www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ভুবনবাবুর ভবিষ্যৎ

আজ অফিসে পৌঁছতে একটু দেরীই হয়ে গেছে ভুবনবাবুর মানে ভুবন কুমার সোমের। উনি বাগুইহাটির ওখানে একটা প্রাইভেট কোম্পানির ডেস্ক ক্লার্ক। আসলে সায়েন্স সিটির সামনে যে ফ্লাইওভারটা নতুন করেছে তার জন্য সুবিধার থেকে বেশি অসুবিধাই হয়, এমনটাই মনে করেন ভুবনবাবু। আজও সেই কারনেই দেরী। বাসে করে পার্ক সার্কাস ব্রিজের কাছে এসেই বুঝেছিলেন যে আজ আবার দেরী হবে। মিনিট সাতেক বসে থাকার পর জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে যা দেখলেন সেটাকে অনায়াসে গাড়ির সমুদ্র বলা যেতে পারে। তার উপর বাসে সামনেই একটা বিশালাকায় লরি দাঁড়িয়ে ক্রমাগত কালো ধোঁয়া ছেড়ে যাচ্ছে, আর তার ফল স্বরূপ কাশতে কাশতে বেশ কাহিল হয়েই পড়েছিলেন উনি। যাই হোক, অফিসে পৌঁছে দেখেন প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট লেট। তাড়াতাড়ি নিজের ডেস্কে গিয়ে সামনে রাখা একটা ফাইল খুলে বসলেন। সাধারনত অফিসে গিয়ে আগে এক কাপ কফি খান ভুবনবাবু, কিন্তু গত পরশু এই কারনে বড়বাবুর কাছে বেশ কথা শুনতে হয়েছিল, তাই আজ কফি বাদ। আসলে পরশু দিনও এই জ্যামের জন্য অফিস আসতে প্রায় আধ ঘণ্টা লেট হয়েছিল ওনার। কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে সবে কফিতে একটা চুমুক দিয়েছেন এমন সময় পিছন থেকে বড়বাবুর গলা, “মিঃ সোম, একে তো আধ ঘণ্টা দেরিতে এলেন, তার উপর এসেই যদি আরও আধ ঘণ্টা ধরে কফি খান তাহলে কাজ কে করবে?”
ভুবনবাবু মিনমিন করে বলেছিলেন, “না, মানে স্যার, এই সায়েন্স সি...”
ওনাকে মাঝ পথেই থামিয়ে বড়বাবু বলেছিলেন, “থাক, আর অজুহাত দিয়ে কাজ নেই। যান, এই বিশাল টেক্সটাইলের ফাইলটা কিন্তু আমার আজই চাই।”
আজও তিনি ভয় ভয় ছিলেন যে এই বুঝি বড়বাবু এসে ধমক দিলেন, কিন্তু পরে সুখেন বিশ্বাসের কাছে জানতে পারেন যে বড়বাবু আজ অফিসেই আসেননি।
সারা অফিসে ভুবনবাবুর বন্ধু বলতে এই সুখেন বিশ্বাস। একটু চাপা স্বভাবের হওয়ায় ভুবনবাবু মানুষের সাথে ঠিক মিশতে পারেন না। কিন্তু পাশের টেবিলে বসা সুখেনবাবুর সাথে ওনার বেশ আলাপ। সুখেন বিশ্বাস বয়সে ওনার থেকে প্রায় বিশ বছরের বড়, আগামি বছর রিটায়ার করবেন। একটা ব্যাপার আছে এই বিশেষ বন্ধুত্বের জন্য, সেটা হল পরলোক সম্পর্কে সুখেনবাবুর অবাধ জ্ঞান। এই পরলোকের বিষয়টা খুব ইন্টারেস্টিং লাগে ভুবনবাবুর। এই তো সেদিন টিফিন টাইমে উনি সুখেনবাবুকে বললেন, “আচ্ছা, সুখেনদা, মৃত্যুর পর আত্মার কি হয়?”
সুখেনবাবু ওনার টিফিন কৌটো থেকে একটা লুচির একটু খানি ছিঁড়ে আলুর দমের সাথে সেটা মুখে পুরে দিয়ে বললেন, “ঠিক কি হয় তা তো বলতে পারব না। তবে হ্যাঁ, বিজ্ঞানও কিন্তু এই আত্মার প্রেসেন্স মেনে নিয়েছে। বিজ্ঞানের ভাষায় আত্মা হল এক্টোপ্লাসম। বাংলায় যাকে আত্মা বা জীবণশক্তি বলি। বলছে, মানুষের মৃত্যুর পর এই এক্টোপ্লাসম নাকি শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। এই এক্টোপ্লাসমের এত শক্তি যে বেরানোর সময় সেটা নাকি সাড়ে চার ফুট মোটা কাঁচেও ভেঙে দিতে পারে।”
ভুবনবাবু চুপ করে শোনেন। একবার তো সুখেনবাবুর কাছ থেকে স্বামী অভেদানন্দের লেখা ‘মরনের পরে’ বইটাও নিয়ে গিয়েছিলেন পড়ার জন্য। কিন্তু সংস্কৃতে কাঁচা হওয়ার ফলে বিশেষ বুঝতে পারেননি।
আজও টিফিন টাইমে দুজনে একসাথে বসে লাঞ্চ করছেন। সুখেনবাবুকে একটু চুপচাপ দেখে ভুবনবাবু জিজ্ঞেস করলেন, “কি সুখেনদা, আজ একটু চুপচাপ আছেন দেখছি?”
সুখেনবাবু একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “আর বল কেন ভাই, আমার এক ভাইপো গত রাতে মোটর বাইক এক্সিডেন্টে মারা গেছে।”
ভুবনবাবু বললেন, “আহা।” তারপর একটু থেমে আবার বললেন, “নিয়তির লেখা, খন্ডাবে কে?”
সুখেনবাবু যেন একটু উত্তেজিত হয়ে বললেন, “খণ্ডানো যেত, যদি ও দেবুদার কথা শুনত।”
ভুবনবাবু ভাবলেন ‘দেবুদা’ হয়তো যে মারা গেছে তার বাবা, তাই বললেন , “আজ কালকার ছেলেরা কি আর বাড়ির লোকের সব কথা শোনে।”
“না, না। বাড়ির লোক হবে কেন? দেবুদা মানে জ্যোতিষী দেব প্রসাদ গাঙ্গুলি।”
পরলোকে বিশেষ ইন্টারেস্ট থাকলেও এই জ্যোতিষী টতিসির ব্যাপারে ভুবনবাবুর খুব একটা বিশ্বাস নেই। তারও একটা বিশেষ কারন আছেন। ছেলেবেলায় একবার ওনার জন্ডিস হয়েছিল। গ্রামের ডাক্তার ধরতে পারেনি। শেষমেশ ওনার ঠাকুরদা ওনাকে এক জ্যোতিষী কাম ওঝার কাছে নিয়ে গেছিলেন। সেই ওঝা দেখে বলল যে ওনার পেটে নাকি শিকড় গজিয়েছে, আর সেটা বের করতে পারলেই উনি সুস্থ হয়ে উঠবেন। পেটের উপর একতাল ময়দা রেখে সে শিকড় তো বের হল কিন্তু তাতে কি আর জন্ডিস সারে। বরং আস্তে আস্তে আরও বেড়ে গেল। তারপর শহরের হাসপাতালে প্রায় একমাস ভর্তি ছিলেন ভুবনবাবু। সেই ঘটনার পর থেকে জ্যোতিষীদের উপর ওনার বিশেষ শ্রদ্ধা নেই।
এই কথাটা সুখেনবাবুকে বলতে উনি বললেন, “আরে দেবুদা সেরকম জ্যোতিষী নয় গো, ভুবন। দেশ বিদেশ থেকে লোক আসে ওনার কাছে আর উনি যা বলেন তা কোনদিন মিথ্যে হয় না। আমার ছেলের বিয়ের তারিখও প্রায় দশ বছর আগে বলে দিয়েছিলেন।” তারপর একটু থেমে নিচু গলায় বললেন, “আর আমার ভাইপোর ব্যাপারটাও।”
অন্য সব জায়গায় মুখচোরা হলেও সুখেন বিশ্বাসের কাছে ভুবনবাবু মন খুলে কথা বলতে পারেন। তিনি বললেন, “সে আপনি যাই বলেন সুখেনদা। এই সব বুজরুকিতে আমি বিশ্বাস করি না। আগামি কাল আমার কি হবে সেটা কেউ হাত গুনে বলে দেবে সেটা সম্ভব নয়। আমার ভবিষ্যৎ আমার হাতে।”
“নিশ্চই, কিন্তু পৃথিবীতে এইরকম অনেক মানুষ আছে যাদের ব্যাখ্যা বিজ্ঞান দিতে পারে না। তোমার যদি দেবুদার কথা বিশ্বাস না হয় তাহলে চল আমার সাথে নিজের চোখে দেখে আসবে।”
যাওয়ার একটুও ইচ্ছে নেই ভুবনবাবুর, কিন্তু সুখেনদার এই জ্যোতিষী-বিশ্বাস ভাঙার প্রয়োজনে উনি যেতে রাজি হয়ে গেলেন। বললেন, “ঠিক আছে সুখেনদা। আমি যাব। কিন্তু সেই জ্যোতিষীর কথা যদি মিথ্যে প্রমান হয় তাহলে?”
