www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ভোরের পাখি

স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার অমন মিষ্টি হাসির স্বপ্নখানি কাহারো বেঢং আওয়াজের হাসিতে রোজ ভাঙিয়া যাইত, তাহাতে আমি প্রায়ই বিরক্ত বোধ করিলেও, আবছা ঘুমের কোলে কে এত সকাল সকাল নিজের প্রত্যহ কর্মের বিষ, সমস্তখানি আমার পাতে ঢালিয়া দিয়া বেশ খুশি হইত তা দেখিবার মনোবাসনা অলস থাকার দরুন পূর্ণ হয় নাই। আমার গৃহখানির উপরেই মস্ত আকারের ব্রিটিশ আমলের এক বড়ই গাছ দম্ভ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। আজকাল সেই গাছে কাঁক পক্ষীদের ঠাই হয় বলিয়া মনে হয় না। কোন এক কাঁচা বয়সী বালিকার নূপুর পায়ের ছন্দ যেমন তাহাদিগর যন্ত্রণার কারণ হইয়াছে তদ্রুপ আমার মনের পীড়নও সমান্তরালে বাড়িয়া চলিতেছে। আমি একদিন রাগের বশত সিদ্ধান্ত লইয়া বসিলাম, আমি এই কালকূট ভূতের উৎপাত থামাইবার জন্য ব্যাবস্থা লইব, আবার ইহাও বোধগম্য হইল না, কি কারনে কুড়ানো সকল বড়ই আমার আধা পাকা গৃহের দ্বারে রাখিয়া যাইত। সে যাই হোক অল্ম বড়ই কে খাইবে এমন প্রতিবাদে হয়ত সে তাহা জড় করিয়া জানান দিয়া যাইত। আমিও অতিষ্ঠ হইয়া তাহাকে শিক্ষা দেবার মানসে এক ফন্দী আটিলাম, তাহারে নিশি ভোরে ভয় দেখাইব। একদিন সুযোগ বুঝিয়া মুখে চুন কালি মাখিয়া, লম্বা সাদা জামা গায়ে জড়াইয়া তাহারে ভয় দেখাইলাম। সে ওরে মা বলিয়া চিৎপটাং করিয়া বেহুশ হইয়া গেল। সেদিন ভয় পাইয়া চিৎকার করিতেই পাড়াময় এক গল্প তৈরি হইয়া গেল, তাহার উপর নাকি ভূতের আছর পড়িয়াছে, আজকাল কেহ তাহারে গৃহ দ্বারে দেখিলে ভয় পাইয়া খিল আটকাইয়া দেয়, তাহার দিকে আড়চোখে তাকাইয়া থাকে, ভাবে বাঘিনীর কবলে পড়িয়াছে। ইহাযে তার কত মন কষ্টের কারণ হইয়াছে, সে ছাড়া আর কেহ বুঝিতে পারে না। যাহাকে তাড়াইবার বাসনা লইয়া অত্যাচার করি, সে কি রূপে হৃদয়ের জালে আস্টে-পিস্টে জড়াইয়া যায় তার ব্যাখা খুজিয়া পাইলাম না। শুনিলাম তাহার গায়ে জ্বর আসিয়া বেশ কাঁপাইয়া যাইতেছে। এক সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বালাইয়া মাতার সহিত দেখিতে গেলাম। মাতার সহিত দুচার খানা ভালো মন্দ কথা কহিল বটে, আমার দিকে আড়চোখে তাকাইয়া পাশ ফিরিয়া শুইয়া রহিল। মাতা উঠিয়া পাশের ঘরে যাইতেই আমি তাহার বালিশের তলে সন্দেশের পুটলি রাখিয়া, চলিয়া আসিতে লাগিলাম, তখন হাতখানা ধরিয়া, উঠিয়া বসিল আকুতি ভরা কণ্ঠে বলিল কিছুক্ষন বসিয়া যাওনা হে দাদা ভাই। ঝড়ে যেমন গৃহের খুটি থরথর করিয়া কাঁপে, আমার পা