একটি ঝড় ও কয়েকটি কবুতর
(১)
জেলা শহরের খুব কাছেই মোড়লগঞ্জের হাট। খুব বেশি আহামরি কোন জায়গা নয় এটা। তবে শহরে ঢোকার সময় আশেপাশের আট-দশটা গ্রামের মানুষদের এ রাস্তা দিয়ে যেতে হয় বলে, জায়গাটার নাম পরিচিতি অনেক বেশী। আজকাল শহরে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় একদল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ চাকুরির শেষকালে পাড়ি দিচ্ছেন এইসব এলাকায়। অবশ্য শহরে জায়গার স্বল্পতা যেমন আছে, তার চেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে এইসব মধ্যবিত্ত মানুষদের ক্রয়ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা। তাই সম্ভবত সারা জীবন নাগরিক সভ্যতার দাসত্বের ঘানি টেনে, একটানা কলুর বলদের ভূমিকায় অভিনয় শেষের ক্লান্তিতে, অবসরের দোরগোড়ায় পৌঁছানো এই মানুষ গুলোর সীমিত সঞ্চয়, একরকম বাধ্য করছে তাদের এরকম জায়গায় পাড়ি জমাতে। চিত্রটা তাই সারাদেশেই অল্পবিস্তর একইরকম!
এরকমই একজন মানুষ জাকির পাটোয়ারী। পাড়ার সবার কাছে তিনি এখন পাটোয়ারী সাহেব। বয়স ষাটের কাছাকাছি। চামড়ার কুঁচকানো বয়সের ছাপ আর অবাধ্য ভুড়িটাকে আটকাতে না পারলেও, কৃত্তিম কালো রঙ মাখিয়ে চুলগুলোকে সাধারণের চেয়েওঅনেক বেশি কালো করে রাখেন সবসময়ই। ভারী পাওয়ারের চশমার প্রতিফলনে দূর থেকে চোখ দুটো ভালো করে লক্ষ্য না করা গেলেও, খুব কাছে থেকে তাকালে বোঝা যায়, সেখানে সবসময় ভাসছে একগাদা বিরক্তি। না, মানুষ হিসেবে পাটোয়ারী সাহেব খারাপ একথা কেউই বলবে না। হতে পারে দীর্ঘ চাকুরীজীবনের ঔপনিবেশিক চাপ, অথবা আদরের ছেলে মেয়েগুলোর বড় হয়ে কর্মসূত্রে বিচ্ছেদ তাকে মানসিক ভাবে অবসাদগ্রস্ত করে রাখে এখন!
তার সাথে থাকেন স্ত্রী রাহেলা বেগম, বছর পঞ্চাশের ছোটখাটো মহিলা। এমনিতেই বিশ বছরের অভ্যস্ত শহুরে জীবনের সুযোগ-সুবিধা থেকে অনাকাঙ্খিত বঞ্চনা, তার উপর ছেলে মেয়েদের আপাত অভাব তাকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছে। এই গ্রামাঞ্চলের ইলেক্ট্রিসিটির আসা যাওয়ার মতোই তার মেজাজ সারাদিন উঠানামা করতে থাকে। একটু পর পর কাউকে না কাউকে শাপ-শাপান্ত করে চেপে রাখা রাগ ঝাড়েন সারাক্ষণ।
(২)
একপাশে আকাশ খোলা ফাঁকা মাঠ আর আরেক পাশে মেহগনির বাগান নিয়ে অনেকটা বেমানান ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে পাটোয়ারীর একতলা বাড়ীটা। সামনেই সদর রাস্তা। বাড়ীর গেটটা এলাকার আর দশটা বাড়ীর থেকে ভিন্নরকম; লোহার; অনেক বেশি মজবুত! আসলে এলাকাটা তার জন্য নতুন হওয়ায় নিরাপত্তার কথা ভেবেই দূর্গের মতো দরজার ব্যবস্থা। তবে তা নিয়ে আশেপাশের বাড়িগুলোতে জল্পনার শেষ নেই। লোকজনের গল্পের আসরে তাই এই নিয়ে মাঝেমাঝেই চলে কৌতূহলোদ্দীপক আলোচনা! মাঝেমাঝেই সেই সব কথা এক কান দুই কান হয়ে রাহেলার কানে এসেও পৌছায়। নতুন জায়গার এইসব অযাচিত কৌতূহল তাকে যথেষ্টই ভয় পাইয়ে দেয়! আর তিনিও পাটোয়ারীকে বাসায় পেলেই, জমানো রাগ ঝাড়তে থাকেন! আসলে তাকে যে এখানে এনে এই বুড়ো বয়সে মরার আগেই নরকে হাজির করা হয়েছে, তা বুঝাতে গিয়ে প্রায়ই গলার স্বর আসমানে উঠান!
পাশের মেহগনি বনের আড়ালে তাসের আড্ডায় বসা ছোকরাগুলো পাড়ায় রটায়-“ পাটোয়ারীর বউ এর চেহারা দেখা যায় না বটে, কিন্তু জাত দজ্জাল” কেউ আবার আরো বাড়িয়ে বলে- “যে ভয়ংকর মহিলা! কে জানে, বুড়া বয়সে পাটোয়ারীকে পিটায় কিনা!”
বয়সের ভারে কিনা কে জানে! বউয়ের প্রতি ব্যবহারে পাটোয়ারীর দার্শনিক সুলভ নিস্পৃহতা চলে এসেছে। আগে যখন বয়স কম ছিল, তখন প্রায়ই বউয়ের প্রতি কথায় তুলকালাম পাকাতেন। কিন্তু এখন দীর্ঘ সংসার জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝে গেছেন, এসব করে লাভ নাই কোন! মেয়েদের কথার ঝড় একাই উঠবে আবার একাই কমবে! অবশ্য মাঝেমাঝে কান কথা যে তার কানে আসে না তা নয়! তাতে তিনি আর আজকাল বিচলিত হন না; ভাবেন, বেশ তো! যদি নতুন সামাজিকতা পাকানোর লোক তার বাড়ির দিকে কম ভিড়ে সেটাই ভালো। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষ এক অদ্ভুত বৈপীরিত্যমূলক মানসিক দশায় উপনীত হয়। সে না পারে কাছের মানুষকে ছাড়া থাকতে আবার না পারে সামাজিকতার হট্টগোল বেশিক্ষণ সহ্য করতে।
(৩)
যাই হোক, বৃদ্ধ বয়সের এইসব অদ্ভুত রকমের ভালো লাগা না লাগার ভিড়ে পাটোয়ারীর মনের গভীরে এক অদ্ভুত স্নেহ জন্ম নিয়েছে একদল কবুতরের জন্য। গত বছরের ফাল্গুন- চৈত্রের কোন এক সময়ে, ভয়াবহ এক ঝড়ের তান্ডবলীলার পর কয়েকটা কবুতর ভিজে একাট্টা হয়ে, ভাঙ্গা পালক শরীরে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলো তার বাড়ির চিলেকোঠায়। তিনি ভেবেছিলেন ঝড় শেষে তারা আবার ফিরে যাবে তাদের নিজ ঠিকানায়। কিন্তু না, পথ ভুলে তারা চিলেকোঠাটাকেই তাদের ঘর বানিয়ে ফেলেছিল।
সব কিছুতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠা পাটোয়ারী পত্নী অবশ্য ওদের দেখে, এখানে আসার পর, প্রথম বারের মত খুশিতে ফেটে পড়েছিলেন। রাহেলার মতে কবুতর হল শান্তির দূত। নতুন বাড়িতে কবুতর আসার মানে সেখানে শান্তি থাকবে। ওদের তাড়ানোর প্রশ্নই আসে না! সারাজীবন শান্তির সন্ধানে কাটানো কোন মধ্যবিত্ত গৃহবধূর জন্য, শান্তির যেকোন সম্ভাবনাই যে অনেক আশা তৈরী করে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই!
প্রথম কিছুদিন এদের নিয়ে মহাবিরক্ত ছিলেন পাটোয়ারী। যেখানে সেখানে বিষ্ঠা আর দুর্গন্ধ দুই মানুষের বাসাটাকে বসবাসের অযোগ্য করবে বলে মনে হচ্ছিল তার। তারপরও রাহেলার জেদাজেদিতে দুইবেলা খাবার দিতেন। মাস কয়েক পর লক্ষ্য করলেন ওদের প্রতি তার কেমন যেন দুর্বলতা জন্মেছে। বয়সের কারণেই হোক আর একাকীত্বের তাড়নায়ই হোক, তার কবুতর গুলোর জন্য মায়া জন্মেছে। আগে মাঝমাঝে প্রতিবেশীরা আসতো কচি ছানা চাইতে, কেউবা কিনতে। তিনি দিয়ে দিতেন। এখন আর দিতেও মন চায়না।
প্রতিদিন বিকালে ছাদে উঠে কয়টা কবুতর ফিরল, কয়টা ছানা বেঁচে আছে, নিয়ম করে হিসাব করেন। এর ফলে গত কয়েক মাস ধরেই এদের বাড়বাড়ন্ত। দুর্গন্ধে ছাদে টেকা দায় হয়ে গিয়েছে। রাহেলা বেগম তার স্বামীর আধিখ্যেতায় বিরক্ত হলেও, শান্তির দুত হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে ব্যাপারটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন না।
মাঝেমধ্যেই দলে নতুন কবুতরও চোখে পড়ে তার। চিনতে না পারলেও জানা একটা জাতের নামে চালিয়ে দেন। রাহেলাকে চীৎকার করে ডেকে কখনো বলেন-“দ্যাখো এইটা গিরিবাজ” অথবা “এইটা সুয়াচন্দন!”