“তাহলে আমিও যাওয়া ছেড়ে দেব। ঠিক আছে।”
ঠিক হল আগামি শনিবার সকাল নটায় সুখেনবাবুর গাড়িতেই যাওয়া হবে দেব প্রসাদ গাঙ্গুলির বাড়ি। সুখেনবাবু এও বললেন যে উনি আগে থেকে সময় নিয়ে রাখবেন ওনার ‘দেবুদা’র কাছে।
ভুবনবাবুর বেহালার বাড়ি থেকে বজবজ ট্রাঙ্ক রোড ধরে বাটানগর পৌঁছতে লাগলো পাক্কা এক ঘণ্টা। এতটা সময় লাগার কথা নয়, কিন্তু এদিকের রাস্তার যা অবস্থা তাতে এক ঘণ্টার বেশি লাগেনি, এই ঢের। একটা সিনেমা হলের পাশ দিয়ে গাড়ি ঢুকে গেল। তারপর আরও বার দুয়েক ডাইনে আর বার তিনেক বাঁয়ে ঘুরে যে বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল, সেখানে অন্ধকার হয়ে গেলে ভুবনবাবু কোনদিনই আসতেন না। বিশাল একটা মাঠের মধ্যে দোতলা বাড়ি। ভবনবাবু আন্দাজ করলেন যে বাড়িটার বয়স কম করে একশো বছর হবে। বাইরের দেওয়ালের রঙ চোটে ভিতরের প্লাস্টার বেরিয়ে গেছে। জলের পাইপ বেঁয়ে গজিয়ে উঠেছে বেশ কিছু বটগাছের চারা। জানলার কার্নিশ ভেঙে পড়েছে, আর তার পাল্লাগুলোরও একই অবস্থা।
কোনরকমে আগাছার জঙ্গল পেরিয়ে দরজা অবধি পৌঁছে সুখেনবাবু বললেন, “এই ভুবন, একটা কথা বলে রাখি আগে থেকে। ওনার চেহারাটা একটু ইয়ে আর কি, তাই ওনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলে উনি একটু ফিল করেন। তাই...”
দরজায় টোকা দিতেই একজন ভৃত্য স্থানীয় লোক এসে দরজা খুলে আমাদের ভীতরে নিয়ে গেল। বাইরেটা যেমন, ভিতরের অবস্থা আরও খারাপ। সারা দেওয়াল জুড়ে ক্র্যাক আর তার মধ্যে মধ্যে বটের চারা। কোনদিন যে এই ঘরগুলো রঙ করা ছিল তা আজ দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না। ঘরগুলো সাইজে মাঝারি কিন্তু কোন আসবাব না থাকার ফলে যেন অনেক বড় মনে হচ্ছে। ভৃত্যটি ওনাদের একটা বেশ ছোট ঘরে এনে বসালেন। এই ঘরটাতে আসবাব আছে চার খানা, একটা গোল টেবিল আর তিনটে চেয়ার, ব্যাস। টেবিলের উপরেও বিশেষ কিছু নেই এক প্যাকেট তাস ছাড়া, যদিও এগুলো সাধারন তাসের থেকে সাইজে একটু বড়। ভুবনবাবু আর সুখেনবাবু দুটো চেয়ারে বসলেন। টেবিলের উল্টো দিকে আরও একটা খালি চেয়ার, যেটা অন্য দুটোর থেকে একটু বড় সাইজের। সুখেনবাবু বললেন যে ওটা দেবুদার চেয়ার। মিনিট পাঁচেক সেই আধো অন্ধকার ঘরে অপেক্ষা করার পর ওনাদের পিছনের দরজা দিয়ে একজন লম্বা, শীর্ণকায় লোক প্রবেশ করল। ভদ্রলোকের গায়ের রঙ বেশ ফর্সা কিন্তু চোখের কোনায় কালী। বয়স আন্দাজ ষাটের কাছাকাছি। চোখে মোটা কালো ফ্রেমের হাই পাওয়ারের চশমা। আরও একটা জিনিষ লক্ষ্য করলেন ভুবনবাবু। ভদ্রলোকের মুখের ডান পাশটা নেই। নেই মানে ডান চোখের নীচ থেকে গলা অবধি কিছু নেই। শুধু যেন চামড়া ঝুলছে। পরে সুখেনবাবুর কাছে জেনেছিলেন যে ক্যান্সারের জন্য মুখের একদিকটা অপরেশন করে বাদ দেওয়া হয়েছিল দেব প্রসাদ গাঙ্গুলির।
ওনার জন্য বরাদ্দ চেয়ারটায় ধপ করে বসে দেব প্রসাদবাবু বললেন, “এর কথাই বলছিলে, সুখেন?”
