আড্ডা
আজ ঘুম থেকে উঠতে সত্যিই দেরি হয়ে গেছে। রবিবার সাধারণত একটু বেশিক্ষণই ঘুমই, তবে আজকে উঠে দেখি সাড়ে দশটা বাজে। প্রায় লাফিয়ে উঠলাম। ইস, আজও যেতে দেরি হয়ে যাবে। সারা সপ্তাহ কলেজ করে এই একটা দিন পাই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার। তাতেও দেরি। ধুস। রোজ রোজ এস. কে. চৌধুরি আর অমিয় পাল-এর লেকচার থেকে এই আড্ডাটাই আমার লাইফ-লাইন। তাতেও দেরি। মেজাজটা খিচড়ে গেল।
তাড়াতাড়ি বিছনা ছেড়ে উঠে হাঁক পাড়লাম, "মা, খেতে দাও। বেরব।জলদি।"
কোন রকমে হাত-মুখ ধুয়ে নিচে গিয়ে দেখি টেবিলে খাবার নেই।
মাথাটা গরম হয়ে গেল।
"মা, কি হল। বললাম না বেরবো। দাও।"
"দাড়া, অত তাড়া দিস না। আমি বলেছিলাম দেরি করে উঠতে?" শ্লেষ ছুড়ে দিল আমার জননী।
কি আর করি, খবরের কাগজটা খুলে বসলাম। এই নেতা চুরি করেছে, ওই বাবা ধরা পরেছে, বাজেট, শিশু শ্রমিক ইত্যাদি পড়তে পড়তে মা রুটি আর তরকারি দিয়ে গেল।
"পুরোটা না খেয়ে বেরবি না কিন্তু।"
কোন রকমে নাকে মুখে গুজে ছুট লাগালা।
আমাদের বাড়ি থেকে সুবুদা-র চায়ের দোকানে যেতে সাইকেলে দশ মিনিট লাগে। ওখানেই প্রতি রবিবার আমাদের আড্ডা বসে। আজ দশ মিনিটের রাস্তা সাড়ে সাত মিনিটে চলে এলাম। গিয়ে দেখে সাবাই প্রায় উপস্থিত। সাইকেলটা পাশের দেওয়ালে হ্যালান দিয়ে অর্ঘ্যদের দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখি অর্ঘ্য আর টুটু-র মধ্যে জোর তর্ক চলছে গতকালের ক্রিকেট খেলা নিয়ে। আমি সবে গিয়ে বসেছি, এমন সময় হন্তদন্ত করে মান্তু এসে ধপ করে টুটুর পাশে বসে পরল।
"কি রে, মুখটা ব্যাজার কেন?" অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করল।
"ধুর, এভাবে থাকা যায়?" প্রশ্নটা প্রায় অগ্রাহ্য করে মান্তু বলল।
"কেন রে? বস আবার বাটাম দিলো নাকি?"
"ভাব একবার, আমায় নাকি সেমিনার দিতে হবে......তাও আবার শিশু শ্রমিক নিয়ে......কোথায় পাবো বল তো ।"
"কেন, এই যে। অর্ঘ্য শিশু আর ওকে খাটালে শিশু শ্রমিক।" এবার টুটু বলল।
" হ্যাঁ রে, বাপকে গিয়ে বল না।" একটু রাগ দেখিয়ে বলল অর্ঘ্য।
" ও শিশু! ঠিক সময় বিয়ে হলে চার শিশুর বাপ হয়ে যেতো রে..."বলেই হো হো করে হেসে উঠল মান্তু। আমরাও যোগ দিলাম ওর হাসিতে।
হাসির রেশ একটু কমলে দিগু-দা বেশ সিরিয়াস গলায় বলে উঠল, "তোরা খিল্লি করছিস, একবার ভাব তো যে সব ছোটো ছোটো বাচ্চারা একটু খাবার জন্য সারাদিন খাটে তাদের কি অবস্থা। আমরা তো আলোচনা করব, হেন করেগা, তেন করেগা বলব তারপর এ.সি ঘরে গিয়ে ঘুম লাগাব। আর..."
