কেতকী হাসির ছলেই যেন বলল কিন্তু এর অন্তর্নিহিত অর্থ কতটা গভীর সে বিচার বিশ্লেষনে যেতে চায়নি বিমান । ভাবলেশহীন ভাবে কেতকীর চুলে বিলি কেটেই যাচ্ছিল সে । তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে, পশ্চিমের আকাশে লাল আবিবের হোলি খেলা চলছে । পাখপাখালির কিচিরমিচিরে তিলোত্তমা শহর মুখরিত হয়ে উঠেছে । একটা প্রতিবন্ধী , না প্রতিবন্ধী শব্দটা এখন আর যথাযথ নয়, বিশেষ ভাবে সক্ষম এক হাত কাঁটা একটি ১১/১২ বছরের মেয়ে পীচের রাস্তার বা পাশ ঘেঁষে সুন্দর আল্পনা আঁকায় নিমজ্জিত , আশে পাশে কয়েকজন অবসন্ন বা অবসর মানুষ বিষয়টাকে উপভোগ করছে আর মাঝে মধ্যেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ হলেও পকেট ঝরছে না কারো । বিমান এই ব্যপারটাকে দীর্ঘ্যক্ষন খেয়াল করলেও এতক্ষণ টাকা দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করে নি কিন্তু আঁকা যখন শেষের পথে মেয়েটা হয়ত উৎসুক উপস্থিত নাগরিকের উদ্দেশ্যে কিছু বলেছেন তাই সকলেই সাধ্যমতো কিছু দিচ্ছেন আবার পেছন থেকে কেউ কেউ আস্তে করে সরে যাচ্ছেন । বিমানের মনে একটা কৃতজ্ঞতা বোধ আসলো, কেতকীকে পাশে বসিয়ে কোন একটা উপভোগ্য বিষয় ছাড়া এতক্ষন বোধহয় সময় কাটাতে পারতো না ! তাই, মেয়েটাকে কিছু উপহার দেয়া আবশ্যক এবং আজকে যেহেতু কেতকী বিমানকে সারাদিনে একটি টাকাও খরচ করতে দেয়নি তাই পকেট থেকে দশটি টাকা নিয়ে অদূরে আল্পনার দেশে গিয়ে দিয়ে আসলো । গোধূলির তির্যক লালের আভায় কেতকীর মুখাবয়ব লেন্সে ধারণকৃত ছবির মতো । আরো বেশী ভালো লাগা নিয়ে গিয়ে বিমান আরো একবার কেতকীর মাথা বুকে নিয়ে বসলো । চুলে চুলে আলতো করে বিলি কাটতে কাটতে জিজ্ঞেস করলো ;

-কেতকী ?

- হুম ,

-আমাকে জানবে না ? আমার বাড়ি কোথায় , কে কে আছে বাড়িতে ?

-না, আমার দরকার নেই । আমি শুধু তোমাকেই চিনি আর এটুকুই যথেষ্ট ।

-তাই !

এ কথা শোনে বিমানের মুখটা যেন অনেকটা চুপসে গেলো । অনেক কিছু জানার ছিল বিমানের, অনেক কিছু বলারও । কিন্তু সঙ্গী যখন সঙ্গ দেয়না সে পথে আর এগুনো যায় না । দুজনের প্রিয় মশলা মাখা কাঁচা ছোলা খেয়ে সেদিনের মতো শেষ হয়েছিল পাশাপশি চলা , যাবার সময় কেতকী বলে গিয়েছিল, আগামী তিন দিন কোম্পানীর কাজে কোলকাতার বাইরে যেতে হবে সুতরাং দেখা হচ্ছে না । যদিও বিমান অনুযোগ করেছিল, মোবাইলটা স্যুইচ অফ কেন থাকে ! কেতকীর সাফ জবাব,

-সে তুমি বুজবে না, আমার এই মোবাইলটা কোম্পানী থেকে দেওয়া তাই কোম্পানীর কাজে বেড়োলে অন্য কল নিষেধ এবং সে কারনেই আমি আমার এই সিমটা খোলে রাখি ।

-ওকে বাবা, তোমার মোবাইল, তোমাই সিম, তোমার কোম্পানী, তাই তোমার যা ইচ্ছে তাই করো, কেউ বাঁধা দেবে না তোমায় ।

-হুম , টা টা ।

বলে দুজন দু দিকের পথ ধরে । আগে থেকে কেতকী বলে দিয়েছে, কেতকী যখন ঘরে ফিরবে তখন রিক্সায় করে ঘরের সামনে দিয়ে আসা বা ট্যাক্সি ডেকে দেওয়া ইত্যাদি আদিখ্যেতা দেখানো সে একদম পছন্দ করে না , অবশ্য বিমানও এসব খুব একটা পছন্দ করে না তবুও প্রেম ভালোবাসা বলে কথা, আবেগের কাছে অনেক কিছুই মাথা নত করে , লোভ, লালসা, হিংসা, নিন্দা, দ্বিধা, দারীদ্রতা ইত্যাদি ইত্যাদি । এভাবেই নিজের ইচ্ছের বাইড়ে দু একদিন কেতকীকে নিয়ে রেষ্টুরেন্টে খেয়ে বিল দিতে গিয়েছিল সে কিংবা কেতকীর জন্য ট্যাক্সি ডাকতে । কিন্তু কেতকীর সাফ মানার পর এখন আর ওসব নিয়ে মাথা ঘামায় না বিমান ।

কেতকী একটা রিক্সা ডেকে হুডটা খোলে দিয়ে বাতাসে চুল উড়িয়ে ঘরের দিকে ফিরে যাচ্ছে । মনে মনে ঠোঁটের কোণে একটা হাসির আভা এঁকে ভাবছে,'কি সরল সোজা বিমান ! যেমন ভাবে চালাতে চায় সে , সেভাবেই চলে । যেন স্বচ্ছ জল, যে পাত্রে রাখে সেই পাত্রের আকাড় ধরে, যে রং এর পাত্র সে রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নেয় বিমান । এমন একটা নির্মল মনের মানুষকেই তো খুঁজছিল কেতকী !'

-----চলবে ।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ২৯৮ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১২/০৩/২০২৩

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • শুভজিৎ বিশ্বাস ১৭/০৩/২০২৩
    বেশ সুন্দর লিখেছেন। অপেক্ষায় থাকলাম আগামী পর্বের ..,
 
Quantcast