www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

রবীন্দ্রনাথের প্রেমিকারা

'কবিরে পাবেনা তাহার জীবণ চরিতে’- রবি ঠাকুর একথা লিখেছেন বটে । কিন্তু, নানা আঙ্গিকে, নানা ভাবে, কবিতায়, গানে, নাটকে এমন কি প্রবন্ধে, নিজের আঁকা ছবিতে, কবি নিজেকেই চিত্রিত করেছেন বারংবার । প্রকৃতির বিস্তার তার রচনাতে জলরাশির মতো বিস্তৃত থাকলেও তাকে আমরা প্রকৃতির কবি বলি না । কারন প্রেম, পূজা আর প্রকৃতি – এই তিনের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে কবির কাব্যিক প্রতিমা । বাঙালীর মানসভূমির সূক্ষ্ম প্রেম রস যেন মূর্তিরূপে ধরা দিয়েছে তার কবিতায়, গানে, উপন্যাসে । এর এতো সহজ অথচ বাস্তব প্রকাশ আগে কখনো হয়নি আর । এমনি এমনি তৈরী হয়নি ‘আমারো পরানো যাহা চায়’ কিংবা ‘ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে’র মতো পংতি মালার । আমরা অনেকেই তাকে ‘দেবতা’ বলে সম্বোধন করিতো, তাই ভুলে যাই তার ‘মানুষ’ পরিচয়ের কথা । সত্যি কথা হচ্ছে রবীন্দ্রনাথও প্রেমে পড়েছিলেন । একবার নয় বহুবার । তবে ঐ প্রেম পূর্ণতা পেয়েছিলো তার সাহিত্যে, দৈহিক বন্ধনে নয় ।

যে বালিকার সঙ্গে তিনি প্রথম প্রেমে পড়েছিলেন , তিনি তার অন্যতম বড়ভাই, জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্ত্রী কাদম্বরী দেবী । যাকে নিয়ে লিখেছিলেন ‘তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা’ কবিতা । যা ‘ভগ্ন-হৃদয়’ নামে ১৮৮০ সালে ছাপা হয় ‘ভারতী’ পত্রিকায় এবং পরে গান হিসাবে গাওয়া হয় ব্রাহ্ম সভাতে । কাদম্বরী দেবী ছিলেন তার প্রথম খেলার সাথী, তারপর সাহিত্যের পথ প্রদর্শক, বন্ধু, সমালোচক । এদিকে ব্যক্তি জীবনে কাদম্বরী ছিলেন গভীর দুঃখে দুঃখী । কারন তৎকালীন সময়ে বিলেত ফেরত বিদ্ব্যান জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারেন নি কখনো । আবার ঠাকুরবাড়ীর মধ্য সারীর কর্মচারীর মেয়ে বলে পরিবারের অন্য বউয়েরাও তাকে যথার্থ ‘জা’ এর মর্যাদা দেননি । তাই তিনি ছিলেন একটু ভালোবাসার , একটু বন্ধুত্বের কাঙাল । কবির সাথে দীর্ঘ দশ বছরের সম্পর্কে ‘ না পাওয়াতে পাওয়ার আনন্দের’ মতো সেই আশা খানিকটা পূরণ হয়েছে বলা যায় ।

এবার কবির বিলাত যাত্রার পালা । সতেরো বছর বয়সে সেজোভাই সত্যেন্দ্রনাথের মতো আইসিএস পরীক্ষায় অংশ নেবেন বিশ্বকবি । পিতার ইচ্ছা আইসিএস না হোক অন্তত ব্যরিস্টার হয়ে ফিরবে ছোট পুত্রটি । এর জন্য প্রয়োজন আগে বিলাতী আচরণ প্রণালী শিক্ষা । তাই কবিকে পাঠানো হলো মুম্বাইয়ে সত্যেন্দ্রনাথের বন্ধু আত্মারাম পান্ডুরংয়ের বাসায় । আত্মারামের তিন মেয়ের মধ্যে ছোট মেয়ে আনা তড়খড়ের উপর দায়িত্ব পড়লো কবিকে খানিকটা ইংরেজ করে তোলার ( কারন আনা পূর্বেই বিলাত ভ্রমন করে এসেছিলেন ) আনা ছিলান কবির থেকে দুই বছরের বড়ো । কিন্তু অমন সুদর্শন গায়ক আর কবির প্রেমে পড়তে মোটেও দেরী হয়নি তার । রবি ঠাকুরও ইংরেজী শেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন না। বরং গান শুনিয়ে, কবিতা লিখে, আনা কে ‘ নলিনীক’ নাম দিয়ে তাকে মুগ্ধ করতেই বেশি আগ্রহ দেখালেন । এ প্রসঙ্গ উঠে এসেছে বন্ধু ধূর্জটী প্রসাদ ও অতুল প্রসাদ সেনের সাথে আলাপচারিতায়- “ এ কথা আমি মানব যে মনে মনে টের পেতাম ঘটবার মতন একটা কিছু ঘটেছে, কিন্তু সেই হওয়াটাকে উস্কে দিতে আমার না ছিলো কোন তৎপরতা, না ছিলো কোন প্রত্যুৎপন্নমতি ।’’

তারপর কবি পাড়ী জমালেন আলো- ছায়ার শহর লন্ডনে । উঠলেন দশ নম্বর ট্যাভীস্টীক স্কয়ারে জন স্কটের বাড়ীতে । কথিত আছে স্কটের বাড়িতে একজন ব্ল্যাকি আসবেন শুনে তার দুই মেয়ে ফ্যানি ও লুসি নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন । পরে যখন শুনলেন ছেলেটি দেখতে রাজপুত্রের মতো, তারপর তারা সানন্দে বাড়ী চলে এলেন । এরি মধ্যে কবির ভাব জমে গেলো লুসির সাথে । লুসি তার কাছে বাংলা শিখত চাইলে কবিও সানন্দে রাজি হয়ে গেলেন । কবির ভূবণমোহন ব্যক্তিত্ব মুগ্ধ করলো লন্ডন নিবাসিনীকে । তিনি প্রেমে পড়লেন রবীন্দ্রনাথের । তবে লুসির প্রতি কবির দুর্বলতারও কমতি ছিলো না ।

লুসির পরে কবির জীবনে যে রমনীর উল্লেখ পাওয়া যায় তিনি ইন্দিরা দেবী । কবির সম্পর্কে ছিলেন ভ্রাতুষ্পুত্রী। তার সাহিত্যবোধ , নান্দনিকতা, বুধিমত্তা, আধুনিকতা কবিকে আকৃষ্ট করেছিলো খুব । ১৮৮৭ থেকে ১৮৯৯ পর্যন্ত এই ইন্দিরা দেবীকেই কবি মোট ২৫২ টি চিঠি লিখেছিলেন । তবে প্রমথ চৌধুরীর সাথে ইন্দিরা দেবীর বিয়ের পরে রবীন্দ্রনাথের চিঠির ভাষা পরিবর্তিত হয়, সম্বোধনও পাল্টে যায়, আস্তে আস্তে সংখ্যাও কমতে থাকে ।

এর দীর্ঘকাল পরে নোবেল প্রাপ্তীর সাত বছরের মাথায় আরেক তরুনী তার জীবনে উদিত হন । যার নাম রানু অধিকারি । কাশবাসি এক অধ্যাপকের উদ্ভিন্ন যৌবনা সুন্দরী কন্যা, ব্যাতিক্রমধর্মী ব্যক্তিত্ব । তার কাছ রবীন্দ্রনাথের দেবত্ব ছিল অপরীসীম । সবাই কবিকে গুরুদেব বলে সম্বোধন করলেও তিনি এর বালাই রাখেননি কখনো । নিজের থেকে ৪২ বছরের বৃদ্ধকে পরিণত করেছিলেন বন্ধুতে। রবীন্দ্রনাথ একে প্রথমে কৌতুহল হিসেবে নিলেও ধীরে ধীরে বাধ্য হন এই আগ্রাসি বালিকার মোহ জ্বালে ধরা দিতে ।

