আমৃত্যু
|| আমৃত্যু ||
(সম্পূর্ণ)
বাংলার এক দূর অজপাড়া গাঁয়ে, সবেমাত্র ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। প্রতিদিনের মতোই পাখিদের কলরবে মুখরিত উত্তর গাঁওয়ের মাতন্ পাড়া। ইদানিং, রাতে ভালো ঘুম হয়না গাঁয়ের প্রবীণতম মানুষ নরেন্দ্রনাথ বসুর। সবাই তাঁকে বসুবাবু নামেই ডাকে। প্রমত্তা নদীর ধার ঘেঁষে তাঁদের চার পুরুষের জমিদারবাড়ি। সে শুধু নামেই। ভেঙে ঝুরঝুরে, নদীগর্ভে বিলীনপ্রায় হাড়জিরজিরে একটি প্রাসাদের কঙ্কাল মাত্র। প্রাসাদের দো'তালায় রাস্তার ধারের একটি স্যাঁতসেঁতে ঘরে, পুরনো রংচটা পালঙ্কে শুয়ে আছেন নরেন্দ্রনাথ। উজ্জ্বল ফর্সা গাত্রবর্ণ, আর শুভ্র চুলদাড়িতে আচ্ছাদিত মুখমন্ডলে রাজবংশীয় ছাপ স্পষ্ট। নিজের পায়ে ভর করে চলতে পারেন না আজ বহুদিন হলো। বিছানার লাগোয়া বিরাট আট শিকের জানালা। নরেন্দ্রনাথের ঘোলাটে চোখ একদৃষ্টিতে সেই জানালার বাইরে নিবদ্ধ। কি দেখছেন, তা বলা মুশকিল। এমনই সময় রাস্তা থেকে হটাৎ শোনা গেলো-
"বলো হরি... হরি বোল...
বলো হরি... হরি বোল..."
: কে যায়? কে যায়...?
: আজ্ঞে আমি কর্ত্তাঠাকুর। পরিমল।
: ও.. তুইও যাচ্ছিস বুঝি? কবে হলো?
: কাল মাঝ রাত্তিরে কর্ত্তা।
: আ...হ্! আ...হ্!
: কি হলো কর্ত্তাঠাকুর?
: বড় কষ্ট রে পরিমল। বড় যন্ত্রণা। আমাকে সঙ্গে নিবিনা?
: মাফ্ করবেন কর্ত্তা। তা হয় না। আমাদের যে একসঙ্গে যাওয়ার নিয়ম নেই।
: নিয়ম নেই..?
: না-গো কর্ত্তাঠাকুর। আপনি আর দুটো দিন অপেক্ষা করুন।
: আরও অপেক্ষা করবো...?
: আজ্ঞে কর্ত্তা। আমি এইবেলা আসি।
: দাঁড়া পরিমল। তোর কি মনে আছে, ওই যে- ওই যে জোড়া পদ্মদিঘিতে আমরা একসাথে খেলে-কুঁদে বড় হয়েছি? দিঘির টলমলে জলে ডুব দিয়ে মুঠোভরে শালুক তুলে এনেছি। দক্ষিণগাঁওয়ের নসু চাচার আমবাগানে আম চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে, তুই আমি কতোবার বাবার হাতে মার খেয়েছি। বাড়ির পিছনের ডেঙাক্ষেতে কাদায় লুটোপুটি করে মাখামাখি হয়ে বাড়িতে ঢুকতেই, কাঠের চেলি হাতে বড়দি তাড়া করতো। তোর মনে পড়ে পরিমল? তোর মনে পড়ে..?
