একটা অদ্ভুত গল্প
আজকে যে গল্পটা বলব, সেটা এর আগে বহুবার বহুজনকে বলেছি। কেউ বিশ্বাস করেছে, কেউ আবার করেনি। বিশ্বাস না করলে যদিও আমার কিছুই এসে যায় না। কারণ ঘটনাটা সত্যিই ঘটেছে। আর আমার জীবনেই ঘটেছে। যারা বিশ্বাস করেছে, তাদেরও মত ভিন্ন। কেউ বলেছে ভূত, আবার কেউ বলেছে মনের ভুল। আমি যদিও দুটোর একটাকেও উডিয়ে দিতে পারি না। কারণ, আমি নিজেই জানি না এর সঠিক ব্যাখ্যা কি। দেখুন, আপনারা কিছু ব্যাখ্যা দিতে পারেন কিনা। যদিও ঘটনাটা বহুদিনের, তবুও ওই হাড়-হিম-করা অভিজ্ঞতা আমি কোন দিন ভুলতে পারব না।
তখন আমি কলেজে পড়ি, কেমিস্ট্রি অনার্স তৃতীয় বর্ষ। আমাদের কলেজ ক্রিকেট দল জোনাল চ্যাম্পিয়নসিপ-এ প্রথম বার উঠেছে। আমি দলের উইকেট-রক্ষক। প্রথম তিনটে খেলা জিতে আমরা লিগে এক নম্বর। আমাদের পরের খেলা বারাসাত কলেজের সাথে, ওদের মাঠে। তিন দিনের টেস্ট খেলা। বারাসাত কলেজ থেকেই আমাদের থাকার বন্দবস্ত করবে। সাধারণত আমরা খেলার আগের দিন যাই। কিন্তু এইবার ঠিক হল খেলার দু’দিন আগে আমরা যাবো। কারণ কিছুই না। আসলে বারাসাত থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরে চড়কের মেলা হচ্ছে। মেলা সারা রাত ধরে চলে। দিনের বেলা প্রাকটিস করে রাতে ওইখানে যাবো। এই ছিল প্লান।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। নির্দিষ্ট দিনে আমরা রওনা দিলাম। কোলকাতা থেকে বারাসাত পৌছতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল। বারাসাত ষ্টেশনের কাছে ওদের লোক থাকবে। সেই আমাদের থাকার জায়গায় নিয়ে যাবে। গরম কালের দুপুর, রাস্তা ঘাটে প্রায় লোকই নেই। ষ্টেশনের কাছে গিয়ে আমাদের বাস থামলো। সাড়ে তিন ঘণ্টা বসে সবার কোমর ধরে গেছে। সবাই বাস থেকে নেমে দাঁড়াল। আমি আর আমাদের ক্যাপ্টেন জাভেদ দুটো সিগারেট ধরালাম। সিগারেট খেতে খেতে খেলা নিয়েই আলোচনা চলছিল। এমন সময়, আমার পিঠে একটা টোকা পড়ল।
“দাদা, আগুনটা একটু দেবে?” খুব মিহি গলায় প্রশ্ন এল।
পিছন ফিরে দেখি সুতানু দাড়িয়ে। সুতানু লাহিড়ী, আমাদের দলের অফ স্পিনার। ও পড়ত প্রথম বর্ষে, ইংরেজি নিয়ে। শান্ত স্বভাবের ছেলে ছিল সুতানু। খেলতও বেশ ভালই। ওর শুধু একটাই দোষ ছিল। ও প্রচণ্ড সিগারেট খেত। প্রায় চেন-স্মোকার।
“আবার রিজেণ্ট ধরাবি?” দেশলাইটা ওর হাতে চালান করে জাভেদ বলল। তারপর সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, “শালা, এই গন্ধটা না সহ্য হয় না।”