দীর্ঘদিন একাসাথে কাটিয়ে রাহেলা এখন এটুকু অন্তত বুঝতে পারেন, তার স্বামি কোনটা জেনে বলছে, আর কোনটা না জেনে! তারপরেও খুব অবাক হবার ভান করেন! মাঝেমধ্যে একা একাই ওদের সাথে কথা বলেন পাটোয়ারী। আর সেটা দেখে নিচের টিনের ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে হেসে দেয় কালাম আলির কন্যা মরিয়ম। প্রচন্ড জোরে গালি দিতে ইচ্ছা হলেও তা সংবরন করেন তিনি। মেয়েটাকে গালি দিয়ে লাভ নেই!
(৪)
পাটোয়ারীর বাড়ির পিছনের কয়েক শতাংশ জায়গা পতিত ছিলো। তিনি নিজেও কখনো সেখানের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করান নাই। গত মৌসুমের বন্যায়, উত্তরের কোন এক নদীভাঙ্গনের জেলা থেকে সব হারিয়ে এ এলাকায় সপরিবারে এসেছিলো কালাম মিয়া। স্ত্রী, দুই পুত্র আর এক কন্যা নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের ঘরের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছিলো সে। চেয়ারম্যান মজনু মিয়া পড়েছিলেন উভয়সংকটে। জনসম্মুখে এদের বিতাড়িত করলেও সমস্যা, আবার থাকতে দেয়াও সম্ভব নয়! খাস জায়গায় বসানোটাও নিরাপদ নয়; যদি দখলে নেয়!
চেয়ারম্যান মেম্বারদের ওই গম্ভীর মিটিঙের কুক্ষণেই তার জমির সীমানা মীমাংসার কাজে সেখানে হাজির হয়েছিলেন পাটোয়ারী। সেখানে সভাসদ সহ চেয়ারম্যানের অনুরোধে ঢেঁকিটা গিলতে বাধ্য হয়েছিলেন। সত্যি বলতে বাধ্যই হয়েছিলেন! নাহলে জায়গার সীমানা নিয়ে পাশের জমির মালিক আজিম মিয়ার সাথে তিনি পেরে উঠতেন না। বাইরের মানুষ হয়ে এলাকার মানুষের সাথা লাগতে যাওয়া খুবই বোকার কাজ। এটা চেয়ারম্যানও জানতেন। রাজনীতি জানা মানুষ তিনি। পাটোয়ারীর সমস্যা সমাধান করেছিলেন বটে, তবে একবছরের জন্য কালাম মিয়াকে পাটোয়ারীর পতিত জমিতে থাকতে দেয়ার শর্তে। রাহেলা বেগম চীৎকার করে পাড়া মাত করেছিলেন সেইদিন। গালি দিয়ে পাটোয়ারী সহ তার চৌদ্দগোষ্ঠীর দফা রফা করেছিলেন। বলেছিলেন-“ বুড়ার বোধবুদ্ধি সব গিয়েছে। এ যুগে কেউ এমন আপদ ঘরে টানে! এবার জায়গাটা জবরদখল হবেই। শেষকালে এই বয়সে রাস্তায় নামতে না হয়!”
(৫)
সময়ের সাথেই জীবনের প্রবাহে মিশে যায় ভেসে আসা সব আপদ বিপদ। পাটোয়ারী- রাহেলার জীবনে শান্তির ছবি হয়ে আসা কবুতর এর মতোই সাক্ষাৎ অশান্তি নিয়ে আসা কালাম মিয়া ও তার পরিবারও একসময় গাঁ সওয়া হয়ে যায়। কালাম সারাদিন বাইরে কামলা খাটে আর মাঝেমাঝে পাটোয়ারী সাহেবের ফাই ফরমাশ খাটে। তার বউ ফজিলার কাজ আপাত দৃষ্টিতে সংসার সামলানো হলেও, ঘোর দুপুরে সে ছাগল চরানোর নামে বাসা থেকে বাইরে যায়। লোকচক্ষুর অন্তরালে খুব সতর্ক ভাবে অন্যের জমি থেকে যথাসম্ভব শাক-সবজি চুরি করে আনে। দীর্ঘ অভাবের দিনগুলোতে সে এই অভ্যাস ভালোমতোই রপ্ত করেছিলো। এখন সেটা কালাম মিয়াকে প্রতিদিন বাজার করার চাপ থেকে অন্তত মুক্তি দেয়! রাহেলা বেগম রুটিন মতো দুপুরবেলায় খাওয়া দাওয়া শেষে জানালার পাশে বসেন, ফজিলা কিভাবে চৌর্যকর্ম সারে তা দেখার জন্য। আর পাটোয়ারী সাহেব বাসায় ফিরলে তার আশ্রিতরা যে কি ভয়ানক চোর তার গল্প শোনান। গল্প শেষে সবসময়ই বলেন-“এত্ত ছোটলোক এগুলা তাকাতেও ইচ্ছা করে না!” কিন্তু দুপুরবেলা চলে আসলে নেশার মতো তাদের কাজ দেখতে যান; না দেখতে পেলে মনে স্বস্তি পাননা তিনি।
ইতোমধ্যে একদিন তার দুইটা কবুতর তাদের ছাপরার ভিতর ঢুকতে দেখলেন কিন্তু বের হতে দেখলেন না। তবে কি এরা সুযোগ পেলেই তাদের কবুতরো ধরছে নাকি! সর্বনাশ!
কালাম মিয়ার বড় ছেলে কিছুদিন আগে ঢাকায় গিয়েছে আয় রোজগার করার জন্য। কথা ছিলো টাকা পাঠানোর, কিন্তু সে এখন লা-পাত্তা। ছোট ছেলেটার বয়স সবে ছয়। স্কুলে না গেলেও মায়ের সাথে ছোট খাটো চুরির বিদ্যা সে আয়ত্ত্ব করেছে। ছোট মানুষকে সহজেই ফসলের মাচার নীচে পাঠিয়ে দেয়া যায়; দূর থেকে চোখে পড়েনা। রাহেলা বেগম জানালার ফাঁক দিয়ে দেখেন আর ভাবেন নিশ্চয়ই এটা বয়সকালে মস্ত ডাকাত হবে!
(৬)
মেঝমেয়ে মরিয়ম। বেচারা জন্ম থেকেই কানেও শোনেনা, কথাও বলতে পারেনা। তেরো কি চৌদ্দ হবে বয়স। কথা না বলতে পারলেও কি হবে, মুখের ভঙ্গী আর চোখের ভাষায় সবই বোঝাতে পারে। প্রকৃতিতে কার কোন ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতা থাকলে অন্য ইন্দ্রিয়গুলো খুব সজাগ হয়ে যায়! মেয়েটাকে কালাম অত্যধিক স্নেহ করে আবার তাকে নিয়েই তার যত ভয়! বাড়ন্ত বয়স, মুখে কিছু বলতে পারেনা ; কখন কোন সর্বনাশ হয়! মাথা ভর্তি চুল, ঠোঁটে সবসময় লেগে থাকা এক চিলতে হাসি নিয়ে সে যখন তাকায়, তখন বোধ হয় একবারের জন্য হলেও সবার মনে আসে-“মেয়েটা যথেষ্টই সুন্দর।” মরিয়ম এখন কাজ করে রাহেলা বেগমের বাসায়। সম্ভবত এটাই এখন বড় কারণ যার জন্য তিনি, তার ভাষায় এই “চোরগুলির” আপদ সহ্য করছেন। দুই একটা কবুতর যে হারিয়ে যাচ্ছে এটা পাটোয়ারী সাহেবও বুঝেন, কিন্তু বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাননা। রাহেলার শরীরে বাতের ব্যথা জেঁকে বসেছে। এখন কাজের লোক না পেলে যে ভোগান্তি হবে তা দুই একটা কবুতর হারানোর চেয়ে অনেক বেশি। আর রাহেলার মুখের গালির তীব্রতা সম্ভবত এই মেয়েটা ছাড়া অন্য কেউ নিতে পারবে না। সে সারাদিন যত চেঁচামেচিই করুক, মরিয়ম ঠোঁটে মুচকি হাসি দিয়ে মাথা দোলায়! এমন বাধ্যানুগত কাজের মানুষ তিনি আগে পান নাই। তাছাড়া রাহেলা নিঃসঙ্গতায় একজন সঙ্গীও পেয়েছেন বলা চলে। মরিয়ম না বুঝলেও মাঝেমাঝেই তাকে শোনান-“শুধু তোর জন্য এখনো তোর চোর পরিবারকে সহ্য করছি, নাহলে কবে আমার জায়গা থেকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতাম!”
মরিয়ম কি বোঝে কে জানে! শুধু মুচকি হাসে!