দুখানা তেমন করিয়া কাঁপিতে লাগিল, চোখে চোখে পড়তেই চাঁদর টানিয়া সে নিজেকে গুটাইয়া লইল। আসার বেলা ফিসফিস করিয়া বলিয়া আসিলাম, ভয় দেখাইয়া ভুল করিয়াছি। ওরে বাবা সে অমন সুন্দর করিয়া হাসিয়া দিল, যাতে শীতল পরশ সমস্ত দেহে মাখিয়া গেল। অনুভব করিতে পারিলাম যন্ত্রণা তাড়াইতে গিয়া নিজেকেই যন্ত্র রূপে আবিষ্কার করিয়াছি, যাহার অন্তরের ভিতর তিরস্কারে ভরা। যন্ত্র ঠিকমত কাজ না করিলে তার যন্ত্রনা ঘাড়ে চাপিয়া বসে। তাহার প্রত্যেহ পায়ের নুপুরের ধ্বনি আজ আমার হৃদয় জুড়িয়া দখল করিয়া রাখিয়াছে, কিন্তু আর সে আমার গৃহের উঠোনে রোজ ভোরে ভোরের পাখি হইয়া বরইতলে বড়ই খুটিতে আসে না।
শশী, আঁধার ঘরের চাঁদ বলিয়া নিত্য উদয় হয় নবনব রূপে, দুলাল চাচার একমাত্র আদরের দুলালী।বাধ্য মেয়েদের মধ্যে যে গুনাগুন থাকিলে, সকলেই তাহারে পরম স্নেহে মমতায় জড়াইয়া যায়, তার সব গুনি রহিয়াছে। তাহারে লইয়া বাবা মার কত স্বপ্ন, কত ভাবনা খেলা করিয়া যায়, তার অমর সাক্ষী হইলাম আমি। এখানে সেখানে পড়িয়া অগ্রিম দুই বছর খরচ করিয়া ফেলিয়াছি, তারি দরুন তাহার সাথে একই শ্রেণীতে পড়িতে হইতেছে। দশম শ্রেণীতে পা রাখিয়া, শশীর আলোর কণার বিচ্ছুরণ চারিদিকে ছড়িয়া যাইতেছে। নিজেকে গোপন রাখিয়া গল্প শোনাইবার ইচ্ছে পোষণ করিয়াছিলাম কিন্তু অপরাধীর কথা গোপন রাখিলে আরও বড় অপরাধী হইয়া যাইব। মাতার বর্ণনা অনুযায়ী আমার নাম শ্রাবণ, মেঘ বাদলের দিনে পৃথিবীতে পদার্পণ করিয়াছি বলিয়া এই নাম রাখিয়া তাহারা তাহাদের কর্ম উদ্ধার করিয়াছে। স্বাগত জানাইয়া ভরা গৃহে বান ডাকিয়া লইয়া আসিয়াছে, তাহা জল নয় গৃহময় অগোছালো ঘটি বাটি, জামা কাপড়ের বান। তিন ভাইয়ের মধ্যে আমিই সবার বড় বলিয়া, অনেক কিছু করিতে চাইলেও করিতে পারি না, বলিতে চাইলেও বলিতে পারিনা। কিন্তু অলসতার জুড়ি মেলা ভার। মাতা আমার আজকাল গৃহ গোছাইতে গিয়া হাঁপাইয়া ওঠে। বাবার শাসন অগ্রাহ্য করিয়া, বুক ভরিয়া নিঃশ্বাস লইয়া আপন মনে চলি। এর বিপরীতও হইতেছে সুন্দর বাগানের মত পরিপাটী করিয়া মাঝে মাঝে গৃহখানি কে যেন সাজাইয়া যায় বুঝিতে পারিনা। খোঁজ লইয়া জানিতে পারিলাম ইহা পিচ্চি শশীর কর্ম। ইহা কানাঘুষা করিতে করিতে পাড়ায় হাহাকার পড়িয়া যাইবে, তখন মুখ দেখানো দ্বায় হইয়া যাইবে। আমি একদিন রাস্তায় দাঁড়াইয়া তাহারে কড়া ভাবে বলিয়া দেই যেন আমার বাড়ি কখনো না যায়, ইহাই আবার আমার দরদী মা জননীর কাছে আসিয়া নয়ন জলে বুক ভাসাইয়া ফুপিয়া ফুপিয়া বলিয়া দেয়ায়, আমার সেদিনের মত রাতের খাবার বন্দ করিয়া মা জননী ঘরে খিল দিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। আমি তাহাকে মোটেও সহ্য করিতে পারি না, ছোট বেলায় খেলার সময় একখণ্ড জিলাপি লইয়া আমার নাকের ডগায় বসিয়া খাইয়াছিল, আমাকে দেবার প্রয়োজন বোধ করে নাই, সেই থেকে মনে মনে মান অভিমান পুষিয়া রাখিয়াছি। আমাদের আটসাট বাড়ির সামনের পুকুরের পাড় ধরে এগোলেই তাহাদিগর ছিমছিম গোছানো বাড়ি, তারি চারিপাশে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেত, আমাদের বাড়ির উঠোন দিয়েই তাহাদের চলাচল। শশীর মা বাবা আমাকে যে কি রূপে ভালোবাসে তাহা বলিয়া বুঝানো যাইবে না।
শশী, ছোট বেলা হতেই সে আমার কাছে উৎপাত বলিয়া চিহ্নিত হইয়া আছে, স্কুলে আমার সাথে এক বেঞ্চে বসিতে চাহিত, আমি বেঞ্চের মাঝখানে বসিয়া পাখির ডানার মত দুইহাত ছড়াইয়া দিয়া, সমস্ত বেঞ্চ দখল করিয়া রাখিতাম। মালতিরে বসিতে দিলেও তাহার জন্য কোন জায়গা আমি ছাড়িতাম না। এ নিয়ে তাহার অভিযোগের অন্ত ছিল না, গ্রামের মাতব্বরের ছেলে হওয়ার সুবাদে ছোট খাটো বিচার শিক্ষক মশাই হাসিয়া উড়াইয়া দিতেন, আর সে ছলছল নয়নে ফুপিয়া বুক ভাসাইত। পাড়ার সকল ছেলে মেয়ে মিলিয়া যখন পুতুল বিয়ে খেলিতাম তখনো খেলায় রাখিতাম না, সে দূরে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকাইয়া অবোধ প্রাণীর মত ফুপিয়া কাঁদিত, তবু কোনরূপে আমার মন গলিত না, সাদা কালো যুগের ছবিতে খলনায়কের মত অট্টহাসি দিয়া উপহাস করিলে তাহার হৃদয়ে যে ক্ষত দাগ পড়িয়া যাইত, তাহার মাঝেই আমার সমস্ত আনন্দ রহিত। তাহাকে আমার কোনরূপে নজরে আসিলেই তাহার প্রতি মানসিক অমানবিক অত্যাচারীর পশুত্ব জাগিয়া উঠিত। তাহার গায়ের রং শ্যামলা বলিয়া না, তাহাদের চেয়ে আমাদের বংশ উচু আর অর্থের ঝংকারের অহংকার। তাহা আজ অংক কষিয়া সরল অংকের ফলাফল জানিতে বড় ইচ্ছে করে। আমার এত অবহেলা সে কেন মানিয়া লইত, তাহা বুঝিবার বয়স হয়ত আজো হইয়া ওঠে নাই। আমার জন্য কেহ অপেক্ষা করিয়া চলিয়া গেলে নিজেকে বড় অপরাধী মনে হয়। একই শ্রেণীতে পড়িবার দরুন সর্বদা আড়ালে থাকিয়া বন্ধুবান্ধবের কাছে তার প্রতি দুচার খানা ভালোমন্দ কথা বলিলেও, নক্ষত্রের মত হঠাত তার উদয় হইলে আমার ঠোঁটের ঝড় দ্রুত থামিয়া যাইত। সে কেবল চঞ্চল ডাহুকের মত তাকাইয়া থাকিত আর আমি গর্তের সাপ হইয়া ফোঁসফোঁস করিতাম। বন্ধু বান্ধবীদের মধুর জ্বালাতন মাথার উপর দিয়া বইয়া যাইত, কখনো খেয়াল করি নাই। সেই সব যন্ত্রণাগুলো জমাট বাঁধিয়া হৃদয় আকাশে ঘনঘটা কালো মেঘের বেশে জমা হইত। অভাগী যা চাহিত তা কখনো পায় নাই, আবার সমবয়সী হওয়ার সুবাদে তাহার মনের ভাঁজে ভাঁজে লেখা কথামালা আমার পক্ষে বোঝা বড়ই দুষ্কর ছিল।