সুতানু একটু হেসে সিগারেটটা ধরিয়ে দেশলাই ফেরত দিয়ে বলল, “মানুষ অভ্যাসের দাস জাভেদ-দা।”
“এই মেলা ডায়লগ ঝাড়িস না।”
“তুমি পজেটিভ দিকটা দেখো। আমি আসে পাশে আছি কিনা, সেটা তুমি গন্ধেই বুঝতে পারবে। হে হে। এই দাঁড়াও, একটু হালকা হয়ে আসি।” এই বলে সুতানু একটু দূরের ঝোপটার দিকে চলে গেল।
“চল রে। অনেক ফুঁকেছিস,” বাসের ওদিক থেকে এ.পি. হাঁক ছাড়ল। এ.পি. আমাদের কোচ। অমিয় পাল।
বাসে উঠে দেখি একটা বুড়ো মতন লোক ড্রাইভারকে হাত নেড়ে রাস্তা বোঝাচ্ছে। আমরা আবার রওনা দিলাম। আরও মিনিট কুড়ি যাওয়ার পর বাসটা একটা বিশাল মাঠের কাছে এসে দাঁড়াল। একে একে বাস থেকে নেমে দেখি একটা তিনতলা পুরনো স্কুল বাড়ি। বাড়িটার ত্রিসীমানায় আর কোন বাড়ি বা দোকান দেখা গেল না। দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠ আর মাঠের শেষে জঙ্গল। বাড়িটার সামনে একটা আধ ভাঙা ফলকে লেখা কৃষ্ণবিহারী বালিকা বিদ্যালয়।
“এ কোথায় আনলে ভাই,” প্রশ্ন করলেন এ.পি.। উদ্দেশ্য বুড়ো লোকটি।
“এখানেই আপনারা থাকবেন, বাবু। ওই তেতলায় তিনটে ঘর পরিষ্কার করা আছে। কোন অসুবিধে হবে না,” বলে একটু হে হে করে হাসল লোকটা।
“তা পিছনের ওই জঙ্গলে বাঘ ভাল্লুক নেই তো?” একটু মজা করে জিজ্ঞেস করল এ.পি.।
“না, বাবু। চোর ডাকাত ও তেমন নেই। আসেন আপনাদের ঘরগুলো দেখিয়ে দি।”
তেতলার ঘরগুলো পুরনো হলেও খারাপ না। মাটিতে চারটে করে বিছানা পাতা। একটা জলের কুঁজো, একটা তেপায়া টেবিল আর দুটো চেয়ার। এই হল আমাদের থাকার ব্যবস্থা। আমাদের ঘর দেখিয়ে চলে যাবার সময় বুড়ো বলল, “ওই নীচের ঘরটায় আমি থাকি। রাতের খাবার আমি আপনাদের ঘরেই এনে দেবো। তাছাড়া, অন্য দরকারে ডাকবেন।” এই বলে বুড়ো নীচে যাবার জন্য পা বাড়াল।
“ওহে, তোমার নামটাই তো বললে না?” এ.পি. বললেন।
“আজ্ঞে, হরিরাম, বাবু। হরি বলে হাঁক দেবেন, আমি চলে আসবো।”
ঠিক হল একটা ঘরে আমি, জাভেদ, সুতানু আর পার্থ থাকবো। কোথাও যাবার নেই বলে সারা সন্ধ্যে তাস খেলে আর আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিলাম। রাতে ভাত আর কচি পাঁঠার ঝোল খেয়ে শুয়ে পড়লাম। শোবার আগে জাভেদ বলল, “ ভাই, জানলাটা খুলে দে, রিজেণ্টের গন্ধে ঘুমনো যাবে না।“
পরের দিন প্রাকটিসে হল মুশকিল। একটা বল পায়ে লেগে পা ফুলে গেল। ঘরে এসে বরফ দিচ্ছি, এমন সময় সুতানু এসে বলল, “কি শৌভিকদা, যাবে না?”
মাথা গরম হয়ে গেল, “শালা ঠ্যাং-এর অবস্থা দেখেছিস। আমার আর যাওয়া হবে না, তোরা ঘুরে আয়।”
“আমিও যাচ্ছি না।”
“কেন রে, তোর আবার কি হল?”