(৭)
কালাম মিয়ার ছাপরা বাড়ি থেকে দুইটা বড় ধানী জমি পরই একটা টিনের বাড়ি হারূন মেকারের। তার ছেলে মোসাদ্দেক। বয়স সতেরো কি আঠারো। বার দুয়েক ফেল করে মাধ্যমিক পাশের স্বপ্ন তার শেষ হয়েছে। তবে তাতে সে বিন্দুমাত্র দুঃখিত বা চিন্তিত নয়। বরং ঝামেলা গেছে ভেবে সারাক্ষণ এপাড়া ওপাড়া করে তার দিন কাটে। আর কখনো সখনো বন্ধুদের নিয়ে পাটোয়ারী বাড়ির ধারে মেহগনি বনের আড়ালে তাসের আড্ডা জমায়। অভিনব রঙের গেঞ্জি আর অদ্ভুত চুলের কাটে তাকে খুব সহজেই আলাদা করা যায় অন্যদের থেকে।
বিকাল বেলা প্রায়ই যখন মরিয়ম কাজ শেষে ছোট ভাইটাকে নিয়ে খেলায় মগ্ন হয়, তখন সে কালামের বাড়ির উঠানের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। প্রথম প্রথম দুই ভাই-বোন খেলায় মগ্ন থাকত, তাকে লক্ষ্যই করতো না। কিন্তু ধীরে ধীরে তার সাহস বেড়ে গিয়েছে। মরিয়মের খুব কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে, দুই ভাই বোনের খেলায় যোগ দেয়ার ছুতায় বারবার মরিয়মের হাত ধরার চেষ্টা করে। একদিন আবার গোলাপ ফুল এনে তাকে দেয়। মেয়েরা নাকি অনেক কিছুই বুঝতে পারে, হয়তো মরিয়ম ও পারে; কি বোঝে তা জানা আমাদের জন্য মুশকিল! তবে সে তার কাছে ঘেঁষতে চায়না। দেখলে আগেভাগেই সরে পড়ে।
মধ্যবয়সের ফযিলা জীবন অভিজ্ঞতায় অনেক পাকা, অনেক কিছুই বোঝেন। ঠান্ডা মাথায় মোসাদ্দেককে ঘুরাঘুরি করতে মানা করেন, তাতেও কাজ না হলে পাড়া মাথায় তুলে গালাগালি দেন। তাতেও কাজ না হলে কালাম মিয়া সরাসরি জিজ্ঞাসা করেন-“ বাপজান কি চান বলেন তো?”
“আপনার মেয়েকে বিবাহ করতে চাই। তার হাসি আমার খুব পছন্দ”।
কালাম এই উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিলোনা। খানিকটা স্বগোতক্তি করেই বলে-“ইয়ার্কি তামাশার বিষয় নয় এটা। কালা বোবা মেয়ে আমার। তারে নিয়া তামাশা করলে উপরয়ালা নারাজ হবে”।
কিন্তু মোসাদ্দেক আগের চেয়েও দৃড়তার সাথে বলে সে মরিয়মকে বিয়ে করবে। মরিয়মের মা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনছিল সব কথাই। হঠাত সামনে এসে বলল-“কবে বিয়ে করবা?”
“বাসায় কথা বলে জানাচ্ছি। কিন্তু কয়টা দিনতো অর সাথে মিশতে দেন। একেতো কথা শুনতেও পারেনা,বলতেও পারেনা; আমারতো তার সাথে একটু ভাব হওয়া লাগবে তাইনা? নাহলে বোবা মানুষের সাথে সংসার কিভাবে করবো!”
কন্যাদায়মুক্তির বিশাল চাপের মাঝে একটু আশার আলো দেখে বেশি কথা বাড়ায়না কালাম। শুধু বলে- “তোমার বাপের সাথে কথা বলে তাড়াতাড়ি জানাও”
(৮)
এরমধ্যেই কালামের সংসারে নতুন এক বিপত্তি আসে। তার ঢাকায় নিরুদ্দেশ ছেলে সুমন বিনা নোটিশে বউ নিয়ে হাজির হয়! গার্মেন্টসে কাজ করতে গিয়ে সেখানেই পছন্দ তারপর বিয়ে। নতুন বউ এর মুখ পাউডারে সাদা আর চুলে লাল মেহেদির ছোপ। ঢাকা থেকে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসা এখনো এইসব দিকে খুব বেশি ঘটেনা। দলে দলে মানুষ সুমনের ঢাকাইয়া বউ দেখতে আসে। নাম জিজ্ঞাসা করলে সে খানিকটা নাকি সুরে বলে-“আমার নাম ল্যাকি, বাড়ি ঢাকা”
কালামের মাথায় বাজ পড়ে। একটা মাত্র থাকার ঘর আর আরেকটা রান্নাঘর। তাতেই দিন কাটাতো তারা। এখন এদেরকে রাখবে কই! আর ছেলেও যে টাকা জমিয়ে এনেছে তাও মনে হচ্ছে না! সেইদিন সন্ধ্যায় মোসাদ্দেকও আসে নতুন বউকে দেখতে। কিছুক্ষণের মধ্যে গল্প জুড়ে দেয়। আসলে নাটক ফিল্ম আর ঢাকা নিয়ে খবর রাখে এমন কাউকে না পেয়ে হাপিয়ে উঠেছিল লাকি। যাক এমন একজনকে পাওয়া গেলো যে কিনা এসব খবর ভালোই জানে! মরিয়মের মা এসে লাকির কানে কানে বলে যায়-“শোন মা কথা বার্তা চলতেছে। এ আমাদের মরিয়মকে বিবাহ করতে চায়”
লাকি ফজিলার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলে-“আম্মা সব ফাইনাল?” ফজিলার “না” উত্তর শুনে হেসে বলে-“টেনশন করেন না; একমাসের মধ্যে আমি আর আপনার ছেলে মিলে সব কনফার্ম করে দিচ্ছি!”
(৯)
কয়েকদিন পর লাকি রাহেলাবেগমের কাছে ঘর বানানোর জন্য আর্জি নিয়ে গেলে, তাকে আপাদমস্তক দেখে ঠান্ডা গলায় মানা করে দেন তিনি। তাও ভাব জমানোর চেষ্টা করেছিলো সে, কিন্তু বুড়ি পাত্তাই দিলোনা শেষ পর্যন্ত। ঢাকায় কতো মানুষকে ম্যানেজ করে চলেছে লাকি, কিন্তু এমন বাজে ব্যবহার সে এর আগে পায় নাই! তার স্বামীকে নিয়ে তাসের আড্ডায় বসেছিলো মোসাদ্দেক। সেখানে গিয়ে চোখ লাল করে নিজের অপমানের কথা জানালো লাকি। হতভম্ব সুমনের হাত ধরে টান দিয়ে মোসাদ্দেক জানালো আজকেই এর বিহিত হবে। আর লাকি সুমন এখানেই বাড়ি করে থাকবে। ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তার। মোসাদ্দেক লাকির দিকে তাকিয়ে একটা শঠ হাসি হেসে বলে-“ ভাবি জানেনতো এইদেশের নিয়ম, দখল যার, জায়গা তার”
মোসাদ্দেক আর সুমনের কথা শুনে পাটোয়ারীর মাথা গরম হয়ে যায়। এমনিতেই চৈত্র মাসের রোদ, তার মধ্যে তারা দুজন আসছে নতুন ঘর বানানোর অনুমতি নিতে! মনে হচ্ছে এদের বাপ দাদার কেনা সম্পত্তি! তিনি সাফ সাফ বললেন-“চলবে না”।
কি চলবে! নাকি চলবেনা ! এসব আমাদের জানার দরকার নাই। ভাই আমার এখানেই থাকবে! পারলে উঠায়েন!
বলে হটহট করে হাঁটা দিতে গিয়ে মোসাদ্দেক আবার পিছন ফিরে বলে-“ চেয়ারম্যান আর পুলিশ কিন্তু মাঝরাতে পাহারা দিতে আসবে না। বাড়াবাড়ি করলে বুড়াবুড়ি দুইজন মেহগনি বনে হাওয়া হয়ে যাবেন!”
ঘামতে থাকেন পাটোয়ারী। স্ত্রীকে ডাকতে গিয়েও ডাকেন না।
(১০)
চৈত্রের শেষের দিকে আর বৈশাখের শুরুতে এদিকে ভয়াবহ ঝড় হয় প্রতিবার। বাংলায় এর নাম কালবৈশাখী। আকাশের কোণে কালো মেঘের আঁচড় দেখে এখনো অনেক অভিজ্ঞ লোক বলতে পারেন, ঝড়টা কখন আসবে! আজকে আকাশের মেঘের হাবভাব দেখে বয়স্ক লোকেরা বলাবলি করছে, খুব সাঙ্ঘাতিক ঝড় হবে!
সবার কথা সত্যি করে একটু পর সত্যিই আকাশের এক মাথা থেকে অন্য মাথা চিড়ে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগলো। শব্দের তীব্রতায় বোঝা যাচ্ছিল আশেপাশেই বজ্রপাত হচ্ছে অনবরত! কান তালা লেগে আর খোলার সময় দিচ্ছিল না! মোসাদ্দেক আর সুমন বাসার ছুপড়ি বারান্দায় দাড়িয়ে অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছিল। বৃষ্টি অল্প অল্প শুরু হলেও বাতাস তখনো শুরূ হয় নাই। পাটোয়ারীর গোটা দশেক কবুতর সম্ভবত বাজের শব্দে দিশেহারা হয়ে তাদের উঠানের কোণে জড়সড় হয়ে আছে! মোসাদ্দেক লাকি আর সুমনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো-“ভাই- ভাবি আজ রাতে কবুতরের পিকনিক হোক! কি বলেন!” বলেই মুরগি রাখার ঝাঁপিটা নিয়ে দ্রুত বেগে কবুতর গুলোর উপর ফেলল। একবারে গোটা দশেক কবুতর এর আগে কখনোই ধরতে পারে নাই সে। বিজয়ীর হাসি হেসে তাকালো মোসাদ্দেক। মনে মনে খুশি হলেও লাকি মুখ থমথম করে জানালো-“পিকনিক পড়ে হবে, ঝড়ে বাসাটা আগে টিকুক তো!”
সম্ভবত পাটোয়ারী সাহেবের হাত থেকে খেতে অভ্যস্ত কবুতর গুলো বন্যতা ছেড়ে একটু বেশিই পোষা হয়ে গিয়েছিল।
জানালার ফাঁক দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে সবই খেয়াল করছিলেন রাহেলা। দৌড়ে স্বামীর ঘরে ঢুকে বললেন-“ সর্বনাশ হয়ে গেছে! চোরের বাচ্চগুলো সবগুলো কবুতর ধরল আমার চোখের সামনে!”
পাটোয়ারী রাহেলার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বললেন-“চুপ!”
রাহেলা আঁতকে উঠে বললেন-“ তোমার গিরিবাজটাকেও...”
পাটোয়ারী আবার বললেন-“ বাঁচতে চাও তো চুপ!”
(১১)
এতক্ষণ বৃষ্টি হচ্ছিল গাঁয়ে গাঁয়ে। এবার হঠাত বাতাস বইতে শুরু করলো ভয়ংকর জোরে। কালাম তখনো কাজ থেকে ফিরে নাই। কবুতর ধরার উত্তেজনায় সবার সাথে ফজিলাও এতো উত্তেজিত ছিলো যে মাঠে ছাগল আছে তা ভুলেই গিয়েছিলো। মনে পড়তেই দিক্বিদিক ভুলে মাঠের দিকে ছুটল সে। ঢাকা থেকে কিনে আনা তার একমাত্র সাইকেলটা ভুলে স্কুলের বারান্দায় রেখে এসেছিলো সুমন। ঝড়ের মাতম দেখে হঠাত হুশ হলো তার। ঝড় শেষে আর যাই হোক সাইকেল পাওয়া যাবে না, তাই ভেবে সেও দৌড় দিল স্কুলের দিকে। আর মোসাদ্দেক চোখের ইশারায় মরিয়মকে কোন একটা সংকেত দিতেই ভয়ে পান্ডুর হলো তার মুখ। চোখ বন্ধ করে দৌড় দিলো সে ঝড়ের মধ্যেই! বাতাসের তীব্রতায় চোখও মেলানো যাচ্ছিলনা। তার মধ্যেই সুমন স্কুলের দিকে যেতে যেতে দেখলো মোসাদ্দেকও তার নিজ বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে। দূর থেকেই হাত নাড়ালো তারা। মোসাদ্দেককে চলে যেতে দেখে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে চুপ করে ঘরে ঢুকলো মরিয়ম।
(১৩)
এরকম ঝড় গত কয়েকবছরের মধ্যে হয় নাই এ তল্লাটে। গাছগুলির মাথা একবার মাটিকে ছুঁয়ে দিচ্ছিল, আরেকবার আকাশে। কলাগাছগুলিও দেয়াশলাইয়ের কাঠির মতো পটাপট ভাঙ্গছিল। যেমন ঝড়ো বাতাস, তেমন মুষল বৃষ্টি! ঘন্টাখানিক অপেক্ষার পর বৃষ্টি মাথায় করেই বাড়ির দিকে রওনা দিলো সুমন। বাসায় সবাই কি অবস্থায়, আর ঘরগুলো কি অবস্থায়! এই চিন্তায় সে দ্রুত সাইকেল চালাতে গিয়ে পিছলে পড়লো বার দুয়েক। প্রতিবারই মনে মনে পাটোয়ারীকে ইচ্ছমত গালি দিলো । কালকেই ওই জায়গায় টিনের ঘর তুলবে সে! দেখবে কে আটকায়!
বাড়িতে এসে প্রথম ঘরে ঢুকে সুমন দেখলো সারা শরীর পানি আর কাঁদায় মেখে এককোণে মাদুর বিছিয়ে গুটিগুটি হয়ে শুয়ে আছে মরিয়ম। ঘুমাচ্ছে মনে হয়। বারান্দা পার হয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিতেই পায়ের নীচে মাটি সরে গেলো তার। মেঝেতে মোসাদ্দেককে আলিঙ্গন করে কামনায় ছটফট করছে লাকি! কিছুক্ষণের মধ্যে সম্বিৎ ফিরে পেয়েই হাতের কাছে থাকা একটা চেড়া বাঁশ তুলে নিলো সে! ততোক্ষনে তার উপস্থিতি বুঝতেই এক ঝটকায় লাকিকে নীচে ফেলে রান্নাঘরের পিছনের ছনের দেয়াল ভেঙ্গে দৌড় দিল মোসাদ্দেক। লাঠি হাতে ক্রুদ্ধ জন্তুর মতো তাকে তাড়া করলো সুমন!
(১৪)
লাকি হতভম্ভ হয়ে বসে থাকলো কিছুক্ষণ। তবে তার মস্তিষ্ক এখনো খুব সজাগ। জীবনে অনেককিছুই দেখেছে সে। এই সাধারণ হাত টানের অভ্যাসয়ালা মানুষগুলোর চেয়ে ঢের বেশি দেখেছে সে। সামলেছেও অনেক। এই পরিস্থিতেও মাথাটাকে ঠান্ডা রেখে এক মুহূর্ত ভাবলো সে!
এরপর সটান ঝাঁপি ঢাকা দেয়া কবুতর গুলো থেকে সবচেয়ে পুষ্টটাকে বের করে আনলো। আঙ্গুল টিপে হেঁটে ঢুকলো শোবার ঘরে মরিয়মের পাশে। ভয়ে আর ক্লান্তিতে অঘোরে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। একটানে কবুতরটার ধড় থেকে মাথা আলাদা করে ফেললো লাকি। উৎক্ষিপ্ত রক্তের ধারাকে কৌশলে মরিয়মের পায়জামার উপরে তলপেটের কাছাকাছি ভরিয়ে দিয়েই বের হয়ে আসলো সে!
খানিক বাদেই, তখন ঝড় কিছুটা শান্ত; লাকি গগনবিদারী চীৎকার দিলো। এমন জোরে চীৎকার যে আশেপাশের মানুষ জড়ো হতে বিশেষ সময় লাগলো না! লাকী বুক চাপড়িয়ে শুধু একটা কথাই বলতে লাগলো-“বিয়ের কথা বলে প্রতিবন্ধী মেয়েটার কি সর্বনাশ করলো রে! এখন কি হবে অর!”
চেঁচামেচিতে কেবলমাত্র ঘুম ভাঙ্গতেই, আশেপাশের বউঝিরা মরিয়মকে হেঁচকা টানে বাইরে নিয়ে আসলো। কয়েক ডজন জোড়া চোখ বিস্মিত চোখে তাখিয়ে মন্তব্য করলো-“ তাইতো! দেখছিস না রক্তের দাগ!”
(১৫)
এরপরের ঘটনা বিশেষ এই যে, কালাম মিয়া খবর পেয়ে বাড়ি ফিরে হিতাহিত জ্ঞানশুন্য
হয়ে বেদম প্রহার করেছিলেন। মুমূর্ষ মেয়েটাকে নিয়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিলো। লাকী বলেছিল- যে সে এমনিতেই চলে যাবে; কিন্তু বাড়াবাড়ি করলেই রটিয়ে দিবে যে সুমন অক্ষম! সুমন সব বুঝলেও আর কথা বাড়ায় নাই। ঘটনার দিন বিকাল বেলায়ই চেয়ারম্যান সাহেব কালামের পরিবার কে গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছিলেন। পাটোয়ারী সাহেব ও তার জায়গা ফেরত পেয়েছিলেন! তবে সেই ঝড়ে পাটোয়াড়ীর বাড়ির চিলেকোঠার ছাদটা ঊড়ে গিয়েছিলো। কবুতরগুলোও আর ফিরে আসে নাই।
জেলা শহরের খুব কাছেই মোড়লগঞ্জের হাট। খুব বেশি আহামরি কোন জায়গা নয় এটা। তবে শহরে ঢোকার সময় আশেপাশের আট-দশটা গ্রামের মানুষদের এ রাস্তা দিয়ে যেতে হয় বলে, জায়গাটার নাম পরিচিতি অনেক বেশী। আজকাল শহরে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় একদল মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ চাকুরির শেষকালে পাড়ি দিচ্ছেন এইসব এলাকায়। অবশ্য শহরে জায়গার স্বল্পতা যেমন আছে, তার চেয়ে বেশি সমস্যা হচ্ছে এইসব মধ্যবিত্ত মানুষদের ক্রয়ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা। তাই সম্ভবত সারা জীবন নাগরিক সভ্যতার দাসত্বের ঘানি টেনে, একটানা কলুর বলদের ভূমিকায় অভিনয় শেষের ক্লান্তিতে, অবসরের দোরগোড়ায় পৌঁছানো এই মানুষ গুলোর সীমিত সঞ্চয়, একরকম বাধ্য করছে তাদের এরকম জায়গায় পাড়ি জমাতে। চিত্রটা তাই সারাদেশেই অল্পবিস্তর একইরকম!