এইবার ভদ্রলোকের গলাটা শুনলেন ভুবনবাবু, কর্কশ। আর মুখের একদিকটা না থাকার ফলে কথাগুলো একটু জড়ানো।
সুখেনবাবু উঠে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে ওনাকে প্রনাম করে বললেন, “হ্যাঁ, দেবুদা। এ আমার বন্ধু, ভুবন সোম।”
“ভবিষ্যৎ জানতে চাও?” একই রকম কর্কশ গলায় বললেন দেব প্রসাদবাবু।
“হ্যাঁ, আসলে আমার খুব একটা বিশ্বাস নেই এই সব ব্যাপারে। তবুও সুখেনদা...”
ওনার কথা শেষ করতে না দিয়েই দেব প্রসাদবাবু বলে উঠলেন, “বিশ্বাস খুব মজার জিনিষ ভুবনবাবু। আর ততটাই মজার জিনিষ হল সেই বিশ্বাসের ভাঙা।” এই বলে সেই তাসের প্যাকেট থেকে তাসগুলো টেবিলের উপর ছড়িয়ে দিয়ে বললেন, “চার খানা তাস আমায় দাও দেখি আমায়?”
ভুবনবাবু কি আর করবেন, অনিচ্ছা সত্তেও চারখানা তাস বের করে দেব প্রসাদবাবুর হাতে দিলেন।
তাসগুলো হাতে নিয়েই আবার টেবিলের তাসের সাথে মিশিয়ে দিয়ে বেশ কঠিন গলায় দেব প্রসাদবাবু বললেন, “এই ভাবে হয় না। মন থেকে, বেছে বেছে তাস দাও। তবেই তো জানতে পারবে,” তারপর একটু থেমে গলাটা ভীষণ নামিয়ে বললেন, “ভবিষ্যৎ।”
ভুবনবাবু খুব শান্ত গলায় বললেন, “আপনি বলছেন যে এই তাস তোলার উপর আমার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। আমি যেটা তুলব আমার ভবিষ্যৎ সেরকম হবে?”
“হবে, হবে,” বললেন দেব প্রসাদবাবু। তারপর একটা অট্টহাসি।
এইবার ভুবনবাবুর একটু ভয় ভয় লাগতে শুরু করেছে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে উনি খুব সন্তর্পণে বেছে বেছে চারটে তাস তুলে দেব প্রসাদবাবুর হাতে দিলেন। দেব প্রসাদবাবু তাসগুলো টেবিলের উপর রেখে প্রথম তাসটা উলটলেন। তাতে একটা ছুরি আঁকা। দেব প্রসাদবাবু ভ্রু কুঁচকে বললেন, “আজ থেকে ঠিক একমাস পর মানে ১৮ই ফেব্রুয়ারি, আপনি খুন দেখবেন,” তারপর ডান হাতের তিনটে আঙুল তুলে আবার বললেন, “তিনটে।”
সুখেনবাবু বললেন, “খুন?”
কোন উত্তর দিলেন না দেব প্রসাদবাবু। উনি দ্বিতীয় তাসটা উল্টে দিলেন। সেখানে একটা লাল হৃদয়ের ছবি আঁকা। এবার ওনার মুখে একটা প্রশস্ত হাঁসি ফুটল। উনি বললেন, “তার একমাস পর মানে ১৮ই মার্চ, আপনি প্রথম ভালবাসা পাবেন।”
এইবার ভুবনবাবুর একটু হাসিই পেল। এখনও উনি বিবাহ করেননি ঠিকই কিন্তু এই চল্লিশ বছর বয়সে যদি তার প্রথম ভালবাসার আগমন হয় তাহলেই হয়েছে। ভালো একজনকে মনে মনে বাসেন ঠিকই, ওনাদের অফিসের রিসেপ্টানিস্ট, মিস গোমসকে, কিন্তু উনার জীবনে তার আগমন হওয়ার চান্স খুবই কম।
ভুবনবাবুর ঠোঁটের কোনায় যে একটা হালকা হাসির রেষ দেখা দিয়েছে সেটা অগ্রজ্য করে দেব প্রসাদবাবু উল্টে দিলেন তৃতীয় তাসটা। এটাতে একটা স্ফুলিঙ্গের ছবি। ওনার ভ্রু আবার কুঁচকে গেল। মুখে বললেন, “আগ্নিদগ্ধ।”
সুখেনবাবু এবার প্রায় চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠে বললেন, “মানে? ফায়ার?”
“হু, ১৮ই এপ্রিল।”
ভুবনবাবুর আর বসার কোন ইচ্ছে ছিল না। অনেক সহ্য করেছেন এই বুজরুকের বুজরুকি। একবার খুন, একবার আগুন, যত্তসব।
খুব ধীর হস্তে দেব প্রসাদাবাবু ফাঁসি কাঠের ছবিওয়ালা চতুর্থ তাসটা উল্টে দিলেন। তারপর কোন কথা বললেন না। এক দৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন ভুবনবাবুর দিকে। তারপর খুব আস্তে আস্তে বললেন, “১৮ই মে। আপনার মৃত্যু হবে। সময় হল সকাল চারটে এক।”
ভুবনবাবু এতক্ষণ কিছু বলেননি। তবে এইবার বললেন, আর বেশ রেগেই বললেন, “কি যাতা বলছেন মশায়। আমি সুস্থ সবল মানুষ, আর চার মাস পরে মরে যাব। আর সেটা আপনি একটা তাস দেখে বলে দেবেন। আপনি সুখেনদাকে বোকা বানাতে পারেন আপনার গল্প দিয়ে, কিন্তু আমি সে বান্দা নই।” তারপর সুখেনবাবুর দিকে ফিরে বললেন, “আমি যাচ্ছি সুখেনদা, আপনি কি আসবেন না এই বুজরুকের গল্পকথা শুনবেন?”
রাস্তায় আর কোন কথা হয়নি। সুখেনবাবু একবার বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন ভুবনবাবুকে কিন্তু উনি কোন উত্তর দেননি।
এই ঘটনার প্রায় একমাস কেটে গেছে। সকালে অফিসে এসে ভুবনবাবু টেবিল ক্যালেন্ডারটার তারিখ পাল্টাতে গিয়ে দেখলেন আজ ১৮ই ফেব্রুয়ারি। মনে পড়ে গেল দেব প্রসাদবাবুর কথা। আজ উনি নাকি তিনটে খুন দেখবেন। মনে মনে হাসলেন ভুবনবাবু। অফিসে থেকে বাড়ি ফেরার পথেও যখন কোন খুন দেখলেন না, তখন মনে মনে আরও একবার হাসলেন উনি। ভাবলেন, “কাল গিয়ে সুখেনদাকে বলব যে আপনার দেবুদার ভবিষ্যতবাণী ফসকে গেল।”
রাতে খেয়ে দেয়ে খাটে শুয়ে যখন কিছুতেই ঘুম আসল না, তখন উনি টিভিটা চালিয়ে বসলেন। বার তিনেক চ্যানেল পাল্টানর পর জি সিনেমায় এসে আটকে গেলেন। একটা সিনেমা শুরু হচ্ছে। ঘণ্টা খানেক দেখার পর প্রথম এড দিল। এড শেষ হতেই যখন সিনেমার নামটা দেখাল তখন ভুবনবাবুর শিরদাঁড়া দিয়ে যেন একটা বিদ্যুৎ খেলে গেল। ছায়াছবির নাম ‘মার্ডার ৩’।
কি মনে হতে উনি টিভিটা বন্ধ করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। পরেরদিন অফিসে গিয়ে সুখেনবাবুকে এই ব্যাপারে কিছু বললেন না। মনের মধ্যে একটা খটকা লেগে থাকল। তারপর ভাবলেন, ধুর, এটা একটা কাকতালীয় ব্যাপার। এই নিয়ে চিন্তা করা বৃথা।
সুখেনবাবু একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, “কি ভাই ভুবন, কাল কি কিছু দেখেছো?”