“কিছুই না, আমার এক বন্ধু থাকে এখানে, আমি ওখানে যাবো। এ.পি.-কে বলে দিয়েছি। কাল খেলার আগেই ফিরবো।” এই বলে সিগারেট টানতে টানতে সুতানু চলে গেল।
সারা সন্ধ্যে একা একা কি আর করি? একটা গল্পের বই ছিল ব্যাগে। সেইটে বের করে পড়তে লাগলাম।
ন’টা নাগাদ হরিরাম এসে খাবার দিয়ে গেল। বলল, “বাবু, একা ভয় করলে আমার ওখানে চলে আসবেন।”
আমি হেসে বললাম, “ভয় টয় আমি পাই না। তুমি যাও, শুয়ে পড়।”
খাওয়া শেষ করে সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখি সিগারেট নেই। কেলেঙ্কারি করেছে। খাবার পরে একটা সিগারেট না খেলে আমার ঘুম হয় না। কি করি? এদিক ওদিক ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ সুতানুর বালিশের তলা থেকে একটা আধ খাওয়া সিগারেট পেলাম। তাই সই। জানলার ধারে দাড়িয়ে সিগারেট-টা ধরালাম। বেশ কড়া। দু-তিন টান দিয়ে ফেলে দিলাম। ঘুম আসছে না। আবার বইটা খুলে বসলাম। জানলা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া আসছে। পড়তে পড়তে কখন ঘুম এসে গেছে জানি না। ঘুমটা ভাঙল একটা অস্বস্তিতে। আমার নিঃশ্বাস নিয়ে খুব অসুবিধে হচ্ছে। দমটা যেন বন্ধ হয়ে আসছে। চোখ খুলে দেখি আলো বন্ধ। ফ্যানটাও ঘুরছে না। মনে হয় কারেন্ট গেছে। ঘরের মধ্যে একটুও হাওয়া আসছে না কেন। মেঘ করল নাকি? উঠে গিয়ে দেখি জানলাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সে কি? পাল্লাগুলো কি লক করি নি? ঠিক মনে পড়ল না। হঠাৎ ঘরের মধ্যে সেই রিজেণ্টের গন্ধ পেলাম। চমকে উঠলাম। পরক্ষণেই মনে পড়ল, আরে, আমিই তো শোবার আগে রিজেণ্ট খেলাম। কি কড়া গন্ধ, এখনও যায় নি। উঠে গিয়ে ফ্যানের সুইচটা টিপতেই হু হু করে ফ্যানটা ঘুরতে লাগলো। দেখলাম লাইটাও জ্বলল।
গা-টা একটু ছমছম করে উঠলো। কি হল? আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি তো আলো নেভাইনি। আর যদি নিভিয়েও থাকি, এই গরমে ফ্যান তো বন্ধ করব না। একবার মনে হল যাই নীচেই চলে যাই। কি আর হবে ওই বুড়ো একটু হাসবে, ভাববে, “খুব তো বললে ভয় টয় আমি পাই না।”
তারপর মনে হল, “পায়ের ব্যাথাটা একটু কম আছে। রাতটা বিশ্রাম নিলে কালকে হয়তো খেলতে পারবো। দেখি, ঘুমানোর চেষ্টা করি, ঘুম না এলে না হয় আস্তে আস্তে নীচে চলে যাব। এই ভেবে আবার শুয়ে পড়লাম। এইবার ইচ্ছে করেই আলোটা নেভালাম না। জানলা দিয়ে এখনো সেই ফুরফুরে হাওয়াটা আসছে। একটু এদিক ওদিক করতেই ঘুম এসে গেল।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। আবার ঘুমটা ভেঙে গেল। সেই একই দম বন্ধ করা পরিবেশ। এবার যেন গন্ধটা একটু বেশীই কড়া। চোখ খুলেই আমার রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ঘরে আলো জ্বলছে না। ফ্যানও ঘুরছে না। সেই ফুরফুরে হাওয়াটাও নেই। হাতড়ে বালিশের পাশ থেকে টর্চটা নিয়ে গেলাম। কিন্তু আমার হাত উঠলো না। একটা মৃদু কাশির আওয়াজ। ঘরটা যেন ধোঁয়ায় ভরে গেছে। এবার আমি হাঁপাচ্ছি। ফুসফুসে আর অক্সিজেন যাচ্ছে না। শুধু যেন রিজেণ্টের গন্ধ। আমার হাত পা অসাড় হয়ে গেছে। ওঠার শক্তি নেই। খানিক্ষণ এই ভাবে কাটার পর একটু থিতু হলাম। নাঃ, নীচেই চলে যাই। উঠতে যাব, এমন সময়, স্পষ্ট শুনলাম সুতানুর গলা, “চললি নাকি?”