এরকমই একজন মানুষ জাকির পাটোয়ারী। পাড়ার সবার কাছে তিনি এখন পাটোয়ারী সাহেব। বয়স ষাটের কাছাকাছি। চামড়ার কুঁচকানো বয়সের ছাপ আর অবাধ্য ভুড়িটাকে আটকাতে না পারলেও, কৃত্তিম কালো রঙ মাখিয়ে চুলগুলোকে সাধারণের চেয়েওঅনেক বেশি কালো করে রাখেন সবসময়ই। ভারী পাওয়ারের চশমার প্রতিফলনে দূর থেকে চোখ দুটো ভালো করে লক্ষ্য না করা গেলেও, খুব কাছে থেকে তাকালে বোঝা যায়, সেখানে সবসময় ভাসছে একগাদা বিরক্তি। না, মানুষ হিসেবে পাটোয়ারী সাহেব খারাপ একথা কেউই বলবে না। হতে পারে দীর্ঘ চাকুরীজীবনের ঔপনিবেশিক চাপ, অথবা আদরের ছেলে মেয়েগুলোর বড় হয়ে কর্মসূত্রে বিচ্ছেদ তাকে মানসিক ভাবে অবসাদগ্রস্ত করে রাখে এখন!
তার সাথে থাকেন স্ত্রী রাহেলা বেগম, বছর পঞ্চাশের ছোটখাটো মহিলা। এমনিতেই বিশ বছরের অভ্যস্ত শহুরে জীবনের সুযোগ-সুবিধা থেকে অনাকাঙ্খিত বঞ্চনা, তার উপর ছেলে মেয়েদের আপাত অভাব তাকে পর্যুদস্ত করে ফেলেছে। এই গ্রামাঞ্চলের ইলেক্ট্রিসিটির আসা যাওয়ার মতোই তার মেজাজ সারাদিন উঠানামা করতে থাকে। একটু পর পর কাউকে না কাউকে শাপ-শাপান্ত করে চেপে রাখা রাগ ঝাড়েন সারাক্ষণ।
(২)
একপাশে আকাশ খোলা ফাঁকা মাঠ আর আরেক পাশে মেহগনির বাগান নিয়ে অনেকটা বেমানান ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে পাটোয়ারীর একতলা বাড়ীটা। সামনেই সদর রাস্তা। বাড়ীর গেটটা এলাকার আর দশটা বাড়ীর থেকে ভিন্নরকম; লোহার; অনেক বেশি মজবুত! আসলে এলাকাটা তার জন্য নতুন হওয়ায় নিরাপত্তার কথা ভেবেই দূর্গের মতো দরজার ব্যবস্থা। তবে তা নিয়ে আশেপাশের বাড়িগুলোতে জল্পনার শেষ নেই। লোকজনের গল্পের আসরে তাই এই নিয়ে মাঝেমাঝেই চলে কৌতূহলোদ্দীপক আলোচনা! মাঝেমাঝেই সেই সব কথা এক কান দুই কান হয়ে রাহেলার কানে এসেও পৌছায়। নতুন জায়গার এইসব অযাচিত কৌতূহল তাকে যথেষ্টই ভয় পাইয়ে দেয়! আর তিনিও পাটোয়ারীকে বাসায় পেলেই, জমানো রাগ ঝাড়তে থাকেন! আসলে তাকে যে এখানে এনে এই বুড়ো বয়সে মরার আগেই নরকে হাজির করা হয়েছে, তা বুঝাতে গিয়ে প্রায়ই গলার স্বর আসমানে উঠান!
পাশের মেহগনি বনের আড়ালে তাসের আড্ডায় বসা ছোকরাগুলো পাড়ায় রটায়-“ পাটোয়ারীর বউ এর চেহারা দেখা যায় না বটে, কিন্তু জাত দজ্জাল” কেউ আবার আরো বাড়িয়ে বলে- “যে ভয়ংকর মহিলা! কে জানে, বুড়া বয়সে পাটোয়ারীকে পিটায় কিনা!”
বয়সের ভারে কিনা কে জানে! বউয়ের প্রতি ব্যবহারে পাটোয়ারীর দার্শনিক সুলভ নিস্পৃহতা চলে এসেছে। আগে যখন বয়স কম ছিল, তখন প্রায়ই বউয়ের প্রতি কথায় তুলকালাম পাকাতেন। কিন্তু এখন দীর্ঘ সংসার জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝে গেছেন, এসব করে লাভ নাই কোন! মেয়েদের কথার ঝড় একাই উঠবে আবার একাই কমবে! অবশ্য মাঝেমাঝে কান কথা যে তার কানে আসে না তা নয়! তাতে তিনি আর আজকাল বিচলিত হন না; ভাবেন, বেশ তো! যদি নতুন সামাজিকতা পাকানোর লোক তার বাড়ির দিকে কম ভিড়ে সেটাই ভালো। বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষ এক অদ্ভুত বৈপীরিত্যমূলক মানসিক দশায় উপনীত হয়। সে না পারে কাছের মানুষকে ছাড়া থাকতে আবার না পারে সামাজিকতার হট্টগোল বেশিক্ষণ সহ্য করতে।
(৩)
যাই হোক, বৃদ্ধ বয়সের এইসব অদ্ভুত রকমের ভালো লাগা না লাগার ভিড়ে পাটোয়ারীর মনের গভীরে এক অদ্ভুত স্নেহ জন্ম নিয়েছে একদল কবুতরের জন্য। গত বছরের ফাল্গুন- চৈত্রের কোন এক সময়ে, ভয়াবহ এক ঝড়ের তান্ডবলীলার পর কয়েকটা কবুতর ভিজে একাট্টা হয়ে, ভাঙ্গা পালক শরীরে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলো তার বাড়ির চিলেকোঠায়। তিনি ভেবেছিলেন ঝড় শেষে তারা আবার ফিরে যাবে তাদের নিজ ঠিকানায়। কিন্তু না, পথ ভুলে তারা চিলেকোঠাটাকেই তাদের ঘর বানিয়ে ফেলেছিল।
সব কিছুতেই তেলে বেগুনে জ্বলে উঠা পাটোয়ারী পত্নী অবশ্য ওদের দেখে, এখানে আসার পর, প্রথম বারের মত খুশিতে ফেটে পড়েছিলেন। রাহেলার মতে কবুতর হল শান্তির দূত। নতুন বাড়িতে কবুতর আসার মানে সেখানে শান্তি থাকবে। ওদের তাড়ানোর প্রশ্নই আসে না! সারাজীবন শান্তির সন্ধানে কাটানো কোন মধ্যবিত্ত গৃহবধূর জন্য, শান্তির যেকোন সম্ভাবনাই যে অনেক আশা তৈরী করে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই!
প্রথম কিছুদিন এদের নিয়ে মহাবিরক্ত ছিলেন পাটোয়ারী। যেখানে সেখানে বিষ্ঠা আর দুর্গন্ধ দুই মানুষের বাসাটাকে বসবাসের অযোগ্য করবে বলে মনে হচ্ছিল তার। তারপরও রাহেলার জেদাজেদিতে দুইবেলা খাবার দিতেন। মাস কয়েক পর লক্ষ্য করলেন ওদের প্রতি তার কেমন যেন দুর্বলতা জন্মেছে। বয়সের কারণেই হোক আর একাকীত্বের তাড়নায়ই হোক, তার কবুতর গুলোর জন্য মায়া জন্মেছে। আগে মাঝমাঝে প্রতিবেশীরা আসতো কচি ছানা চাইতে, কেউবা কিনতে। তিনি দিয়ে দিতেন। এখন আর দিতেও মন চায়না।
প্রতিদিন বিকালে ছাদে উঠে কয়টা কবুতর ফিরল, কয়টা ছানা বেঁচে আছে, নিয়ম করে হিসাব করেন। এর ফলে গত কয়েক মাস ধরেই এদের বাড়বাড়ন্ত। দুর্গন্ধে ছাদে টেকা দায় হয়ে গিয়েছে। রাহেলা বেগম তার স্বামীর আধিখ্যেতায় বিরক্ত হলেও, শান্তির দুত হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে ব্যাপারটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন না।
মাঝেমধ্যেই দলে নতুন কবুতরও চোখে পড়ে তার। চিনতে না পারলেও জানা একটা জাতের নামে চালিয়ে দেন। রাহেলাকে চীৎকার করে ডেকে কখনো বলেন-“দ্যাখো এইটা গিরিবাজ” অথবা “এইটা সুয়াচন্দন!”