: বড়দি...? খুব মনে আছে। দুগগা প্রতিমার মতো আমাদের বড়দির মুখখানার কথা কী করে ভুলে যাবো কর্ত্তা? সেসব কতো বছর আগের স্মৃতি! বাহির বাঢী থেকে বড়দির তাড়া খেয়ে অন্দরের উঠোনে ঢুকে, পাটের দড়িতে শুকোতে দেওয়া সদ্য ধোয়া সকলের কাপড়চোপড় জল কাদায় এঁটো করে দিয়ে, ফের সেই পদ্মদিঘিতে ঝাঁপ দেওয়া। বড়দি পুকুর ঘাটে আসতেই আমরা ডুব দিয়ে জলের তলায় উধাও হতাম। আমাদের দেখতে না পেয়ে বড়দির তখন সে-কি কান্না।
সেবার আশ্বিন মাসে খুব ধুমধাম করে বড়দির বিয়ে হয়ে গেলো। ঢাকা থেকে কলের গাড়িতে চড়ে বর এলো। রাজপুত্তুরের মতো চেহারা। বিয়ে শেষ হতেই ওরা বড়দিকে নিয়ে কলের গাড়িতে চড়ে ফিরে গেলো। বাড়ির ছোটছোট ছেলেমেয়েরা সকলে মিলে হৈহৈ করে সেই গাড়ির পেছনপেছন অনেক দূর পর্যন্ত ছুটে গিয়েছিলাম। গাড়ির জানালা দিয়ে বড়দি আমাদের দিকে তাকিয়ে খুব কাঁদছিলো। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো- “তোরা বাড়ি ফিরে যা ভাই...। আমি জলদি আবার ফিরে আসবো। অনেক খেলবো তখন। খুব মজা হবে”। তিনদিন পরেই বাড়ির দূর্গাপূজো। বাড়ির উঠোনে ঠাকুর দালানের সামনে চারটে ঢাক বাজছে। সানাই বাজছে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীতে বিশাল বাড়ি গিজগিজ করছে। আমাদের কতো আনন্দ। দেখতে দেখতে বিসর্জনের দিন উপস্থিত হলো। সানাইয়ের করুণ সুরে আমাদের সব আনন্দ যেন গলে জল হয়ে গেলো। দুপুরের দিকে বড়কর্ত্তা (নরেন্দ্রনাথের বাবা) আচমকা আমার বাবাকে ঘোড়ার গাড়ি বার করতে বললেন। চোখের ঈশারায় বুঝিয়ে দিলেন আমাদের দুজনকেও সঙ্গে যেতে হবে। কেন জানিনা হটাৎ করেই বাড়ি পরিবেশটা থমথমে হয়ে উঠলো। ভিতর বাড়িতে মহিলাদের চাপাকান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে আমরা দুজনে একজন আরেকজনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই জোড়াঘোড়ায় টানা গাড়ি রেল স্টেশনের দিকে ছুটে চললো।
: সব মনে পড়ে যাচ্ছে'রে পরিমল। একদিকে সকলে যখন মায়ের পায়ে সিঁদুর ছুঁইয়ে প্রতিমা বিসর্জনের আয়োজন করছে, অন্যদিকে আমার দিদির কপালের সিঁদুর সারাজীবনের জন্যে মিলিয়ে গেছে। কতো আর বয়েস হবে তখন? চৌদ্দ কি পনেরো। জামাইবাবুর মৃত্যুর দুদিন বাদে আমরা বড়দিকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। শ্বশুরবাড়ির লোকেদের তাতে আপত্তি ছিলো। কিন্তু বড়দির মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে বাবা ওসব আমলে নেননি। বড়দির পরনে সাদা থানের শাড়ি দেখে আমার খুব কান্না পেত। আমি প্রায়ই দিদিক বলতাম, “বড়দি, তুমি আগের মত জামা পড়লেই পার। এই সাজে তোমাকে দেখতে ভালো লাগেনা”। এই কথা শুনে বড়দি আচমকা ঠাশ করে আমার গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো। আমি কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে আমার শান্ত স্বভাবের দিদিটির মধ্যে কেমন একটা রাগিরাগি ভাব চলে এলো। দিনের বেশিরভাগ সময় মায়ের ঠাকুরঘরে নামজপ করে কাটাতো। আমার বাবা সেই আমলে ডবল এম এ ছিলেন। কিছুদিন বিলেতে ওকালতি প্র্যাকটিস করে শেষে দেশে ফিরে জমিদারী দেখাশোনায় মনোনিবেশ করলেন। তিনি