হঠাৎ যেন ভয়টা আরও দিগুণ হয়ে গেল। দরজাটা তো বন্ধ করে শুয়েছিলাম। সুতানু ঢুকল কি করে? মনে হল এ রাত আর আমার ফুরাবে না। এখান থেকে বেরতেই হবে। এ আমাদের সুতানু না। ঘামে ভেজা বিছানাটা ছাড়তে যেন শরীরের সবটুকু শক্তি লাগিয়ে দিলাম। ব্যাথা পায়ের কথা আর মনে নেই। কোনক্রমে টলতে টলতে দরজা অবধি পৌছোলাম। তারপর এক ছুট। হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে বুঝলাম পায়ের ব্যাথাটা একটুও কমে নি, বরং বেশ বেড়েছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হরির ঘরের দরজাটা ধাক্কাতে লাগলাম। বার তিনেক ধাক্কা দেবার পর, ঘুম চোখে হরিরাম দরজা খুলল।
“কি হয়েছে, বাবু? কিছুতে ভয় পেয়েছেন?” ঘুম জড়ানো গলায় প্রশ্ন করল হরিরাম।
উত্তর দেওয়ার জন্য আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুলো না। হরিরাম যদিও আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই বলল, “আসেন, বাবু। রাতটা এখানেই শুয়ে পড়েন।”
সেই রাতে আমার আর ঘুম হল না। সকালে সবাই ফিরে খুব হাসাহাসি করল। সুতানু কিন্তু ফিরল না। ঘরে ফিরে এসে জাভেদ শুধু বলল, “তুই রাতে ফ্যান আর জানলা দুটোই বন্ধ করে শুয়েছিলি?”
এই প্রশ্নের কোন উত্তর আমার কাছে ছিল না। সকালে দেখলাম পা-টা আরও ফুলেছে। দেখে এ.পি. বলল, “ওই পা নিয়ে তুই খেলতে পারবি না। দীনেশ, তুই কিপিং করবি।”
খেলার আগে সুতানু ফিরল না। যখন বিকেল পাঁচটা বেজে গেল, তখন এ.পি. কলেজে জানিয়ে দিল সুতানুর অনুপস্থিতির কথাটা। এই ঘটনার প্রায় বারো বছর কেটে গেছে, এখনো সুতানু লাহিড়ীর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। পুলিশও এই তদন্তের কোন কিনারা করতে পারে নি। হুট করে পৃথিবীর বুক থেকে সুতানু লাহিড়ী চীরদিনের মতো হারিয়ে গেল।
আজও যখন মনে পড়ে সেই রাতটার কথা, আমার কানে শুধু একটা কথাই বাজে। সুতানু সিগারেটে টান দিয়ে বলেছিল, “তুমি পজেটিভ দিকটা দেখো। আমি আসে পাশে আছি কিনা, সেটা তুমি গন্ধেই বুঝতে পারবে।”
তখন আমি কলেজে পড়ি, কেমিস্ট্রি অনার্স তৃতীয় বর্ষ। আমাদের কলেজ ক্রিকেট দল জোনাল চ্যাম্পিয়নসিপ-এ প্রথম বার উঠেছে। আমি দলের উইকেট-রক্ষক। প্রথম তিনটে খেলা জিতে আমরা লিগে এক নম্বর। আমাদের পরের খেলা বারাসাত কলেজের সাথে, ওদের মাঠে। তিন দিনের টেস্ট খেলা। বারাসাত কলেজ থেকেই আমাদের থাকার বন্দবস্ত করবে। সাধারণত আমরা খেলার আগের দিন যাই। কিন্তু এইবার ঠিক হল খেলার দু’দিন আগে আমরা যাবো। কারণ কিছুই না। আসলে বারাসাত থেকে প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার দূরে চড়কের মেলা হচ্ছে। মেলা সারা রাত ধরে চলে। দিনের বেলা প্রাকটিস করে রাতে ওইখানে যাবো। এই ছিল প্লান।
যেমন ভাবা, তেমন কাজ। নির্দিষ্ট দিনে আমরা রওনা দিলাম। কোলকাতা থেকে বারাসাত পৌছতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল। বারাসাত ষ্টেশনের কাছে ওদের লোক থাকবে। সেই আমাদের থাকার জায়গায় নিয়ে যাবে। গরম কালের দুপুর, রাস্তা ঘাটে প্রায় লোকই নেই। ষ্টেশনের কাছে গিয়ে আমাদের বাস থামলো। সাড়ে তিন ঘণ্টা বসে সবার কোমর ধরে গেছে। সবাই বাস থেকে নেমে দাঁড়াল। আমি আর আমাদের ক্যাপ্টেন জাভেদ দুটো সিগারেট ধরালাম। সিগারেট খেতে খেতে খেলা নিয়েই আলোচনা চলছিল। এমন সময়, আমার পিঠে একটা টোকা পড়ল।
“দাদা, আগুনটা একটু দেবে?” খুব মিহি গলায় প্রশ্ন এল।
পিছন ফিরে দেখি সুতানু দাড়িয়ে। সুতানু লাহিড়ী, আমাদের দলের অফ স্পিনার। ও পড়ত প্রথম বর্ষে, ইংরেজি নিয়ে। শান্ত স্বভাবের ছেলে ছিল সুতানু। খেলতও বেশ ভালই। ওর শুধু একটাই দোষ ছিল। ও প্রচণ্ড সিগারেট খেত। প্রায় চেন-স্মোকার।
“আবার রিজেণ্ট ধরাবি?” দেশলাইটা ওর হাতে চালান করে জাভেদ বলল। তারপর সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে বলল, “শালা, এই গন্ধটা না সহ্য হয় না।”
সুতানু একটু হেসে সিগারেটটা ধরিয়ে দেশলাই ফেরত দিয়ে বলল, “মানুষ অভ্যাসের দাস জাভেদ-দা।”
“এই মেলা ডায়লগ ঝাড়িস না।”
“তুমি পজেটিভ দিকটা দেখো। আমি আসে পাশে আছি কিনা, সেটা তুমি গন্ধেই বুঝতে পারবে। হে হে। এই দাঁড়াও, একটু হালকা হয়ে আসি।” এই বলে সুতানু একটু দূরের ঝোপটার দিকে চলে গেল।
“চল রে। অনেক ফুঁকেছিস,” বাসের ওদিক থেকে এ.পি. হাঁক ছাড়ল। এ.পি. আমাদের কোচ। অমিয় পাল।
বাসে উঠে দেখি একটা বুড়ো মতন লোক ড্রাইভারকে হাত নেড়ে রাস্তা বোঝাচ্ছে। আমরা আবার রওনা দিলাম। আরও মিনিট কুড়ি যাওয়ার পর বাসটা একটা বিশাল মাঠের কাছে এসে দাঁড়াল। একে একে বাস থেকে নেমে দেখি একটা তিনতলা পুরনো স্কুল বাড়ি। বাড়িটার ত্রিসীমানায় আর কোন বাড়ি বা দোকান দেখা গেল না। দিগন্ত বিস্তৃত খোলা মাঠ আর মাঠের শেষে জঙ্গল। বাড়িটার সামনে একটা আধ ভাঙা ফলকে লেখা কৃষ্ণবিহারী বালিকা বিদ্যালয়।
“এ কোথায় আনলে ভাই,” প্রশ্ন করলেন এ.পি.। উদ্দেশ্য বুড়ো লোকটি।
“এখানেই আপনারা থাকবেন, বাবু। ওই তেতলায় তিনটে ঘর পরিষ্কার করা আছে। কোন অসুবিধে হবে না,” বলে একটু হে হে করে হাসল লোকটা।
“তা পিছনের ওই জঙ্গলে বাঘ ভাল্লুক নেই তো?” একটু মজা করে জিজ্ঞেস করল এ.পি.।
“না, বাবু। চোর ডাকাত ও তেমন নেই। আসেন আপনাদের ঘরগুলো দেখিয়ে দি।”
