গল্প হলেও সত্যি - পাষণ্ড
বলছিলাম তপনের বৌ এর কথা । প্রথমেই একটা পরিচিতি রাখলে ভাল হয় । তপন ভূঁইয়া আমার পাশের গ্রাম নেহালচন্দ্রনগরের ছেলে । আমার সাথে যখন পরিচয় তখন সে ট্রাক ড্রাইভার । আমার সঙ্গে পরিচয়ের প্রসঙ্গটাও বলে রাখি । আমি তখন উকিল মোহরার কাজ করি । আমি নতুন নতুন কাজে যোগ দিয়েছি তখনি আমার উকিল বাবুর কাছে দীর্ঘ্যদিন ধরে চলতে থাকা তার মায়ের এক্সিডেন্ট কেইসের ক্ষতিপূরণের টাকার রায় হয় । আমিও বেশ ভাল টাকা পেলাম, ওরাও বেশ খুশী ছিল কিন্তু পরবর্তী সময়ে কেইসের রায় অনুযায়ী ব্যাঙ্কে ফিক্সড রাখা টাকাগুলোর ম্যায়াদ শেষে তুলে আনতে গিয়ে আমার উকিল বাবুর সঙ্গে ওদের কিছুটা মনোমালিন্য হয় , যদিও সেটা দেনা - পাওনা নিয়ে নয় তবে সেটা অন্য প্রসঙ্গ । সেই থেকে তপনের সাথে আমার খুব ঘনিষ্টতা ।তপন এক সময়ে তার বড় ভাই স্বপনকে বিশ্বাস করতে পারছে না বলে আমার কাছে টাকাগুলো কাজে লাগানোর সঠিক যুক্তি চেয়েছিল, আমি আমার সাধ্যমত যুক্তি বুদ্ধি দিয়েছিলাম । এভাবেই চলতে চলতে একসময়ে সে, গাড়ি চালানো ছেড়ে দিয়ে আগে থেকেই রেষ্টুরেন্টের খাবার বানানোর কাজ জানতো বলে সে কাজে যোগ দিয়ে বেশ ভালো উপার্জন করছিল । ততদিনে ভাইয়ের সংসার ছেড়ে পৃথক ভাবে বাড়িঘর করে বিয়ে শাদী করেছে । যদিও খুব কষ্টে সৃষ্টেই এই কাজগুলো সম্পন্ন হয়েছে তবুও আমার ভালো লেগেছে যে, সে এক অসহায় মাতৃহারা গরীব ঘরের মেয়েকে বিয়ে করেছে । সৎ মায়ের ঘরে বেড়ে উঠা মেয়েটি ছিল বেশ মিষ্টি । আমার সঙ্গে ঘনিষ্টতা থাকলেও সেই সম্পর্ক কখনোই বন্ধুত্বে পৌছায় নি, সব সময়ই সে আমার থেকে একটা দূরত্ব বজায় রাখত বলে আমিও নিজে থেকে সেই জড়তা কাটানোর চেষ্টা করিনি তবে সে তার চলার পথের কোন কথাই আমার কাছে গোপন রাখেনি , শুধুমাত্র বিড়িটা আমার সামনে খেত না । বৌভাতে কোন এক কারনে যেতে পারিনি বলে দু-একদিন পরে গিয়ে বৌ দেখার অছিলায় বৌয়ের প্রাপ্য উপহারটাও দিয়ে এসেছিলাম । সেই থেকে ওরা দুজনের সঙ্গেই আমার ভাল সম্পর্কটা থেকে গেল এবং আজ অব্দি এক রকমই চলছে । পাশের গ্রাম হলেও কথায় কথায় তপনের বাড়ির পেছনে একটা ছোট্ট সেগুন বাগান আমি কিনেছিলাম । একারনেই প্রায়ই আসা যাওয়া হত । দু চার বার ওদের স্বামী - স্ত্রী'র সাংসারিক ছোট খাট ঝামেলার মীমাংসাও করে দিয়েছি । ওদের প্রথম সন্তান মেয়ে, দুজনেই বেশ হাসি খুশী, মেয়েটা বাবার মতোই গায়ের রং কালো হলেও বেশ নাদুস নুদুস চেহারার । ততদিনে তপন রেষ্টুরেন্টের কাজ ছেড়ে দিয়ে রিক্সা চালাতে শুরু করেছে । কাজটা যে কেন ছাড়ল কারন না জানে তার বউ না জানি আমি । আসলে তপনদের মত কিছু কিছু ছেলে এমনি থাকে, ওরা কখন যে কি করবে কেউ বলতে পারে না । একেবারে ছোট বেলা থেকে পিতৃহীন একটু বড় হওয়ার পরে মা চলে গেলেও স্নেহের ধন মানে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কারনে ক্ষতিপূরন বাবদ প্রাপ্য টাকা একেবারে কম দিয়ে যায়নি । রিক্সা চালানো শুরু করার পরে থেকেই তার মদে আসক্তির খবর জানতে পারি । বউটা অনেক সময়ে কান্নাকাটি করত, আস্তে আস্তে সংসারে অশান্তিও শুরু হল ; অভাব নেমে আসতে শুরু করেছে । কিভাবে কখন সঞ্চিত অর্থ শেষ করেছে কেউ জানে না কিংবা শুধু আমিই জানি না । শেষের দিকটা আমার সামনে বেশী বাধ্যগত হয়ে থাকতো । কোন প্রশ্নের উত্তর দিত না, মাথা নুইয়ে বসে থাকতো । আমিও ততদিনে পারিপার্শিক আরও অন্যান্য কাজের সাথে যুক্ত হয়ে পরার কারনে আগের মতো যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছিলাম না তবে তপনের বউ নিয়মিত যোগাযোগ রাখত, সুখ দুঃখের কথা জানাতো ।এমনি ভাবে সময়ের স্রোতে চলতে চলতে তপন আমাকে একদিন বেশ হাসি মুখেই খবরটা জানালো যে তার দ্বিতীয় সন্তান আরো একটি মেয়ে জন্মেছে । এই হাসি মুখের আড়ালে যে এত রাগ , এত অভিসন্ধি ছিল আমি তা ঘূর্ণাক্ষরেও বুজতে পারিনি , অনেক দিন পর হঠাত মনে হল , তপনের মেয়ের অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ তোপাইনি ! কি হল, কিছু অঘটন ! কেননা আমার সঙ্গে এত বছরের সম্পর্কের নির্যাস কিন্তু বলছে আমাকে নিমন্ত্রণ পেতেই হবে তাই ঈশান কোনে কালো মেঘের আভাষ পেলাম । সময়ের সুযোগ বুজে একদিন তপনের বাড়িতে গেলাম, দেখলাম কোন অঘটন ঘটেনি । স্বস্তি পেলেও সেদিনের তপনের বঊয়ের চোখের জল আমাকে যথেষ্ট ভাবিয়েছিল, সমবেদনায় চোখের কোনে আমার অজান্তেই জল জমেছিল । ভারাক্রান্ত হৃদয়ে অনেক ভেবেছি, সমাদানের অনেক সূত্র, বিকল্প উপায় নিয়ে ওদের বাড়িতে আরেকদিন যাব যাব করেও বেশ কয়েক মাস আর যাওয়া হয়নি । এই কয়েক মাসের মধ্যেই যে, তপনের সংসারে এত বড় ঝড় আসবে আমি ভাবতেই পারিনি । পথ চলতে চলতে এক সময়ে আমি ভুলেই গেছিলাম যে, তপনের সংসারের সুখ দুঃখ আমাকে ভাবায়, আমাকে ভাবতে হয় । বড় ভাইয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখে না বলেই আমাকে ওরা সেই স্থানে রেখেছে, আমিও দিনে দিনে জড়িয়ে গেছি অভিভাবকের মতো । তবুও জল গড়ায়, গড়িয়ে যায় , কারোর জন্যই থেমে থাকে না । নদী যেমন আপন মনে চলতেই থাকে তেমনি আমার ব্যস্ততার কারনে খুব একটা যোগাযোগ আর না হলেও তপনের সংসার চলছিল, আর এই চলতে চলতেই ঈশান কোনে যে মেঘের ঘনঘটা ছিল তা আস্তে আস্তে কাল থেকে কাল হতে হতে একদিন ঘোর অন্ধাকারাচ্ছন্ন হয়ে তুফান রূপে আছড়ে পরল তার সংসারে । সর্বনাশ হয়, দুর্ঘটনা ঘটে কিন্তু কোন সংসারে এমন অভাবনীয় অঘটন ঘটতে পারে অন্ততঃ আমি কস্মিনকালেও ভাবতে পারিনি ।
............ চলবে ।
............ চলবে ।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
রায়ান নূর ০৮/০৪/২০২০দারুন
-
আব্দুল হক ৩০/১০/২০১৯বেশ লিখেছেন।
-
এইচ আর মুন্না ২৮/১০/২০১৯অনন্য সুন্দর
-
শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য ২৭/১০/২০১৯নাইস