চাইতেন তার ছেলেমেয়েরাও উচ্চ শিক্ষালাভ করুক। একদিন বড়দিকে ডেকে বললেন- “মা মৃদুলা, তুমি পড়ালেখায় যথেষ্ট মেধাবী ছিলে। বাড়িতে মাস্টারমশাই রেখে দিচ্ছি। তুমি আবার পড়ালেখা আরম্ভ কর, ঢাকায় একটা মেয়েদের স্কুল হয়েছে। মিশনারি স্কুল। সেখানে নাকি মেয়েদের হোস্টেল সুবিধাও আছে। আমি ভাবছি তোমাকে ওই স্কুলটিতে ভর্তি করে দেব”। কিন্তু বিধিতে অন্যকিছু লেখা ছিল বোধ হয়। বাবাকে এবং আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে খুব নরম সুরে দিদি বললো- “বাবা, কিছু মনে করোনা। জীবনে ‘আমার’ বলে আমার আর কোন আকাঙ্ক্ষা নেই। ঐ ঠাকুর ঘরেই আমার জীবন-মরণ সবকিছু সমর্পণ করে দিয়েছি। আমাকে শুধু তুমি এ বাড়িতে থাকতে দিও। আর কিছুই আমার চাওয়ার নেই”। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবা উঠে গিয়ে দিদির সামনে দাঁড়ালেন। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজের কাজে বেড়িয়ে গেলেন।
: কর্ত্তামা আস্তে আস্তে সংসারের সমস্ত ভার বড়দির উপরে ছেড়ে দিলেন। মাঝেমাঝে বড়দিকে দেখলে সেটা কর্ত্তামা না-কি বড়দি বোঝা যেতোনা। বাড়ির সকলকে তিনি কড়া শাসনে এবং শৃঙখলায় বেঁধে রেখেছিলেন। আমাদের পড়ালেখা, খাওয়াদাওইয়া ও নিয়মিত পাঠশালায় যাওয়ার প্রতি তাঁঅর বিশেষ মনোযোগ ছিলো। বিশেষ করে বড় কর্ত্তার স্বর্গপ্রাপ্তির পর থেকে।
: হুম। আমরা প্রায়ই সকুল থেকে জলকাদা গায়ে মাখিয়ে ফিরতাম। বড়দি আমাদের ফেরার অপেক্ষায় বাহির বাঢীর কুয়োতলায় একটা বাঁশের কঞ্চি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতো। উদ্দেশ্য আমাদেরকে সেখানে গা ধুইয়ে, স্নান করিয়ে বাড়িতে ঢোকানো। কতোদিন বড়দির তাড়া খেয়ে অন্দরের উঠোনে ঢুকে, পাটের দড়িতে শুকোতে দেওয়া সদ্য ধোয়া সকলের কাপড়চোপড় জল কাদায় এঁটো করে দিয়ে, ফের সেই পদ্মদিঘিতে ঝাঁপ দিয়েছি। বড়দি পুকুর ঘাটে আসতেই আমরা ডুব দিয়ে জলের তলায় উধাও হতাম। অনেক্ষণ আমাদের ভেসে উঠতে দেখতে না পেয়ে, বড়দির তখন সে-কি কান্না। জল থেকে উঠে এসে, কর্ত্তামায়ের হাতে কতো মার'ই না খেয়েছি দুজনে। শেষে সেই বড়দিই এসে আমাদের দুজনকে বুকে আগলে, মায়ের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনতো। সেসব স্মৃতি কোনদিন ভোলার নয়।
: সেদিনতো তুই আমাকে একা রেখে পালিয়ে যাসনিরে হারামজাদা। আশৈশব দু'জনে একসঙ্গে বুড়ো থুত্থুরে হলাম৷ তবে আজ এতো কীসের তাড়া তোর হতভাগা?
: যমদেব কাওকে নিরাশ করেনা কর্ত্তাঠাকুর। তাঁর কাছে আমার নিবেদন, আপনিও শিগগিরই আসুন। নদীর ও'ঘাটে আমি আপনার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকবো। দয়া করে এইবার আমাকে আজ্ঞা দিন।
: কালের আবর্তে এককালের এতো বড় প্রাসাদবাড়ি, লোকলস্কর- সব গেলো নদীগর্ভে। ছেলেপুলে গেলো। নাতিনাতনিরা দূরদেশে। এই অজপাড়াগাঁয়ে, আর কোনদিনই তারা ফিরবেনা। একগুচ্ছ বুড়ো হাড় নিয়ে কেবল আমিই একা, একটা বটগাছের মতো চির অক্ষয়, এই পৈতৃক জড়াজীর্ণ ভিটের মায়ায় বাঁধা পরে রয়েছি। এই দীর্ঘজীবনের নানান চড়াই-উতরাইয়ে, সুখে-দুঃখে একমাত্র সঙ্গী ছিলি তুই। আজ সেই তুইও কি-না...!