তেতলার ঘরগুলো পুরনো হলেও খারাপ না। মাটিতে চারটে করে বিছানা পাতা। একটা জলের কুঁজো, একটা তেপায়া টেবিল আর দুটো চেয়ার। এই হল আমাদের থাকার ব্যবস্থা। আমাদের ঘর দেখিয়ে চলে যাবার সময় বুড়ো বলল, “ওই নীচের ঘরটায় আমি থাকি। রাতের খাবার আমি আপনাদের ঘরেই এনে দেবো। তাছাড়া, অন্য দরকারে ডাকবেন।” এই বলে বুড়ো নীচে যাবার জন্য পা বাড়াল।
“ওহে, তোমার নামটাই তো বললে না?” এ.পি. বললেন।
“আজ্ঞে, হরিরাম, বাবু। হরি বলে হাঁক দেবেন, আমি চলে আসবো।”
ঠিক হল একটা ঘরে আমি, জাভেদ, সুতানু আর পার্থ থাকবো। কোথাও যাবার নেই বলে সারা সন্ধ্যে তাস খেলে আর আড্ডা দিয়ে কাটিয়ে দিলাম। রাতে ভাত আর কচি পাঁঠার ঝোল খেয়ে শুয়ে পড়লাম। শোবার আগে জাভেদ বলল, “ ভাই, জানলাটা খুলে দে, রিজেণ্টের গন্ধে ঘুমনো যাবে না।“
পরের দিন প্রাকটিসে হল মুশকিল। একটা বল পায়ে লেগে পা ফুলে গেল। ঘরে এসে বরফ দিচ্ছি, এমন সময় সুতানু এসে বলল, “কি শৌভিকদা, যাবে না?”
মাথা গরম হয়ে গেল, “শালা ঠ্যাং-এর অবস্থা দেখেছিস। আমার আর যাওয়া হবে না, তোরা ঘুরে আয়।”
“আমিও যাচ্ছি না।”
“কেন রে, তোর আবার কি হল?”
“কিছুই না, আমার এক বন্ধু থাকে এখানে, আমি ওখানে যাবো। এ.পি.-কে বলে দিয়েছি। কাল খেলার আগেই ফিরবো।” এই বলে সিগারেট টানতে টানতে সুতানু চলে গেল।
সারা সন্ধ্যে একা একা কি আর করি? একটা গল্পের বই ছিল ব্যাগে। সেইটে বের করে পড়তে লাগলাম।
ন’টা নাগাদ হরিরাম এসে খাবার দিয়ে গেল। বলল, “বাবু, একা ভয় করলে আমার ওখানে চলে আসবেন।”
আমি হেসে বললাম, “ভয় টয় আমি পাই না। তুমি যাও, শুয়ে পড়।”
খাওয়া শেষ করে সিগারেট ধরাতে গিয়ে দেখি সিগারেট নেই। কেলেঙ্কারি করেছে। খাবার পরে একটা সিগারেট না খেলে আমার ঘুম হয় না। কি করি? এদিক ওদিক ঘাটতে ঘাটতে হঠাৎ সুতানুর বালিশের তলা থেকে একটা আধ খাওয়া সিগারেট পেলাম। তাই সই। জানলার ধারে দাড়িয়ে সিগারেট-টা ধরালাম। বেশ কড়া। দু-তিন টান দিয়ে ফেলে দিলাম। ঘুম আসছে না। আবার বইটা খুলে বসলাম। জানলা দিয়ে ফুরফুরে হাওয়া আসছে। পড়তে পড়তে কখন ঘুম এসে গেছে জানি না। ঘুমটা ভাঙল একটা অস্বস্তিতে। আমার নিঃশ্বাস নিয়ে খুব অসুবিধে হচ্ছে। দমটা যেন বন্ধ হয়ে আসছে। চোখ খুলে দেখি আলো বন্ধ। ফ্যানটাও ঘুরছে না। মনে হয় কারেন্ট গেছে। ঘরের মধ্যে একটুও হাওয়া আসছে না কেন। মেঘ করল নাকি? উঠে গিয়ে দেখি জানলাগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। সে কি? পাল্লাগুলো কি লক করি নি? ঠিক মনে পড়ল না। হঠাৎ ঘরের মধ্যে সেই রিজেণ্টের গন্ধ পেলাম। চমকে উঠলাম। পরক্ষণেই মনে পড়ল, আরে, আমিই তো শোবার আগে রিজেণ্ট খেলাম। কি কড়া গন্ধ, এখনও যায় নি। উঠে গিয়ে ফ্যানের সুইচটা টিপতেই হু হু করে ফ্যানটা ঘুরতে লাগলো। দেখলাম লাইটাও জ্বলল।
গা-টা একটু ছমছম করে উঠলো। কি হল? আমার স্পষ্ট মনে আছে, আমি তো আলো নেভাইনি। আর যদি নিভিয়েও থাকি, এই গরমে ফ্যান তো বন্ধ করব না। একবার মনে হল যাই নীচেই চলে যাই। কি আর হবে ওই বুড়ো একটু হাসবে, ভাববে, “খুব তো বললে ভয় টয় আমি পাই না।”
তারপর মনে হল, “পায়ের ব্যাথাটা একটু কম আছে। রাতটা বিশ্রাম নিলে কালকে হয়তো খেলতে পারবো। দেখি, ঘুমানোর চেষ্টা করি, ঘুম না এলে না হয় আস্তে আস্তে নীচে চলে যাব। এই ভেবে আবার শুয়ে পড়লাম। এইবার ইচ্ছে করেই আলোটা নেভালাম না। জানলা দিয়ে এখনো সেই ফুরফুরে হাওয়াটা আসছে। একটু এদিক ওদিক করতেই ঘুম এসে গেল।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। আবার ঘুমটা ভেঙে গেল। সেই একই দম বন্ধ করা পরিবেশ। এবার যেন গন্ধটা একটু বেশীই কড়া। চোখ খুলেই আমার রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ঘরে আলো জ্বলছে না। ফ্যানও ঘুরছে না। সেই ফুরফুরে হাওয়াটাও নেই। হাতড়ে বালিশের পাশ থেকে টর্চটা নিয়ে গেলাম। কিন্তু আমার হাত উঠলো না। একটা মৃদু কাশির আওয়াজ। ঘরটা যেন ধোঁয়ায় ভরে গেছে। এবার আমি হাঁপাচ্ছি। ফুসফুসে আর অক্সিজেন যাচ্ছে না। শুধু যেন রিজেণ্টের গন্ধ। আমার হাত পা অসাড় হয়ে গেছে। ওঠার শক্তি নেই। খানিক্ষণ এই ভাবে কাটার পর একটু থিতু হলাম। নাঃ, নীচেই চলে যাই। উঠতে যাব, এমন সময়, স্পষ্ট শুনলাম সুতানুর গলা, “চললি নাকি?”
হঠাৎ যেন ভয়টা আরও দিগুণ হয়ে গেল। দরজাটা তো বন্ধ করে শুয়েছিলাম। সুতানু ঢুকল কি করে? মনে হল এ রাত আর আমার ফুরাবে না। এখান থেকে বেরতেই হবে। এ আমাদের সুতানু না। ঘামে ভেজা বিছানাটা ছাড়তে যেন শরীরের সবটুকু শক্তি লাগিয়ে দিলাম। ব্যাথা পায়ের কথা আর মনে নেই। কোনক্রমে টলতে টলতে দরজা অবধি পৌছোলাম। তারপর এক ছুট। হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে বুঝলাম পায়ের ব্যাথাটা একটুও কমে নি, বরং বেশ বেড়েছে।
হাঁপাতে হাঁপাতে এসে হরির ঘরের দরজাটা ধাক্কাতে লাগলাম। বার তিনেক ধাক্কা দেবার পর, ঘুম চোখে হরিরাম দরজা খুলল।
“কি হয়েছে, বাবু? কিছুতে ভয় পেয়েছেন?” ঘুম জড়ানো গলায় প্রশ্ন করল হরিরাম।
উত্তর দেওয়ার জন্য আমার গলা দিয়ে আওয়াজ বেরুলো না। হরিরাম যদিও আমার উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করেই বলল, “আসেন, বাবু। রাতটা এখানেই শুয়ে পড়েন।”
* * *
সেই রাতে আমার আর ঘুম হল না। সকালে সবাই ফিরে খুব হাসাহাসি করল। সুতানু কিন্তু ফিরল না। ঘরে ফিরে এসে জাভেদ শুধু বলল, “তুই রাতে ফ্যান আর জানলা দুটোই বন্ধ করে শুয়েছিলি?”