গত বৈশাখে আমাদের বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে মেলা বসিয়াছিল, সেই মেলায় আমার সহিত যাইবে বলিয়া গোঁ ধরিয়া বসিয়া ছিল। বলিয়াছিলাম পাড়ার মেয়েদের সাথে গেলে ভালো হইবে, সারা মেলা ঘুরিয়া, আনন্দ করিয়া দেখিতে পারিবে। কোনরূপে কোন কথায় কাজ হইল না, তার মাতা আসিয়া আমাকে অনুরধ করিয়া বসিল, সাথে মা জননীর ধমক খাইয়া, তাহার ভরা মলিন মুখ দেখিয়া মায়া বশত, আগ্রহ না থাকা স্বত্বেও সাথে লইয়া যাইতে বাধ্য হইলাম। মেলায় ভিড়িতেই নতুন উৎপাতের উদয় হইল, হাসুর গাল টিপ্পনী কথা, আমার মোটেও ভালো লাগিত না, অল্পতেই মাথা গরম হইয়া উঠিত। আমার জ্বালা পোড়া করিলেও, শশী তাহাতে মোটেও সংকোচ বোধ করিত না, বিচলিত না হইয়া বরং খুশি হইত। হাসুর অতিরঞ্জিত কথা শুনিয়া মাথায় চড়িয়া গেল, কলার চাপিয়া ধরিয়া সজোরে দেয়ালের সাথে আঘাত করিতেই মাথা শিংয়ের মত ফুলিয়া উঠিল, ইহা দেখিয়া সকল বন্ধু বান্ধবী হতবিম্ব হইয়া চুপ হইয়া গেল। মাঠের কোনে এক প্রকার জট পাকিয়া গেল। বাবার কাছে বিচার দিলে, দেখিয়া লইব বলিয়া শাসিয়া দিলাম। ভিড়ের মধ্য হইতে শশীর হাত ধরিয়া প্রসাধনীর দোকানের সামনে লইয়া গেলাম। বলিলাম "শশী কি নিবি?" মাথা নিচু করিয়া ভয়ে ভয়ে বলিল "কিছুই লইব না"। আমি তখনো রাগে ফোঁসফোঁস করিতেছি। খুজিয়া দেখিলাম দোকানের কোনে এক জোড়া সোনালী নূপুর দোল খাইতেছে, বলিলাম "শশী নূপুর জোড়া লইবি, তোকে খুব মানাইবে"। এইবার মেঘ কাটিয়া রবির হাসি ফুটিয়া উঠিল।
একদিন স্কুল ছুটি শেষে শশীর খোঁজ করিয়া তাহাকে খুজিয়া পাইলাম না, দ্রুত পায়ে হাটা শুরু করিলাম, দেখি পথের ধারে পুকুর পাড়ে গাছের ছায়ায়, শেফালী আর সে মাচার উপর পা দুলিয়া বসিয়া রহিয়াছে। আমাকে দেখিয়া বলিল শ্রাবণ দাদা তোমার জন্যই বসিয়া রহিয়াছি, আমি কোনরূপ ভনিতা না করিয়া হাঁপাইতে হাঁপাইতে সোজা বলিয়া বসিলাম "শশী তোর খালাতো ভাই সৌদি প্রবাসী মেরুন ভাইয়ের সাথে বিয়ে নাকি ঠিক হইয়া গিয়াছে, শুনিলাম পরীক্ষার পরেই বিয়ে করিয়া উড়াল দিয়া প্রবাসে লইয়া যাইবে, পাড়াময় গুঞ্জন চলিতেছে"। সে কোনরূপ উত্তর না দিয়া, নিরুত্তাপ আকাশের দিকে মুখ ফিরাইয়া হাটা শুরু করিল। আমি পিছন দিক হইতে প্রশ্ন করিলেও কোনরূপ সাড়া মিলিল না। এমন খরা মুখের পৃথিবীকে অচেনা লাগিল, চপল পায়ে হাটার আওয়াজে পথে দাগ পড়িয়া রহিল।তাহার বাড়ি গিয়া সত্যতা জানিয়া আসিলাম, বিয়ে হইলে হইবে ইহাতে আমার মাথা ব্যাথা নাই, কিন্তু পাগলি না থাকিলে যে তাহাকে খুব মনে পড়িবে তাহা ভাবিতেই মনের মধ্যে মোচড় দিয়া উঠিল। শ্বাস আটকাইয়া যাইতে আরম্ভ করিল, গৃহে ফিরিয়া আয়নায় মুখ দেখিলাম ভ্রু জোড়া ঘামে ভিজিয়া গেছে।