: আমি... আমি পারলামনা কর্ত্তাঠাকুর। আমি পারলামনা। দয়া করে আর অল্পকাল অপেক্ষা করুন। পেন্নাম।
: অপেক্ষা করবো! আরও..? না, না...। দাঁড়া পরিমল। ওরে, ওরে যাসনে হতভাগা৷ ফিরে আয়...। যাসনে পরিমল...। আমাকে ফেলে যাসনে...। পরিমল...। ওরে...।
ভবনদী পার হতে গিয়ে, পরিমল একবারের জন্য করজোড়ে পিছন ফিরে তাকালো। অনেক যোজন দূরে বৃদ্ধ মনিব ও শৈশবের বন্ধুর গগনবিদারী বিলাপ শুনতে পেলো।
: কর্ত্তাঠাকুর, আমার যে কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছেগো। আমি, আমি আপনার জন্য অপেক্ষায় থাকবো। নদীর ওপারে হিজলডাঙার ঘাটে, নাম না জানা গাছটির তলায়। সেই উঁচু ঢিবির ধারে। যেখান থেকে দুজনে রোজ নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পরতাম। নির্মল আনন্দে দুজনে মাতোয়ারা হতাম। আমি এইবেলা যাই। আপনি ভালো থাকুন কর্ত্তাঠাকুর। পেন্নাম।
(গল্পের স্থান, কাল, চরিত্র, বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কোথাও মিলে গেলে তা কাকতাল মাত্র)
----০----
|| আমৃত্যু ||
©সুব্রত ব্রহ্ম
আগস্ট ১৩, ২০২০খ্রিঃ
ময়মনসিংহ।
(সম্পূর্ণ)
বাংলার এক দূর অজপাড়া গাঁয়ে, সবেমাত্র ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। প্রতিদিনের মতোই পাখিদের কলরবে মুখরিত উত্তর গাঁওয়ের মাতন্ পাড়া। ইদানিং, রাতে ভালো ঘুম হয়না গাঁয়ের প্রবীণতম মানুষ নরেন্দ্রনাথ বসুর। সবাই তাঁকে বসুবাবু নামেই ডাকে। প্রমত্তা নদীর ধার ঘেঁষে তাঁদের চার পুরুষের জমিদারবাড়ি। সে শুধু নামেই। ভেঙে ঝুরঝুরে, নদীগর্ভে বিলীনপ্রায় হাড়জিরজিরে একটি প্রাসাদের কঙ্কাল মাত্র। প্রাসাদের দো'তালায় রাস্তার ধারের একটি স্যাঁতসেঁতে ঘরে, পুরনো রংচটা পালঙ্কে শুয়ে আছেন নরেন্দ্রনাথ। উজ্জ্বল ফর্সা গাত্রবর্ণ, আর শুভ্র চুলদাড়িতে আচ্ছাদিত মুখমন্ডলে রাজবংশীয় ছাপ স্পষ্ট। নিজের পায়ে ভর করে চলতে পারেন না আজ বহুদিন হলো। বিছানার লাগোয়া বিরাট আট শিকের জানালা। নরেন্দ্রনাথের ঘোলাটে চোখ একদৃষ্টিতে সেই জানালার বাইরে নিবদ্ধ। কি দেখছেন, তা বলা মুশকিল। এমনই সময় রাস্তা থেকে হটাৎ শোনা গেলো-
"বলো হরি... হরি বোল...
বলো হরি... হরি বোল..."
: কে যায়? কে যায়...?
: আজ্ঞে আমি কর্ত্তাঠাকুর। পরিমল।
: ও.. তুইও যাচ্ছিস বুঝি? কবে হলো?
: কাল মাঝ রাত্তিরে কর্ত্তা।
: আ...হ্! আ...হ্!
: কি হলো কর্ত্তাঠাকুর?
: বড় কষ্ট রে পরিমল। বড় যন্ত্রণা। আমাকে সঙ্গে নিবিনা?
: মাফ্ করবেন কর্ত্তা। তা হয় না। আমাদের যে একসঙ্গে যাওয়ার নিয়ম নেই।
: নিয়ম নেই..?
