গল্প হলেও সত্যি
বলছিলাম শ্রী হরিপ্রসন্ন দেবনাথের ক্থা, উনি ত্রিপুরা রাজ্যের সিপাহীজলা জেলার সোনামূড়া মহকুমার নলছড় গ্রামের বাসিন্দা । আজকে বুধবার, আমি আমার পেশাগত কাজে এই বারে খুব ব্যস্ত থাকি । অন্যান্য দিনের চাইতে আজকে ব্যস্ততা একটু বেশীই ছিল বটে । বিকেল পাঁচটায় সব কাজ শেষ করে যখন একটু হাফ ছেড়ে নিজের চেম্বার কাম দোকানে বসতে যাচ্ছিলাম তখনি এই ভদ্রলোক সামনে এসে বেশ গলা ছেড়ে জোড়ে জোড়ে হাঁক ছাড়লেন “গামছা রাখবেন, গামছা” । বিগত ৫/৭ বছড়ের মধ্যে এমন ভাবে সামনে এসে কেউ এরকম বলেছে বলে মনে পরছে না । আমার ষ্টাফ উনাকে বিদেয় করে দিতে যাচ্ছিল কিন্তু আমি বাধা দিলাম, উনাকে ঘরে ডেকে বসালাম । এক লহমায় আমার অনেক কিছুই মনে পরে গেল । আমি উনার কাছে সবচেয়ে দামী গামছা কোনটা জানতে চেয়ে দুটো গামছার দাম জিজ্ঞেস করলাম । আড়াইশ টাকার নীচে হবে না জানিয়ে কিছুক্ষন থেমে থেকে বললেন ঠিক আছে দশ টাকা কম দিন । আমি চুপচাপ গামছাগুলো নিলাম, পাঁচশ টাকার নোট দিলে উনি আমাকে দুশ ষাট টাকা ফেরত দিলেন, আমি টাকাগুলো হাতে নিয়ে ঊনার হাতে দশ টাকার নোটটা ধরিয়ে দিয়ে বললাম, এটা নিন , দোকানে গিয়ে চা খাবেন। প্রথমে ইতস্তত করলেও টাকাটা হাতে নিলেন । আমি ষ্পষ্ট দেখতে পেলাম, উনার চোখ ছল ছল করছিল, সঙ্গে সঙ্গেই কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু ঠোঁট কাঁপছিল, একটু থেমে আড়ষ্ট গলায় বললেন, “চলুন না দুজনেই এক সঙ্গে চা খাই”। আমারো ইচ্ছে ছিল, কিন্তু আমি জানি আমরা যেখান থেকে রোজ চা খাই , সেই দোকানদার আজকে অসুস্থতার কারনে আসতে পারেনি বলে সারাদিন চা খেতে পারিনি । তাই উনাকে বুজিয়ে বলে এড়িয়ে গেলাম । অতঃপর উনি অনেক আগ্রহ ভরে আমার কাছে ছোট্ট করে হলেও জীবন বৃত্তান্ত বলার চেষ্টা করলেন । আমি মনযোগ দিয়ে শোনলাম । এই একানব্বই বছর বয়সে একটা হাত প্রায় অচল (প্যারালাইজড) এবং একটা পা খুড়িয়ে খুড়িয়ে কেন পেটের দায়ে গামছা বিক্রি করার জন্য এতদুর এসেছে । সেই কথাগুলোই বলছিলেন, বলতে বলতে থেমে যাচ্ছিলেন, চোখ মুছছিলেন, আবার কখনো “আহ” বলে দীর্ঘ শ্বাস ফেলছিলেন । কবে হঠাৎ করে ষ্ট্রোক করলেন, ভাগ্য ভাল ছিল বলেই বাড়িতেই এই ঘটনা ঘটেছে ; আবার কবে বাইকের সাথে ধাক্কা লেগে ডান পা’টা একেবারে ভেঙ্গে গেছে এবং বর্তমানে পা’য়ে রড নিয়েই কিভাবে চলছে ইত্যাদি ইত্যাদি । পা’য়ের কথা বলতে গিয়ে বলছিলেন, “ডাক্তার তো আমাকে তিন বছর রেষ্টে থাকতে বলেছিল, তখন আমার বয়স সত্তর, কি অবস্থা হতো ! আমি কবিরাজী তেল লাগিয়ে দিব্যি চলছি বাবু, আমার রোজ ১৫ টাকার অসুধ লাগে, ব্যাথা বেদনার লাইগ্যা, ভালোই আছি” । উনার তিন ছেলে, তিন জনেই বিয়ে শাদী করে পৃথকান্নে ভাল আছেন, বড় ছেলের ঘড়ে নাতি কোলকাতায় পড়াশোনা করে । কোন ছেলেই কোন দিন দু-টাকা দিয়ে সাহায্য করেনি, বরঞ্চ এখনো প্রায়ই ছোট ছেলে , শশুর-শাশুড়ীর ঘর থেকে এটা ওটা নিতে আসে, গত বছর চৈত্র মাসে ছোট ছেলে বেশী ঋণগ্রস্থ হয়ে যাওয়ায় দু-হাজার টাকা দিতে হয়েছিল । যদিও গামছা ব্যবসার পূঁজিতে টান পরেছিল, তবে কোন অসুবিধা হয়নি । এই ছিল উনার জীবনের না বলা কিছু কথা । হয়তো বলার লোক