কিছু কালের মধ্যে স্কুলের টেস্ট পরীক্ষা সমাপন হইল এর মধ্যে কাহারো পরীক্ষা ব্যাতিত মুখ দর্শন হইত না। যথাসময়ে ফলাফল ঘোষণা হইল শশী সর্বোচ্চ নাম্বারধারী হইয়া প্রথম স্থান অধিকার করিল আর আমি টেনেটুনে পাশের মুখ দর্শন করিলাম, তাহাতেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলিয়া আনন্দে উল্লাস করিলাম। দোয়া নেয়ার কারণ দেখাইয়া বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষকের কাছে বিদায় অনুষ্ঠানের অনুমতি চাহিয়া, অনুমতি পাইয়া গেলাম। সকলের কাছ হইতে চাঁদা উঠাইয়া, দিনক্ষণ ঠিক করিয়া অনুষ্ঠান আয়োজনের দায়িত্বে থাকিলাম। সে দিন শনিবার ভোরের আলো অস্তমিত হইয়া আছে, মেঘকে ঠেলিয়া, আপন মনে খেলিতে পারিতেছে না। আজ বিদ্যালয় প্রাঙ্গন ধুয়ে মুছে নতুন রূপে দেখিয়া মনটা আনন্দে নাচিয়া উঠিল, মাইকে ঘোষণা চলিতেছে কয়টায় কোন পর্ব চলিবে। ভোর সকালে একে একে সব বন্ধু বান্ধবী আসিয়া বিদ্যালয় প্রাঙ্গন পাখির কোলাহলের মত মাতিয়া তুলিয়াছে। দুচার জন মিলিয়া স্কুলের প্রথম দিনের স্মৃতি মন্থন করিতেছে। আমার প্রথম পদার্পণ ছিল বাবার সহিত, সাথে ছিল শশী, তাহার সহিত প্রথম স্কুলে আসিয়া প্রথম দিন কাটাইয়াছিলাম। এই স্কুলের প্রতিটি গাছ, ঘাস খুব নিকট আত্নিয় হইয়া গিয়াছে। যাই হোক সব পরিচিত মুখ দেখিলেও একজনের দেখা পাইতেছিলাম না, জারুল গাছের তলে দাঁড়াইয়া তার অপেক্ষায় রহিয়াছি। একে ওকে জিজ্ঞাসা করিলেও বলিতে পারে না, ভোরে তার সাথে দেখা হয় নাই। রোদ্দুর মাঠের দিকে তাকাইলে চোখ ঝলসাইয়া যায়, হঠাত মাঠের মাঝে কাউকে দেখিয়া চোখ আটকাইয়া গেল, নীল শাড়িতে কেমন রোদের আলো পড়িয়া ঝলমল করিয়া উঠিতেছিল, অপরূপ শোভার বিচ্ছুরণ চারিদিকে ঢেউ খেলিতেছিল। তাকাইয়া থাকিতে থাকিতে সে কাছে আসিয়া ভিড়িল। সবাই তাহার জন্য অধীর আগ্রহ লইয়া অপেক্ষা করিতেছিল, তাহাকে দেখিয়া সকলেই হইহই করিয়া উঠিল। অমন সাঁজ দেখিয়া সকলের চোখ ছানাবড়া হইয়া গেল, এত সুন্দর করিয়া সাজিলে তাহারে মায়াপরি লাগিবে তা কেউ আগে কখনো স্বীকার করে নাই। দেরি হওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করিতেই তড়িৎ উত্তর দিল সাজিতে গিয়া দেরি হইয়া গিয়াছে। কালবিলম্ব না করিয়া মঞ্জে যাইতে বলিলাম, শশীর কণ্ঠে প্রথম অনুষ্ঠান ঘোষণা