দীর্ঘদিন একাসাথে কাটিয়ে রাহেলা এখন এটুকু অন্তত বুঝতে পারেন, তার স্বামি কোনটা জেনে বলছে, আর কোনটা না জেনে! তারপরেও খুব অবাক হবার ভান করেন! মাঝেমধ্যে একা একাই ওদের সাথে কথা বলেন পাটোয়ারী। আর সেটা দেখে নিচের টিনের ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে হেসে দেয় কালাম আলির কন্যা মরিয়ম। প্রচন্ড জোরে গালি দিতে ইচ্ছা হলেও তা সংবরন করেন তিনি। মেয়েটাকে গালি দিয়ে লাভ নেই!
(৪)
পাটোয়ারীর বাড়ির পিছনের কয়েক শতাংশ জায়গা পতিত ছিলো। তিনি নিজেও কখনো সেখানের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করান নাই। গত মৌসুমের বন্যায়, উত্তরের কোন এক নদীভাঙ্গনের জেলা থেকে সব হারিয়ে এ এলাকায় সপরিবারে এসেছিলো কালাম মিয়া। স্ত্রী, দুই পুত্র আর এক কন্যা নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের ঘরের বারান্দায় আশ্রয় নিয়েছিলো সে। চেয়ারম্যান মজনু মিয়া পড়েছিলেন উভয়সংকটে। জনসম্মুখে এদের বিতাড়িত করলেও সমস্যা, আবার থাকতে দেয়াও সম্ভব নয়! খাস জায়গায় বসানোটাও নিরাপদ নয়; যদি দখলে নেয়!
চেয়ারম্যান মেম্বারদের ওই গম্ভীর মিটিঙের কুক্ষণেই তার জমির সীমানা মীমাংসার কাজে সেখানে হাজির হয়েছিলেন পাটোয়ারী। সেখানে সভাসদ সহ চেয়ারম্যানের অনুরোধে ঢেঁকিটা গিলতে বাধ্য হয়েছিলেন। সত্যি বলতে বাধ্যই হয়েছিলেন! নাহলে জায়গার সীমানা নিয়ে পাশের জমির মালিক আজিম মিয়ার সাথে তিনি পেরে উঠতেন না। বাইরের মানুষ হয়ে এলাকার মানুষের সাথা লাগতে যাওয়া খুবই বোকার কাজ। এটা চেয়ারম্যানও জানতেন। রাজনীতি জানা মানুষ তিনি। পাটোয়ারীর সমস্যা সমাধান করেছিলেন বটে, তবে একবছরের জন্য কালাম মিয়াকে পাটোয়ারীর পতিত জমিতে থাকতে দেয়ার শর্তে। রাহেলা বেগম চীৎকার করে পাড়া মাত করেছিলেন সেইদিন। গালি দিয়ে পাটোয়ারী সহ তার চৌদ্দগোষ্ঠীর দফা রফা করেছিলেন। বলেছিলেন-“ বুড়ার বোধবুদ্ধি সব গিয়েছে। এ যুগে কেউ এমন আপদ ঘরে টানে! এবার জায়গাটা জবরদখল হবেই। শেষকালে এই বয়সে রাস্তায় নামতে না হয়!”
(৫)
সময়ের সাথেই জীবনের প্রবাহে মিশে যায় ভেসে আসা সব আপদ বিপদ। পাটোয়ারী- রাহেলার জীবনে শান্তির ছবি হয়ে আসা কবুতর এর মতোই সাক্ষাৎ অশান্তি নিয়ে আসা কালাম মিয়া ও তার পরিবারও একসময় গাঁ সওয়া হয়ে যায়। কালাম সারাদিন বাইরে কামলা খাটে আর মাঝেমাঝে পাটোয়ারী সাহেবের ফাই ফরমাশ খাটে। তার বউ ফজিলার কাজ আপাত দৃষ্টিতে সংসার সামলানো হলেও, ঘোর দুপুরে সে ছাগল চরানোর নামে বাসা থেকে বাইরে যায়। লোকচক্ষুর অন্তরালে খুব সতর্ক ভাবে অন্যের জমি থেকে যথাসম্ভব শাক-সবজি চুরি করে আনে। দীর্ঘ অভাবের দিনগুলোতে সে এই অভ্যাস ভালোমতোই রপ্ত করেছিলো। এখন সেটা কালাম মিয়াকে প্রতিদিন বাজার করার চাপ থেকে অন্তত মুক্তি দেয়! রাহেলা বেগম রুটিন মতো দুপুরবেলায় খাওয়া দাওয়া শেষে জানালার পাশে বসেন, ফজিলা কিভাবে চৌর্যকর্ম সারে তা দেখার জন্য। আর পাটোয়ারী সাহেব বাসায় ফিরলে তার আশ্রিতরা যে কি ভয়ানক চোর তার গল্প শোনান। গল্প শেষে সবসময়ই বলেন-“এত্ত ছোটলোক এগুলা তাকাতেও ইচ্ছা করে না!” কিন্তু দুপুরবেলা চলে আসলে নেশার মতো তাদের কাজ দেখতে যান; না দেখতে পেলে মনে স্বস্তি পাননা তিনি।
ইতোমধ্যে একদিন তার দুইটা কবুতর তাদের ছাপরার ভিতর ঢুকতে দেখলেন কিন্তু বের হতে দেখলেন না। তবে কি এরা সুযোগ পেলেই তাদের কবুতরো ধরছে নাকি! সর্বনাশ!
কালাম মিয়ার বড় ছেলে কিছুদিন আগে ঢাকায় গিয়েছে আয় রোজগার করার জন্য। কথা ছিলো টাকা পাঠানোর, কিন্তু সে এখন লা-পাত্তা। ছোট ছেলেটার বয়স সবে ছয়। স্কুলে না গেলেও মায়ের সাথে ছোট খাটো চুরির বিদ্যা সে আয়ত্ত্ব করেছে। ছোট মানুষকে সহজেই ফসলের মাচার নীচে পাঠিয়ে দেয়া যায়; দূর থেকে চোখে পড়েনা। রাহেলা বেগম জানালার ফাঁক দিয়ে দেখেন আর ভাবেন নিশ্চয়ই এটা বয়সকালে মস্ত ডাকাত হবে!
(৬)
মেঝমেয়ে মরিয়ম। বেচারা জন্ম থেকেই কানেও শোনেনা, কথাও বলতে পারেনা। তেরো কি চৌদ্দ হবে বয়স। কথা না বলতে পারলেও কি হবে, মুখের ভঙ্গী আর চোখের ভাষায় সবই বোঝাতে পারে। প্রকৃতিতে কার কোন ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতা থাকলে অন্য ইন্দ্রিয়গুলো খুব সজাগ হয়ে যায়! মেয়েটাকে কালাম অত্যধিক স্নেহ করে আবার তাকে নিয়েই তার যত ভয়! বাড়ন্ত বয়স, মুখে কিছু বলতে পারেনা ; কখন কোন সর্বনাশ হয়! মাথা ভর্তি চুল, ঠোঁটে সবসময় লেগে থাকা এক চিলতে হাসি নিয়ে সে যখন তাকায়, তখন বোধ হয় একবারের জন্য হলেও সবার মনে আসে-“মেয়েটা যথেষ্টই সুন্দর।” মরিয়ম এখন কাজ করে রাহেলা বেগমের বাসায়। সম্ভবত এটাই এখন বড় কারণ যার জন্য তিনি, তার ভাষায় এই “চোরগুলির” আপদ সহ্য করছেন। দুই একটা কবুতর যে হারিয়ে যাচ্ছে এটা পাটোয়ারী সাহেবও বুঝেন, কিন্তু বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাননা। রাহেলার শরীরে বাতের ব্যথা জেঁকে বসেছে। এখন কাজের লোক না পেলে যে ভোগান্তি হবে তা দুই একটা কবুতর হারানোর চেয়ে অনেক বেশি। আর রাহেলার মুখের গালির তীব্রতা সম্ভবত এই মেয়েটা ছাড়া অন্য কেউ নিতে পারবে না। সে সারাদিন যত চেঁচামেচিই করুক, মরিয়ম ঠোঁটে মুচকি হাসি দিয়ে মাথা দোলায়! এমন বাধ্যানুগত কাজের মানুষ তিনি আগে পান নাই। তাছাড়া রাহেলা নিঃসঙ্গতায় একজন সঙ্গীও পেয়েছেন বলা চলে। মরিয়ম না বুঝলেও মাঝেমাঝেই তাকে শোনান-“শুধু তোর জন্য এখনো তোর চোর পরিবারকে সহ্য করছি, নাহলে কবে আমার জায়গা থেকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতাম!”
মরিয়ম কি বোঝে কে জানে! শুধু মুচকি হাসে!