দিগুদার কথা শেষ করতে না দিয়ে টুটু বলল, "দেখো দিগুদা, আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এতো খারাপ যে এখানে তোমার আমার কিছু করার নেই।"
"বললেই হল। দেখ আমরা সবাই যদি একে একে এই সব বে-আইনি ব্যাপারগুলর বিরুদ্ধে রুখে দাড়াই তা হলেই এগুলোকে গোড়া থেকে নিরমুল করা যেতে পারে।" দেশের কথা উঠতে একটু আবেগপ্রবন হয়ে বললাম।
অর্ঘ্য মিচকি হেসে বলল, "সবই তো বুঝলাম, কিন্তু প্রথমে এটা দেখতে হবে যে বেড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাধবে কে?" তারপর দিগুদার দিকে তাকিয়ে বলল, "তুই?"
"এতো চাটাচাটি হয়ে গেলো ভাই। আসল কথা হল, এই যে অর্থনৈতিক অবস্থা সেটা দূর না করা গেলে কিছুই হবে না। যারা শিশুদের দিয়ে কাজ করায় আগে তাদের বলা উচিত।" দিগুদা প্রতিবাদ করল।
"কি বলবে? তোমরা শিশুদের দিয়ে কাজ না করিয়ে নিজে করো। তা ছাড়া, ওরা তো তাদের পয়সা দিচ্ছে। ফ্রি তে তো খাটাচ্ছে না।" এবার বক্তা টুটু।
মান্তু হাত তুলে টুটু থামিয়ে বলল, "আরে? পয়সা দিলেই হল। ওদের শিক্ষা হচ্ছে কৈ? শিক্ষা ছাড়া ওদের তো সারা জীবন ঐ করতে হবে?"
অর্ঘ্য আবার ফুট কাটল, "এবার মালিকরা বলবে, শিশুদের না খাটিয়ে মান্তু কে খাটাবো।"
"এবার চড় থাপ্পার মেরে দেবো কিন্তু। একটা সিরিয়াস আলোচনা হচ্ছে আর একে দেখ?"
এর মধ্যে এক রাউন্ড চা এসে গেছে। আলচনায় একটু বিরতি দিয়ে সবাই চা পানে ব্যস্ত হয়ে গেল। একটা গোটা সিগারেট শেষ করে, ফিল্টার-টা এক টোকায় ছুড়ে ফেলে দিগুদা বেশ হতাশ গলায় বলল, "ধুর, দেশ রসাতলে যাচ্ছে......"
"আর দিগুদা জ্ঞান বিলোচ্ছে।" আবার অর্ঘ্য। আমাদের যে কোন আড্ডায় অর্ঘ্য হল যাকে বলে কমিক রিলিফ। "এই অনেক বকেছিস। একটা সিগারেট ছাড় তো।" শেষ কথাটা মান্তুর উদ্দেশ্যে ছিল।
মান্তুর থেকে সিগারেট নিয়ে অর্ঘ্য সবে আগুনটা ধরিয়েছে, এমন সময় মিলনের প্রবেশ। বেশ গম্ভীর গলায় বলল, "কি, গভীর সমস্যা মনে হচ্ছে?"
অর্ঘ্য চাপা গলায় বলল, "হয়ে গেল।"
এই 'হয়ে গেল' মন্তব্যটির কারন হল মিলন একটু জ্ঞ্যানপাপী টাইপের। যে কোন বিষয় কথা হোক, ও সব জানে।
"ঐ শিশু শ্রমিক নিয়ে একটু কথা হচ্ছে আর কি?" আমি বললাম।
"এটা তো বেশ স্পর্শকাতর ব্যাপার। ভেরি প্যাথেটিক কেস।"
"ধুর, বড্ড গরম, তার মধ্যে তুমি আর ইংরেজি ঝেড়ো না তো..." নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন বক্তা কে? ঠিকই ধরেছেন অর্ঘ্য।
"যাচ্চলে, আমার উপর খার খাচ্ছিস কেন?"
দুজনের মধ্যে বচসা শুরু হবার আগেই, দিগুদা ধমকানি দিলো, “তোরা থামবি?”