ভুবনবাবু বললেন, “আপনিও না সুখেনদা। কি দেখব? খুন?”
সুখেনবাবু আর এই ব্যাপারে কথা বাড়াননি। শুধু নিজেই মনেই বললেন, “দেবুদার কথা তো বিশেষ ভুল হয় না, তাহলে কি...”
আরও এক মাস কেটে গেল এই ভীতর। ভুবনবাবু একটা জিনিষ লক্ষ্য করেছেন যে এই এক মাসে মিস গোমস-এর সাথে ওনার বন্ধত্ব হয়ে গেছে বেশ ভালোই। অফিসে ওনার এখন দুজন বন্ধু। সুখেনবাবুও যে সেটা লক্ষ্য করেন নি, তা নয়। তবে দেব প্রসাদবাবুর কথা আর বলার সাহস পাননি।
একদিন অফিস থেকে ফিরে সবে বৈঠকখানার সোফায় গা এলিয়ে বসেছেন, এমন সময় দরজার বেলটা বেজে উঠল। উঠে গিয়ে দরজা খুলতে উনি থ। মিস গোমস দাঁড়িয়ে আছেন।
প্রাথমিক শকটা কাটিয়ে ভুবনবাবু বললেন, “একি, আপনি?”
মিস গোমস হেঁসে বললেন, “আসলে আপনার একটা পার্সেল এসেছিল। অফিসে দিতে ভুলে গেছি, তাই ভাবলাম বাড়ি ফেরার পথে আপনাকে দিয়ে যাই।”
এই বলে কাঁধের ব্যাগ থেকে একটা ব্রাউন কাগজে মোড়া প্যাকেট ভুবনবাবুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন মিস গোমস। সোফায় এসে বসে প্যাকেটটা ভালো করে দেখলেন ভুবনবাবু। ওনার খুড়তুতো দাদা পাঠিয়েছেন। দিন চারেক আগে ওনার নতুন কবিতার বই প্রকাশ হয়েছে। তারই একটা কপি। কাগজটা খুলে বইটা হাতে নিতেই ভুবনবাবুর চোখ চলে গেল ঘরের দওয়ালে টাঙানো ক্যালেন্ডারটার দিকে। তারিখ দেখাচ্ছে ১৮ই মার্চ। আর ভুবনবাবুর দাদার লেখা কবিতার বইটার নাম ‘প্রথম ভালোবাসা’।
দেব প্রসাদবাবুর দ্বিতীয় কথাটাও মিলে গেল। এইবার ভুবনবাবুর একটু ভয় করল। মনে হল একবার কাকতালীয় হতে পারে, কিন্তু পর পর দুবার? একবার ভাবলেন সুখেনবাবুকে ফোন করবেন, তারপর আবার ভাবলেন কি সব ভাবছেন উনি। তাস কখনও কারুর ভবিষ্যৎ বলতে পারে? যদি দেব প্রসাদবাবুর কাছে উনি নাও যেতেন তখনও তো এগুলো হত। তাহলে? নানা চিন্তার মধ্যে দিনটা কাটিয়ে দিলেন ভুবনবাবু।
একটা একটা করে দিন কাটতে লাগল। দেব প্রসাদবাবুর কথা উনি অবিশ্বাস করলেও ভাবলেন একটু সাবধানে থাকতে ক্ষতি কি? দেখতে দেখতে ১৮ই এপ্রিল এসে গেল। দেব প্রসাদবাবু বলেছিলেন যে আজ ভুবনবাবু অগ্নিদগ্ধ হবেন। তাই বাড়ি থেকে বেরনোর সময় গ্যাসের নবটা ভালো করে চেক করে নিলেন। তারপর বাসে না গিয়ে একটা ট্যাক্সি ধরলেন ভুবনবাবু। মনে মনে ঠিক করেছেন যে আজ বাড়িতে রান্না করবেন না। বাইরে থেকে খেয়ে আসবেন।
যাই হোক, অফিসে গিয়ে দেখলেন যে কাজের টেবিলে কেউ নেই, সবাই ছোটবাবুর টেবিলের সামনে জড় হয়ে আছে। ভুবনবাবুও সেখানে গিয়ে দাঁড়ালেন। ওনাকে দেখে ছোটবাবু বললেন, “মিঃ সোম, আপানর জন্য একটা খারাপ খবর আছে।”
“কি?” ভুবনবাবু প্রমাদ গুনলেন। আগেও কথা হয়েছিল ওনাকে সুন্দরবনে অন্য ব্রাঞ্চে বদলি করার, সেবার যদিও বড়বাবুর হাতে পায়ে ধরে সেটা আটকানো গেছিল। তবে এইবার মনে হয় ভাগ্যে সেই সুন্দরবনই ঝুলছে।