এই প্রশ্নের কোন উত্তর আমার কাছে ছিল না। সকালে দেখলাম পা-টা আরও ফুলেছে। দেখে এ.পি. বলল, “ওই পা নিয়ে তুই খেলতে পারবি না। দীনেশ, তুই কিপিং করবি।”
খেলার আগে সুতানু ফিরল না। যখন বিকেল পাঁচটা বেজে গেল, তখন এ.পি. কলেজে জানিয়ে দিল সুতানুর অনুপস্থিতির কথাটা। এই ঘটনার প্রায় বারো বছর কেটে গেছে, এখনো সুতানু লাহিড়ীর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি। পুলিশও এই তদন্তের কোন কিনারা করতে পারে নি। হুট করে পৃথিবীর বুক থেকে সুতানু লাহিড়ী চীরদিনের মতো হারিয়ে গেল।
আজও যখন মনে পড়ে সেই রাতটার কথা, আমার কানে শুধু একটা কথাই বাজে। সুতানু সিগারেটে টান দিয়ে বলেছিল, “তুমি পজেটিভ দিকটা দেখো। আমি আসে পাশে আছি কিনা, সেটা তুমি গন্ধেই বুঝতে পারবে।”
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
মনিরুজ্জামান জীবন ১৮/০১/২০১৬অতুলনীয় গল্পের ভাবনা, অসাধারণ প্রকাশ।
-
শ্রীতরুণ গিরি ৩০/০৭/২০১৫গ্ল্প পুরানো।
লিখেছেন ভালো। -
আবুল হাসান ৩০/০৭/২০১৫গল্পটা সুনেছিলাম ... কিন্তু
পরে দিগুন ভাল লাগলো...।
খুব ভাল... -
সমরেশ সুবোধ পড়্যা ২৭/০৭/২০১৫এটা গল্প না সত্যি ঘটনা। পড়তে গিয়ে গল্পের মধ্যে ঢুকে গেছি। এই কি হয় কি হয়। ভুতে ধরল নাকি। মাঝে একবার ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। সত্যি আপনি গুছিয়ে লিখেছেন । ভাব আর ভাষা সঠিক। ভালো লেখা। এমনি লিখতে থাকুন। অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
-
SUBIR ২৭/০৭/২০১৫দারুণ ভূত।
-
Saurav Goswami ২৫/০৭/২০১৫ভাল ।
-
T s J ২৪/০৭/২০১৫অপূর্ব
-
তরীকুল ইসলাম সৈকত ২৪/০৭/২০১৫ভালো লাগলো!!!
-
Sourav Dutta ২৪/০৭/২০১৫ভালো লাগলো।
-
Amit Das ২৪/০৭/২০১৫দারুণ BOSS.
-
স্বাধীন আমিনুল ইসলাম ২৩/০৭/২০১৫বেশ ভাল লাগল।অনেক মজা পেলাম
-
রাজ শেখর ২২/০৭/২০১৫দারুণ লিখেছিস বস...। পাগলা।
-
শিবজিত ২২/০৭/২০১৫গল্পটা সুনেছিলাম ... কিন্তু পরে দিগুন ভাল লাগলো...। খুব ভাল...
-
Amit Mukherjee ২২/০৭/২০১৫সুন্দর। বেশ লাগলো আপনার গল্পটা। আরও লিখুন।