www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

সুব্রত ব্রহ্ম

।। শত বছরে বাংলাদেশের নারী ।।
প্রথম প্রকাশ
জানুয়ারী, ১৯৯৯
ঢাকা, বাংলাদেশ
(নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা)
সম্পাদনাঃ ফরিদা আখতার
তথ্য সংকলনঃ মেরীনা চৌধুরী সাঈদা আখতার
ডিজিটাল ফরমেটঃ সুব্রত ব্রহ্ম

শত বছরে বাংলাদেশের নারী~০১
||বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন||
(1880-1932খ্রি,)

রোকেয়া খাতুন রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামের জমিদার সাবির পরিবারে ১৮৮০ সনে (১২৮৬ বাং) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা জহির উদ্দিন মুহাম্মদ আবু আলি সাবির। তিনি ছিলেন আরবি, পারসিতে বুৎপন্ন গোঁড়া মুসলমান। মাতা রাহাতুন্নেসা সাবেরা চৌধুরী। যুগের প্রথা অনুযায়ী সে পরিবারের মেয়েরা ছিলেন ঘোর পর্দানশীন। পাঁচ বছর বয়স থেকে পর্দা মেনে চলা তাঁদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। দাদি, নানি ছাড়া অন্য কোন অপরিচিতা স্ত্রীলোকের সামনে বের হওয়াও ছিল কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
বেগম রোকেয়ার তিন ভাই, দু বোন ছিল। তাঁকে পরিবারের অন্যান্য মেয়েদের সাথে অল্প বয়স থেকেই সাবির পরিবারের অন্ধ অন্তঃপুরে বন্দিনী জীবন যাপন করতে হয়েছে। এই অন্ধকারময় জীবনে বড় ভাই ইব্রাহীম সাবির ও বোন করিমুন্নিসা আলোর পথ দেখান। তাঁদের প্রভাব রোকেয়াকে গড়ে তুলেছিল বৈপ্লবিক দৃষ্টির অধিকারী করে, মুসলিম বঙ্গে নারী জাগরণের সনদহীন দূতরূপে।
রোকেয়ার পিতা স্ত্রী শিক্ষার ঘোর বিরোধী ছিলেন। কিন্তু ভাই ইব্রাহীম ছিলেন শিক্ষানুরাগী। তিনি রাতের অন্ধকারে ছোট বোন রোকেয়াকে পড়াতেন। এভাবে তাঁর শিক্ষা জীবনের শুরু রাতের অন্ধকারে। যেন তাঁর প্রথম বিদ্রোহই ছিল অন্ধকারের বিরুদ্ধে। মানুষের জীবন তথা নারী জীবনকে শিক্ষায় আলোকিত করার জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। স্ত্রী শিক্ষাই ছিল রোকেয়ার জীবনস্বপ্ন, সেই সংগ্রামই ছিল তাঁর সমাজকর্ম।

১৮৯৮ সালে সংস্কার মুক্ত, উদার মানসিকতা সম্পন্ন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট খান বাহাদুর সাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। স্বামী সাখাওয়াত হোসেন স্ত্রীর মনের গতি লক্ষ্য করে তাঁর সাহিত্য প্রতিভা বিকাশে রীতিমত সহায়ক হয়েছিলেন। রোকেয়ার বিবাহিত জীবন ছিল স্বল্পকালীন। কিন্তু এই স্বল্প কালের দাম্পত্যজীবনে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এসেছিল অসীম সমঝোতা। স্বামীর মৃত্যুর আগে রোকেয়াকে পরবর্তী জীবনের যে পথনির্দেশ দিয়েছিলেন, তাঁরই প্রেরণায় ১৯০৯ সনের ১ অক্টোবর মাত্র পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে ভাগলপুরে প্রথম সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলের ভিত্তি স্থাপন করেন। কিন্তু সপত্নী কন্যা ও জামাতার ষড়যন্ত্রে বাধ্য হয়ে তিনি ভাগলপুর ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। এখানে ১৯১১ সনের ১৬ মার্চ মাত্র ৮ জন ছাত্রী নিয়ে কলকাতার ১৩ নং ওয়ালী উল্লাহ লেনে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল নতুন করে প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিম নারী শিক্ষার অন্ধকার যুগে বেগম রোকেয়া মহল্লায় মহল্লায় ঘুরে ছাত্রী সংগ্রহ করেন।