খুঁজে পান না তাই বলেন না । সবশেষে উনি আমার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাইকে রইলেন, আমি বুজতে পাড়লাম, কিছু জানতে চাইছেন আমার তরফ থেকে । সারাদিনের কাজ শেষে বসেছি, যতক্ষণ অব্দি কেউ এসে ডিষ্টার্ব না করবে ততক্ষণ অবসর আছি । ভাবছিলাম কিছু বলব, এমন সময় জিজ্ঞেস করলেন “ বাবু, দুইটা গামছা নিছেন ক্যারে, বাড়িত কেডা আছে ? আপনের বাপ আছেনি ?” আমি যে কথাগুলো বলব ভাবছিলেম, কোথায় থেকে শুরু করব ভাবছিলেম ; এই কথাগুলো শুরু করার কাজটা সহজ করে দিলেন উনি । আমি বললেম, আসলে আমার এখন গামছার কোন দরকার নেই, কিন্তু আপনাকে দেখে, আপনার বয়সকে দেখে আমি গামছাগুলো নিলাম । ঊনি আরেকবার দীর্ঘ্য শ্বাস ছাড়লেন কিন্তু আমার আসল কথা তখনো বলা হয় নি । আমি যে গামছাগুলো নিলাম, সেগুলো হয়ত আজকে প্রয়োজন নেই কিন্তু কিছুদিন পরে হলেও তো আমার লাগবে, আমার গায়ের ঘাম মুছতে এই গামছাগুলো যে আমার খুব প্রয়োজন কেননা এই গামছা কাঁধে মানুষ দেখলেই যে আমার ভিতরটা একটা মোচড় দিয়ে উঠে । আমার মনে পরে , কত কষ্ট, কত স্বপ্ন, কত আশা নিয়ে শত অসহ্য যন্ত্রণা নিয়েও কাঁধে এই গামছা তোলে নেয় তাঁরা ! আরো অন্য পেশা বা ব্যবসাতেও হয়ত এরকম আরো অনেক যন্ত্রণা ক্লিষ্ট মানুষ আছেন, তাদেরও স্বপ্ন , আশা থাকে । কিন্তু এই গামছার প্রতিটি ভাঁজে ভাঁজে যে লুকিয়ে আছে আমার আজকের দিনের এই বাবু - মানুষের প্রতিদিনের বেড়ে উঠার গল্প । হ্যাঁ, আমার বাবাও একদিন এভাবেই শত সহস্র যন্ত্রণা বয়ে বেড়িয়েছেন দ্বারে দ্বারে । বুকে স্বপ্ন ছিল অসীম । ছেলেটাকে মানুষ করতে হবে, মানুষের মত মানুষ । কোন কোন দিন যদি গামছা বিক্রি না হতো সারাদিন না খেয়েই কাটিয়ে দিতেন । রোগা শীর্ণ দেহটাকে কোনরকমে টেনে নিয়ে যেতেন বাড়িতে । ঘরে গিয়েও হয়তোবা নীরবে থাকতেন, আমার কথা ভেবে বলতেন , “আমি খেয়ে এসেছি, ছেলেকে ভাত দাও” । মানুষ কতটা হতে পেরেছি জানিনা । কিন্তু এই অক্লান্ত পরিশ্রম করতে করতেই একদিন বাবা হারিয়ে গেলেন চিরতরে ; রেখে গেলেন তাঁর স্বপ্নের মানুষকে, আমাকে । সেবা শুশ্রষা করার সুজোগ পেলাম না, তবে একটা শান্তনা নিয়ে চোখ মুদেছিলেন বাবা, আমার মা, ঠাম্মা, ছোট ভাই-বোনকে আমার হাতে দিয়ে গেছিলেন । তাই এই গামছার বোঝা কাঁধের মানুষগুলোকে দেখলেই আমার বুকের ভিতরটা কেঁদে উঠে । তাঁদের থেকে প্রয়োজনে অ-প্রয়োজনে গামছা কিনি । কিন্তু তাঁদের জীবনের করুন কাহিনীগুলি যখন শুনি অন্তরটা কেঁদে উঠে । বাবার কথা আরো বেশী করে মনে পরে । বাবাকে বলতে ইচ্ছে করে , “বাবা,তুমি তো উনাদের মত নও, তুমি তো তোমার আদর্শে ছেলেটাকে ঠিকঠাক ভাবেই বড় করেছ ! কিন্তু এত তারাতারি কেন চলে গেলে ?” আমার এই কথাগুলো আমার অন্তরের ভিতর থেকে বাইড়ে বেড়িয়ে বাতাসে প্রবাহিত হোক, এতে করে যদি কোন এক বাবার, কোন এক গামছা বিক্রেতার ছেলে-মেয়ে তাদের বাবার এই যন্ত্রনা উপলব্দি করতে পারে, হয়তো এভাবেই বাবারা একদিন তাঁদের এই যন্ত্রণাকে দূরে সরাতে পারবে ।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ১৪/০৩/২০১৯ভালো লাগলো
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ০৭/০৩/২০১৯হৃদয়বিদারক।