www.tarunyo.com

সাম্প্রতিক মন্তব্যসমূহ

কাকের কান্না

আত্মা কি আছে? খুব কঠিন একটা প্রশ্ন করে ফেললাম। তাই না? আপনারা কেউ বলবেন আছে, আবার কেউ বলবেন, ‘ছাড়ুন তো দাদা, আবার আজগুবি গল্প ফাঁদতে বসেছেন?’ আমি যদিও কোনটাকেই অগ্রাহ্য করব না। আজগুবি? হতেও পারে। তবে গল্প ফাঁদতে আমি বসিনি। গল্পটা আমারও না। শুনেছিলাম আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। তার আসল নামটা আমি বলব না। এখানে তাকে অমিত বলেই লিখছি।  
অমিত যেটা বলেছিল আর যেভাবে বলেছিল, তাতে ওকে অবিশ্বাস করার কথা মাথায় আসে নি। আপনারা যদি ওকে চিনতেন তাহলে হয়তো আপনারও ‘আজগুবি’ বলে উড়িয়ে দিতে পারতেন না।  যাই হোক, গল্পটা প্রথম থেকেই বলা শুরু করলাম। দেখুন, কি মনে হয়।
তখন আমি কলেজে পড়ি। পূজোর ছুটিতে বেশ অনেকদিন পরেই বাড়ি গেছিলাম। আমাদের ছোটো গ্রামটায় পড়াশোনার ব্যবস্থা ভালো না, তাই প্রায় সকলেই কোলকাতায় থেকে পড়াশোনা করে।  ওই সময়টা আমার যে ক’জন বন্ধু ছিল, তারা সবাই বাড়ি আসে। সারাদিন হইহুল্লোড় করে সময় যে কোথা দিয়ে কেটে যেত, তা জানাই যেত না। যাই হোক, সে বার বাড়ি যেতেই শুনলাম অমিত এসেছে। বেশ অবাক হলাম।
ওর মা মারা যাওয়ার প্রায় এক সপ্তাহ পরে ও মামাবাড়ি চলে যায়। তাও প্রায় বছর চারেক হয়ে গেল। তারপর আর আসেনি। তার যদিও আরেকটা কারনও ছিল। ওর মা মারা যাওয়ার তিন মাসের মধ্যে ওর বাবা আবার বিয়ে করেছিলেন।
তা, অমিত এসেছে শুনে মন খুশিতে ভরে গেল। ও চলে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমরা ছিলাম যাকে বলে বেস্ট ফ্রেন্ড। এক স্কুলে পড়েছি, একসাথে খেলেছি। আমাদের দুটো বাড়ি পরেই থাকত ওরা। আমাদের গ্রামে একমাত্র দোতলা বাড়ি ছিল ওদের। আমার শোবার ঘর থেকে ওদের দোতলাটা দেখা যায়। দোতলাটায় ছিল অমিতের ঘর। ছোটোবেলায় রোজ শুতে যাওয়ার আগে দুজনেই জানলায় দাঁড়াতাম। হাত নাড়িয়ে শুভ রাত্রি বলতাম। সেই অমিতের সাথে আবার দেখা হবে, এই আনন্দে ছুট লাগালাম ওদের বাড়ির উদ্দেশ্য।  
পুরনো বন্ধূকে পেয়ে দুজনেই ভীষণ খুশি। এখন অমিত আবার আগের মত। হাসিঠাট্টা, ইয়ার্কি চলতে লাগলো আমাদের মাঝে।
একদিন সন্ধ্যে বেলায় আড্ডা দিচ্ছিলাম আমাদের ছাদে। কথা প্রসঙ্গে বললাম, “ভাই, তুই না গেলেই পারতিস। তুই মামাবাড়ি চলে যাওয়ার পর তিন বছর ভীষণ বোর হয়েছি রে।”
অমিত যেন একটু উদাস ভাবে তাকাল আমার দিকে। তারপর সামান্য হেসে বলল, “জীবনে অনেক কিছু হয় রে বন্ধু। আমার যে না গিয়ে উপায় ছিল না।”
“তুই যাই বল ভাই, তোর নতুন মা কিন্তু খারাপ না। আমাদের বাড়িতেও তো কয়েকবার এসেছেন। থাকলে তোর কোন প্রবলেম হত না।”
এবার যেন অমিত একটু দমে গেল। বলল, “উনি ভীষণ ভালো। আমায় খুব স্নেহ করেন। ওনার জন্য যাই নি রে।”
“তা হলে?”
“কাউকে বলিনি জানিস। বাবাকেও না, আমার প্রেমিকাকেও না। জানি ওরা কেউ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু আমি জানি তুই করবি। তুই জানতে চাস আমি কেন চলে গেছিলাম। তবে শোন। কিন্তু কাউকে বলিস না প্লিজ।”
আমার বুকটা কেমন ধড়াস করে উঠল। বললাম, “প্রমিস।”
অমিত বলতে শুরু করল। ও যা বলল, তা অন্য কেউ বললে আমিও হেসে উড়িয়ে দিতাম, কিন্তু অমিতের একটাও কথা আমি অবিশ্বাস করতে পারলাম না।
“বেশ কিছুদিন ধরে বাড়িতে খুব ঝামেলা হচ্ছিলো জানিস। কবে যেন মামা আমার বাবাকে কোন মহিলার সাথে কোলকাতার কোন হটেলে ঢুকতে দেখেছে। তুমুল অশান্তি। বাবা মা একসাথে থাকলে ঘরে কান পাতা যেত না। আমি তাই সচরাচর নীচে নামতাম না। গেলেও সটান দরজা দিয়ে বাইরে চলে যেতাম, যাতে কারুর সামনে না পড়তে হয়। কিন্তু গোল বাধল এক রবিবার। বাবা বাড়িতে ছিলেন। সকালে ঘুমও ভাঙল ঝগড়া শুনে।”
একটু থামল অমিত। চুপ করে তাকিয়ে থাকলো খানিকক্ষণ ছাদের পাঁচিলের দিকে।
বেশ একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। বললাম, “সিগারেট খাবি?”
আমার কথায় একটু যেন চমকে উঠল ও। বলল, “এমনিতে ছেড়ে দিয়েছি। তবে, বললি যখন, দে একটা।”
সিগারেট ধরিয়ে অমিত আবার বলতে লাগল।
“মাঝেমাঝে জানিস বাবা মাকে মারধরও করতেন। মা আমাকে চেঁচিয়ে ডাকত। ‘অমিত, অমিত’। আমি নীচে যেতাম না জানিস। বাবাকে ভীষণ ভয় পেতাম। প্রথম প্রথম একদিন গেছিলাম। সে ভয়ানক দৃশ্য। আমাকে দেখে দুজনেই ভীষণ ভাবে রিঅ্যাক্ট করল। আমি ছুটে উপরে পালিয়ে গেছিলাম। আর কোনদিন যাইনি।”
আবার থামল অমিত। সিগারেটটা এক টোকায় বাড়ির পিছনের আম বাগানটায় ফেলে দিল।
“সেই রবিবার দুপুরে বাড়িতে রান্নাও হল না। ভীষণ খিদে পেয়েছিলো। লুকিয়ে নীচে গিয়ে বিস্কুটের কৌটোটা নিয়ে এলাম। বিস্কুট খেয়ে থাকলাম দুপুরে। প্রচণ্ড চেঁচামিচি করে তিনটে নাগাদ বাবা বেরিয়ে গেলেন। বাড়িটা যেন একটু শান্ত হল। মা নীচ থেকে সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে অমিত অমিত বলে। পাত্তা দিলাম না। ভাবলাম, ‘ধুর, এ তো রোজকারের নাটক।’ সাড়াও দিলাম না। গুম মেরে বসে থাকলাম। ঘড়িতে দেখি তিনটে কুড়ি। মা তখন ডাকাডাকি থামিয়ে দিয়েছেন। ভাবলাম এই সুযোগ, যাই মাঠে যাই। খোলা হাওয়ায় থাকলে ভালো লাগবে।”
দম নেবার জন্য থামলও অমিত। পাশ থেকে জলের বোতলটা নিয়ে একটু জল খেল। দেখি ওই কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
বললাম, “কি রে ঘামছিস কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”
ও যেন শূনতেই পেল না আমার কথা। বলে চলল, “আমাদের সদর দরজায় গেলে বাবা-মার ঘরটা দেখা যায়। বেরতে যাব, চোখ পড়ল ওদিকে। শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেল। দরজার ফাঁক দিয়ে দেখলাম শুধু এক জোড়া ঝুলন্ত পা। গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুল না। দৌড়ে গেলাম ওই ঘরে। ফ্যান থেকে মায়ের ঝুলন্ত দেহটা তখনো অল্প দুলছে। জড়িয়ে ধরলাম পা দুটো। আমার চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগলো অঝরে। তারপর কিছু মনে নেই। জ্ঞান ফিরল বাবার ধাক্কায়। তুই তখন ছিলি না এখানে। কোথায় যেন গেছিলি। সারারাত কেঁদে কেঁদে কাটালাম। শুধু মনে হচ্ছিল যদি একবার মায়ের ডাকে নীচে যেতাম তাহলে হয় তো...।”
অমিতের গলা বেশ ভারি হয়ে এসেছে। ওকে সান্তনা দেওয়ার জন্য ওর পিঠে হাত রাখলাম।
“পরের দিন সকালে যেন একটু থিতু হলাম। বাড়িটা বেশ শান্ত। চুপ করে বসে থাকলাম ঘরে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হল। খিদে যেন কিছুতেই পাচ্ছে না। খিদের কথা মনে পড়তেই আবার চোখ ভিজে গেল। মনে হল মায়ের রান্না আর কোনদিন খেতে পারব না। এমন সময় নীচের ঘড়িতে ঢং ঢং করে তিনটে বাজল। হঠাৎ শুনি একটা খুট খুট শব্দ। প্রথমটায় জানিস, কান দিই নি। কিন্তু বেশ কিছুক্ষন পরেও যখন শব্দটা থামলও না তখন এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি একটা বিশাল দাঁড় কাক জানলায় বসে কাঁচটাকে ঠোকরাচ্ছে। কিরকম বিকট একটা শব্দ। আমার ভালো লাগলো না। হুশ হুশ করে ওটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করলাম। কিছুতেই গেল না। ঠুকরেই যাচ্ছে। এরকম চলল আরও মিনিট কুড়ি। তারপর নিজে থেকেই উড়ে গেল কাকটা। কাকটাকে দেখে আমার কিরকম একটা অস্বস্তি হতে লাগলো। যাই হোক। একটু পরেই দেখি মামা এলো। মামাকে জড়িয়ে ভীষণ কাঁদতে লাগলাম। ভুলেই গেলাম কাকটার কথা। কিন্তু পরের দিন আবার সেই তিনটে বাজতেই সেই কাকের আগমন। আবার সেই প্রাণ জ্বালানো খুট খুট শব্দ। আবার সেই বিফল তাড়ানোর চেষ্টা। ঘড়িতে দেখলাম, ঠিক তিনটে আঠারোয় নিজেই উড়ে চলে গেল। এই একই ঘটনা চলতে থাকলো রোজ। ঠিক তিনটেয় কাকটা আসবে আর তিনটে আঠারো পর্যন্ত জানলার কাঁচে ঠোকরাবে, তারপর নিজেই চলে যাবে। একদিন জানিস, ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছিল। জানলা দিয়ে দেখলাম রাস্তায় প্রায় কোমর জল। ভাবলাম যাক, আজ হয়তো নিস্তার পবো। কিন্তু কই। ঠিক তিনটের সময় ভিজে জবজবে হয়ে আবার কাকটা চলে এলো। আবার সেই শব্দ। আমার দম বন্ধ হয়ে আসত। ওই খুট খুট শব্দটার মধ্যে আমি যেন অমিত অমিত ডাক শুনতে পেতাম।”
অমিত থামল। পকেট থেকে রুমাল বের করে ঘাম মুছল। আমার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। শরীরের সমস্ত রোম খাড়া হয়ে গেছে।
অমিত একটা গলা খেকরানি দিয়ে বলল, “ওই কাকের উৎপাত বেশি দিন সহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিল না। তাই মামাবাড়ি চলে গেলাম।”
কথা শেষ করে অমিত আর বসলো না। বলল, “আজ উঠি রে। আবার কাল আসব।”
আমিও মাথা নেড়ে সায় দিলাম। আমারও শরীরটা কেমন যেন অস্থির লাগছে। ঘড়িতে দেখি সাড়ে নটা। রাতে কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়লাম। শুতে গিয়ে জানলা দিয়ে চোখ পড়ল অমিতদের দোতলার ঘরে, সেই জানলাটায় যেখানে ছেলেবেলায় অমিত শুভ রাত্রি বলত। যেখানে সেই কাকটা রোজ আসত ঠিক তিনটের সময়।
বিষয়শ্রেণী: গল্প
ব্লগটি ১৬৯০ বার পঠিত হয়েছে।
প্রকাশের তারিখ: ২৯/০৭/২০১৫