রোকেয়ার অধ্যবসায় ছিল প্রবাদতুল্য। শৈশবের সামান্য প্রাথমিক লেখাপড়া ছাড়া আনুষ্ঠানিক কোন শিক্ষা তাঁর ভাগ্যে জোটে নি। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার অবিচ্ছিন্ন প্রয়াসে তিনি সামান্য ইংরেজি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন এবং এটুকু সম্পদ পুঁজি করে তাঁর ঐকান্তিক সাধনা ও অক্লান্ত চেষ্টায় সাত বছরের মধ্যে স্কুলটি ইংরেজি স্কুলে পরিণত করেন। স্কুলের কাজে তিনি যে বাধা পেয়েছিলেন, তা তাঁর নিজের সমাজের রক্ষণশীল গোঁড়াদের দিক থেকেই। কিন্তু আবার অনেক মহৎপ্রাণ ব্যক্তি সাহায্যও করেছিলেন। সেটা এমন এক সময় ছিল যখন নারীর অবদানকে অস্বীকার করার প্রবণতা ছিল তীব্র।
স্কুল প্রতিষ্ঠার পর বেগম রোকেয়া সমাজে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে কলকাতায় ১৯১৬ সনে আঞ্জুমান- খাওয়াতীনে নামক ইসলাম বা মুসলিম মহিলা সমিতি গঠন করেন। নারীর শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর নেতৃত্বে এ সমিতি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। ক্রমে বাঙালি মুসলিম মহিলা সমাজে একটি চেতনাবোধ। সৃষ্টি হয়। বহু যুগ ধরে অন্দরে অবরুদ্ধ থাকার ফলে মুসলিম নারী সমাজ তার সহজাত শক্তি হারিয়ে, গভীর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন ছিল। তাদের জীবনে প্রগতির আলোক এনে দিলেন বেগম রোকেয়া। বেগম রোকেয়া মুসলমান নারীকে আত্মমর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত, সম্ভ্রমে উজ্জ্বল, নানা শিক্ষায় শিক্ষিতা, অর্থনীতিতে স্বাবলম্বী এবং সমাজ ও সংসারে সর্বক্ষেত্রে মানুষের মত বেঁচে থাকবার অধিকার অর্জনে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন।
বেগম রোকেয়া বিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্ন থেকে অর্থাৎ যুগসন্ধির এক কঠিন সময়ে নারীর আত্মপরিচয় উদ্ধারের ব্রত গ্রহণ করেছিলেন সাহিত্য সৃষ্টির মাধ্যমে। তাঁর জীবনের বিপুল কর্মপ্রয়াস, বিচিত্র সৃষ্টিধর্মী পরিকল্পনা আর বিভিন্ন আঙ্গিকের সাহিত্য সাধনা বলতে গেলে পরস্পরের পরিপূরক। শক্ত হাতে তিনি ধরেছিলেন লেখনী। সাহিত্যের মধ্য দিয়ে তিনি ভবিষ্যৎ নারী জাতির শক্তি ও স্বাধীনতার যে গৌরবোজ্জ্বল স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তার কিছুটা বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় তাঁর কর্মজীবনে। দীর্ঘকাল পরেও মানুষ সাহিত্যের ভেতবেই তাঁর সত্যিকার পরিচয় খুঁজে পাবে।

সমাজসেবা, নারীশিক্ষা প্রসার এবং সাহিত্য সাধনার ত্রিবিধ আয়োজনের সমন্বয় সাধিত হয়েছে বেগম রোকেয়ার মধ্যে। তিনি নারী অধিকারসমূহ বাস্তবায়নের জন্য সংগ্রামে আহবান জানিয়েছেন। পুরুষের কাছে দয়া বা অনুগ্রহ ভিক্ষা নয়, পুরুষের আধিপত্য ও দুঃশাসনের প্রতিবাদ করে অধিকার প্রতিষ্ঠার দৃঢ়তা প্রকাশিত হয়েছে তাঁর রচনাবলীতে। স্বাধীনতার পূর্বশর্ত হিসেবে তিনি নির্দেশ করেন শিক্ষা ও অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতাকে। বেগম রোকেয়ার সমগ্র কর্মময় জীবন নারী সমাজের কাছে অনন্য আদর্শের প্রতীক। নারীমুক্তি তথা নারীপ্রগতি আন্দোলনের পূর্বশর্ত হিসেবে তাঁকে জানতেই হবে, চিনতেই হবে। বাঙালি মুসলমান সমাজে বেগম রোকেয়া একজন মুক্তবুদ্ধিসম্পন্না, সমাজ সংস্কারক, মননশীল সাহিত্য সাধক ও নারীমুক্তির পথ প্রদর্শক রূপে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন, থাকবেন চিরকাল। বেগম রোকেয়া ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় পরলোকগমন করেন।
বিষয়শ্রেণী: অন্যান্য
ব্লগটি ৬১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১০/১১/২০২৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast