নতুন ফ্ল্যাটের রহস্য
এই গল্পটা আমি কেন লিখতে বসলাম সেটা জানি না। আসলে এটা আদৌ কোন গল্প কিনা সেটা নিয়েও আমার বেশ সন্দেহ আছে। অলৌকিকে আমার একটুও বিশ্বাস নেই, যেমন বিশ্বাস নেই ভগবানে। এই নিয়ে বাড়িতে আশান্তিও যে কম হয় না সেটা বলাই বাহুল্য। আমার স্ত্রী বা আমার মা দুজনেই এতটাই ঈশ্বর ভক্ত যে আমার মাঝে মাঝে মনে হয় যে ওদের পুজোর চোটে ভগবান নেমে না আসেন। যাই হোক, ভগবান আছে কি নেই, নেমে আসবেন কি আসবেন না সেই তর্কে না যাওয়াই ভালো। সেটা বলব বলে বসলাম, সেই প্রসঙ্গে আসি।
আমার সাথে যা ঘটেছিল আমি সেটাই লিখছি, একটুও রঙ চড়ানো হয় নি। গল্পতা আগে যাদের বলেছি, তারা সবাই হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। আমিও হেসেছি। কিন্তু তবুও কোথায় যেন একটা খটকা লেগে আছে।
আমি কর্মসূত্রে চীন দেশে থাকি। তাও প্রায় বছর সাতেক হয়ে গেল। কলেজ পাস করেই একটা চীনা কোম্পানিতে চাকরির অফার পেয়ে বিদেশে পাড়ি। তারপর আর স্থায়ী ভাবে দেশে ফেরার তাগিদটা অনুভব করিনি। যদিও আমার ছেলের এখন প্রায় দু বছর বয়স, তাই ওর স্কুলিং-এর জন্য আর বছর দুয়েকের মধ্যেই দেশে ফেরার প্লান করতে হবে। দেখি কত দূর কি করা যায়।
আমি থাকি চীনের দক্ষিণে দাসিচাও বলে একটা ছোট্ট শহরে। ছোট্ট বললাম কারন এটা বেজিং বা ডালিয়ানের তুলনায় খুবই ছোট, কিন্তু ভারতের যে কোন মাঝারি শহরের এর কাছে ফেল খেয়ে যাবে। বিশাল বিশাল চওড়া রাস্তা, কুড়ি তলা, পঁচিশ তলার হাই-রাইজ, রাস্তায় অডি, মার্সিডিজ বেঞ্জ ছাড়া কিছু চোখেই পড়ে না। আর রাস্তার পাশের যে ফুটপাথ, সেটা প্রায় আমাদের কোলকাতার বি টি রোডের সমান। রাস্তার দু ধারে লাইন দিয়ে আলো ঝলমলে দোকান। সেই সব দোকানের বেশির ভাগই নয় রেস্তরা, নয় সেলুন। এখানের লোক জনও বেশ ভালোই, খুব ফ্রেন্ডলি।
যাই হোক, এবার মুল গল্পে আসি। চীনে আসার পর, আমি যে ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছিলাম এখনও সেটাতেই আছি। ভাড়া একটু বেশি হলেও, ফ্ল্যাটটার পোজিশান এত ভালো যে ছাড়তে ইচ্ছে হয়নি। আমার ফ্ল্যাট থেকে বাজার হেঁটে দশ মিনিট লাগে, এখানের সবথেকে ভালো যে সুপার মার্কেট, সিংলোন, সেটাও ওই মিনিট পনেরো। এত সুবিধে আছে বলে ভাড়াটা অত গায় লাগে না। যাই হোক, গত মাসে এক রবিবার সকালে আমার বাড়ির মালিক এসে হাজির, মিঃ লি লিন। ভদ্রলোক খুব মিশুকে, আর অল্প আধটু ইংরেজিও বলতে পারেন। আর হ্যাঁ, যেটা বলা হয়নি। আমি সাত বছর চীনে থেকে চীনা ভাষা একটু রপ্ত করতে পারলেও আমার স্ত্রী চার বছর থেকেও একটুও পারেনি। যাই হোক, তা মিঃ লি লিন এসে যা বললেন সেটা শুনে একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম। উনি ফ্ল্যাটটা রঙ করাতে চান তাই হপ্তা দুয়েকের জন্য আমাদের অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে হবে। তারপর কাজ শেষ হলে আবার পুরনো আস্তানায়। কি আর করি, পরের দিন বেরলাম বাড়ি খুঁজতে। আজ কাল চীনে রিয়েল এস্টেটের অবস্থা খুব ভালো নয়। আমাদের দাসিচাওতেই প্রায় আট দশ খানা হাই-রাইজ ইনকমপ্লিট অবস্থায় পড়ে আছে। তাই আজকাল বাড়ি খোঁজা এখানে একটা ঝক্কির ব্যাপার। দিন দুয়েক খুঁজেও যখন কিছু পেলাম না, তখন বেশ চিন্তায় পড়লাম। হোটেলে থাকা যায়, তবে এখানে হটেল বলতে একটাই – লিহুয়া ইন্টারন্যাশানাল। আর তার একদিনের যা ঘর ভাড়া, তাতে আমার একমাসের বাড়ি ভাড়া হয়ে যাবে। একদিন অফিসে আমার এক কলিগ, মিঃ সুন ইয়াং মাও-কে বলতে সে বলল, “আমি একটা ফ্যাটের সন্ধান দিতে পারি। দাসিচাওয়ের উত্তর দিকে। মেন শহর থেকে একটু দূরে হবে ঠিকই তবে তাতে তোমার বিশেষ অসুবিধে হবে না। মাত্র দু সপ্তাহের তো ব্যাপার।”
“না, না। অসুবিধের কি আছে। ধন্যবাদ ভাই। একটু দেখ না।”
“আসলে ফ্যাটটা আমার এক মামার। এখন উনি বেজিং-এ থাকেন, ওনার মেয়ের কাছে। গত দুবছর ধরে খালি পড়ে আছে, আর উনি ভাড়াও দিতে নারাজ। কিন্তু আমি বললে দু সপ্তাহের জন্য উনি দিয়ে দেবেন। আর ভাড়াও নেবেন বলে মনে হয় না। দেখি কথা বলে।”
আমি বললাম, “ভাড়া দিতে তো আপত্তি নেই আমার। কিন্তু বাড়িটা আমার খুবই দরকার। পরশু থেকে রঙের কাজ শুরু হবে। একটু দেখ না, ভাই।”
মিঃ সুন তার মামাকে রাজি করিয়ে নিলেন। ভাড়া দিতে হবে না, শুধু জল আর ইলেকট্রিকের চার্জ দিতে হবে। আর একটা সর্ত আছে।
“কি সর্ত?” মিঃ সুনকে জিজ্ঞেস করলাম।
উনি একটু আমতা আমতা করে বললেন, “তোমাকে আর কি বলব ভাই, আমার মামা কুকুর খুব ভালোবাসেন। এখানে থাকার সময় ওনার প্রায় সাতখানা কুকুর ছিল। ওনার যে সবচেয়ে প্রিয় কুকুরটা ছিল সেটা মারা যাওয়ার পর তার একটা বিশাল ছবি ফ্যাটের সামনের ঘরে উনি টাঙিয়ে রেখেছিলেন। ওনার সর্ত হল, সেটা দেওয়াল থেকে খোলা যাবে না। কি অদ্ভুত আবদার বল দেখি?”
আমি বললাম, “সেটা আবার একটা সর্ত হল? থাকবে ছবি টাঙানো। তাতে আমার কোন অসুবিধে নেই।”
পরের দিনই দুটো সুটকেস নিয়ে চলে গেলাম নতুন ফ্যাটে। মেন শহর থেকে একটু দূরে বলেই হয়তো সোসাইটিটা একটু নোংরা। বাড়ির তিনতলায় আমাদের নতুন ফ্যাট। ঘরে ঢুকে দেখি বেশ সাজানো গোছান। মিঃ সুন লোক দিয়ে আগেরদিন ঘরটা পরিষ্কার করিয়ে রেখেছিলান। কিন্তু ঘরে ঢোকা মাত্রই গোল বাঁধল। কুকুরের ছবিটার কথা আমার স্ত্রিকে আগে বলিনি। আর সেটা দেখেই সে বলল, “এটা এখুনি নামানোর ব্যবস্থা কর।”
আমার দু বছরের ছেলে জোজো আবার ছবিটা দেখেই “ডগি, ডগি” বলে লাফাতে শুরু করে দিল। আমার বাড়িতে কোনদিন কুকুর ছিল না। বলতে গেলে কুকুর জিনিষটাকে আমি একটু ভয়ই পাই। ছেলেবেলায় একবার কুকুরের তাড়া খেয়েছিলাম, সঙ্গে কামড়ও। তারপর থেকেই কুকুর আমার খুব অপছন্দের।
সর্তের কথাটা আমার স্ত্রিকে বলতে ও বলল, “এ আবার কিরকম সর্ত, রে বাবা? মরা কুকুরের ছবি টাঙিয়ে রাখতে হবে।”
এই বলে গজগজ করতে করতে ভীতরে চলে গেল। একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করলাম, যে ঘরগুলোর মধ্যে কেমন যেন একটা গন্ধ। খুব তীক্ষ্ণ নয়, তবে নাকে আসে। এইরকম গন্ধ অনেকটা আলিপুর চিড়িয়াখানায় পাওয়া যায়, বাঘ কিম্বা নেকড়ের খাঁচার পাশে, তবে সেখানে গন্ধটা অনেক প্রখর।
এই নতুন ফ্যাটের বসার ঘরটা অনেক বড়, তাই আমার ছেলে খুব আনন্দের সাথে লাফালাফি শুরু করে দিল। আরও একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম যে ঘরগুলোর দেওয়ালে সাদা রঙের উপর কুকুরের ময়লা পায়ের ছাপ। মিঃ সুন আমাকে আগেই বলেছিলেন যে বাড়ি পুরনো আর বছর দুই কেউ থাকেনি, তাই দেওয়ালেও রঙ চটে গেছে। আর বাড়িতে কুকুর বেড়াল থাকলে দেওয়ালে তাদের পায়ের ছাপ যে থাকবে সেটা আর নতুন কি?
আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করতে বললাম, “সুন তো বলেই ছিল, যে দেওয়াল টেওয়াল নোংরা হয়ে আছে। আর আমরা তো থাকবো দিন দশেক। একটু এডজাস্ট করে নাও।”
আমি কুকুরে যতটা ভয় পাই, আমার ছেলে জোজো যেন ততটাই কুকুর ভালোবাসে। রাস্তা ঘাটে কুকুর দেখলেই ‘ডগি, ডগি’ করে চেঁচাতে থাকে। আর ওর প্রিয় সফট টয়টাও একটা কুকুর। তাই মাঝে মাঝেই ও ‘ডগি’ বলে উঠছে, আর ঘরের এদিক থেকে ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
“তুমি এখানেই খেলো, হ্যাঁ বাপি,” বলে আমি পাশের ঘরে গিয়ে স্ত্রিকে জিনিষপত্র গোছানোয় সাহায্য করতে লাগলাম।
সাধারনত নতুন জায়গায় আমার খুব ভালো ঘুম হয় না। কিন্তু সেদিন রাতে বেশ ভালোই ঘুম হল। সকালে উঠে অফিস বেরিয়ে গেলাম। অফিস মিঃ সুন জিজ্ঞেস করল, “কি ভাই, কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো?”
“না, না। অসুবিধে কিসের। এই বাজারে এরকম একটা ফ্ল্যাট কি চট করে পাওয়া যায়। ধন্যবাদ মিঃ সুন।”
বিকেলে বাড়ি ফিরতেই আমার স্ত্রী বলল, “এই কুকুরের ছবিটা নামাও তো।”
“কেন? আরে তোমায় বললাম না...”
আমাকে মাঝ পথে থামিয়ে দিতে ও বলল, “সারাদিন জোজো ডগি ডগি করে মাথা খারাপ করে দিয়েছে। আমার মনে হয়, ও ছবিটা দেখে ভয় পাচ্ছে।”
আমি হেসে বললাম, “ভয় পেলে কি কেউ আর ডগি ডগি করে। আমার দেখেছো কখনও?”
অফিস থেকে ফিরে আমরা রোজ জোজোকে নিয়ে হাঁটতে যাই। তাই আমার স্ত্রী ওকে ঘুম থেকে ডাকতে গেলে আমি সেই কুকুরের ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। পাঁচ ফুট বাই পাঁচ ফুটের মোটা কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো একটা গ্রে হাউন্ডের ছবি। কুঁচকুঁচে কালো রাং। ছবিটার চোখগুলো যেন জ্বলছে। আমি এমনিতেই কুকুরে ভয় পাই, তাই সেই চোখ দেখে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ভাবলাম, মিঃ সুন তো আর দিন দশেকের মধ্যে আসছে না, ছবিটা বরং খুলেই রাখি। ফ্ল্যাট ছাড়ার সময় আবার টাঙিয়ে দেব। ছবিটার নীচে রাখা সোফাটার উপর দাঁড়িয়ে ছবিটা খোলার চেস্টা করতে লাগলাম। কিন্তু কিছুতেই খুলতে পারলাম না। আমাকে দেখে আমার স্ত্রী বলল, “আটকে গেছে নাকি?”
বললাম, “তাই তো মনে হয়।”
আরও মিনিট পনেরো চেস্টা করার পর আমি ব্যর্থ হয়ে নেমে এলাম। ছবিটা ঝুলতে লাগল তার জায়গায়।
এই ভাবেই আরও দিন পাঁচেক কেটে গেল। নতুন ফ্ল্যাটে বেশ ভালোই আছি। কোন অসুবিধে হচ্ছে না। শুধু এই কুকুরের ছবির সামনে থেকে আমার ছেলের যেন কুকুর প্রীতি বেড়ে গেছে। সবসময়ই ডগি ডগি করে। আগে শুধু কুকুরের ছবিটা দেখলেই বেশি করত, এখন তো যত্রতত্র। গত রাতে তো আমাদের বেডরুমেও বলতে লাগল ‘বাপি, ওই দেখ, ডগি।’
আমি ওকে জিজ্ঞেস করতে ও আলমারির সামনে দেখিয়ে দিল। কিন্তু কোথায় সেটা আর আমি বুঝতে পারলাম না। আমার স্ত্রী বলল, “তুমিও আছ। ও বলল ডগি আর তুমিও চললে ওর সাথে ডগি দেখতে। সাড়ে এগারোটা বাজে। শুয়ে পড়। কাল অফিস আছে তো, নাকি?”
অগত্যা, শুয়ে পড়লাম।
পরের দিন অফিস থেকে ফিরে, হাত মুখ ধুতে বাথরুমে গিয়ে চমকে উঠলাম। ওয়াশিং ম্যেশিনের উপর এক জোড়া পায়ের ছাপ, কুকুর, বেড়াল এই জাতীয় কোন প্রাণীর। তাড়াতাড়ি আমার স্ত্রীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম। ও ভালো করে দেখে বলল, “ঘরের মধ্যে কুকুর, বেড়াল কোথা থেকে আসবে। মনে হচ্ছে এটা জোজোর কীর্তি। দুপুরে ওর ওই কুকুর টেডিটা নিয়ে একবার ঢুকে গেছিল বাথরুমে। পড়ে যায়নি এই ভাগ্য ভাল। সারাদিন যা দুষ্টুমি করে না!”
আমি মনে মনে ভাবলাম, সেটাও ঠিক। অযথা কি সব ভাবছি। ঘরের মধ্যে দিন দুপুরে কুকুর, বেড়াল ঢুকে যাবে আর কেউ টের পাবে না?
আরও দিন তিনেক কেটে গেল। পরের রবিবার সকালে উঠে দেখি আমার স্ত্রী পায়ের বুড়ো আঙুলে বোরোলিন লাগাচ্ছে।
বললাম, “পায়ে আবার কি হল?”
“আর বল না, তোমার ছেলের নখ কাটতে যে কি ভয় জানি নে বাপু। নখ কাটতে গেলেই তারোস্বরে চিৎকার। নখগুলো দেখ, বাঘের মত বড় হয়েছে। আজ চেপে ধরে কাটিয়ে দিতেই হবে।”
আমি কাছে গিয়ে দেখে বললাম, “ওর নখে কেটেছে?”
“আবার কি? রোজ ঘুমের মধ্যে নখ লেগে যায়। আমার লাগে তাও ঠিক আছে, কিন্তু ওর নিজেরও হাতে পায়ে আঁচড় লেগে যায়।”
আমি দেখলাম সত্যিই জোজোর পায়ের কাছে একটা লম্বা আঁচড়ের দাগ। পেটের কাছেও আছে একটা। হেসে বললাম, “বাচ্চা মানুষ, ওর ভয় পেলেই হল। আজ একটু ভুলিয়ে ভালিয়ে কাটিয়ে দিও ক্ষন।”
তারপর জোজোর হাতের দিকে দেখে মনে মনে বললাম, “বাবা, নখ কোথায়? এই টুকু নখেই কেটে যাচ্ছে?”
রবিবার বলে সারাদিন বাড়িতেই ছিলাম। আর লক্ষ্য করলাম যে সারাদিনে জোজো প্রায় হাজারবার এদিক ওদিক আঙুল দেখিয়ে বলে গেল, “ওই দেখ ডগি, ওই দেখ ডগি।”
শুধু তাই নয়, ইদানীং আরও একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছি, জোজো যেন কেমন একটা ভয়ে ভয়ে থাকে। আগে যে ছেলে কোলে উঠতেই চাইতো না, সে একটু পরে পরেই এসে কোলে চড়ে বসছে আর কাধে মাথে রেখে শুয়ে পড়ছে। আমার স্ত্রীকে বললাম, “জোজোর কি শরীরটা ঠিক নেই? কেমন একটু ঝিমিয়ে পড়েছে না?”
“আমিও কদিন সেটা লক্ষ্য করছি, জানো। তোমাকে বলেছিলাম, দশ দিনের জন্যই হোক, নতুন বাড়ি তো? একটু পুজো করে ঢুকলেই হত। মা-ও কতবার বলেছিলেন। তুমি শুনলে তো?”
আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, “বোঝো, ওর শরীর খারাপের সাথে পুজোর কি সম্পর্ক জানি না বাবা। আর তো এক দিনের ব্যাপার, তারপর তো আর এখানে থাকতে হচ্ছে না। কাল সকালেই তো চলে যাব। একটু আগে মিঃ লি লিন ফোন করেছিলেন, বললেন ফ্ল্যাট রেডি।”
ফ্ল্যাট রেডি শুনে আমার স্ত্রী এক গাল হেসে বলল, “যাক বাবা, আজ রাতেই সব গুছিয়ে নিতে হবে। কাল সকালে অফিস যাওয়ার আগে তাহলে আমাদের ড্রপ করে দিও?”
রাতে যা সামান্য জিনিষ আনা হয়েছিল, সেটা আবার সুটকেস বন্দী করা হল। পরের দিন সকালে উঠে দেখি আমার স্ত্রী রেডি হয়ে বসে আছে। জোজোকে ঘুমের মধ্যেই জামা পরিয়ে আমরা নীচে নেমে এলাম। গাড়িতে যখন মালপত্র তুলছি, তখন আমার ফ্ল্যাটের উলটো ফ্ল্যাটে যিনি থাকেন, সেই ভদ্রমহিলার সাথে দেখা। এনার সাথে আগেও কথা হয়েছে আমার, সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামার পথে। গাড়িতে সুটকেস তুলছি দেখে উনি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “কি, বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছেন আজ?”
আমি হেসে বললাম, “হ্যাঁ, আমার ফ্ল্যাটের কাজ শেষ। তাই নিজের বাড়িতেই ফিরে যাচ্ছি।”
গাড়ির মধ্যে উঁকি মেরে আমার স্ত্রী আর ছেলেকে দেখে বললেন, “আবার ফিরছেন তো বাকি জিনিষ নিতে।”
“কি আর জিনিষ, এই তো দুটো সুটকেস। আর কিছু তো আনিনি।”
“সে কি, আপনার কুকুরটাকে তো দেখছি না। ওটাকে কি আগেই রেখে এসেছেন? আপনার বাড়ির মালিক তো কুকুর ছাড়া চলতেনই না। তাই মনে হয় আপনার কুকুর আছে বলেই এতদিন পর ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছিলেন।”
"কুকুর? আমার আবার কুকুর কোথায়?" বেশ অবাক হয়েই বললাম।
ভদ্মহিলা যেন একটু রেগেই বললেন, "কি যে বলেন। রোজই তো দেখি আপনাদের গ্রিল দেওয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। আজ সকালেও মর্নিং ওয়াক করতে বেরনোর সময় দেখলাম।"
আমার স্ত্রী বলল, “কি এত বলছে?”