দিগুদার ধমকানিতে কাজ হল। ওরা চুপ করতে, মান্তু আবার বলতে লাগলো, “হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম। তুমি যেটা বলছ সেটা তো করা সম্ভব না। আমাদের জনসংখ্যা ১২০ কটি। তার ৬০% BPL। তুমি কি করবে?”
মান্তু র কথার রেষ টেনেই দিগুদা বলে চলল, “এই অশিক্ষার ফলেই তো বড় হয়ে ওরা মানুষ হচ্ছে না । পরে এরাই চুরি ডাকাতি করবে। তখন কি কেউ ভাববে ওরা কেন এমন হল?”
আমি বললাম, “তুই কি করতে চাস? ঝাণ্ডা নিয়ে মিছিল বের করবি?”
“সেটা তো সমাধান না। সবাইকে জানাতে হবে যে শিশুদের খাটালে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারে।”
ফাজলামি ছেড়ে অর্ঘ্য বলল, “তুই বলছিস পুলিশের ভয়ে এটা কমানো যাবে? তাই হলে তো এতদিনে কমতো। কৈ, কমলো না তো?”
“মানুষের মধ্যে এই সচেতনতাটা আনতে হবে। তো হলেই কাজ হবে।”, বেশ বিজ্ঞের মত বলল মিলান।
“কিচ্ছু হবে না। যতদিন জনসংখ্যা না কমবে, ততদিন শিশুশ্রমও কমবে না।”
“হ্যাঁ, জনসংখ্যা আর কমেছে......সব শালা অশিক্ষিতের দল.........সারাদিন ভ্যান,রিকশা টানবে......আর রাতে গণ্ডা গণ্ডা বাচ্চা বার করবে...... কিচ্ছু হবে না...... শুধু আলোচনায় হবে...... তুমি পারবে ওদের বোঝাতে?” কথাটা দিগুদার উদ্দেশ্যে বলল টুটু।
মান্তু দিগুদাকে ডীফেণ্ড করল, “সেটা তো সরকারের কাজ।”
আমি বললাম, “তা, তোদের সরকার কোন কাজটা করছে শুনি।”
মান্তু বলল, “সরকার যদি না করে, তাহলে আমাদের করতে হবে। আরও ভালো হয় যদি সবাই এই কাজে এগিয়ে আসে। প্রত্যেকের বোঝা দরকার যে শিশুশ্রম আমাদের সেই আদিম যুগেই ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।”
আমি সকালেই পড়েছি, তাই বললাম, “জানিস, গ্রামের দিকে কত বাচ্চারা বিড়ি বাঁধে? তারা তো সব সময় ঐ টোব্যাকো গুঁড়ো ইনহেল করছে। তাদের কি সুস্থ ভাবে বাঁচার কোন অধিকার নেই। শুধু কি তাই, ওদের তো মালিকরা ভীষণ মারে বলেও শুনেছি। আজই তো কাগজে বেরিয়েছে। ধুস, ভাবলেই মেজাজ খিচড়ে যায়।”
দিগু বলল, “হ্যাঁ, আমিও পড়েছি। লিখেছে, চেন্নাই তে ৫ জন কে গ্রেপ্তার করেছি এই ইসু-তে।”
মিলন বলল, “ও তো খুচর কেস। একটাকে ধরে তো পঞ্চাশটাকে ছাড়ে। সবই গট আপ।”
মান্তু আবেগপ্রবণ হয়ে বলল, “সত্যি, ভাবলেও খারাপ লাগে। আমাদের কিছুই কি করার নেই?”
হঠাৎ টুটু সবাইকে বেশ চমকে দিয়েই চেঁচিয়ে বলল, “না, নেই। এই ভাট বকা থামা তো? মালগুলো বকেই চলাছে। আমার তাড়া আছে। আর এক কাপ চা খেয়েই উঠবো। কি সুবুদা চা হবে না কাটবো?”
দোকানের ভীতর থেকে সুবুদার গলা এল, “বস দিচ্ছি। এই দিনু, আর কতক্ষন বাসন মাজবি? তাড়াতাড়ি আয়।”
দিনু বলে একটা সাত আট বছরের ছেলে সুবুদার দোকানে কাজ করে। এতক্ষন সে আমাদের একটু পাশে ড্রেনের ধারে বসে এক কাড়ি বাসন মাজছিল। সুবুদার ধমকানি শুনে, কোন রকমে বাসনগুলো নিয়ে আস্তে গিয়ে হোঁচট খেলো। অমনি কেলেঙ্কারি। বাসন সুদ্ধ পড়ল দিগুদার ঘাড়ে। বাসনের জলে দিগুদার নতুন পাঞ্জাবী ভিজে চপচপে। দিগুদা প্রায় লাফিয়ে উঠে, “শ্যালা ছোটলোকের বাচ্চা...”, বলে তাকে একটা চড় কসিয়ে দিল।
টুটু তাড়াতাড়ি দিগুদাকে আটকাল, “ছাড়ো না।“
দিগুদা ভীষণ রেগে গজগজ করতে লাগলো। বলল, “দেখ নতুন পাঞ্জাবীটার কি অবস্থা করল। শ্যালা...”
অর্ঘ্য হাঁক ছাড়ল, “কি সুবুদা, কি সব কাজে রাখো? কী করল দেখে যাও।”
সুবুদা বেরিয়ে এসে দিনুকে আর একটা চড় লাগিয়ে বলল, “শালা জানোয়ার, মেরে চামড়া গুটিয়ে দেবো । যা মাপ চা।”
মান্তু হাত তুলে বলল, “থাক থাক, আর মাপ চেয়ে কাজ নেই। তুমি চা-টা দাও। বাড়ি যাই।”
দিগুদা গজগজ করতে করতে একটা সিগারেট ধরায়, “চললাম রে”বলে হাঁটা লাগালো। আমরাও একে একে ঊঠে পড়লাম। রবিবারের আড্ডাটাই মাটি।
তাড়াতাড়ি বিছনা ছেড়ে উঠে হাঁক পাড়লাম, "মা, খেতে দাও। বেরব।জলদি।"
কোন রকমে হাত-মুখ ধুয়ে নিচে গিয়ে দেখি টেবিলে খাবার নেই।
মাথাটা গরম হয়ে গেল।
"মা, কি হল। বললাম না বেরবো। দাও।"
"দাড়া, অত তাড়া দিস না। আমি বলেছিলাম দেরি করে উঠতে?" শ্লেষ ছুড়ে দিল আমার জননী।
কি আর করি, খবরের কাগজটা খুলে বসলাম। এই নেতা চুরি করেছে, ওই বাবা ধরা পরেছে, বাজেট, শিশু শ্রমিক ইত্যাদি পড়তে পড়তে মা রুটি আর তরকারি দিয়ে গেল।
"পুরোটা না খেয়ে বেরবি না কিন্তু।"
কোন রকমে নাকে মুখে গুজে ছুট লাগালা।
আমাদের বাড়ি থেকে সুবুদা-র চায়ের দোকানে যেতে সাইকেলে দশ মিনিট লাগে। ওখানেই প্রতি রবিবার আমাদের আড্ডা বসে। আজ দশ মিনিটের রাস্তা সাড়ে সাত মিনিটে চলে এলাম। গিয়ে দেখে সাবাই প্রায় উপস্থিত। সাইকেলটা পাশের দেওয়ালে হ্যালান দিয়ে অর্ঘ্যদের দিকে এগিয়ে গেলাম। দেখি অর্ঘ্য আর টুটু-র মধ্যে জোর তর্ক চলছে গতকালের ক্রিকেট খেলা নিয়ে। আমি সবে গিয়ে বসেছি, এমন সময় হন্তদন্ত করে মান্তু এসে ধপ করে টুটুর পাশে বসে পরল।
"কি রে, মুখটা ব্যাজার কেন?" অর্ঘ্য জিজ্ঞেস করল।
"ধুর, এভাবে থাকা যায়?" প্রশ্নটা প্রায় অগ্রাহ্য করে মান্তু বলল।
"কেন রে? বস আবার বাটাম দিলো নাকি?"