(৭)
কালাম মিয়ার ছাপরা বাড়ি থেকে দুইটা বড় ধানী জমি পরই একটা টিনের বাড়ি হারূন মেকারের। তার ছেলে মোসাদ্দেক। বয়স সতেরো কি আঠারো। বার দুয়েক ফেল করে মাধ্যমিক পাশের স্বপ্ন তার শেষ হয়েছে। তবে তাতে সে বিন্দুমাত্র দুঃখিত বা চিন্তিত নয়। বরং ঝামেলা গেছে ভেবে সারাক্ষণ এপাড়া ওপাড়া করে তার দিন কাটে। আর কখনো সখনো বন্ধুদের নিয়ে পাটোয়ারী বাড়ির ধারে মেহগনি বনের আড়ালে তাসের আড্ডা জমায়। অভিনব রঙের গেঞ্জি আর অদ্ভুত চুলের কাটে তাকে খুব সহজেই আলাদা করা যায় অন্যদের থেকে।
বিকাল বেলা প্রায়ই যখন মরিয়ম কাজ শেষে ছোট ভাইটাকে নিয়ে খেলায় মগ্ন হয়, তখন সে কালামের বাড়ির উঠানের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করে। প্রথম প্রথম দুই ভাই-বোন খেলায় মগ্ন থাকত, তাকে লক্ষ্যই করতো না। কিন্তু ধীরে ধীরে তার সাহস বেড়ে গিয়েছে। মরিয়মের খুব কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে, দুই ভাই বোনের খেলায় যোগ দেয়ার ছুতায় বারবার মরিয়মের হাত ধরার চেষ্টা করে। একদিন আবার গোলাপ ফুল এনে তাকে দেয়। মেয়েরা নাকি অনেক কিছুই বুঝতে পারে, হয়তো মরিয়ম ও পারে; কি বোঝে তা জানা আমাদের জন্য মুশকিল! তবে সে তার কাছে ঘেঁষতে চায়না। দেখলে আগেভাগেই সরে পড়ে।
মধ্যবয়সের ফযিলা জীবন অভিজ্ঞতায় অনেক পাকা, অনেক কিছুই বোঝেন। ঠান্ডা মাথায় মোসাদ্দেককে ঘুরাঘুরি করতে মানা করেন, তাতেও কাজ না হলে পাড়া মাথায় তুলে গালাগালি দেন। তাতেও কাজ না হলে কালাম মিয়া সরাসরি জিজ্ঞাসা করেন-“ বাপজান কি চান বলেন তো?”
“আপনার মেয়েকে বিবাহ করতে চাই। তার হাসি আমার খুব পছন্দ”।
কালাম এই উত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিলোনা। খানিকটা স্বগোতক্তি করেই বলে-“ইয়ার্কি তামাশার বিষয় নয় এটা। কালা বোবা মেয়ে আমার। তারে নিয়া তামাশা করলে উপরয়ালা নারাজ হবে”।
কিন্তু মোসাদ্দেক আগের চেয়েও দৃড়তার সাথে বলে সে মরিয়মকে বিয়ে করবে। মরিয়মের মা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে শুনছিল সব কথাই। হঠাত সামনে এসে বলল-“কবে বিয়ে করবা?”
“বাসায় কথা বলে জানাচ্ছি। কিন্তু কয়টা দিনতো অর সাথে মিশতে দেন। একেতো কথা শুনতেও পারেনা,বলতেও পারেনা; আমারতো তার সাথে একটু ভাব হওয়া লাগবে তাইনা? নাহলে বোবা মানুষের সাথে সংসার কিভাবে করবো!”
কন্যাদায়মুক্তির বিশাল চাপের মাঝে একটু আশার আলো দেখে বেশি কথা বাড়ায়না কালাম। শুধু বলে- “তোমার বাপের সাথে কথা বলে তাড়াতাড়ি জানাও”
(৮)
এরমধ্যেই কালামের সংসারে নতুন এক বিপত্তি আসে। তার ঢাকায় নিরুদ্দেশ ছেলে সুমন বিনা নোটিশে বউ নিয়ে হাজির হয়! গার্মেন্টসে কাজ করতে গিয়ে সেখানেই পছন্দ তারপর বিয়ে। নতুন বউ এর মুখ পাউডারে সাদা আর চুলে লাল মেহেদির ছোপ। ঢাকা থেকে বিয়ে করে বউ নিয়ে আসা এখনো এইসব দিকে খুব বেশি ঘটেনা। দলে দলে মানুষ সুমনের ঢাকাইয়া বউ দেখতে আসে। নাম জিজ্ঞাসা করলে সে খানিকটা নাকি সুরে বলে-“আমার নাম ল্যাকি, বাড়ি ঢাকা”
কালামের মাথায় বাজ পড়ে। একটা মাত্র থাকার ঘর আর আরেকটা রান্নাঘর। তাতেই দিন কাটাতো তারা। এখন এদেরকে রাখবে কই! আর ছেলেও যে টাকা জমিয়ে এনেছে তাও মনে হচ্ছে না! সেইদিন সন্ধ্যায় মোসাদ্দেকও আসে নতুন বউকে দেখতে। কিছুক্ষণের মধ্যে গল্প জুড়ে দেয়। আসলে নাটক ফিল্ম আর ঢাকা নিয়ে খবর রাখে এমন কাউকে না পেয়ে হাপিয়ে উঠেছিল লাকি। যাক এমন একজনকে পাওয়া গেলো যে কিনা এসব খবর ভালোই জানে! মরিয়মের মা এসে লাকির কানে কানে বলে যায়-“শোন মা কথা বার্তা চলতেছে। এ আমাদের মরিয়মকে বিবাহ করতে চায়”
লাকি ফজিলার হাতে মৃদু চাপ দিয়ে বলে-“আম্মা সব ফাইনাল?” ফজিলার “না” উত্তর শুনে হেসে বলে-“টেনশন করেন না; একমাসের মধ্যে আমি আর আপনার ছেলে মিলে সব কনফার্ম করে দিচ্ছি!”
(৯)
কয়েকদিন পর লাকি রাহেলাবেগমের কাছে ঘর বানানোর জন্য আর্জি নিয়ে গেলে, তাকে আপাদমস্তক দেখে ঠান্ডা গলায় মানা করে দেন তিনি। তাও ভাব জমানোর চেষ্টা করেছিলো সে, কিন্তু বুড়ি পাত্তাই দিলোনা শেষ পর্যন্ত। ঢাকায় কতো মানুষকে ম্যানেজ করে চলেছে লাকি, কিন্তু এমন বাজে ব্যবহার সে এর আগে পায় নাই! তার স্বামীকে নিয়ে তাসের আড্ডায় বসেছিলো মোসাদ্দেক। সেখানে গিয়ে চোখ লাল করে নিজের অপমানের কথা জানালো লাকি। হতভম্ব সুমনের হাত ধরে টান দিয়ে মোসাদ্দেক জানালো আজকেই এর বিহিত হবে। আর লাকি সুমন এখানেই বাড়ি করে থাকবে। ব্যবস্থা করার দায়িত্ব তার। মোসাদ্দেক লাকির দিকে তাকিয়ে একটা শঠ হাসি হেসে বলে-“ ভাবি জানেনতো এইদেশের নিয়ম, দখল যার, জায়গা তার”
মোসাদ্দেক আর সুমনের কথা শুনে পাটোয়ারীর মাথা গরম হয়ে যায়। এমনিতেই চৈত্র মাসের রোদ, তার মধ্যে তারা দুজন আসছে নতুন ঘর বানানোর অনুমতি নিতে! মনে হচ্ছে এদের বাপ দাদার কেনা সম্পত্তি! তিনি সাফ সাফ বললেন-“চলবে না”।
কি চলবে! নাকি চলবেনা ! এসব আমাদের জানার দরকার নাই। ভাই আমার এখানেই থাকবে! পারলে উঠায়েন!
বলে হটহট করে হাঁটা দিতে গিয়ে মোসাদ্দেক আবার পিছন ফিরে বলে-“ চেয়ারম্যান আর পুলিশ কিন্তু মাঝরাতে পাহারা দিতে আসবে না। বাড়াবাড়ি করলে বুড়াবুড়ি দুইজন মেহগনি বনে হাওয়া হয়ে যাবেন!”
ঘামতে থাকেন পাটোয়ারী। স্ত্রীকে ডাকতে গিয়েও ডাকেন না।
(১০)
চৈত্রের শেষের দিকে আর বৈশাখের শুরুতে এদিকে ভয়াবহ ঝড় হয় প্রতিবার। বাংলায় এর নাম কালবৈশাখী। আকাশের কোণে কালো মেঘের আঁচড় দেখে এখনো অনেক অভিজ্ঞ লোক বলতে পারেন, ঝড়টা কখন আসবে! আজকে আকাশের মেঘের হাবভাব দেখে বয়স্ক লোকেরা বলাবলি করছে, খুব সাঙ্ঘাতিক ঝড় হবে!