আসিল। কাঁপা গলায় বলিলেও তাহার মাঝে জাদুর ছোঁয়া ছিল বলিয়া মনে মনে হাসিয়া উঠিলাম। অনুষ্ঠান যথারীতি চলিতে আরম্ভ করিল। অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে কে কোনদিক চলে যাইতেছিল কার খবর কে রাখে? মাঝখানে এক ছোট্ট বালক আসিয়া আমার পাঞ্জাবীর কোনা ধরিয়া ডাকিতেছে "এইযে শ্রাবণ কাকু তোমাকে ডাকিতেছে", আমি তাহার দিকে মুখ ফিরাইয়া বলিলাম "কে ডাকিতেছে"? সে তড়িঘড়ি জবাব দিল "শশী আন্টি ওই দিকে আছে, আপনাকে ডাকে" বলিয়া চলিয়া গেল। এদিক ওদিক খুজিয়া দেখিলাম পলেস্তার চটে ওঠা দুই বিল্ডিঙয়ের মাঝে ফাঁকা জায়গায় শশী একা দাঁড়াইয়া রহিয়াছে। কাছে যাইতেই ত্রস্ত মনে আমার হাতে একখানা ভাঁজ করা সাদা কাগজ ধরাইয়া দিল। তার মনে হইতে লাগিল তার দিন ক্ষণ ফুরিয়া আসিতেছে, সে যাহা দিয়াছে তাহা বাড়িতেই ধীর স্থির ভাবে দিতে পারিত, হয়ত বিদায়ের উন্মাদনায় তার মধ্যেও বিদায়ের দাগ বসিয়া গিয়াছিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম "এইটা কি"? বলিল পড়িয়া আজকেই জানাইতে। ভাবিলাম কোন প্রশ্ন হইবে বোধয়, নাড়াচাড়া করিয়া ভাঁজ না খুলিয়া, না পড়িয়া, আনমনে হাটা ধরিলাম পিছনে আর ফিরিয়া তাকাইলাম না। মঞ্চের দিকে যাইতে পথে হাসুর সহিত দেখা হইল, হাসুর হাতে কাগজখানা গুজিয়া দিয়া বলিলাম, "শশীরে কাগজে লেখা প্রশ্নের উত্তরখানা জানাইয়া দিস"। জানিত পরীক্ষায় টেনেটুনে পাশ, উত্তর বোধয় পারিব না। আমি অনুষ্ঠানে চলিয়া গেলাম, তুই জানাইয়া দিস বন্ধু। সে মাথা নাড়িয়া সম্মতি জ্ঞাপন করিল। আজিকে কলের পাড়ে জল ভরাইতে গিয়া হাত হইতে কাঁচের গ্লাস পড়িয়া ভাঙিয়া গেল, ভাবিলাম অসাবধানতার ফল হইবে বোধয়। বাকিটুকু লিখিতে যাইয়া হাত কাঁপিতেছে, কণ্ঠ রোধ হইয়া আসিতেছে, জলের আকাশ পৃথিবী ভাসাইয়া লইয়া যাইতেছে, তবুও অপরাধ সবাইকে জানাইতে আজ বড় ইচ্ছে করে। ঘন্টা দেড়েক পর মিষ্টি বিতরণ কালে লক্ষ করিলাম অনুষ্ঠানে শশী ছাড়া সকলেই উপস্থিত রহিয়াছে। তাহাকে তন্ন তন্ন করিয়া খুজিয়া না পাইয়া মনক্ষুণ্ণ হইল। দেখিলাম আমার ছোট ভাই দোলন আমার নাম ধরিয়া ডাকিতে ডাকিতে হাঁপাইয়া দৌড়াইয়া আসিতেছে, কাছে আসিয়া জড়াইয়া ধরিয়া ভারা গলায় বলিল "ভাইয়া, শশী আপা বিষ খাইয়াছে, তাড়াতাড়ি চল"। শুনিয়া সকলে স্তম্ভিত হইয়া গেল, শরীর ঘামিয়া উঠিল, বদনের উপরে বিষণ্ণ ছাপ পড়িয়া গেল, কেন? কি জন্য? এমন হইল জিজ্ঞাসা করিবার শক্তি হারাইয়া ফেলিলাম। সকলে মিলিয়া শশীদের বাড়ির দিকে দৌড়াইতে আরম্ভ করিল, পথ যেন আর শেষ হইতেছে না। পৌঁছাইয়া দেখিলাম