আমি উপর দিকে আমাদের ফ্ল্যাটের ফাঁকা বারান্দাটার দিকে তাকালাম। মুখে বললাম, “চলে যাচ্ছি তো, তাই বেস্ট উইসেস জানাচ্ছেন।”
আমার সাথে যা ঘটেছিল আমি সেটাই লিখছি, একটুও রঙ চড়ানো হয় নি। গল্পতা আগে যাদের বলেছি, তারা সবাই হেসে উড়িয়ে দিয়েছে। আমিও হেসেছি। কিন্তু তবুও কোথায় যেন একটা খটকা লেগে আছে।
আমি কর্মসূত্রে চীন দেশে থাকি। তাও প্রায় বছর সাতেক হয়ে গেল। কলেজ পাস করেই একটা চীনা কোম্পানিতে চাকরির অফার পেয়ে বিদেশে পাড়ি। তারপর আর স্থায়ী ভাবে দেশে ফেরার তাগিদটা অনুভব করিনি। যদিও আমার ছেলের এখন প্রায় দু বছর বয়স, তাই ওর স্কুলিং-এর জন্য আর বছর দুয়েকের মধ্যেই দেশে ফেরার প্লান করতে হবে। দেখি কত দূর কি করা যায়।
আমি থাকি চীনের দক্ষিণে দাসিচাও বলে একটা ছোট্ট শহরে। ছোট্ট বললাম কারন এটা বেজিং বা ডালিয়ানের তুলনায় খুবই ছোট, কিন্তু ভারতের যে কোন মাঝারি শহরের এর কাছে ফেল খেয়ে যাবে। বিশাল বিশাল চওড়া রাস্তা, কুড়ি তলা, পঁচিশ তলার হাই-রাইজ, রাস্তায় অডি, মার্সিডিজ বেঞ্জ ছাড়া কিছু চোখেই পড়ে না। আর রাস্তার পাশের যে ফুটপাথ, সেটা প্রায় আমাদের কোলকাতার বি টি রোডের সমান। রাস্তার দু ধারে লাইন দিয়ে আলো ঝলমলে দোকান। সেই সব দোকানের বেশির ভাগই নয় রেস্তরা, নয় সেলুন। এখানের লোক জনও বেশ ভালোই, খুব ফ্রেন্ডলি।
যাই হোক, এবার মুল গল্পে আসি। চীনে আসার পর, আমি যে ফ্ল্যাটটা ভাড়া নিয়েছিলাম এখনও সেটাতেই আছি। ভাড়া একটু বেশি হলেও, ফ্ল্যাটটার পোজিশান এত ভালো যে ছাড়তে ইচ্ছে হয়নি। আমার ফ্ল্যাট থেকে বাজার হেঁটে দশ মিনিট লাগে, এখানের সবথেকে ভালো যে সুপার মার্কেট, সিংলোন, সেটাও ওই মিনিট পনেরো। এত সুবিধে আছে বলে ভাড়াটা অত গায় লাগে না। যাই হোক, গত মাসে এক রবিবার সকালে আমার বাড়ির মালিক এসে হাজির, মিঃ লি লিন। ভদ্রলোক খুব মিশুকে, আর অল্প আধটু ইংরেজিও বলতে পারেন। আর হ্যাঁ, যেটা বলা হয়নি। আমি সাত বছর চীনে থেকে চীনা ভাষা একটু রপ্ত করতে পারলেও আমার স্ত্রী চার বছর থেকেও একটুও পারেনি। যাই হোক, তা মিঃ লি লিন এসে যা বললেন সেটা শুনে একটু চিন্তিত হয়ে পড়লাম। উনি ফ্ল্যাটটা রঙ করাতে চান তাই হপ্তা দুয়েকের জন্য আমাদের অন্য কোথাও গিয়ে থাকতে হবে। তারপর কাজ শেষ হলে আবার পুরনো আস্তানায়। কি আর করি, পরের দিন বেরলাম বাড়ি খুঁজতে। আজ কাল চীনে রিয়েল এস্টেটের অবস্থা খুব ভালো নয়। আমাদের দাসিচাওতেই প্রায় আট দশ খানা হাই-রাইজ ইনকমপ্লিট অবস্থায় পড়ে আছে। তাই আজকাল বাড়ি খোঁজা এখানে একটা ঝক্কির ব্যাপার। দিন দুয়েক খুঁজেও যখন কিছু পেলাম না, তখন বেশ চিন্তায় পড়লাম। হোটেলে থাকা যায়, তবে এখানে হটেল বলতে একটাই – লিহুয়া ইন্টারন্যাশানাল। আর তার একদিনের যা ঘর ভাড়া, তাতে আমার একমাসের বাড়ি ভাড়া হয়ে যাবে। একদিন অফিসে আমার এক কলিগ, মিঃ সুন ইয়াং মাও-কে বলতে সে বলল, “আমি একটা ফ্যাটের সন্ধান দিতে পারি। দাসিচাওয়ের উত্তর দিকে। মেন শহর থেকে একটু দূরে হবে ঠিকই তবে তাতে তোমার বিশেষ অসুবিধে হবে না। মাত্র দু সপ্তাহের তো ব্যাপার।”
“না, না। অসুবিধের কি আছে। ধন্যবাদ ভাই। একটু দেখ না।”
“আসলে ফ্যাটটা আমার এক মামার। এখন উনি বেজিং-এ থাকেন, ওনার মেয়ের কাছে। গত দুবছর ধরে খালি পড়ে আছে, আর উনি ভাড়াও দিতে নারাজ। কিন্তু আমি বললে দু সপ্তাহের জন্য উনি দিয়ে দেবেন। আর ভাড়াও নেবেন বলে মনে হয় না। দেখি কথা বলে।”
আমি বললাম, “ভাড়া দিতে তো আপত্তি নেই আমার। কিন্তু বাড়িটা আমার খুবই দরকার। পরশু থেকে রঙের কাজ শুরু হবে। একটু দেখ না, ভাই।”
মিঃ সুন তার মামাকে রাজি করিয়ে নিলেন। ভাড়া দিতে হবে না, শুধু জল আর ইলেকট্রিকের চার্জ দিতে হবে। আর একটা সর্ত আছে।
“কি সর্ত?” মিঃ সুনকে জিজ্ঞেস করলাম।
উনি একটু আমতা আমতা করে বললেন, “তোমাকে আর কি বলব ভাই, আমার মামা কুকুর খুব ভালোবাসেন। এখানে থাকার সময় ওনার প্রায় সাতখানা কুকুর ছিল। ওনার যে সবচেয়ে প্রিয় কুকুরটা ছিল সেটা মারা যাওয়ার পর তার একটা বিশাল ছবি ফ্যাটের সামনের ঘরে উনি টাঙিয়ে রেখেছিলেন। ওনার সর্ত হল, সেটা দেওয়াল থেকে খোলা যাবে না। কি অদ্ভুত আবদার বল দেখি?”