"ভাব একবার, আমায় নাকি সেমিনার দিতে হবে......তাও আবার শিশু শ্রমিক নিয়ে......কোথায় পাবো বল তো ।"
"কেন, এই যে। অর্ঘ্য শিশু আর ওকে খাটালে শিশু শ্রমিক।" এবার টুটু বলল।
" হ্যাঁ রে, বাপকে গিয়ে বল না।" একটু রাগ দেখিয়ে বলল অর্ঘ্য।
" ও শিশু! ঠিক সময় বিয়ে হলে চার শিশুর বাপ হয়ে যেতো রে..."বলেই হো হো করে হেসে উঠল মান্তু। আমরাও যোগ দিলাম ওর হাসিতে।
হাসির রেশ একটু কমলে দিগু-দা বেশ সিরিয়াস গলায় বলে উঠল, "তোরা খিল্লি করছিস, একবার ভাব তো যে সব ছোটো ছোটো বাচ্চারা একটু খাবার জন্য সারাদিন খাটে তাদের কি অবস্থা। আমরা তো আলোচনা করব, হেন করেগা, তেন করেগা বলব তারপর এ.সি ঘরে গিয়ে ঘুম লাগাব। আর..."
দিগুদার কথা শেষ করতে না দিয়ে টুটু বলল, "দেখো দিগুদা, আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা এতো খারাপ যে এখানে তোমার আমার কিছু করার নেই।"
"বললেই হল। দেখ আমরা সবাই যদি একে একে এই সব বে-আইনি ব্যাপারগুলর বিরুদ্ধে রুখে দাড়াই তা হলেই এগুলোকে গোড়া থেকে নিরমুল করা যেতে পারে।" দেশের কথা উঠতে একটু আবেগপ্রবন হয়ে বললাম।
অর্ঘ্য মিচকি হেসে বলল, "সবই তো বুঝলাম, কিন্তু প্রথমে এটা দেখতে হবে যে বেড়ালের গলায় ঘণ্টাটা বাধবে কে?" তারপর দিগুদার দিকে তাকিয়ে বলল, "তুই?"
"এতো চাটাচাটি হয়ে গেলো ভাই। আসল কথা হল, এই যে অর্থনৈতিক অবস্থা সেটা দূর না করা গেলে কিছুই হবে না। যারা শিশুদের দিয়ে কাজ করায় আগে তাদের বলা উচিত।" দিগুদা প্রতিবাদ করল।
"কি বলবে? তোমরা শিশুদের দিয়ে কাজ না করিয়ে নিজে করো। তা ছাড়া, ওরা তো তাদের পয়সা দিচ্ছে। ফ্রি তে তো খাটাচ্ছে না।" এবার বক্তা টুটু।
মান্তু হাত তুলে টুটু থামিয়ে বলল, "আরে? পয়সা দিলেই হল। ওদের শিক্ষা হচ্ছে কৈ? শিক্ষা ছাড়া ওদের তো সারা জীবন ঐ করতে হবে?"
অর্ঘ্য আবার ফুট কাটল, "এবার মালিকরা বলবে, শিশুদের না খাটিয়ে মান্তু কে খাটাবো।"
"এবার চড় থাপ্পার মেরে দেবো কিন্তু। একটা সিরিয়াস আলোচনা হচ্ছে আর একে দেখ?"
এর মধ্যে এক রাউন্ড চা এসে গেছে। আলচনায় একটু বিরতি দিয়ে সবাই চা পানে ব্যস্ত হয়ে গেল। একটা গোটা সিগারেট শেষ করে, ফিল্টার-টা এক টোকায় ছুড়ে ফেলে দিগুদা বেশ হতাশ গলায় বলল, "ধুর, দেশ রসাতলে যাচ্ছে......"
"আর দিগুদা জ্ঞান বিলোচ্ছে।" আবার অর্ঘ্য। আমাদের যে কোন আড্ডায় অর্ঘ্য হল যাকে বলে কমিক রিলিফ। "এই অনেক বকেছিস। একটা সিগারেট ছাড় তো।" শেষ কথাটা মান্তুর উদ্দেশ্যে ছিল।
মান্তুর থেকে সিগারেট নিয়ে অর্ঘ্য সবে আগুনটা ধরিয়েছে, এমন সময় মিলনের প্রবেশ। বেশ গম্ভীর গলায় বলল, "কি, গভীর সমস্যা মনে হচ্ছে?"