: না-গো কর্ত্তাঠাকুর। আপনি আর দুটো দিন অপেক্ষা করুন।
: আরও অপেক্ষা করবো...?
: আজ্ঞে কর্ত্তা। আমি এইবেলা আসি।
: দাঁড়া পরিমল। তোর কি মনে আছে, ওই যে- ওই যে জোড়া পদ্মদিঘিতে আমরা একসাথে খেলে-কুঁদে বড় হয়েছি? দিঘির টলমলে জলে ডুব দিয়ে মুঠোভরে শালুক তুলে এনেছি। দক্ষিণগাঁওয়ের নসু চাচার আমবাগানে আম চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে, তুই আমি কতোবার বাবার হাতে মার খেয়েছি। বাড়ির পিছনের ডেঙাক্ষেতে কাদায় লুটোপুটি করে মাখামাখি হয়ে বাড়িতে ঢুকতেই, কাঠের চেলি হাতে বড়দি তাড়া করতো। তোর মনে পড়ে পরিমল? তোর মনে পড়ে..?
: বড়দি...? খুব মনে আছে। দুগগা প্রতিমার মতো আমাদের বড়দির মুখখানার কথা কী করে ভুলে যাবো কর্ত্তা? সেসব কতো বছর আগের স্মৃতি! বাহির বাঢী থেকে বড়দির তাড়া খেয়ে অন্দরের উঠোনে ঢুকে, পাটের দড়িতে শুকোতে দেওয়া সদ্য ধোয়া সকলের কাপড়চোপড় জল কাদায় এঁটো করে দিয়ে, ফের সেই পদ্মদিঘিতে ঝাঁপ দেওয়া। বড়দি পুকুর ঘাটে আসতেই আমরা ডুব দিয়ে জলের তলায় উধাও হতাম। আমাদের দেখতে না পেয়ে বড়দির তখন সে-কি কান্না।
সেবার আশ্বিন মাসে খুব ধুমধাম করে বড়দির বিয়ে হয়ে গেলো। ঢাকা থেকে কলের গাড়িতে চড়ে বর এলো। রাজপুত্তুরের মতো চেহারা। বিয়ে শেষ হতেই ওরা বড়দিকে নিয়ে কলের গাড়িতে চড়ে ফিরে গেলো। বাড়ির ছোটছোট ছেলেমেয়েরা সকলে মিলে হৈহৈ করে সেই গাড়ির পেছনপেছন অনেক দূর পর্যন্ত ছুটে গিয়েছিলাম। গাড়ির জানালা দিয়ে বড়দি আমাদের দিকে তাকিয়ে খুব কাঁদছিলো। কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো- “তোরা বাড়ি ফিরে যা ভাই...। আমি জলদি আবার ফিরে আসবো। অনেক খেলবো তখন। খুব মজা হবে”। তিনদিন পরেই বাড়ির দূর্গাপূজো। বাড়ির উঠোনে ঠাকুর দালানের সামনে চারটে ঢাক বাজছে। সানাই বাজছে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীতে বিশাল বাড়ি গিজগিজ করছে। আমাদের কতো আনন্দ। দেখতে দেখতে বিসর্জনের দিন উপস্থিত হলো। সানাইয়ের করুণ সুরে আমাদের সব আনন্দ যেন গলে জল হয়ে গেলো। দুপুরের দিকে বড়কর্ত্তা (নরেন্দ্রনাথের বাবা) আচমকা আমার বাবাকে ঘোড়ার গাড়ি বার করতে বললেন। চোখের ঈশারায় বুঝিয়ে দিলেন আমাদের দুজনকেও সঙ্গে যেতে হবে। কেন জানিনা হটাৎ করেই বাড়ি পরিবেশটা থমথমে হয়ে উঠলো। ভিতর বাড়িতে মহিলাদের চাপাকান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়ে আমরা দুজনে একজন আরেকজনের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই জোড়াঘোড়ায় টানা গাড়ি রেল স্টেশনের দিকে ছুটে চললো।
: সব মনে পড়ে যাচ্ছে'রে পরিমল। একদিকে সকলে যখন মায়ের পায়ে সিঁদুর ছুঁইয়ে প্রতিমা বিসর্জনের আয়োজন করছে, অন্যদিকে আমার দিদির কপালের সিঁদুর সারাজীবনের জন্যে মিলিয়ে গেছে। কতো আর বয়েস হবে তখন? চৌদ্দ কি পনেরো। জামাইবাবুর মৃত্যুর দুদিন বাদে আমরা বড়দিকে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। শ্বশুরবাড়ির লোকেদের তাতে আপত্তি ছিলো। কিন্তু বড়দির মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে বাবা ওসব আমলে নেননি। বড়দির পরনে সাদা থানের শাড়ি দেখে আমার খুব কান্না পেত। আমি প্রায়ই দিদিক বলতাম, “বড়দি, তুমি আগের মত জামা পড়লেই পার। এই সাজে তোমাকে দেখতে ভালো লাগেনা”। এই কথা শুনে বড়দি আচমকা ঠাশ করে আমার গালে একটা চড় বসিয়ে দিলো। আমি কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে আমার শান্ত স্বভাবের দিদিটির মধ্যে কেমন একটা রাগিরাগি ভাব চলে এলো। দিনের বেশিরভাগ সময় মায়ের ঠাকুরঘরে নামজপ করে কাটাতো। আমার বাবা সেই আমলে ডবল এম এ ছিলেন। কিছুদিন বিলেতে ওকালতি প্র্যাকটিস করে শেষে দেশে ফিরে জমিদারী দেখাশোনায় মনোনিবেশ করলেন। তিনি চাইতেন তার ছেলেমেয়েরাও উচ্চ শিক্ষালাভ করুক। একদিন বড়দিকে ডেকে বললেন- “মা মৃদুলা, তুমি পড়ালেখায় যথেষ্ট মেধাবী ছিলে। বাড়িতে মাস্টারমশাই রেখে দিচ্ছি। তুমি আবার পড়ালেখা আরম্ভ কর, ঢাকায় একটা মেয়েদের স্কুল হয়েছে। মিশনারি স্কুল। সেখানে নাকি মেয়েদের হোস্টেল সুবিধাও আছে। আমি ভাবছি তোমাকে ওই স্কুলটিতে ভর্তি করে দেব”। কিন্তু বিধিতে অন্যকিছু লেখা ছিল বোধ হয়। বাবাকে এবং আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে খুব নরম সুরে দিদি বললো- “বাবা, কিছু মনে করোনা। জীবনে ‘আমার’ বলে আমার আর কোন আকাঙ্ক্ষা নেই। ঐ ঠাকুর ঘরেই আমার জীবন-মরণ সবকিছু সমর্পণ করে দিয়েছি। আমাকে শুধু তুমি এ বাড়িতে থাকতে দিও। আর কিছুই আমার চাওয়ার নেই”। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাবা উঠে গিয়ে দিদির সামনে দাঁড়ালেন। তারপর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে নিজের কাজে বেড়িয়ে গেলেন।
: কর্ত্তামা আস্তে আস্তে সংসারের সমস্ত ভার বড়দির উপরে ছেড়ে দিলেন। মাঝেমাঝে বড়দিকে দেখলে সেটা কর্ত্তামা না-কি বড়দি বোঝা যেতোনা। বাড়ির সকলকে তিনি কড়া শাসনে এবং শৃঙখলায় বেঁধে রেখেছিলেন। আমাদের পড়ালেখা, খাওয়াদাওইয়া ও নিয়মিত পাঠশালায় যাওয়ার প্রতি তাঁঅর বিশেষ মনোযোগ ছিলো। বিশেষ করে বড় কর্ত্তার স্বর্গপ্রাপ্তির পর থেকে।
: হুম। আমরা প্রায়ই সকুল থেকে জলকাদা গায়ে মাখিয়ে ফিরতাম। বড়দি আমাদের ফেরার অপেক্ষায় বাহির বাঢীর কুয়োতলায় একটা বাঁশের কঞ্চি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতো। উদ্দেশ্য আমাদেরকে সেখানে গা ধুইয়ে, স্নান করিয়ে বাড়িতে ঢোকানো। কতোদিন বড়দির তাড়া খেয়ে অন্দরের উঠোনে ঢুকে, পাটের দড়িতে শুকোতে দেওয়া সদ্য ধোয়া সকলের কাপড়চোপড় জল কাদায় এঁটো করে দিয়ে, ফের সেই পদ্মদিঘিতে ঝাঁপ দিয়েছি। বড়দি পুকুর ঘাটে আসতেই আমরা ডুব দিয়ে জলের তলায় উধাও হতাম। অনেক্ষণ আমাদের ভেসে উঠতে দেখতে না পেয়ে, বড়দির তখন সে-কি কান্না। জল থেকে উঠে এসে, কর্ত্তামায়ের হাতে কতো মার'ই না খেয়েছি দুজনে। শেষে সেই বড়দিই এসে আমাদের দুজনকে বুকে আগলে, মায়ের হাত থেকে ছাড়িয়ে আনতো। সেসব স্মৃতি কোনদিন ভোলার নয়।
: সেদিনতো তুই আমাকে একা রেখে পালিয়ে যাসনিরে হারামজাদা। আশৈশব দু'জনে একসঙ্গে বুড়ো থুত্থুরে হলাম৷ তবে আজ এতো কীসের তাড়া তোর হতভাগা?