ছোটবাবু গলা খাকরিয়ে বললেন, “গত দুবছর কোম্পানির প্রচুর লস হয়েছে, সেটা তো আপনি জানেন। তাই মালিক ঠিক করেছেন যে খান তিরিশেক লোক ছাটাই করে দেওয়া হবে। সেই লিস্টে আপনার নামও আছে, মিঃ সোম। ইউ আর ফায়ার্ড।”
এই ‘ফায়ার্ড’ কথা শুনেই ভুবনবাবুর রক্ত জল হয়ে গেল। মনে পড়ে গেল দেব প্রসাদবাবুর অগ্নিদগ্ধ আর সেই সময় সুখেনবাবুর বলা ফায়ার কথাটা। মিলে গেল তৃতীয় তাসের ভবিষ্যতবাণী। বাকি আরও যাদের ছাটাই করা হয়েছে তারা তখনও ছোটবাবুর সাথে বাকবিতণ্ডা করছেন। কিন্তু ভুবনবাবু ধীর পায়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গেলেন। ওনার মথায় ঘুরছে ১৮ই মে, চারটে এক, মৃত্যু।
প্রায় তিন সপ্তাহ বাড়িতে বসে শুধু দুটো কাজ করেছেন ভুবনবাবু। এক হল নিজের শরীরের যত্ন নেওয়া, আর দ্বিতীয় হল নতুন চাকরি খোঁজা। একটা ইন্টার্ভিউয়ের ডাক এসেছে কিন্তু এমন দিনে যে ভুবনবাবু সেটা নিয়ে খুব একটা মাথা ব্যাথা নেই। ইন্টার্ভিউয়ের দিন হল ১৮ই মে।
সতেরো তারিখ রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করার পর থেকেই ওনার শরীরটা আইঢাই করছে। অম্বলের ওষুধ খেয়েছেন ঠিকই, তবে তাতে বিশেষ কাজ দেয় নি। আজ রাতে ভুবনবাবু ঠিক করেছেন ঘুমাবেন না। দেব প্রসাদবাবুর তিনটে ভবিষ্যতবাণী যখন মিলেছে, চতুর্থটাও মিলবে। তার মানে এটাই ওনার শেষ রাত। খাটের পাশে রাখা আরামকেদারাটায় হেলান দিয়ে বসলেন ভুবনবাবু। চোখের সামনে ভেসে উঠছে জীবনের বিভিন্ন সময়। সেই ছেলেবেলায় বাবার হাত ধরে গ্রামের মেলায় ঘুরতে যাওয়া, তারপর মায়ের কোলে চড়ে বাগানে ফুল তোলা। হঠাৎ চোখ বন্ধ করে মায়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করলেন ভুবনবাবু। খুব ঝাপসা একটা ছবি ভেসে উঠল চোখের সামনে। প্রায় কুড়ি বছর হতে চলল মা মারা গেছেন, বাবা তো আরও আগে। বিভিন্ন ভাবনার মধ্যে ডুবে থাকতে থাকতে কতক্ষন কেটে গেছে খেয়াল করেননি উনি। দেওয়াল ঘড়িটাতে ঢং ঢং করে চারবার ঘণ্টা বাজতে উনি উঠে বসলেন। অস্বস্তিটা বেশ বেড়েছে, তার সাথে বুকের বাঁ দিকটাতেও একটা চিনচিনে ব্যাথা। হাত ঘড়িটার দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছেন ভুবনবাবু। চারটে বেজে তিরিশ সেকেন্ড... চল্লিশ সেকেন্ড... পঞ্চাশ সেকেন্ড... পঞ্চান্ন সেকেন্ড...চারটে বেজে এক মিনিট... চারটে বেজে দু মিনিট... চারটে বেজে দশ মিনিট।
ভুবনবাবু লাফিয়ে উঠলেন। মনে মনে বললেন, “শালা, জ্যোতিষী না ছাই। আমি নাকি চারটে বেজে এক মিনিটে মরে যাব। যত সব বুজরুক। কাল সকালেই সুখেনদাকে ফোন করে বলব ওনার দেবুদা ফেল্টু মেরে গেছে।”