অর্ঘ্য চাপা গলায় বলল, "হয়ে গেল।"
এই 'হয়ে গেল' মন্তব্যটির কারন হল মিলন একটু জ্ঞ্যানপাপী টাইপের। যে কোন বিষয় কথা হোক, ও সব জানে।
"ঐ শিশু শ্রমিক নিয়ে একটু কথা হচ্ছে আর কি?" আমি বললাম।
"এটা তো বেশ স্পর্শকাতর ব্যাপার। ভেরি প্যাথেটিক কেস।"
"ধুর, বড্ড গরম, তার মধ্যে তুমি আর ইংরেজি ঝেড়ো না তো..." নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন বক্তা কে? ঠিকই ধরেছেন অর্ঘ্য।
"যাচ্চলে, আমার উপর খার খাচ্ছিস কেন?"
দুজনের মধ্যে বচসা শুরু হবার আগেই, দিগুদা ধমকানি দিলো, “তোরা থামবি?”
দিগুদার ধমকানিতে কাজ হল। ওরা চুপ করতে, মান্তু আবার বলতে লাগলো, “হ্যাঁ, যেটা বলছিলাম। তুমি যেটা বলছ সেটা তো করা সম্ভব না। আমাদের জনসংখ্যা ১২০ কটি। তার ৬০% BPL। তুমি কি করবে?”
মান্তু র কথার রেষ টেনেই দিগুদা বলে চলল, “এই অশিক্ষার ফলেই তো বড় হয়ে ওরা মানুষ হচ্ছে না । পরে এরাই চুরি ডাকাতি করবে। তখন কি কেউ ভাববে ওরা কেন এমন হল?”
আমি বললাম, “তুই কি করতে চাস? ঝাণ্ডা নিয়ে মিছিল বের করবি?”
“সেটা তো সমাধান না। সবাইকে জানাতে হবে যে শিশুদের খাটালে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারে।”
ফাজলামি ছেড়ে অর্ঘ্য বলল, “তুই বলছিস পুলিশের ভয়ে এটা কমানো যাবে? তাই হলে তো এতদিনে কমতো। কৈ, কমলো না তো?”
“মানুষের মধ্যে এই সচেতনতাটা আনতে হবে। তো হলেই কাজ হবে।”, বেশ বিজ্ঞের মত বলল মিলান।
“কিচ্ছু হবে না। যতদিন জনসংখ্যা না কমবে, ততদিন শিশুশ্রমও কমবে না।”
“হ্যাঁ, জনসংখ্যা আর কমেছে......সব শালা অশিক্ষিতের দল.........সারাদিন ভ্যান,রিকশা টানবে......আর রাতে গণ্ডা গণ্ডা বাচ্চা বার করবে...... কিচ্ছু হবে না...... শুধু আলোচনায় হবে...... তুমি পারবে ওদের বোঝাতে?” কথাটা দিগুদার উদ্দেশ্যে বলল টুটু।
মান্তু দিগুদাকে ডীফেণ্ড করল, “সেটা তো সরকারের কাজ।”
আমি বললাম, “তা, তোদের সরকার কোন কাজটা করছে শুনি।”
মান্তু বলল, “সরকার যদি না করে, তাহলে আমাদের করতে হবে। আরও ভালো হয় যদি সবাই এই কাজে এগিয়ে আসে। প্রত্যেকের বোঝা দরকার যে শিশুশ্রম আমাদের সেই আদিম যুগেই ফিরিয়ে নিয়ে যাবে।”
আমি সকালেই পড়েছি, তাই বললাম, “জানিস, গ্রামের দিকে কত বাচ্চারা বিড়ি বাঁধে? তারা তো সব সময় ঐ টোব্যাকো গুঁড়ো ইনহেল করছে। তাদের কি সুস্থ ভাবে বাঁচার কোন অধিকার নেই। শুধু কি তাই, ওদের তো মালিকরা ভীষণ মারে বলেও শুনেছি। আজই তো কাগজে বেরিয়েছে। ধুস, ভাবলেই মেজাজ খিচড়ে যায়।”
দিগু বলল, “হ্যাঁ, আমিও পড়েছি। লিখেছে, চেন্নাই তে ৫ জন কে গ্রেপ্তার করেছি এই ইসু-তে।”
মিলন বলল, “ও তো খুচর কেস। একটাকে ধরে তো পঞ্চাশটাকে ছাড়ে। সবই গট আপ।”
মান্তু আবেগপ্রবণ হয়ে বলল, “সত্যি, ভাবলেও খারাপ লাগে। আমাদের কিছুই কি করার নেই?”
হঠাৎ টুটু সবাইকে বেশ চমকে দিয়েই চেঁচিয়ে বলল, “না, নেই। এই ভাট বকা থামা তো? মালগুলো বকেই চলাছে। আমার তাড়া আছে। আর এক কাপ চা খেয়েই উঠবো। কি সুবুদা চা হবে না কাটবো?”
দোকানের ভীতর থেকে সুবুদার গলা এল, “বস দিচ্ছি। এই দিনু, আর কতক্ষন বাসন মাজবি? তাড়াতাড়ি আয়।”
দিনু বলে একটা সাত আট বছরের ছেলে সুবুদার দোকানে কাজ করে। এতক্ষন সে আমাদের একটু পাশে ড্রেনের ধারে বসে এক কাড়ি বাসন মাজছিল। সুবুদার ধমকানি শুনে, কোন রকমে বাসনগুলো নিয়ে আস্তে গিয়ে হোঁচট খেলো। অমনি কেলেঙ্কারি। বাসন সুদ্ধ পড়ল দিগুদার ঘাড়ে। বাসনের জলে দিগুদার নতুন পাঞ্জাবী ভিজে চপচপে। দিগুদা প্রায় লাফিয়ে উঠে, “শ্যালা ছোটলোকের বাচ্চা...”, বলে তাকে একটা চড় কসিয়ে দিল।
টুটু তাড়াতাড়ি দিগুদাকে আটকাল, “ছাড়ো না।“
দিগুদা ভীষণ রেগে গজগজ করতে লাগলো। বলল, “দেখ নতুন পাঞ্জাবীটার কি অবস্থা করল। শ্যালা...”
অর্ঘ্য হাঁক ছাড়ল, “কি সুবুদা, কি সব কাজে রাখো? কী করল দেখে যাও।”
সুবুদা বেরিয়ে এসে দিনুকে আর একটা চড় লাগিয়ে বলল, “শালা জানোয়ার, মেরে চামড়া গুটিয়ে দেবো । যা মাপ চা।”
মান্তু হাত তুলে বলল, “থাক থাক, আর মাপ চেয়ে কাজ নেই। তুমি চা-টা দাও। বাড়ি যাই।”
দিগুদা গজগজ করতে করতে একটা সিগারেট ধরায়, “চললাম রে”বলে হাঁটা লাগালো। আমরাও একে একে ঊঠে পড়লাম। রবিবারের আড্ডাটাই মাটি।
মন্তব্য যোগ করুন
এই লেখার উপর আপনার মন্তব্য জানাতে নিচের ফরমটি ব্যবহার করুন।
মন্তব্যসমূহ
-
সুব্রত সামন্ত (বুবাই) ১২/১১/২০১৫bhalo
-
দেবব্রত সান্যাল ০১/১০/২০১৫খুব ভালো। বলার কায়দাটা ও ভালো। Ideal for a short film . dialogue একটু ছাঁটলেই হবে।
-
অরিত্র পাল ০২/০৯/২০১৫বাঃ।
-
সমরেশ সুবোধ পড়্যা ২৯/০৭/২০১৫খুব ভালো লাগলো।
-
স্বপ্নীল মিহান ২১/০৭/২০১৫চালিয়ে যান
-
Asith ২১/০৭/২০১৫সুন্দর কাহিনি।
-
Sanjay Das ১৮/০৭/২০১৫BAH
-
PANDEY ১৮/০৭/২০১৫DARUN.
-
সাইদুর রহমান ১৫/০৭/২০১৫খুব ভালো লাগলো ।
-
জহরলাল মজুমদার ১৫/০৭/২০১৫ভাল লাগল
-
কিশোর কারুণিক ১৫/০৭/২০১৫ভাল