: যমদেব কাওকে নিরাশ করেনা কর্ত্তাঠাকুর। তাঁর কাছে আমার নিবেদন, আপনিও শিগগিরই আসুন। নদীর ও'ঘাটে আমি আপনার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকবো। দয়া করে এইবার আমাকে আজ্ঞা দিন।
: কালের আবর্তে এককালের এতো বড় প্রাসাদবাড়ি, লোকলস্কর- সব গেলো নদীগর্ভে। ছেলেপুলে গেলো। নাতিনাতনিরা দূরদেশে। এই অজপাড়াগাঁয়ে, আর কোনদিনই তারা ফিরবেনা। একগুচ্ছ বুড়ো হাড় নিয়ে কেবল আমিই একা, একটা বটগাছের মতো চির অক্ষয়, এই পৈতৃক জড়াজীর্ণ ভিটের মায়ায় বাঁধা পরে রয়েছি। এই দীর্ঘজীবনের নানান চড়াই-উতরাইয়ে, সুখে-দুঃখে একমাত্র সঙ্গী ছিলি তুই। আজ সেই তুইও কি-না...!
: আমি... আমি পারলামনা কর্ত্তাঠাকুর। আমি পারলামনা। দয়া করে আর অল্পকাল অপেক্ষা করুন। পেন্নাম।
: অপেক্ষা করবো! আরও..? না, না...। দাঁড়া পরিমল। ওরে, ওরে যাসনে হতভাগা৷ ফিরে আয়...। যাসনে পরিমল...। আমাকে ফেলে যাসনে...। পরিমল...। ওরে...।
ভবনদী পার হতে গিয়ে, পরিমল একবারের জন্য করজোড়ে পিছন ফিরে তাকালো। অনেক যোজন দূরে বৃদ্ধ মনিব ও শৈশবের বন্ধুর গগনবিদারী বিলাপ শুনতে পেলো।
: কর্ত্তাঠাকুর, আমার যে কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছেগো। আমি, আমি আপনার জন্য অপেক্ষায় থাকবো। নদীর ওপারে হিজলডাঙার ঘাটে, নাম না জানা গাছটির তলায়। সেই উঁচু ঢিবির ধারে। যেখান থেকে দুজনে রোজ নদীর জলে ঝাঁপিয়ে পরতাম। নির্মল আনন্দে দুজনে মাতোয়ারা হতাম। আমি এইবেলা যাই। আপনি ভালো থাকুন কর্ত্তাঠাকুর। পেন্নাম।
(গল্পের স্থান, কাল, চরিত্র, বিষয়বস্তু সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কোথাও মিলে গেলে তা কাকতাল মাত্র)
----০----
|| আমৃত্যু ||
©সুব্রত ব্রহ্ম
আগস্ট ১৩, ২০২০খ্রিঃ
ময়মনসিংহ।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
আব্দুর রহমান আনসারী ১৫/০৮/২০২০ভালো
-
ফয়জুল মহী ১৪/০৮/২০২০চমৎকার একটা লেখা পড়ে গেলাম। l
-
আব্দুর রহমান আনসারী ১৪/০৮/২০২০খুব সুন্দর
-
সাইয়িদ রফিকুল হক ১৪/০৮/২০২০ভালো।