মন্তব্য যোগ করুন

এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।

Use the following form to leave your comment on this post.

মন্তব্যসমূহ

  • আজিজ আহমেদ ০৯/০২/২০১৬
    টান টান ভাব টা ভাল লাগলো।
    সুন্দর।
  • দেবাশীষ দিপন ০৮/১১/২০১৫
    আপনার গল্প লেখার হাতও যে এত অসাধারণ এটা না পড়লে জানতাম না।।ছোট গল্পের ক্ষেত্রে উপস্থাপনা খুবই জরুরী।আর আপনার উপস্থাপনার দক্ষতায় মুগ্ধ।।আর আপনার গল্পটা তো দারুণ ই।
  • Nice, brother Abhishek ! go ahead.....
  • মোবারক হোসেন ১১/০৮/২০১৫
    জীবন মানেই ঘটনার অঘটন।এ গল্প পড়ে কষ্টে আমি
    নীল হয়ে গেছি।এমন র্সাথক লেখায় লেখকও র্সাথক হোক
    এই শুভ কামনা রইলো।ধন্যবাদ।
  • অপর্ণা বসু ০৫/০৮/২০১৫
    খুব সুন্দর গল্প পড়ালেন l অপূর্ব !
  • জাভেদ ০১/০৮/২০১৫
    অপূর্ব।
  • Sourav Dutta ০১/০৮/২০১৫
    WONDERFUL STORY.
  • জে এস সাব্বির ৩১/০৭/২০১৫
    খুবই তন্ময় নিয়ে পরলাম ।কাকের ঠোকরানো কাব্যের একটা ফিনিশিং হইলে ভাল লাগতো আরো ।

    হুমমম , ছোট গল্পের মজাটাই এখানে । গ্রেট জব ।
  • Adhir Sanyal ৩১/০৭/২০১৫
    বাঃ। বেশ গল্প।
  • কল্লোল বেপারী ৩০/০৭/২০১৫
    খুব ভালো লাগল।
  • অনিল বসু ৩০/০৭/২০১৫
    দারুণ ভূত। লিখে চলুন। পাশে থাকবো।
  • আবুল হাসান ৩০/০৭/২০১৫
    অপুর্বময়! এর কোন তুলোনাই হয়না।
  • আবুল হাসান ৩০/০৭/২০১৫
    গল্পটা সুনেছিলাম ... কিন্তু
    পরে দিগুন ভাল লাগলো...।
    খুব ভাল...
    উত্তর
    • অভিষেক মিত্র ৩০/০৭/২০১৫
      ও দাদা, এটা কি? আপনি তো দেখছি সব গল্পই শুনেছেন।
      কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি? পড়ে ভালো লাগলে, শুধু 'ভালো' লিখলেই চলত। অন্যের মন্তব্য কপি করার দরকার ছিলনা। ওই মন্তব্যটা আমার এক বন্ধু করেছিল। ও, আমার কাছেই শুনেছিল গল্পটা।
  • সুনীল চক্রবর্তী ৩০/০৭/২০১৫
    সুন্দর গল্প। দারুণ লাগলো।
  • জহরলাল মজুমদার ২৯/০৭/২০১৫
    সুন্দর
  • ভাল লাগলো
  • ২৯/০৭/২০১৫
    বেশ সুন্দর গল্প ।
  • বিশ্বাস অবিশ্বাসের কথা না। আপনার পরিবেশনা চমত্কার। পড়া শুরু করে শেষ করার আগে আমি একটুকুও অন্যমনস্ক হইনি। গল্পটা সত্যি দারুন ! শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
 
Quantcast