তার পরমুহূর্তেই মনে পড়ল যে সেদিন তো ইন্টারভিউ আছে? ঘণ্টা দুয়েক না ঘুমালে চলবে না। শুয়ে পড়লেন ভুবনবাবু। একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে ঘুমটা ভেঙে গেল। উনি দেখলেন, যে দেব প্রসাদবাবু, সেই ঘরটায় বসে আছেন আর হা হা করে হাসছেন। তারপর হাঁসি থামিয়ে বলছেন, “আমার ভবিষ্যৎবানী মিথ্যে হয় না রে ভুবন। মিথ্যে হয় না।”
ইন্টার্ভিউটা ছিল ডালহৌসিতে। সেখানে পৌঁছতে প্রায় সাড়ে নটা বেজে গেল। অফিসটা একটা বিশ তলা বাড়ির সতেরো তলায়। গিয়ে বসলেন উপরে। ডাক এল প্রায় দশটা পঁয়তাল্লিশে। মিনিট দশকের ইন্টার্ভিউয়ের পর চাকরিটা পেয়ে গেলেন ভুবনবাবু। এখানেও সেই ব্যাক ডেস্ক ক্লার্ক। মাইনে সাড়ে দশ হাজার। বেশ উৎফুল্ল হয়ে বেরলেন উনি। নিজের এপোয়েন্মেন্ট লেটার নিয়ে লিফটের সামনে এসে দাঁড়ালেন। লিফট নামতে লাগলো নীচে। মিনিট দুয়েক পর একটা ঝটকা খেলেন ভুবনবাবু। তার সাথে একটা প্রচন্ড শব্দ। নিজের শরীরের ওজন যেন ফিলই করতে পারছিলেন না উনি। লিফটের মাথার কাছে লাল একটা আলো জ্বলে উঠেছে আর আলোর গতিতে লিফটটা নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে। লিফটের দড়িটা ছিঁড়ে গেছে কিছু করে। ভুবনবাবু বুঝতে পারলেন যে এটাই ওনার শেষ। সতেরো তলা থেকে সোজা নীচে। মৃত্যু অনিবার্য। হঠাৎ ভুবনবাবুর চোখ পড়ল লিফটের ডিজিটাল ঘড়িটার দিকে। মনে পড়ে গেল দেব প্রসাদবাবুর মুখ, আর সেই দুঃস্বপ্নের কথা। ডিজিটাল ঘড়িতে সময় দেখাচ্ছে এগারোটা এগারো, মানে চারটে এক।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৫৬৭ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২২/০১/২০১৬

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • রিয়া ০৬/০৮/২০১৬
    কী লিখেছেন মশাই! ঊফ... কোন কথা হবে না। অসাধারণ।
  • Sishir Chakraborty ১০/০৪/২০১৬
    Babuda golpo ta porar somoy bukta dhuk dhuk korchilo.....outstanding
  • মাহাবুব ২৯/০১/২০১৬
    দারুণ, গল্পটা বেশ ভালো লাগলো কবি।
  • মহঃ এসরাফিল সেখ ২৫/০১/২০১৬
    Darun golpo।
  • ফয়েজ উল্লাহ রবি ২৪/০১/২০১৬
    বেশ ভাল লেগেছে শুভেচ্ছা দাদা।
  • আজিজ আহমেদ ২৪/০১/২০১৬
    চারটে তাসের reality picture টা বেশ interesting.
    গল্পটা খুব practical লাগল। কোনো ড্রামা নেই।
    দারুন।
  • স্বপ্নীল মিহান ২৩/০১/২০১৬
    ভাল লিখেছেন খুব।
  • রুমা ঢ্যাং ২৩/০১/২০১৬
    দারুন । টান টান উত্তেজনা । খুব ভাল হয়েছে অভি
  • দাদা অসাধারণ।
  • মাহাবুব ২৩/০১/২০১৬
    ভালোই লাগলো গল্পটা, সুন্দর।
  • SWAPNOPRIYA ২২/০১/২০১৬
    অভিষেক দা ভীষন ভালো লেগেছে।
  • প্রদীপ চৌধুরী. ২২/০১/২০১৬
    দারুণ লেখা আমার মন প্রাণ জুরিয়ে গেলো
  • এক নিশ্বাসে পড়লাম। খুব ভালো লাগলো। সবাইকে পড়তে বলি।
 
Quantcast