www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

ভালোবাসার সেই দিনটা

"ড্রাইভার, বাঁয় রোকো," বলতেই আমার ছ'বছরের পুরানো অল্টো গাড়িটা মৃদু প্রতিবাদ জানিয়ে ফুটপাথের ধারে থেমে গেল। পার্ক স্ট্রীটের মাঝে একটা বারের সামনে। ড্রাইভারকে ইশারায় দাঁড়াতে বলে আমি ভীতরে ঢুকে গেলাম। দামি বার, তাই উর্দি-পরা দারোয়ান সেলাম ঠুকে এগিয়ে যেতে বলল। বাঁ দিকের কোনায় একটা নির্দিষ্ট টেবিলে বসতেই ওয়াটার অর্ডার নিয়ে গেল। এই টিচার্স স্কোচ, বড়।
আমার বয়স প্রায় ষাট। আর দু মাস বাকি আছে অবসরের। প্রতি শুক্রবার এখানে আসা আমার গত পঁয়ত্রিশ বছরের অভ্যাস। হ্যাঁ, দেখতে দেখতে পঁয়ত্রিশ বছর কেটে গল। এই তো সেদিনের কথা। বি এস সি পাশ করে রসায়ন বিভাগে ভর্তির জন্য ফর্ম তুলতে গেছিলাম রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে। বিশাল লাইন পড়েছে। যাকেই জিজ্ঞেস করি, সেই এমন একটা নম্বর বলে যে মনটা বাসি লুচির মত মিয়িয়ে যায়। যাই হোক, অনেক আশা নিয়ে এসেছি পড়ব বলে, তাই মস্তিষ্ক বললেও হৃদয় মানতে চায় না যে এখানে পড়ার সুযোগটা হয়তো নাও পেতে পারি।
কিন্তু অবশেষে সুযোগ পাই। এম এস সি পড়তে ঢুকি। জানি হয়তো এ্যানালিটিকাল নিয়ে করতে হবে।তাই সই। বাড়ির অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। বাবার অবসরের মাত্র দু বছর বাকি। কম সে কম এস এস সি-টা টপকাতে পারলে কিছু একটা করা যাবে। এই আশায় ভর্তি হয়ে গেলাম।
নতুন কলেজের প্রথম দিন, তাই গত বারের পূজোয় কেনা পাঞ্জাবিটা পড়ে গেলাম। কিন্তু কলেজে ঢুকতেই কে একটা আওয়াজ দিল, 'এই দেখ হ্যাঙ্গারে পাঞ্জাবি ঝুলছে।' আমি রোগা জানি। তবে এই ভাবে আওয়াজ খেয়ে আমার আমার পঁয়তাল্লিশ কেজির আত্মসম্মানে ঘা লাগলো। আওয়াজটা পিছন থেকে এসেছিল,তার পিছন ফিরতে দেখি চার পাঁচ জন ছেলে বসে আছে। আমি চোখ ফেরাতে পারলেম না।
না, না ছেলেদের প্রতি আমার কোন ইন্টারেস্ট নেই। আমি ওরকম নই। ওদের পিছন দিয়ে একটা মেয়ে কলেজে ঢুকছিল। আকাশী চুড়িদার, খোলা চুল আর...।
হঠাৎ মাথায় একটা সজোরে চাঁটি পড়তে সম্ভিত ফিরল। একটা লম্বা করে ছেলে আমার কলার চেপে ধরেছে। আমি কিছু বোঝার আগেই সে বলে উঠল, "জুনিয়ার জুনিয়ারের মত থাকবি। দেবীর সিকে ড্যাবড্যাব করে তাকালে চোখ গেলে দেব। চোপা দেখেছিস আয়নায়?"
উত্তরটা আমার জানাছিল। হ্যাঁ, দেখেছি। রোজ দেখি। কিন্তু তখন উত্তরটা দিলে আমার যে কি পরিণতি হত সেটা আন্দাজ করতে পেরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। দুবার আমার কলার ধরে ঝাঁকিয়ে সে ছেড়ে দিল। ঐ ঝাকুনির চোটে আমার শরীরের কলকব্জা সব ঝনঝন করে উঠল। যাই হোক, মাথা নিচু করে ক্লাসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
রাতে শুয়ে যতবার ঘুমতে চেষ্টা করি, ততবার আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে ঐ আকাশী ওড়না, আর পরক্ষনেই সেই লম্বা ছেলেটার চেহারা। বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর বুঝলাম যে আমি প্রেমে পড়েছি। এই প্রেম বোধটা আমার মধ্যে জাগিয়ে তুলেছে এই আকাশী ওড়নার দেবীদি। হ্যাঁ, দেবীদি আমার থেকে এক বছরের বড়। বাংলায় এম এস সি দ্বিতীয় বর্ষ। কিন্তু তাতে কি? প্রেম কি আর বয়স মানে?
এই প্রেম জিনিষটা আমার খুব প্রিয়। মনে আমার অনেকদিনের ইচ্ছে, একটা চুটিয়ে প্রেম করার। কিন্তু তরুণীর অভাবে সেটা হয়ে ওঠে নি এতদিন। দেশে তরুণী নেই তা বলছি না। বাসে, ট্রেনে, রাস্তায়, কলেজে প্রচুর তরুণী আছে। কিন্তু ঐ চুটিয়ে প্রেম করার মত একটি তরুণীও আমি খুঁজে পাইনি।
একবার ছাদে ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে পাশের বাড়ির একটি সুন্দরী তরুণীকে দেখে আমার প্রেম বোধটা জেগে উঠেছিল। তখন আমি থার্ড ইয়ার। তার দিক থেকেও আমি চোখ সরাতে পারিনি। কিন্তু সেবারও একই কেস। না না, সেবার কেউ কলার ধরে ঝাঁকিয়ে দেয় নি। আমি যখন অবাক দৃষ্টিতে 'তার' দিকে তাকিয়ে আছি, ওমনি সে বলে উঠল, "মাসি দেখ না, পাশের বাড়ির এই লগবগে ছেলেটা আমার দিকে কেমন তাকিয়ে আছে।" ওর এই মাসিটি যে পুলিশে চাকরি করত সেটা আমি জানতাম, তাই ঘুড়ি ফেলে এক ছুটে নীচে পালিয়ে আসি।
তারপর এই দীর্ঘ পাঁচ মাস পর আবার সেই প্রেম বোধটা জেগে উঠেছে। যাই হোক, ওসব ইতিহাস আমার কোনদিনই ভালো লাগে না। তাই আমার এই সাড়ে পাঁচ ফুট শরীরে যতটা সাহস ছিল তাই নিয়ে ঠিক করলাম, আমি দেবীদিকে প্রপোজ করব। দেবীদিকে না পেলে জীবনটাই বৃথা। চিন্তায় ছেদ পড়ল। ওয়েটার এসে এক গ্লাস স্কোচ দিয়ে গেল। সেটায় দুটো চুমুক দিয়ে আবার চিন্তায় ডুবে গেলাম।
দু সপ্তাহ চেষ্টা করেও যখন আলাপ করতে পাড়লাম না, তখন হঠৎ একদিন সুযোগটা নিজেই এসে গেল। দেবীদি ক্লাসে এসে বলে গেল যে রি- ইউনিয়নে নাটকের জন্য ছেলে চাই। ইচ্ছুকেরা যেন সুভ্রতনুদার কাছে নাম লিখিয়ে আসে। শোনা মাত্রই আমি ছুট লাগালাম ইউনিয়ন রুমের দিকে। সুভতনুদা কে? জিজ্ঞেস করতে সবাই যে ছেলেটাকে দেখিয়ে দিল, সে প্রথম দিনের সেই লম্বা ছেলেটা। আমাকে দেখে ভ্রু নাচিয়ে বলল, "কি রে, কি দরকার? নাটক করবি নাকি?"
কোন উত্তর দেওয়ার আগেই সে এমন একটা হাঁসি দিল যে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। সেদিন আমি আরও নাজেহাল হতাম, কিন্তু আমার ত্রাতা হয়ে প্রবেশ করম আমার দেবীদি। এই প্রথম দেবীদি আমার সাথে কথা বলল। আমার দিকে তাকিয়ে হেঁসে বলল, "তুই নাটক করবি?"
আমি মাথা নাড়ালাম। মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরচ্ছে না। বুকের মধ্যে ট্রাম্পেট বাজছে।
দেবীদি বলল, "আগে কোনদিন অভিনয় করেছিস?"
আমি আবার মাথা নাড়লাম। এবার ডান দিক বাঁ দিকে। একটা ছেলে বলে উঠল, "এ শালা বোবা মনে হয়। এ ব্যাটাকে ভাগা, নাটকে তো বোবার রোল নেই।" আবার সেই হাঁসি।
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় দেবীদি সবাইকে একটা মৃদু ধমক দিয়ে আমার কাঁধে হাত রাখল। আমার পা কাঁপছে, বুকের মধ্যে যেন আরও জোরে ট্রাম্পেট বাজছে।
"আচ্ছা, কাল থেকে আমাদের রিহার্সাল। চলে আসিস। কোন চরিত্র করবি, বলে দেব। কাল ঠিক দুটো," এই বলে দেবীদি বেরিয়ে গেল। আমিও এক ছুটে গেটের বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরালাম। মনে উৎফুল্ল ভাব। এমন একটা ভাব করে সিগারেট টানতে লাগলাম যেন অলিম্পিকের বিস্কুট দৌড়ে আমি সোনা পেয়েছি।
সেদিন রাতে ঘুম এল না। শুধু ভাবতে লাগলাম দেবীদির কথা। পরের দিন গিয়ে কলেজে গিয়ে জানতে পারলাম রামায়ন নাটকে আমার ভুমিকা একটা রাক্ষস সৈন্যের। এই নাটকে আমার বরাদ্দ তিনটে ডায়লগ।
"মারো।"
"মারো"
আর "আআআআআ" ব্যাস।
তাই সই। দেবীদি ভালবেসে যখন দিয়েছে, তখন এই চরিত্রেই ফাটিয়ে দেব। তিন সপ্তাহ রিহার্সাল করার পর যখন ফাইনাল রিহার্সাল করতে স্টেজে উঠলাম, তখন জান দিয়ে অভিনয় করলাম। যথারীতি অনেকে অনেক কথা বলেছিল আমার অভিনয় নিয়ে।
সুভতনুদা বলেছিল, "রাবণটা শালা কিপটে মনে হয়। সৈন্যগুলোকে খেতে দিত না। এই চেহারার সৈন্যদের জন্যই মালটা যুদ্ধে হেরেছিল।"
কথাটা আমি কানেই তুলিনি। দেবীদির নাটকে অভিনয় করার জন্য আমি হাজারটা এই রকম কটু কথা শুনতে রাজি আছি। সেদিন তো মাত্র পঞ্চাশ জন ছিল হলে। পরেরদিন রি-ইউনিয়ন। বাড়িতে ফিরে ঠিক করলাম কালই প্রপোজ করব দেবীদিকে। যা হবে দেখা যাবে।
কিন্তু পরেরদিন গোল বাঁধল। সাড়ে দশটার ট্রেন ধরব আর সকাল ছটা থেকে নটার মধ্যে এগারো বার বাথরুম গেছি। প্রচণ্ড পেট খারাপ। কোনরকমে তিনটে মেট্রোজিল খেয়ে কলেজে গেলাম। একটু বেশি নড়াচড়া করলেই পেটটা কেমন জানি করছিল। তার উপরে সুভতনুদার কথায় কথায় পেটে ঘুসি মারায় বিপদের আশঙ্কা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
কোন মতে নাটক শেষ করে বাড়ি যাব, হঠৎ মনে পড়ে গেল, আরে,আজ তো প্রপোজ করার দিন। কিন্তু সাহসে কুলাল না। পুরো সাহসটাই বাথরুম চাপতে খরচ হয়ে গেছে। গত এক সপ্তাহ ধরে খুব যত্ন করে লেখা প্রেমপত্রটা দেবীদির ব্যাগে চালান করে দিয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। চিঠিতে ছিল আমার ফোন নম্বরটাও।
পরের দিন কলেজে গিয়ে ক্লাসে বসে আছি। পি কে এম আসে নি। সবাই বসে আড্ডা দিচ্ছে। এমন সময় মোবাইলটা বেজে উঠল। অচেনা নম্বর। কানে দিতেই ওপাশ থেকে ভেসে এল দেবীদির মিষ্টি কণ্ঠ।
"এই অভি, ওটা তুই দিয়েছিলি?"
আমি মাথা নাড়লাম। আবার একই প্রশ্ন করায় বুঝতে পারলাম মোবাইলে তো দেখা যায় না। বললাম, "হ্যাঁ।"
দেবীদি বলল, "আমায় সামনা সামনি বললি না কেন?"
মনে হল আমার বুকের ভীতর যেন একশো ঢাকি ঢাক বাজাচ্ছে। বললাম, "না, মানে..."
"এখন একবার দেখা করবি? সুবুদার জেরক্সের দোকানে?"
দেবীদি ফোনটা রেখে দিলে পনেরো মিনিটের মধ্যে কলেজের পাশের গলির সুবুদার দোকানে পৌঁছে গেলাম। না, যেতে অতক্ষণ লাগত না যদি না রাস্তায় দুটো সিগারেট খেয়ে সাহস বাড়াতাম। পৌঁছে দেখি গলির প্রায় শেষে দেবীদি দাঁড়িয়ে আছে। পরনে সেই আকাশী ওড়না...।
ভাবনাটা একটু থমকে গেল। কারন একটা মস্ত বড় হাত আমার কলার চেপে ধরেছে। আর গোটা তিনেক ছেলে মিলে আমায় বেধড়ক পেটাচ্ছে। আমি কাতরাচ্ছি। আর পাশে দাঁড়িয়ে আমার দেবীদি বলছে, "মার শালাকে। বামন হয়ে চাঁদ ধরতে যাওয়া। মার।"
যখন জ্ঞান ফিরল, তখন আমি হাসপাতালে। পায়ে প্লাস্টার। মাথায় ব্যান্ডেজ। পাশে দেখি সুভতনুদা বসে আছে। বলল, "তোকে কি সাদে বারন করে ছিলাম রে। দেবীর বয়ফ্রেন্ড রাজাবাজারের নাম করা বিচ্ছু। আমিও ভিক্তভুগি। তাই..."
আমার কানে কোন কথা ঢুকছে না। চোখের সামনেটা কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে।
ওয়েটারের ডাকে সম্ভিত ফিরল। বিল মিটিয়ে ধীর পায়ে বেরিয়ে এলাম। গাড়িতে বসে বললাম, "ঘর চলো।"
গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে পার্ক স্ট্রীট পিছনে ফেলে। হঠাৎ মনে হল, 'দেবীদিকে একটা ধন্যবাদ দেওয়ার আছে। ওর জন্যই তো এই চাকরি। সরকারি চাকরি, পঞ্চাশ হাজার টাকা মাইনে। কোটা ছাড়া কি হয়। এস সি, এস টি নই তো কি হয়েছে। দেবীদির দয়ায় পি এইচ (মানে physically handicapped) তো হলাম।'
ক্র্যাচটা পাশে রেখে ড্রাইভারকে বললাম, "একবার গঙ্গার ওদিকটা চল তো।"
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৭৬০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ০১/১০/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • খুব ভালো লাগলো।
  • সত্যি খুব সুন্দর লেখা । ভাল লাগল । শুভেচ্ছা জানাই ।
  • এল এস ডি ১৮/১০/২০১৫
    দারুণ!
  • অন্যরকম একটা কিছু ছিল। দারুন...
  • দারুন , খুব ভাল লাগল অভিষেক।
  • রাজ চৌধুরী ০১/১০/২০১৫
    ফাটাফাটি
  • রাশেদ খাঁন ০১/১০/২০১৫
    ভালো লেগেছে।
  • ভালো
  • তপন দাস ০১/১০/২০১৫
    বাহ! ভীষণ ভালো লাগছে...কিন্তু দেবীদির সংগে আর কখনো দেখা হয়নি?
  • অনিমেষ ঘোষ ০১/১০/২০১৫
    হা হা! বেশ লাগলো
 
Quantcast