এরপর ‘ ভূবন ভ্রমিয়া শেষে’ কবি এলেন নূতন এক দেশে। যার নাম আর্জেন্টিনা । ব্রাজিল হয়ে চিলি যাওয়ার কথা থাকলেও জাহাজে দৈবক্রমে তিনি হয়ে পড়লেন অসুস্থ । ডাক্তার বাবু পরামর্শ দিলেন দু’মাস বিশ্রামের । ঠিক হলো থাকবেন বুয়েন্স আয়ার্সে । ওদিকে ১৯১৪ সালে গীতাঞ্জলীর অনুবাদ পড়েই কবির সৃষ্টির প্রমে পড়ে যান আর্জেন্টিনার বিখ্যাত কবি , সাহিত্যিক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো । ভিক্টোরিয়ার সেই ভালোবাসার মানুষটি তার শহরে, তার চোখের সামনে । এ সুযোগ কি কখনো হাত ছাড়া করা যায় ? তাই অনেক ভৃত্য থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজেই নিলেন কবির যত্নের ভার । স্নেহ- বালোবাসার কাঙাল রবীন্দ্রনাথ ভিক্টোরিয়ার রূপে, গুনে সেবা যত্নে আর ব্যাক্তিত্বে অচিরেই মুগ্ধ হলেন । আনা তড়খড়ের মতো বাংলায় তার নাম রাখলেন ‘বিজয়া’ ।পরে কবি তার ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ এই বিজয়াকেই উৎসর্গ করেন ।

যাই হোক , অত্যন্ত ক্ষুদ্র পরিসরে বিশ্বকবির প্রেমের চিত্র অংকন করে পাঠকের তৃষ্ণা নিবারন করার চেষ্টা বাতুলতা ছাড়া আর কিছুই নয় । তাই ধৃষ্টতা প্রদর্শণের জন্য ক্ষমা চাইছি । তবে এটা টিক যে প্রম কোন অতিমানবীয় গুন নয়, জীবনের আর দশটা সাধারণ দিকের মধ্যে এটিও একটি । তবে কখনো কখনো মানবের এই আবহমান বোধটি আসীম প্রেরণার উৎস হয়ে ‘আশার সোনার বিন্দুতে’ পরিণত হয় । তাকে বসিয়ে দেয় কল্পলোকের স্বর্ণ- সিংহাসনে । যেটি হয়েছিলো কবিগুরুর ক্ষেত্রেও । তাই তার প্রেম ‘কাম গন্ধ নাহি তায়’ এর সীমা পেরিয়ে সাহিত্য সুষমায় উদ্ভাসিত । রবি ঠাকুরের এই প্রেমিকাদের নিকট ঋণী গোটা বাংলা সাহিত্য । যারা না থাকলে হয়তো সৃষ্টি হতো না এমন হৃদয় স্পর্শী পঙতিমালার । তাই জয় হোক রবীন্দ্রনাথের, জয় হোক তার প্রেমিকেদের ।

..............................

সহায়ক গ্রন্থাবলী-
১)প্রশান্ত পাল- রবি জীবনী ( ২য় খন্ড )
২) শঙ্খঘোষ- ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ
৩) আবুল হাসনাত (সম্পাদিত) – কালি ও কলম, ৭ম বর্ষ, একাদশ সংখ্যা ৪) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর – য়ূরূপবাসীর পত্র
৫) অয়ন চক্রবর্ত্তী - দ্বিধাগ্রস্থ রবীন্দ্রনাথ
বিষয়শ্রেণী: প্রবন্ধ
ব্লগটি ১৮৫৪ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ১২/০৯/২০১৪

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

 
Quantcast