আমি বললাম, “সেটা আবার একটা সর্ত হল? থাকবে ছবি টাঙানো। তাতে আমার কোন অসুবিধে নেই।”
পরের দিনই দুটো সুটকেস নিয়ে চলে গেলাম নতুন ফ্যাটে। মেন শহর থেকে একটু দূরে বলেই হয়তো সোসাইটিটা একটু নোংরা। বাড়ির তিনতলায় আমাদের নতুন ফ্যাট। ঘরে ঢুকে দেখি বেশ সাজানো গোছান। মিঃ সুন লোক দিয়ে আগেরদিন ঘরটা পরিষ্কার করিয়ে রেখেছিলান। কিন্তু ঘরে ঢোকা মাত্রই গোল বাঁধল। কুকুরের ছবিটার কথা আমার স্ত্রিকে আগে বলিনি। আর সেটা দেখেই সে বলল, “এটা এখুনি নামানোর ব্যবস্থা কর।”
আমার দু বছরের ছেলে জোজো আবার ছবিটা দেখেই “ডগি, ডগি” বলে লাফাতে শুরু করে দিল। আমার বাড়িতে কোনদিন কুকুর ছিল না। বলতে গেলে কুকুর জিনিষটাকে আমি একটু ভয়ই পাই। ছেলেবেলায় একবার কুকুরের তাড়া খেয়েছিলাম, সঙ্গে কামড়ও। তারপর থেকেই কুকুর আমার খুব অপছন্দের।
সর্তের কথাটা আমার স্ত্রিকে বলতে ও বলল, “এ আবার কিরকম সর্ত, রে বাবা? মরা কুকুরের ছবি টাঙিয়ে রাখতে হবে।”
এই বলে গজগজ করতে করতে ভীতরে চলে গেল। একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করলাম, যে ঘরগুলোর মধ্যে কেমন যেন একটা গন্ধ। খুব তীক্ষ্ণ নয়, তবে নাকে আসে। এইরকম গন্ধ অনেকটা আলিপুর চিড়িয়াখানায় পাওয়া যায়, বাঘ কিম্বা নেকড়ের খাঁচার পাশে, তবে সেখানে গন্ধটা অনেক প্রখর।
এই নতুন ফ্যাটের বসার ঘরটা অনেক বড়, তাই আমার ছেলে খুব আনন্দের সাথে লাফালাফি শুরু করে দিল। আরও একটা জিনিষ লক্ষ্য করলাম যে ঘরগুলোর দেওয়ালে সাদা রঙের উপর কুকুরের ময়লা পায়ের ছাপ। মিঃ সুন আমাকে আগেই বলেছিলেন যে বাড়ি পুরনো আর বছর দুই কেউ থাকেনি, তাই দেওয়ালেও রঙ চটে গেছে। আর বাড়িতে কুকুর বেড়াল থাকলে দেওয়ালে তাদের পায়ের ছাপ যে থাকবে সেটা আর নতুন কি?
আমার স্ত্রী জিজ্ঞেস করতে বললাম, “সুন তো বলেই ছিল, যে দেওয়াল টেওয়াল নোংরা হয়ে আছে। আর আমরা তো থাকবো দিন দশেক। একটু এডজাস্ট করে নাও।”
আমি কুকুরে যতটা ভয় পাই, আমার ছেলে জোজো যেন ততটাই কুকুর ভালোবাসে। রাস্তা ঘাটে কুকুর দেখলেই ‘ডগি, ডগি’ করে চেঁচাতে থাকে। আর ওর প্রিয় সফট টয়টাও একটা কুকুর। তাই মাঝে মাঝেই ও ‘ডগি’ বলে উঠছে, আর ঘরের এদিক থেকে ওদিক দৌড়ে বেড়াচ্ছে।
“তুমি এখানেই খেলো, হ্যাঁ বাপি,” বলে আমি পাশের ঘরে গিয়ে স্ত্রিকে জিনিষপত্র গোছানোয় সাহায্য করতে লাগলাম।
সাধারনত নতুন জায়গায় আমার খুব ভালো ঘুম হয় না। কিন্তু সেদিন রাতে বেশ ভালোই ঘুম হল। সকালে উঠে অফিস বেরিয়ে গেলাম। অফিস মিঃ সুন জিজ্ঞেস করল, “কি ভাই, কোন অসুবিধে হচ্ছে না তো?”
“না, না। অসুবিধে কিসের। এই বাজারে এরকম একটা ফ্ল্যাট কি চট করে পাওয়া যায়। ধন্যবাদ মিঃ সুন।”
বিকেলে বাড়ি ফিরতেই আমার স্ত্রী বলল, “এই কুকুরের ছবিটা নামাও তো।”
“কেন? আরে তোমায় বললাম না...”
আমাকে মাঝ পথে থামিয়ে দিতে ও বলল, “সারাদিন জোজো ডগি ডগি করে মাথা খারাপ করে দিয়েছে। আমার মনে হয়, ও ছবিটা দেখে ভয় পাচ্ছে।”
আমি হেসে বললাম, “ভয় পেলে কি কেউ আর ডগি ডগি করে। আমার দেখেছো কখনও?”
অফিস থেকে ফিরে আমরা রোজ জোজোকে নিয়ে হাঁটতে যাই। তাই আমার স্ত্রী ওকে ঘুম থেকে ডাকতে গেলে আমি সেই কুকুরের ছবিটার সামনে এসে দাঁড়ালাম। পাঁচ ফুট বাই পাঁচ ফুটের মোটা কাঠের ফ্রেমে বাঁধানো একটা গ্রে হাউন্ডের ছবি। কুঁচকুঁচে কালো রাং। ছবিটার চোখগুলো যেন জ্বলছে। আমি এমনিতেই কুকুরে ভয় পাই, তাই সেই চোখ দেখে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ভাবলাম, মিঃ সুন তো আর দিন দশেকের মধ্যে আসছে না, ছবিটা বরং খুলেই রাখি। ফ্ল্যাট ছাড়ার সময় আবার টাঙিয়ে দেব। ছবিটার নীচে রাখা সোফাটার উপর দাঁড়িয়ে ছবিটা খোলার চেস্টা করতে লাগলাম। কিন্তু কিছুতেই খুলতে পারলাম না। আমাকে দেখে আমার স্ত্রী বলল, “আটকে গেছে নাকি?”
বললাম, “তাই তো মনে হয়।”
আরও মিনিট পনেরো চেস্টা করার পর আমি ব্যর্থ হয়ে নেমে এলাম। ছবিটা ঝুলতে লাগল তার জায়গায়।
এই ভাবেই আরও দিন পাঁচেক কেটে গেল। নতুন ফ্ল্যাটে বেশ ভালোই আছি। কোন অসুবিধে হচ্ছে না। শুধু এই কুকুরের ছবির সামনে থেকে আমার ছেলের যেন কুকুর প্রীতি বেড়ে গেছে। সবসময়ই ডগি ডগি করে। আগে শুধু কুকুরের ছবিটা দেখলেই বেশি করত, এখন তো যত্রতত্র। গত রাতে তো আমাদের বেডরুমেও বলতে লাগল ‘বাপি, ওই দেখ, ডগি।’
আমি ওকে জিজ্ঞেস করতে ও আলমারির সামনে দেখিয়ে দিল। কিন্তু কোথায় সেটা আর আমি বুঝতে পারলাম না। আমার স্ত্রী বলল, “তুমিও আছ। ও বলল ডগি আর তুমিও চললে ওর সাথে ডগি দেখতে। সাড়ে এগারোটা বাজে। শুয়ে পড়। কাল অফিস আছে তো, নাকি?”
অগত্যা, শুয়ে পড়লাম।
পরের দিন অফিস থেকে ফিরে, হাত মুখ ধুতে বাথরুমে গিয়ে চমকে উঠলাম। ওয়াশিং ম্যেশিনের উপর এক জোড়া পায়ের ছাপ, কুকুর, বেড়াল এই জাতীয় কোন প্রাণীর। তাড়াতাড়ি আমার স্ত্রীকে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম। ও ভালো করে দেখে বলল, “ঘরের মধ্যে কুকুর, বেড়াল কোথা থেকে আসবে। মনে হচ্ছে এটা জোজোর কীর্তি। দুপুরে ওর ওই কুকুর টেডিটা নিয়ে একবার ঢুকে গেছিল বাথরুমে। পড়ে যায়নি এই ভাগ্য ভাল। সারাদিন যা দুষ্টুমি করে না!”
আমি মনে মনে ভাবলাম, সেটাও ঠিক। অযথা কি সব ভাবছি। ঘরের মধ্যে দিন দুপুরে কুকুর, বেড়াল ঢুকে যাবে আর কেউ টের পাবে না?
আরও দিন তিনেক কেটে গেল। পরের রবিবার সকালে উঠে দেখি আমার স্ত্রী পায়ের বুড়ো আঙুলে বোরোলিন লাগাচ্ছে।
বললাম, “পায়ে আবার কি হল?”
“আর বল না, তোমার ছেলের নখ কাটতে যে কি ভয় জানি নে বাপু। নখ কাটতে গেলেই তারোস্বরে চিৎকার। নখগুলো দেখ, বাঘের মত বড় হয়েছে। আজ চেপে ধরে কাটিয়ে দিতেই হবে।”
আমি কাছে গিয়ে দেখে বললাম, “ওর নখে কেটেছে?”
“আবার কি? রোজ ঘুমের মধ্যে নখ লেগে যায়। আমার লাগে তাও ঠিক আছে, কিন্তু ওর নিজেরও হাতে পায়ে আঁচড় লেগে যায়।”
আমি দেখলাম সত্যিই জোজোর পায়ের কাছে একটা লম্বা আঁচড়ের দাগ। পেটের কাছেও আছে একটা। হেসে বললাম, “বাচ্চা মানুষ, ওর ভয় পেলেই হল। আজ একটু ভুলিয়ে ভালিয়ে কাটিয়ে দিও ক্ষন।”
তারপর জোজোর হাতের দিকে দেখে মনে মনে বললাম, “বাবা, নখ কোথায়? এই টুকু নখেই কেটে যাচ্ছে?”
রবিবার বলে সারাদিন বাড়িতেই ছিলাম। আর লক্ষ্য করলাম যে সারাদিনে জোজো প্রায় হাজারবার এদিক ওদিক আঙুল দেখিয়ে বলে গেল, “ওই দেখ ডগি, ওই দেখ ডগি।”
শুধু তাই নয়, ইদানীং আরও একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছি, জোজো যেন কেমন একটা ভয়ে ভয়ে থাকে। আগে যে ছেলে কোলে উঠতেই চাইতো না, সে একটু পরে পরেই এসে কোলে চড়ে বসছে আর কাধে মাথে রেখে শুয়ে পড়ছে। আমার স্ত্রীকে বললাম, “জোজোর কি শরীরটা ঠিক নেই? কেমন একটু ঝিমিয়ে পড়েছে না?”
“আমিও কদিন সেটা লক্ষ্য করছি, জানো। তোমাকে বলেছিলাম, দশ দিনের জন্যই হোক, নতুন বাড়ি তো? একটু পুজো করে ঢুকলেই হত। মা-ও কতবার বলেছিলেন। তুমি শুনলে তো?”
আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, “বোঝো, ওর শরীর খারাপের সাথে পুজোর কি সম্পর্ক জানি না বাবা। আর তো এক দিনের ব্যাপার, তারপর তো আর এখানে থাকতে হচ্ছে না। কাল সকালেই তো চলে যাব। একটু আগে মিঃ লি লিন ফোন করেছিলেন, বললেন ফ্ল্যাট রেডি।”
ফ্ল্যাট রেডি শুনে আমার স্ত্রী এক গাল হেসে বলল, “যাক বাবা, আজ রাতেই সব গুছিয়ে নিতে হবে। কাল সকালে অফিস যাওয়ার আগে তাহলে আমাদের ড্রপ করে দিও?”
রাতে যা সামান্য জিনিষ আনা হয়েছিল, সেটা আবার সুটকেস বন্দী করা হল। পরের দিন সকালে উঠে দেখি আমার স্ত্রী রেডি হয়ে বসে আছে। জোজোকে ঘুমের মধ্যেই জামা পরিয়ে আমরা নীচে নেমে এলাম। গাড়িতে যখন মালপত্র তুলছি, তখন আমার ফ্ল্যাটের উলটো ফ্ল্যাটে যিনি থাকেন, সেই ভদ্রমহিলার সাথে দেখা। এনার সাথে আগেও কথা হয়েছে আমার, সিঁড়ি দিয়ে ওঠা নামার পথে। গাড়িতে সুটকেস তুলছি দেখে উনি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, “কি, বাড়ি ছেড়ে দিচ্ছেন আজ?”
আমি হেসে বললাম, “হ্যাঁ, আমার ফ্ল্যাটের কাজ শেষ। তাই নিজের বাড়িতেই ফিরে যাচ্ছি।”
গাড়ির মধ্যে উঁকি মেরে আমার স্ত্রী আর ছেলেকে দেখে বললেন, “আবার ফিরছেন তো বাকি জিনিষ নিতে।”
“কি আর জিনিষ, এই তো দুটো সুটকেস। আর কিছু তো আনিনি।”
“সে কি, আপনার কুকুরটাকে তো দেখছি না। ওটাকে কি আগেই রেখে এসেছেন? আপনার বাড়ির মালিক তো কুকুর ছাড়া চলতেনই না। তাই মনে হয় আপনার কুকুর আছে বলেই এতদিন পর ফ্ল্যাট ভাড়া দিয়েছিলেন।”
"কুকুর? আমার আবার কুকুর কোথায়?" বেশ অবাক হয়েই বললাম।
ভদ্মহিলা যেন একটু রেগেই বললেন, "কি যে বলেন। রোজই তো দেখি আপনাদের গ্রিল দেওয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকে। আজ সকালেও মর্নিং ওয়াক করতে বেরনোর সময় দেখলাম।"
আমার স্ত্রী বলল, “কি এত বলছে?”
আমি উপর দিকে আমাদের ফ্ল্যাটের ফাঁকা বারান্দাটার দিকে তাকালাম। মুখে বললাম, “চলে যাচ্ছি তো, তাই বেস্ট উইসেস জানাচ্ছেন।”
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মহঃ ইসরাফিল সেখ ৩১/০৫/২০১৭Dada apnar golpo r pawa ja6ena kno
-
রোজারিও ৩০/০৯/২০১৬আপনার ছেলের নাম 'জোজো' কেন??
-
মহঃ এসরাফিল সেখ ১১/০৮/২০১৬অসাধারন দাদা।
-
সাইদুর রহমান ০৭/০৫/২০১৬অসাধারণ।
-
ফয়জুল মহী ১৭/০৪/২০১৬একাগ্র লেখা
-
জয় শর্মা ০৪/০৪/২০১৬বেশ লাগল, ধরে রাখুন... শুভকামনা।
-
সুকান্ত ০২/০৪/২০১৬দারুন হয়েছে, বেশ জমজমাট গল্পো
-
নীল-অভিজিৎ ২০/০৩/২০১৬হা হা হা... ডগি ভুত! বেশ ডগির কথা শুনালেন, কিন্তু... প্রশ্ন থাকল আদৌ সত্যি ঘটনা নাকি?
-
শান্তনু ব্যানার্জ্জী ১৯/০৩/২০১৬সুন্দর লেখা, খুব ভালো লাগল অভিষেক।
-
প্রদীপ চৌধুরী. ১৭/০৩/২০১৬খুব ভাল লাগলো.
-
শুভাশিষ আচার্য ১৭/০৩/২০১৬বেশ লাগল অভিষেক এই গল্প্টা। বিশ্বাসের প্রশ্ন পরে, পড়ার সময় একটা বেশ কী হয় কী হয় ব্যাপার। আর তোমার ঝরঝরে ভাষা নিয়ে তো কথাই হবে না।
-
মলয় ঘটক ১৬/০৩/২০১৬পড়লাম, বিচার-বিশ্লেষণ করতে যাবো না। ভালো লেগেছে এতটুকই দাদা।
শুভ কামনা। -
দেবব্রত সান্যাল ১৬/০৩/২০১৬রহস্য মানেই সেই তথাকথিত মৃত্যু - রক্ত - আক্রমন হতে হবে , তেমন কোনো মানে নেই। গল্প বলার কায়দায় ভালো হয়ে ওঠে। রহস্যও কিছুটা না বোঝা , কিছুটা গা ছমছমে ভাব এমন হলে উপভোগ করা যায়। তাই আমার পছন্দের গল্পে থাকলো।
টাইপো গুলো দেখে নিলেই হয়। -
আজিজ আহমেদ ১৬/০৩/২০১৬লেখা টা ভাল হয়েছে। ডিটেলিং ভাল।
শেষের রিমার্ক টা বুঝলাম না।
তোমার তো কুকুর ছিল না।
টুইস্ট টা বোঝাও।