সবার কথা সত্যি করে একটু পর সত্যিই আকাশের এক মাথা থেকে অন্য মাথা চিড়ে বিদ্যুৎ চমকাতে লাগলো। শব্দের তীব্রতায় বোঝা যাচ্ছিল আশেপাশেই বজ্রপাত হচ্ছে অনবরত! কান তালা লেগে আর খোলার সময় দিচ্ছিল না! মোসাদ্দেক আর সুমন বাসার ছুপড়ি বারান্দায় দাড়িয়ে অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছিল। বৃষ্টি অল্প অল্প শুরু হলেও বাতাস তখনো শুরূ হয় নাই। পাটোয়ারীর গোটা দশেক কবুতর সম্ভবত বাজের শব্দে দিশেহারা হয়ে তাদের উঠানের কোণে জড়সড় হয়ে আছে! মোসাদ্দেক লাকি আর সুমনের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বললো-“ভাই- ভাবি আজ রাতে কবুতরের পিকনিক হোক! কি বলেন!” বলেই মুরগি রাখার ঝাঁপিটা নিয়ে দ্রুত বেগে কবুতর গুলোর উপর ফেলল। একবারে গোটা দশেক কবুতর এর আগে কখনোই ধরতে পারে নাই সে। বিজয়ীর হাসি হেসে তাকালো মোসাদ্দেক। মনে মনে খুশি হলেও লাকি মুখ থমথম করে জানালো-“পিকনিক পড়ে হবে, ঝড়ে বাসাটা আগে টিকুক তো!”
সম্ভবত পাটোয়ারী সাহেবের হাত থেকে খেতে অভ্যস্ত কবুতর গুলো বন্যতা ছেড়ে একটু বেশিই পোষা হয়ে গিয়েছিল।
জানালার ফাঁক দিয়ে রুদ্ধশ্বাসে সবই খেয়াল করছিলেন রাহেলা। দৌড়ে স্বামীর ঘরে ঢুকে বললেন-“ সর্বনাশ হয়ে গেছে! চোরের বাচ্চগুলো সবগুলো কবুতর ধরল আমার চোখের সামনে!”
পাটোয়ারী রাহেলার ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে বললেন-“চুপ!”
রাহেলা আঁতকে উঠে বললেন-“ তোমার গিরিবাজটাকেও...”
পাটোয়ারী আবার বললেন-“ বাঁচতে চাও তো চুপ!”
(১১)
এতক্ষণ বৃষ্টি হচ্ছিল গাঁয়ে গাঁয়ে। এবার হঠাত বাতাস বইতে শুরু করলো ভয়ংকর জোরে। কালাম তখনো কাজ থেকে ফিরে নাই। কবুতর ধরার উত্তেজনায় সবার সাথে ফজিলাও এতো উত্তেজিত ছিলো যে মাঠে ছাগল আছে তা ভুলেই গিয়েছিলো। মনে পড়তেই দিক্বিদিক ভুলে মাঠের দিকে ছুটল সে। ঢাকা থেকে কিনে আনা তার একমাত্র সাইকেলটা ভুলে স্কুলের বারান্দায় রেখে এসেছিলো সুমন। ঝড়ের মাতম দেখে হঠাত হুশ হলো তার। ঝড় শেষে আর যাই হোক সাইকেল পাওয়া যাবে না, তাই ভেবে সেও দৌড় দিল স্কুলের দিকে। আর মোসাদ্দেক চোখের ইশারায় মরিয়মকে কোন একটা সংকেত দিতেই ভয়ে পান্ডুর হলো তার মুখ। চোখ বন্ধ করে দৌড় দিলো সে ঝড়ের মধ্যেই! বাতাসের তীব্রতায় চোখও মেলানো যাচ্ছিলনা। তার মধ্যেই সুমন স্কুলের দিকে যেতে যেতে দেখলো মোসাদ্দেকও তার নিজ বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে। দূর থেকেই হাত নাড়ালো তারা। মোসাদ্দেককে চলে যেতে দেখে ঝোপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে চুপ করে ঘরে ঢুকলো মরিয়ম।
(১৩)
এরকম ঝড় গত কয়েকবছরের মধ্যে হয় নাই এ তল্লাটে। গাছগুলির মাথা একবার মাটিকে ছুঁয়ে দিচ্ছিল, আরেকবার আকাশে। কলাগাছগুলিও দেয়াশলাইয়ের কাঠির মতো পটাপট ভাঙ্গছিল। যেমন ঝড়ো বাতাস, তেমন মুষল বৃষ্টি! ঘন্টাখানিক অপেক্ষার পর বৃষ্টি মাথায় করেই বাড়ির দিকে রওনা দিলো সুমন। বাসায় সবাই কি অবস্থায়, আর ঘরগুলো কি অবস্থায়! এই চিন্তায় সে দ্রুত সাইকেল চালাতে গিয়ে পিছলে পড়লো বার দুয়েক। প্রতিবারই মনে মনে পাটোয়ারীকে ইচ্ছমত গালি দিলো । কালকেই ওই জায়গায় টিনের ঘর তুলবে সে! দেখবে কে আটকায়!
বাড়িতে এসে প্রথম ঘরে ঢুকে সুমন দেখলো সারা শরীর পানি আর কাঁদায় মেখে এককোণে মাদুর বিছিয়ে গুটিগুটি হয়ে শুয়ে আছে মরিয়ম। ঘুমাচ্ছে মনে হয়। বারান্দা পার হয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিতেই পায়ের নীচে মাটি সরে গেলো তার। মেঝেতে মোসাদ্দেককে আলিঙ্গন করে কামনায় ছটফট করছে লাকি! কিছুক্ষণের মধ্যে সম্বিৎ ফিরে পেয়েই হাতের কাছে থাকা একটা চেড়া বাঁশ তুলে নিলো সে! ততোক্ষনে তার উপস্থিতি বুঝতেই এক ঝটকায় লাকিকে নীচে ফেলে রান্নাঘরের পিছনের ছনের দেয়াল ভেঙ্গে দৌড় দিল মোসাদ্দেক। লাঠি হাতে ক্রুদ্ধ জন্তুর মতো তাকে তাড়া করলো সুমন!
(১৪)
লাকি হতভম্ভ হয়ে বসে থাকলো কিছুক্ষণ। তবে তার মস্তিষ্ক এখনো খুব সজাগ। জীবনে অনেককিছুই দেখেছে সে। এই সাধারণ হাত টানের অভ্যাসয়ালা মানুষগুলোর চেয়ে ঢের বেশি দেখেছে সে। সামলেছেও অনেক। এই পরিস্থিতেও মাথাটাকে ঠান্ডা রেখে এক মুহূর্ত ভাবলো সে!
এরপর সটান ঝাঁপি ঢাকা দেয়া কবুতর গুলো থেকে সবচেয়ে পুষ্টটাকে বের করে আনলো। আঙ্গুল টিপে হেঁটে ঢুকলো শোবার ঘরে মরিয়মের পাশে। ভয়ে আর ক্লান্তিতে অঘোরে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। একটানে কবুতরটার ধড় থেকে মাথা আলাদা করে ফেললো লাকি। উৎক্ষিপ্ত রক্তের ধারাকে কৌশলে মরিয়মের পায়জামার উপরে তলপেটের কাছাকাছি ভরিয়ে দিয়েই বের হয়ে আসলো সে!
খানিক বাদেই, তখন ঝড় কিছুটা শান্ত; লাকি গগনবিদারী চীৎকার দিলো। এমন জোরে চীৎকার যে আশেপাশের মানুষ জড়ো হতে বিশেষ সময় লাগলো না! লাকী বুক চাপড়িয়ে শুধু একটা কথাই বলতে লাগলো-“বিয়ের কথা বলে প্রতিবন্ধী মেয়েটার কি সর্বনাশ করলো রে! এখন কি হবে অর!”
চেঁচামেচিতে কেবলমাত্র ঘুম ভাঙ্গতেই, আশেপাশের বউঝিরা মরিয়মকে হেঁচকা টানে বাইরে নিয়ে আসলো। কয়েক ডজন জোড়া চোখ বিস্মিত চোখে তাখিয়ে মন্তব্য করলো-“ তাইতো! দেখছিস না রক্তের দাগ!”
(১৫)
এরপরের ঘটনা বিশেষ এই যে, কালাম মিয়া খবর পেয়ে বাড়ি ফিরে হিতাহিত জ্ঞানশুন্য
হয়ে বেদম প্রহার করেছিলেন। মুমূর্ষ মেয়েটাকে নিয়ে সদর হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিলো। লাকী বলেছিল- যে সে এমনিতেই চলে যাবে; কিন্তু বাড়াবাড়ি করলেই রটিয়ে দিবে যে সুমন অক্ষম! সুমন সব বুঝলেও আর কথা বাড়ায় নাই। ঘটনার দিন বিকাল বেলায়ই চেয়ারম্যান সাহেব কালামের পরিবার কে গ্রাম থেকে বের করে দিয়েছিলেন। পাটোয়ারী সাহেব ও তার জায়গা ফেরত পেয়েছিলেন! তবে সেই ঝড়ে পাটোয়াড়ীর বাড়ির চিলেকোঠার ছাদটা ঊড়ে গিয়েছিলো। কবুতরগুলোও আর ফিরে আসে নাই।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
শঙ্খজিৎ ভট্টাচার্য ২১/০৬/২০২৪নাইস
-
মোঃ নূর ইমাম শেখ বাবু ২১/০৫/২০১৯Nice..
-
নাসরীন আক্তার রুবি ২১/০৫/২০১৯গল্পটি চমৎকার,বাস্বব কাহিনী