উঠোন ভরা মানুষের ঢল, তাহার মা বাবার কি যে করুণ আর্তনাদ তাহা শুনিলে পশু পাখির আত্না ফাটিয়া চৌচির হইয়া যাইবে। বাড়িময় শোকের মাতম, সকলে মুখে হাত চাপিয়া ছলছল চোখে দাঁড়াইয়া রহিয়াছে, কেহ কোন কথা কহিতেছে না। ভিড় ঠেলিয়া গৃহের মধ্যে ঢুকিতেই চোখ বেয়ে জল পড়িতে আরম্ভ করিল, কোন রূপে বাঁধা মানিতে চাহিতেছে না। শশীর নীল শাড়ি জড়াইয়া খাটের উপর পড়িয়া আছে, মুখের মধ্যে বিষের ফেনা উথলাইয়া পড়িতেছে, লাল চুরিগুলো ভাঙিয়া গিয়াছে, উন্মাদের মত বাহিরে ছুটিয়া আসিয়া, হাসুর কাছে চিরকুট চাহিতেই সে বাহির করিয়া হাতে ভরিয়া দিল, ভাঁজ খুলিতে খুলিতে চোখের জলে ভিজিয়া গেল, আবছা চোখে দেখিলাম লেখা আছে "শ্রাবণ দাদা তোমারে বড্ড ভালোবাসি, কিন্তু জানিনা কেন এত অবহেলা কর, ইতি শশী"। বুক ফাটানো আওয়াজ দিয়া শশীর পড়ে থাকা দেহের কাছে গিয়া দেখিলাম, তার হাতের মধ্যে নূপুর জোড়া ধরিয়া আছে, সাথে আরেকটা চিরকুট মুষ্টি পাকিয়া আছে, আমি মাতালের মত খামচাইয়া ধরিয়া চিরকুটের ভাঁজ খুলিলাম, দেখিলাম ছোট অক্ষরে লেখা আছে "হাসুর কটু কথা আর শ্লিতাহানির চেষ্টা, সহ্য করতে না পারিয়া চির বিদায় নিলাম, শ্রাবণ দাদা অভিমান ভাঙিয়া তোমার দেয়া নূপুর জোড়া ফেরত লইও, ইতি ভোরের পাখি"। চিরকুট পড়িয়া শক্ত হইয়া চোখের জল মুছিতে মুছিতে দাঁড়াইলাম, ধীর স্থির ভাবে একখানা ধারালো বটি খুজিয়া বাহির করিলাম, কেউ কিছু বুঝিয়া ওঠার আগেই, রাগ ক্রোধে উন্মাদ হইয়া উঠোনে দাঁড়ানো হাসুর গলা সই করিয়া দুইটা কোপ হাঁকাইলাম, তা ঠিকমত না লাগিয়া হাতে লাগিল, কেহ দৌড়াইয়া পালাইল, কেহ মিলিয়া আমাকে জোর করিয়া আটাকাইল, হাসু রক্তে ভিজিয়া মাটিতে পড়িয়া গেল, আমি পাগলের মত দাঁত চেপে অট্ট হাসি দিয়া জ্ঞান হারাইয়া পড়িলাম। তিনমাস পর জেল হতে ছাড়া পাইয়া বাড়ি আসিলাম। জীবনের জেলখানায় বন্দী হইয়া গিয়াছি, অভিমানের দাম চোখের জলে মিটাইতে হইবে জানিলে, তাহারে অবহেলা না করিয়া তাহার হৃদয়ে সারাজীবন বন্দী হইয়া থাকিতাম। স্মৃতির তরী ভাসিতেছে শুধু মাঝি নাই, অজানা গন্তব্য। নিত্য জানাল খুলিয়া আমি তাহারে দেখি, সে অপলক দৃষ্টিতে বিরামহীন, ক্লান্তিহীন ভাবে এক নাগাড়ে আমার দিকে তাকাইয়া থাকে, আমিও তার কবর পানে সকাল সন্ধ্যা তাকাইয়া থাকি, ভোরের পাখি হইয়া আর সে জাগিবে না, চিরঘুমে ঘুমাইয়া রহিয়াছে।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ৮৬১ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১০/০৬/২০১৮

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast